‘আবার মার্ডারার যদি স্বর্ণমালা ম্যাডামের চেনা কেউ হন—মানে, ধরুন, আপনি—তা হলেও তো ওই কোশ্চেনটার কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না৷ কারণ, মোবাইল থেঁতো করলেই তো আর কল রেকর্ডস উধাও হয়ে যাবে না!
‘তাহলে মোবাইলটা স্ম্যাশ করার কারণ কী হতে পারে?’ হাসলেন মোহনলাল পাল৷ চাপা খুকখুক শব্দ হল৷ তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কারণটা হল, একটা পাজল তৈরি করে পুলিশকে মিসগাইড করা৷ আর…আর…মোবাইলটা ফুলগাছের আড়ালে বা অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্যে যদি সেটার গায়ে ধুলো-মাটির কণা লেগে-টেগে থাকে সেসব যেন থেঁতলানো মোবাইলের ফোরেনসিক টেস্টে ট্রেস না করা যায়৷ তো সত্যি-সত্যিই আমরা সেরকম কোনও ট্রেস পাইনি৷’ মোহনলাল বিড়িতে ঘন-ঘন টান দিলেন৷
আমি মুখটা শক্ত করে চুপচাপ বসে রইলাম৷ স্বপ্নেও ভাবিনি যে, স্বর্ণা খুন হওয়ার একমাস পরেও আমি এভাবে হ্যারাসড হতে পারি৷ মোহনলাল লোকটার দেখছি সৌজন্য, সঙ্কোচ, ভদ্রতা, লাজ, লজ্জা কিছুই নেই!
‘এবারে আসা যাক আপনার এ-বাড়ির সদর দরজার ব্যাপারটায়…৷ এ-ব্যাপারে তেমন কোনও মিস্ট্রি নেই, কারণ, আপনি তদন্তের শুরুতেই আমাদের বলেছিলেন, খুনের ঘটনার মাসখানেক আগে আপনার সদর দরজার একটা চাবি হারিয়ে গিয়েছিল৷ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেটা পাননি বলে শেষ পর্যন্ত আপনি চাবিওয়ালা ডেকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি তৈরি করান৷
‘প্রথমে আপনি আমাদের এ-বিষয়ে কিছু বলেননি৷ ইন ফ্যাক্ট চাবিওয়ালা ডেকে চাবি তৈরির ব্যাপারটা আমরা প্রথম জানতে পারি আপনার পাশের বাড়ির মিসেস মিনতি ব্যানার্জির কাছ থেকে৷ তারপর তো ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে যা-যা কোশ্চেন করার সেসব আমরা আপনাকে করেছি৷ আপনি অনেস্টলি সেসব কোশ্চেনের উত্তর আমাদের দিয়েছেন৷ আমরা…৷’
মোহনলাল আরও যেসব কথা বলছিলেন সেগুলো আমার মাথায় ঢুকছিল না৷ শার্লক হোমস মিসেস ব্যানার্জির কথা ভাবছিলাম৷ ভদ্রমহিলার মতো এত দায়িত্ববান এবং একনিষ্ঠ নোজি পার্কার সত্যিই রেয়ার৷ আসলে চাবি তৈরির ব্যাপারটা প্রায় মাসখানেকের পুরোনো ছিল বলে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তা ছাড়া স্বর্ণমালার আচমকা খুন হওয়া! ওফ, আমার দুনিয়াটা পুরো টপসি-টারভি হয়ে গিয়েছিল৷ এখনও সেটা মাঝে-মাঝে টাল খাচ্ছে৷ মোহনলাল পাল সেসব জ্বালা-যন্ত্রণার কী বুঝবেন! আমার মনে হল, এই ছোটলোকটা বোধহয় কখনও যুবক ছিল না৷ আর থাকলেও কখনও কাউকে ভালোবাসেনি৷
ওঃ, চাবি হারানোর ব্যাপারটা নিয়ে মোহনলাল অ্যান্ড কোম্পানি আমাকে কম জ্বালিয়েছে!
