- বইয়ের নামঃ নিম্নবর্গের ইতিহাস
- লেখকের নামঃপার্থ চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
মুখবন্ধ / সূচীপত্র
‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’-এর প্রথম সংকলন প্রস্তুত করার ভার আমাদের দু-জনের ওপর ন্যস্ত হয়েছিল কয়েক বছর আগে। প্রধানত আমাদের গাফিলতিতেই প্রকাশনায় এত দেরি হল। তা হলেও, বিলম্বের একটা কারণ এখানে বুঝিয়ে বললে ক্ষতি হবে না। সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বাংলা পত্রপত্রিকায় এ-বিষয়ে আলোচনা হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর সঙ্গে যুক্ত লেখকেরা অনেকে। তাঁদের গবেষণা নিয়ে মৌলিক বাংলা প্রবন্ধও লিখেছেন। বাংলা সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা যখন প্রথম নেওয়া হয়, তখন তা ইংরেজি সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রবন্ধের অনুবাদ সংকলন হিসেবে ভাবা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়। কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, বাংলায় নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা খানিকটা নিজের পথে এগিয়ে গিয়েছে। তার গুরুত্ব স্বীকার করতে গিয়ে পুরনো পরিকল্পনা বদলাতে হল। ইতিমধ্যে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মূল প্রকল্পেও নানা বিবর্তন ঘটতে থাকে। এইভাবে গত সাত-আট বছরে এই সংকলনের সূচি বেশ কয়েকবার পালটাতে হয়েছে। আশা করছি বর্তমান সংকলনটি থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার ধারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে, তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।
আমাদের কাজে অনেকের সাহায্য পেয়েছি। সংকলনে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করানো হয়েছিল। পরিকল্পনা বদলে যাওয়ায় অধিকাংশই এখানে নেওয়া হল না। অনুবাদের কাজ কষ্টসাধ্য। তাই অনুবাদকদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্জনাও চাইতে হচ্ছে তাঁদের সকলের অনুবাদ আমরা ব্যবহার করতে পারলাম না বলে। সম্পাদনার কাজে অমূল্য সাহায্য পেয়েছি অরুণ নাগ-এর কাছে। তাঁর সযত্ন পরামর্শ সত্ত্বেও যে-সব ভুলত্রুটি থেকে গেল তার জন্য দোষী আমরা। এক্ষণ, বারোমাস, যোগসূত্র ও অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দেওয়ার জন্য ওই পত্রিকার সম্পাদকদের ধন্যবাদ।
গৌতম ভদ্র
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা, ১ জানুয়ারি ১৯৯৮
সূচিপত্র
- পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ভুমিকা: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস - রণজিৎ গুহ
নিম্নবর্গের ইতিহাস - শাহিদ আমিন
গান্ধী যখন মহাত্মা - রণজিৎ গুহ
একটি অসুরের কাহিনী - ডেভিড হার্ডিম্যান
দেবীর আবির্ভাব - পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ইতিহাসের উত্তরাধিকার - দীপেশ চক্রবর্তী
শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি - বীণা দাস
হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর - গৌতম ভদ্র
কথকতার নানা কথা - জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে
ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?
ভূমিকা: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস : পার্থ চট্টোপাধ্যায়
১
সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। প্রথম সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মিলন হয় ১৯৮৩-তে। এরপর বারো বছরের মধ্যে আট খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৯৯৮-এর জানুয়ারি মাসে লখনৌতে।
গত পনেরো বছরে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর লেখাপত্রকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার মহল বেশ কিছুটা আলোড়িত হয়েছে। তার ঢেউ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞান, এমন কি ভাষা-সাহিত্য-শিল্পচর্চার এলাকাতেও গিয়ে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাস চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে আলোচনা এখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাসরচনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকে স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের নিজস্ব সাবলটার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মূল লেখাগুলো সকলে পড়ে থাকুন আর না-ই থাকুন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান চর্চার মহলে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’এখন খুবই পরিচিত একটি নাম।
প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিরূপ সমালোচনাই শোনা গিয়েছিল বেশি। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রধান কেন্দ্রগুলির কর্তাব্যক্তিরা—ভারতবর্ষে, ইংল্যান্ডে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে—এবং প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকেরা অনেকেই সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর বিরোধিতায় মুখর হয়েছিলেন। বলে রাখা দরকার, সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এবং প্রথম সংকলনে যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছিল, একমাত্র রণজিৎ গুহ ছাড়া অন্য সকলেই তখন নিতান্ত তরুণ এবং অপরিচিত লেখক। অনেকেরই প্রথম গবেষণার কাজ প্রকাশিত হয় সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ। সেদিক দিয়ে দেখলে, বিরূপ হলেও যে-পরিমাণ সমালোচনা এই সংকলনটি উদ্রেক করতে পেরেছিল তা খানিকটা বিস্ময়করই বলতে হয়। বোঝাই যাচ্ছিল, পাঠককে তুষ্ট করতে না পারলেও, তার অভ্যস্ত ধ্যানধারণাকে কোথাও একটা নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সাবলটার্ন স্টাডিজ৷
পর-পর তিন বছরে প্রথম তিনটি খণ্ড বেরিয়ে যায়। তার পাশাপাশি প্রকাশিত হয় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর লেখকদের নিজস্ব গবেষণাগ্রন্থ—জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের দি অ্যাসেন্ডেন্সি অফ দি কংগ্রেস ইন উত্তর প্রদেশ(১৯৭৮), গৌতম ভদ্র-র মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ(১৯৮১), ডেভিড হার্ডিম্যান-এর পেজান্ট ন্যাশনালিস্টস্ অফ গুজরাট (১৯৮১), শাহিদ আমিন-এর সুগারকেন অ্যান্ড সুগার ইন গোরখপুর (১৯৮৪), পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর বেঙ্গল ১৯২০-১৯৪৭; দি ল্যান্ড কোয়েশ্চেন (১৯৮৪) এবং ডেভিড আর্নল্ড-এর পুলিশ পাওয়ার অ্যান্ড কলোনিয়াল রুল (১৯৮৬)। এই পর্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া (১৯৮৩)। ভারতবর্ষের ইতিহাসের লেখক-পাঠকদের সামনে প্রথম যে দুটি বিষয় উপস্থিত করে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’—(১) ঔপনিবেশিক ভারতে উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য এবং (২) কৃষক চৈতন্যের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য—সেই দুটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বিশদ এবং তথ্যপূর্ণ আলোচনা করা হয় রণজিৎ গুহ-র বইতে। প্রথম পর্যায়ের সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে প্রবল বিতর্কের ঝড় ওঠে এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।
গৌতম ভদ্র-র বইটি বাদ দিলে এইসব লেখাপত্র সবই ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু প্রথম খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলা পত্রপত্রিকাতেও এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ১৯৮২-তে রণজিৎ গুহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বাংলায় দুটি বক্তৃতা করেন যা এক্ষণ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ শিরোনামে ছাপা হয়।১ হয়তো স্বাভাবিক কারণেই, বাংলা পত্রপত্রিকায় এ সময়কার বিতর্কে একটা প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর বিশ্লেষণপদ্ধতির সঙ্গে মার্কসীয় বিশ্লেষণপদ্ধতির সামঞ্জস্য অথবা অসঙ্গতি। ১৯৮৫-তে এক্ষণ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটির পারিভাষিক পরিচয় দিতে গিয়ে আমি এই প্রসঙ্গে খানিকটা বিশদ আলোচনা করি। প্রথম পর্যায়ের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর তাত্ত্বিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা ধারণা এই আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে, তাই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি নীচে উদ্ধৃত করলাম।২
২
Subaltern (নিম্নবর্গ): ইংরেজি ভাষায় শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে। ক্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের ‘সাবলটার্ন’বলা হয়। তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হল অধস্তন বা নিম্নস্থিত। আরিস্ততেলীয় ন্যায়শাস্ত্রে এর অর্থ এমন একটি প্রতিজ্ঞা যা অন্য কোনও প্রতিজ্ঞার অধীন, যা বিশিষ্ট, মূর্ত, সার্বিক নয়। সাধারণ অর্থে ইংরেজিতে এর সমার্থক শব্দ হল ‘সাবর্ডিনেট’।
মার্কসীয় আলোচনায় এই শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) বিখ্যাত কারাগারের নোটবই-তে। এই নোটবইতে বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু জটিলতা আছে। এটি রচিত হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে, গ্রামশি যখন মুসোলিনির কারাগারে বন্দি। সেন্সরের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর জন্য বহুক্ষেত্রে প্রচলিত মার্কসীয় পরিভাষা বর্জন করে অন্য শব্দ ব্যবহার করেন গ্রামশি। যেমন ‘মাকর্সবাদ’ কথাটা তিনি কোথাও ব্যবহার করেননি, বলেছেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন’। মার্কসের নামও ব্যবহার করেননি, বলেছেন, ‘প্রাক্সিসের দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা’। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, এই ধরনের প্রতিশব্দ উদ্ভাবন করার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসীয় ধারণাগুলি সম্পর্কে গ্রামশির নিজস্ব চিন্তা, তাদের তাৎপর্য সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধ, প্রায় অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। ‘মার্কসবাদ’-এর প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে তিনি যখন বেছে নেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন’, তখন মার্কসবাদের তত্ত্বজগতের বিশেষ একটা দিক বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায় তাঁর লেখায়। পরিভাষায় প্রচলিত অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন ব্যঞ্জনা। কারাবাসের পর্যায়ের রচনাগুলি পড়ার সময় আমরা এই রূপকসমৃদ্ধ ভাষার জায়গায় প্রচলিত পরিভাষাগুলি বসিয়ে নিয়ে পড়তে পারি নিশ্চয়। কিন্তু তাতে গ্রামশির চিন্তার জটিলতা, তার অভিনবত্ব, বহুলাংশেই হারিয়ে যাবে।
সাবলটার্ন (ইতালীয়তে সুবলতের্নো) শব্দটি গ্রামশি ব্যবহার করেছেন অন্তত দুটি অর্থে। একটি অর্থে এটি সরাসরিভাবে ‘প্রলেটারিয়াট’-এর প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ‘সাবলটার্ন শ্রেণী’ হল শ্রমিকশ্রেণী। সামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী শোষিত ও শাসিত হয়। এই বিন্যাসে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণী বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ‘হেগেমনিক’ শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজিমালিক, ‘বুর্জোয়াসি’। শ্রমিকশ্রেণী/বুর্জোয়াশ্রেণী, এই বিশেষ অর্থে সাবলটার্ন/ ‘হেগেমনিক’ শ্রেণীর সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে গ্রামশির বিশ্লেষণ আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনায় এক বিশিষ্ট অবদান। এই বিশ্লেষণে গ্রামশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির উপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়াশ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা ‘হেগেমনি’। কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘হেগেমনিক’ বুর্জোয়াশ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। গ্রামশির বিশ্লেষণে তাই গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্পর্ক, জাতি, জনগণ, বুর্জোয়াশ্রেণী ও অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক, জাতীয় জীবনের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বুর্জোয়াশ্রেণীর সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ইত্যাদি প্রশ্ন।
কিন্তু আরও সাধারণ অর্থেও ‘সাবলটার্ন’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামশির লেখায়। কেবল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নয়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অন্যান্য ঐতিহাসিক পর্বেও ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর কথা বলেছেন গ্রামশি। স্পষ্টতই এখানে ‘সাবলটার্ন-এর অর্থ শিল্পশ্রমিক শ্রেণী নয়। বরং যে-কোনও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাবিন্যাসের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উঠছে এখানে। এই বিন্যাসকে গ্রামশি দেখেছেন একটি সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে, যার এক মেরুতে অবস্থিত প্রভুত্বের অধিকারী ‘ডমিন্যান্ট’ শ্রেণী অপর মেরুতে যারা অধীন সেই ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণী। বহুক্ষেত্রেই অবশ্য গ্রামশি বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কর্তত্ব, প্রভুত্ব, শাসন এই শব্দগুলিকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে কর্তৃত্বের অধিকার, প্রভুত্বের অধিকার, শাসনের অধিকার, এই ধারণাগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কি না, গ্রামশির আলোচনা থেকে তা বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু তাই নয়, যে-কোনও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব/অধীনতার এই সম্পর্কের সাধারণ চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু মন্তব্য করা সত্ত্বেও গ্রামশি এমন কয়েকটি তাত্ত্বিক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন যার নির্দিষ্ট সমাধান তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না। উৎপাদন-সম্পর্কের দিক দিয়ে বিচার করলে এই প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্ক স্বভাবতই নানা প্রকারের উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে গ্রথিত থাকতে পারে। তবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইতালীয় সমাজে পুঁজিবাদী বিকাশের অসম্পূর্ণতার পটভূমিতে সামন্তশ্রেণীর প্রভুত্ব ও কৃষকশ্রেণীর অধীনতার চরিত্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে এসেছে গ্রামশির লেখায়। প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্কের সাধারণ চরিত্রটির সন্ধান করেছেন তিনি প্রধানত সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের ক্ষেত্রগুলিতে। দুটি মূল ঝোঁক কাজ করেছে তাঁর মধ্যে। একদিকে ইউরোপীয় মার্কসবাদের আদিপর্বে কৃষকের সংস্কৃতি, ধ্যানধারণা, আচার-আচারণ ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার ভাব ছিল, তার বিরুদ্ধে গ্রামশি বলে গেছেন ‘সাবলটার্ন’ কৃষকদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিশিষ্ট লক্ষণগুলির কথা এবং বিপ্লবী নেতৃত্ব তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে এই লক্ষণগুলিকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা ও বোঝার প্রয়োজনের কথা। অথচ একই সঙ্গে তিনি ক্রমাগত জোর দিয়েছেন কৃষকশ্রেণীর চেতনার সীমাবদ্ধতার উপর। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রভুত্বের অধিকারী যে শ্রেণী, তার চেতনার সমগ্রতা, মৌলিকতা, সক্রিয় ইতিহাসবোধের তুলনায় কৃষকচেতনা একান্তভাবেই খণ্ডিত, নির্জীব, পরাধীন। এমন কি বিদ্রোহের মুহূর্তেও তার চেতনা বহুলাংশেই আচ্ছন্ন থাকে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শের আবরণে। কৃষকের ইতিহাসবোধ, ধর্মবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির যে বিবরণ গ্রামশির লেখায় পাওয়া যায় তা থেকে এটা মনে হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয় যে বৈপ্লবিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মতে কৃষকচেতনার মূল চরিত্র মোটামুটিভাবে নেতিবাচক।
তা হলে গ্রামশি এত জোরের সঙ্গে কৃষকের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ও ভাবাদর্শের জগতটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন কেন? খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ঘটনাটা অত সরল নয়। গ্রামশি কৃষকচেতনার সীমাবদ্ধতা এবং পরনির্ভরতার কথা বলেছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু একই সঙ্গে এ-কথাও বলেছেন যে যে-কোনও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্কটা হল বিরোধিতার সম্পর্ক। ফলে তার পরনির্ভরতার মধ্যেও কৃষকচেতনা সামন্তশ্রেণীর চেতনার বিপরীত বিন্দুতে অবস্থিত থাকে। এই বিরুদ্ধতার জন্য কৃষকচেতনার বাস্তব প্রকাশ সময় সময় ইতিবাচক ভূমিকাও গ্রহণ করতে পারে। লোকমানসের কিছু কিছু উপাদান যেমন আশ্চর্য রকমের শক্তিশালী—বিশেষ করে এক ধরনের স্বাভাবিক নীতিবোধ কাজ করে তার মধ্যে যা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ন্যায়শাস্ত্র বা আইনের তুলনায় অনেক সহজ অথচ গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। দৈনিক জীবনযাত্রার রীতিতে নানা পরিবর্তন ঘটলেও এই স্বাভাবিক ন্যায়-অন্যায় বোধ অক্ষুণ্ণ থাকে। এমন কি নতুন নতুন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নানা অভিনব পন্থার জন্ম দিতেও তা সক্ষম। সংস্কৃতি বা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে লোকসংস্কৃতি যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চাপে ভারাক্রান্ত থাকে, তা সত্ত্বেও ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীগুলি তাদের নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদানকেই মাত্র বেছে নেয়, সবটুকু নেয় না। ফলে ধর্মীয় জীবনের সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক চেহারার মধ্যেও এক ধরনের স্তরবিন্যাস দেখা দেয়। শাসকশ্রেণীর ধর্মবিশ্বাস আর তাদের অধীন শ্রেণীগুলির ধর্মবিশ্বাস প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে এক হলেও তাদের আকার ও চরিত্র পৃথক, এমন কী বিরোধী রূপ ধারণ করতে পারে। এই বিরুদ্ধতা থেকেই জন্ম নেয় ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর প্রতিরোধ, যা বহুসময়ই ক্ষমতাশীল শ্রেণীগুলিকে বিপদে ফেলতে সক্ষম হয়।
সুতরাং ‘সাবলটার্ন’ চেতনার সীমাবদ্ধতার কথাই যদিও গ্রামশির লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে, তা সত্ত্বেও এই চেতনার স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিতও তাতে যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। মার্কসীয় তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে এই ইঙ্গিতগুলোর সঠিক তাৎপর্য কী, তার উত্তর কিন্তু গ্রামশির আলোচনায় খুব স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে না। এমন কি এই সম্ভাবনাগুলোকে তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবেও গ্রামশি নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করতে পারেননি।
সম্প্রতিকালে ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর ধারণাটিকে নতুনভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। রণজিৎ গুহ এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘নিম্নবর্গ’। সাবলটার্ন স্টাডিজনামক প্রবন্ধসংকলনগুলিতে এবং জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, রণজিৎ গুহ, শাহিদ আমিন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে এই ধারণাটি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রামশির ইঙ্গিতগুলিকে অনুসরণ করেই ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটির উদ্ভব। কিন্তু তার প্রয়োগ ও বিস্তার করা হয়েছে ভারতবর্ষের সমাজ-ইতিহাসের ক্ষেত্রে। এর ফলে মার্কসীয় তত্ত্ব ও বিশ্লেষণপদ্ধতিতেও কয়েকটি নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে আবার দেখা দিয়েছে কিছু নতুন সমস্যাও।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে যাকে ‘আধুনিক’পর্ব বলে অভিহিত করা হয়, মার্কসীয় পদ্ধতি অনুযায়ী তার মূল চরিত্রটির অনুসন্ধান করা প্রয়োজন প্রাক্ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে। ইউরোপের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের উদ্ভব সম্পর্কে কিছু ধারণা মার্কসবাদী আলোচনায় প্রচলিত আছে। সামন্তশ্রেণীর আধিপত্য ও কৃষকের অধীনতাকে কেন্দ্র করে যে উৎপাদনব্যবস্থা, তার ভঙ্গুর অবস্থা; পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদনের সূত্রপাত; কৃষকদের মধ্যে পৃথকীকরণের প্রক্রিয়া; জমি ও উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক সর্বহারা শ্রেণীর সৃষ্টি; একই সঙ্গে শহরাঞ্চলে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় শিল্পোৎপাদনের প্রসার—মোটামুটি এইভাবেই সামাজিক উৎপাদনের সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের উদ্ভবকে দেখা হয়ে এসেছে। এরই সমান্তরাল প্রক্রিয়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে বুর্জোয়াশ্রেণীর সামাজিক কর্তৃত্ব বিস্তার— ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও যুক্তিবাদী সমাজদর্শন, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক আদর্শ, প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার যে প্রতিকল্পটি মার্কসীয় তত্বে নির্মিত হয়েছিল, বলা বাহুল্য তার অবলম্বন ছিল পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা। উৎপাদন সম্পর্ক, রাষ্ট্রক্ষমতার বিন্যাস, সাংস্কৃতিক জীবন—প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য বিস্তারের একটা সঙ্গতিপূর্ণ চেহারা তুলে ধরা হয়েছিল এই প্রতিকল্পে। অর্থাৎ তত্ত্বের দিক দিয়ে এটাই ছিল বিশুদ্ধ রূপ— সুবিন্যস্ত, সুসমঞ্জস ও নির্দিষ্ট।
কিন্তু বিশ্বের যে-সমস্ত অঞ্চলে পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটেছে দেরিতে, অর্থাৎ মধ্য, পূর্ব কিংবা দক্ষিণ ইউরোপে অথবা ঔপনিবেশিক তত্ত্বাবধানে—যেমন এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায়—সেখানে ঐতিহাসিক বিবর্তনের এই সুসমঞ্জস রূপটি আদৌ দেখতে পাওয়া যায় না। একদিকে তাত্ত্বিক প্রতিকল্পের নির্দিষ্ট রূপ, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে ঐতিহাসিক বিবর্তনের বিভিন্নতা—এই সমস্যাটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয় মার্কসের শেষজীবনের লেখাগুলিতে। তারপর লেনিনের রচনাতে পাওয়া গেল এই তাৎপর্যগুলির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কয়েকটি ইঙ্গিত। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ধারণাটি, সেটি হল সামাজিক সম্পর্কের পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বের অসম বিকাশের সম্ভাবনা।
দ্বন্দ্বের অসম বিকাশ তখনই দেখা দেয় যখন সমাজকাঠামোর বিভিন্ন অংশে পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে এগোয় না। অর্থাৎ অর্থনীতির ক্ষেত্রে শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায় কোনও বিশেষ শ্রেণীর প্রাধান্য সমান্তরালভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা বা সাংস্কৃতিক জগতে প্রাধান্যে পরিণত নাও হতে পারে। তেমনি আবার এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের বিকাশ ভৌগোলিক ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। ফলে শ্রেণীদ্বন্দ্বের মৌলিকতা, বৈরিতা, প্রাধান্য ইত্যাদি গুণগুলি এক জটিল ও পরিবর্তনশীল কাঠামোয় বিন্যস্ত হয়ে থাকে। এবং পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত প্রতিকল্পের সাহায্যে এই দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক উত্তরণের পথ নির্দেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এই অনির্দিষ্টতার জন্যই ইতিহাসের আলোচনায় উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের ধারণাটি তার তাৎপর্য লাভ করেছে। শুধু পূর্ব ইউরোপ, কিংবা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় নয়, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদের উদ্ভব অথবা বুর্জোয়াশ্রেণীর সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কোনও একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে ঘটেনি। বরং পুঁজিবাদে উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির অন্তর্গত যে শ্রেণীসংগ্রাম, তার বিশিষ্ট রূপ, শ্রেণীতে শ্রেণীতে বৈরিতা, মৈত্রী, সমঝোতার বিশিষ্ট রাজনৈতিক চেহারা, এক-এক দেশে এক-একভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এবং সম্ভাবনার এই বিভিন্নতার কারণ সমাজকাঠামোর বিভিন্ন অংশে দ্বন্দ্বের অসম বিকাশ। সুতরাং উৎপাদন-রীতির বিন্যাসমূলক ও বিমূর্ত বিশ্লেষণ শুরু করামাত্রই প্রয়োজন হয়ে পড়ে উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতা, ধর্মীয় জীবন, সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে শ্রেণীদ্বন্দ্বের চরিত্রটিকে চিহ্নিত করা। যদি ধরে নিই, সমাজকাঠামোর প্রত্যেকটি অংশে এই দ্বন্দ্বের বিকাশ সমান্তরালভাবে এগোয়নি, তাহলে উৎপাদন-রীতির চরিত্র অনুযায়ী উৎপাদন-সম্পর্কের ধারণাটি ছাড়াও আরও কতকগুলি ধারণার প্রয়োজন দেখা দেয় যার সাহায্যে রাষ্ট্র কিংবা সংস্কৃতি-ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের বিকাশকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
