প্রথম-প্রথম ছেলের এই ‘জুনো ম্যানিয়া’ নিয়ে শ্রেয়সী এবং রণবীর বুয়ানের সঙ্গে অনেক চেঁচামেচি করেছেন৷ কিন্তু বুয়ান বারবারই বলেছে, ‘জুনো আমার পড়াশোনায় কত হেলপ করে জানো?’
‘একটা মেকানিক্যাল রোবট—সেটা আবার হেলপ করবে কী করে!’ শ্রেয়সী একইসঙ্গে অবাক এবং বিরক্ত৷
বুয়ান হেসে বলেছে, ‘ও তোমরা বুঝবে না, মা—ওটা আমাদের দুজনের সিক্রেট…৷’
রণবীর ধৈর্য হারিয়ে বলেন, ‘কী যে সব এলোমেলো কথা বলিস…!’
এইরকম ক’দিন ঝামেলা চলার পর বুয়ানের ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট বেরোতে শুরু করল৷ এবং তখনই শ্রেয়সী আর রণবীর চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন৷ কারণ, বুয়ান দারুণ সব নম্বর পেয়েছে৷ সব ক’টা এগজ্যামেই গ্রেড ‘ও’—আউটস্ট্যান্ডিং৷ এর আগে ও কখনও এত ভালো স্কোর করতে পারেনি৷ সুতরাং, বুয়ানকে তখন আর পায় কে!
সত্যিই জুনো ওকে অনেক হেলপ করে৷ জুনো অনেক বিষয়ে অনেক কিছু জানে৷ ওর সামনে বুয়ান এ পর্যন্ত যত পড়াশোনা করেছে তার সবটুকুই জুনোর মগজ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে৷ যখন-তখন ও বুয়ানের পড়ার ভুল শুধরে দেয়৷ এ ছাড়া নতুন অনেক কিছু শিখিয়ে দেয় ওকে৷ রণবীর আর শ্রেয়সী যখন কাছে থাকেন না তখনই ওদের দুজনের মধ্যে এইসব কথাবার্তা হয়৷ আর যদি ওঁদের দুজনের কেউ একজন কাছে থাকেন তা হলে জুনোর ছক বাঁধা ‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ শুরু হয়ে যায়৷
একদিন সন্ধেবেলা বুয়ান একটা বই পড়ছিল৷ বেশ বড় মাপের বাঁধানো বই৷ তাতে অনেক রঙিন ছবি৷ বইটার নাম ‘মাই বিগ এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ডাইনোসরস’৷
বুয়ান পড়ছিল আর অবাক হয়ে ডাইনোসর যুগের হরেকরকম প্রাণীর ছবি দেখছিল৷
জুনো বইটার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল৷ বুয়ানের পড়া শুনে ও ধাতব গলায় বলে উঠল, ‘এটা মেসোজোয়িক যুগের ব্যাপার৷ এই যুগের টাইম লেংথ হচ্ছে একশো বিরাশি মিলিয়ন বছর৷ এই সময়ের মধ্যে রয়েছে তিন-তিনটে পিরিয়ড: ট্রায়াসিক পিরিয়ড, জুরাসিক পিরিয়ড আর ক্রিটেইশাস পিরিয়ড৷ ট্রায়াসিক পিরিয়ডে ছোট-ছোট ডাইনোসরের জন্ম হয়৷ জুরাসিক পিরিয়ডে ওরা সংখ্যায় আর মাপে বেড়ে ওঠে৷ সবচেয়ে বড় তৃণভোজী ডাইনোসর ছিল অ্যাপাটোসরাস, আর সবচেয়ে বড় মাংসাশী ডাইনোসর ছিল টিরানোসরাস রেক্স৷ তারপর ক্রিটেইশাস পিরিয়ডে ওদের মাপ আর দাপট আরও বাড়তে থাকে৷ বাড়তে-বাড়তে হঠাৎই সব শেষ৷ সায়েন্টিস্টদের আইডিয়া হল, একটা প্রকাণ্ড ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে৷ আর সেই মহা সংঘর্ষেই ডাইনোসররা একদম খতম৷ এই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল প্রায় পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে…৷’
জুনোর কথা শুনতে-শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল বুয়ান৷ কারণ, রোবটটা এমন অনেক কথা বলছে যেগুলো বইটাতেও লেখা নেই!
