ওঃ ভগবান! লোকটার মনটা কি জিলিপি দিয়ে তৈরি? তা ছাড়া কী করেই বা এরকম একটা ফোনের কথা কেউ আগে থেকে জানতে পারে?
‘আচ্ছা, মিস্টার পাল, সত্যি করে বলুন তো, এরকম একটা এস. ও. এস. ফোনের কথা কারও পক্ষে কি আগে জানা পসিবল?’
‘ঠিক—ঠিক৷ আন্ডার নরমাল সারকামস্ট্যান্সেস, পসিবল নয়৷ কিন্তু আন্ডার কন্ট্রোলড সিচুয়েশান, ইট ইজ নট ইমপসিবল…৷’
‘তার মানে?’
‘তার মানে, আপনার কোনও অ্যাকমপ্লিস—মানে, ওই তিন নম্বর কোণ—হয়তো ওই ফেক এস. ও. এস. কলটা করেছে৷ এবার সেটা যে আপনার ওয়াইফের গলা নয় সেটা প্রুভ করা খুব টাফ৷ কারণ, মোবাইল ফোনের সার্ভিস প্রোভাইডাররা যে-ভয়েস রেকর্ড পুলিশকে দেয় তাতে অনেক নয়েজ আর ডিসটরশন থাকে৷ ফলে ঠিকঠাক ভয়েস ম্যাচ পাওয়া খুব ডিফিকাল্ট৷ আমরা সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে ভয়েস রেকর্ড নিই কথাবার্তা শোনার জন্য আর ইনফরমেশন পাওয়ার জন্যে…৷’
লোকটার মুখে সপাটে একটা ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছিল আমার৷
মোহনলাল হয়তো প্রচুর গোয়েন্দাগিরি করেছেন, কিন্তু গোয়েন্দা গল্প আমিও তো কিছু কম পড়িনি! সুতরাং কিছুটা তর্কাতর্কি ওঁর সঙ্গে করাই যায়৷ তাই বললাম, ‘একটা কথা জিগ্যেস করছি—প্লিজ, মনে কিছু করবেন না…৷’
‘মনে করব কেন?’ জোরে হেসে উঠে টেবিলে দু’বার আলতো চাপড় মারলেন: ‘করুন কী জিগ্যেস করবেন—৷’
‘স্বর্ণার মোবাইল ফোনটা আমার সেই তিন নম্বর কোণের হাতে গেল কেমন করে? তারপর সেই ফোনটাই থেঁতলানো অবস্থায় দোতলার সিঁড়িতে পাওয়া গেছে৷ এই ব্যাপারগুলো আপনি কীভাবে এক্সপ্লেইন করবেন, মিস্টার পাল?’
ডায়েরির পাতায় চোখ রাখলেন পালবাবু৷ কয়েকটা পাতা এদিক-সেদিক ওলটাতে-ওলটাতে নীচু গলায় বললেন, ‘রাগ করবেন না, রীতেশবাবু, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব একটা কঠিন নয়…’ মুখ বিকৃত করে হঠাৎই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগলেন৷ তারপর: ‘তর্কের খাতিরে ধরা যাক, সেদিন অফিসে বেরোনোর সময় আপনি আপনার ওয়াইফের মোবাইলটা হাতসাফাই করলেন৷ তারপর ওটাকে বাড়ির বাইরের ফুলগাছগুলোর আড়ালে বা কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে রেখে অফিসে চলে গেলেন৷ দুটো বাজতে পাঁচে আপনার প্রেমিকা—ধরা যাক, ম্যাডাম এক্স—এখানে চলে এলেন৷ ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে চট করে কাছেই কোথাও সটকে পড়লেন৷ সেখান থেকে এস. ও. এস. কলটা করে ফোনটা আবার লুকিয়ে রেখে গেলেন—আপনার জন্যে৷
‘মোবাইল ফোনটা কোথায়-কোথায় লুকোনো হবে সেটা আপনারা দুজনে আগেই ডিসকাস করে প্ল্যান করে নিয়েছিলেন…৷’
অসহ্য! মাথাটা গরম হয়ে গেল আমার৷ আর চুপ করে থাকা যায় না!