এই প্রয়োজনেই ‘উচ্চবগ’/‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটির উদ্ভব। এর সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের সেই সমতলে যেখানে ক্ষমতাই হল মূল কথা। অর্থাৎ যেখানে প্রভুত্ব/অধীনতার এক বিশিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সামাজিক সম্পর্কটি বাঁধা থাকে। সুতরাং উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ ধারণাটির অবস্থান উৎপাদন-সম্পর্কের সমতলে নয়, কিংবা সেটি সামাজিক শ্রেণীর কোনও বিকল্প সংজ্ঞা নয়। বরং বলা যায়, ঐতিহাসিক বিবর্তন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসম বিকাশকে চিত্রিত করার প্রয়োজনে উৎপাদন-সম্পর্কের সম্পূরক একটি ধারণা এটি। ফলে উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের বিশ্লেষণ পদ্ধতি উৎপাদন-রীতির ধারণাটিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। ঐতিহাসিক বিবর্তনের কোনও বিশেষ পর্ব বা পরিস্থিতিতে এই রীতির জটিল বিন্যাস, অসমতা ও উত্তরণের সম্ভবনার বিভিন্নতাকে বোধগম্য করে তুলতে সাহায্য করে মাত্র।
উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ শব্দ দুটিকে শাসক শ্রেণী/শাসিত শ্রেণীর প্রতিশব্দ হিসেবেও সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলে না। কারণ অসম বিকাশের অবস্থায় সামাজিক ক্ষমতা সবসময় আইনবদ্ধ রাষ্ট্রীয় শাসনক্ষমতা হিসেবে প্রতিপন্ন নাও হতে পারে। ফলে অনেক সময় সামাজিক ক্ষমতার এমন সম্পর্কেরও হদিশ পাওয়া যাবে যেখানে উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের সম্পর্ক রাষ্ট্রক্ষমতার বিন্যাসের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক।
সমাজকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ও পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়াগুলিকে তাদের মৌলিক উপাদানে বিভক্ত করে দেখাই উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের বিশ্লেষণের লক্ষ্য। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতির যেটি মূল অবলম্বন সেই ধারণাটি আমরা গ্রামশির রচনাতেও পাই। সেটি হল, শ্রেণী বিভক্ত সমাজে প্রভুত্ব/অধীনতার সম্পর্কের অন্তর্নিহিত বিরোধিতা। এই বিরোধিতার তাৎপর্য কী, সে-বিষয়ে গ্রামশির লেখাতে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কোনও স্পষ্ট তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় এই সমস্যাটিকে আরও নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
বলা হয়েছে, সমাজবিন্যাসের দিক থেকে প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন-সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ ঐতিহাসিক বিবর্তনের সম্ভাবনাগুলি প্রকাশ পায় দুটি পরস্পরবিরোধী চেতনার বৈপরীত্যে। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্তপ্রভু/ভূমিদাস কৃষকের সম্পর্কটির রাজনৈতিক চরিত্র নিহিত রয়েছে উচ্চবর্গীয় সামন্তচেতনা ও নিম্নবর্গীয় কৃষকচেতনার বৈপরীত্যে। এই সম্পর্কের বিন্যাসগত রূপটি স্বভাবতই প্রকাশ পায় উচ্চবর্গের প্রভুত্ব ও নিম্নবর্গের অধীনতায়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা যতদিন টিঁকে থাকে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার গতিতে এই প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্কটাই পুনরাবর্তিত হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, প্রভুত্ব/অধীনতার সম্পর্ক সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও সম্পূর্ণ স্থিতিশীল, সমান্তরাল, সুবিন্যস্ত রূপ ধরে এগোয় না। তাতে দেখা দেয় রাজনৈতিক বিরোধ, বিদ্রোহ, বিদ্রোহ দমন, শ্রেণীদ্বন্দ্বের নানা অসম অভিব্যক্তি। এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের জন্য সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সামগ্রিক স্থায়িত্বের মধ্যেও ইতিহাসের গতি স্তব্ধ হয়ে থাকে না। সামন্তপ্রভু ও কৃষকের পারস্পরিক সম্পর্কের রাজনৈতিক, আইনগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সবদিক থেকেই ঘটে নানা পরিবর্তন। এবং এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের মধ্যেই নিহিত থাকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সামগ্রিক বিবর্তনের সম্ভাবনা।
ফলে সামন্ততন্ত্রের ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়ে পড়ে উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের চেতনার বৈপরীত্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। যেহেতু প্রভুত্ব/অধীনতা সম্পর্কটির বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুটি পরস্পরবিরোধী শ্রেণী, এবং যেহেতু এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের রাজনৈতিক প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি শ্ৰেণীই সক্রিয়, কেবল উচ্চবর্গই সক্রিয় আর নিম্নবর্গ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এমন নয়, সুতরাং ধরে নিতে হয় উচ্চবর্গের চেতনার বিপরীত অবস্থানে নিম্নবর্গের চেতনাও কোনও না কোনওভাবে তার স্বকীয়তা, তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়। তা যদি না হত, তাহলে শ্রেণীদ্বন্দ্বের কোনও রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটা সম্ভব হত না। বস্তুত তাহলে কোনও দ্বন্দ্বই থাকত না, নিম্নবর্গের অস্তিত্ব উচ্চবর্গের চেতনার সার্বিকতায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেত।
কিন্তু উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ সম্পর্কের মধ্যে দুটি চেতনার স্বাতন্ত্র্যও যেমন সত্য, উচ্চবর্গের প্রভুত্ব ও নিম্নবর্গের অধীনতাও তেমনি সমানভাবেই সত্য। অর্থাৎ নিম্নবর্গের চেতনা স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও পরাধীন। এই দ্বান্দ্বিক রূপটিকে অবলম্বন করেই নিম্নবর্গের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ঐতিহাসিক মালমশলা স্বভাবতই রচিত ও রক্ষিত হয় উচ্চবর্গের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে। এই মালমশলার মধ্যে নিম্নবর্গের চেতনার স্বতন্ত্র রূপটির আবির্ভাব ঘটে কদাচিৎ। অধিকাংশ সময়ই নিম্নবর্গকে দেখা যায় নিষ্ক্রিয়, ভীরু, একান্ত অনুগত একটি জীব হিসেবে। অন্যে চালিত করলে তবেই যেন সে চলে। একমাত্র প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিরোধ, বিশেষ করে বিদ্রোহের সময়ই শাসকগোষ্ঠী তাকে সক্রিয় প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রাহ্য করে। এই ধরনের ঐতিহাসিক বিবরণগুলির মধ্য থেকে নিম্নবর্গের চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র, অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য/পরাধীনতার দ্বৈত চরিত্রটি উদ্ঘাটন করাটা নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার একটা বিশেষ দিক হিসেবে গৃহীত হয়েছে। রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া গ্রন্থটি প্রধানত এই সমস্যা নিয়ে। এতে তিনি দেখিয়েছেন, কৃষকবিদ্রোহকে কতকগুলি অর্থনৈতিক শর্ত দিয়ে সরাসরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে যে বিদ্রোহকে মনে হয় আকস্মিক, কিছু অবাস্তব কল্পনার দ্বারা চালিত, আসলে তা কিন্তু এই অর্থে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ নয়। তার পিছনে থাকে প্রস্তুতি, সংগঠন, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের নির্দিষ্ট একটা ছক। এই ছক নিহিত রয়েছে কৃষকচেতনায়। বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, তার অলীক চরিত্র, এবং রাজনৈতিক পরিণতি হিসেবে তার অনিবার্য ব্যর্থতা, এ-সবেরই যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে কৃষকচেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের মধ্যে, অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য/বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিক রূপটিতে।
নিম্নবর্গের ইতিহাসের অপর আলোচ্য বিষয় হল ঐতিহাসিক উত্তরণের সমস্যা। এর অন্তত দুটি দিক আছে। একটি হল, উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলস্বরূপ সমাজকাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতদূর? অন্যটি হল, নিম্নবর্গের চেতনার পৃথক ও স্বতন্ত্র রূপটিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি? পরিবর্তন ঘটলে তা কীভাবে ঘটে? প্রথম প্রশ্নটির বলা বাহুল্য কোনও সরল কিংবা সাধারণভাবে প্রযোজ্য উত্তর নেই। কারণ এই সম্ভাবনাগুলো একান্তই নির্ভর করে বিশেষ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অসম বিকাশের ফলে সৃষ্ট বিরোধগুলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠী বা জনসমষ্টির রাজনৈতিক ভূমিকা ও পারস্পরিক শক্তির উপর। উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কোনও সাধারণ নিয়ম এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। তবে উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ বিশ্লেষণ পদ্ধতি যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁদের বিশ্বাস উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শ্রেণীসংগ্রামের রাজনৈতিক প্রকাশ ও শ্রেণীচেতনার বৈপরীত্য গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে এই সাধারণ নিয়মগুলি নির্ধারণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বিশেষ করে, শ্ৰেণীসম্পর্কের জটিল বিন্যাস এবং সমাজকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে ও ভৌগোলিক ব্যাপ্তিতে শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসম বিকাশকে আরও স্পষ্টভাবে বোধগম্য করে তোলা যাবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটিও সমস্যাকণ্টকিত। উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার নিজস্ব বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই মুহূর্তে এই বিশ্লেষণপদ্ধতিগুলি যে অভিনব এবং অপেক্ষাকৃত অনির্দিষ্ট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষ দেশ-কালের সীমানার মধ্যে এই বিশ্লেষণ নিম্নবর্গের চেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সাহায্য করছে কি না, তা বিচার করার একমাত্র মানদণ্ড হল সমাজ পরিবর্তনের বৈপ্লবিক রাজনীতির মানদণ্ড। পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রের অধীন যে আধুনিক সমাজব্যবস্থা, তার ঐতিহাসিক উত্তরণের ক্ষেত্রে কৃষকচেতনার একক, এমন কি প্রধান ভূমিকাও থাকা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া চেতনার সমগ্রতা, তার ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা, ক্ষমতা ব্যবহারের নানা জটিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমন কোনও শ্ৰেণীচেতনার নেতৃত্বে বৈপ্লবিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কৃষকশ্রেণীর ঐতিহাসিক পরাধীনতার অবসান সম্ভব নয়। মার্কসবাদের আদিযুগ থেকেই এ সত্য সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী প্রসারের পরেও যে বহু দেশে এক বিশাল কৃষকশ্রেণী তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দীর্ঘদিন বজায় রেখে চলবে, এমন সম্ভাবনার কথা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মার্কসবাদীরা ভাবেননি। তখন মনে করা হত, কৃষকশ্রেণীর অবলুপ্তি পুঁজিবাদী উৎপাদনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি—নির্মম, রক্তক্ষয়ী, কিন্তু অনিবার্য। অথচ ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব থেকেই দেখা গেছে, তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলিতে ঐতিহাসিক উত্তরণ সম্ভব হয়েছে ব্যাপক কৃষক জনসমষ্টির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এক বৃহত্তর সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর অঙ্গীভূত হয়ে নয়, তাদের জীবিকা, জীবনধারণ ও চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং ভারতবর্ষের মতো কৃষিজীবীবহুল দেশে কৃষকচেতনার পরিবর্তনের সমস্যা কোনও ঐতিহাসিক অনিবার্যতার ধারণা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। আধুনিক পুঁজিবাদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম এমন শ্রেণীচেতনার সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের সম্ভাবনার মধ্যেই এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। এইজন্যই আন্তোনিও গ্রামশি বলেছিলেন, সাবলটার্ন শ্রেণীর জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ, ভাবাদর্শ গভীরভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। আজকের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও সেই কারণে বৈপ্লবিক নেতৃত্ব তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ দ্বন্দ্বের জটিল বিন্যাস ও অসমতা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলে সেই দ্বন্দ্বের নানা ধরনের বহিঃপ্রকাশ, এবং এই অসমতার মধ্যে বৈপ্লবিক ঐক্যের সন্ধান করা।
৩
১৯৭০-এর দশকে ভারতের মার্কসবাদী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ ঘটে যায়, ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে সেই অসম্পূর্ণ বিতর্কে। ওপরে উদ্ধৃত প্রবন্ধটিতেও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক জমে উঠেছিল ওই সময়। একটিতে অংশ নেন প্রধানত অর্থনীতিবিদেরা, যাঁদের আলোচ্য ছিল ভারতবর্ষের কৃষি-অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী উৎপাদনরীতির উদ্ভব। এক পক্ষের বক্তব্য ছিল, ঔপনিবেশিক আমলের শেষ পর্ব থেকেই ভারতের কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। কৃষিপণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার এবং বড়মাপের সংগঠিত অর্থলগ্নী ব্যবস্থার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে বড়-মাঝারি-ছোট সবরকম উৎপাদনই এখন পুঁজীবাদী উৎপাদন-রীতির নিয়ম মেনে চলতে শুরু করেছে। অন্য পক্ষ দেখাবার চেষ্টা করে যে কোনও কোনও এলাকায় সীমিত কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো অটুট রয়েছে। বৃহত্তর বাজার বা লগ্নীব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েও প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক রূপান্তরের কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। অন্য বিতর্কটি হয় প্রধানত ঐতিহাসিকদের মধ্যে। সেখানে আলোচ্য ছিল উনিশ শতকের বাংলায় তথাকথিত নবজাগরণ। জাতীয়তাবাদী, এমন কি মার্কসবাদী ইতিহাসেও দীর্ঘদিন ধরে ‘নবজাগরণ’-এর মণীষীদের ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অধিকার করে ছিল। সত্তর দশকে অশোক সেন, রণজিৎ গুহ, সুমিত সরকার ইত্যাদি ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুললেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মণীষীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রগতিশীল কোন অর্থে? তাঁদের সংস্কার-চিন্তা তত ঔপনিবেশিক অর্থনীতি-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করেনি। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রগতিশীলতার ওপর আস্থা রেখেই তো তাঁদের সমাজ-সংস্কার প্রচেষ্টার শুরু, আর সেই শাসনক্ষমতার সীমাবদ্ধতাই তাঁদের সংস্কার-প্রচেষ্টার সীমা। ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে কোনও মৌলিক প্রশ্ন ‘নবজাগরণ’-এর নায়কেরা তোলেননি, বরং সেই ক্ষমতাবিন্যাসকে অবলম্বন করেই তাঁরা সামাজিক প্রগতি আনার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া অনিবার্য ছিল।
সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়ার জগতে এই দুটি বিতর্ক যে-সময় ওঠে, তার অল্প কদিন আগেই ভারতের বামপন্থী রাজনীতি আর-একটি বিতর্কে আন্দোলিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের নকশালবাড়ি কৃষক-সংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাত শুধুমাত্র কিছুটা ক্ষণস্থায়ী চাঞ্চল্য, রক্তক্ষয় আর রাজনৈতিক ব্যর্থতাতেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতাবিন্যাসের প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে এমনই নাটকীয়ভাবে উপস্থিত করতে পেরেছিল সেই আন্দোলন, যে সেই প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করা ছিল অসম্ভব। রাজনৈতিক সংগ্রাম পর্যুদস্ত হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও তাই সে-প্রশ্নটি সমাজবিজ্ঞানে, ইতিহাসে, শিল্পকলায়, সাহিত্যে, নাটকে, সিনেমায় নানাভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। যে-দুটি পণ্ডিতি বিতণ্ডার কথা ওপরে বললাম, তাতেও যে বিভিন্ন দিক থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই অসম্পূর্ণ বিতর্কের পটভূমিতে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ আবার ওই ক্ষমতাবিন্যাসের প্রশ্নটিকে নতুনভাবে তুলতে সক্ষম হয়।
সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম খণ্ডের গোড়ায় রণজিৎ গুহ রচিত একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যাকে পরবর্তীকালে অনেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার ‘ম্যানিফেস্টো’ বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রবন্ধের প্রথম লাইনেই বলা হয়, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস-রচনায় দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ আর বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য চলে আসছে।’ নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার উদ্দেশ্য হল এই দুই ধরনের উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের বিরোধিতা করা। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর ঝগড়া এই সময় তুঙ্গে। এক দিকে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন ঐতিহাসিক দেখাবার চেষ্টা করছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবর্গের নীতিহীন আদর্শহীন ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। চিরাচরিত জাতি-ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বন্ধনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেখানে শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এর তুমুল প্রতিবাদ করে বলছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা, জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের কথা। রণজিৎ গুহ-র প্রবন্ধে ঘোষণা করা হল, এই দুটি ইতিহাস আসলে উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত, কারণ দুটি ইতিহাসই ধরে নিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ হল উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপের ফসল। বিবাদ শুধু সেই ক্রিয়াকলাপের নৈতিক চরিত্র নিয়ে—তা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থের সাময়িক যোগফল, নাকি আদর্শ আর স্বার্থত্যাগের জাদুকাঠির স্পর্শে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনার উন্মেষ। এই দুটি ইতিহাসের কোনওটাতেই জনগণের নিজস্ব রাজনীতির কোনও স্থান নেই।
সাম্রাজ্যবাদী আর জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিরোধিতার পথ ধরেই নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম কর্মসূচি নির্দিষ্ট হল। আগেই বলেছি, দুটি বিষয় এখানে প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল। এক, ঔপনিবেশিক আর দেশীয়, দু-ধরনের উচ্চবর্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর পদ্ধতির সঙ্গে নিম্নবর্গের রাজনীতির পার্থক্য। দুই, নিম্নবর্গীয় চেতনার নিজস্বতা। প্রথম বিষয়টি অনুসরণ করতে গিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর ঐতিহাসিকেরা দেখালেন যে শুধুমাত্র দেশীয় উচ্চবর্গের অঙ্গুলিহেলনে নিম্নবর্গের দল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছিল, সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের এই অভিযোগ যেমন সত্য নয়, তেমনি জাতীয়তাবাদী নেতাদের আদর্শ আর অনুপ্রেরণার স্পর্শ পেয়ে তবে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক চেতনা জেগে উঠল, এই দাবিও সত্য নয়। উচ্চবর্গ পরিচালিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মঞ্চে নিম্নবর্গ প্রবেশ করেছিল ঠিকই। আবার বহুক্ষেত্রে নানা অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও তারা সেখানে প্রবেশ করতে আদৌ রাজি হয়নি, অথবা একবার প্রবেশ করে পরে সরে এসেছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা, পদ্ধতি ছিল উচ্চবর্গের তুলনায় পৃথক। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রেও নিম্নবর্গের জাতীয়তাবাদ ছিল উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদের তুলনায় ভিন্ন।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি এসেছে প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। নিম্নবর্গের রাজনীতির ধরনধারণ যদি স্বতন্ত্র হয়, সেই স্বাতন্ত্রের সূত্র কোথায়? তা নির্ধারিত হচ্ছে কোন নিয়মে? উত্তর হল, নিম্নবর্গের রাজনীতির চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে নিম্নবর্গের নিজস্ব চেতনার রূপরেখা অনুসারে। সেই চেতনা গড়ে উঠেছে অধীনতার অভিজ্ঞতা থেকে। দৈনন্দিন দাসত্ব, শোষণ আর বঞ্চনার মধ্যেও নিজের অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। সে চেতনার পরিচয় পাওয়া যাবে কোথায়? ঐতিহাসিক নথিপত্রে নিম্নবর্গের চেতনার সরাসরি সাক্ষ্য প্রায় কোথাওই পাওয়া যায় না। কারণ সেই নথি তৈরি করেছে উচ্চবর্গেরা। সাধারণ অবস্থায় নিম্নবর্গকে সেখানে কেবল প্রভুর আদেশপালন করতেই দেখা যায়। একমাত্র একটি মুহূর্তেই শাসককুলের মানসপটে নিম্নবর্গ আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে। সেই মুহূর্তটি হল বিদ্রোহের মুহূর্ত। নিম্নবর্গ যখন বিদ্রোহী, তখনই হঠাৎ শাসকবর্গের মনে হয়, দাসেরও একটা চেতনা আছে, তার নিজস্ব স্বার্থ আর উদ্দেশ্য আছে, কর্মপদ্ধতি আছে, সংগঠন আছে। উচ্চবর্গের তৈরি করা সাক্ষ্যপ্রমাণের মহাফেজখানায় যদি নিম্নবর্গের চেতনার খোঁজ করতে হয়, তবে তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে বিদ্রোহ আর বিদ্রোহদমনের ঐতিহাসিক দলিলে।
এই কারণেই প্রথম পর্বের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর গবেষণায় একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস্ গ্রন্থের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু এ-ছাড়াও সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলনে এবং তার বাইরে অন্যান্য জায়গায় নানা প্রবন্ধে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস অনুসন্ধান করে বিদ্রোহী কৃষকচেতনার পরিচয় দেবার চেষ্টা করলেন। এই চেষ্টার ফলে অল্প কিছু নতুন সূত্র আবিষ্কার হল, বিদ্রোহী কৃষক যেখানে তার নিজের কথা বলে গেছে। কিন্তু জানাই ছিল, এমন সূত্র খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ইতিহাস-রচনার প্রকরণ হিসেবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়ে দেখা দিল কৃষকবিদ্রোহের পরিচিত নথিপত্রগুলোকেই নতুনভাবে পড়ার কৌশল। শাসকবর্গের প্রতিনিধিরা যেখানে কৃষকবিদ্রোহের রিপোর্ট দিচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেই সরকারি রিপোর্টের বর্ণনাকেই বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উল্টো করে পড়লে বিদ্রোহী কৃষকচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়—নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা এর অনেক উদাহরণ এনে হাজির করলেন। তাঁরা আরও দেখালেন উচ্চবর্গের ঐতিহাসিকেরা, এমন কি প্রগতিশীল এবং শোষিত শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ঐতিহাসিকেরাও যখন তাঁদের যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে কৃষকচেতনায় উপস্থিত ধর্মবিশ্বাস, অলৌকিকতা, মিথ, দৈবশক্তিতে আস্থা, অলীক কল্পনা প্রকৃতিকে অযৌক্তিক মনে করে উপেক্ষা করেন বা সে-সবের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা খাড়া করে একরাশ মিথ্যার ভেতর থেকে সঠিক ইতিহাসটুকু বের করে আনার চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা কৃষকচেতনার বিশিষ্ট উপাদানগুলোকেই আসলে হারিয়ে ফেলেন। হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁরা নিম্নবর্গের রাজনীতিকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেলে বোধগম্য করার চেষ্টা করেন। নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাস, অথবা অন্যভাবে বললে, ইতিহাসে নিম্নবর্গের কীর্তির স্বাক্ষর কিন্তু সেখানে হারিয়ে যায়।’৩
৪
‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ নিয়ে গোড়ার দিকে সমালোচনাতে দুধরনের আপত্তি উঠেছিল। একটি আপত্তির লক্ষ ছিল উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পৃথকীকরণ। দুটি ক্ষেত্র কি সত্যিই ততটা পৃথক? অথবা, কোনও এক প্রাক-জাতীয়তাবাদী বা প্রাক-ধনতান্ত্রিক ঐতিহাসিক অবস্থায় তা পৃথক হয়ে থাকলেও, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গণতান্ত্রিক প্রভাবে দুটি ক্ষেত্র কি ক্রমশ একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়নি? বিশ্লেষণের লক্ষ্য হিসেবে উচ্চবর্গের আর নিম্নবর্গের রাজনীতির পার্থক্যের ওপর অতটা জোর দেওয়ার তাৎপর্য কী? তাতে কি নানা ধরনের বিভেদকামী, বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকেই পরোক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছে না?
দ্বিতীয় আপত্তি নিম্নবর্গীয় চেতনা নিয়ে। প্রগতিশীল ইতিহাস চিন্তার প্রথম উপপাদ্য হল, মানবচেতনার বিকাশ, চেতনার অনুন্নত বা আদিম অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নত চেতনার দিকে অগ্রসর হওয়া। এই প্রগতির তত্ত্ব যেমন একটা গোটা সমাজ বা সভ্যতার বেলায় খাটে, তেমনি সমাজের আভ্যন্তরীণ বিভাজনের ক্ষেত্রেও খাটে। অর্থাৎ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে আর্থিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ক্ষমতাভোগী শ্রেণীর চেতনার স্তরও অপেক্ষাকৃত উন্নত হয়। সামাজিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে সেই শ্রেণী বা তার কোনও অংশ যদি অগ্রগামী ভূমিকা নেয়, তাহলে তার চেষ্টায় অন্যান্য শ্রেণীর চেতনার মানও ক্রমশ উন্নত হয়ে উঠতে পারে। নিম্নবর্গের চেতনার স্বাতন্ত্র্যের কথা তুলে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা কি চৈতন্যের স্তরভেদ, তার ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ, এবং সামাজিক প্রগতির ক্ষেত্রে উন্নত চেতনার অধিকারী অগ্রগামী শ্রেণীর ভূমিকাকে অস্বীকার করছেন? তাঁরা কি উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের চেতনার বিচারে উন্নত/পশ্চাৎপদ, এই তুলনাটাই মানতে চাইছেন না? তাঁরা কি বলছেন, ওই দুটি চেতনা ভিন্ন, স্বতন্ত্র নিয়ম অনুযায়ী গঠিত, অতএব তাদের মধ্যে তুলনার কোনও সাধারণ মাপকাঠি নেই?
