সোমপ্রকাশ আর দেরি করলেন না৷ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ তিনি পেয়ে গেছেন৷
উঠোন ঘিরে বাঁশের বেড়া৷ তারই এক জায়গায় বাখারি দিয়ে তৈরি বাউন্ডারি গেট—তারের হুড়কো দিয়ে আটকানো৷
দু-সেকেন্ডে সেই হুড়কো খুলে সোমপ্রকাশ বেরিয়ে এলেন কাঁচা রাস্তায় এবং টর্চের আলোগুলো একটু আগে যেদিকে ছুটে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করলেন৷
রাস্তার দু’পাশে নানারকম গাছপালা৷ তাদের ডালপালায় কুয়াশার ফুল ফুটে আছে৷ রাস্তার কোথাও-কোথাও শালের খুঁটিতে উলঙ্গ বালব জ্বলছে৷
চেনা রাস্তা ধরে ছুটলেন সোম৷ এই রাস্তাটা শ্রীমানীদের পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে৷ দু-বছর আগে সোম ওই প্রাইমারি স্কুলেই পড়তেন৷
সোমপ্রকাশ ছুটোছুটির ব্যাপারে বেশ দক্ষ৷ স্কুলের স্পোর্টসে তিনবার ছোট-ছোট কাপ পেয়েছেন৷ সুতরাং একটু পরেই তিনি ‘চোর! চোর!’ চিৎকার করা দলটাকে ধরে ফেললেন৷ তখন সবাই শ্রীমানীদের পুকুরের লাগোয়া একটা বড়সড় ফাঁকা জমিতে চলে এসেছেন৷
এই জমিটার চরিত্র ভারী অদ্ভুত৷ জমির মালিকানা শ্রীমানীদের হলেও তাঁরা এ জমির দিকে নজর দেন না৷ ফলে গ্রামের গরিব মানুষরা এই জমির ছোট-ছোট টুকরোয় যে-যার মরজি মতন চাষবাস করে৷ ফলে এই জমিতে পাঁচ-সাত রকম ফসল দেখা যায়৷
‘ওই যে! ব্যাটা পুকুরপাড়ের দিকে যাচ্ছে৷ ওই যে…৷’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে পেয়েছি…৷’
টর্চের আলোয় সোম একঝলক দেখতে পেলেন একটা ছেলেকে৷ রোগাটে সরু চেহারা৷ গায়ে একটা সাদা হাফশার্ট আর কালচে হাফপ্যান্ট৷ একহাতে একটা ছোট প্যাকেট গোছের কিছু রয়েছে৷
ছেলেটা তিরবেগে ছুটছে৷
পুকুরপাড়ে অনেকগুলো বড়-বড় গাছ৷ তাদের পাতা বেশিরভাগটাই ঝরে গেছে৷ শুধু কালো-কালো ডালপালা মেলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে দুটো গাছ আবার হেলে পড়েছে পুকুরের ওপরে৷ এমনভাবে হেলে পড়েছে যেন গাছের ডালপালাগুলো পুকুরের জলের কানে-কানে কিছু বলতে চায়৷
পাঁচমিশেলি খেতের ছোট-ছোট গাছ আর ভিজে মাটি মাড়িয়ে সবাই ছুটল পুকুরের দিকে৷
একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে, ওই যে! ব্যাটা ওই গাছটায় উঠছে!’ এবং একইসঙ্গে তার হাতের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল একটা বড়সড় গাছের ওপরে৷ গাছটা পুকুরের ওপরে বেশ খানিকটা হেলে রয়েছে৷
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে…!’
