বিজয়েশ আমতা-আমতা করে বলল, ‘দারুণ বলেছেন, ম্যাডাম৷’
‘হ্যাঁ—সত্যি এটা দারুণ বলেছ, রূপশ্রী৷’ সোমরঞ্জন হেসে তারিফ করলেন৷
রূপরেখা ওর সাইডব্যাগটা পাশেই সিটের ওপরে রেখেছিল৷ এখন ব্যাগ হাতড়ে ওর মোবাইল ফোনটা বের করে নিল৷ বোতাম টেপাটিপি করতে-করতে বিজয়েশকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনার একটা ট্রিট পাওনা রইল৷ বিকজ এরকম একটা দিনে আপনি আমাদের মাঝে এসে পড়েছেন৷’ কথা বলতে-বলতে ও মোবাইল ফোনের আলোয় বিজয়েশের আঙুল দেখতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু কপাল খারাপ৷ বিজয়েশের ডান হাতটা মুঠো করে সিটের ওপরে রাখা৷ আর বাঁ-হাতটা ওর শরীরের ওপাশে—দেখা যাচ্ছে না৷
রূপরেখার কথার খেই ধরে রূপশ্রী বলে উঠলেন, ‘খুব ভালো বলেছ, রুপি৷ আমাদের দুজনেরই উচিত ছিল আগেই বিজয়েশবাবুকে নেমন্তন্ন করা৷’ কথাটা বলে সোমরঞ্জনের দিকে তাকালেন রূপশ্রী: ‘কী, ঠিক বলিনি?’
‘অফ কোর্স ঠিক বলেছ৷ ও. কে., বিজয়েশ৷ আমি আর ‘‘বাবু-টাবু’’ বলছি না৷ স্ট্রেট ‘‘তুমি’’ করে বলছি৷ আমাদের বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন রইল৷ এনি ডে অফ ইয়োর চয়েস৷ জাস্ট দু-দিন আগে একটা ফোন করে জানিয়ে দেবে যে, তুমি আসছ৷ রুপি তোমাকে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছে…৷’
‘আপনার মোবাইল নাম্বারটা বলুন, আমি একবার রিং বাজিয়ে দিচ্ছি—৷’
বিজয়েশ ওর মোবাইল নম্বর বলল, একটু পরেই জলতরঙ্গের মিষ্টি সুর বেজে উঠল৷ দু’বার বেজে থেমে গেল৷
‘আপনি যেদিন আসবেন, বলবেন—আমাদের বাড়ির ডায়রেকশনের ডিটেইলস আপনাকে দিয়ে দেব৷’ রূপরেখা বলল৷
বিজয়েশ ‘ঠিক আছে’ বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিল৷ রূপরেখার নম্বরটা সেভ করল৷ কিন্তু তখনও ওর আঙুলের ডগা দেখা গেল না৷
হঠাৎই সোমরঞ্জন গাড়ির স্পিড কমালেন৷ গতিজাড্যের জন্য রূপরেখা আর বিজয়েশ দুজনেই ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে৷ দূরে, হেডলাইটের এলাকার শেষ প্রান্তে, একটা প্রাণী রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ বেশ লম্বা চেহারা৷ এতটাই লম্বা যে সামনের দিকে ঝুঁকে বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে রয়েছে৷ সারা গায়ে লোম৷ হাত দুটো সামনে ঝুলছে৷ হাতের প্রান্তে লম্বা-লম্বা আঙুল৷ আঙুলের ডগায় নখ হয়তো আছে, কিন্তু মলিন আলো আর বৃষ্টির ঝালর নজর ঝাপসা করে দিয়েছে৷
‘ওয়্যারউলফ!’ চাপা গলায় বলল রূপরেখা৷
‘হ্যাঁ—৷’ শান্তভাবে বললেন রূপশ্রী, ‘এটা ওদের এলাকা…৷’
সোমরঞ্জন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন৷
অদ্ভুত প্রাণীটা নেকড়ের মতো ক্ষিপ্র দু-তিন লাফে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল৷
‘নিন, স্যার, এবার গাড়িতে স্টার্ট দিন…৷ ওটা চলে গেছে…৷’ বিজয়েশ চাপা গলায় বলল৷
সোমরঞ্জন শান্ত গলায় বললেন, ‘না, বিজয়েশ—গাড়িটা এখন বেশ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ এইমাত্র রূপরেখা এইটিন প্লাস হল৷ আমরা চারজনে এই মোমেন্টটাকে সেলিব্রেট করব…৷’
বিজয়েশ অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে!’
