যদিও ওকে ঘিরেই সব কথাবার্তা তবুও রূপরেখা চুপ করেই ছিল৷ তাকিয়ে ছিল সামনের কালো রাস্তার দিকে৷ হেডলাইটের সাদা আলো পড়েছে সেখানে৷ সেই আলোয় রুপোলি ঝালরের মতো চিকচিক করছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মিহি ফোঁটা৷
আজ বিকেল থেকেই ড্যাড আর মমের সঙ্গে ডে-আউটে বেরিয়েছে রূপরেখা৷ আজ ওর জন্মদিন ঠিকই, কিন্তু ড্যাড আর মম সেটা নিয়ে যেন একটু বেশিরকম আদেখলেপনা করছে৷ বলছে, আঠেরো বছর পার করে উনিশ ছুঁয়ে ফেলাটা নাকি দারুণ স্পেশাল ব্যাপার৷
অন্যান্য বছরেও তো রূপরেখার জন্মদিন আসে, জন্মদিন যায়৷ সেই দিনগুলোয় জন্মদিনের সেলিব্রেশানও করা হয়৷ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসে, ড্যাড অফিস থেকে সেদিন জলদি-জলদি ফেরে৷ মম একটা বিউটি পার্লার চালায়৷ কিন্তু রুপির বার্থডের দিন তিন ঘণ্টা আগে পার্লার বন্ধ করে বাড়ি চলে আসে৷ তারপর সবাই মিলে হই-হুল্লোড় হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়৷ বেশ মজা আর আনন্দে কাটে দিনটা৷
কিন্তু এবার ব্যাপারটাই যেন আলাদা৷
মম দু-দিন আগে থেকেই বলে দিয়েছে, রুপির এবারের জন্মদিনটা একটু অন্যরকম, কিন্তু দারুণভাবে সেটা সেলিব্রেট করা হবে৷ এবং সেই স্পেশাল সেলিব্রেশানে থাকবে শুধু তিনজন: রূপরেখা, ওর মম, আর ড্যাড৷ মম আর ড্যাড এও বলেছে, এবারে আর ইনডোর সেলিব্রেশান নয়, সবটাই হবে আউটডোরে, খোলা আকাশের নীচে, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি৷
বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই ওরা তিনজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ স্টিয়ারিং-এ সোমরঞ্জন৷ পাশে রূপশ্রী৷ আর পিছনের সিটে বার্থডে গার্ল রূপরেখা৷
আকাশে তখন মেঘ থাকলেও একটা কনে-দেখা-আলো ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে৷ কিন্তু তারপর মেঘের ওপরে মেঘ জমেছে৷ শুরু হয়েছে বৃষ্টি—তবে তেমন জোরে নয়, ঝিরিঝিরি৷ যেমন এখন চলছে৷
সোমরঞ্জন গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আর আপনমনে বকবক করছিলেন৷ রূপরেখার ছোটবেলার কথা বলছিলেন, বলছিলেন ওর স্কুলজীবনের নানান কাণ্ড-কারখানার কথা৷ যেমন, ও ছোটবেলায় টিফিন না খেয়ে সেটা স্কুলের উঠোনের গাছতলায় ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাঁও’ আর উড়ে বেড়ানো কাককে খাইয়ে দিত৷
সেটা জানাজানি হওয়ার পর মম যখন ওকে জিগ্যেস করেছে, ‘এ কী ব্যাপার, রুপি! তুমি নিজের টিফিন এভাবে বিলিয়ে দাও কেন?’ তখন রুপি বলেছে, ‘ওরা তো রোজ স্কুলে আসে, কিন্তু টিফিন আনে না! তাই আমি ওদের টিফিন খাওয়াই—৷’
একবার ওর স্কুলের এক ম্যাডাম বিয়ের জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি নিয়েছিলেন৷ তো বিয়ের পর তিনি যখন আবার ওদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তখন রূপরেখা আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাডামকে বলেছিল, ‘ম্যাম, আমিও আপনার মতো বিয়ে করব, সিঁদুর পরব—৷’
গোটা ক্লাস জুড়ে হাসির রোল উঠেছিল৷
ম্যাডাম একটুও রাগ না করে ওকে বলেছিলেন, ‘অফ কোর্স বিয়ে করবে, সিঁদুর পরবে৷ তবে তোমাকে চোদ্দো-পনেরো বছর ওয়েট করতে হবে, রূপরেখা—৷’
আবার হাসির রোল৷
হাসির রোল উঠেছে গাড়িতেও৷ সোমরঞ্জন কথায়-কথায় হেসে ওঠেন৷ আর ওঁর হাসি মানেই অট্টহাসি৷ হাসির সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর ভুঁড়ি কেঁপে-কেঁপে ওঠার কথা, কিন্তু স্টিয়ারিংটা ভুঁড়িতে চেপে বসায় কাঁপুনির অসিলেশানে ড্যাম্পিং ফ্যাক্টর কাজ করছে৷
রূপশ্রী ভুরু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উঃ, এত জোরে-জোরে হাসছ কেন? আমার ডানদিকের কানটা তো কালা হয়ে যাবে—!’