‘ওই যে, বেয়ে ওপরে উঠছে—৷’
গাছের ডালপালা আর অল্পস্বল্প পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সাদা শার্টের অংশ দু-এক পলকের জন্য চোখে পড়ল৷ তবে ছেলেটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠছে কি না সেটা খুব স্পষ্টভাবে ঠাহর হল না৷
গাছটার কাছ থেকে খানিকটা দূরে ছুটন্ত ভিড়টা থমকে দাঁড়াল৷ সোমপ্রকাশ খেয়াল করলেন, ভিড়টা এর মধ্যে একটু পরিপুষ্ট হয়েছে৷ হইচই চেঁচামেচি শুনে গাঁয়ের আরও কিছু লোক চোর-তাড়া-করা দঙ্গলে নাম লিখিয়েছে৷ তার মধ্যে দু-চারজন কিশোর এবং বালকও রয়েছে৷
উত্তেজিত জনতা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলছিল, উত্তেজনায় হাত নাড়ছিল৷ সেইসব কথাবার্তা থেকে সোম চোরের ‘গল্প’-টা কম-বেশি উদ্ধার করলেন৷ সেইসঙ্গে নানান টর্চের ছিটকে পড়া টুকরো-টুকরো আলোয় এটাও দেখতে পেলেন, ওই দঙ্গলের মধ্যে ওঁর বাবা, মেজকাকা এবং ছোটকাকাও রয়েছেন৷ তাঁদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটা চেনা মুখ নজরে পড়ল৷ যেমন সমীরকাকু—বেনিয়ামোড়ে ওঁর সাইকেল সারানোর দোকান আছে৷ পরেশ রায়চৌধুরী—গাঁয়ের একমাত্র পুরুতমশাই—গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন, বিয়ে, কিংবা শ্রাদ্ধ—সবকিছুতেই ওঁর ডাক পড়ে৷ হূদয়দা— গ্রামে ওঁর মুদিখানা দোকানটাই সবচেয়ে চালু দোকান৷ রঘু পোরেল—রঘুদা ঢাক বাজায়, দুর্গাপুজোয় কালীপুজোয় কলকাতায় বাজাতে যায়৷ ওর বাড়িতে তিনটে ঢাক আছে, সোমপ্রকাশ দেখেছেন৷
‘চোর! চোর!’ আওয়াজ শুনে যে যেমন পোশাকে ছিলেন সেই পোশাকেই পথে নেমে এসেছেন৷ কেউ ফুলপ্যান্ট, কেউ লুঙ্গি, কেউ বা নিতান্ত গামছা পরে আছেন৷ তবে শীত ঠেকাতে গায়ে সোয়েটার, চাদর কিংবা শাল জড়ানো৷
ভিড়ের মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে নানানরকম অস্ত্র: যেমন, লাঠি, শাবল, উনুন খোঁচানোর বাঁকানো শিক, বাখারির টুকরো, আর এপাশ-ওপাশ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আধলা ইটের টুকরো৷
সোমপ্রকাশ ভিড়ের মধ্যে এমনভাবে মিশে ছিলেন যাতে ওঁর বাবা অথবা কাকারা ওঁকে দেখতে না পান৷
সোমদের বাড়ির দু’পাশে ওঁর দু-কাকার বাড়ি৷ তার মধ্যে ছোটকাকার বাড়ির ওপাশে মিত্যুনকাকুর বাড়ি৷ মিত্যুনকাকু পেট্রোল-পাম্পে চাকরি করেন৷ ওঁর বাড়িতেই চুরির ঘটনাটা ঘটেছে৷
মিত্যুনকাকুর দাওয়াতে অনেকরকম জিনিস একজায়গায় জড়ো করে রাখা ছিল৷ মুদিখানার জিনিস আর টুকিটাকি খাওয়ার জিনিস৷ সেখান থেকেই এই চোর কীসের একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে পালায়৷ মিত্যুনকাকুর স্ত্রী ছেলেটাকে উঠোনের ওপর দিয়ে ছুটে পালাতে দেখেন এবং ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করে ওঠেন৷ তারপরই শোরগোল শুরু হয়ে যায়৷ মিত্যুনকাকু চিৎকার করতে-করতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন৷ এবং ওঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে জড়ো হয়ে যায় এবং ছেলেটা যেদিকে ছুটে পালিয়েছে সেদিক লক্ষ্য করে দৌড়োতে শুরু করে৷
সোমপ্রকাশের দু-কাকা ঘরেই ছিলেন৷ ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ‘সার্চ পার্টি’-তে জয়েন করতে ওঁদের দেরি হয়নি৷ তবে সোমের বাবার ছুটে আসতে একটু সময় লেগেছে, কারণ তিনি কালীতলার মন্দিরের চাতালে বসে তাস খেলছিলেন৷ মন্দিরের দরজা দিয়ে উপচে পড়া আলোয় তাস পেতে রোজ সন্ধেবেলায় এই আসর বসে৷