‘আমিও খোঁজখবর রাখছি—যদি কোনও বিজনেসম্যান এখানে টাকাপয়সা ইনভেস্ট করে কিছু একটা ছোটামোটা ইনডাস্ট্রি বানাতে চায়৷ সব জমিতে তো আর চাষবাস হয় না৷ যে-মাইনিং কোম্পানি এ-জমির মালিক তার ডিরেক্টরকে আমি চিনি৷ ধানবাদে ওনার বাড়ি৷ আমার সঙ্গে থোড়াবহত জানপহেচানভি আছে৷ দু-চারবার বাতচিত হয়েছে৷ যদি কেউ এ জমিন কেনার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখায় তো আমি কানেকশন করিয়ে দেব৷’
কথা বলতে-বলতে আমরা পথ হাঁটছিলাম৷ বাতাস ভেজা৷ আকাশে মেঘ মাঝে-মাঝেই চাপা গরর-গরর শব্দ তুলছে৷ পায়ের নীচে ভেজা মাটি৷ আমি কলাগাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দূরে নজর চালিয়ে দিচ্ছিলাম—যদি ‘দাওয়াই টাউন’-এর দু-এক চিলতে নজরে পড়ে৷ কিন্তু শুধুই গাছপালা চোখে পড়ছিল৷
কলাবাগান শেষ হতেই এপাশে-ওপাশে কয়েকটা বড়-বড় পুকুর দেখতে পেলাম৷ তার মাঝখান দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে৷
মহাবীর যাদব জানালেন, এই পুকুরগুলোয় মাছ চাষ হয়৷ আবার সুখার সময়ে এইসব পুকুর থেকেই জল টেনে চাষজমিতে কাজে লাগানো হয়৷
সামনে বাঁ-দিকটায় বেশ কয়েকটা ছোট-বড় গাছপালা চোখে পড়ছিল৷ সেদিকে আঙুল দেখিয়ে মহাবীরজী বললেন, ‘এসে গেছি৷ ওই যে, ওই গাছপালাগুলোর ওপাশেই ‘‘দাওয়াই টাউন’’৷ আপনাকে আমি শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে এলাম…৷’
আর বড়জোর পাঁচ মিনিট কি সাত মিনিট লাগল৷ আমরা ‘দাওয়াই টাউন’-এর সামনে এসে পড়লাম৷
‘জনতা সেবাকেন্দ্র’ যখন গড়ে ওঠে তখন তাকে ঘিরে একটা টাউনশিপ মতন তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল৷ প্ল্যান ছিল, ধীরে-ধীরে ব্যাপারটাকে ঠিকঠাক চেহারায় নিয়ে যাওয়া যাবে৷ তা হলে বেশ কিছু স্টাফ হাসপাতাল এলাকাতেই থাকতে পারবে৷ আর তাতে স্টাফদের ডিউটি করতে সুবিধে হবে৷ তা ওই টাউনশিপের ভাবনাটা এলাকার লোকজনের মুখে-মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল৷ আর সে থেকেই হয়তো ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’-এর নাম ‘দাওয়াই টাউন’ হয়ে গিয়েছিল৷
মহাবীর যাদব হাত তুলে ইশারা করে দেখালেন ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে: ‘ওই যে…৷’
মেঘলা আকাশের পটভূমিতে ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে তাকিয়ে চাইনিজ ইঙ্ক আর জল মিশিয়ে হ্যান্ডমেড পেপারে আঁকা ওয়াশের ছবি বলে মনে হল৷ আর বিচিত্র সেই ছবিটা যেন অন্য একটা মায়াবী জগৎ থেকে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে৷
ছ’তলা হাসপাতাল বিল্ডিংটা ভাঙাচোরা রংচটা৷ সারা গায়ে পোড়া কালো-কালো দাগ৷ লম্বা-লম্বা ফাটল অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছাদের দিক থেকে নেমে এসেছে নীচে৷ অথবা তার উলটোটাও হতে পারে৷
