তা হলে কি অজয়দের দোকানটার হাতবদল হয়েছে? পঞ্চাশ বছর সময়ের মধ্যে সেটা হতেই পারে৷ একবার কেন, দু-চারবারও হাতবদল হয়ে থাকতে পারে৷ কিন্তু ছেলেটিকে অজয়ের কথা একটিবার অন্তত জিগ্যেস না করে আমি ফিরে যাব না৷
‘ভাই, এটা কি অজয়দের দোকান? অজয়—মানে, আমার সঙ্গে ও স্কুলে পড়ত…৷’
ছেলেটি হেসে বলল, ‘আপনি আমার বাবাকে চেনেন? হ্যাঁ, বাবা ওই স্কুলটাতেই পড়ত—৷’
‘অনেক বছর পর ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি—একবার দেখা করা যাবে?’
ছেলেটি ঘাড় কাত করল: ‘হ্যাঁ—কেন যাবে না? বাবা তো সবসময় বাড়িতেই থাকে…৷’
কথা বলতে-বলতে ছেলেটি কাউন্টারের কাঠের ডালা তুলে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল৷ হাত দুটো ঘষে-ঘষে পাজামায় মুছল৷ পাশেই একটা ছোট টেলারিং-এর দোকান ছিল৷ সেই দোকানের ভেতরে গলা বাড়িয়ে ছেলেটি কাকে যেন বলল, ‘পারভেজদা, আমার দোকানটা একটু দেখো তো৷ আমি এই কাকুকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি৷ উনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—৷’
টেলারিং-এর দোকানের ভেতর থেকে কারও তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল: ‘ঠিক আছে৷ তবে জলদি-জলদি ব্যাক কোরো—৷’
আমরা রওনা হলাম৷ ছেলেটি আগে, আমি পেছনে৷
বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ-দিকের গলি৷ সেই গলিতে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরই আবার বাঁ-দিক৷ এবারে আরও সরু একটা গলি৷ সেখানে অনেক পুরোনো-পুরোনো খাটো মাপের সব বাড়ি৷ তারপর কয়েকটা বাড়ির পরেই একটা মলিন বাড়ির ছোট্ট দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ছেলেটা৷ পেছন ফিরে আমাকে ডাকল, ‘আসুন—৷’
শেষ পর্যন্ত একটা ঘরে এসে পৌঁছোলাম৷
ছোট মাপের ঘর৷ বাতাসে পুরোনো গন্ধ৷ ঘরে একটা খাট, আর দুটো টুল৷ একপাশে একটা টেবিলে বই, খবরের কাগজ আর কয়েকটা জামাকাপড় ডাঁই করা৷ দেওয়ালের কোণে একটা সেলাই-মেশিন৷ দেখেই বোঝা যায়, বহুদিন ওই মেশিনে কেউ হাত দেয়নি৷
ঘরের শেষ আইটেম হল, বিছানায় বসে থাকা একজন বয়স্ক মানুষ৷ খালি গা, পরনে লুঙ্গি, রোগা, গাল বসা, মাথায় টাক৷ খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি- গোঁফ৷ পাঁচ দশক আগে দূর থেকে যে-মানুষটিকে আমি ‘দাদুভাই স্টোর্স’-এর কাউন্টারে দেখেছিলাম৷
তখনই আমি অজয়কে চিনতে পারলাম৷
ছেলেটি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা, ইনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—তোমার স্কুলের বন্ধু…৷’
অজয় আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷ বোধহয় পুরোনো ‘আমি’-টাকে খুঁজছিল৷
একটা টুল দেখিয়ে ছেলেটি আমাকে বলল, ‘আপনি বসুন৷ বাবার সঙ্গে কথা বলুন৷ আমি দোকানে যাই—নইলে পারভেজদা আবার খচে যাবে—৷’
এই কথা বলে অজয়ের ছেলে চলে গেল৷
আমি একটা টুল টেনে নিয়ে অজয়ের কাছে বসলাম৷
‘অজয়, কেমন আছ? আমি অনীশ—৷’
অল্প হেসে অজয় বলল, ‘ও—৷’
বুঝলাম, আমাকে ওর একটুও মনে নেই৷ আবার জিগ্যেস করলাম, ‘কেমন আছ তুমি?’
‘চলে যাচ্ছে, ভাই৷ গ্যাসট্রিকের পেইন নিয়ে আছি৷ লাস্ট মাসে হার্নিয়া অপারেশন হয়েছে৷’
মনে হচ্ছিল, আমার চেনা অজয় নয়, তার ছায়ার সঙ্গে আমি কথা বলছি৷
এরপর আমিই কথা বলতে লাগলাম৷ অজয় শুধু ‘হুঁ’, ‘হাঁ’ শব্দ করে ঠেকা দিতে লাগল৷
আমি ওর ছোটবেলার কাহিনি ওকেই শোনাতে লাগলাম৷ সেসব শুনে ও প্রথম-প্রথম ঠোঁটে হাসছিল, অল্প-অল্প মাথা নাড়ছিল৷ কিন্তু একটু পরেই কেমন যেন চুপ মেরে গেল৷
আমি কথা বলতে-বলতে সেই পুরোনো ‘অজয়’কে খুঁজছিলাম৷ কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেদিনের সেই হিরো?
সেই ‘হিরো’-কে অজয়ও বোধহয় খুঁজছিল৷
হঠাৎই দেখলাম, ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল বুকের কাছে৷ ওর পলকা শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল৷
আমারও কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল, তাই টুল ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ চুপচাপ বেরিয়ে এলাম ওর ঘর থেকে৷
বুঝতে পারছিলাম, আজকের ‘অজয়’ সেদিনের সেই ‘অজয়’কে সবসময় খুঁজে চলেছে৷ খুব মিস করছে সেই দুষ্টু ছেলেটাকে৷
আসলে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে দুজন করে মানুষ থাকে৷ তারা বিশাল সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়েও হাতধরাধরি করে চলতে চায়৷ একে অপরকে মিস করে৷
কিন্তু ‘অজয়’-কে তো আমরা হারাতে চাই না!
আমি চাই, আমরা যারা-যারা ‘অজয়’ হতে পারিনি তাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ‘অজয়’-রা চিরকাল বেঁচে থাকুক৷