‘মধ্যমা মানে? কোন ফিঙ্গারটা?’ রুপি জানতে চাইল৷
‘মিডল ফিঙ্গার—৷’
রূপরেখা চুপ করে গেল৷
‘অবাক হোস না, রুপি—’ সোমরঞ্জন হেসে বললেন, ‘এসবই জিনের ম্যাজিক৷ জিনের প্যাটার্ন—মানে, স্ট্রাকচারের মধ্যেই সেই ম্যাজিক লুকিয়ে আছে৷ কেউ-কেউ ব্যাপারটাকে একটা অসুখ বলে মনে করে৷ তাই জিন থেরাপি দিয়ে ট্রিটমেন্টের চেষ্টা করে৷ কিন্তু তাতে সমাধান কিছু পাওয়া গেছে বলে শুনিনি…৷’
‘তোমরা ওয়্যারউলফ নিয়ে এত কথা জানলে কেমন করে?’
‘আমি আর তোর মম এই টপিকটা নিয়ে একটু-আধটু স্টাডি করেছি—স্রেফ নিজেদের ইন্টারেস্টে৷ সায়েন্টিস্টরা অবশ্য এখনও বলে, এই ওয়্যারউলফে পালটে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি একটা ইলিউশান৷ একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশান৷ বাট বেশিরভাগ মানুষই এই থিয়োরিটা মেনে নেয়নি৷ তারা মনে করে, লাইক্যানথ্রপি—মানে, এই পালটে যাওয়ার ব্যাপারটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট রিয়্যাল৷ আমাদেরও সেই একই ধারণা৷ যাকগে— যে-কারণে তোকে নেকড়ে-মানুষ—আই মিন, মানুষ-নেকড়ে নিয়ে এত কথা বলা…সেটা হচ্ছে ওই সাইনবোর্ড৷ বিপজ্জনক রাস্তা, সাবধানে গাড়ি চালান৷
‘রুপি, এই যে দু’পাশের গাছপালা আর জঙ্গল দেখছিস, এটা হচ্ছে ওয়্যারউলফদের প্রিয় এলাকা৷ এখানে এসে ওরা মনের সুখে শিকার ধরে৷ এই জঙ্গল ওদের হ্যাপি হান্টিং গ্রাউন্ড৷ সেইজন্যেই এই রাস্তা দিয়ে সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়৷ এ-রাস্তায় খুব একটা কেউ আসে না…৷’
‘তা হলে আমরা এলাম কেন?’ প্রশ্নটা করার সময় রূপরেখার ভুরু কুঁচকে গেল৷
‘তোকে সাহসী করে তোলার জন্যে—’ রূপশ্রী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘তুমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আঠেরো প্লাস হবে৷ তুমি একটা মোমেন্টেই অ্যাডাল্ট হয়ে যাবে৷ তোমাকে সেই মোমেন্ট থেকে অ্যাডাল্ট হিসেবে সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে৷ সেই সঙ্গে ভয়েরও৷ তখন চট করে ভয় পেলে কিন্তু চলবে না…৷’
মমের কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই রূপশ্রী দেখল, দূরে রাস্তার ধারে নীল রঙের একটা ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা লোক৷ লোকটা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথার ওপরে দু-হাত তুলে নাড়ছে—গাড়ি থামাতে ইশারা করছে৷
‘ড্যাড, গাড়ি থামাবে না কিন্তু…৷’
‘কেন রে?’ সোমরঞ্জন মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকানোর চেষ্টা করে হাসলেন, ‘নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের গাড়িটা বিগড়ে গেছে…৷ তার ওপর এই বৃষ্টি…!’
‘আননোন লোকদের লিফট দিতে গিয়ে কত ছিনতাই, ডাকাতি আর মার্ডার হয় নিউজপেপারে পড় না! ডোন্ট স্টপ, ড্যাড!’
‘রুপি, তুই ফর নাথিং ভয় পাচ্ছিস৷’ রূপশ্রী এবার মেয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বললেন, ‘আজ যদি আমাদের গাড়িটাই মাঝ-রাস্তায় খারাপ হত তা হলে আমরা কি লিফট চাইতাম না, হেলপ চাইতাম না, বল?’ তারপর স্বামীর দিকে তাকালেন: ‘সোম, আমাদের হেলপ করা উচিত…৷’
‘নিশ্চয়ই! এরকম বিপদে পড়ে একজন হেলপ চাইছে…৷’
সোমরঞ্জনের গাড়ির গতি কমতে শুরু করল৷ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ক্রমশ ওঁদের কাছে চলে আসতে লাগল৷ তারপর একসময় থামল৷
লোকটা বেশ লম্বা৷ ছ’ফুট কেন, তার বেশিও হতে পারে৷ হয়তো সেইজন্যেই সামান্য কুঁজো হয়ে গেছে৷ গায়ে শ্যাওলা রঙের একটা বর্ষাতি৷ মাথায় সাদা রঙের একটা ছোট ক্যাপ—বেশ শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে৷
গাড়ি থামতেই লোকটা ব্যস্তভাবে গাড়ির পিছনের দরজার কাছে চলে এল৷
‘রুপি, দরজাটা খুলে দে…৷’ রূপশ্রী বললেন৷
রূপরেখার ভীষণ রাগ হচ্ছিল৷ ড্যাড আর মম যেন হঠাৎ করে দয়ার অবতার হয়ে উঠল৷ এই রাতে বৃষ্টির মধ্যে এই শুনসান রাস্তায় অচেনা-অজানা উটকো একটা পাবলিককে হুট করে গাড়িতে তুলে নিল!
লোকটা মাথার টুপিটা খুলে বর্ষাতির পকেটে ঢোকাল৷ রূপরেখা দরজা খুলতেই সে চট করে বর্ষাতিটা খুলে ফেলল৷ অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সেটা কার্পেটের মতো রোল করে গুটিয়ে ছোট করে ফেলল, ছুড়ে দিল গাড়ির মেঝেতে৷ তারপর তিন সেকেন্ডের মধ্যে উঠে বসল রূপরেখার পাশে, এবং দরজা বন্ধ করে দিল৷
কোনও কারণ ছাড়াই রূপরেখা ওর দিকের দরজার কাছে আরও সরে গেল৷
লোকটা বলল, ‘মেনি থ্যাংকস৷’ রূপকথার দিকে তাকিয়ে নড করল৷ তারপর সোমরঞ্জনকে লক্ষ করে বলল, ‘ভাগ্যিস আপনি গাড়ি থামালেন! নইলে এই বিচ্ছিরি ওয়েদারে কতক্ষণ সাফার করতাম কে জানে!…আমার নাম বিজয়েশ৷ সফটওয়্যারে আছি৷ অ্যাবাকাস স্কোয়ারে আমি নেমে যাব৷ আজ অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে এই ট্রাবল৷ এখন এই সিচুয়েশান থেকে উদ্ধার পেলে হয়!’
বিজয়েশ৷ নামটা তো অদ্ভুত! রূপরেখা ভাবছিল৷ ও একইসঙ্গে বিজয়েশকে লক্ষ করছিল৷
লম্বাটে মুখ৷ কপালটা বেশ বড় হয়ে মাথার টাকে মিশে গেছে৷ তবে সেই টাক মাথার আধাআধি পর্যন্ত৷ তারপরই দিব্যি চুল রয়েছে এবং সেই চুল লম্বা হয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে৷
অন্ধকারে বিজয়েশের মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ গাড়ির ড্যাশবোর্ডের আবছা আলো ওর কপালে, গালে, নাকের ডগা আর থুতনিতে হালকা হাইলাইট তৈরি করেছে৷
অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ওর বেশ পুরু গোঁফ রয়েছে৷ আন্দাজে মনে হচ্ছিল, ওর বয়েস পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ হবে৷ কিন্তু বয়েসের তুলনায় গলাটা বেশ ভরাট৷
রূপরেখার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল৷ একইসঙ্গে বিরক্তও লাগছিল৷ বারবার করে বারণ করা সত্ত্বেও ড্যাড আর মম শুনল না৷ উটকো লোকটাকে সেই গাড়িতে তুলল!