পমেশমামার গিফটের বইগুলো আর্যরা হাতে-হাতে নিয়ে দেখছিল৷ আর নিজেদের মধ্যে ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে কথাবার্তা বলছিল৷
তখনই পরমেশ্বর এক টিপ জোয়ান মুখে দিয়ে চোখ বুজে চিবোতে-চিবোতে বললেন, ‘শোন মিতা, পৃথিবীর সব জায়গাতেই…৷’
আর্যরূপ বলল, ‘আঙ্কল, একটা কথা বলছি—কিছু মাইন্ড করবেন না৷ ভূত ব্যাপারটাকে কিছুতেই লজিক দিয়ে দাঁড় করানো যায় না—কেউ তো এখনও পারেনি৷ তা হলে আপনিই বলুন, ভূতুড়ে, মানে, হন্টেড ব্যাপারটা লজিকের ওপরে দাঁড়াবে কেমন করে?’
আর্যরূপ বড় হয়ে সায়েন্টিস্ট হতে চায়৷ তাই সবসময় ‘লজিক-লজিক’ করে৷ সেজন্য মধুমিতার মাঝে-মাঝে বিরক্ত লাগে৷
পমেশমামা হেসে বললেন, ‘দ্যাখো আর্য, আমিও সবসময় লজিক আঁকড়ে চলতে ভালোবাসি৷ কিন্তু যখন সব লজিকই হাত তুলে দেয় তখন কী করব বলো তো! তখন তো শূন্যে ভাসতে থাকি৷ সে বড় গোলমেলে ব্যাপার…৷’
অভিলাষ হাঁ করে পমেশমামার কথাবার্তা শুনছিল৷ ওর ফরসা মুখে কেমন একটা কবি-কবি ভাব৷ ওর টানা-টানা চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ও যেন একটা ঘোরের জগতে আছে৷
ও জিগ্যেস করল, ‘এরকম সিচুয়েশানে কখনও পড়েছেন নাকি, আঙ্কল?’
পরমেশ্বর ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন৷ মনে হল যেন দোটানায় পড়ে ভাবছেন৷ তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির ঝালরের দিকে আনমনাভাবে চেয়ে রইলেন৷
অনেকক্ষণ পর বললেন, ‘হন্টেড ব্যাপারটা আমি লাইফে দু-চারবার দেখেছি৷ তবে তার মধ্যে একটা সিচুয়েশান সবচেয়ে সিরিয়াস ছিল৷ ব্যাপারটা আমার গায়ে দুটো পারমানেন্ট চিহ্ন রেখে গেছে…৷’
মামার মুখে এরকম কথা মিতা আগে কখনও শোনেনি৷ তাই ও অবাক হয়ে পমেশমামার দিকে তাকাল৷
‘না, এ ব্যাপারটা তোকেও কখনও বলিনি৷ ইন ফ্যাক্ট, কাউকেই বলিনি—৷’ হাফ শার্টের বাঁ হাতাটা ওপর দিকে তুলে ধরলেন পরমেশ্বর৷ চোখে পড়ল ইঞ্চি-তিনেক লম্বা একটা বীভৎস ক্ষতের দাগ৷ দাগটা বেশ চওড়া আর ক্ষতটা সেরে গেলেও সেখানে মাংস এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে৷
‘এটা হল একটা চিহ্ন—’ জামার হাতাটা টেনে নামিয়ে ঠিকঠাক করে পরমেশ্বর বললেন, ‘আর-একটা পারমানেন্ট চিহ্ন আছে আমার পিঠে৷ পিঠের ডানদিকে অনেকটা জায়গা পুড়ে গিয়েছিল৷ আমাকে নার্সিংহোমে বারোদিন থাকতে হয়েছিল৷ চোটটা খুব সিরিয়াস ছিল…৷’
মধুমিতা আবদারের গলায় বলল, ‘পমেশমামা, প্লিজ, এই স্টোরিটা আজ আমাদের চারজনকে শুনিয়ে দাও—৷’
‘স্টোরি নয় রে—’ একটু হেসে পরমেশ্বর বললেন, ‘একেবারে সত্যি ঘটনা৷ রিয়েল হন্টিং-এর কেস৷’ জানলা দিয়ে আবার তাকালেন বাইরে৷ কিন্তু কিছু দেখেও যেন দেখছিলেন না৷ বোধহয় ধীরে-ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন সেই ঘটনার সময়ে৷