‘একমাস ধরে তদন্তের নাটক করে আপনি কি শেষমেশ আমাকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছেন? স্বর্ণার মোবাইল ফোনের উদ্ভট রুট ওভার মাইনাস ওয়ান গল্প শোনাতে এসেছেন আমাকে!’
হাসলেন পালবাবু৷ গোঁফের আড়ালে চাপা হাসি৷ ডায়েরি আর পেন টেবিলে নামিয়ে রেখে আপনমনেই বললেন, ‘উত্তেজনা, রাগ আর বিরক্তি৷ আমাদের তদন্তের তিনটে হেলপলাইন৷ সাসপেক্টরা যখন এই তিনটে ইমোশন শো করে তখন আমাদের তদন্তের অনেক সুবিধে হয়…৷’
কথা বলতে-বলতে ডায়েরিটা টেবিলে রেখে পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন মোহনলাল৷ প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে নিয়ে আমার দিকে ইশারা করে জিগ্যেস করলেন, ‘চলবে না কি?’
আমি জানালাম যে, আমি স্মোক করি না৷
‘গুড৷ স্মোক না করাটা খুব ভালো৷ কিন্তু আমরা তো সবসময় খারাপ কাজই করি…’ লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরালেন মোহনলাল৷ বিড়ির প্যাকেট এবং রঙিন প্লাস্টিকের লাইটারটাকে আবার পকেটে ফেরত পাঠালেন৷
চোখ বুজে বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন৷
বিড়ির গন্ধ আমার কাছে অসহ্য৷ কিন্তু অসহ্য অনেক কিছুই তো এতক্ষণ ধরে সহ্য করছি!
‘রীতেশবাবু, লাস্ট একমাস ধরে আমরা যা তদন্ত করার করে নিয়েছি৷ আমরা এখনও আপনার ওয়াইফের মার্ডারারকে অ্যারেস্ট করতে পারিনি৷ খুঁজেই পাইনি তো অ্যারেস্ট! এ জন্যে আপনি কয়েকশোবার আমাদের কাছে রাগ-টাগ দেখিয়েছেন৷ তার উত্তরে আমরা মিনমিন করে দায়সারা কিছু জবাব দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি৷ বলতে পারেন, অফিশিয়ালি আমাদের কেস ক্লোজড—মানে, প্রায় ক্লোজড৷ আমি কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আন-অফিশিয়ালি দেখা করতে এসেছি৷ না, আপনাকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি৷ শুধু আমার কতকগুলো আইডিয়ার কথা শোনাতে এসেছি৷ আইডিয়াগুলো রুট ওভার মাইনাস ওয়ান টাইপের হতে পারে…৷’
‘আপনি এগজ্যাক্টলি কী চান বলুন তো?’
ওঁর বিড়ির ধোঁয়ায় আমার গা গুলোচ্ছিল৷
গোঁফে কয়েকবার আলতো করে আঙুল বোলালেন৷ তারপর গোঁফটার এদিক-ওদিক আঙুল দিয়ে চাপলেন৷ যেন গোঁফটা নকল—চেপেচুপে ঠিকঠাক করে না বসালে এখুনি খুলে যাবে৷
‘কিছুই চাই না—শুধু কতকগুলো আইডিয়ার কথা শোনাতে এসেছি৷ যেমন ধরুন, বাড়িতে ঢুকে মার্ডারার আপনার ওয়াইফকে মার্ডার করার পর সম্ভবত সেই ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়েই আপনার ওয়াইফের মোবাইলটাকে থেঁতলে চুরচুর করে দিয়েছে৷
‘যদি মার্ডারার টাকাপয়সা গয়নাগাটি লুঠ করার জন্যেই বাড়িতে ঢুকে থাকে তাহলে আপনার বউয়ের মোবাইলটাকে সে খামোখা থেঁতো করতে যাবে কেন? এই কোশ্চেনটার উত্তর আমরা খুঁজে পাইনি৷