সোমপ্রকাশদের গ্রামে সবার জীবনই খুব শান্ত ছন্দে চলে৷ সে-চলায় কখনও কোনও ঢেউ ওঠে না৷ সেই কারণেই বোধহয় জীবনগুলো একটু একঘেয়ে ম্যাড়মেড়ে হয়ে গিয়েছিল৷ তাই ওই সন্ধেবেলার উত্তেজনার ঢেউটা চুম্বকের মতো টানে সব্বাইকে টেনে নামিয়েছে শীতের রাস্তায়৷ বোধহয় শীতের রাতে সবাই একটু উত্তেজনার ওম পেতে চাইছিল৷
সন্দেহজনক গাছটা লক্ষ্য করে কেউ একজন একটা আধলা ইট ছুড়ে মারল৷ অনেকে বোধহয় এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল৷ কারণ, প্রথম ইটটা বাতাস কেটে রওনা হতেই তার পিছু-পিছু পরপর কয়েকটা ইট গাছ লক্ষ্য করে উড়ে গেল৷ দু-চারটে ইট গাছে লাগল, বাকিগুলো এদিক-সেদিক দিয়ে উড়ে গিয়ে অন্ধকার পুকুরের জলে পৌঁছে তাদের উড়ান শেষ করল৷
চোরটার গায়ে যে একটা ইটও লাগেনি সেটা সবাই বুঝতে পারল৷ সেইজন্যই হয়তো বেশ কয়েকজন জমির কিনারায় গিয়ে এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলে নতুন ইটের টুকরোর সন্ধান করতে লাগল৷
সোমপ্রকাশ শুনছিলেন, চোর ছেলেটার হাতে কী-কী অস্ত্র থাকতে পারে সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে৷ অনেক তর্কবিতর্কের পর সকলে সিদ্ধান্তে এলেন যে, ছেলেটার কাছে ছুরি অথবা পিস্তল থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ, এই অস্ত্র দুটো হাফপ্যান্টের পকেটেও লুকিয়ে রাখা যায়৷
এই জটলার মধ্যে অনেকেই বারবার মিত্যুনকাকুকে জিগ্যেস করছিলেন, ‘কী চুরি হয়েছে? কী চুরি হয়েছে?’
মিত্যুনকাকু দু-চারবার ঢোঁক গিলে বললেন, ‘টাকা…টাকা৷ একটা প্যাকেটে প্রায় শ’ দেড়েক টাকা ছিল…৷’
সত্যিই তো, চুরিটা তা হলে নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! অতগুলো টাকা বলে কথা!
জটলার মধ্যে বেশ কয়েকজন হা-ডু-ডু খেলার মতন সতর্ক ভঙ্গিতে গাছটার দিকে এগোচ্ছিল৷ তাদের সকলের হাতেই টর্চ, আর ছোট কিংবা বড় হাতিয়ার৷
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ভিড় থেকে আরও দু-একটা বড়সড় ঢেলা ছুটে গেল গাছ লক্ষ্য করে৷ চোর ছেলেটাকে ভয় দেখানোর জন্য ‘চোর! চোর!’ ‘ধর ব্যাটাকে!’ ‘মার ব্যাটাকে!’ ইত্যাদি নানানরকম চিৎকার শোনা যেতে লাগল৷ কেউ-কেউ বলতে লাগল, ‘বদমাশটাকে একবার হাতে পেলে হয়! পিটিয়ে ছালচামড়া গুটিয়ে নেব৷’
সাহসী যে-কয়েকজন গাছের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ তাদের সুবিধের জন্য গাছের ডালপালায়, তাদের বেয়ে ওঠার পথে, টর্চের আলো ফেলতে লাগল কয়েকজন৷ একইসঙ্গে হইচই চেঁচামেচিও চলতে লাগল৷
তারই মধ্যে আচমকা ‘ঝপাং’৷
এই শীতের রাতে চোরবাবাজি পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে৷
একজন বলল, ‘কী সাংঘাতিক! এই ঠান্ডায় পুকুরের জলে কেউ ঝাঁপ দেয়!’
