বুয়ান ‘মুভ’ লেখা সুইচটা অন করে দিল৷ সঙ্গে-সঙ্গে জুনো চলতে শুরু করল৷
ওঃ, কী অদ্ভুত ওর চলার ধরন! সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা ছেলের মতো একটু সময় নিয়ে একটা-একটা করে পা ফেলছে৷ একইসঙ্গে মাথাটা এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে গোল-গোল চোখজোড়া মেলে কী দেখছে ও-ই জানে!
রোবটটার চোখের মণির জায়গায় সাদা রঙের এল. ই. ডি. লাগানো ছিল৷ সুইচ অন করে দিতেই সেই আলোগুলো এখন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে৷ তার সঙ্গে বুকের এল. ই. ডি.-গুলো দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে৷
বুয়ান মুগ্ধ চোখে জুনোর চলা-ফেরা দেখছিল৷ ওর চলার সময় মোটরের আওয়াজ প্রায় শোনাই যাচ্ছে না৷ বাপি বলেছেন, রোবটের চলার জন্য মোটর ব্যবহার করা হয়৷ জুনোর মোটরটা নিশ্চয়ই খুব হাই-ফাই, তাই আওয়াজ কম৷
কিন্তু আরও একটা ব্যাপার বুয়ানকে খুব অবাক করল৷ হাঁটতে-হাঁটতে জুনো যখন টেবিলের কিনারার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তখনই ও থমকে দাঁড়াচ্ছে নিজে থেকেই৷ তারপর ডানদিকে ঘুরে আবার চলতে শুরু করছে৷ কী করে রোবটটা বুঝতে পারছে যে, ও টেবিলের কিনারায় এসে গেছে—আর এগোলেই ও টেবিল থেকে নীচে পড়ে যাবে?
এই জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে বুয়ান চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘বাপি! বাপি! মা! মা! শিগগির আমার পড়ার ঘরে এসো…৷’
ওর ডাকে তাড়াহুড়ো করে চলে এলেন দুজনেই৷ কিছুক্ষণ ওঁরা অবাক বিস্ময়ে জুনোর চলে বেড়ানো দেখলেন৷ তারপর বুয়ানের প্রশ্নের উত্তরে রণবীর বললেন, ‘শোন, জুনোর চোখে অপটিক্যাল সেন্সর লাগানো রয়েছে৷ সেই সেন্সর বুঝতে পারছে যে, টেবিলের সারফেসটা শেষ হয়ে গেছে—সুতরাং আর এগোনো ঠিক হবে না৷ সেই সিগন্যালটা চলে যাচ্ছে জুনোর ভেতরের কম্পিউটার-ব্রেইনে৷ ব্রেইন জুনোর মোটরকে থামিয়ে দিচ্ছে—তারপর ওর চলার দিক ডানদিকে, নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিচ্ছে৷ সবমিলিয়ে খুব কমপ্লিকেটেড ব্যাপার…৷’
কমপ্লিকেটেড ব্যাপার যে তাতে সন্দেহ নেই৷
রোবট-ফ্রেন্ড জুনোর নতুন বাক্সটা বাড়িতে এনে খোলার পর একটা মোটাসোটা ‘অপারেটিং ম্যানুয়াল’ দেখতে পেয়েছিল বুয়ান৷ মা আর বাপিকে ও ম্যানুয়ালটা পড়ে ফেলার দায়িত্ব দিয়েছিল৷ শ্রেয়সী আবার সেটা কায়দা করে রণবীরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন৷ অগত্যা রণবীর স্কুল-কলেজের পড়াশোনার মতো সেটা স্টাডি করেছেন এবং সাধ্যমতো বুয়ানের খটোমটো প্রশ্নের থতোমতো জবাব দিয়েছেন৷
শ্রেয়সী বুয়ানকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে, তোর হোমটাস্ক কতটা এগোল?’