জাতীয়তাবাদী এবং মার্কসবাদী, দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই প্রশ্নগুলি তোলা হয়েছিল। এবং দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত ন্যায্য প্রশ্ন ছিল। জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার প্রস্তাবকে ঐক্যবদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের জীবনবৃত্তান্তের পরিপন্থী বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আর প্রগতিবাদী-বামপন্থী অবস্থান থেকেও নিম্নবর্গের চৈতন্যের নিজস্ব গড়ন আর তার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উদ্যমের ওপর জোর দেওয়ার মানে অগ্রগামী বুর্জোয়া-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং বৈপ্লবিক পার্টি সংগঠনের প্রগতিশীল ভূমিকা একরকম অস্বীকার করা। দুটি ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের উত্তর ছিল, নিম্নবর্গের অবস্থান থেকে দেখলে জাতীয়তাবাদী আর প্রগতিবাদী-বামপন্থী ইতিহাসের কর্মসূচীর ভেতরে যে নিম্নবর্গের কোনও স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকছে না, এটা প্রমাণ করাই নিম্নবর্গের ইতিহাসের উদ্দেশ্য। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের কাজ হল প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস-রচনার সমালোচনা করা। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই সবসময়ই বিরোধী ইতিহাস। বিকল্প ইতিহাসরচনা-পদ্ধতির কোনও পরিপূর্ণ কর্মসূচী নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক দিতে পারেন না। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকা লিখতে গিয়ে রণজিৎ গুহ তাই লিখলেন, ‘একজন সমালোচক আমাদের তিরস্কার করে বলেছেন, আমরা নাকি সব প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনা-পদ্ধতিরই বিরোধী। এ অভিযোগ সত্যি। নিম্নবর্গ যে তার নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে, এ-কথা স্বীকার করে না বলে ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান চর্চার অধিকাংশ রীতি-নীতি-পদ্ধতিরই আমরা বিরোধিতা করি। এই বিরোধিতাই আমাদের প্রকল্পের চালিকাশক্তি।’
বিরোধী বা ক্রিটিকাল ইতিহাসরচনা। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসরচনার পদ্ধতি আছে, থাকবে। উচ্চবর্গের আধিপত্যও আছে, থাকবে। অন্তত ইতিহাস লিখে সে-আধিপত্যের অবসান ঘটানো যাবে না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে। নিজের ক্রিয়াকলাপের কর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে। সে ইতিহাস কখনওই পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাসের সামগ্রিকতা অর্জন করতে পারবে না। নিম্নবর্গ কখনওই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারবে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই অনিবার্যভাবে আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ।
বলা বাহুল্য, এইরকম খণ্ডিত, প্রায়শই অসংলগ্ন, ইতিহাসরচনার পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করে যাওয়া সহজ নয়। পেশাদার গবেষণার জগতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের জগতে, রাজনৈতিক বাদানুবাদের জগতে নতুন লেখকগোষ্ঠীর কাছে স্বভাবতই একটা প্রত্যাশা থাকে যে তাদের মৌলিক গবেষণার কাজ প্রচলিত ভাবনাচিন্তাকে একটা নতুন দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। যে সব সমস্যার সমাধান প্রচলিত বাকবিতণ্ডার ভেতর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার একটা নতুন সমাধানের ইঙ্গিত দেবে। তারা যদি প্রতিষ্ঠিত মতবাদের বিরোধিতা করে, তবে বিকল্প কোনও মতবাদকে এখনই উপস্থিত করতে না পারলেও, তেমন এক সামগ্রিক বিকল্প নির্মাণ করার প্রচেষ্টাটুকু অন্তত তারা সমর্থন করবে, এমন আশা করা নিশ্চয় অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ এই প্রত্যাশা পূরণ করতে রাজি হয়নি।
বিষয়টা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে, তাই খানিকটা বিশদ আলোচনা করলে হয়তো সুবিধা হয়।
সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রথম পর্বের কাজে এমন একটা বিকল্প মতবাদের ইঙ্গিত অনেকে দেখেছিলেন। আগেই বলেছি, সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর গবেষণা প্রধানত কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। রাজনৈতিক চেতনাহীন নিষ্ক্রিয় কৃষকের ধারণার বিরোধিতা করে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর ঐতিহাসিকেরা দেখাবার চেষ্টা করেন যে বিদ্রোহী কৃষক আসলে এক স্বকীয়, সৃজনশীল এবং বিশিষ্ট চৈতন্যের অধিকারী। বলা বাহুল্য, ঔপনিবেশিক এবং জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের উচ্চবর্গীয় পক্ষপাতিত্বের বিরোধিতায় এই পদ্ধতি খুব উপযোগী ছিল। কিন্তু উলটো এক বিপদের সম্ভাবনাও তাতে নিহিত ছিল। তা হল কৃষকসমাজ নিয়ে এক ধরনের রোমান্টিকতা, যা রাশিয়ার নারদনিক দলগুলি থেকে শুরু করে এ-দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কৃষক বিপ্লবের বিভিন্ন প্রচেষ্টায় বহুবার দেখা গিয়েছে। অস্বীকার করে লাভ নেই, ১৯৬০-এর আর ১৯৭০-এর দশক দুটির রাজনৈতিক বাদানুবাদ এবং নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের আপাত বিপর্যয়ের পটভূমিতে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এ কৃষকবিদ্রোহের ইতিহাসচর্চা প্রায় অনিবার্যভাবেই এক ধরনের নকশালি রাজনীতির রোমান্টিক রোমন্থন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। এও সত্যি যে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ইতিহাসরচনাকে সমালোচনা করতে গিয়ে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর একাধিক লেখক প্রচ্ছন্নভাবে হলেও এ ধরনেরই কোনও বিকল্প রাজনৈতিক অবস্থানকে অবলম্বন করেছিলেন। আর এক সম্ভাবনাও গোড়ার দিকের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর লেখায় অনেকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তা হল এক ধরনের রোমান্টিক স্বদেশিয়ানা—বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রসভ্যতা আর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিধ্বংসী ইতিহাসের হাত থেকে যা আমাদের নিষ্কৃতি দিতে পারে, যার নিরাপদ ছায়ায় বসে মনে হয় দেশজ কৃষকসমাজের জ্ঞানভাণ্ডার এবং ব্যবহারিক জীবনের ঐতিহ্যই আমাদের প্রকৃত আদর্শ সমাজ গঠনের পথ বাতলে দিতে পারে। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর কোনও লেখায় ঠিক এইরকম ইঙ্গিত কখনও করা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে একাধিক সমালোচক সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মধ্যে এই জঙ্গি স্বদেশিয়ানার গন্ধ পেয়েছেন। তার কারণ তাঁদের ঘ্রাণশক্তির অসাধারণ প্রখরতা না কি ওরকম একটা তকমা এঁটে দিতে পারলে গালাগাল করতে সুবিধে হয়, এর উত্তর নিশ্চিতভাবে জানি না।
আসলে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসচর্চার মহলে যে-ভূমিকায় সাবলটার্ন স্টাডিজ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল, সেটা হয় এক ধরনের র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাস কিংবা ‘হিসট্রি ফ্রম বিলো’—তল থেকে দেখা ইতিহাস। সত্তর-আশির দশকে ইউরোপে এই ধরনের ইতিহাস লেখার খুব চল হয়েছিল। ক্রিস্টোফার হিল, এডোয়ার্ড টমসন, এরিক হব্সবম প্রভৃতি ইংরেজ মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের ধারা অনুসরণ করে অনেকেই তখন ইউরোপের পুঁজিবাদ আর যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতির ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত, অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও তাদের ভিন্নতর জীবনযাত্রার কথা লিখছিলেন। এই ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ প্রধানত ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, মতাদর্শ, স্মৃতি খুঁজে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষ করে যে সব ঘটনা বা আন্দোলন ছিল নিতান্তই আঞ্চলিক এবং ক্ষণস্থায়ী, সেই সব ঘটনার পৃথক পৃথক কাহিনী এবং বিশিষ্ট তাৎপর্যকে চিহ্নিত করে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মূলধারার বর্ণনাটিকে অনেক বেশি জটিল ও বর্ণাঢ্য করে তুলেছিল এই নতুন সামাজিক ইতিহাস। ইতিহাসচর্চার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ধারাটি তখন প্রচলিত ছিল বলে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখাগুলিতে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকেরাও যে ইউরোপের র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ তফাত ছিল। পশ্চিমী দুনিয়ায় আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের বিশাল ইমারতের তল থেকে খুঁজে খুঁজে এইসব বিস্মৃত কাহিনী বের করে আনার ফলে সেই ইমারত কী করে তৈরি হল, তার বর্ণনাটি আরও বিশদ ও পরিপূর্ণ হল সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ইমারতের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব এবং ঐতিহাসিক ন্যায্যতা সম্বন্ধে কোনও মৌলিক প্রশ্ন সেখানে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসের কাহিনী বাঁধা হত ট্র্যাজেডির সুরে। শোষিত অবহেলিত মানুষের বঞ্চনা আর নিপীড়নের গল্প সেখানে মর্মান্তিক, তাদের প্রতিরোধ হয়তো-বা সহনীয়, কিন্তু গল্পের শেষে তাদের পরাজয় অনিবার্য। এ-সব গল্পের প্রভাবে ইতিহাসের মূল গতিপথ এক চুল এদিক-ওদিক নড়ার সম্ভাবনা ছিল না।
ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসকে কিন্তু এরকম কোনও ছকের ভেতরে বেঁধে রাখা কঠিন ছিল। ভারতে পুঁজিবাদী আধুনিকতার বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গল্পের শেষটা অত নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়নি। বিশ্বের অন্যত্র যা ঘটেছে, ভারতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এই ফর্মূলাটা যদি মাথায় চেপে বসে না থাকে, তাহলে ‘তল থেকে দেখা’ ভারতীয় ইতিহাসের লেখক সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর গবেষণার উপাদান থেকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক মৌলিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ খোলা রয়েছে। আগেই বলেছি, লিবেরাল জাতীয়তাবাদ এবং মার্কসবাদ, দুধরনের ইতিহাসরচনার প্রতিষ্ঠিত ছক সম্বন্ধেই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকদের মনে সংশয় ছিল। র্যাডিকাল সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় নেমে তাঁরা তাঁদের বর্ণনাকে কোনও নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিণতি আধুনিক সমাজের কোনও নির্দিষ্ট ও পরিচিত ধারণার বাস্তবায়ন, এই কাহিনীসূত্রটি তাঁরা বারে বারেই অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁদের লেখায়। তাই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাস হিসেবেও ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল ইতিহাসচর্চার মহলে।
৫
সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রথম পর্বের কাজের সবচেয়ে মৌলিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক-এর দুটি প্রবন্ধে।৪ ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর গবেষণার দুটি বৈশিষ্ট্যের দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। প্রথম বৈশিষ্ট্য হল যে, ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের যা পরিধি, নিম্নবর্গের রাজনীতি তার বাইরেও বটে, আবার ভেতরেও বটে। যে অর্থে তা বাইরে, সেই অর্থে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অথবা ভাবাদর্শের তুলনায় স্বতন্ত্র। কিন্তু তা আবার ভেতরেও বটে, কারণ বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, তাকে সুবিধেমতো ব্যবহার করছে, হয়তো বা একরকমভাবে আত্মস্থ করছে। এই গবেষণার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, একদিকে নিম্নবর্গীয় সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ আকৃতির ধারণা, অন্যদিকে ঐতিহাসিক মালমশলায় বারেবারেই এটা আবিষ্কার করা যে নিম্নবর্গের উপস্থিতি ঘটছে বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন চেহারায়। এমন কি নিজের ভেতরেই বিভাজিত অবস্থায়। গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রশ্ন তুললেন, ইতিহাস রচনার প্রতিটি উপাদানই যখন দেখিয়ে দিচ্ছে যে নিম্নবর্গ মানেই ‘কোনও এক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি’, তখন নিম্নবর্গের ঐতিহাসিককে অত ঘটা করে বিশুদ্ধ কৃষকচৈতন্য অথবা একান্তভাবে স্বতন্ত্র নিম্নবর্গের রাজনীতির স্লোগান আওড়াতে হচ্ছে কেন? বুর্জোয়া ইতিহাস রচনায় ‘মানব’ অথবা ‘নাগরিক’ নামে যে সার্বভৌম কর্তাটি অধিষ্ঠিত হয়েছিল, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তো দেখিয়েছেন যে সেই কর্তাটির আসল পরিচয় হল সে উচ্চবর্গ। এখন আবার সেই জায়গায় ‘নিম্নবর্গ’-কে আর-একটি সার্বভৌম কর্তার পোশাক পরিয়ে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে উপস্থিত করার প্রয়োজন কী? আসলে ইতিহাসের কোনও একটি কর্তা আছে, এবং তার একটি বিশুদ্ধ পূর্ণাবয়ব চৈতন্য আছে, এই ধারণাটাকেই তো নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাঁর গবেষণার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সেই ধারণাকেই আবার তাঁরা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন কেন? ঐতিহাসিকের লেখার ভেতর দিয়ে নিম্নবর্গ তার নিজের কথা বলবে, এটা তো নিতান্তই গল্পকথা। খুব বেশি হলে সেটা ঐতিহাসিকের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ। আসলে তো ঐতিহাসিক নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব করছেন মাত্র। নিম্নবর্গকে ইতিহাসের পাতায় উপস্থিত করছেন। নিম্নবর্গ তার নিজের কথা কখনওই বলতে পারে না।
১৯৮৫ সালে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘সবার ওপরে নিম্নবর্গ সত্য,’ এরকম মন্ত্র না আউড়ে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চেষ্টা করা উচিত উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গকে কীভাবে নির্মাণ করা হয়, সেই প্রক্রিয়াগুলোকে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করা। হাজার আওয়াজের ভেতর থেকে নিম্নবর্গের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আলাদা করে বের করে আনার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। ইতিহাসের দলিলে যে-কণ্ঠস্বরই শুনি না কেন, তা নিম্নবর্গের কথা নয়, অন্যের নিমার্ণ। এই নির্মাণের সামাজিক পদ্ধতিগুলি কী, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে তা তৈরি হয়, কোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তা ব্যাপক সামাজিক স্বীকৃতি পায়, সে-সব প্রক্রিয়াগুলো আবিষ্কার করাই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁদের কাছে সেটাই সবচেয়ে বাস্তব প্রত্যাশা।
মোটামুটিভাবে পঞ্চম-ষষ্ঠ খণ্ড থেকে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ প্রকাশিত গবেষণায় নতুন ঝোঁক দেখা দিতে শুরু করে। আগের সঙ্গে পরের পর্বের প্রধান তফাত এইখানে যে ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে নিম্নবর্গের সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ পরিপূর্ণ চেহারার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব, এই অতি সরল ধারণাটি এখন পরিত্যক্ত হল। নিম্নবর্গের ইতিহাস আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ, তার চেতনাও বহুধাবিভক্ত, ক্ষমতাশীল আর ক্ষমতাহীন নানা শ্ৰেণীচৈতন্যের বিভিন্ন উপাদানের তা সংমিশ্রণ—এই সিদ্ধান্তগুলিকেও এখন অনেক গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হল। ফলে বিদ্রোহের মুহূর্তে কৃষকচৈতন্যের স্বকীয়তার পাশাপাশি দৈনন্দিন অধীনতার জীবনযাপনে কৃষকচৈতন্যের স্বরূপ সন্ধান জরুরি হয়ে পড়ল। এবং এই প্রশ্নগুলো এসে পড়তে দেখা গেল, প্রচলিত সমাজবিজ্ঞান ইতিহাসচর্চার প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়েই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা নতুন অনুসন্ধানের পথ খুলে যাচ্ছে। কারণ প্রশ্নটা এখন আর এই রইল না যে ‘নিম্নবর্গের প্রকৃত স্বরূপ কী?’ প্রশ্নটা হয়ে গেল ‘নিম্নবর্গকে রিপ্রেসেন্ট করা হয় কীভাবে?’ ‘রিপ্রেসেন্ট’ কথাটা এখানে প্রদর্শন করা আর প্রতিনিধিত্ব করা, উভয় অর্থেই প্রযোজ্য। উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গের ধারণার নির্মাণ—এই বিষয়টি ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর গোড়া থেকে চর্চিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তখন অনুমানটি এমন ছিল যে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে উচ্চবর্গের নির্মাণের খোলশটা খসে পড়বে, প্রকৃত নিম্নবর্গের স্বরূপ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এই অনুমানটি যে ভুল, রিপ্রেসেন্টেশন-এর গণ্ডি অতিক্রম করে কোনও এক প্রত্যক্ষ বাস্তবের উপলব্ধিতে পৌঁছনো যে অসম্ভব, এটা একবার স্বীকার করে নেওয়ার পর খাঁটি আগমার্কা নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার সদিচ্ছাটুকুও আর পোষণ করা সম্ভব ছিল না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চোখের সামনে রোমান্টিকতার মোহজাল থেকে থাকলে তা এবার নিশ্চিতভাবে খসে পড়ল।
রিপ্রেসেন্টেশন-এর প্রক্রিয়াগুলোই যেহেতু এখন বিশ্লেষণের লক্ষ্য, তাই গবেষণার পদ্ধতিও অনেকাংশে বদলে গেল। একদিকে ঝোঁক গিয়ে পড়ল টেক্সট্ বা পাঠ্যবস্তুর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে। ক্ষমতাশীল উচ্চবর্গের দ্বারা নিম্নবর্গের নির্মাণ—এর নিদর্শন আমরা পাই ইতিহাসের দলিলে। হাজার হাজার দলিল, সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকের বর্ণনা, তার পাশাপাশি অন্য নানাবিধ জ্ঞানচর্চা, ধর্মচর্চা, সমাজবিধি, এ-সবের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এক-একটি প্রভাবশালী ডিসকোর্স যার মাধ্যমে ক্ষমতাশীল শ্রেণীর মতাদর্শ সামাজিক আধিপত্য বিস্তার করে। এইসব ডিসকোর্সের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিম্নবর্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ‘নিম্নবর্গের নির্মাণ’ এই প্রশ্নটিকে সামনে রাখার ফলে এবার ঔপনিবেশিক ভারতে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এবং আধুনিক সমাজ-প্রতিষ্ঠান গড়ার জটিল ইতিহাসের দলিল সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ার প্রয়োজন দেখা দিল। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের প্রসার, ইংরেজি শিক্ষা, তথাকথিত নবজাগরণ, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ—এইসব বহুচর্চিত বিষয় নিয়েও সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ নতুন করে আলোচনা শুরু হল।৫ সেই সঙ্গে নজর গিয়ে পড়ল আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর, যার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান-সঞ্চারিত মতাদর্শ এবং আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র ঔপনিবেশিক এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতবর্ষে তার জাল বিস্তার করেছে। অর্থাৎ, স্কুল-কলেজ, সংবাদপত্র, প্রকাশনসংস্থা, হাসপাতাল-ডাক্তার-চিকিৎসাব্যবস্থা, জনসংখ্যাগণনা, রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, আধুনিক শিল্পউৎপাদনে দৈনন্দিন শ্রমসংগঠন, বিজ্ঞান-সংস্থা, গবেষণাগার—এইসব প্রতিষ্ঠানের বিশদ ইতিহাসও এবার ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর বিষয় হয়ে পড়ল।৬
এই দিক পরিবর্তনে সব পাঠক সন্তুষ্ট হননি। নিম্নবর্গকে নায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সাদাসাপটা ঐতিহাসিক রোমান্সের বদলে পাঠকের সামনে এবার এসে পড়ল সরকারি দলিল, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক, জাতীয়তাবাদী নেতার বক্তৃতা, সমাজবিজ্ঞানের প্রবন্ধের খুঁটিনাটি চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেকেই বললেন, নিম্নবর্গের ইতিহাস এবার ভদ্রলোকের ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নিম্নবর্গের ক্রিয়াকলাপ থেকে ছড়িয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অন্য সব এলাকাতে পৌঁছে যাওয়ায় একটা অসুবিধা অবশ্য হচ্ছিল। সমাজবিজ্ঞান চর্চার জগতে প্রথম আলোড়নটা কেটে যাওয়ার পর ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা যেন নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার পাশাপাশি ‘সাবলটার্ন স্কুল’ নিয়ে খানিকটা পড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়েছিল। এখন দেখা গেল, ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর কোনও নির্দিষ্ট বিষয়গত সীমারেখা থাকছে না, সব বিষয় নিয়েই সেখানে লেখাজোকা শুরু হয়ে গিয়েছে। আপত্তিটা অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়াল—‘বেশ তো তোমরা চাষাভুষো কুলিকামিন নিয়ে লিখছিলে। এখন হঠাৎ বঙ্কিম-গান্ধী-জওহরলাল বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লিখতে শুরু করলে কেন?’ এই আপত্তি এখনো শুনতে পাই।
আসলে ‘নিম্নবর্গের নির্মাণ’, এই পদ্ধতিগত আবিষ্কারটির পর নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের কাজ আর কেবল নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র ক্রিয়াকলাপের বিবরণ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমগ্র সমাজ-প্রতিষ্ঠান-ভাবাদর্শের জগতকেই এখন নিম্নবর্গের ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আবিষ্কারটি একান্তই পদ্ধতিগত। যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং ক্রিয়াকলাপ যা প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্রের অঙ্গ বা তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তার বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা করার সরঞ্জাম এই পদ্ধতি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনও বিকল্প রাষ্ট্রক্ষমতা নির্মাণের কর্মসূচি তা থেকে পাওয়া যাবে না। বরং যে কোনও প্রতিষ্ঠিত অথবা প্রতিষ্ঠার অভিলাষী ক্ষমতাতন্ত্রের সমালোচনাই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর ভেতর সম্ভব।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখক বা পাঠক হিসেবে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাদানুবাদে যোগ দেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্চবর্গের রাজনীতি বা মতাদর্শের ভেতর নিম্নবর্গের প্রতিকল্পটি কীভাবে নির্মিত হয়েছে, সেই বিষয়টি এখন অনেক স্পষ্টভাবে নজরে আসার ফলে উচ্চবর্গীয় রাজনীতির বিবাদে ভিন্নতর অবস্থান নেওয়াও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক পর্যায়ের ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর আলোচনায় অন্তত তিনটি সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনটি ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের পারস্পরিক বিতর্কে নিম্নবর্গীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন মাত্রা যোগ করা গিয়েছে।৭
প্রথম বিষয়টি হল সাম্প্রদায়িকতা। এই নিয়ে অধিকাংশ আলোচনাই দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে হয়েছে—একটি হিন্দুত্ববাদী, অন্যটি সেকুলারপন্থী। ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর আলোচনা থেকে যে-দিকটা অনেক স্পষ্ট হয়েছে, সেটা হল যে এই সেকুলার কমিউনাল ঝগড়া কোনও অর্থেই আধুনিকতা বনাম পশ্চাৎপদতার ঝগড়া নয়। দুটিই সমানভাবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীভূত। দ্বিতীয়ত, দুই পক্ষ আসলে আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতা বিস্তারের দুধরনের কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করে চলেছে। দুটিই উচ্চবর্গীয়, কিন্তু তাতে নিম্নবর্গের নির্মাণ দুরকমের। তৃতীয়ত, নিম্নবর্গেরাও এই দুধরনের আধিপত্যের সামনে পড়ে নিজেদের মতো, কিন্তু বিভিন্নভাবে, তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। দরিদ্র এবং শোষিত হলেই তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরোধী এবং সেকুলার রাজনীতির সমর্থক হবে, এই অতিসরল সিদ্ধান্ত নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক প্রথমেই খারিজ করে দেবেন।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এ উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়েছে, তা হল জাতিভেদ প্রথা। বিশেষ করে মণ্ডল কমিশন বিরোধী আন্দোলনের পর এই নিয়ে তুমুল হট্টগোল হয়ে গেছে। ডিসকোর্স হিসেবে দেখার ফলে জাতপাত নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির একটি দিক কিন্তু অনেক স্পষ্ট হয়েছে। তা হল যে জাতিভেদ প্রথার ধর্মীয় ভিত্তি এখন প্রায় সম্পূর্ণ লুপ্ত। কেউ তা নিয়ে আর কথা বলে না। এখন সমস্ত বিরোধেরই কেন্দ্র হল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান নিয়ে। দ্বিতীয়ত, তথাকথিত সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয় গণ্য করা বা না করার মধ্যেও আবার উচ্চবর্গের আধিপত্য বিস্তারের দুধরনের কৌশল কাজ করছে। এবং নিম্নবর্গও তার সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্নভাবে এই ক্ষমতাতন্ত্রের বিরোধিতাও করছে, আবার সুযোগও নিচ্ছে।
তৃতীয় বিষয়টি হল মহিলাদের সামাজিক অবস্থান সংক্রান্ত আলোচনা। পুরুষশাসিত সমাজে সব নারীই এক অর্থে নিম্নবর্গ। কিন্তু তাই বলে নারীর কোনও শ্রেণীগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত পরিচয় নেই, এও সত্য নয়। সুতরাং নিম্নবর্গের নির্মাণ দেখতে হলে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অধীনতাও যেমন বিশ্লেষণের বিষয়, তেমনি অন্যান্য ক্ষমতার সম্পর্ক, যেমন শ্রেণী, জাতি, সম্প্রদায়, ইত্যাদি কীভাবে সেই নিম্নবর্গীয় নারীর নির্মাণটিকে আরও জটিল করে তোলে, তাও বিশেষ গবেষণার বিষয়। সাম্প্রতিক বিতর্কে সমাজসংস্কার এবং বিশেষ করে নারীর অধিকার রক্ষার জন্য আইনের সংস্কার নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলেছে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে নারীর অধীনতা আর বিশেষ অর্থে নিম্নবর্গীয় নারীর অধীনতা পরস্পর সম্পর্কিত হলেও যে দুটি ভিন্ন বিষয়, এই সত্যটি তুলে ধরার ফলে সাম্প্রতিক কালে ভারতের নারীবাদী রাজনীতির বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