রূপরেখা সোমরঞ্জনের কলারে ছোট্ট টান মেরে বলল, ‘ওঃ, ড্যাড! তুমি এত জোরে হাসো যে ভীষণ আনসিভিলাইজড৷ তোমাকে অফিসে কিছু বলে না? জানো, এরকম লাউডলি হাসলে গ্র্যাভিটি কমে যায়!’
‘শোন, শোন, রুপি৷ মোটাসোটা মানুষরা দিলখোলা হয়, তাই প্রাণ খুলে হাসে৷ আর যারা…৷’
সোমরঞ্জন আড়চোখে স্ত্রীকে দেখলেন৷ রূপশ্রী যথেষ্ট স্লিম৷ এবং রোগা থাকার চেষ্টায় বলতে গেলে ঘাস-পাতা ইত্যাদি খেয়ে দিনযাপন করেন৷ আর রূপরেখাও বেশ তন্বী৷ সুতরাং, সোম বুঝলেন, ওঁর সেনটেন্সের শুরুটা ভুলভাল হয়ে গেছে৷ তাই মরিয়া হয়ে কারেকশনের চেষ্টায় বললেন, ‘আর যারা রোগা, তারাও দারুণ দিলখোলা দিলদরিয়া হয়৷ তা ছাড়া তারা দেখতেও হেবি সুন্দর হয়…৷’
রূপরেখা পিছনের সিট থেকে বলে উঠল, ‘ড্যাড, কী হচ্ছে এবার?’
গাড়ির ভেতরে ওরা তিনজনে এরকম মজা-মশকরায় মশগুল ছিল৷
নির্জন রাস্তা ধরে একঘেয়েভাবে গাড়ি চলছিল৷ রাস্তা কখনও-কখনও বাঁক নিচ্ছিল৷ রূপরেখা গুনগুন করে গান করছিল৷ রূপশ্রীও তার সঙ্গে গুনগুনিয়ে গলা মেলালেন৷
হঠাৎই রাস্তার ধারে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল রুপির৷
গাড়িতে এসি চলছে বলে সব কাচ তোলা৷ বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ জানলায় ভাপ জমেছে৷ কিন্তু এতরকম অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও সাইনবোর্ডের লেখাটা রুপি পড়তে পারল, কারণ, ও উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলছে বলে ওর একটু একঘেয়ে লাগছিল৷ লাস্ট ফর্টি মিনিটস ধরে ড্যাড গাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই! তাই ও নতুন কিছু দেখার আশায় মুখিয়ে ছিল৷
সাইনবোর্ডের লেখাটা ভারী অদ্ভুত:
কেন? রাস্তাটা নিরাপদ নয় কেন? সাবধানে গাড়ি চালাতেই বা বলছে কেন?
রুপির কপাল ভালো যে, ইংরেজিটা সঙ্গে থাকার জন্য সরকারি বাংলা ‘অ-নিরাপদ’ পড়ে ও আসল মানেটা বুঝতে পেরেছে৷