১৯৪৭ সালে প্রথম রেলযাত্রীদের সদলে খুন করা হয়েছিল। তখন বলা হয় যে দেশ সবেমাত্র ভাগ হয়েছে, দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, গুছিয়ে নিতে তাদের কিছুটা সময় লাগবে। সৈন্যবাহিনী ও পুলিশও দুইভাগে বিভক্ত। ফলে বিভ্রান্তি হবেই, মারাত্মক অপরাধ ও হিংসা প্রায় অবশ্যম্ভাবী। ১৯৮৪ সালে যখন একই ঘটনা ঘটল তখন বলা হল যে, একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বনেত্রীকে খুন করা হয়েছে, মহীরূহ উপড়ে গেলে উথাল-পাথাল হওয়া বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াটাই তো স্বাভাবিক। অবস্থা এখন এইরকম যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে লোককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলে কোনও রকম ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতির কৈফিয়ৎ খাড়া করাও যেন অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। সংবাদপত্রগুলি কখনও কখনও বিনা মন্তব্যে ভেতরের পতায় এই জাতীয় খবর ছাপায়।
হিংসাকে ঘিরে এই জাতীয় আলোচনা ‘ঘটনাগুলিকে’ অসাধারণ বলে চিহ্নিত করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একেবারে সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে আনে, নজরে পড়ার অযোগ্য, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় বলে সরিয়ে রাখে। এই প্রসঙ্গে আমি ভাগলপুর থেকে তুলে আনা এক ‘খণ্ড’ বয়ানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই ‘খণ্ড’ বয়ানটি হিংসার প্রেক্ষিতকে কিছুটা বদলে দেয়, আজকের দিনের ‘সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের’ ভিন্ন অর্থ তুলে ধরে। শুধু আর-এক ধরনের ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ’ হিসাবে এই খণ্ড বা ভগ্নাংশটিকে পেশ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিশেষ অভিজ্ঞতায় ও উপলব্ধিতে বিধৃত অন্য এক বিষয়ীর নিজস্ব অবস্থানগত বোধের প্রকাশ হিসেবে খণ্ডটিকে বিচার করা যেতে পারে। এতে আমাদের নিজেদের বিষয়গত অবস্থান ও উপলব্ধির মাপকাঠিও পরিষ্কার হতে পারে। এ ছাড়া আমাদের ইতিহাসচর্চায় সর্বজ্ঞ হবার প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতাও বোধের এই প্রকাশে ধরা পড়ে।
আলোচ্য এই ভগ্নাংশটি ভাগলরপুরের কলেজের এক শিক্ষকের লেখা একটি কাব্য সংকলন।৩১ শিক্ষক নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী অধ্যুষিত, হিন্দু-মুসলিম একটি মিশ্র এলাকার বাসিন্দা। খুব বড় রকমের হত্যাকাণ্ড এখানে হয়নি। কিন্তু এলাকাটি বারবার আক্রান্ত হয়েছে। ফলে অঞ্চলটি চিরতরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, ক্ষতবিক্ষত থেকে যাবে। সংঘর্ষ হবার প্রথম পাঁচদিনের মধ্যে মনাশির আশিক হরগাঁভি