এই তিনটি ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী এবং প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী রাজনীতির সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সিংহভাগ ধরে যে উচ্চবর্গীয় রাজনীতি ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, আগামীদিনে তার বিরোধী শক্তি হয়তো এইসব সমালোচনাকে অবলম্বন করেই সংগঠিত হবে। বামপন্থী ভাবনাচিন্তার জগতে অন্যদের তুলনায় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ যে সেই সম্ভাবনাকে অপেক্ষাকৃত বেশি তাত্ত্বিক স্বীকৃতি দিতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ হয়তো এই যে, পদ্ধতির দিক দিয়ে অত্যন্ত মৌলিক সমালোচনা এবং দিকপরিবর্তনও এখানে নিষিদ্ধ হয়নি। নিম্নবর্গের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ, পরিবর্তনশীল, নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চারও ঠিক তেমনই অবদ্ধ আর সচল থাকার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এই অর্থে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এই ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের সংগ্রামের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার প্রয়াস চলেছে।
টীকা
১ বর্তমান সংকলনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হল। দ্র. পৃ. ২২।
২ পার্থ চট্টেপাধ্যায়, ‘পরিভাষা পরিচয়: সাবলটার্ন’, এক্ষণ, গ্রীষ্ম সংখ্যা ১৩৯১ (১৯৮৪-৮৫)।
৩ এই পর্যায়ের বহু প্রবন্ধের মধ্যে থেকে তিনটি প্রবন্ধ বর্তমান সংকলনে দেওয়া হল—রণজিৎ গুহ-র ‘একটি অসুরের কাহিনী’, শাহিদ আমিন-এর ‘গান্ধী যখন মহাত্মা’ আর ডেভিড হার্ডিম্যান-এর ‘দেবীর আবির্ভাব’।
৪ Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Subaltern Studies: Deconstructing Historiography’ in Ranajit Guha, ed. Subaltern Studies IV (Delhi: Oxford University Press, 1985), pp. 338-63: ‘Can the Subaltern Speak?ֹ’ in Cary Nelson and Lawrence Grossberg, eds., Marxism and the Interpretation of Culture (Urban: University of Illinois Press 1988).
৫ এই পর্যায়ের রচনার নিদর্শন এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত: দ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’।
৬ এর দৃষ্টান্ত এই সংকলনে দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধ।
৭ তিনটি দৃষ্টান্ত এই সংকলনে দেওয়া হল: গৌতম ভদ্র, বীণা দাস ও জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে-র প্রবন্ধ।
গান্ধী যখন মহাত্মা – শাহিদ আমিন
১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গান্ধী পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলায় আসেন। এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাত্রেই বারাণসীতে ফিরে যান। জনসমাবেশে এক থেকে আড়াই লাখ মতো মানুষ তাঁকে আবেগপূর্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু বিহারের চম্পারনে অথবা গুজরাটের খেড়ায় গান্ধীজি যেমন বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন, গোরখপুরকে তিনি তেমন কোনও সময় দেননি, যাতে কৃষক আর জনসাধারণের আন্দোলন সেখানে গড়ে উঠতে পারে। এই অঞ্চলে সশরীরে গান্ধী ছিলেন একদিনেরও কম, কিন্তু মহাত্মার কল্পরূপ পরবর্তী মাসের পর মাস জনমনের চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিল। এমন কী ১৯২১-এর এপ্রিল-মে নাগাদ স্থানীয় কিছু কংগ্রেসকর্মীর কাছেও এই দেবত্ব আরোপ (পায়নিয়র পত্রিকার ভাষায় ‘আনঅফিসিয়াল ক্যাননাইজেশন’) বেশ ভয়াবহ ঠেকে।
এই কয়েক মাসের সময়সীমায় নেহাতই ছোট সেই জায়গাটিতে মহাত্মার কর্ম এবং জীবনের প্রভাব কীভাবে পড়েছিল, তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। কৃষকের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ঐতিহাসিকদের কাছে বিষয় হিসাবে অসামান্য। এই প্রবন্ধে সেই সম্বন্ধের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গান্ধীর ‘ক্যারিসমা’র উপাদানসমূহ নয়, বরং কীভাবে ব্যাখ্যার অতীত তাঁর সেই ক্ষমতা কৃষকচৈতন্যকে স্পর্শ করেছিল, তাই আমাদের বিষয়। এমন কাজে ঐতিহাসিক দলিলপত্রই একটা মূল বাধা। মহাত্মার প্রতাপ নিয়ে যে গুজব গোরখপুরের পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছিল, তার সবগুলিরই প্রকাশ ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে। যে কাহিনীগুলি আমরা নির্বাচন করেছি, তার প্রতিটিই ওই সময়সীমার অংশ। তাই ১৯২১ সালের গোড়ায় চৌরিচৌরার দাঙ্গা অথবা অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহাত্মার কল্পরূপে কী পরিণতি এনেছিল, তা পুরোপুরি জানা যায় না। নির্বাচিত কাহিনীগুলির ভিত্তিতে বুঝতে চেষ্টা করব, গান্ধীকে নিয়ে কী ছিল কৃষকমনের অনুভব, লোকায়ত বিশ্বাসে মহাত্মার অবস্থানই বা কোথায়, কৃষকের প্রতিবাদে কী তার প্রভাব, যে প্রতিবাদ অনেকাংশেই কংগ্রেসী বিশ্বাসের ছকে ঢালা ব্যাখ্যা থেকে আলাদা।
উনিশ শতকের শেষ দশকে গৌ-রক্ষণী সভার প্রসার, পরে নাগরী আন্দোলনের অগ্রগতি, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দি সাংবাদিকতা ও হিন্দু সমাজ-সংস্কার, এগুলোই ১৯১৯-২০ পর্যন্ত গোরখপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।১ জেলার বিভিন্ন স্তরের লোকেরা এই সব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরগনার ভূতপূর্ব রাজারানিরা, জমিদার-বংশের প্রতিনিধিবর্গ, স্কুলশিক্ষক, পোস্টমাস্টার, নায়েব, তহশীলদার, আহির এবং কর্মী রায়ত, সবাই সেই আন্দোলনে মেতে ওঠে। যদিও সেই আন্দোলন সম্বন্ধে আহির আর কুমীদের ধারণা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম কুড়ি বছরের ঘটনাসমূহ মূলত গণ্যমান্য বণিকশ্রেণীর সাহায্যনির্ভর, তবু বুদ্ধিজীবী, ধর্মপ্রচারক এবং গ্রামবাসীদের অংশবিশেষও সেই ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গড়ে ওঠেনি রাওলাট অ্যাক্ট-এক বিরোধিতায় কোনও আন্দোলন, যেমন হয়েছিল পঞ্জাবে, জন্ম নেয়নি অযোধ্যার সমতুল কোনও কিযাণ সভা-আন্দোলনও। গোরখপুরের গৌ-রক্ষণীসভাগুলি সমাজ-সংস্কারের প্রয়াসে বিংশ শতাব্দীর ‘সেবাসমিতি’ হিতকারিণী সভাগুলির পথ প্রদর্শক। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গোরখপুরে সমাজ-সংস্কার, হিন্দিভাষা বা হিন্দুধর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন আর আন্দোলনগুলো ছিল জাতীয়তাবাদী কর্মধারায় অপ্রত্যক্ষ সাহায্যের মতো।
জাতি বা বর্ণকে ভিত্তি করে যেসব সভা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন ১৯২০-র ডিসেম্বরে ভিতিগ্রামে ভূমিহার-রামলীলামণ্ডল, উদ্দেশ্য শ্রীরামচন্দ্রজীর প্রকৃত চরিত্র উদ্ঘাটন করে একতা ও সত্যাগ্রহ প্রচার। একইভাবে নিম্ন আর মধ্যবর্ণের পঞ্চায়েতে দেখা গেল আহারের ব্যাপারে নতুন বাছ-বিচার। আসলে এ-সবই আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যার প্রকাশ মেয়েদের পরের বাড়িতে কাজ করায় অসম্মতিতে, অথবা সরকার কি জমিদারকে বেগার দেওয়ায় আপত্তিতে। একই সময় মেথর, ধোপা নাপিতের মতো বহু নিম্নবর্ণের মানুষ মদ মাংস ছেড়ে দেয়। আচার অনুষ্ঠানে যারা ছিল অশুদ্ধ, তাদের এই আত্মশুদ্ধির প্রয়াস অনেক ক্ষেত্রেই নিগ্রহের চিহ্নসমূহকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার সমতুল। উনিশ শতকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা প্রায় সকলেই মাংসাশী ছিল। ১৯২০ সালে হঠাৎ মাংস ছেড়ে দেওয়া তাদের দিক থেকে একটা জাতে ওঠার বা ‘সংস্কৃতায়ন’-এর প্রচেষ্টামাত্র নয়। মদ-মাংস, অন্যান্য নেশাদ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জেলাশাসকদের জানিয়েছিল চিরাচরিত বেগার দেওয়ায় তাদের আপত্তির কথাও।
১৯২০ সালের গোরখপুরকে কোনওভাবেই কংগ্রেস অথবা স্বাধীন কিষাণ সভার দুর্গ বলা চলে না। কংগ্রেস সাপ্তাহিকী স্বদেশ-এর সম্পাদক গোরখপুর, বস্তি, আজমগড়ের এই অবস্থা নিয়ে একাধিকবার আক্ষেপ করেছেন। উপযুক্ত কর্মনিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবই এমন পরিস্থিতির হেতু, এই ছিল তাঁর যুক্তি। গোরখপুর শহরে, এমন কী দেওরিয়া, বাহরাজ বাজারের মতো ছোট শহরেও রাজনৈতিক সভা জোরদার হয় ১৯২০-র জুলাই-আগস্ট থেকে। ওই সময় কাউন্সিল নির্বাচনে রাজা রইস এবং উকিলদের প্রচারের বিরোধিতা করা হয়, সরাসরি প্রশ্ন ওঠে অত্যাচারী জমিদার আর স্বার্থান্বেষী উকিলদের সততার বিষয়ে। বহু খোলা চিঠি প্রকাশিত হয় স্বদেশ-এ, যার মূল বিষয় বড় জমিদারদের কৃষক নিপীড়ন। এতদূরও শোনা গেল যে প্রজাদের হয়ে কথা বলবার কোনও স্বাভাবিক অধিকার রাজাদের নেই। ডিসেম্বর ১৯২০-র নাগপুর কংগ্রেস আর কাউন্সিল নির্বাচন বয়কট-এর ধারাবাহিকতাতেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার মহাত্মার আত্মিক জীবনীর অংশ হিসাবে জোর পায়। ১১ নভেম্বরের স্বদেশ-এ প্রথম পৃষ্ঠায় দশরথ দ্বিবেদীর জোরাল সম্পাদকীয়তে বোল্ড হরফে ছাপা হল ভোটদাতাদের উদ্দেশে আবেদনঃ
গোরখপুরের ভোটদাতারা শুনুন! নিজেদের আত্মসম্মানের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হবেন না। পোষা দালালদের থেকে সাবধান। আপনাদের প্রকৃত শুভার্থী কে, সে বিষয়ে অবহিত থাকুন। মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, পণ্ডিত মালভিয়াজী, না সেই সব লোক যারা ভোট ভিক্ষে করতে এখন আপনাদের পিছনে ছুটছে? নিজেরাই ভেবে দেখুন, এসব লোক কী করেছে আপনাদের জন্য, যে কাউন্সিল-এর ভিতর থেকে তারা আপনাদের দুঃখদুর্দশার সম্মান আনবে? এবারে মহাত্মা গান্ধীর দিকে চোখ ফেরান। এই পবিত্র মূর্তি আপনাদের জন্য নিজের তনু মন ধন অর্পণ করেছেন। আপনাদের কল্যাণ করতেই তিনি সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন, জেলে গেছেন, অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও এই মুহূর্তে যে তিনি সারা দেশে ঘুরছেন, এ শুধু আপনাদেরই স্বার্থে। এ হেন মহাত্মা গান্ধীরই উপদেশ—আপনারা ভোট দেবেন না। দেবেন না, কারণ আপনাদের প্রায় তিরিশ হাজার পাঞ্জাবী ভাইদের উপর গুলি চলেছে অমৃতসরে। মানুষকে চলতে হয়েছে বুকে ভর দিয়ে। যাঁরা ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবধান! সাবধান! কাউকে ভোট দেবেন না।
গোরখপুরে জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিল বয়কট নিয়ে যে আলোচনা হয়, এই পাঠ্যাংশটিকে বলা চলে তার প্রতীক। ভোটদানে বিরত থাকার কারণ হিসাবে পাঞ্জাবের অত্যাচার, ব্রিটিশের উদাসীনতার উল্লেখ ছিল সেই লেখায়। লেখাটিতে অনস্বীকার্য যা, তা হল গান্ধীর সাধুসুলভ ব্যক্তিত্ব, দরিদ্রের যন্ত্রণায় যে ব্যক্তি দগ্ধ, আবার একই সঙ্গে নিজের আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য যে দাবি করে। এমনভাবে যদি দেখি, নির্বাচন বয়কট বা ব্রিটিশদরদী প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান ঠেকে ধর্মীয় আচরণের মতো; যে আচরণ মিল খুঁজে পাবে তৎকালীন বহু হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং আত্মশুদ্ধির প্রয়াসে। যা আবার জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রচারকদেরই প্রচার, যাকে পালনীয় ধর্ম বলে মেনে নেন হিন্দু নিম্নবর্ণের অনেক পঞ্চায়েত। এ তবে তেমনই এক অঞ্চল, যার সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ অযোধ্যায় হয়েছে কৃষকবিদ্রোহ, অথচ সেই অঞ্চলটিতে তখনও গড়ে ওঠেনি তেমন কোনও কৃষক আন্দোলন। এ-হেন গোরখপুরে গান্ধী এলেন ১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর এক জনসভায় গান্ধীকে গোরখপুরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সভাপতি ছিলেন মৌলবী মকসুদ আলি ফৈজাবাদী, প্রধান বক্তা গৌরীশঙ্কর মিশ্র। সভায় খিলাফত আন্দোলনের বন্দিদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অপর একটি সিদ্ধান্তে অসহযোগই অবশ্যকর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে গান্ধী এবং আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে গোরখপুরে আসবার জন্য তারবার্তা পাঠানো হয়। নাগপুর কংগ্রেসে গোরখপুরের প্রতিনিধিরাও দেখা করেছিলেন গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধী কথা দিলেন, জানুয়ারির শেষে কি ফেব্রুয়ারির গোড়ায় আসবেন গোরখপুরে। প্রতিনিধি দলটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য বাবা রাঘবদাসের নাম। অনন্ত মহাপ্রভুকে ঘিরে যে আধ্যাত্মিক সংগঠন, সেই সময় রাঘবদাস তার নেতা, বাহরাজ-এর পরমহংস আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাও বটে। অসহযোগের যে মন্ত্র রাঘবদাস আর দশরথ দ্বিবেদী নাগপুর থেকে নিয়ে এলেন তার সঙ্গে যুক্ত হল মন্ত্রের প্রবক্তার প্রত্যাশিত আবির্ভাবের উত্তেজনা। খুব তাড়াতাড়ি অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার জেলাকে একটা উৎসবের সাজে সাজিয়ে ফেলল৷ যেন আরও বড় কোনও ঘটনার প্রস্তুতিতে মাতিয়ে দেওয়া হল অঞ্চলটিকে। বাহরাজ-এর কাছে রাঘবদাস আর তাঁর ব্রহ্মচারী শিষ্যদের পদভ্রমণ, নিকটস্থ কুইন অঞ্চলে কৃষকদের কাছে গাওয়া চঙ্গুর ত্রিপাঠীর গান্ধীভজনের সুর তেমন কিছু উত্তেজনা আর প্রতীক্ষার ইতস্তত নিদর্শন। আবার নবপর্যায়ে প্রকাশিত কবি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কাব্যময়তার প্রবল আবেগেও সেই একই উত্তেজনার প্রতিফলন। যে কবিত্বের উদ্দেশ্য সকল মানুষকে শ্রেণী-নির্বিশেষে পরিত্রাতা কৃষ্ণের পুনরায় মর্ত্যে আবির্ভাবের বার্তায় আকুল করে তোলা।
জনগণের উত্তেজনার আভাস মিলবে গান্ধীর গোরখপুর আগমনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনাকল্পনা এবং সংবাদ পরিবেশনায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গান্ধীর আগমনবার্তা বাধাহীন আগুনের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। স্বদেশ-এর সম্পাদক দশরথ দ্বিবেদীর কাছে শত শত চিঠি আসে, প্রতিটিরই প্রশ্ন গান্ধীর আগমনের সঠিক তারিখ নিয়ে। এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার আবহে ৯ জানুয়ারির স্বদেশ পাঠকদের জানাল যে বারাণসীর আজ পত্রিকায়, কানপুরের প্রতাপ এবং বর্তমান-এ, প্রয়াগের ভবিষ্য পত্রিকায় গান্ধীর আগমনের তারিখ প্রকাশিত হবে, লিডার আর ইনডিপেনডেন্ট কাগজেও থাকবে তার খবর। গোরখপুর জেলার ছ’টি তহশীলে পোস্টার, চিঠি, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল স্বদেশ নিজে।
একই সঙ্গে প্রস্তুতি চলছিল কংগ্রেস জেলা পরিষদেও। স্থির হল, একটি জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করবেন গান্ধী, জেলা পরিষদই এ-বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিল। গান্ধীর আগমনবার্তা নিয়ে বক্তারা আগেই চলে যাবেন তহশীলভুক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে, বক্তৃতায় তারা কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করবেন, অনুরোধ করবেন জাতীয় বিদ্যালয়ে অর্থ সাহায্যের জন্য। ৮ ফেব্রুয়ারির জনসভা, স্টেশনে স্টেশনে গান্ধীকে দেখবার জন্য বিশাল জনসমাগম প্রমাণ করে যে সংবাদ প্রচারের গতি ছিল যথেষ্ট দ্রুত। ৬ ফেব্রুয়ারির স্বদেশ-এ গান্ধীর আগমন সম্বন্ধে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই লেখা থেকে বোঝা যায় গান্ধীর কোন মূর্তি স্থানীয় কংগ্রেসকর্মীরা তুলে ধরেছিলেন; জানা যায় জাতীয়তাবাদী পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবর্গের সঙ্গে এলিট নেতৃত্বের সম্বন্ধটা কোন প্রকৃতির, সেখানে গান্ধীর অবস্থানই বা কোথায়। ‘গোরখপুরের পরম সৌভাগ্য’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়টি দশরথ দ্বিবেদীর লেখা। একজন গোঁড়া জাতীয়তাবাদী তিনি। ভেবেছিলেন, গান্ধীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গোরখপুরের অরাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যাবে। সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণের যে নমুনা সম্পাদকীয়তে পাই, তা জরুরি:
প্রার্থনা এই যে গোরখপুরের সাধারণ জনতা কেবলমাত্র মহাত্মাজির দর্শন পেতেই উৎসুক। মহাত্মাজি আসবেন, কৃতার্থ করবেন দর্শন দিয়ে। নিজেদের ত্রাতাকে স্বচক্ষে দেখে মানুষের আনন্দের সীমা থাকবে না। তবে আমার জিজ্ঞাস্য, সরকারের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করছে যারা, এ সময় তাদের কোনও কর্তব্য আছে কি না। হৃদয় থেকে যে উত্তর পাই, তা বলে, নিশ্চয় আছে। তারা যেন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নতজানু হয়ে সেই পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করে, যাতে তিনি তাদের নৌকাকে এই ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছিয়ে দেন।…এই সময় আমাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর অবতীর্ণ হওয়া দেশ এবং সমাজের পক্ষে কতখানি কল্যাণের, তা সহজেই তোমরা বুঝতে পারবে।…কোনওরকম ইতস্তত না করে এগিয়ে এসো জেলার পীড়িত ভাইদের সেবায়। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে বাজাও স্বরাজের শঙ্খ। এই আন্দোলন, যা মহাত্মা গান্ধী তোমাদের কাছে পেশ করছেন, তা তোমাদের কাছে অমৃতস্বরূপ।
সাধারণ মানুষ এবং এলিট কীভাবে গান্ধীর আগমনকে আমন্ত্রণ জানাবে, এ লেখাতে তা পরিষ্কার। সমবেতভাবে গান্ধীদর্শন, দর্শন পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মানা, আর এই স্বর্গসুখের আস্বাদ নিয়ে নিষ্ক্রিয়, নিপীড়িত জীবনে ফিরে যাওয়া—এই তাদের কর্তব্য। সাধারণ মানুষ এটাই কেবল জানবে যে মহাত্মা গোরখপুরে আসছেন শুধুমাত্র তাদের দর্শন দিতে। স্বরাজ আন্দোলনের আহ্বান তারা নিজেদের ভিতরে নিজেরা অনুভব করবে, এটা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। গ্রামে গ্রামে স্বরাজের শঙ্খ বাজাবে এলিটরা, গোরখপুরের নিপীড়িত ভাইদের আন্দোলন হবে গান্ধীর এলিট-অনুগামীদের প্রেরণানির্ভর। গান্ধীকে দেখতে কৃষকের গোরখপুরে আসা, মফস্বল স্টেশনে গান্ধীদর্শনের আশায় তাদের ভিড়, জাতীয়তাবাদের দর্পণে এ সবই তো অর্থহীন, যদি না নেতারা এই বিপুল জনসমর্থনকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন। কৃষকের এই যাত্রা যে অনেক সময়েই জমিদারের আদেশের বিরুদ্ধে, এবং সে অর্থে এক রাজনৈতিক প্রতিবাদ, এমনভাবেই যে সাধারণ গ্রামবাসী কোনও পণ্ডিতের ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝে নিতে পারে গান্ধীর মন্ত্রকে তার নিজের মতো করে, অনুরূপ কোনও সম্ভাবনা দশরথ দ্বিবেদীর মনে আদৌ দেখা দেয়নি। অথচ পরবর্তী কয়েক মাসে দ্বিবেদীর পত্রিকায় যেসব স্থানীয় খবর প্রকাশ পেল, তাতে দেখি গান্ধীর আগমনে সাধারণের প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের প্রত্যাশার অতীত। গান্ধীর গোরখপুর ভ্রমণ একান্ত সুব্যবস্থায় চিহ্নিত, তৎকালীন জনসমাবেশও বিস্ময়কর। স্বদেশ পত্রিকার বিবরণই বলে দেয়, যে ট্রেনে গান্ধী গোরখপুরে আসছিলেন, তা কীভাবে স্টেশনে স্টেশনে দর্শনপ্রার্থীর ভিড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২১-এ গান্ধী দর্শনের প্রত্যাশা নিয়ে গোরখপুরে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে বহু কৃষকই এক বছরের ব্যবধানে ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে চৌরিচৌরা রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সম্পূর্ণ অন্য এক ইতিহাস রচনা করতে। গোরখপুরে কৃষকদের মহাত্মাভক্তি যেন খানিকটা উগ্র ঠেকেছিল। মহাদেব দেশাই-এর ডায়েরি থেকে জানতে পারি, দর্শনলাভ ক্রমশই চলে যায় জনগণের অধিকারের পর্যায়ে। ‘জনতার হঠগ্রহ’, যা নাকি মধ্যরাত্রিতেও দর্শন দাবি করে, গান্ধীজির সহ্যসীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এমন করে যদি গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানায় কৃষক, তাঁর মন্ত্রকে তারা তবে বোঝে কীভাবে? এমন কিছু কি ছিল গান্ধীর বাণীতে, যা দ্ব্যর্থবোধক? গোরখপুরের কৃষককে গান্ধী যা বলেছিলেন, তার প্রধান বক্তব্য এইভাবে সাজানো যায়: (১) হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, (২) যেসব কাজ করা জনগণের পক্ষে অনুচিত—লাঠির ব্যবহার, হাটবাজার লুট, সামাজিক বয়কট, (৩) মহাত্মা তাঁর অনুগামীদের যা যা বর্জন করতে বলেন—জুয়া, মদ- গাঁজা, বেশ্যালয়ে যাওয়া, (৪) উকিলদের কর্তব্য ওকালতি ছেড়ে দেওয়া, সরকারি বিদ্যালয় বয়কট করা এবং সরকারি খেতাব বর্জন করা উচিত, (৫) সাধারণের উচিত তাঁত বোনা, তাঁতিদের উচিত হাতে-বোনা সুতোয় কাপড় তৈরি করা, (৬) স্বরাজ আসন্ন, কিন্তু স্বরাজের জন্য প্রয়োজন তাত্মিক শক্তি ও শান্তি, ঈশ্বরের কৃপা, আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি।
গান্ধীর বক্তৃতার বক্তব্যকে তাঁর ভাবাদর্শের মূল উপাদানসমূহে এইভাবে ভেঙে নিয়েই হয়তো গোরখপুরের কৃষক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল।
উপরোক্ত (৩) এবং (৬) সংখ্যক উপাদানকে জড়িয়ে তাঁর প্রতাপ এবং জাদু সম্পর্কে তখনকার যে ধারণা, তা গান্ধী সম্পর্কিত অনেক গুজবের মূলে কাজ করে। কী উচিত আর কোনটা অনুচিত, অর্থাৎ (২) আর (৩) সংখ্যক উপাদান গ্রামের মানুষের কাছে তেমন অর্থবহ ছিল না। কিন্তু উপাদান (৩) আর (৬) একত্রে দেবতুল্য মানুষের আদেশে উপমা পায়। সামাজিক বয়কট ১৯২১-এর আগে প্রায় অপ্রচলিত ঘটনা। গান্ধী গোরখপুরে আসবার পরপরই মানুষ নিজের তাগিদে কি পঞ্চায়েত বা সভার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির কাজে ব্যাপৃত হতে থাকে। গান্ধীর মন্ত্রের প্রসার, আবার একই সঙ্গে তার পরিবর্তনের এটাই প্রণালী। গোরখপুরে তখন যেসব কাহিনী চালু হয়েছিল, তাতে পাই সেই পরিবর্তনের আভাস, ওই বদলের উপর অতি-মানবিকের প্রভাব আর সব কিছুর সঙ্গে মহাত্মার যোগাযোগ।
গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গল্প স্থানীয় পত্রিকায় প্রথম বেরোয় ১৯২১ সালের জানুয়ারির শেষে। স্বদেশ-এর যে সংখ্যা গোরখপুরে তাঁর আগমনের সংবাদ জানায়, তাতেই ছিল আর এক নিবন্ধ, শিরোনাম ‘স্বপ্নে মহাত্মা গান্ধী: উলঙ্গ ইংরেজদের পলায়ন’। এক জন ইঞ্জিন ড্রাইভার, সম্ভবত সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, রাত এগারোটা নাগাদ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তার ঘুম এসে গেল; এক দুঃস্বপ্ন দেখল সে, ঘুম ভেঙে গেল সেই স্বপ্ন দেখে। ইংরেজদের বাংলোর দিকে ছুটে গেল চিৎকার করতে করতে, পালাও পালাও, গান্ধী আসছেন অনেক অনেক ভারতবাসী সঙ্গে নিয়ে, ইংরেজদের ধ্বংস করতে করতে। সেই চিৎকারে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, তাতে সাহেবরা সব বিছানা ছেড়ে উঠে উলঙ্গ অবস্থাতেই ছুটে গেল স্টেশনের দিকে, মেমসাহেবদের বন্ধ করল বাক্স অথবা আলমারিতে। অফিসার অনুপস্থিত, তাই পাওয়া গেল না অস্ত্রাগারের চাবি। কিন্তু ইংরেজরা বলে চলে, বাব্বা, এখনও জয়ধ্বনি কানে ভাসছে, আর আমরা ফিরব না বাংলোয়। সকালে ঘটনা শুনে ইংরেজদের আত্মিক শক্তি নিয়ে ভারতীয়রা খুব একচোট হাসিঠাট্টা করল। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় বারাণসীর আজ পত্রিকায়, পরে স্বদেশ-এ। ইংরেজদের ছোট করে ভারতীয় শক্তিকে বাড়িয়ে দেখবার যে তৎকালীন প্রবণতা, এ কাহিনীর প্রচলন তারই এক নিদর্শন। এমন সব গল্পে ইংরেজকে দেখা হতো নেহাতই দুর্বল এক জাতির চেহারায়, যাদের মনে অহিংস মহাত্মাকে নিয়ে নিদারুণ আতঙ্ক।
গোরখপুর আর উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গান্ধীর সম্বন্ধে এরকম বহু গল্প সে-সময় চলত। কাঠামো আর ধারাবাহিকতার বিচারে কাহিনীসমূহ প্রায় একই রকম। চারটি ভাগে এ ধরনের গল্পসমূহের আলোচনা করা যায়: (ক) মহাত্মার শক্তির পরীক্ষা, (খ) মহাত্মার বিরুদ্ধাচরণ, (গ) গান্ধীবাদী মন্ত্রের বিরোধিতা, বিশেষত খাওয়া-দাওয়া, মদ্যপান আর ধূমপান-সংক্রান্ত ব্যাপারে এবং (ঘ) বরপ্রাপ্তি, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের ফলস্বরূপ হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া, বৃক্ষ বা কৃপের প্রাণলাভ।
(ক) ১। বস্তি জেলায় মনসুরগঞ্জ থানার সিকন্দর শাহু ১৫ ফেব্রুয়ারি বললে, মহাত্মাজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি তার কারখানায় আখের রস-ভরা কড়াই দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। কড়াইটি ঠিক মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেল।
২। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ, বসন্তপুরের এক কাহার মহাত্মাজিকে সাচ্চা মানবে বলেছিল, একমাত্র যদি তার বাড়ির চাল উপরে উঠে যায়। লোকটার বাড়ির চাল দেয়াল ছেড়ে একহাত উপরে চলে গেল। আবার স্বস্থানে তা ফিরে এল তখনই, কাহার যখন মহাত্মাকে মেনে নিয়ে কেঁদে উঠল।
৩। ১৫ মার্চ আজমগড়ের এক চাষি বলে, মহাত্মাকে সে সত্যি মানবে, যদি তার দেড় বিঘে জমি সর্ষেতে ভরে যায়। পরের দিন তার গমের ক্ষেতের সব শস্য সর্ষে হয়ে গেল।
৪। ১৫ মার্চ রিয়াজন মৌজার বাবু বীরবাহাদুর শাহী ক্ষেতের ফসল তুলতে তুলতে কিছু মিষ্টি প্রার্থনা করলেন মহাত্মার শক্তি পরীক্ষার জন্য। অকস্মাৎ তাঁর শরীরের উপর মিষ্টিবর্ষণ হলো। মিষ্টির অর্ধেকটা দিলেন তিনি মজুরদের, বাকিটা রাখলেন নিজের জন্য।
৫। ১৩ এপ্রিল মহাত্মাজির নাম করে একটি কড়াই তৈরি হচ্ছিল। এক ঠাকুরের বউ বললেন, কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটলে, তবেই তিনি কড়াইটি মহাত্মাকে নিবেদন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা একটা ধুতিতে আগুন লেগে সেটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যদিও কোনও পোড়া গন্ধ সেখানে পাওয়া যায়নি।
৬। বাহরাজ থেকে স্বদেশ-এর এক পাঠক লিখছেন, দুজন চামার মাটি খুঁড়ছিল, আর কথা বলছিল ভোর গ্রামে সদ্য-আবিষ্কৃত মূর্তিটি নিয়ে। এক জন হঠাৎ বলে, এইখানে যদি একটি মূর্তি বেরিয়ে পড়ে, তবেই সে বিশ্বাস করবে ভোর গ্রামের মূর্তিটি মহাত্মাকে ডাকছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মহাদেবের একটি মূর্তি সেখানে পাওয়া গেল কাকতালীয়ভাবে। খবর ছড়িয়ে পড়ল, মানুষজন মেতে উঠল দর্শন পেতে, পূজা আর প্রণামী দিতে। স্থানীয় লোকেদের মত হলো যে, সেই প্রণামী দেওয়া উচিত জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।
৭। এমনই আর এক ঘটনা ঘটে বাহরাজ-এর কাছে বাবু শিবপ্রতাপ সিং-এর কুয়োতে। কিন্তু সেখানে লোকে যখন কুয়োর কাছে ছুটে যায় মূর্তিটি দেখবার আশায়, সেটি আর দৃশ্যমান ছিল না।