ফাটলগুলোর নানান জায়গা থেকে বট-অশ্বত্থ ইত্যাদি গাছ দিব্যি বেড়ে উঠেছে৷ এ ছাড়া ছাদেও বেশ কয়েকটা উলটো-পালটা গাছ গজিয়ে গেছে৷ হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ছাদে কেউ বাগানচর্চা করেছে৷
বাড়িটায় অনেকগুলো জানলা—হাসপাতালে যেমনটা হয়৷ তবে সব জানলাই বন্ধ৷ ব্যতিক্রম হিসেবে বেশ কয়েকটা জানলার পাল্লা ভেঙে ঝুলছে—অথবা খসে পড়ে গেছে৷
বাড়িটার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা টিনের চালার ঘর৷ তাদের চালগুলো সব জং ধরে খসে-খসে গেছে৷ কোথাও বা ইটের দেওয়াল হেলে পড়েছে৷ আর কোনও-কোনও দেওয়াল একেবারে ধসে গেছে—সময়ের চাপ সামলাতে পারেনি৷
‘দাওয়াই টাউন’ এলাকাটা এককালে খাটো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু এখন সেই পাঁচিলের সেরকম কোনও অস্তিত্ব নেই৷ শুধু কোথাও-কোথাও দু-চার লাইন ইট পাঁচিলের স্মৃতিকথা হয়ে আছে৷
‘দাওয়াই টাউন’-এর পেছনে বড়-বড় গাছের জঙ্গল৷ মহাবীরজী বললেন, ‘ও-জঙ্গলে শেয়াল, ভাম, নেকড়ে, বুনো কুকুর কিংবা চিতাবাঘ-টাঘও আছে বলে শুনেছি—কিন্তু আমি কখনও চোখে দেখিনি৷ গাঁয়ের লোক একটু রিসক নিয়েই ওখানে কাঠ-টাট কাটতে যায়…৷’
আমি ছ’তলা বাড়িটাকে দেখছিলাম৷ কেমন যেন একটা থমথমে চুপচাপ ব্যাপার৷ শুধুমাত্র ভূতুড়ে বদনামের জন্যে এতবড় একটা জায়গা বেকার পড়ে-পড়ে নষ্ট হচ্ছে! ফ্যাক্টরি-ট্যাক্টরি না হোক, অন্তত চাষবাস করেও তো জমিটা থেকে দু-চার পয়সা আয় হত!
সে-কথাই মহাবীরজীকে বললাম৷
মহাবীরজী মাথা নাড়লেন৷ পকেট থেকে ছোট ডিব্বা বের করে সুপুরির কুচি মুখে ফেললেন৷ তারপর: ‘পমেশজী, পহেলে পুরা স্টোরি তো সুন লিজিয়ে…৷’
‘পরমেশ্বরজী’ কথাটা উচ্চারণ করতে বেশ হোঁচট খেতে হয়৷ পরিচয়ের শুরু-শুরুতে মহাবীরজী নিজেই এ-কথা আমাকে বলেছেন৷ তাই মধুমিতার ‘পমেশমামা’-র মতো উনি আমাকে ‘পমেশজী’ করে নিয়েছিলেন৷
আমাকে হাত ধরে হালকা টান দিলেন৷ কাছেই একটা ভেঙে পড়া শুকনো গাছের গুঁড়ির খানিকটা অংশ কাত হয়ে পড়েছিল৷ বাকিটা লোকাল লোকজন কেটেকুটে নিয়ে গেছে৷ সেদিকে দেখিয়ে মহাবীর যাদব বললেন, ‘চলুন—ওখানে গিয়ে একটু বসি…৷’
তো আমরা সেখানে গিয়ে বসলাম৷ আমার চোখ বারবারই ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে চলে যাচ্ছিল৷
‘পমেশজী, আমাদের মহল্লায় দু-টাইপের লোক আছে৷ এক, যারা ভূত-জিন এসবে বিসোয়াস করে৷ আর একদল চোরি-ওরিতে বিসোয়াস করে৷ তাই অনেকে ‘‘দাওয়াই টাউন’’-কে ভয় পায়, ওটার কাছে যেতে চায় না৷ আবার কেউ-কেউ চোরি-ছুপে ওই হসপিটাল বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ে, কাঠের টেবিল, চেয়ার, লোহালক্কড়, মেশিনপত্তর যা পারে চুরি করে৷ তারপর সেগুলো বিক্রিবাটা করে পয়সা কামায়…৷