‘আই অ্যাম ইয়োর ফ্রেন্ড৷’
‘আমিও তোমার বন্ধু৷’
‘আই লাভ ইউ৷’
‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি৷’
‘কাম, লেট আস প্লে৷’
‘হ্যাঁ, চলো—আমরা খেলি৷’
তারপরই জুনো চুপ৷ কারণ, এই চারটি কথা শোনানোর ব্যবস্থাই করা আছে জুনোর সিস্টেমে৷ আর এক-একটা সংলাপ বলার পর জুনো চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ৷ সেই চুপ করে থাকার সময়টুকুতে বুয়ান ওর ইচ্ছেমতো উত্তর দেয়৷
জুনো রোজ একইরকম কথা বারবার বলে, কিন্তু বুয়ানের সেটা মোটেই একঘেয়ে লাগে না৷ তা ছাড়া ওর বিশ্বাস, জুনো ওর সঙ্গে মিশে একদিন না একদিন নতুন-নতুন কথা বলতে শিখবে৷
এই বিশ্বাসের কথা মা আর বাপিকেও জানিয়েছে বুয়ান৷ শুনে যা হওয়ার তাই হয়েছে: ওঁরা দুজনেই হেসে ফেলেছেন৷
‘তাই আবার কখনও হয় না কি? জুনো তো একটা মেশিন—মানুষ তো আর নয়!’ বাপি৷
‘জুনো তোর সঙ্গে নতুন-নতুন কথা বলতে না পারুক, তুই তো পারিস! তুই ওর সঙ্গে মন খুলে গল্প কর—৷’ মা৷
তো সেটাই করে বুয়ান৷ জুনোর সঙ্গে অনেক গল্প করে৷ ওকে স্কুলের নানান বন্ধুর কথা শোনায়, টিভিতে দেখা প্রোগ্রামের গল্প বলে, বলে টিনটিনের চাঁদে অভিযানের গল্প, ডাইনোসরের গল্প, মহাকাশের গল্প, আরও কত কী!
বুয়ানের এক-একসময় হঠাৎ করে মনে হয়, গল্প শুনতে-শুনতে জুনো মাথা নাড়ছে৷
মাঝে-মাঝে ডাইনোসর আর মহাকাশের বই নিয়ে জুনোর সামনে বসে পড়ে বুয়ান৷ বইগুলো বড় মাপের, তাতে সুন্দর-সুন্দর রঙিন ছবি৷ সেইসব বই থেকে জুনোকে পড়ে-পড়ে শোনায়৷ জুনো সেসব বুঝতে না পারলেও কথা বলে যায়—ওর সেই পুরোনো কথা৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ ‘আই অ্যাম ইয়োর ফ্রেন্ড৷’ ইত্যাদি৷
যতই পুরোনো হোক কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে বুয়ানের৷ তবে মাঝে-মাঝে মনে হয়, ইস, জুনো যদি নতুন-নতুন কথা বলতে পারত!
একদিন সন্ধেবেলা একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল৷
তখন ঘড়িতে ক’টা বাজে? সাতটা কি সওয়া সাতটা৷ আধঘণ্টা ধরে বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ মাঝে-মাঝেই আকাশ আলোয় ভাসিয়ে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, আর তার পরেই কড়-কড়-কড় কড়াৎ৷ কানফাটানো আওয়াজে কেঁপে উঠছে বাড়ি৷
বাজ পড়ার ব্যাপারটাকে শ্রেয়সী ভীষণ ভয় পান৷ তাই বাজের প্রতিটি আওয়াজের পরপরই তিনি ভয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠছেন এবং সেই চিৎকার থামানোর জন্য রণবীর বারবার বলছেন, ‘কী হচ্ছে, শ্রেয়সী! কেন এমনি করে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করছ!’