৮। রুদ্রপুর মৌজায় এক ব্রাহ্মণের অভ্যাসই হল ঘাস চুরি করা। লোকে তাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছে যে এসব কুকাজ বন্ধ করাই মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য। ব্রাহ্মণ বলে, গান্ধীজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, বা অসুস্থ হয় কি গোবর খায়। ভগবানের এমনই লীলা যে তিন-তিনটি ঘটনাই ঘটে গেল। ঘাস চুরি করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল, কে যেন ধরতে আসছে তাকে। চিৎকার শুরু হল তার। তার পর জ্ঞান হারাল, প্রচণ্ড জ্বরে পড়ল সে। লোকজন তাকে বাড়ি নিয়ে এল ধরাধরি করে। কিন্তু খানিক পরেই সে বাইরে গিয়ে গোবর খেল। তিন দিন বাদে তার পরিবারের লোকেরা মানত নেওয়ার পর সে সুস্থ হয়। এই ঘটনার ফলে সেই গ্রাম আর সেই অঞ্চলের সবাই চুরি করা ছেড়ে দিল।
৯। গোরখপুর বিদ্যালয়ের শ্রীবলরাম দাস স্বদেশ পত্রিকায় লিখে জানান যে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে তিনি রুদ্রপুর গ্রামে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। মহাত্মা-নির্দিষ্ট পথ সেখানে সবাই স্বীকার করে নেয়। এক ব্যক্তি শুধু তার পুরনো অভ্যাস ছাড়তে নারাজ, সে ঘাস কাটতে যায়। ফিরে এসে সে পাগল হয়ে গেল, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে লাগল। মহাত্মার নামে পাঁচ টাকা দেওয়ার পর সে শান্ত হয়।
এইসব গল্পে দুটি তথ্য খুব পরিষ্কার। প্রথমত, গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে গান্ধী তখন বিস্তৃত আলোচনার বিষয়। আমি গান্ধীজিতে বিশ্বাস করব, যদি কোনও অলৌকিক সম্ভব হয়, এই যে কথাটি বার বার ফিরে আসে, তা বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর পারস্পরিক কথোপকথনেরই প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে অপর একটি ইঙ্গিত নিহিত। উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে অসামান্যকে পূজা করবার যে রীতি লোকায়ত বিশ্বাসের অঙ্গ, গান্ধীর প্রতি মানুষের আচরণ তার সঙ্গে এক হয়ে যায়। উইলিয়াম ক্রুক লিখছেন, এমন সব অসামান্য ব্যক্তিত্বে দেবত্ব আরোপের মূলে ছিল তাঁদের শুদ্ধ জীবনযাপন এবং অলৌকিক ক্ষমতা।২ জীবনযাপনে শুদ্ধতার শর্তটি গান্ধী তাঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মে পূর্ণ করতেন। ভগবৎবিশ্বাসী গ্রামীণ মানুষ এতে দেবত্বের সন্ধান পায়। প্রতিটি কাহিনীই গান্ধীকে দেয় জাদু আর অলৌকিকের অধিকার। ফলে সেলিম চিশতির গল্পে অভ্যস্ত যে কৃষক, তার মনে গান্ধীর চেহারা উপমা পায় কল্পনার ঈশ্বরের অবয়বে।
(১), (৩), (৪) এবং (৫) সংখ্যক আখ্যানে, কোনও ব্যক্তি তার কাজ অথবা পরিপার্শ্বকে জড়িয়ে কোনও প্রার্থনা করে। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়াতেই কাহিনীর সমাপ্তি। কিন্তু (২) নং আখ্যান আরও কিছুদূর যায়। যে ব্যক্তি গান্ধীর শক্তি যাচাই করতে চেয়েছিল, তাকে মহাত্মার ক্ষমতার কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করতে হয়। এমন সব কাহিনী কেমনভাবে গান্ধীর নাম ছড়িয়ে দেয় গ্রামে গ্রামান্তরে, সাধারণের আচারকে ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যে, তার প্রমাণ (৬) সংখ্যক আখ্যান। মূর্তির উদ্দেশে দেওয়া প্রণামী কোনও ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয় না, চলে যায় জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে, যার সঙ্গে গান্ধীর গোরখপুরে আসা সরাসরি জড়িত। (৭) সংখ্যক কাহিনীতে মূর্তিটি অদৃশ্য হয়েছিল এবং খুবই সম্ভব একদল লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোটা গুজবটা ছড়িয়েছিল, এসব প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এমন অলৌকিক ঘটনাসমূহকে গোরখপুরে গ্রামবাসীর একান্ত স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া। যার ধরনটি হয়তো মেলে ধর্মগ্রন্থপাঠের সঙ্গে। তবে সুপ্ত এক রাজনৈতিক চেতনার প্রভাবও সেখানে নিহিত থাকে।
(২) সংখ্যক আখ্যানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে (৫) সংখ্যক কাহিনীর। দুটি গল্পেই অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করে তুলছে ভীতি। শাস্তির ভয় পূর্ব ভারতের বহু ধর্মোপাখ্যানেরই বিষয়। সন্দিগ্ধ কাহার অথবা অবিশ্বাসী মহিলা যখন ভক্তি আর বিশ্বাসেই আত্মসমর্পণ করে, মনে হয় এ যেন সেই পাঁচালি কি ব্রতকথার সমতুল, যেখানে দেবদেবীর ক্রোধ অবিশ্বাসীর বিরোধকে ভেঙে দেয়। একই বিষয়বস্তু আরও সুবিন্যস্ত (৮) এবং (9) সংখ্যক আখ্যানে। যেখানে মহাত্মার ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় মানুষ, আর মহাত্মার শক্তি সেই চ্যালেঞ্জকে পেরিয়ে নিজেকে অজেয় প্রমাণিত করে। রুদ্রপুরের ব্রাহ্মণ কোনও এক জন সাধারণ অবিশ্বাসী নয়; গান্ধীর মন্ত্রে উচ্চবর্ণের যে বিরোধিতা, তারই প্রতিনিধি ওই ব্রাহ্মণ। তার বিরুদ্ধতা এক অর্থে সমগ্র গ্রামের বিশ্বাসকেই প্রশ্ন জানায়। কিন্তু অবিশ্বাসের দাম তাকে দিতে হয় শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণায়। কাহিনীর পরিণামে গ্রামের সব মানুষ চৌর্যবৃত্তি বর্জন করে। এক নতুন নীতিবোধ যে গ্রামে জয়ী হল, এ তারই ইঙ্গিত। জয় আরও জোরদার, কারণ যথেষ্ট প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়েই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
(খ) ১০। বস্তি জেলার দামোদর পাণ্ডে জানায়, দুমারিয়া মৌজায় গান্ধীকে গালাগালি দেওয়ার ফলে এক ব্যক্তির চোখের পাতা জুড়ে গেছে।
১১। চারাঘাটের এক মাইল দূরে উনছাভা গ্রামে অভিলাখ আহীর-এর চার সের ঘি নষ্ট হয়ে যায়, কারণ সে গান্ধীর উদ্দেশে ব্যঙ্গোক্তি করেছিল।
১২। বেনুয়াকুটী মৌজার মৌনীবাবা রামানুগ্ৰহদাস বার বার গান্ধীকে গালমন্দ করেছিলেন। ফলে তাঁর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরতে থাকে। খানিক যত্ন নিলে, অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়। মৌনীবাবা তখন যজ্ঞাহুতির আয়োজন করলেন।
১৩। মাঝৌলি থেকে মুরলীধর গুপ্ত লিখে জানিয়েছেন যে, ৮ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী যখন গোরখপুর থেকে বারাণসী ফিরে যাচ্ছিলেন, সালেমপুর স্টেশনে তাঁকে দেখবার জন্য এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। সেই জনসভায় এসেছিল এক বারাই অর্থাৎ পানপাতার চাষির ছেলে। স্টেশনে আসবার সময় এক ব্রাহ্মণীর কাছে সে একটি চাদর চায়। ব্রাহ্মণী সেই অনুরোধ ক্রোধের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে কোনওমতে স্টেশনে এসে মহাত্মাকে দেখে বাড়ি ফিরে যায়। সকালবেলা আমি গ্রামে গুজব শুনলাম যে সেই ব্রাহ্মণীর গৃহে বিষ্ঠাবর্ষণ হয়েছে। শেষে ব্রাহ্মণী চব্বিশ ঘণ্টা নির্জলা উপোস আর মহাত্মাজির আরাধনায় শান্তিস্বস্ত্যয়ন করলেন।
১৪। বস্তি জেলার হরিহরপুর কসবায় এক রইস বাবু জ্ঞানপাল দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করছিল নিজের পিতার অন্তিম ইচ্ছানুসারে। সে ছিল গান্ধীবিরোধী; প্রজাদের ভয় দেখাত, যদি কেউ গান্ধীর শিষ্য হয়, এমন কি তাঁর নাম উচ্চারণ করে, পাঁচ টাকা জরিমানা হবে। চতুর্ভুজ এক বিশালাকার পুরুষ আবির্ভূত হলেন ৪ এপ্রিল রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ, জনসমাবেশে তিনি বললেন, “আমি শিবভক্ত। তোমরা সবাই শিবকে ভজনা কর। বাবুসাহেব, নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেবেন না। সত্য বলুন, অধর্ম বর্জন করুন, ধর্মকে অনুসরণ করুন’। এর পর সেই মূর্তি ধীরে ধীরে তাদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রথম চারটি আখ্যানে শারীরিক যন্ত্রণা এবং শুদ্ধতাহানিকে দেখা হয়েছে গান্ধীর বিরুদ্ধাচরণে দৈবিক শাস্তিস্বরূপ। (১৪) সংখ্যক আখ্যানে শরীরের যন্ত্রণার পরিবর্তে আসল দেবতার হুঁশিয়ারি, যার প্রকাশ এক জনসমাবেশে। ফলে যাদের সামাজিক অবস্থান বাবুটির নীচে, তাদেরই সামনে বাবুর ইজ্জৎ ভাঙচুর হয়ে যায়।
‘সন্ন্যাসী’, ‘বাবা’—এই ধরনের লোকেরা জাতীয়তাবাদী মন্ত্রকে লোকায়ত বিশ্বাসে মিলিয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিলেন, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু (১২) সংখ্যক আখ্যানটি ভিন্ন এক ইঙ্গিতেই পূর্ণ। মৌনীবাবা তার মৌন ভেঙেছিল গান্ধীর সমালোচনা করতে। ফলে যে পরিণতি তার হয়, তাতে বুঝি, গ্রামের মানুষ স্থানীয় সাধুটির কথা আক্ষরিক অর্থে মানেনি। সাধুর যন্ত্রণা যে গান্ধী বিরোধিতারই পরিণতি এমন ব্যাখ্যা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মৌনীবাবার কাছেও এই বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে, তাই তিনি যথোপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করেন। জানি না ওই ব্যাখ্যার আদিকর্তা কে, কোনও স্থানীয় কংগ্রেস নেতা, নাকি সাধারণ মানুষ। কংগ্রেস মহলে ব্যাখ্যার সূত্রপাত হলেও, তার প্রচলন, এবং এমন আরও অনেক কাহিনীর চলন বৃহত্তর এক বিশ্বাসেরই ইঙ্গিত।
দর্শনপ্রার্থীর নিষ্ঠা তাকে কতদূর কষ্টসহিষ্ণু করে, (১৩) সংখ্যক আখ্যানে তা দেখি। এও দেখি যে মহাত্মা-বিরোধীর যন্ত্রণা বা অশুদ্ধতা কীভাবে বাড়তে থাকে। উপবাস এবং পূজা প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গ। গল্পটি পড়লে বোঝা যায়, গুজবের গতি কী দ্রুত, তার শক্তিই বা কী মারাত্মক। এই আখ্যানে ব্রাহ্মণী ছেলেটিকে কেবল সক্রোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু রায়কিশোর চাঁদ বা বাবু জ্ঞানপালদেবের মতো বড় জমিদার প্রজাদের গান্ধী দর্শনে আরও প্রত্যক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়ান। (১৪) সংখ্যক কাহিনীটির একাধিক ব্যাখ্যা আছে। স্বদেশ-এ এই কাহিনী যিনি লিখে পাঠান, সেই যমুনাপ্রসাদ ত্রিপাঠী বাবু জ্ঞানপালদেবের সঙ্গে একমত যে এক দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রথমজন ঘটনাকে দেখছেন গান্ধী-বিরোধীর প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধের উপমায়। বাবু জ্ঞানপালদেব তা অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শিবপূজার উন্নতি প্রকল্পেই ওই আবির্ভাব। অতিপ্রাকৃতের সেই উপস্থিতিকে কৃষক কোন অর্থে বুঝেছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে এমন চিন্তা অমূলক নয় যে তাদের কাছে ঘটনাটি জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দৈবতিরস্কার।
(গ) ১৫। গোরখপুর থেকে এক ভদ্রলোক লিখে জানান, আলিনগর মহল্লার এক মোক্তার তার বাড়ির মেয়েদের চরকা কাটতে বলেছিলেন। মেয়েরা বলে, তাদের তো কিছুরই অভাব নেই, কেন তারা অকারণে চরকা কাটবে? ঠিক সেই সময় বাড়ির একটি তোরঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আগুন ধরে যায়। গোটা শহরে এই খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
১৬। বিস্তাউলি মৌজায় এক ফৌজদারি মামলা চলছিল। পুলিশ সেখানে পৌঁছলে, আসামী, প্রতিবাদী উভয় পক্ষই মিথ্যা ভাষণ করে। একজন মহাত্মার প্রতাপের দোহাই দিয়ে মিথ্যা ভাষণ থেকে বিরত হতে বলল তাদের। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ লিখে নেওয়ার পরেই আসামীর পুত্রবধূ মারা যায়।
১৭। আজমগড় থেকে শ্রীতিলকধারী রাই লিখে জানান, মৌজাগাজিয়াপুরে ১৮ ফেব্রুয়ারির সভায় স্থির হল যে গবাদিপশু আর ছাড়া থাকবে না। কাদের চৌকিদার এই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সে তার কথা রাখেনি। সে অঞ্চলের মানুষজন প্রতিজ্ঞার কথা তাকে মনে করিয়ে দিলে, কাদের বলল, গবাদিপশু সে ছেড়েই রাখবে, দেখবে পঞ্চায়েত বা গান্ধীজি কী করতে পারেন। এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটার পা ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। সে ফোলা আজও কমেনি।
১৮। দেওরিয়া থেকে বিশেষ প্রতিনিধি জানালেন, উকিল বাবু ভগবানপ্রসাদের কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! তার বাড়ির চারদিকে বিষ্ঠা; বাড়ির একটি মূর্তি, যা রাখা থাকত ট্রাঙ্কে, হঠাৎ পড়ে গেছে বাড়ির ছাদ থেকে। ভদ্রলোক বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরেও, চারপাশের সেই বিকট অবস্থা বদলায় না। শহরের অশিক্ষিত মানুষ বলে, উকিলসাহেব অসহযোগ নিয়ে আলোচনারত এক ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করেছিলেন, তাই এই দুরবস্থা।
১৯। দেওরিয়ার নামকরা উকিল ভগবানপ্রসাদের স্ত্রীর অবস্থাও অদ্ভুত। যেখানেই তিনি বসেন, চারপাশেই বিষ্ঠা দেখেন। যে পাতার উপর খাবার থাকে, সেখানেও মাঝেমধ্যে দেখেন বিষ্ঠা। বাড়িতে যে মূর্তি আছে, পূজার পর তাকে রাখলে সে অদৃশ্য হয়, অথবা উঠে যায় ছাদে কি পড়ে যায় ছাদ থেকে। কাউকে তিনি পুরি খেতে দিলে, চারটের জায়গায় দুটো কি পাঁচটা দিলে তিনটে থাকে। এ কথা সত্যি নয় যে মহিলাকে গান্ধীর এক অনুগামী অভিশাপ দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, উকিল সাহেব কলকাতা কংগ্রেসে গিয়েছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ওকালতি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ফিরে এসে কথা রাখেননি। তখন গান্ধীজির শিষ্যরা তাকে অভিশাপ দেন। তাই নাকি তিনি যত্রতত্র বিষ্ঠা দেখেন, এমনকি তাঁর আহার্যও মাঝেমধ্যে রূপান্তরিত হয় বিষ্ঠায়। এ সবই অসত্য। উকিলসাহেব দিব্যি আছেন। ওসব তিনি কিছুই দেখেন না। কলকাতায় কখনওই যাননি তিনি, ওকালতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেননি, কেউ কোনও অভিশাপও দেয়নি তাকে। তার বউ বাড়িতে যেসব ঘটনা দেখে থাকেন, সে সবই ভূতের লীলা।
২০। ১১ এপ্রিল পরাশিয়া আহীর-এর গ্রামে কয়েকজন জুয়া খেলছিল। স্বদেশ পত্রিকার লেখক কাশীনাথ তেওয়ারি তাদের বারণ করেন। সবাই তাঁকে মেনে নেয়, কেবল একজন ছাড়া। সে গান্ধীজির উদ্দেশে গালিগালাজ আরম্ভ করে। ঠিক পরদিনই তার ছাগলকে তারই চারটে কুকুর কামড়ে দেয়। ফলে লোকটি এখন বেজায় অখুশি— সে মেনেও নিয়েছে তার কসুর।
২১। রাও চক্রীপ্রসাদ লিখেছেন, ভাত্নি স্টেশনের কাছে এক পানবিক্রেতার ছেলেরা ছাগল মেরে তার মাংস খেয়েছিল। যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের কারও বারণই ছেলেরা মানেনি। একটু পরেই তারা বমি করতে থাকে, ভয় পেয়ে যায় সবাই। শেষ পর্যন্ত তারা মহাত্মার নামে শপথ নেয়, আর কোনওদিন মাংস খাবে না, সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়।
২২। বস্তি জেলার রামপুর গ্রামে এক পণ্ডিতকে বার বার বলা হয়েছিল মাছ খাওয়া ছেড়ে দিতে। বহু নিষেধ সত্ত্বেও পণ্ডিত অভ্যাস ছাড়েনি, বলেছিল মাছ সে খাবেই, দেখবে মহাত্মাজির দৌড় কতখানি। খেতে বসে সে দেখে, তার মাছভর্তি পোকা।
২৩। গোরখপুর জেলার নৈকট থানার বাবু ভগীরথ সিং লিখলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি বাবু চন্দ্রিকাপ্রসাদের পরামর্শে তাঁর রায়তরা মাদকদ্রব্য বর্জনের প্রতিজ্ঞা করে। এক কালোয়ার কিন্তু তার কথা রাখেনি। শুড়িখানার দিকে এগোনোর পথে, তার চারদিক থেকে ইঁট পড়তে থাকে। সে আন্তরিকভাবে মহাত্মাকে স্মরণ করলে ইঁট পড়া বন্ধ হয়।
২৪। গোদবাল গ্রামে ২২ ফেব্রুয়ারি এক সাধু এসে গাঁজার ছিলিমে টান দিচ্ছিল। মানুষজন তাকে থামাতে চাইল, শুরু হল মহাত্মার প্রতি তার কটুকাটব্য। পরদিন সকালে দেখা গেল, তার দেহ বিষ্ঠায় ভরা।
২৫। আজমগড় জেলায় পাহাড়িপুর গ্রামে পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ মিশ্র লেখেন যে কমলাসাগর মৌজার একটি সভায় স্থির হয়, কেউ কোনওরকম নেশা করবে না। পরে দুজন লোক লুকিয়ে লুকিয়ে খৈনি খাচ্ছিল। হঠাৎ একটা বাছুরের কাটা পা এক চতুর্বেদী সাহেবের বাড়ির সামনে পড়ে। এই অস্বাভাবিক ঘটনায় সবাই তামাক খৈনি ইত্যাদি বর্জন করে।
২৬। মাঝ্ওয়া মৌজার এক ব্যক্তি ধূমপান ছেড়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু কথা সে রাখতে পারেনি। ফলে চারপাশ থেকে নানাবিধ পোকামাকড় ঘিরে ধরে তাকে। এই খবরে মাঝ্ওয়ার দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরাও নেশা ছেড়ে দেয়।
২৭। দাভানি জেলায় পানবিক্রেতা একটি মেয়ে ধূমপান করত। একদিন স্বপ্নে সে দেখে, ধূমপানকালে হুঁকোটি আটকে গেছে তার মুখে। মেয়েটি ভয় পেয়ে প্রতিজ্ঞা করল, ধূমপান সে ছেড়ে দেবে।
এই সব আখ্যানে দেখি সেই একই ধারাবাহিকতা—ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, শুদ্ধতাহানি, প্রায়শ্চিত্ত—যার একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। ধারাবাহিকতায় লক্ষণীয় যে গান্ধীর মন্ত্র অনুযায়ী যা কিছু নিষিদ্ধ, তাকে সিদ্ধ করতে চাইলেই যন্ত্রণা অথবা শুদ্ধতাহানির সূত্রপাত। বুঝি, শুদ্ধতার যে গান্ধীবাদী সংজ্ঞা, তা লোকায়ত ধ্যানধারণাকে নিশ্চিতভাবে স্পর্শ করেছে। (১৮) এবং (১৯) সংখ্যক আখ্যান একই ব্যক্তি বা পরিবারকে ঘিরে। এ গল্পের দুটি আলাদা পাঠ আমরা পাচ্ছি, একটি স্বদেশ থেকে, অন্যটি ইংরেজের অনুগত জ্ঞানশক্তি পত্রিকা থেকে। স্বদেশ পত্রিকার লেখক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা থেকে নিজেকে তফাতে রাখেন, যেমন ‘শহরের অশিক্ষিতদের মতে’, নিজের কোনও ভিন্ন ব্যাখ্যা তিনি নির্মাণ করেন না। কার্যত দেওরিয়ার অশিক্ষিতদের ভাবনাই তাঁর লেখার মাধ্যমে চালু হয়ে যায়। জ্ঞানশক্তি-র সম্পাদক উর্পযুক্ত ব্যাখ্যার প্রতিটি ভাবাদর্শকেই খণ্ডন করেন। গৃহের অশুদ্ধতাকে তিনি মানেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে উকিল স্বামীর থেকে তাঁর স্ত্রীরই ক্ষতি বা দায়, দুইই বেশি। স্ত্রীর ওই অস্বস্তির মূলে স্বামীর কোনও আচরণের তেমন ভূমিকা নেই। লেখক দেখান, স্বামীর সম্পর্কে গুজবগুলো সবই মিথ্যে। কংগ্রেসের কাছে কোনও প্রতিজ্ঞা করেননি তিনি, শারীরিক বা মানসিক আরামেরও কোনও অভাব নেই তাঁর। অস্বাভাবিক ঘটনাবলী নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও, তার ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। প্রচলিত বিশ্লেষণে গুজবটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রসারের অংশ হয়ে যায়। ব্রিটিশ অনুগামী জনশক্তি-র কলমে এই বিশেষ দিকটি অনুপস্থিত। তথ্যখণ্ডনের প্রণালীতে মহাত্মা গান্ধীর স্থান নিল সেখানে ভূতের লীলা।
গান্ধীর মন্ত্রের জনপ্রিয় ব্যাখ্যার দিকটা অন্য কয়েকটি আখ্যানে আরও প্রকট। এখানে কাকতালীয় আর ঘটনাপরম্পরা কার্যকারণের স্থানে প্রতিষ্ঠিত। গোরখপুরের শ্রোতৃবৃন্দকে গান্ধী মাছ-মাংস পরিত্যাগ করতে বলেননি। অথচ (২১), (২২) বা (২৪) সংখ্যক আখ্যানে গান্ধীর ভাবরূপ এবং প্রতাপ কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়, ঘটনাপরম্পরায় বৃহত্তর অর্থসমূহ প্রাধান্য পেয়ে যায়। ‘আমি মাছ-মাংস খাব, ধূমপান করব, গাঁজা-তাড়ি-মদ খাব, দেখি তোমার মহাত্মাজি কী করতে পারে’, গান্ধীর প্রতি এই অবজ্ঞাপূর্ণ বিরোধী মন্তব্যই গুজবের জন্ম আর প্রচলনে জরুরি। মিতাচারের পক্ষ আর বিপক্ষের সংলাপে গান্ধীর নাম কীভাবে ব্যবহৃত, সে ইঙ্গিত কাহিনীগুলিতে পরিষ্কার। গান্ধীর পথকে মানতে চাইল না যারা, তাদের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী; সে সর্বনাশের সামাজিক তাৎপর্য এবং প্রায়শ্চিত্ত লোকায়ত বিশ্বাসকে অন্য এক চেতনার আস্বাদ দেয়; যা বোঝায়, স্থানীয় নিয়মে নির্ধারিত এসব রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ ব্যবহারিক জীবনে কত অসম্ভব, কত অবাঞ্ছিত।
খাওয়াদাওয়ার শুদ্ধতা নিয়ে কেন এত উদ্বেগ? এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর জানবার মতো তথ্য আমাদের নেই। তবে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। আগেই দেখেছি ১৯১০ সালে আচার-আচরণের শুদ্ধিকরণ নিয়ে গোরখপুরে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার জের নিরামিষ ভক্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। নিরামিষাশী হওয়ার কথা যে শুধু ধর্মপ্রচারকরা বলেছিলেন, তা নয়, নিম্নবর্ণের পঞ্চায়েত যেমন ধোবি, ভাঙ্গি, নাপিত, এরাও ঠিক করে, আহারের নিষেধাজ্ঞা না মানলে, জরিমানা দিতে হবে। ১৯২১-এর গোড়ায় শুদ্ধতার প্রতি এই আসক্তিকে দেখা যেতেই পারে গান্ধীবাদী আত্মশুদ্ধির (যথা মদ-গাঁজা বর্জন) বিস্তার হিসাবে। এই বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিত এমনই যে, নিষেধাজ্ঞা মাছ-মাংস বর্জন পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে সহজেই। সঙ্গে সঙ্গে একে ভাবা যায় ধর্মভাব এবং নিম্নবর্ণের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রমাণ। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯২১-এর জানুয়ারিতে উত্তর বস্তির পঞ্চায়েতরা বলে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার যে একান্ন টাকা জরিমানা, তা দেওয়া হবে গৌশালার অর্থভাণ্ডারে।
(ঘ) ২৮। ভাগলপুরের দেবকলি মৌজার পণ্ডিত জীবনন্দন পাঠক লেখেন, ছ-মাস পূর্বে এক মুসলমানের পাত্র কূপে পড়ে গিয়েছিল। মহাত্মাজির কাছে মানত করার পরে পাত্রটি আপনিই আবার উঠে আসে।
২৯। আজমগড়ে নৈপুরা গ্রামে ডালকু আহীর-এর বহুদিনের হারানো বাছুর আবার তার খুঁটিতে ফিরে আসে, মহাত্মাজির উদ্দেশে মানত করার পর। ডালকু আহীর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে মানতের এক টাকা দান করেছিল।
৩০। বার্নিয়া জেলার এক ভদ্রলোক লেখেন, রুস্তমপুর মৌজায় গোয়ালাসাধুর কুঁড়েঘর থেকে নব্বই টাকা সমেত থলিটি উধাও হয়েছিল। মহাত্মার উদ্দেশে মানত করার পর টাকা-সমেত থলি ফিরে আসে।
৩১। দেওরিয়া তহশিল-এ সমগড় মৌজার এক নামী জমিদার ভগবতীজির কাছে মানতে ছাগবলি দেন। সেই মাংসের প্রসাদ অনেকেই নিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জমিদারতনয়ের হাত তার বুকের কাছে আটকে গেল, পাগল হয়ে গেল তার বউ। জমিদার তখন জাতীয় অর্থভাণ্ডারে সেই ছাগলের মূল্য দান করতে সম্মত হন। ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন, এমন প্রতিজ্ঞাও নেন। ছেলে, ছেলের বউ, উভয়েরই স্বাভাবিকতা ফিরে এল।
৩২। গোরখপুর শহরে হুমায়ুনপুর মহল্লায় উকিলবাবু যুগলকিশোরের বাগানে দুটি গাছ মরে পড়ে গিয়েছিল। আবার তারা সজীবতা ফিরে পায়, উঠে দাঁড়ায় সোজা হয়ে। অনেকেই বলেন, মহাত্মাজির আশীর্বাদ এর মূলে। কারণ, যে লোকটি গাছ কেটেছিল, সে বলে মহাত্মাজির প্রতাপ যদি সাচ্চা হয়, গাছ দুটি আপনিই জীবন ফিরে পাবে। হাজার হাজার লোক রোজ আসে সেখানে, দেয় বাতাসা, টাকা, গয়না। লোকে বলে, এই প্রণামী স্বরাজ আশ্রম এবং তিলক স্বরাজ-অর্থভাণ্ডারে দেওয়া হবে।
৩৩। জ্ঞানশক্তি ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখল, একটি শীর্ণকায় আবৃক্ষ ঝড়ে উৎপাটিত হয়েছিল। গাছটির শাখাপ্রশাখার ভারবহনের পক্ষে তার শিকড় ছিল দুর্বল। গাছটি পড়ে যাওয়ার পরেও, তার মুলের অংশবিশেষ মাটির তলায় ছিল। লোকে যখন জ্বালানির প্রয়োজনে পড়ে-যাওয়া গাছের ডালপালা কেটে নিয়ে যায়, অপেক্ষাকৃত লঘুভার গাছটি সেই শিকড়ের জোরে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লোকের মুখে মুখে চালু হল, গাছটি আপনা থেকেই পুনর্জীবন পেয়েছে। লোকজন জড়ো হয় সেখানে, জায়গাটিতে যেন সর্বদাই মেলা। সকলেই দান করে বাতাসা, ফুল, টাকা। বলা হয় গান্ধীর প্রতাপেই নাকি তার জীবনলাভ। এই মেলা, লৌকিক বিশ্বাসের এই প্রকাশ শিক্ষিতের কাছে হাস্যকর।
৩৪। বস্তি জেলার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি স্বদেশ পত্রিকায় ঘটনাসমূহ লিখে পাঠিয়েছিলেন। চাকদেহী গ্রামে মহুয়া গাছের খুঁটি থেকে দুটি গাছ বেরিয়েছিল। কার্তিক মাসে খুঁটিটি পোঁতা হয়। তাতে বাঁধা থাকত এক পাঁড়েজির দুটি মহিষ। গুজব, যে এক চামার দেখেছিল, খুঁটি থেকে গাছটিকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু চামারের বউ সেটি টেনে একেবারে বের করে নেয়। ফলে চামারের উপর খানিকটা চোটপাট করে লোকজন। চামার প্রার্থনা করে, মহাত্মা, ‘তুমি যদি সত্যি সত্যি মহাত্মা হও, এই খুঁটিতে আর একটি গাছের জন্ম দাও’। তাই ঘটল। এখন প্রত্যহ সেই গাছ দেখতে বহু লোকের জমায়েত হয় জায়গাটিতে।
৩৫। বস্তি শহরে রঘুবীর কাসাউধন-এর বিধবা থাকেন। বিধবার পুত্রও বছর তিনেক হল মারা গেছে। তার স্বর্গত স্বামী দুটি আমগাছ পুঁতেছিলেন। একটিকে কিছুদিন আগে কেটে ফেলা হয়েছে, অন্যটিও গেছে শুকিয়ে। পনেরো দিন হল, শুকিয়ে যাওয়া গাছে হঠাৎ এসেছে নতুন পাল। বৃদ্ধা সেই বিধবা বলছেন, তিনি মহাত্মাজির কাছে মানত মেনেছিলেন—এই গাছই আমার স্বামীর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন, একে তুমি বাঁচিয়ে দাও। এই স্থানেও এখন বিরাট জনসমাগম হয়।
৩৬। স্বদেশ, ১৩ মার্চ ১৯২১: গত শনিবার গোরখপুর শহরের গোটা চার পাঁচ কুয়ো থেকে ধোঁয়া বেরতে শুরু করে। লোকের ধারণা হল, কূপের জলে আগুন লেগে গেছে, গোটা শহর ভেঙে পড়ল কূপগুলির কাছে। কিছু মানুষ একটি কূপ থেকে জল তুলল, সেই জলে ছিল ক্যাওড়াফুলের সুবাস। লোকের মনে হয়, এটা মহাত্মাজির প্রতাপের ফল। কুয়োটিতে কিছু টাকা প্রণামী দেওয়া হয়।
৩৭। স্বদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯২১: কিছুদিন আগে গোরখপুর সিভিল কোর্টের কাছে এক গ্রামে মারাত্মক আগুন লাগে। গোটা গ্রামই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কাছাকাছি একটি নালা ছিল। কাদা আর জলের আশায় লোকে সেই নালার মধ্যে একটি কাঁচা কুয়ো খুঁড়তে থাকে। অনেক হাত খুঁড়বার পরেও কিন্তু জল মেলে না। লোকমুখে শোনা যায়, সেই সময় কেউ একজন মহাত্মার কাছে মানত করেছিল। হঠাৎ ফোয়ারার মতো জলে উপচে উঠল কুয়ো, ষোলো-সতেরো হাত কুয়োটি ভরে গেল জলে। আশপাশের গর্তগুলিও জলে পরিপূর্ণ হল। তার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে আসছে, ফুল বাতাসা টাকা দিচ্ছে, স্নান করছে, মুখ ধুচ্ছে সেই জলে, বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে সেই জল।
৩৮। ওই একই ঘটনা সম্বন্ধে জ্ঞানশক্তি লেখে: গোরখপুর শহরের বাইরে বুলন্দ্পুর গ্রামের দক্ষিণে একটি বিশাল গর্ত আছে, যার গভীরতা ২৩ ফুটের কম নয়। গোরখপুর শহরের জলসীমা ২১ ফুট। অনেক সময় ওই সীমার আগেই জল পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে কুয়ো থেকে জল তুলতে সাধারণত ১১ হাত দড়ি ব্যবহার করা হয়। যে কুয়ো থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়েছে, সেটি এই গর্তের মধ্যে। জল পাওয়া গেলে, তা কুয়োটিকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। সেখানে এখন মেলা হচ্ছে। এমন একটি বিশাল গর্তে যখন কুয়ো খোঁড়া হয়, এরকম ঘটনা তো স্বাভাবিক। এ ধরনের কুয়ো অনেক দেখা যায়, যা গর্তের ভিতরেই খোঁড়া আর কানায় কানায় ভর্তি। লোকে বিশেষ কুয়োটিকে এখন টাকা বাতাসা ফুল দিচ্ছে, বলছে এ নাকি গান্ধীর আশীর্বাদের নিদর্শন, কূপের নামকরণও হয়েছে গান্ধীর নামে।…স্বরাজের জন্য কি এমন জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োজন?