উত্তর পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই: ‘হ্যাঁ—দেয়৷ চোররা দেয়৷ ওদের চামড়া বেজায় মোটা৷ ঠান্ডায় ওদের কিস্যু হয় না৷’
চোর ছেলেটি পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ায় জনগণ বেশ অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেল৷ হইহই করে পুকুরপাড় বরাবর ছড়িয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢিল মারতে লাগল৷ টর্চের অনেকগুলো আলো চোর ছেলেটাকে তাক করে চলে বেড়াচ্ছে৷ আর চোর ঠান্ডা জলের পুকুরে পাগলের মতো, কিংবা জলে পড়া ইঁদুরের মতো এলোমেলো সাঁতার কাটছে৷ তারই মধ্যে দেখা গেল ছেলেটা ওর বাঁ-হাতটা জলের ওপরে সামান্য উঁচু করে আছে৷ আর সেই হাতে একটা সাদাটে প্যাকেট না কী যেন!
পুকুরের জলে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ছিল৷ তার বেশ কয়েকটা মনে হয় ছেলেটার গায়ে-মাথায় লাগল৷ কিন্তু কোনও যন্ত্রণার চিৎকার শোনা গেল না পুকুরের জল থেকে৷ হয়তো সে-চিৎকার এতই চাপা যে, কারও কানে পৌঁছোনোর মতন নয়৷
অন্ধকারে মাছের মতো সাঁতার কাটছিল ছেলেটা৷ জল কেটে-কেটে ও পশ্চিম পাড়ে উঠে পড়ল৷ ভিজে জামা গায়ে লেপটে আছে৷ হাফপ্যান্ট থেকে টপটপ করে জল পড়ছে৷ ও হয়তো ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছিল, কিন্তু টর্চের আলো-ছায়ায় সেটা ভালো করে বোঝা গেল না৷
পাড় বেয়ে আগাছার ঝোপঝাড় ঠেলে সরিয়ে ও আবার ছুটতে শুরু করল৷ চিৎকার করতে-করতে জনগণ তাড়া করল ওকে৷
ছেলেটা যেদিকে দৌড়চ্ছে সেদিকে কয়েক বিঘে জুড়ে সনাতন নাহাদের বাঁশবাগান৷ বাঁকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই বাগানে৷ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাথা তুলে আছে কালো-কালো বাঁশঝাড়৷
পুকুর ছাড়িয়ে এদিকটায় আসামাত্রই তাপমাত্রা যেন আরও দু-এক ডিগ্রি নেমে গেল৷ সোমপ্রকাশ এবার শীতটা ভালোরকম টের পেলেন৷
কয়েকটা বাঁশঝাড়কে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে রোগাসোগা ছেলেটা আচমকা একটা বাঁশঝাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গেল৷ ব্যাপারটা খুব দ্রুত ঘটলেও ওর পিছু ধাওয়া করা দঙ্গলের দু-তিনজন সেটা খেয়াল করল৷
‘এইখানে! এইখানে! এই বাঁশঝাড়টার ভেতরে লুকিয়েছে! এই যে—এটার ভেতরে…৷’ কয়েকজন উঁচু গলায় শোরগোল শুরু করল৷
সেই বিশেষ বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে লোকজন ভিড় জমাল৷ সবক’টা টর্চের আলো বাঁশঝাড়ের ওপরে গিয়ে পড়ল৷
এতক্ষণ ধরে ব্যবহারের ফলে টর্চের আলোগুলো বেশ হলদেটে আর মলিন হয়ে গেছে৷ কিন্তু সেই স্তিমিত আলোতেও ছবিটা দেখা গেল৷
বাঁশঝাড় থেকে লম্বা-লম্বা বাঁশ ফোয়ারার মতো মাথা তুলেছে৷ দুটো বাঁশ তো এতটাই লম্বা যে, আকাশে অধিবৃত্ত এঁকে ঝুঁকে পড়েছে অন্ধকার মাঠের দিকে৷
শীতের সময়৷ বাঁশগাছের সব পাতাই প্রায় খসে পড়েছে৷ বাঁশগাছগুলো কঙ্কালের হাতের আঙুলের মতন দেখাচ্ছে৷ ওপরদিকে আঙুলগুলো ফাঁক-ফাঁক দেখালেও নীচের দিকে এসে জট পাকিয়ে গেছে৷ এ ছাড়া বাঁশঝাড়ের গোড়ায় জমে আছে, ছড়িয়ে আছে, অসংখ্য শুকনো বাঁশপাতা৷