‘হবে, মা৷ জুনোর ব্যাপারটা এই তো সবে কমপ্লিট হল৷ কাল থেকে আমার হোমটাস্ক স্টার্ট—৷’
রণবীর হেসে বুয়ানের মাথায় একটা আদরের চাঁটি মেরে বললেন, ‘দেখা যাক, কাল থেকে তোমার হোমটাস্ক স্টার্ট হয় কি না৷ নইলে জুনোকে আবার দোকানে রিটার্ন করে দেব—৷’
‘সত্যি বলছি, বাপি, কাল থেকে হোমটাস্ক স্টার্ট করবই৷ গড প্রমিস৷’
শ্রেয়সী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই রোবটের ব্লকটা ওকে কিনে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে৷ এখন লেখাপড়া বাদ দিয়ে ক’দিন ধরে চলবে শুধু রোবট আর রোবট—৷’
রণবীর শ্রেয়সীকে পালটা বললেন, ‘যতদূর মনে পড়ছে, আমি তো এটা কিনে দেওয়ার এগেইনস্টেই ছিলাম৷ কিন্তু কে একজন যেন বুয়ানের হয়ে ওকালতি করেছিল…৷’
শ্রেয়সী ছেলের বইপত্রের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘তখন তো আর জানি না, রোবটের নেশায় লেখাপড়া লাটে উঠবে! যাকগে, রাত দশটা বেজে গেছে, এখন খেতে চলো দেখি! বুয়ান, জুনো যেমন আছে থাক, এখন চলো তো, খেতে চলো…৷’
বুয়ান জুনোর রিমোটের ‘স্টপ’ বোতাম টিপে দিল৷ তারপর ওর কাছ থেকে উঠে পড়ল৷ তবে ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় দুবার ওর দিকে পিছন ফিরে তাকাল৷ যেন বলতে চাইল, ‘তুমি টেবিলে দাঁড়িয়ে একটু রেস্ট নাও, আমি পাঁচমিনিট পরেই আসছি…৷’
জুনোকে নিয়ে বুয়ান এমন মেতে উঠল যে, জুনো হয়ে গেল ওর ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’৷ তবে একইসঙ্গে ও পড়াশোনা শুরু করল মন দিয়ে৷ আর সত্যি-সত্যিই স্কুলের সামার ভ্যাকেশনের হোমটাস্ক রোজ নিয়ম করে করতে লাগল৷
বুয়ানের পড়ার টেবিলের ডানদিকে আর-একটা টেবিল বসানো হয়েছে৷ সেই টেবিলটা জুনোর জন্য৷ জুনো সবসময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, নয় চলাফেরা করে৷ ওকে পাশে রেখে বুয়ান পড়াশোনা করে৷ কখনও-কখনও ওর সঙ্গে কথা বলে, কিংবা ‘টক’ বোতাম টিপে জুনোর কথা চালু করে দেয়৷ ওর কথা শোনে, কখনও বা পালটা কথাও বলে, কিন্তু জুনো বুয়ানের কথা বুঝতে পারে না বলে ওর ভেতরের সেট করা প্রোগ্রাম অনুযায়ী নিজের কথা বলেই যায়৷
জুনোর ব্যাপার নিয়ে ছেলের এই পাগলামিতে শ্রেয়সী বা রণবীর নাক গলাননি, বাধাও দেননি৷ বরং ওঁরা লক্ষ করেছিলেন, জুনো বাড়িতে আসার পর থেকে বুয়ানের লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ অনেক বেড়ে গেছে৷ অনেক সময় ওঁদের মনে হয়েছে, বুয়ান যেন জুনোকে দেখিয়ে-দেখিয়ে ওর পড়াশোনার বহরটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে৷
একদিন সন্ধেবেলা পড়াশোনার মাঝে ব্রেক নিয়ে জুনোর সঙ্গে খেলতে শুরু করল বুয়ান৷ ‘টক’ বোতাম টিপে ওর কথা চালু করে দিল৷ জুনো ওর প্রোগ্রাম অনুযায়ী বাঁধাধরা কথা বলতে লাগল৷
‘হাই, মাই নেম ইজ জুনো৷’ একটু জড়ানো ধাতব কণ্ঠস্বর৷ তবে কী বলছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়৷
বুয়ান জুনোর কথার জবাব দিল: ‘আমার নাম বুয়ান৷ ভালো নাম অঙ্কুশ৷’