বেশির ভাগ কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাগুলিতে সেই সময়ে ভাগলপুরের অনেক বাসিন্দাদের আতঙ্ক ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতির আভাস পাওয়া যায়। কবিতায় আছে অন্ধকারের কথা, দীর্ঘ নিশিযাপনের অভিজ্ঞতা এবং সেই সব দিন ও রাতের কাহিনী, যাদের আবর্তন যেন নিরর্থক ও অন্তহীন। কবিতায় ধরা পড়েছে সময়ের উন্মত্ত বিফল আর্তনাদ, শোনা গেছে লুটেরাদের চিৎকার। অট্টহাসির তলায় ডুবে গেছে সাহায্য পাবার আকুল আর্তি।
জান লেভা হঁসি প্রাণ হিম করে দেওয়া হাসি
ভয়ানক কহ্কহে ভয়ানক অট্টরোল
বচাও কি আঁওয়াজে (আমাদের) বাঁচাবার আর্তিগুলি
ফাঁসে রহ গঁয়ে। দাঙ্গাবাজদের মধ্যে হারিয়ে গেল।
মাঠভর্তি পড়ে থাকা লাশের চিত্রকল্প আছে, লাশগুলিকে গোনাও অসম্ভব।
এক…তিন…সত্তর এক-তিন-সত্তর
সই-দোসও-ঢাইসও শ-দুশ-আড়াইশ
যহ গিনতি পার নহী লগেগী এই গুনতি আর শেষ হবার নয়
ইনহে গিনানে সে পহলে হী কারণ শেষ হবার আগেই
তুম আ জাতে হো তুমি আবার আসবে
বম্ আউর গোলি লেকর বোমা আর গুলি নিয়ে
গিনতি কি তাদাদ বঢ়ানে গুনতির সংখ্যা বাড়াতে;
লম্হে কি রূপহলী তসবীর, কেউ এসে দেখুক
কোই দেখে আকর। কি রূপালি এই মুহূর্ত।
‘জেগে ওঠার’ রূপকল্প থাকে, অন্ধকারের অবসানের পর আলোর আভাস পাবার প্রতীক্ষা থাকে। কিন্তু তারই সঙ্গে থাকে ভয়াবহ আতঙ্ক, লুটেরাদের ফিরে আসার আশঙ্কা।
দাঙ্গই ফির আয়েঙ্গে দাঙ্গাবাজরা আবার আসবে
অ্যায়সা হ্যায় ইন্তেজার। তারই জন্য অপেক্ষা।
এই কাব্য সংকলনে অনেক ধর্ষণের কথা আছে। একটা সম্প্রদায়ের অবমাননার রূপকও হতে পারে, অথবা কোনও সত্য ঘটনার আক্ষরিক বর্ণনাও হওয়া সম্ভব।
মর গয়ে বেটে মেরে আমার ছেলেরা মরেছে
বিবি মেরী বৌটাও
ঔর য়হ বেটি জিসে তুম সাধ আর পাশে বসে থাকা এই মেয়েটি
মেরে কনখিঁয়ো সে দেখতে হো যাকে তুমি চোখের কোণ দিয়ে দেখছ
বেশুমার হাঁথোনে লুটা হ্যায় ইসে। কত শত হাত একে লুটেছে।
এইরকম কাব্যাংশের মতো অসংখ্য টুকরো পংক্তি আছে যার উদ্দিষ্ট প্রতিবেশি বা বন্ধু বা সেই সব লোক যারা একদিন পড়শি বা মিত্র ছিল। পড়শিরা আজ খুনেতে রূপান্তরিত, চেনা অচেনা মানুষেরা একে অপরের থেকে দূরে পালাচ্ছে, লোকে বা ‘আমরা সবাই’ আরশিতে মুখ দেখতে পচ্ছি, না জানি কি দেখব। কবিতাগুলিতে শোনা আবেদন আর অভিযোগ, আঁকা হয় নিঃসীম শূন্যতার ছবি।
কুছ ভী নহী রহা গয়া হ্যায় কহী
(কোথাও কিছু অবশিষ্ট নেই)
আদমী বহুৎ হী বওনা হো চুকা হ্যায়
আপনী লম্বাই কা ঝুঠা এহসাস ভী
বাকী নহি বচা
(মানুষ বামনের মত খর্ব হয়ে গেছে,
নিজের উচ্চতা সম্পর্কে মিছে বিশ্বাসও
আর শেষ অবধি রইল না)
হম বেহদ খোখলে হো গয়ে হ্যায়।
(আমরা একেবারে ফোঁপরা হয়ে গেছি)
আধে আধুরে লোক
(অর্ধেক অসমাপ্ত মানুষ)
আমাদের নিজেদের, প্রিয়-জনদের ও বন্ধুদের খুঁজে বার করার ব্যাকুলতা থেকে যায়: