বিজয়েশের গা থেকে একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল৷ অন্তত রূপরেখার নাক সেইরকমই জানান দিচ্ছিল৷ গন্ধটা ঘামের নয়—একটু অন্যরকম৷
সোমরঞ্জন বিজয়েশকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘এদিকে কোথায় এসেছিলেন?’
‘আমার এক বন্ধুর সঙ্গে জাস্ট এমনি অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছিলাম৷ ওর খেয়াল চেপেছিল বলে এই নটোরিয়াস রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছিলাম৷ তারপর…৷’ কথা বলতে-বলতে হঠাৎই থেমে গেল বিজয়েশ৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷
‘না, না—আপনি টেনশান করবেন না৷ রিল্যাক্স করুন৷ অ্যাবাকাস স্কোয়্যার মানে এই জঙ্গল শেষ হওয়ার পর…ও আসতে অনেক দেরি আছে৷’ সোমরঞ্জন ওকে ভরসা দিলেন৷
বিজয়েশ গাড়িতে ওঠার আগে ওর গাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল রূপরেখা৷ সেটা নিয়ে ও কোনও কথাই বলেনি৷ ভয়ে৷ সেই দৃশ্যটার কথা মনে করেই ও বিজয়েশকে ভয় পাচ্ছিল৷ ওকে বিশ্বাস করতে পারছিল না৷
এখন ড্যাডের প্রশ্নের উত্তরে ও যা বলল সেটাও তো অসম্পূর্ণ অস্পষ্ট!
রূপরেখা বিজয়েশের গাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিল একটা ফরসা হাত৷ হাতটা স্টিয়ারিং-এর ওপরে এলিয়ে আছে৷ সে-হাতে লেগে আছে রক্তের ছোপ৷
রূপরেখার মনে হয়েছে, বিজয়েশের বন্ধু সামনের সিটে এমনভাবে পড়ে আছে যে, তাকে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু ডানহাতটা স্টিয়ারিং-এর ওপরে এলিয়ে থাকায় রূপরেখার চোখে পড়েছে৷ তার মানে…তার মানে…৷
‘তারপর কী হল?’ রূপশ্রী বিজয়েশকে কথার খেই ধরিয়ে দিলেন৷
‘তারপর যেটা হল সেটা এত আনএক্সপেক্টেড, এত সাডেন যে, কী বলব! আমার বন্ধু মোহন গাড়ি চালাচ্ছিল৷ ওরই গাড়ি৷ হঠাৎ ও বুকে ব্যথা বলে স্টিয়ারিং-এর ওপরে ঝুঁকে পড়ল৷ কোনওরকমে গাড়িটা সাইড করল৷ তারপর কাত হয়ে পড়ল৷ দেখলাম, ওর মুখ দিয়ে বেশ খানিকটা ব্লিডিং হয়েছে৷ সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে বলে মনে হল৷ তাড়াতাড়ি ওকে যে একটা নার্সিংহোম-টোমে নিয়ে যাব সেটাও পসিবল নয়৷ বিকজ আমি গাড়ি চালাতে জানি না৷ তখন কী করব ভেবে না পেয়ে ওকে কোনওরকমে আধশোয়া করে গাড়ি থেকে নেমে এসেছি৷ মোহনের দিকের দরজা খুলে ওর পালস-টালস চেক করেছি৷ না, কোনও ধুকপুকুনি নেই৷ সব শেষ৷ ওর বাড়ির ফোন-নাম্বার আমার কাছে নেই৷ তাই আমাদের দুজন কমন ফ্রেন্ডকে ফোন করলাম৷ ওরা মোহনের বাড়ি, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স—এসব জায়গায় ফোন-টোন করছে, সব ব্যবস্থা করছে৷ আমাকে বলল, মোহনের বডি গাড়িতে লক করে রেখে চটপট বাড়ি ফিরতে৷ ওরা আমার জন্যে আমার বাড়িতে ওয়েট করবে৷ তারপর সবাই মিলে যা করার করব…৷’ কথা বলতে-বলতে বিজয়েশ বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল আবার৷
