কিন্তু ব্যাপারটা কী? কীসের ভয় আছে এখানে?
সে-কথাই ও রূপশ্রীকে জিগ্যেস করলঃ ‘মম, এই রাস্তাটায় কীসের ভয়? কেয়ারফুলি ড্রাইভ করতেই বা বলছে কেন?’
রূপশ্রী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন৷ তাকালেন সোমরঞ্জনের দিকে৷ অন্ধকারে ওঁর মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ দু-হাতে স্টিয়ারিং মুঠো করে ধরে আছেন৷ তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে৷
সোম রূপশ্রীর তাকিয়ে থাকাটা কীভাবে যেন অনুভব করলেন৷ শব্দ করে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ও. কে.—আমিই বলছি৷’ ঘাড় ঘুরিয়ে রূপরেখার দিকে তাকালেন: ‘শোন, রুপি…ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং৷ তুই কি কখনও ওয়্যারউলফের কথা শুনেছিস বা পড়েছিস?’
‘ওয়্যারউলফ? হোয়াট ইজ দ্যাট? তোমাদের মুখে তো কখনও এই পিকিউলিয়ার ওয়ার্ডটা শুনিনি!’
‘শুনিসনি বিকজ তোর সামনে আমরা কখনও ওয়্যারউলফের টপিকটা ডিসকাস করিনি৷ তবে একটু পরেই করতাম, বিকজ টুডে ইজ আ স্পেশাল ডে৷’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর সোম বললেন, ‘ওয়্যারউলফ—মানে, মানুষ- নেকড়ে…অথবা নেকড়ে-মানুষ৷’
‘নেকড়ে-মানুষ!’ রূপরেখার গলায় ভয় আর বিস্ময়৷
‘তুই ফর নাথিং ভয় পাচ্ছিস, রুপি—৷’ মেয়ের ভয় কমাতে আশ্বাস দিলেন রূপশ্রী, ‘ব্যাপারটা খুব সিম্পল৷ কোনও-কোনও মানুষ এক-একসময় নেকড়েতে পালটে যায়৷ মানে, হাফ অ্যানিম্যাল, হাফ ম্যান৷ যাকে বলে ওয়্যারউলফ৷ এই ওয়্যারউলফরা ভীষণ হিংস্র হয়, ওদের গায়ে অসম্ভব শক্তি৷’
‘কিন্তু হঠাৎ করে কোনও-কোনও মানুষ এরকম পালটে যায় কেন?’ রূপরেখা অবাক হয়ে জানতে চাইল এবার৷
বাইরে বৃষ্টির চেহারা একইরকম৷ তবে বৃষ্টি-ভেজা রাস্তার দু’পাশে এখন শুধুই গাছপালা আর জঙ্গল৷ কোনও লোকজন চোখে পড়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলেন সোমরঞ্জন, ‘কেন যে এমন ট্রান্সফরমেশান হয় সেটা এখনও কেউ জানে না৷ সায়েন্টিস্টরা এখনও এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছে৷ তবে অনেকের ধারণা, ব্যাপারটা জিনের সঙ্গে রিলেটেড এবং এটা এক ধরনের অসুখ৷
‘একটা সময় ছিল, যখন এই টাইপের অসুস্থ মানুষরা পূর্ণিমার রাতে ওয়্যারউলফের চেহারায় পালটে যেত৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে, পূর্ণিমার রাতের এই নিয়মের বাইরেও কোনও-কোনও মানুষ নেকড়ে-মানুষে পালটে যাচ্ছে৷ কেউ পূর্ণিমার বদলে অমাবস্যার চক্র মেনে চলছে৷ কেউ বা নিজের ইচ্ছেয় চেহারা পালটাতে পারছে৷ কেউ আবার নেকড়ে-মানুষের বদলে অন্য চেহারা নিতে পারছে৷ আসলে পুরো ব্যাপারটাই জিনের ম্যাজিক৷ এ-জিন কিন্তু আলাদিনের প্রদীপের জিন নয়—এ-জিন হল আমাদের শরীরের ভেতরের ব্যাপার—মানে, বংশাণু, বুঝলি?’