স্বর্ণমালা একটা ছোট সফটওয়্যার কোম্পানিতে পার্টটাইম চাকরি করত৷ তাই আমাদের দুজনের কাছেই একটা করে চাবি থাকত৷ হারিয়ে গিয়েছিল ওর চাবিটাই৷ তখন আমি দরজার লকটা পালটানোর কথা বলেছিলাম, কিন্তু স্বর্ণা অত খরচ আর ঝঞ্ঝাট করতে রাজি হয়নি৷ তখন বলতে গেলে ওর চাপেই আমি চাবিওয়ালা ডেকে ডুপ্লিকেট চাবি তৈরির ব্যবস্থা করি৷ কিন্তু আমি কল্পনাও করিনি, সেই হারানো চাবি কোন জটিল প্রসেসে স্বর্ণার মার্ডারারের হাতে গিয়ে পড়বে, আর স্বর্ণার এরকম সর্বনাশ হবে৷ সেইসঙ্গে আমারও৷
মোহনলাল বিড়ি শেষ করে টুকরোটা নির্বিকারভাবে মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে ঘষে দিলেন৷ তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘এবার ধরুন, মিস্টার মজুমদার, ওই চাবি- এপিসোডটা পুরোপুরি আপনার ম্যানিপুলেট করা…৷’
‘কী বলছেন আপনি?’ চেয়ার ছেড়ে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি, ‘চাবি হারানোর ব্যাপারটা আমার কারসাজি? নাটকবাজি? আপনি এই মুহূর্তে রাস্তা মাপুন—দয়া করে বেরিয়ে যান—এক্ষুনি!’
মোহনলাল বাচ্চা ছেলের মতো হেসে ফেললেন৷ বললেন, ‘আরে বসুন, বসুন, রীতেশবাবু৷ আপনাকে আলাদা করে আর বলা হয়নি যে, আমি খুব ঠ্যাঁটা টাইপের ডিটেকটিভ৷ অত সহজে আমি রাস্তা মাপি না৷ তা ছাড়া, আমি তো বলিনি, আপনি চাবি-এপিসোডটা ম্যানিপুলেট করেছেন৷ আমি বলেছি ‘‘ধরুন’’—মানে, মনে করুন৷ তাতেই এত চটে যাচ্ছেন কেন? এরকম চটে গেলে আপনার ওপরে সন্দেহ তো আরও বাড়বে…৷’
আমি একটা বড় শ্বাস ফেললাম৷ মোহনলাল কি আমাকে লেজে খেলাচ্ছেন? আমার ওপরে এইরকম মেন্টাল টরচার আর কতদিন চলবে?
চেয়ারে বসে পড়লাম আবার৷ এ কী বিরক্তিকর ইঁদুর-বেড়াল খেলা! যদি ওরা মনে করে আমিই মার্ডারার তা হলে আর দেরি কীসের! আমাকে বিচারের নাটক করে যাবজ্জীবনে ঢুকিয়ে দিক কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিক৷ এই লাইফ আর ভালো লাগছে না৷
ডায়েরিটা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিলেন আবার৷ পাতা ওলটাতে লাগলেন৷ তারপর চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন: ‘চাবির ব্যাপারটা আপনি গোড়াতে আমাদের বলেননি৷ ইচ্ছে করেই বলেননি৷ আপনি চাইছিলেন আমরা খোঁজখবর করে ব্যাপারটা উৎঘাটন করি৷ তা হলে আপনাদের হারানো চাবি হাতিয়ে নিয়ে খুনি আপনার বাড়িতে ঢুকেছে এই থিয়োরিটা আমরাই তৈরি করে আপনার প্লেটে সার্ভ করব…৷’
‘মিস্টার পাল, এবারে আপনি আসুন৷ আমার শরীর বা মনের অবস্থা ভালো নয়৷ আমার মাথাটা অসম্ভব ব্যথা করছে৷ ভুরুর ওপরটা দপদপ করছে৷ সত্যিই আমি আর নিতে পারছি না…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন মোহনলাল৷ তারপর বেশ নরম গলায় বললেন, ‘রীতেশবাবু, প্রায় একমাস ধরে আমরা আপনার ওয়াইফের মার্ডারের তদন্ত-টদন্ত করেছি, কিন্তু সেরকম কিছু করে উঠতে পারিনি৷ আর, জুতসই কোনও প্রমাণ-টমানও পাইনি৷ আপনি প্রাইম সাসপেক্ট হলেও আমরা আপনার এগেইনস্টে কোনও স্টেপ নিতে পারিনি৷ তা ছাড়া, আমরা কীভাবে তদন্ত করেছি, কী-কী সন্দেহ করেছি, কী-কী থিয়োরি অ্যাপ্লাই করে মার্ডারটাকে রিকনস্ট্রাক্ট করেছি সেসব কিছুই আপনাকে বলিনি৷ আপনাকে সেসব খোলাখুলি বলব বলেই আজ আমার এই আন-অফিশিয়াল ভিজিট৷ সেজন্যেই এত মন খুলে আজ আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি৷ আপনি মনে কিছু করবেন না—৷’