ওর গল্পের মাঝে-মাঝে ড্যাড আর মম ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’, ‘তারপর’ ইত্যাদি বলছিল, কিন্তু রূপরেখা চুপ করে বিজয়েশের কথা শুনছিল৷ ওর মনে হচ্ছিল, গল্পটার মধ্যে কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে৷
‘তাই আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে লিফট পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভয়ও করছিল৷ কারণটা তো আপনারা নিশ্চয়ই জানেন! এই জঙ্গলে ভীষণ নেকড়ে-মানুষের উৎপাত৷ নেকড়ে-মানুষ—মানে, ওয়্যারউলফ৷ দু-দুটো গাড়ি আমাকে পেরিয়ে চলে গেল৷ আমার ইশারায় একটুও পাত্তা দিল না৷ তারপর…তারপর আমার গুডলাক যে আপনারা দাঁড়ালেন৷ সিরিয়াসলি বলছি, এই রাস্তায় একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভয় করছিল৷ ওয়্যারউলফরা যেরকম ফেরোশাস হয়…৷’
বিজয়েশ ভয় পাওয়ার কথা বলছিল বটে কিন্তু ওর কথাবার্তায় ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা মোটেই ফুটে উঠছিল না৷ বিজয়েশ যত যা-ই বলুক না কেন, রূপরেখার মনে সন্দেহের কাঁটাটা একঘেয়েভাবে খচখচ করছিল৷ অথচ ড্যাড আর মমকে দ্যাখো! অচেনা লোকটার সঙ্গে এমনভাবে গল্প জুড়ে দিয়েছে যেন কতদিনের চেনা! তার ওপর ড্যাড আবার হাসতে-হাসতে বলে বসেছে, ‘আপনাকে একটা গুড নিউজ দিই, বিজয়েশ৷ আর ঠিক…’ হাতঘড়ির দিকে তাকাল ড্যাড: ‘আর ঠিক বাইশ মিনিট পরই একটা ঘটনা ঘটবে এই গাড়ির ভেতরে—কিন্তু আপনি সেই ঘটনাটা দেখতেও পাবেন না, শুনতেও পাবেন না…৷’
‘সে আবার কীরকম ঘটনা!’ অবাক হয়ে বলে উঠল বিজয়েশ৷
সোমরঞ্জন আবার হাতঘড়ি দেখে বললেন, ‘আর ঠিক সাড়ে একুশ মিনিট পর আমার মেয়ে রূপরেখা ওর আঠেরো বছর কমপ্লিট করে আঠেরো প্লাস হবে৷ আজ ওর জন্মদিন—৷’
‘ও, তাই নাকি! ভেরি গুড!’ রূপরেখার দিকে তাকাল বিজয়েশ: ‘হ্যাপি বার্থডে, রূপরেখা৷ কনগ্র্যাচুলেশানস!’
রূপরেখার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল৷ ও হ্যান্ডশেখ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল বিজয়েশের দিকে৷ বিজয়েশ একটু ইতস্তত করে হাত মেলাল৷ কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘সরি, কোনও গিফট দিতে পারলাম না…৷’
রুপি হেসে বলল, ‘গিফটের কোনও দরকার নেই—উইশটাই আসল৷’
আধো-অন্ধকারে যতটা পেরেছে বিজয়েশের হাতটা ততটাই অনুভব করার চেষ্টা করেছে রূপরেখা৷ অনামিকার দৈর্ঘ্যটা বুঝতে চেয়েছে৷ ওটা মধ্যমার সমান, না কি বড়?
না, সেটা বুঝতে পারা যায়নি৷ তার আগেই হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে বিজয়েশ৷
সামনের সিট থেকে রূপশ্রী বলে উঠলেন, ‘রুপি ঠিক বলেছে, বিজয়েশ৷ গিফটের চেয়ে উইশটা অনেক বড়৷ তা ছাড়া…’ হাসলেন রূপশ্রী: ‘বলতে গেলে আপনার প্রেজেন্সটাই তো একটা গিফট! কী, বলুন?’