‘কী এক্সাইটিং, ড্যাড!’ অবাক হওয়ার আনন্দ-উত্তেজনা রূপরেখাকে ছুঁয়ে ফেলেছেঃ ‘আচ্ছা, একটা ওয়্যারউলফ যখন নরমাল থাকে তখন তাকে দেখে কি বোঝা যায় যে সে, আই মিন, একজন মানুষ যদি আসলে ওয়্যারউলফ হয়, তা হলে তাকে দেখে সেটা বোঝার কি কোনও ওয়ে আছে?’
‘ব্যাপারটা এত সিম্পল নয়, রুপি৷’ মম এবার কথা বলল, ‘বিকজ ওয়্যারউলফ অনেক রকমের হয়৷ যেমন, ফুল মুন ওয়্যারউলফ, নিউ মুন ওয়্যারউলফ, শেপ শিফটার, সাইকললেস ওয়্যারউলফ—আরও অনেক-রকম৷ আমরা যতদূর জানি, নিউ মুন ওয়্যারউলফ ছাড়া আর কোনও টাইপের ওয়্যারউলফকে চিনে ফেলার কোনও উপায় নেই…৷’
‘নিউ মুন ওয়্যারউলফকে চেনা যায়!’ অবাক হয়ে বলল রূপরেখা, ‘বাট হাউ? কীভাবে চেনা যায়, মম?’
রূপশ্রী একবার তাকালেন সোমরঞ্জনের দিকে৷ আজ রুপির জন্মদিন৷ বিকেল থেকে ওঁরা তিনজন কত না আনন্দ করেছেন! সুখিয়ানা নদীর তীরে ‘ড্রিমল্যান্ড’ থিম পার্কে গেছেন৷ সেখানে মনের সুখে বোটিং করেছেন৷ সমুদ্রের নকল ঢেউয়ে লাফালাফি করে স্নান করেছেন৷ হরেকরকম রঙিন ফুল আর গাছ দিয়ে সাজানো চোখভোলানো মনভোলানো বনানীতে অসংখ্য রঙিন পাখপাখালির ফটো তুলেছেন৷ সেখানে ছুটোছুটিও করেছেন তিনজনে৷ ওঁদের বয়েস যেন দশবছর করে কমে গিয়েছিল৷ তারপর শুরু হয়েছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ কিন্তু বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই ওঁরা আনন্দ করেছেন৷ রূপরেখাকে খুশি দেখে ওঁদের খুশি অনেক বেড়ে গেছে৷ সন্ধের পর ‘ড্রিমল্যান্ড’-এর পশ রেস্তোরাঁয় আর্লি ডিনার সেরে তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন৷ এবং ইচ্ছে করেই এই অ-নিরাপদ রাস্তা ধরে ওঁরা এখন চলেছেন৷ কারণ, আঠারো পেরোলেই রূপরেখা হিসেব মতো বড় হয়ে যাবে৷ তখন ওর ভয়ের একটু মুখোমুখি হওয়া দরকার, ভয়ের সঙ্গে মোকাবিলা হওয়া দরকার৷ ভাগ্যিস ওই রোড সাইনটা দেখে রুপি নিজেই ইস্যুটা তুলল৷ না তুললে রূপশ্রী অথবা সোমরঞ্জন অবশ্যই তুলতেন৷
‘মম, কী হল? টেল মি, কী করে নিউ মুন ওয়্যারউলফকে চেনা যায়—৷’
‘আমি বলছি৷’ সোমরঞ্জন রূপশ্রীর অস্বস্তি যেন সূক্ষ্ম বেতার তরঙ্গে টের পেলেন৷ সামনে সোজা রাস্তা—কোনও বাঁক চোখে পড়ছে না৷ শুধু চোখে পড়ছে আকাশ থেকে ওপরওয়ালার ছিটিয়ে দেওয়া শান্তির জল, আর দু’পাশের গাছপালা৷ আর কখনও-কখনও রাস্তার ধারে পার্ক করে রাখা একটা কি দুটো গাড়ি৷
‘শোন বলছি—’ ঘাড় ঘুরিয়ে রূপরেখার দিকে একবার দেখলেন সোমঃ ‘নিউ মুন ওয়্যারউলফদের হাতের আঙুল একটু পিকিউলিয়ার টাইপের হয়৷ ওদের দু-হাতের অনামিকা—মানে, রিং ফিঙ্গার—মধ্যমার সমান কিংবা তার চেয়ে একটু বড় হয়৷ তবে কেন যে এটা হয় সেটা এখনও কেউ জানে না…৷’