মিতারা চারজন চুপ করে চেয়ে রইল পরমেশ্বরের মুখের দিকে৷
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়৷ বছর কুড়ি হবে৷ তখন আমার মাথায় টাক ছিল না৷ আমি সেসময়ে বিহারের রাখিতপুরে পোস্টেড৷ এখন অবশ্য জায়গাটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে৷ ধানবাদ জংশন থেকে বালিয়াপুর হীরক রোড ধরে গাড়িতে গেলে রাখিতপুর মিনিট পঁয়ত্রিশের রাস্তা৷
ছোট্ট স্টেশন৷ একটাই প্ল্যাটফর্ম৷ সারাদিনে চারটে কি পাঁচটা গাড়ি দাঁড়ায়৷ সুতরাং, বুঝতেই পারছ—কাজ-টাজ বেশ কমই ছিল৷ সেসময়ে রাখিতপুরে স্টেশন- মাস্টারের কোনও কোয়ার্টার ছিল না৷ কাছাকাছি একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল—দুসরা৷ সেখানে যাদবদের বস্তিতে আমি একটা ঘরভাড়া পেয়ে গিয়েছিলাম৷ সেখানেই থাকতাম৷ নানান জনের খেতের শাকসব্জি সস্তায় পেতাম, পাতকুয়োর জল তুলে সেসব দু-বেলা রান্না করতাম৷ তার সঙ্গে রুটি আর অড়হড় ডাল বানিয়ে দিব্যি খেতাম৷ আর ফাঁকা সময় পেলে আমার বাড়িওয়ালা মহাবীর যাদবের সঙ্গে গল্প করতাম৷
এ ছাড়া মাঝে-মাঝে উত্তরদিকের মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে রাখিতপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে চলে যেতাম৷ সেদিকে একটা জঙ্গলও ছিল৷ রাখিতপুরের মানুষজন সেখানে কাঠের সন্ধানে যেত৷ আর জঙ্গলের নেশা আমাকে যে টানত তার কারণ ছিল ফুল আর পাখি৷ যেসব ফুল আর পাখি সেখানে দেখতাম তাদের একটারও আমি নাম জানতাম না৷ কিন্তু ওদের রংচং আর মিষ্টি ডাক আমার মনে নেশা ধরিয়ে দিত৷
আমার গল্পটা সেই ‘দাওয়াই টাউন’-কে নিয়ে৷
‘দাওয়াই টাউন’-এর কথা আমি প্রথম শুনি মহাবীর যাদবের কাছে৷ একদিন রাতে বস্তিতে গানবাজনার মেহফিল বসেছিল৷ সপ্তাহে একটা দিন—শনিবার বা রোববার—হ্যাজাক লণ্ঠনের আলো জ্বেলে এরকম গানবাজনার আসর বসে৷ সেইসঙ্গে চাঁদা তুলে চাপাটি, ভুজিয়া, লিট্টি অথবা খিচুড়ি আর আলুভাজার ব্যবস্থা করা হয়৷ গানের সঙ্গে-সঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলে৷
সেইরকম এক গানবাজনার আসরে একদিন একটা অল্পবয়েসি ছেলেকে গান গাইতে দেখলাম৷ ছেলেটার গানের গলা বেশ ভালো৷ কিন্তু আমার চোখ টানল ওর গালের একটা লম্বা কাটা দাগ৷ দাগটা বাঁ-গালে রগের কাছ থেকে শুরু হয়ে গাল বেয়ে একেবারে গলা পর্যন্ত নেমে গেছে৷ দাগটা এমন যে, দেখলে যে-কেউ শিউরে উঠবে৷
আমারও একই অবস্থা হয়েছিল৷ হ্যাজাকের আলোয় দাগটা প্রথম চোখে পড়তে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম৷ মনে হচ্ছিল, ছেলেটার গালে কেউ নিষ্ঠুরভাবে তরোয়াল চালিয়ে দিয়েছে৷
আমি মহাবীরজীকে চাপা গলায় বলেছিলাম, ‘ওই ছেলেটা কে? ওর গালের ওই কাটা দাগটা দেখেছেন!’