বুয়ান তখন জানলা-টানলা বন্ধ করে পড়াশোনা করছিল৷ পাশের টেবিলে জুনো হেঁটে বেড়াচ্ছিল, কথা বলছিল৷ বুয়ান বাজ পড়ার শব্দকে মোটেই ভয় পায় না৷ কিন্তু বাজ-টাজ পড়লে মায়ের এই ছেলেমানুষি কাণ্ড দেখতে ওর খুব মজা লাগে৷ তাই ও পড়া ফেলে ছুটল মায়ের কাণ্ড দেখতে৷ এবং সেই কাণ্ড দেখে ও তো হেসেই কুটিপাটি৷ ও আর বাপি মা-কে বাজ পড়ার ভয় দেখিয়ে মজা করতে লাগল৷
একটু পরেই বুয়ান চলে এল ওর পড়ার ঘরে৷ ঝড়-বৃষ্টির দাপট তখন আরও বেড়েছে৷ জুনো টেবিলের ওপরে ওর নিজের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছিল৷
হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে ঘরের একটা জানলা খুলে গেল৷ সোঁ-সোঁ হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে৷ সেইসঙ্গে বৃষ্টির ছাট৷ বিকট শব্দে বাজ পড়ল কাছেই৷ এবং জুনো উলটে পড়ে গেল টেবিলের ওপরে৷
বুয়ান প্রায় দৌড়ে গেল টেবিলের কাছে—জুনোকে সোজা করে দাঁড় করাতে গেল৷ কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে জুনো নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, চলতে শুরু করল আগের মতো৷
ব্যাপারটা কী হল?
বুয়ান হাঁ করে তাকিয়ে রইল আট ইঞ্চি মাপের রোবটটার দিকে৷ ওটা যে পড়ে গেলে আবার নিজে-নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারে এমন কথা দোকানের সেলসম্যান ছেলেটিও বলেনি, আর ম্যানুয়াল পড়ে বাপিও কিছু বলেননি৷ তা হলে?
বুয়ান ওর পড়ার টেবিলে বসে পড়ল৷ রিমোটটা রাখা ছিল কম্পোজিট ম্যাথ বইটার পাশেই—সেটা তুলে নিয়ে বোতাম টিপে জুনোকে থামাল৷ তারপর ‘রোটেট’ বোতাম টিপে জুনোকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করাল৷ ওর শরীরের এল. ই. ডি. বাতিগুলো দপদপ করে জ্বলছে নিভছে৷
‘ব্যাপার কী, জুনো? তুমি পড়ে গেলে নিজে-নিজে উঠে দাঁড়াতে পারো?’
‘পারি—’ পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিল বুয়ানের রোবট, ‘এটা সিক্রেট৷ আর কেউ যেন জানতে না পারে৷ তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷’
বুয়ান কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারল না৷ জুনো এরকম পালটে গেল কী করে! ওর ‘টেল মি হোয়াই’ সিরিজের বই পড়ে ও জেনেছে, বাজ পড়া মানে হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটির ডিসচার্জ৷ সেই সময় কাছাকাছি কোনও ধাতুর জিনিস থাকলে তার মধ্যে ভোল্টেজ তৈরি হয়—ইনডিউসড ভোল্টেজ৷ সেরকম কিছু হয়েই কি জুনো পালটে গেল? ওর ভেতরের প্রোগ্রামের বাইরে কাজ করতে লাগল? হিসেবের বাইরে কথা বলতে লাগল?
বুয়ানকে চমকে দিয়ে জুনোর এই পালটে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হল বুয়ান৷ কিন্তু ব্যাপারটা সিক্রেট রাখতে হবে৷ ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে সে-কথাই বলেছে৷
এরপর থেকে বুয়ানের দিন আর রাত কেমন পালটে গেল৷ জুনোর সঙ্গে ওর ‘সিক্রেট বন্ধুত্ব’ ক্রমশই বাড়তে লাগল৷ রণবীর আর শ্রেয়সী সেই আড়ালের বন্ধুত্বের কথা মোটেও জানতে পারলেন না৷
বুয়ান যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ জুনো ওর সঙ্গে-সঙ্গে থাকে৷ এমনকী খাওয়ার টেবিলে যখন বুয়ান খেতে বসে তখনও জুনোকে ওর চেয়ারের পাশে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে রাখে৷ এ ছাড়া টিভি দেখা, কমিকস কিংবা গল্পের বই পড়ার সময়, অথবা পড়াশোনার সময় জুনো তো পাশে আছেই!