৩৯। মির্জাপুর বাজার, যেখানে জল আপনাআপনি বেরিয়ে এসেছে, ভক্তরা সেখানে দান করেছে ২৩ টাকা ৮ আনা ১২ পাই। শীছেদিলাল এই টাকা গোরখপুর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছেন।
৪০। বস্তি জেলার বিক্রমজিবাজারে এক কুয়োর জলে দুর্গন্ধ ছিল। দুজন মহাজন মহাত্মাজির নামে মানত করলেন। পরের সকালেই জল শুদ্ধ হয়ে যায়।
৪১। সোনাওরা গ্রামে মহামারী লেগেছে। লোক এসে থাকছে গ্রামের বাইরে এক কুঁড়েঘরে। কিন্তু সেখানকার কুয়ো এতই অগভীর যে ২৭ এপ্রিল একটা লোটাও তার জলে পুরোপুরি ডোবানো যাচ্ছিল না। দেখেশুনে এক মিশ্রজি গান্ধীজির নামে পাঁচ টাকা বিতরণ মনস্থ করলেন। এর পরই জল ক্রমশ বাড়তে থাকে, ২৮ তারিখ দুপুরের মধ্যে জল ওঠে পাঁচ হাত, তার পরদিন এগারো হাত।
কাহিনীগুলিতে আবার দেখছি, মহাত্মার ভাবরূপ লোকায়ত বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের কাঠামোতেই স্থান পাচ্ছে। আঞ্চলিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানত করার যে প্রথা, তাই গান্ধীর আরাধনার উপায় (২৮) থেকে (৩০) সংখ্যক আখ্যানে। (৩১) সংখ্যক গল্পে দেখলাম তারই এক ভিন্ন চেহারা। যেখানে ভগবানকে মানত করা ছাগলের জন্য ফল হল হিতে বিপরীত, যেমন উচ্চবর্ণ জমিদার-পরিবারে শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক অসুস্থতা। যার প্রায়শ্চিত্ত শুধুমাত্র ব্রাহ্মণভোজনে সীমাবদ্ধ থাকল না, ছাগলের মূল্য-সমান টাকা দান করতে হল জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।
কংগ্রেসবিরোধী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা বৃক্ষ কি কূপের জীবনলাভকে (৩৩ নং, ৩৮ নং) যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা করল। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা সে বিন্যাস থেকে লুপ্ত। অঘটনের পার্থিব হেতুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ব্যাখ্যা। পানীয় জল সরবরাহ এবং সেচব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝি কূপ-সংক্রান্ত আখ্যানগুলি (৩৬ সংখ্যক থেকে ৪১ সংখ্যক) থেকে। তবে, এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রধান বিষয়বস্তু এক্ষেত্রে দুটি; প্রথমত, মহাজন কি উচ্চবর্ণের কোনও ব্যক্তির (সাধারণত জমিদার) পানীয় জল শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মানত (আখ্যান ৪০ এবং ৪১ সংখ্যক); দ্বিতীয়ত, যেসব কূপে অলৌকিকভাবে জল এসেছে, সেখানে জনসাধারণের টাকা, ফুল, বাতাসা ইত্যাদি প্রণামী দেওয়া। দুটি বিষয়ই সহজে বোধগম্য, যদি মনে রাখি জমিদারেরই একমাত্র সামর্থ্য ছিল ইঁদারা নির্মাণের খরচ বইবার, আর গোরখপুরে ইঁদারা নির্মাণ ঘিরে গড়ে উঠেছিল আচারবহুল অনুষ্ঠান।
গোরখপুরে কূপ নির্মাণ নিয়ে পূজার মনোভাব তখন বর্তমান। তাই কুয়োর উদ্দেশে ফুল, বাতাসা, টাকা প্রণামী দেওয়া, বা সেই টাকা জাতীয় বিদ্যালয়ে দান করা, ১৯২১-এর গোড়ায় যা বিশেষ লক্ষণীয়, এই সব কিছুই উপস্থিত ধ্যান-ধারণাকে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তৃত করছে। গান্ধীর নামে মানত, ব্ৰত বা আরাধনা, কি তাঁর নাম করে মহিলাদের ভিক্ষা চাওয়া, ভোগবিতরণ, সবই সেই একই বিস্তারের অংশ।
স্বদেশ-এর সম্পাদক ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখছেন, দেবী ভবানীর নামে ভিক্ষা অথবা ভোগ যেমন প্রচলিত, তেমনি গান্ধীর নামে মেয়েদের ভিক্ষা চাওয়া আর ভোগ দেওয়ার খবর এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এমন কী ঢেঁকিশালে যখন সদ্য রবিশস্য তুলে আনা হয়েছে, মহিলারা আসতেন শস্যভিক্ষা চাইতে, যা লাগবে মহাত্মার ভোগে। ভোগ দেওয়ার যে আচার, তার সমসাময়িক তাৎপর্য সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে মনে হয় ভাগ্য ফেরানোর বিশ্বাস এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল দেবী ভবানীর আরাধনাসংক্রান্ত আচারের বিস্তার; ঢেঁকিশালে ভিক্ষা চেয়ে কৃষকের মনে এমন এক নৈতিক দায়বোধ চারিয়ে দেওয়ার প্রয়াসও বটে, যে শস্য যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, তখন মহাত্মার নামে তা দান করা কর্তব্য। আরও লক্ষণীয়, যে গুড় তৈরি করে যে চাষি, তাকেও এমন দায়ে বদ্ধ করা হত। আখখোয়াড়ে গিয়ে গুড় ভিক্ষা চাওয়া প্রচলিত ছিল। আর সেই স্থান থেকে ভিখারিকে ফিরিয়ে দেওয়া নাকি অমার্জনীয় অপরাধ। ১৯২১-এর ১ মার্চ আজমগড় জেলায় নানুশাক গ্রামে এক আহীরের কাছে গুড় ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিল একজন সাধু। আহীর সাধুকে ফিরিয়ে দেয়। গুজব যে আধ ঘণ্টার মধ্যে আহীর-এর গুড় আর সঙ্গে দুটি মহিষ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। স্বদেশ পত্রিকায় এ কাহিনীর যে বিবরণ পাই, তাতে গান্ধীর কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু লক্ষ্ণৌ-এর পায়নিয়র পত্রিকা অনুযায়ী, সাধুটি মহাত্মার নামেই ভিক্ষা চাইছিল। সত্যি হোক আর নাই হোক, গান্ধীর নাম যে এ ঘটনার সঙ্গে আরও পত্রিকাও জড়িয়েছিল, এটা খুবই সম্ভব।
স্থানীয় জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিকে এসব গুজবের প্রতিবেদন কি একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট করে না যে কিছু গোষ্ঠী কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে গুজবগুলো ছড়িয়েছিল? এ কথা সত্যি যে স্বদেশ-এ তা ছাপা হত তখনই, যখন পত্রিকা দপ্তরে কেউ লিখে পাঠাত তেমন কাহিনী। তবে তার অর্থ এই নয় যে, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার আগে এমন-সব গুজবের অস্তিত্ব কি প্রচলন ছিল না। জ্ঞানশক্তি-র মতো জাতীয়তাবাদবিরোধী স্থানীয় পত্রিকায় গুজবের প্রতিবেদনে সেই প্রচলনেরই প্রমাণ।
একথা অবশ্য সন্দেহাতীত যে স্বদেশ-এ প্রকাশ পেলে, তাদের প্রচলন বাড়ে, আরও বিশ্বাসযোগ্যও হয় তারা। ফরাসি বিপ্লবকালে গ্রামে আতঙ্কের বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক লেকেব্র দেখিয়েছেন, গুজবকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে সাংবাদিকরা কীভাবে তাতে জুড়ে দিতেন নতুন জোর। তা সত্ত্বেও এটা পুরোপুরি মানা যায় না যে ছাপার অক্ষর গুজবের চেহারাকে খুব বেশি বদলে দেবে। গুজব এমনই এক মৌখিক ভাষা, যার স্রষ্টার নাগাল পাওয়া ভার। ছাপার অক্ষরে তার কার্যকারিতা বাড়ে। তবে গোরখপুরের মানুষ যে গল্পসমূহ মেনে নেয়, তার কারণ এই নয় যে স্থানীয় সংবাদপত্রে তাদের আস্থা অগাধ। কাহিনীগুলি তাদের বিশ্বাস, অলৌকিক নিয়ে তাদের ধারণা, তাদের নীতিবোধ, এসবের সঙ্গে একাকার হয়েছিল—গোরখপুরের মানুষের বিশ্বাসের মূল এটাই।
এমন সব গুজবের প্রচলনে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মৌলভী সুবহানুল্লাহ ১৯২২ সালে স্টেশন কোর্টে স্বীকার করেন যে, জনগণকে গুজবে বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে কংগ্রেস বা খিলাফৎ-এর পক্ষে কোনও প্রচেষ্টাই ছিল না। স্বদেশ পবিত্রতার দোহাই দিয়ে গুজব ছেপে চলে ‘ভক্তদের বিশ্বাস’ শিরোনামে। কিন্তু গুজবের প্রতি এই কাগজেরও ছিল দুটি ভূমিকা। একদিকে, তারা মাঝেমধ্যে নোট ছাপত অলৌকিক ঘটনাসমূহকে উড়িয়ে দিতে, এমন কি ব্যঙ্গকৌতুকও করত সেসব নিয়ে। অন্য দিকে, পায়নিয়র-এর আক্রমণের প্রতিবাদে নিজেদের তরফে গুজব ছাপার সাফাই গাইত। চাপে পড়ে, স্বদেশ-এর সম্পাদক কৃষকের মেনে নেওয়াকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বদেশ-এর সম্পাদক, মহাত্মার প্রতি ভক্তির আদর্শ যিনি জেলায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর দ্বিধা ছিল না মহাত্মার প্রতাপ-বিষয়ে গুজব প্রকাশ করতে। তবে গুজব যখন বিপজ্জনক কোনও ধারণা অথবা কাজের প্ররোচক, যেমন জমিদারিপ্রথা বিলোপ, খাজনা কমানো, বাজারে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা, তখনই আবার স্বদেশ পত্রিকা গুজবের বিরোধী ভূমিকায় চলে যায়।
ঠিক যেমন গোরখপুরে নানান অলৌকিক ঘটনায় মহাত্মার নাম জড়িয়ে গেল, তেমনিভাবে জনসভা, পুস্তিকা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর নাম। যুক্ত হয় মহাত্মার নাম স্বরাজ কথাটির সঙ্গে, একাধিক অর্থে যার ব্যবহার। চৌরিচৌরা দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ কোর্টে জজেরা বললেন, এটা লক্ষণীয় যে গোরখপুরে কৃষকের মনে স্বরাজের সঙ্গে মিস্টার গান্ধীর নাম কীভাবে জড়িত। সাক্ষীরা বার বার বলে, এ হল গান্ধীর স্বরাজ অথবা মহাত্মার স্বরাজ, কৃষক যার পথ চেয়ে আছে। চৌরিচৌরা মামলার প্রধান আসামী লাল মহম্মদ কিছু উর্দু ঘোষণাপত্র বিক্রি করেছিল। তার মতে, সেগুলি গান্ধীর কাগজ; যখন গান্ধী চাইবেন, তখনই বের করবে বলে সে রেখেছিল। খিলাফৎ অর্থভাণ্ডারে দান করলে যে রসিদ পাওয়া যেত, তা অনেকটা এক টাকার মতো দেখতে। গোরখপুরের চাষিরা তাকে বলত গান্ধী-নোট। এসবের মধ্যে আমরা দেখি গান্ধীকে বিকল্প শক্তির স্রষ্টা ভাবতে জনসাধারণের বিশেষ প্রবণতা। স্থানীয় এক প্রামাণিক বিবৃতিতে পাওয়া যায়, ১৯২২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি চৌরা থানায় ঐতিহাসিক সংঘর্ষের ঘণ্টা কয়েক আগে যেসব কৃষক-ভলান্টিয়ার দু মাইল দূরে ডুম্রীর দিকে যাচ্ছিল এক সভায় যোগ দিতে, তারা বলে, গান্ধী-মহাত্মার সভায় যাচ্ছে তারা, যা এনে দেবে গান্ধী-স্বরাজ। গোরখপুরে জেলা-কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়াই গান্ধী-স্বরাজ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল। হাইকোর্ট জজরা লক্ষ করেছেন যে স্থানীয় কৃষক স্বরাজকে মিলিয়েছিল সেই আদর্শ স্বপ্নযুগে, যখন খাজনা নেওয়া হবে কম টাকায়, কি মাঠ বা ঢেঁকিশাল থেকে নেওয়া শস্যে, কৃষক জমি রাখতে পারবে নামমাত্র খাজনায়। আদালতে বিচারের সময় কংগ্রেস এবং খিলাফৎ-এর নেতারা বার বার বলেন যে এমন কোনও ধারণা গ্রামে তাঁরা প্রচার করেননি। বস্তুত এমন তথ্য আছে যে ১৯২১-এর মার্চ মাস থেকেই গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে স্বরাজের আগমনবার্তা ঘোষিত হচ্ছিল। জমিদারদের অনুগামী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা এসব ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাদের ভাষায়, এগুলি অশুভ ইঙ্গিত:
এক রাত্রে গ্রামবাসীরা নিদ্রা ত্যাগ করে আশপাশের চারটি গ্রামে ঘুরে বেড়াল। সে রাত্রে ঘুমনো প্রায় অসম্ভব। তারা চিৎকার করছিল—গান্ধীজির জয় হোক। তাদের সঙ্গে ছিল ঢোল, তাশা ইত্যাদি। আওয়াজে কান পাতা দায়। লোকে চেঁচিয়ে বলে যে, এ স্বরাজের ডঙ্কা। স্বরাজ এসে গেছে। গান্ধীর সঙ্গে বাজি ধরেছিল ইংরেজ—স্বরাজ তারা দেবে, যদি গান্ধীজি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একটি বাছুরের লেজ ধরে আগুন দিয়ে হেঁটে গেছেন গান্ধীজি। এখন স্বরাজ এসে গেছে। বিঘা প্রতি চার থেকে আট আনার বেশি খাজনা দেওয়া হবে না, এমন ঘোষণাও কানে আসে। এসব গুজব জমিদার আর কৃষকের মধ্যে সংঘাতের প্রতীক। চাষি আর জমিদারের কথা মানতে বা তার কাজ করতে রাজি নয়। এর প্রতিটিই দেশের পক্ষে অশুভ ইঙ্গিত।
গান্ধীর আগুন দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কৃতিত্ব যে তৎকালীন কৃষকচৈতন্যের স্তরে খাপ খেয়ে যাবে, তা স্পষ্ট। যা মিলে যায় সেই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্নে, যে রাজ্যে কোনও খাজনা নেই। সেই রাত্রে গোরখপুরের গ্রামে স্বরাজের আগমনবার্তায় এমন চেতনাই ভাষা পেয়েছিল। স্বীকৃত কংগ্রেস নীতি থেকে এর দূরত্ব অনেক। ১৯২১-এর শেষে স্থানীয় ভলান্টিয়ারদের কার্যকলাপ আরও মারমুখী হয়ে ওঠে, স্বরাজের উপমা তখন পুলিশি শক্তির বিকল্পে। এটাও তৎকালীন কংগ্রেস নীতির স্বপক্ষে নয়। চৌরার যে থানাদার খুন হয়, তার ভৃত্য সরযু কাহারের কথায়, ঘটনার দু-চার দিন আগেই সে শুনেছিল, গান্ধী-মহাত্মার স্বরাজ এসে গেছে। চৌরা থানা উঠে যাবে, স্থাপিত হবে ভলান্টিয়ারদের নতুন থানা। ১৯২২-এর আগস্ট মাসে ফেঁকু চামার জজকে বলে, ‘বিপথ কাহার, স্বরূপভার আর মহাদেও ভুজ, এরা সবাই গান্ধী মহারাজ, গান্ধী মহারাজ বলতে বলতে উত্তর দিক অর্থাৎ চৌরার দিকে এগিয়ে আসে। আমি তাদের শুধোলাম, গান্ধী মহারাজের নাম করে তারা চেঁচাচ্ছে কেন? তারা উত্তর করল, চৌরা থানা পুড়িয়ে দিয়েছে তারা, মহারাজের স্বরাজ এসে গেছে।’
গান্ধীর স্বরাজের প্রকাশে যেমন পরিবর্তন এল, তেমনি চৌরিচৌরায় কৃষক ভলান্টিয়ারদের গান্ধী মহারাজের নামে জয়ধ্বনিতেও একটা প্রভেদ লক্ষণীয়। আগেই দেখেছি, ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারিতে গান্ধী যখন গোরখপুর থেকে ফিরছিলেন, জয়ধ্বনিতে ছিল দাবির সুর। এক মাসের ভিতরে সেই ধ্বনি কৃষক ভলান্টিয়ারদের সংগঠিত শক্তি আর সংগ্রামের নিদর্শনে রূপান্তরিত হল। সে এমনই এক ধ্বনি, যা শত্রুদের মনে, এমনকি যে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী নয়, তার মনেও জাগায় আতঙ্ক। উত্তর ভারতে কৃষকের কাছে এ আর গান্ধীর জয়ধ্বনি নয়, থানা বা বাজারের উপর আক্রমণের ঘোষণামন্ত্র। জয় মহাবীর, বম্ বম্ মহাদেও, যা ছিল যুদ্ধের মন্ত্র, মহাত্মা গান্ধী কী জয় এখন তারই সমতুল। ভক্তি আর শ্রদ্ধার সেই জয়ধ্বনি সরাসরি সংঘর্ষের উদ্দীপনায় পরিণতি পেল। যেসব সংঘর্ষ মহাত্মা নামের দোহাই দিয়ে খাড়া করতে চায় সততার যুক্তি। কিন্তু কৃষকের এই মহাত্মা প্রকৃত গান্ধী নয়, কৃষকের কল্পনার প্রতিরূপ তিনি। যা করত তারা, ভেবে নিত তার বিধান আসছে তাদের কল্পনার মহাত্মার কাছ থেকে। আসলে সঠিক নীতি, ঔচিত্য আর সম্ভাব্য নিয়ে তাদেরই যে লোকায়ত ধারণা, সেখানেই তার প্রকৃত ভিত্তি। ১৯২১-এর শীতকালে উত্তর বিহারে যে সব হাট লুটের ঘটনা হয় সে-বিষয়ে এক জন আমলা লিখছেন:
সরকারের হাতে যা সাক্ষ্য রয়েছে, তাতে আর কোনও সন্দেহই নেই যে ওই হাট লুটের ঘটনা আর অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। লুণ্ঠনকারীরা এসে প্রথমে চাল বা কাপড় বা সবজি বা ওই জাতীয় কোনও জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করে। দাম শুনেই তারা বলে যে গান্ধী হুকুম দিয়েছেন দাম এই হবে, বলে চলতি মূল্যের এক-চতুর্থাংশ একটা মূল্য উল্লেখ করে। দোকানি ওই দামে জিনিস বিক্রি করতে অস্বীকার করলে তাদের গালাগাল আর মারধর করে তাদের দোকান লুঠ করা হয়।৩
পূর্ব উত্তরপ্রদেশ বা উত্তর বিহারের কৃষকের মনে মহাত্মা কোনও একটি বিশেষ স্বীকৃত ধারণা নয়। গান্ধীর বিধান আর প্রতাপ নিয়ে তাদের যে বোধ, তা অনেকাংশেই স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের ধারণার বিরুদ্ধে, গান্ধীবাদের মূলমন্ত্রেরও তা প্রতিকূল। এই স্ববিরোধই চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনাবলীর সূত্র।
অনুবাদ: রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, রুশতী সেন
টীকা
১ উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে গোরক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: John R. McLane. Indian Nationalism and the Early Congress (Princeton, 1977); Sandria Freitag. ‘Sacred Symbol as Mobilizing Ideology: The North Indian Search for a “Hindu” Community’. Comparative Studies in Society and History, 22 (1980). pp. 597-625. Gyan Pandey, ‘Rallying Round the Cow: Sectarian Strife in the Bhojpur Region.c. 1886-1917’ in R. Guha (ed.), Subaltern Studies II (Delhi, 1983)
২ Willian Crooke. The Popular Religion and Folklore of Northern India, Vol. 1 (London, 1896) pp. 183-96.
৩ Bihar and Orissa Legislative Council Debates, 8 March 1921 vol. 1. p. 293.
একটি অসুরের কাহিনী – রণজিৎ গুহ
যেসব তথ্যের সূত্র ধরে ইতিহাস রচনা সম্ভব, আমাদের এই উপমহাদেশে তার প্রাচীনতম সংকলন রয়েছে ধর্মে। প্রভু আর অধীনের সনাতন সম্পর্কের সব বিশিষ্ট মুহূর্ত ধর্মেই গ্রথিত রয়েছে কর্তৃত্ব, সহযোগিতা আর প্রতিরোধের নিয়মে। এমন নিয়মের মূলে আছে কিছ ক্ষমতার বিধান; ইতিহাসে তার উচ্চারণ স্পষ্ট। দীর্ঘ দিন ধরে ফিরে ফিরে আসে এসব নিয়ম, শক্ত হয় তাদের ভিত, সার্বজনীন চেহারা পায় তারা; নিজেদের প্রারম্ভিক কর্মকে ছাপিয়ে উত্তরকালের সাংস্কৃতিক পর্যায়ে তারা আর শুধু স্মৃতিচিহ্নমাত্র নয়, বিশেষ ভাবে কার্যকর উপাদানও বটে। ফলে ক্ষমতার প্রতি উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গের যে মনোভাব, তার এক পুঞ্জীভূত তথ্যসমগ্র গড়ে ওঠে। তার প্রকাশ আমরা দেখি কখনও পৌরাণিক কাহিনীতে, কখনও বা আচার-অনুষ্ঠানে, আবার কখনও রীতিনীতিতে, অথবা বিশ্বাসের জগতে পূর্বোক্ত উপকরণসমূহের বিচিত্র যোগাযোগের বিভিন্ন বিন্যাসে। যে আকারে এই তথ্যসমগ্র আমাদের নাগালে আসে, তাতে এর অধ্যয়ন সহজ থাকে না। কারণ লিখিত ভাষ্যের স্বচ্ছতা এই সমগ্রে অনুপস্থিত, মৌখিক লোককথার পরম্পরাতেই তার প্রধান অবলম্বন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতীন্দ্রিয় ভাবপ্রবণতা এবং অজ্ঞাত প্রতীকে তা আচ্ছন্ন; তার যুক্তি ভাষ্যকারদের যুক্তিবাদী ধারণাকে অস্বীকার করে। নানান যোগবিয়োগে পরিমার্জিত হতে হতে এই তথ্যসমগ্র আইনের সংগতিপূর্ণ চেহারা কখনওই পায় না। এর প্রকাশ অতি সংক্ষিপ্ত, একে বোঝা কঠিন, কারণ যে বার্তা সে রেখে যায়, তার প্রকৃতি দ্ব্যর্থবোধক; একাধারে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সেই প্রকৃতি।
এই তথ্যসমগ্রের অস্তিত্ব এবং তার গুরুত্ব বিষয়ে আমরা যে সচেতন, তার জন্য ঐতিহাসিক দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বির কাছে আমাদের ঋণ সব থেকে বেশি। অতীতের আদিবাসী ইতিহাস ছাপিয়ে পরবর্তী উন্নয়নের পর্যায় এসে পড়ে; পুরনো যা-কিছু উপাদান অবশিষ্ট থাকে, তা নতুন সামাজিক স্তরের সঙ্গে মিলে মিশে যায়; এই সংমিশ্রণেই প্রাত্যহিক জীবন আর চিন্তাশীল মননের সংস্কৃতি প্রকাশ পেয়েছে। কোশাম্বি তাঁর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ দুটিতে একথারই বিশ্লেষণ করেন।১ ভাবজগতের স্তরে এই বিন্যাস সব চেয়ে স্পষ্ট সেই-সব জাতির ধর্মে, হিন্দু বর্ণভেদ অনুসারে সকলের নিচু ধাপে যাদের জায়গা। বর্তমানে এবং অতীতে খাদ্যোৎপাদন আর হালচাষকে এরা বর্জন করেছে; এদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের মূল কারণ সেটাই। এই সব নিম্নতম জাতি ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায় অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’; অনেক সময়েই উপজাতীয় আচার-ব্যবহার এবং পৌরাণিক কাহিনীকে তারা বাঁচিয়ে রাখে।২ কিন্তু সেই আচার অথবা পুরাণ, কোনও কিছুই এই সংরক্ষণে অপরিবর্তিত থাকা সম্ভব নয়। ‘সমান্তরাল ঐতিহ্যের’ আকর্ষণ, উচ্চজাতির প্রধানত ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির ভার তাকে বদলায়, আত্মসাৎ করে। এতখানিই বদলায় যে মনে হয় আচার-ব্যবহার হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত প্রকাশভঙ্গিমার অভ্যন্তরীণ চিহ্নমাত্র; যেটুকু ফারাক, সে যেন কেবল তারা বহুল প্রচলিত নয় বলেই। কোশম্বি বলেছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল কাজই হল পৌরাণিক কাহিনীকে একত্র করা, যে আলেখ্য নানান চেহারায় বার বার ফিরে আসে, তাকে একতায় চিহ্নিত করা আর তাকে স্থাপন করা কোনও উন্নত সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে।৩ একবার বহুমিশ্রিত সামঞ্জস্যের এই আবরণ সরিয়ে নিলে, অনেক পৌরাণিক কাহিনীর বিষয়ই মূর্ত হয়ে ওঠে অমীমাংসিত কোনও এক প্রাচীন বিরোধের রূপকে। বস্তুত সেই বিরোধের মূর্তিতেই পৌরাণিক কাহিনীর স্বরূপ।
২
রাহুকে নিয়ে যে পৌরাণিক আলেখ্য,৪ তাকে এমন এক বিরোধের স্মারক বলা চলে। মহাভারত-এর সমুদ্রমন্থনে এই আখ্যানের প্রথম বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রথম উপাখ্যান।
তার পর মথ্যমান সাগর থেকে…ধন্বন্তরিদেব অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ ‘আমার’ ‘আমার’ বলে কোলাহল করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনীমায়ায় স্ত্রীরূপ ধারণ করে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগণকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে বসিয়ে কমণ্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগণের দিকে ধাবিত হল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রূপ ধরে অমৃত পান করলে। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে সেই দানবের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুণ্ড ভূমিতে পড়ল এবং ভয়ঙ্কর গর্জন করতে লাগল। সেই অবধি চন্দ্র-সূর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হল। আজও সে চন্দ্র-সূর্যকে গ্রাস করে।
স্বর্গীয় এই লড়াইয়ের প্রতীকে নৈতিকতা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। সৃষ্টির সেই দ্বন্দ্বময়তায় দেবতা-দানব, অমৃত কালকূট, এমন-সব পরস্পরবিরোধী ধারণার ঘাতপ্রতিঘাত প্রয়োজন ছিল।৫ অমৃত নিয়ে দেবদানবের যুদ্ধে দেবতাদের অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে দিতে মোহিনীমায়ার ছলনাই দেখি বিষ্ণুর একমাত্র আশ্রয়; আর সেই নীচ উপায়েই দানবদের বঞ্চিত করা হলো অমৃতের ভাগ থেকে। যদি কোনও দানব সবার অলক্ষ্যে স্বর্গীয় ভোজ সভায় ঢুকে পড়ার সাহস রাখে, তার শাস্তির মূলে থাকে দ্বৈত অপরাধ—দেবতার জন্য নির্দিষ্ট আহার্য অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা এবং অশুচি করা সেই আনুষ্ঠানিক ভোজকে। অমৃত পানের এই অনুষ্ঠান তাই মিলে যায় নিশ্চিত এক হত্যার কারণে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যপ্রথায় দণ্ডের সর্বোচ্চ ধারণা রাহুর মুণ্ডচ্ছেদে সঙ্গতি পায়।
গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্কৃতির পৌরাণিক কাহিনীর আর আচার-অনুষ্ঠানের বিকৃতি কি বিচ্ছিন্নতার ধারণা এই প্রতীকে সামঞ্জস্য খুঁজে পায়। সূর্য থেকে চন্দ্র, দিন থেকে রাত্রি, আলো থেকে অন্ধকার, উষ্ণতা থেকে শৈত্যের পালাবদল৬ যে নিয়মে গ্রথিত, গ্রহণ তার ব্যতিক্রমের প্রতিনিধি। লেভি-স্ত্রোস বলেছেন ‘প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতার এই ভাঙন আসলে এক বিকৃতি; প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বাইরের কোনও এক উপাদান এসে পড়লে এমন বিকৃতির সূত্রপাত ঘটে’। পাশ্চাত্য সমাজের বাইরে গ্রহণের মতো মহাজাগতিক ঘটনা নিয়ে যে লোকায়ত বিশ্বাস প্রচলিত, সমাজতাত্ত্বিক স্তরে কোনও কোনও ইউরোপীয় মনোভাবে তার প্রতিতুলনা মেলে। লেভি-স্ত্রোস দেখান, বেনিয়মের বিয়ে নিয়ে মশকরা এমনই এক নিদর্শন। গ্ৰহণ যেভাবে গ্রহসমূহের গতিকে ব্যাহত করে, ঠিক তেমনি বিরূপ সম্বন্ধের উদবাহ বন্ধন ভেঙে দেয় বৈবাহিক সম্পর্কের আদর্শ পরম্পরাকে।৭
ভারতবর্ষেও লোকায়ত কল্পনায় সামাজিক বিচ্যুতির আশঙ্কা জড়িয়ে গেছে গ্রহণসৃষ্ট ভ্রষ্টতার সঙ্গে; সে ভ্রষ্টতা প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতিকে ব্যাহত করে। এমন বিশ্বাস ছিল যে গ্রহণ প্রজননের আবর্তনে বাধা দিতে পারে, জন্মকে রোধ করে অথবা তাকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে ভাঙতে পারে সে জন্মমৃত্যুর ধারাবাহিকতা। গ্ৰহণ সন্তান প্রসবের পক্ষে প্রতিকূল সময়, এই শঙ্কা তাই লোকগাথায় ফিরে ফিরে আসে। বহু স্থানে গর্ভবতী নারী এমন কী তার স্বামীরও গ্রহণ দেখা নিষিদ্ধ, অন্যথায় তাদের সন্তান নাকি হবে বিকলাঙ্গ। গ্রহণ দেখাই শুধু নয়, গ্রহণ-লগ্নে অন্য যে কোনও কাজের ফলেই ভ্রূণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেইসব কাজ সন্তানের শরীরে নিজের ছাপ রেখে যায়; যেমন সন্তানের দ্বিধাবিভক্ত ওষ্ঠ গ্রহণকালে পূর্বপুরুষের কর্তনকর্মের সাক্ষী, কাঠ কি আর কিছু চেরার শ্রম দাগ ফেলে সন্তানের আঙুলে, তার বাঁকানো আঙুল হয়ে থাকে মা-বাবার তালা নিয়ে কাজ করবার চিহ্ন, আর তিল জড়ুল ইত্যাদি বিভিন্ন জন্মচিহ্ন মায়ের চোখে সুর্মাটানা অথবা বাবার কপালে তিলক-কাটার পরিণাম।৮ ধর্মশাস্ত্রের দণ্ডবিধিতে এ সবই সঙ্গত; সেখানে পাতকের শাস্তি প্রায়ই নির্দিষ্ট হয় তার দেহের সেই অঙ্গে, যা বিশেষ অপরাধে প্রত্যক্ষ লিপ্ত ছিল। গ্রহণ-লগ্নে জন্মগ্রহণের ক্ষতি তার শারীরিক অক্ষমতাকে ছাপিয়ে মানুষকে জীবনভর নানাভাবে অতিষ্ঠ করতে পারে। রাহুর দশায় যার জন্ম, তার ধনসম্পদ, বিদ্যাবুদ্ধি, সন্তানসন্ততি ধ্বংস হয়, দুঃখজৰ্জর হয় তার জীবন, একাধিক শত্রুর সম্মুখীন হতে হয় তাকে।৯
মরণে যেমন অশুদ্ধতার সংক্রমণ, গ্রহণ তেমনি ত্রাসে সমাজকে নিমজ্জিত করে। হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের শুদ্ধতার সঙ্গে রাহুর পৌরাণিক আখ্যানকে মিলিয়ে তার ব্যাখ্যা: ‘…যখন গ্রহণ লাগে, সেই বিশাল সর্প রাহু গ্রাস করে সূর্য অথবা চন্দ্রকে; অর্থাৎ হল সূর্য কি চন্দ্রের মৃত্যু; গ্রহণকাল ব্যেপে মানুষকে তাই অশৌচ পালন করতে হয়।’১০
এই বিশ্লেষণের অন্য পাঠে চন্দ্র বা সূর্যের মৃত্যু নয়, রাহুর আগমনই১১ অশুদ্ধতার হেতু, ঠিক যেমন নিম্নজাত ব্যক্তির ছায়া গায়ে পড়লে শুদ্ধতা হারায় ব্রাহ্মণ। অশুদ্ধতা সংক্রামক, তাই চন্দ্র বা সূর্য যতক্ষণ রাহুর কবলে, সমগ্র পৃথিবীও ততক্ষণ শুদ্ধতা থেকে বঞ্চিত। গুজরাট অঞ্চলে উচ্চজাতির ঐতিহ্যের ব্যাখ্যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এক পর্যবেক্ষক লেখেন ‘দানবের ছায়া আর ভাঙ্গির ছোঁয়া অশুদ্ধতায় সমতুল্য, যাতেই এ-ছায়া পড়ে, তাকেই সে অশুদ্ধ করে। যেহেতু গ্রহণকালে সূর্য অথবা চন্দ্র অশুদ্ধ, তখন তাদের আলো যেখানে পড়ে, সেখানকার শুদ্ধতা অবশিষ্ট থাকে না।’১২ সুতরাং যে রন্ধিত আহার্য বা পানীয় জল মজুত ছিল গ্রহণের সময়, অশুচি বলে গৃহস্থকে তা ফেলে দিতে হয়; গ্রহণ ছেড়ে যাওয়ার আগে নতুন করে রান্না করা, এমন কী রান্নার উদ্যোগ নেওয়াও ঠিক নয়।১৩ এমনই প্রকট গ্রহণের অশুদ্ধতা যে সে সময় পরিবারে কোনও মৃত্যু বিশেষ অমঙ্গলের ইঙ্গিত।১৪ মনুর বিধান হল, ‘রাহু যখন গ্রহণকালে চন্দ্রের শুদ্ধতা হরণ করেছে, বিদগ্ধ ব্রাহ্মণের তখন উচিত নয় বেদপাঠ করা।’১৫ গ্রহণ সম্বন্ধে লোকায়ত ধ্যানধারণা যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদের সংস্কার থেকেই উদ্ভূত, এই আদেশ তারই প্রমাণ।
গ্রহণের সময় প্রতিষেধক হিসাবে কিছু আচার-অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট আছে। রাহুর অমঙ্গলসূচক মূর্তিটিকে সেগুলি আরও জোরদার করে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে গন্ধের একটি বিশেষ জায়গা আছে; যেমন থারস্টান-এর লেখায় পাই, দক্ষিণ ভারতে পশুর শিং আর খুর পোড়ানোর প্রথা, ‘যার গন্ধ নাকি অশুভ অশরীরীকে দূরে রাখবে।’১৬ এই উপমহাদেশের বহু স্থানেই ভূত ছাড়ানোর এমন উপায় বর্তমান। আরও বেশি প্রচলিত কোলাহলের ব্যবহার; যেন সেই কোলাহলে ‘ভেকধারী দৈত্য বাধ্য হবে খাদ্যের গ্রাস উদ্গীরণ করতে।’ যেমন লিখেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক জেসুইট তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে।১৭ এমন কোলাহলের কথা গোটা বিশ্ব জুড়ে, পেরু থেকে পিকিং পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই পাওয়া যায়।১৮ আমাদের দেশে এই কোলাহল শোনা যায় আসামের ঘণ্টাধ্বনিতে, নীলগিরি পাহাড়ে টোডাদের কণ্ঠনাদে এবং আকাশ লক্ষ্য করে কুৰ্গদের বন্দুক-চালনায়।১৯ লেভি-স্ত্রোস বলেছেন, ‘একটি অণুক্রমের সুষম বিন্যাসের অসংগতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণেই কোলাহলের সক্রিয়তা। এই অণুক্রমের দুটি রাশি এখন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নতার অবস্থায়; এবং তার একটি রাশি তৃতীয় রাশির সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, যদিও এই তৃতীয় রাশিটি অণুক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়।’২০ লোকায়ত কল্পনায় বহিরাগত রাশিটিকে যে চেহারায় দেখি তাতে এক সাপ একটি খরগোশকে ভক্ষণ করছে এবং সংস্কৃত পাঠে এক দানব স্বর্গীয় অস্তিত্বকে গ্রাস করছে। আমাদের আলোচনার পক্ষে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। দানব এবং গ্রহের মূর্তিটি মনে রেখেই গ্রহণে শুদ্ধতাহানির প্রতিষেধক আচারে দূর্বা এবং কুশের প্রয়োজন হয়।২১ আশীর্বাদের সামগ্রীরূপে দূর্বা এবং কুশ উভয়ই পবিত্র; এই পবিত্রতার মূলে আছে দানবগণের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের বিশিষ্ট ভূমিকা। এক দানব বিশ্বকে যখন সাগরের অতলে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল, বরাহ অবতার বিষ্ণু তাকে ধ্বংস করেন। তখন তাঁর মাথা থেকে কেশকণা পড়েছিল ভূমিতে; সেই কেশকণা ধর্মীয় কাহিনীর আশ্রয়ে পরিবর্তিত হয়ে পৃথিবীতে দূর্বা (সংস্কৃত দর্ভ শব্দ থেকে) রূপে বিরাজমান। আবার পৌরাণিক কাহিনীর সৃজনশীলতায় তৃণ হয়ে ওঠে অস্ত্র; তাই কুশ নিয়ে দেখি বিভিন্ন আখ্যান, সেখানে কুশ মুণ্ডচ্ছেদের এক হাতিয়ার; দেবতা এবং ঋষিগণ তাকে ব্যবহার করেন তাদের শক্তিশালী শত্রুদের বিরুদ্ধে।২২ তাই কার্যকারিতায় বিষ্ণুর চক্রের সঙ্গে কুশের তুলনা চলে। বিষ্ণুর চক্রে ধ্বংস হয়েছিল সেই দানব যে সমুদ্রমন্থনের (প্রথম উপাখ্যান) সময় অমৃত আত্মসাৎ করতে চায়। ঠিক একই উপায়ে কুশ শাস্তি দিয়েছিল নাগদের, জিহ্বা বিভক্ত করে; নাগগণ তখন গরুড়ের কাছ থেকে বলপূর্বক অমৃত হরণের প্রয়াস পেয়েছিল।২৩ পৌরাণিক কাহিনী এবং আচার-অনুষ্ঠান একই সঙ্গে সমর্থন করে রাহুর সাবেকি হিন্দু মূর্তিটি। সমাজতত্ত্ব এবং বিশ্বতত্ত্বের স্তরে রাহু তেমনি এক শক্তি, যে কেবল ভাঙে, ধ্বংস করে। তাই আকাশে তার আবির্ভাবে ব্রাহ্মণের এমন আশঙ্কার কারণ থাকে যে বিশ্ব আজ আসন্ন প্রলয়ের পথে এসে দাঁড়িয়েছে।২৪
৩
ব্রাহ্মণদের বিশ্লেষণই শেষ কথা নয়। ব্রাহ্মণদের নিন্দায় দূষণ আর লুণ্ঠনের অপরাধে চিহ্নিত রাহু বহু অনুগামী খুঁজে পায় তাদের মধ্যে, হিন্দুধর্মের স্তরবিন্যাসে যাদের স্থান নিম্নতম ধাপে। এ-বিষয়ে ঔপনিবেশিক পর্যায় থেকে আমরা কিছু তথ্য পাই; তা একাধারে প্রভূত এবং অভ্রান্ত। উনিশ শতকের শুরুতে বিউক্যানান হ্যামিলটন-এর পর্যবেক্ষণ থেকে ব্রিটিশ রাজের শেষ পাঁচ দশকে বহু আমলা এবং নৃতত্ত্ববিদের বর্ণনায় এইসব তথ্য ছড়িয়ে আছে।২৫ সেই তথ্য প্রমাণ করে যে গ্রহণপূজার অস্তিত্ব একান্ত প্রাচীন এবং ডোম, দোসাদ, ভাঙ্গি আর মাঙ্গ প্রভৃতি জাতির বিশ্বাসের জগতে আজও তা এক কার্যকরী উপাদান।
অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং জীবনযাত্রার বিন্যাসে এই জাতিগুলি নানাভাবেই পৃথক এবং বিভক্ত। কিন্তু সকলে মিলে তারা যে গোষ্ঠী গড়ে তোলে, ব্রিগস-এর প্রামাণ্য পুস্তিকায় তাকে বলা হয়েছে ডোম। এরা এক গোষ্ঠী, কারণ অর্থনৈতিক অবনতি, সামাজিক কলঙ্কচিহ্ন এবং আচার-অনুষ্ঠানের অশুচিতে এদের প্রত্যেকেরই এক দশা। পঁচাত্তর বছর আগে এক পর্যবেক্ষক তাদের অবস্থান বর্ণনায় লিখেছিলেন:
ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার উপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনও সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত।…সে আছে হিন্দুধর্মের নাগালের বাইরে।… সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।২৬
এই সূত্রের সারকথা মিলে যায় চণ্ডাল এবং শ্বপচদের সম্পর্কে মনুর বচনে। অনেক পণ্ডিতের২৭ মতে ইতিহাসে চণ্ডাল এবং শ্বপচরাই ডোম সম্প্রদায়ের পূর্বসুরী। অতএব:
‘চণ্ডাল এবং শ্বপচ জাতি গ্রামের বাইরে বাস করবে…কুকুর আর গাধা এদের ধনসম্পদ হবে। এরা শববস্ত্র পরিধান করবে, এরা ভগ্নপাত্রে ভোজন করবে, লৌহ অলঙ্কার ধারণ করবে এবং এরা সর্বদা ভ্রমণ করবে।… রাত্রে এরা গ্রামে কি নগরে কদাচ গমনাগমন করবে না।’২৮
এ কথা স্পষ্ট যে কালের ধারায় ডোমেদের অবস্থা বদলায়নি। তারা সমাজের প্রান্তে ভবঘুরের জীবনেই দণ্ডিত। প্রাচীন আইন-প্রণেতার বিধান ছিল, ‘এরা সর্বদা ভ্রমণ করবে’; আজ বিশ শতকেও তাদের একই দশা। ঘুরে বেড়ানোর এই স্পৃহা যেন শাস্ত্রের নির্দেশের মতো; ইংরেজ আমলের সরকারি লেখাপত্রে এই স্পৃহাকেই মনে হয় স্বভাবের অঙ্গ। পবিত্র জ্ঞান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান, এই অগ্রগতি দেড় হাজার বছরে নৃতত্ত্ব বর্ণনার পরিবর্তনকেই নির্দেশ করে। ধর্মীয় প্রাচীন থেকে সমাজতাত্ত্বিক আধুনিকে এই বিবর্তন এবং দীর্ঘকালীন ইতিহাসের ধারায় রক্ষণশীল শক্তি, এরা বৈপরীত্যের সম্পর্কেই যুক্ত। কৃষি সমাজে অথবা তার ভাবজগতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য; এই প্রাধান্যের অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল আর্যপূর্ব দেশজ আদিবাসী সম্প্রদায়। সে বিষয়ে কোশাম্বির বিশ্লেষণ:
সামাজিক স্তরবিন্যাসের একেবারে নিচু ধাপে এখনও দেখি সেই-সব আদিবাসী গোষ্ঠীকে, যারা খাদ্য সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। পারিপার্শ্বিক সমাজে খাদ্য উৎপাদনই বর্তমানে স্বাভাবিক পর্যায়। সুতরাং এমন সব নিম্নতম জাতির খাদ্য সংগ্রহ সাধারণত ভিক্ষাবৃত্তি অথবা চৌর্যবৃত্তির চেহারা নেয়। নিম্নতম এই গোষ্ঠীদের যথার্থ নামকরণ করেছিলেন ইংরেজরা ‘অপরাধপ্রবণ উপজাতি’ বলে, কারণ গোষ্ঠীর বাইরে কোনওরকম আইন-শৃঙ্খলা মানতে এরা অস্বীকার করত।
ভারত ইতিহাসের অনেকখানি ব্যাখ্যা করে বলেই ভারতীয় সমাজের এই স্তরবিন্যাস ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।…অতীতে অথবা বর্তমানে কৃষিকাজ কি খাদ্যোৎপাদনের জীবিকা গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক; সেই কারণেই যে তারা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদায় হীন, তা সহজেই ধরা পড়ে। এই সব নিচু জাতি অনেক সময়েই উপজাতীয় আচার-ব্যবহার এবং পৌরাণিক কাহিনীকে বাঁচিয়ে রাখে।২৯২৯
প্রামাণ্য সূত্রে বলা হয়েছে যে উপরোক্ত জাতিগোষ্ঠীগুলি মূলত ডোম আর মাঙ্গদের মতো সম্পূর্ণ আদিবাসী।৩০ অথবা দোসাদ আর ভাঙ্গিদের মতো ‘আদিবাসীভিত্তি থেকে গড়ে উঠে’ আদিবাসী নয় এমন মানুষের অন্তর্ভুক্তিতে তাদের পুনর্বিন্যাস।৩১ উভয় ক্ষেত্রেই যা অভিন্ন, তা হল এদের জমিতে কাজ করার উল্লেখযোগ্য অক্ষমতা— ইতিহাসে খাদ্যোৎপাদন বা কৃষিকাজে তাদের যে অনীহা দেখি, এই বৈশিষ্ট্য নিঃসন্দেহে তারই জের। ফলত, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দেও রিসলি লেখেন, ডোম আর দোসাদ হল দরিদ্র কৃষক; যে রায়তকে যদৃচ্ছ উৎখাত করা যায়, অথবা বড়জোর দখলী স্বত্ববান রায়ত— তাদের থেকে উন্নত অবস্থা এদের কোনওকালেই হয়নি। মাঙ্গদের মতো এদের বেশির ভাগই জীবিকায় যাযাবর চাষি, নয়তো ভূমিহীন দিনমজুর।৩২ দরিদ্রতম এবং দুর্বলতম গ্রামবাসী তারা, তাই জমিদার কি সরকারের বেগার দেওয়া এদেরই কাজ; ‘যে কোনওরকম অস্পৃশ্য কর্মপালনে তারা বাধ্য’; যুগ যুগ ধরে এরাই আছে ‘সমগ্র হিন্দুসমাজের ক্রীতদাসের ভূমিকায়।’৩৩ অন্যথায় তার জন্য পড়ে থাকত ভবঘুরের অপদার্থ জীবন এবং আনুষঙ্গিক জীবিকায় ভিক্ষা কিংবা ডাকাতি। যে সমাজ কৃষি ব্যবস্থায় নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছে, সেখানে এমন মানুষকে ভাবা হত প্রান্তিক; তাদের বাস সমাজের প্রান্তে, তাই সমাজের অন্যান্য অধিবাসীদের কাছে তারা ঘৃণ্য। কর্তৃপক্ষ অত্যাচার করত এদের উপরে, এমন কী মনুর সময়েও এরা সমাজের আইন-শৃঙ্খলার পক্ষে বিপদের আশঙ্কা বলে গণ্য হত। যে অরণ্য ছিল তাদের খাদ্য সংগ্রহের উৎস, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার চাপে সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার বন্ধ হল, বাড়ল তাদের জীবিকার অনিশ্চিতি। ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষায় তারা ‘অপরাধপ্রবণ উপজাতি’; এই নামকরণ তাদের পতিত দশাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তাদের জীবন বন্দি শিবিরে নির্দিষ্ট, সেখানকার নিয়ম চলে কার্ফু-র ঘণ্টায় আর ফৌজদারি ব্যবস্থায়।৩৪
এমন সব গোষ্ঠী সমাজে যেমন দরিদ্র এবং বিপর্যস্ত, কোনও আচার-অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের উপস্থিতি তেমনি চরম অশুচি। ধর্মশাস্ত্রে আক্ষরিক অর্থেই তাদের অশুদ্ধতার প্রতিভূ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ অশুচি এমন মারাত্মক যে যদি কোনও উচ্চবর্ণজাত ব্যক্তি তাদের দৈহিক সংস্পর্শে আসে, এমনকী তাদের ছায়া পড়ে সেই ব্যক্তির গায়ে, অথবা তাদের চোখে পড়ে যায় তেমন এক উচ্চবর্ণ, কঠিন শাস্তি আর কঠোর শুদ্ধাচারের প্রায়শ্চিত্ত মেনে তবেই সে ফিরে পাবে তার উচ্চবর্ণের গৌরব। এই রীতি ব্রাহ্মণধর্মের শূন্যগর্ভ আদেশমাত্র নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর উপান্তেও সামাজিক প্রথা এমন রীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, ‘এমন তথ্য লিপিবদ্ধ আছে যে স্থানীয় শাসকদের আমলে পুনার ফটকের ভিতরে দুপুর তিনটে থেকে সকাল ন-টা পর্যন্ত মাহার এবং মাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল না, কারণ সেই সময়ে তাদের দেহ নাকি একান্ত দীর্ঘ ছায়া ফেলে।’৩৫ এই সংস্কারের বিলোপসাধনে ঔপনিবেশিক ‘আধুনিকীকরণের’ কার্যকারিতা সামান্যই ছিল; ইংরেজ শাসনের শেষ দশকের একটি পর্যবেক্ষণে তারই স্বচ্ছ পরিচয় আমরা পাই: ‘যখন কোনও ডোমকে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ডাকা হয়, দর্শকবৃন্দ তার স্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচাতে আপন আপন পরিচ্ছদ সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে ওঠে [এই প্রথা ভাঙ্গি এবং ওই শ্রেণীভুক্ত যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য]।’৩৬
যেসব মানুষ ঘৃণার লক্ষ্য, ঐতিহ্যের ভারে অশুচির বোধকে তারা আত্মস্থ করে নিয়েছে; বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা এখানেই। তারা সকলেই এমন পুরাণের অনুগামী, যে কাহিনীতে কোনও এক আদি পাপ তাদের অশুদ্ধ পরিণামের হেতু; আর সেই পাপ সব ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যের শুদ্ধতাবিধি থেকে তাদের কোনও-না-কোনও পূর্বপুরুষের বিচ্যুতিতে প্রকাশ পায়। শিব পার্বতী এক ভোজসভায় বর্ণনির্বিশেষে সকলকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সর্বপ্রথম ডোম সুপাচ ভগৎ সেখানে পৌঁছেছিল বিলম্বে এবং ভক্ষণ করেছিল উচ্ছিষ্ট। সেদিন থেকে তার উত্তর-পুরুষেরা অন্য বর্ণের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণে বাধ্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্ছিষ্টভোজী জাতির সঙ্গে তারা সহজেই নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারে, রিসলির এই ধারণার উৎস পূর্বোক্ত উপাখ্যান।৩৭ এই আখ্যানেরই এক পরিবর্তিত পাঠে (যেখানে আতিথেয়তায় রয়েছেন রাম সীতা) ভাঙ্গিরা খুঁজে পায় জীবনের প্রসাদ থেকে নিজেদের বিচ্যুতির কারণ।৩৮ ডোম, ভাঙ্গি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন অনেক আখ্যান প্রচলিত আছে যেখানে তাদের পূর্বপুরুষ মৃত পশু স্পর্শ করার অশুচি অপরাধে দুষ্ট। নিজেদের জন্মগত অশুদ্ধতার সূত্রনির্দেশে মাঙ্গরা বলে, সে বংশের প্রথম মানুষকে লেগেছিল শিবের বাহন ষাঁড়কে খোজা করার অভিশাপ। এমন আরও বহু কাহিনীর প্রচলন আছে। আখ্যানগুলিতে দেখি, কী ভাবে বিশ্বের হতভাগ্যরা নিজেদের ভাগ্যহীনতাকে আধ্যাত্মিক উপায়ে যৌক্তিক আর বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তুলতে চায়।
মনে হতে পারে, হিন্দু সমাজের পতিতদের কাছে এই ধর্মীয় চেতনা শুধু নিজেদের অবস্থাকে ভাগ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপায়; এমন চিন্তা একপেশে আর সেই কারণেই বেঠিক। একই চৈতন্যের ভিন্ন উপাদানসমূহ প্রকাশ পেয়েছে সমান্তরাল অন্যান্য কাহিনীতে। ওই একই নিম্নবর্গের কল্পনায় সেই সব আখ্যানের নির্মাণ, কিন্তু বিষয়ে তা বিষাদের আখ্যান তো বটেই, কখনও বা বিদ্রোহের ইস্তাহারও। এই চেতনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থই এক গণ্ডিকে নির্দেশ করা; সে গণ্ডির বাইরে মানুষ নিজের হীনতাকে মেনে নিতে অক্ষম। সে গণ্ডি মানুষের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের অঙ্গীভূত। অবশ্য উচ্চবর্গের ধারণা এর বিপরীত; তারা ভাবে, সাধারণ মানুষ নিজের নিয়তিকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়।
৪
বিরুদ্ধতার উপাদানে এসব জাতির বিশ্বাসের জগৎ স্পষ্টই চিহ্নিত। যে শাসনব্যবস্থা তাদের উপরে আরোপ করা হয়েছে, তার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের কাছে নতি স্বীকার নয়, বরং তাকে অস্বীকার করাই এই বিরোধের প্রবণতা। তবু এই বিরুদ্ধতা এমন কোনও সুস্পষ্ট কর্ম খুঁজে পায় না, যার জোরে দুনিয়াটাকে উলটে দেওয়া যায়। বরং, এই যে বিরোধের সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়, সেখানেই শুরু হয় নানান আচার-অনুষ্ঠানের অবক্ষেপ; ফলে শেষ পর্যন্ত বিরুদ্ধতার উপাদান প্রভুর জন্যেই অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে দিয়ে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিরুদ্ধতা থেকে যায় সেই চেতনার পর্যায়ে, যার অস্তিত্ব শুধুই তত্ত্বে, জীবনে নয়; বিরুদ্ধতার এই চৈতন্যে প্রকৃত যন্ত্রণা থাকে নিশ্চয়, কিন্তু তার তত্ত্বের অনুষঙ্গে কোনও উপযুক্ত কর্ম অনুপস্থিত। এমন অবস্থায় চেতনাই হয়ে পড়ে নিছক এক নেশার আচ্ছন্নতা, তার পরিণাম নিষ্ক্রিয়তায় আবিষ্ট। নিচু জাতির ধর্মবিশ্বাসের একেবারে মূলে রয়েছে এই স্ববিরোধ। সুতরাং শাসক সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্যের এই ঝোঁককে বিপরীত প্রবণতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার—বিপরীত প্রবণতার আকর্ষণ উলটোপথে—প্রতিবাদের দিকে।
একাধারে স্ববিরোধী এবং পরিপূরক এই প্রবণতার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে ডোম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত বেশ কিছু উপাখ্যানে এবং পূজাপার্বণে। তার প্রকাশ আধ্যাত্মিক দুঃসাহসে। কর্তৃত্বকারী সংস্কৃতির কাছে যারা কোনও স্বীকৃতি পায় না, সেই সব বাস্তব চরিত্র এবং পৌরাণিক মূর্তিকে এমন সাহস ঐশ্বরিক মর্যাদায় ভূষিত করে। বাস্তবের চোর ডাকাত যেমন মরণোত্তর দেবত্ব লাভ করে, তেমনি দেশের অক্ষম দরিদ্র মানুষের উপর প্রভাব ফেলে পৌরাণিক বীরের অসাধারণ কীর্তি, তাদের অতিমানবিক ক্ষমতার রূপক। সেই ক্ষমতা একাধারে দৈহিক এবং আধ্যাত্মিক। ইতিহাসের যে দুই রদবদলের মূলে ছিল আর্য সভ্যতা এবং উপনিবেশের সংস্থাপন, পূর্বোক্ত দৃষ্টান্তগুলিতে একসঙ্গে তারই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার প্রকাশ পায়। জনসংখ্যার এক বিপুল অংশ কৃষিজীবিকার সংস্কৃতিতে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধ্যাত্মিকতায় পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি; ইংরেজ শাসনেও তাদের অবস্থা অনেকাংশেই অপরিবর্তিত থাকে, তারা বিকল্প জীবিকার পথ খুঁজে পায় অসৎ কর্মে; এর অনুষঙ্গে তাদের ধর্মে আসে এক ভিন্ন প্রবণতা, যা অপরাধীকে বানিয়ে তোলে উপদেবতা।
