‘হ্যাঁ—দেখেছি৷ লাস্ট এক সাল ধরেই দেখছি৷’ মহাবীরজী সুপুরি চিবোচ্ছিলেন৷ তার সঙ্গে সুগন্ধী কিছু বোধহয় মেশানো ছিল৷ নেশা ধরানো বেশ একটা মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছিল৷ জমিতে থুতু ফেলে তিনি বললেন, ‘ওর নাম মোহন৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ ঢুকে ওর এই হাল হয়েছে…৷’
‘‘‘দাওয়াই টাউন’’ মানে?’
‘‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর কাহানি আপনাকে পরে শোনাব৷ ওখানে জিন আছে৷ ওখানে কারও না যাওয়াটাই ভালো৷ আমি তো সববাইকে মানা করি৷ আপনি রাখিতপুরে নতুন আছেন৷ কথা যখন উঠল তখন আপনাকে ভি বলে দিই: ওই এরিয়ায় আপনি কখনও যাবেন না—৷’
‘কিন্তু, মহাবীরজী, জায়গাটা তো আমি চিনিই না! তা হলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে?’ এ-ধরনের সাবধানবাণী শুনে আমার বেশ অবাকই লাগছিল৷ তা ছাড়া ভূত-প্রেত-এ বিশ্বাস আমার কোনও কালেই ছিল না৷ তবে বরাবরই আমার কৌতূহল একটু বেশি৷
‘চেনেন না, ঠিক আছে৷ কিন্তু যদি কখনও পথ ভুলে বেখেয়ালে চলে যান—তাই বলছি৷ অবশ্য ওখানে ওয়ার্নিং লাগানো আছে…৷’
‘তা ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ ঢুকে মোহনের গাল কাটল কেমন করে?’
‘জানি না৷ কেউই জানে না৷ কারণ, মোহন কাউকে বলেনি৷ জিগ্যেস করলে দুঃখ করে শুধু বলে, ‘‘ছোড়িয়ে ভাইয়া—মেরা নসিব…৷’’’
এর কিছুদিন পর মহাবীর যাদবের কাছ থেকে আমি ‘দাওয়াই টাউন’-এর কাহিনি শুনেছি৷
প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে রাখিতপুরের সীমানায় গরিবদের জন্যে একটা হাসপাতাল তৈরির বন্দোবস্ত করা হয়৷ একটা মাইনিং কোম্পানি নাকি গভর্নমেন্টের সাপোর্ট নিয়ে এটা তৈরি করতে নেমে পড়েছিল৷ তাতে কন্ডিশান ছিল, কোনও গ্রামে হাসপাতাল তৈরি করলে তবেই পাওয়া যাবে সরকারি ভর্তুকির টাকা৷
প্রায় দশ বিঘে জায়গা খুঁটি দিয়ে বাঁশ দিয়ে ঘেরা হল৷ তার মাঝামাঝি জায়গায় ছ’তলা হাসপাতাল বিল্ডিং তৈরি হল৷ আর বিল্ডিং-এর আশেপাশে বেশ কয়েকটা টিনের চালার ঘরও তৈরি করা হয়েছিল৷ স্টাফদের কোয়ার্টার৷
খুব কম পয়সায় চিকিৎসা করা যাবে বলে এলাকায় হ্যান্ডমাইক নিয়ে ভ্যান-রিকশা করে পাবলিসিটি করা হয়েছিল৷ মহাবীর যাদব এসব শুনেছে তার বাবার কাছে৷ সেসময়ে দুসরা গ্রামে একটা ছোটখাটো হাসপাতাল পাওয়া মানে ছিল হাতে স্বর্গ পাওয়া৷ সে-সুবিধে তো হলই, তার সঙ্গে বোনাস পাওয়ার মতো লোকাল ছ’-সাতজন লোকের চাকরিও হয়ে গেল সেখানে৷
হাসপাতালটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’৷ চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে যে খুব ভালো লেভেলের ছিল তা নয়—বরং বলা যায় চলনসই, মামুলি৷ তবু কিছু না থাকার চেয়ে তো ভালো!