বুয়ানের কী মনে হল, ও বই বন্ধ করে উঠে পড়ল৷ বলল, ‘জুনো, জাস্ট এক মিনিট ওয়েট করো৷ আমার টিরানোসরাস রেক্সের একটা ব্লক আছে৷ ওটা কিছুদিন আগে আমি তৈরি করেছিলাম৷ এক্ষুনি নিয়ে আসছি৷ ওই ডাইনোসরটা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে…৷’
বুয়ান ছুটে চলে গেল শোওয়ার ঘরে৷ সেই ঘরের এক কোণে ওর খেলনার পাহাড়৷ ক্লাস ফাইভে পড়ে অথচ এখনও ও ছোট বাচ্চার মতো খেলনা নিয়ে খেলতে ভালোবাসে৷
আধ মিনিটের মধ্যেই টিরানোসরাস রেক্সকে হাতে নিয়ে ফিরে এল ও৷ ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে এল জুনোর কাছে৷
‘এই দ্যাখো, জুনো, কী সুন্দর দেখতে৷ টিরানোসরাস রেক্স…৷’
প্রাণীটা দেখতে বড় ভয়ংকর, হিংস্র৷ অসংখ্য তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত৷ সবুজ, কালো আর বাদামি রং৷ গা-টা চকচক করছে, আলো পিছলে যাচ্ছে এমনভাবে যে, মনে হচ্ছে সারা গায়ে লালা মাখানো৷ একটা প্রকাণ্ড টিকটিকি যেন দু-পায়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সামনের দুটো পা ছোট, মাথাটা বড়৷ মুখটা হাঁ করা৷
এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটাকেই ছোট-ছোট পলিমারের ব্লক জুড়ে-জুড়ে বুয়ান তৈরি করেছে৷ মাপে ছোট একটা মডেল হলেও প্রাণীটা একেবারে যেন জীবন্ত৷
‘অ্যানিম্যালটা দারুণ ইন্টারেস্টিং দেখতে…৷’ জুনো বলল৷
বুয়ানের মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চাপল৷ আচ্ছা, ডাইনোসরের দেশে অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে কেমন হয়? ওঃ, একটা সুপার-ডুপার অ্যাডভেঞ্চার হবে তা হলে!
সেই কথাটাই জুনোকে জিগ্যেস করল বুয়ান৷
জুনো ওর ধাতব গলায় উত্তর দিল, ‘সেটা পসিবল নয়, ফ্রেন্ড৷ কারণ, ডাইনোসরদের ল্যান্ডে যেতে হলে আমাদের টাইম ট্র্যাভেল করতে হবে৷ আর টাইম ট্র্যাভেল করতে হলে টাইম মেশিন চাই৷ ব্যাড লাক, আমাদের কোনও টাইম মেশিন নেই৷’
শুনে মুখ ব্যাজার করল বুয়ান৷ ওঃ, একটা মেশিনের জন্য একটা অ্যাডভেঞ্চার ফসকে গেল!
এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন শ্রেয়সী৷
‘বুয়ান, তোর রুটিন ধরে স্কুলের ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে? নাকি কাল স্কুল আছে সেটা ভুলে গেছিস!’
বুয়ান সঙ্গে-সঙ্গে ডাইনোসরের বই বন্ধ করে উঠে পড়ল, বলল, ‘এই দ্যাখো না, এক মিনিটে গুছিয়ে নিচ্ছি…৷’
জুনো ওর প্রোগ্রাম বাঁধা সংলাপ শুরু করে দিল৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’
আবার নতুন দুটো ব্লক কিনল বুয়ান৷ একটা অ্যাপাটোসরাস, আর-একটা চাঁদ৷ ওর পড়াশোনা ভালো হচ্ছে, পরীক্ষাতেও ভালো-ভালো নম্বর পাচ্ছে, তাই শ্রেয়সী বা রণবীর ছেলের নতুন বায়না মেটাতে আর আপত্তি করেননি৷