‘বলছি—বুঝিয়ে বলছি…৷’ সোমরঞ্জন অনেকটা ঘুরে বসলেন নিজের সিটে৷ যাতে বিজয়েশের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধে হয়৷ এপাশ-ওপাশ তাকালেন৷ কাচের বাইরে বৃষ্টি আর জঙ্গলকে দেখলেন৷ তারপর: ‘বিজয়েশ, তোমাকে আগে মাছরাঙার ব্যাপারটা বলি৷ হয়তো তুমি জানো…তবুও…৷’
রূপরেখা বেশ উশখুশ করছিল৷ মাথা ঝাঁকাচ্ছিল বারবার৷
রূপশ্রী জানতে চাইলেন, ‘কী হল, রুপি?’
‘শরীরের ভেতরটা কেমন করছে, মম৷ ফিলিং আনইজি…৷’
‘মাছরাঙা পাখি পুকুর, ঝিল কিংবা নদীর কাছে গাছের ডালে ধৈর্য ধরে চুপটি করে বসে থাকে৷ জলের সারফেসে মাছ নড়তে দেখলেই সাঁ করে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে সেটাকে তুলে নেয়৷ ওদের ঠোঁটে করাতের মতো দাঁত কাটা থাকে৷ তাই ওদের কাছ থেকে শিকার কখনও ছিটকে পালাতে পারে না৷
‘অথচ এই মাছরাঙাকে যদি কখনও জ্যান্ত তিড়িংবিড়িং মাছ সামনে ধরে দাও সে সেটা ছুঁয়েও দেখবে না৷ ওর অভ্যেস ছোঁ মেরে নদী অথবা পুকুরের জল থেকে মাছ শিকার করা৷’ একটু চুপ করে থেকে তারপর: ‘ওয়্যারউলফদেরও ঠিক তাই৷ ওরা শিকারি…মাছরাঙার মতো…৷’
‘ড্যাড!’ অদ্ভুত কর্কশ গলায় ডেকে উঠল রূপরেখা৷ ওর মুখের চামড়ায় টান ধরছিল৷ হাতের আঙুলগুলো কী একটা অদ্ভুত ম্যাজিকে লম্বা হয়ে যাচ্ছিল৷ নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল ও৷
‘বয়েস আঠেরো প্লাস হওয়ামাত্রই আমাদের ওয়্যারউলফদের একটা রূপান্তর ঘটে যায়৷ সেটার ওপরে কারও কন্ট্রোল থাকে না৷’ সোমরঞ্জন তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘সবই জিনের ম্যাজিক৷ যে-ম্যাজিকের মিস্ট্রি আজও কেউ এক্সপ্লেইন করতে পারেনি…৷’
রূপরেখার গলা দিয়ে একটা হিংস্র গর্জন বেরিয়ে এল৷ ওর চোখ এখন নেকড়ের মতো হলদে-সবুজ, ধকধক করে জ্বলছে৷ গায়ের চামড়ায় গজিয়ে উঠেছে গোছা-গোছা কালো লোম৷
ও ভাঙা-ভাঙা কর্কশ গলায় বলে উঠল, ‘ড্যাড, মম! হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং টু মি? কী হচ্ছে এসব?’
‘ভয় পেয়ো না, রুপিসোনা৷ আমরা সাইকললেস ওয়্যারউলফ৷ আমাদের প্রথম ট্রান্সফরমেশান হয় এইটিন প্লাস বয়েস হওয়ামাত্রই৷ এর ওপরে কারও কোনও কন্ট্রোল থাকে না৷ তারপরই তোমার কাজ হল শিকার ধরা—মাছরাঙার মতো৷ সো, বিজয়েশ, এক্ষুনি তুমি দরজা খুলে পালাও—প্রাণপণে ছুটে পালাও৷ যাতে রুপি তোমাকে তাড়া করে শিকার করতে পারে…৷ রান! রান! রান!’ চিৎকার করে বললেন সোমরঞ্জন৷