লোকাল লোকের কাছে ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’-এর লোকাল নাম হয়ে গেল ‘দাওয়াই টাউন’৷ ব্যস, তারপর থেকে শান্ত গ্রামে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল৷
এমনি করে বছর দুয়েক চলার পরই গোলমালটা হল৷ একটা আজব ঘটনা ঘটে গেল ওই হাসপাতালে৷ তারপর থেকে ওটার গায়ে ‘অভিশপ্ত’, ‘ভূতুড়ে’—এইসব দাগ লেগে গেল৷
প্রথমদিন মহাবীরজী ‘দাওয়াই টাউন’-এর পুরো গল্প আমাকে শোনাননি৷ সুপুরি চিবোতে-চিবোতে কাশির দমক আসায় বারকয়েক কাশলেন৷ তারপর কাশি সামলে হলদে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসলেন: ‘চলুন—একদিন আপনাকে জায়গাটা চিনিয়ে দিই৷ তারপর ওই জিনিয়া টাউনের আশেপাশে বসে মউজ করে বাকি কাহানিটা আপনাকে শোনানো যাবে…৷’
তো তাই হল৷
রবিবার দুপুর বারোটা সাতের পর রাখিতপুরে আর কোনও ট্রেন দাঁড়ায় না৷ তাই আমার বলতে গেলে সোয়া বারোটার পর ছুটি৷ নিজের সাপ্তাহিক কাজকর্ম সেই দিনটাতেই আমি সেরে নিই৷ তো সেইরকম এক রবিবারে দুপুর আড়াইটের সময় মহাবীর যাদব আমার আস্তানায় এসে হাজির৷ আমি তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে তক্তপোশে বডি ফেলে একটু জিরোনোর পদক্ষেপ নিচ্ছি৷
আমার নাম-ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ দেখি মহাবীরজী দাঁড়িয়ে আছেন৷
মাথায় কদমছাঁট কাঁচাপাকা চুল, ভাঙা গাল, মোটা গোঁফ৷ কিন্তু তার মধ্যেও চোখ দুটোয় সরলতা মাখানো৷ এবং মুখে হাসি৷
মহাবীরজীর গায়ে হালকা নীলের ওপরে সাদা ডোরাকাটা একটা ফতুয়া, তার সঙ্গে সামান্য ময়লা হয়ে যাওয়া ধুতি৷ পায়ে চপ্পল৷ হাতে ছাতা৷ সে-ছাতার হ্যান্ডেল বেতের লাঠির তৈরি, মাথাটা বাঁকানো৷
‘চলুন, মাস্টারজী—‘‘দাওয়াই টাউন’’ দেখবেন চলুন…৷’
সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পেলাম৷
দু-দিন ধরে আকাশে মেঘ-মেঘ৷ মাঝে-মাঝে অল্পস্বল্প বৃষ্টি৷ তাই আমিও তৈরি হয়ে ছাতা নিয়ে বেরোলাম৷ আমার ছাতাটা অবশ্য ভাঁজ করা যায়৷
গাঁয়ের ছোট-ছোট ঘরগুলো পেরিয়ে আমরা চাষজমির এলাকায় এসে পড়লাম৷ এখানে-ওখানে কয়েকটা সাদা বক ওড়াউড়ি ঘোরাঘুরি করছে৷ জমি থেকে কীসব খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছে৷ আলের ওপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে দু-দুটো বড়-বড় খেত পেরিয়ে গেলাম৷ তারপরই বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে কলাবাগান৷ তার মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় দুটো শেয়াল চোখে পড়ল৷ আমাদের দেখে ছুটে আড়ালে চলে গেল৷
পথ চলতে-চলতে মহাবীর যাদব রাখিতপুরের নানান কথা বলছিলেন৷ বলছিলেন এখানকার মানুষেরা বেশিরভাগই খুব ভালো৷ তবে সবাই খুব অভাবী৷ অভাবের চোটে কেউ-কেউ অসৎ পথেও নেমে গেছে৷ রাতের আঁধারে এ-খেত ও-খেত থেকে চাষের ফসল চুরি করে৷ কখনও বা এর মুরগি ওর ছাগল লোপাট করে মাংস-টাংস খায়৷ সেইজন্যে এখানে দু-চারটে কলকারখানা হলে ভালো হয়৷ এলাকার জোয়ানগুলো সেখানে নোকরি-ওকরি পেতে পারে৷