হিন্দুসমাজে যে-সব মূল্যবোধ মুখ্য, এই পরিবর্তন প্রণালী তার প্রতিবিধানেরই সামিল; এই প্রণালী আধ্যাত্মিক চেহারা দিল কিছু উপাদানকে; সমাজের তত্ত্বাবধায়কদের বিচারে সেই উপাদানগুলি এতদিন ছিল অসামাজিক। এই প্রণালীর কর্মকাল এতই দীর্ঘ যে তাকে আমরা বিপরীত ঐতিহ্যের চেহারায় দেখি। কোশাম্বি লিখেছেন পশ্চিমাঞ্চলের সেই বোলহাই দেবীর কথা; এই দেবী ‘নাকি গিয়েছিলেন কতিপয় তস্করের সঙ্গে।’ কোশাম্বির মতে, তাঁর এই যাত্রা সেই তথ্যেরই নিশ্চিত ইঙ্গিত যে, ‘দেবী তেমনি এক উপজাতির রক্ষাকত্রী, যারা কখনও বশ্যতা স্বীকার করেনি।’৩৯ একইভাবে দোসদরা ডাকাত দেবতা গোড়াইয়া আর সালেশকে পূজা করে; সেই যে চোর গণ্ডক, যার ফাঁসি হয়েছিল আর তার বন্ধু সামাইয়া, দুজনকেই মঘইয়া ডোমরা দেবতা বলে মানে; ডাকাত সর্দার শ্যাম সিংকে সব ডোমই ভাবে রক্ষাকর্তা ভগবান এবং নিজেদের পূর্বসূরী। এমন করে বার বার জাতিগুলির দেশজ পূর্ব ইতিহাস প্রমাণ হয়।৪০ যেসব আদিবাসী বশ্যতা মানেনি, তাদের নিয়ে কোশাম্বির ইঙ্গিত আরও জোরদার হয় যখন দেখি তাদের দেবতার প্রতিনিধি কখনওই হিন্দু প্রথানুরূপ মূর্তি নয়, বরং পাথর অথবা ঢেলা। আচার-অনুষ্ঠানে তাদের নৈবেদ্যও ব্রাহ্মণ্য প্রথানুরূপ নয়, এদের নিবেদন শুয়োর, মোরগ আর কারণ।
একজন দস্যুদেবতার আরাধনা অন্যান্য অনুরূপ দেবতার মতো কোনও এক বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর নাম বাল্মীকি। ব্রিগ্স বলেছেন,৪১ বাল্মীকি ‘মধ্য ভারতের দেশজ আদিবাসীদের একজন।’ এই মত সন্দেহাতীত নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, দক্ষিণ ভারতের নিম্নজাতির মানুষও তাকে ঈশ্বর বলে মানে। হিংসাত্মক জীবনে লিপ্ত বাল্মীকি প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন। এই কাহিনী সব শ্রেণীর হিন্দুরাই মেনে নেয়। কিন্তু পতিতরা তাঁর উপাখ্যানকে নিজেদের বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে বাল্মীকিকে একান্তই নিজের করে নিয়েছে। একটি আখ্যানে বাল্মীকি কালু আর জীবনের জনক। সেই কালু আর জীবন থেকে আবার ডোম আর ভাঙ্গিরা তাদের উৎপত্তি নির্দেশ করে। ভিন্ন কিছু গল্পে কখনও ভাঙ্গিদের পূর্বপুরুষ লাল বেগ স্বয়ং অথবা তাঁর পুত্র বলে, কখনও বা ডোম সম্প্রদায়ের কাল্পনিক প্রতিষ্ঠাতা সুপাচ ভগৎ বলে অথবা পঞ্চপাণ্ডবের একজন নকুল বলে বাল্মীকিকে সনাক্ত করা হয়। শব্দের খেলায় নকুল কথাটির অর্থ হতে পারে কুল নেই যার; আর এই ভাবে নকুল পেয়ে যায় প্রথম ভাঙ্গির পদমর্যাদা।
বাল্মীকির দৃষ্টান্তে আরও কিছু মন্তব্য সম্ভব। ভাষাগত রীতির জোরে এই বিশেষ উপাখ্যানটির বৃত্তে আরও পরিবর্তন আসতেই পারে। শ্লোকচ্ছন্দের কাঠামো নিয়ে কাহিনীর প্রচলন আছে; রামায়ণের শুরুতে ব্যাধের নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিবাদে বাল্মীকি ব্যাধকে অভিশাপ দেন; সেই অভিশাপের বচন আরম্ভ হয় ‘মা নিষাদ’ বলে। অভিশাপের সেই স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দেই শ্লোকের ছন্দ।৪২ আবার এমন লোকগাথারও চল আছে, যার নানান পাঠে৪৩ জানি, বাল্মীকি পাপমুক্ত হয়েছিলেন বার বার সেই ইতর আর অশুচি শব্দ ‘মরা’ উচ্চারণ করে। নিরবচ্ছিন্ন উচ্চারণে শব্দ গেল উলটে, অর্থাৎ রাম, যে নাম ঐশ্বরিক বীরের, যে নাম পবিত্র।
ভাঙ্গিদের পৌরাণিক আখ্যান অন্যান্য অনুরূপ আখ্যান থেকে বিশিষ্ট; সেখানে এক মহাকাব্যের উপাদান আর এক মহাকাব্যের উপাদানে জড়িয়ে গেছে, মিলে গেছে বাল্মীকি আর নকুল। ব্রিগ্স মনে করেন, এই যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে ‘বাল্মীক’ শব্দটির নিপুণ ব্যবহারে। বাল্মীক, অর্থাৎ ভাল ছেলে। আখ্যানমতে, কথাটি ব্যবহার করে ভাইরা নকুলকে ভুলিয়েছিল, একটি মৃত পশুকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে নকুল সম্মত হয়েছিল। আর যখন সে কাজটা করছে, ভাইরা পালাল তাকে ফেলে। তার পর, অপর এক বাক্চাতুর্যে, নকুল, যার নতুন পরিচয় এখন বাল্মীক, অর্থাৎ আখ্যানের সৃজনশীলতায় বাল্মীকি, হয়ে গেল সুপাচ ভগৎ। সেই সব মানুষের জন্মদাতা এই সুপাচ ভগৎ, যারা রুটি বানাতে আটায় যে ছাঁকুনি দরকার, তাই বানিয়ে আর বেচে জীবিকা নির্বাহ করে।৪৪ রামায়ণে বাল্মীকি আগে দস্যু, পরে পাপমুক্ত কবি। সাত্ত্বিক শূদ্রের নিধনকে তাঁর মনে হয়েছিল ন্যায়ের প্রতিভূ, সেই হত্যার গুণগান করেছিলেন তিনি। কারণ সেই শূদ্র ব্রাহ্মণ্যের উৎকর্ষ এবং তার পুরস্কার পেতে চেয়েছিল; সে উৎকর্ষ অথবা পুরস্কার শুধুমাত্র উচ্চজাতেরই যোগ্য, তাই শূদ্রের এই কামনা ব্রাহ্মণদের অপমানের সামিল। উচ্চবর্ণদের যথার্থ জবাব দিয়েছিল ভাঙ্গিরা। সংস্কৃত কৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে নিজেদের কথায়, কল্পনায় পাপভ্রষ্ট দস্যুকেই তারা বানিয়ে নেয় নিজেদের পূর্বপুরুষ এবং রক্ষাকর্তা। নিম্নবর্গের এক ধরনের কার্যকলাপ নির্বিচারে অপরাধ বলে চিহ্নিত হয়। তার মধ্যে যদি সেই দ্ব্যর্থ নীতিবোধের পরিচয় মেলে, যা ‘সামাজিক দস্যুবৃত্তি’ বা সোশ্যাল ব্যান্ডিট্রির ধারণায় স্বীকৃত, তবে বাল্মীকিতে দেবত্ব আরোপ এবং অপরাধে দুষ্ট আরও বহু দেবদেবীর অস্তিত্ব পূর্বোক্ত নীতিবোধ এবং তার সঙ্গে প্রচলিত ধারণাকে গৌরবান্বিত করে।
বিকল্প ন্যায়বোধ আর সেখানে নিহিত সমালোচনার নিদর্শন কেবল দস্যুবৃত্তির আধ্যাত্মিক মূল্যায়নেই নয়; হিন্দু পুরাণের সেই কুখ্যাত বিদ্রোহী রাজা বেণ-এর৪৫৪৫ প্রতি সুস্পষ্ট অনুমোদনও তেমন প্রতিবিধানের প্রবণতাই প্রমাণ করে। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তো রাজার কুকীর্তি নিয়ে কাহিনীর ছড়াছড়ি। মনুসংহিতায় (৯, ৬৬) বিধবাবিবাহ প্রচলনের, অন্তত তাকে মেনে নেওয়ার অপরাধে রাজাকে দোষারোপ করা হয়। মনুর মতে, দ্বিজজাতির বিদগ্ধগণ এমন বিবাহকে একমাত্র পশুরই উপযুক্ত মনে করেন। পদ্মপুরাণ বলে, শাসক হিসাবে রাজা বেণ-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ যথেষ্ট ভাল, কিন্তু পরবর্তীকালে জৈন ধর্মে তাঁর মতি হল। শাস্ত্রমতে তাঁর চরমতম অপরাধ ছিল সর্বপ্রকার বলি, দান এবং নৈবেদ্য বন্ধ করা, ব্যতিক্রম কেবল সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে রাজা নিজেই উৎসর্গের লক্ষ। রাজা ঘোষণা করেছিলেন, ‘সকল নৈবেদ্যের উপরে একচ্ছত্র অধিকার আমার।’ যে ঋষিরা ওই সব অনুষ্ঠান পরিচালনা করত এবং দেবতাকে উৎসর্গীকৃত দানসামগ্রী আত্মসাৎ করত, তারা রাজার আদেশে আপত্তি জানায়। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রাজা বলেন, ‘কে তোমাদের এই হরি যাকে তোমরা বর্ণনা কর তোমাদের নৈবেদ্যের অধিকারী বলে? ব্ৰহ্মা…এবং অন্য সব দেবতাই…রাজার ব্যক্তিত্বে বিরাজ করেন…।’ ঋষি এবং পুরোহিতগণ এতদূর সহ্য করতে পারেননি। কুশতৃণ দিয়ে রাজাকে তাঁরা বধ করেন; এই কুশতৃণ পৌরাণিক আখ্যানে দেবতাদের শত্রুনিধনের হাতিয়ার। কাহিনীতে আছে বিন্ধ্য অঞ্চলের বন্য উপজাতি নিষাদ এবং ম্লেচ্ছরা এই রাজার শরীর থেকে উদ্ভূত। ডোমেরাও বলে যে তারা রাজা বেণ-এরই বংশধর। এ হয়তো তাদের আদিবাসী জন্মের স্মৃতি। কথাটির ঐতিহাসিক ভিত্তি যাই হোক, এর নিশ্চিত সাদৃশ্য আছে ডোমেদের ঐতিহ্যের কিছু উপাদানের সঙ্গে; বিদ্রোহের মানসিকতা তেমন উপাদানের অবলম্বন। যেমন বস্তি-গোরখপুরে ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত শাসকেরা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বিবাহ করতে চেয়ে সেখানকার ব্রাহ্মণদের বিপদে ফেলেছিল।
৫
রাহুও ব্রাহ্মণদের শত্রু, তাদের ঘৃণার পাত্র। রাহু যে ডোম সম্প্রদায়ের আরাধ্য, তা বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির প্রতি নিম্নবর্ণের বিরোধিতার আর এক নিদর্শন। আমরা রাহু পূজার প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত বিবরণ পাই বিউক্যানান-হ্যামিলটন-এর লেখায়। উনিশ শতকের গোড়ার বছরগুলিতে পূর্ণিয়া অঞ্চলে তিনি দেখেন৪৬, নাথপুরের দোসাদরা ব্রাহ্মণধর্মের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে কী ভাবে নিজেদের আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে জাহির করত, রাহু-আরাধনার উপলক্ষে। সেখানে রাহু পূজা এক বলির চেহারা পেত; তার কেন্দ্রে ছিল মুখ্যভক্তের অগ্নিপরিক্রমা; সে নিজে একজন দোসাদ, আবার অশরীরীর সঙ্গে সংযোগস্থাপনের মাধ্যমও বটে।৪৭ সেই ভক্ত ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিত নিজের হাত; খালি পায়ে হেঁটে যেত সাড়ে তিন মিটার দীর্ঘ জ্বলন্ত কয়লার জাজিমের উপর দিয়ে, তবু তার দেহ পুড়ত না, কোনও ফোসকাও পড়ত না তার শরীরে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে জনতার যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হত তার বর্ণনায় বিউক্যানান-হ্যামিলটন লিখছেন, ‘এটা স্পষ্ট…যে সমগ্র দর্শক, সংখ্যায় যারা অগণিত, তারা সকলেই রাহুর প্রভাবে বিশ্বাস করত; দোসাদরা তো বটেই, সম্ভবত অন্য সকলেও বিশ্বাস করত যে রাহুর প্রভাবেই মানুষটি আগুনের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। আমার সঙ্গে যেসব ব্রাহ্মণ ছিল তাদের মহোল্লাসে চ্যালেঞ্জ জানাল মুখ্যভক্তের অনুগামীরা, সেই উপাসককে অনুকরণ করতে।’৪৮ সাহেবের দলে যে পণ্ডিত ছিল, এই দ্বন্দ্বের পরিণাম তার অনুকূল হয়নি।
আচার-অনুষ্ঠানে এ রকম ক্ষমতার যে স্বীকৃতি, তার চেয়ে নিম্নজাতির মধ্যে প্রচলিত গ্রহণ বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনী বেশি আলোকিত করত উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গের মধ্যে ধর্মীয় বচনের বিরোধকে। নিম্নজাতির এই পুরাণ সমুদ্রমন্থনের কাহিনীর (প্রথম উপাখ্যান) সমান্তরালে থাকে; এবং তারা দুয়ে মিলে একত্রে এক পরম্পরা নির্মাণ করে, ভাবের জগতে সে পরম্পরার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। পৌরাণিক কাহিনীর এই পরম্পরা কখনওই বিচ্ছিন্নভাবে কার্যকরী হয় না। বরং সাবেকি হিন্দু পুরাণের কাহিনীতে নিজেদের বিষয়বস্তু মিশিয়ে তাকে বদলে দেয়। প্রথমত রাহু এবং তার অনুগামীদের মধ্যে একটি সম্পর্কের অস্তিত্ব নির্দেশ করে; দ্বিতীয়ত নিম্নবর্গের বাস্তব এবং সামাজিক অবস্থার উপরে সেই সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে, আরও খুলে বলতে গেলে, সম্পর্কটি যেন গ্রথিত হয় পৃথিবীর মাটিতে। দ্বৈত প্রক্রিয়ায় সংঘটিত কাঠামোগত পরিবর্তনের সমগ্রতা থেকেই গড়ে ওঠে নিম্নজাতির ভাবাদর্শের বৈশিষ্ট্য। পুরাণের উপাদানকে নিম্নবর্গের গোষ্ঠীগুলি কেমনভাবে আপন করে নেয়, নিম্নোক্ত আখ্যান তারই দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয় উপাখ্যান
রাবণ বিজয়ের পরে লঙ্কা থেকে ফিরে রাম তার সেনাবাহিনীর জন্য এক ভোজের আয়োজন করেন। মহাদেব (শিব) পার্বতীর উপরে ছিল পরিবেশনের ভার। এমন সময় নিম্নজাতির এক মাঙ্গ বালকের উপস্থিতির প্রতি মহাদেব পার্বতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন,…এবং পার্বতীকে সতর্ক করে দেন, পরিবেশনের সময় তিনি যেন ছেলেটির থেকে যথোচিত দূরত্ব রাখেন। কিন্তু রাম যখন সেই মাঙ্গকে দেখতে পেলেন, তার দুঃসাহসিক অপরাধের জন্য রাম তাকে বধ করলেন; কারণ সেই বালক নিজের অশুদ্ধ উপস্থিতিতে ভোজসভার পবিত্রতা খর্ব করতে চেয়েছিল। মৃত ছেলেটির মাতা তখন সন্তানের মস্তক একটি ডালায় স্থাপনপূর্বক বিশুদ্ধ জলের ছিটায় প্রাণসঞ্চারের বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। হারানো পুত্রের মস্তকবাহী সেই ডালা নিয়ে সে গেল দেবদেবীদের কাছে, নিজের খাদ্য ভিক্ষা চাইতে। পর্যায়ক্রমে গেল সে সূর্য এবং চন্দ্রের কাছে, ভয় দেখাল তাঁদের, বলল যদি তার অনুরোধ রক্ষা না হয়, সে চন্দ্র সূর্যকে স্পর্শ করবে, নষ্ট হবে তাঁদের শুদ্ধ চরিত্র। সেই ডালার ছায়াই গ্রহণের কারণ। এই মাঙ্গনারী, অর্থাৎ সেই উত্যক্তকারী পাওনাদারের হাত থেকে রেহাই পেতে চন্দ্র সূর্যকে নৈবেদ্য দান এবং মাঙ্গদের ভিক্ষাদানের প্রথা চালু হলো।৪৯
পরিবর্তনের উপাদানগুলি এক নজরেই স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম উপাখ্যান মহাভারতের অংশবিশেষ, কিন্তু দ্বিতীয় উপাখ্যান রামায়ণের পাঠ। প্রথম কাহিনীতে নিমন্ত্রণকর্তা এবং হত্যাকারী ছিলেন বিষ্ণু, কিন্তু এখানে সেই একই ভূমিকায় দেখি রামকে। তবে এই আখ্যানে দোষী এবং শিকার কোনও দানব নয়, শম্বুকের মতো একজন অস্পৃশ্য, অধিকারের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবার জন্য যে প্রাণ দিল। এই কাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানেই দেখি, এখানে তার অপরাধ দেবতাদের আহার্য অপসারণে নয়, কিন্তু নিজের অশুদ্ধ উপস্থিতিতে ভোজসভাকে অপবিত্র করায়। মুণ্ডচ্ছেদের পরবর্তী ঘটনাবলী প্রথম কাহিনী থেকে দ্বিতীয় কাহিনীতে আলাদা। প্রথম আখ্যানে ছিল প্রতিশোধস্পৃহা, কিন্তু দ্বিতীয় উপাখ্যানে প্রতিশোধ-প্রবণতার থেকে বড় হয়ে ওঠে বিচারের অন্বেষণ; বিচার খুঁজে ফেরে এক মা, যে হারিয়েছে তার সন্তানকে হারিয়েছে নিজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। প্রথম পুরাণে ছিল বিষ্ণুর দুই বার্তাবহ চন্দ্র-সূর্যের বিরুদ্ধে ফিরে ফিরে আক্রমণ, দ্বিতীয় কাহিনীতে দেখি দেবতাদের কাছে ভিক্ষাপ্রার্থনা অর্থাৎ ধরনা দেওয়ার চিরাচরিত চেহারা।
পরিবর্তনের এই পরম্পরায় রাহু মিলে যায় মাঙ্গ-এর সঙ্গে, মাঙ্গ-এর সামাজিক অস্তিত্বই আরোপিত হয় রাহুতে। বাস্তবজীবনের এই প্রক্রিয়া ভারতের বহু পৌরাণিক কাহিনীতে উপস্থিত, যেখানে ঈশ্বর আর মানুষ একাত্ম এবং একে অপরের পরিপূরক। এই উদ্দেশ্যে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়—ব্যাকরণের পদ্ধতি, কুলুজির পদ্ধতি এবং পূজার পদ্ধতি। ব্যাকরণ-পদ্ধতি যে কোনও দুটি রাশির মধ্যে সংযোগকে একটা সাধারণ রূপ দেয়, যেমন ক হচ্ছে খ। দ্বিতীয় উপাখ্যানে দেখি রাহু হচ্ছে একজন মাঙ্গ। আবার মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলের যেসব লোকগাথা রাসেল এবং লাল একত্র করেছেন সেখানে রাহু হচ্ছে একজন মেথর বা ভাঙ্গি।৫০ কুলুজি পদ্ধতি আসে নিম্নোক্ত আকারে, ক হচ্ছে খ-এর একজন পূর্বপুরুষ। বিহারের তিরহুত অঞ্চলের দোসাদরা বলে রাহু (আঞ্চলিক ভাষায় রাহ অথবা রাহ্) তাদের একজন পূর্বপুরুষ, যুদ্ধে যার মৃত্যু হয়েছিল।৫১ মির্জাপুরের দোসাদদেরও গর্ব আছে, রাহু তাদের পূর্বপুরুষ বলে; আখ্যান অনুযায়ী (যে আখ্যানে আজও পাই সেই পৌরাণিক যুদ্ধের স্মৃতি) তাদের রাহু বাংলাদেশ থেকে উত্তরপ্রদেশ যাত্রাপথে বন্দি হল জগন্নাথের (বিষ্ণু) মন্দিরে।৫২ কথিত হয় পশ্চিমাঞ্চলের মাঙ্গরাও সেই দানব কুলজাত, যে দানব গ্রহণকালে চন্দ্রকে গ্রাস করে।৫৩ পূজা-পদ্ধতির (খ ক-কে পূজা করে) প্রক্রিয়ায় যে কোনও বিগ্রহ আরাধনার নিয়মাবলী নির্দিষ্ট হয়। সেখানেও পার্থিব বিশ্বের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখি; পূজারী এবং তার আরাধ্য দেবতার সম্পর্ক পুত্র এবং পিতার বন্ধনের মতো। সুতরাং কুলুজি-পদ্ধতির প্রক্রিয়া হয়ে যেতে পারে পূজা-পদ্ধতির প্রক্রিয়া; পূজা-পদ্ধতি হতে পারে কুলুজি পদ্ধতি। রাহুর সব পূজারীই তাই নিজেকে রাহুর উত্তরপুরুষ ভাবতে পারে; এমন কী তারাও, দোসাদ বা মাঙ্গদের মতো যাদের পুরাণে রাহু পূর্বপুরুষ বলে বর্ণিত নেই।
ভাবজগতের যে কাঠামো আমাদের আলোচনার বিষয়, বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই বন্ধন তার পক্ষে একান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বন্ধনের পরিণামে এক দিকে গ্রহণ, অন্য দিকে তার অশুদ্ধ আর অশুভ ইঙ্গিতে গ্রহণ যাদের ভয় দেখায়, এই দুয়ের ভিতরে এক মধ্যস্থতার ভূমিকা পেয়ে যায় পতিত মানুষেরা। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে একমাত্র তাদেরই ক্ষমতা আছে রাহুকে ভুলিয়ে তার প্রকোপ থেকে চন্দ্র-সূর্যকে উদ্ধার করবার, কারণ তারা রাহুর অনুগামী। অর্থাৎ হিন্দুসমাজে যারা সবচেয়ে অক্ষম এবং ঘৃণ্য, তারাই পারে অশুদ্ধতা আর ধ্বংসের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে। বিপরীত অর্থের ব্যঞ্জনায় এর মধ্যে যেন এক রসিকতার আমেজ এসে যায়। এ যেন নিম্নজাতিদের দেয় এক কৃত্রিম প্রভুত্ব, যার উৎপত্তি ওই ‘মধ্যবর্তী অবস্থায়’ জড়িয়ে আছে। কারণ ‘দুই বিপরীত মেরুকে অঙ্গীভূত করে এই মধ্যস্থতা; ফলে শেষ পর্যন্ত দুই প্রান্তের তুলনায় মধ্যবর্তীকেই মনে হয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ বিত্তের জগতে বিনিময়মূল্যের মধ্যস্থতা এবং আধ্যাত্মিক জগতে মধ্যবর্তীদের ভূমিকা মার্কস-এর উক্তিতেও৫৪ সমানভাবে সত্য।
‘ধর্মের জগতে তাই দেখি খ্রিস্ট দেবতা আর মানুষের মধ্যবর্তী সেতু—তাদের পরস্পরের মধ্যে বহতার এক উপায়মাত্র, আবার সেই খ্রিস্টেই মিলে যায় দেবতা আর মানুষ, খ্রিস্ট হয়ে যান মানুষদেবতা, যাঁর তাৎপর্য দেবতার থেকে বেশি। সন্তরা খ্রিস্টের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আবার পোপদের গুরুত্ব সন্তদের থেকে বেশি।’
ঠিক তেমনি রাহু এবং এক জ্যোতিষ্কের পারস্পরিক বিরোধের চরম মুহূর্তে পতিতকে দেখি দুজনের মধ্যবর্তী অবস্থায়। মনে হয়, রাহু এবং জ্যোতিষ্ক, উভয়ের উপরেই এখন পতিতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত; রাহু তার অধীন, কারণ সেই পতিতই একমাত্র চন্দ্র-সূর্য উদগীরণে দানবকে বাধ্য করতে পারে; অন্য দিকে চন্দ্র-সূর্য এবং চন্দ্র-সূর্যের উপরে যাদের জীবন নির্ভর, তারা সকলেই পতিতের অধীন, কারণ পতিতই একমাত্র পারে এই পরিস্থিতিতে তাদের রক্ষা করতে।
ভাষার ব্যবহারে, পূজাপার্বণের সূত্রে এবং পবিত্র বংশানুক্রমের কাহিনীতে রাহুর সঙ্গে একাত্ম সব নিম্নজাতির মানুষের মধ্যবর্তীর ভূমিকা স্বীকৃতি পায় গ্রহণের লগ্নে, যখন আনুষ্ঠানিক সমারোহে তাদের উপর বর্ষিত হয় দান। ‘দানবগণের পূজা করে ডোম, তাই চন্দ্রকে দানবের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে তারাই সক্ষম। সেই কারণেই ধার্মিক মানুষ গ্রহণকালে ডোমকে ভিক্ষা দেয়, যাতে ডোম তার ক্ষমতা ব্যবহার করে চন্দ্রের মুক্তির শুভসাধনে।’৫৫ উত্তরপ্রদেশে ভিক্ষাদান প্রথার এই বর্ণনার মিল আছে বাংলা এবং বিহার অঞ্চলে রিসলির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে। পার্থক্য একটাই যে বাংলা অথবা বিহারে প্রথাটা ঠিক দানের নয়; সেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তামার পয়সা বাড়ির বাইরে রেখে দিত, ডোমেরা যেন তা সংগ্রহ করতে পারে।৫৬ রাহু ‘একজন মেথর অথবা মেথরদের দেবতা’, এই বিশ্বাসে মধ্যপ্রদেশের মানুষ গ্রহণলগ্নে মেথরদের ভিক্ষা দেয়, যদি রাহু ‘সন্তুষ্ট হয়ে জ্যোতিষ্কদের মুক্তি দেয়।’৫৭ আরও পশ্চিমে গুজরাটে ‘গ্রহণ লাগলেই ভাঙ্গিরা ঘুরে বেড়ায় “গ্রহণদান”, “বস্ত্রদান”, “রূপাদান” কলরবে।’৫৮
৬
উচ্চবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দানকে বলা যায় স্বর্গে শান্তি এবং মর্ত্যে পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার মূল্য। ধ্বংসাত্মক দানবকে শান্ত করবার উদ্দেশ্যে যে আচার নির্দিষ্ট, তারই নাম শান্তি; এই নামেই আছে ওই দানের যথার্থ তাৎপর্যের ইঙ্গিত।৫৯ প্রথম উপাখ্যানের যে ব্রাহ্মণ্য বৈশিষ্ট্য, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই দানের দ্বিতীয় কোনও ব্যাখ্যা অসম্ভব।
কিন্তু যে পতিত দান গ্রহণ করে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই দানের এক ভিন্ন বিশ্লেষণ হতেই পারে। সেই সূত্র নিহিত আছে অপর পৌরাণিক আখ্যানে, যাকে অভিহিত করেছি দ্বিতীয় উপাখ্যান নামে। সেই আখ্যানে মাঙ্গনারী ভিক্ষার জন্য উত্ত্যক্ত করে দেবতাদের; ভিক্ষালাভে সেই নারীর অধিকার আছে; কারণ সেই নারী এমন এক মাতা, সন্তানের প্রাণনাশের পরে জীবনধারণের আর কোনও অবলম্বন যার অবশিষ্ট নেই। ভিক্ষাবৃত্তিতে ওই নারীর অর্থোপার্জন দেবতাদের বিবেককে সন্তুষ্ট রাখবারই সমতুল, কারণ দেবতাদের নায়ক রাম (বিষ্ণু) এবং শিব ছিলেন নিধনের কারক এবং প্ররোচক। বিপর্যস্ত মাতা জীবনধারণের ন্যূনতম দাবি করছেন, এ ঘটনা গভীর নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ—যেন এক ন্যায্য ক্ষতিপূরণেরই অন্বেষণ। একই ভাবে ভিক্ষাদান প্রথাকেও বলা চলে নৈতিকতার প্রতিনিধি। তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে মাঙ্গনারীকে বঞ্চিত করলে, তা হবে নীতিগত ভ্রষ্টতা। কারণ হিন্দুদের আদর্শ ধারণায়, যে কোনও দানেই, দাতা এবং গ্রহীতা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এক সম্পর্কে যুক্ত; সে সম্পর্ক যতখানি আধ্যাত্মিক, ততটাই জাগতিক। মার্সেল মাউস যাকে বলেছেন ‘আর্থনীতিক ধর্মতত্ত্ব’ তার নিয়ম এই দেওয়া নেওয়ার পরিচালক। সেখানে স্তরবিন্যাস অনুযায়ী সম্পত্তিতে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর অধিকার নির্দিষ্ট থাকবে; আর সেই অধিকার, যা তাদের আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক চাহিদাকে পূর্ণ করবে, তা হবে এক নৈতিক অধিকার। তাই যাদের সম্পদ আছে, সম্পদ ভাগ করে নেওয়া তাদের কর্তব্য। কিন্তু কোনও ক্ষতির প্রশ্ন এখানে নেই। বরং এ কেবল তাদের আধ্যাত্মিক উৎকর্যের উপায়ই নয়, তাদের ধনসম্পদও এভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ দান ‘সততই দাতাকে সমান প্রতিদান এনে দিতে পারে—কখনওই তা দাতার কাছ থেকে হারিয়ে যায় না, উপরন্তু এনে দেয় আরও কিছু, যা ছিল না আগে; আথবা দাতা তার দান লাভসমেত সম্পূর্ণ ফিরে পায়।’৬০ বলা যায়, পতিত ভিক্ষুকের প্রতি দাতার আচরণে পৃষ্ঠপোষকরা নিজেদেরই উপকার করেছিল: তারা যে কেবল সমতুল্য প্রতিদান এবং সম্পদবৃদ্ধির নিশ্চিতি পেল তাই নয়, চাওয়া-পাওয়ার যে প্রবাহে দানের স্থান, সেই প্রবাহে বাধাসৃষ্টির পাপও তাদের স্পর্শ করতে পারল না।
স্বকীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনও দাতা এই প্রবাহে বাধাসৃষ্টির পাপ নাও এড়াতে পারেন, হরিশ্চন্দ্রের নিয়তিই তার দৃষ্টান্ত। আখ্যানের সেই রাজা ব্রাহ্মণের দাবিতে সাড়া দিয়েছিলেন নিজের ‘স্বর্ণ, স্ত্রীপুত্র, দেহ, রাজ্য, জীবন এবং সৌভাগ্য’ উৎসর্গ করে। কথামতো সবই গ্রহণ করেন ব্রাহ্মণ, এবং প্রতিশ্রুতি পালনার্থে রাজাকে প্রথমে স্ত্রী, তার পর পুত্র, শেষ পর্যন্ত নিজেকেও বিক্রয় করতে হয়। চরমতম বিপর্যয় আসে, যখন নিজেকে তিনি বিক্রয় করেন এক চণ্ডালের কাছে। এই পুরাণ অবলম্বনে যে কাহিনী গড়ে ওঠে, সেখানে দেখি, ডোমদের পূর্বপুরুষ কলুবীর সেই দুর্ভাগা রাজাকে কিনেছিল, আর এতই সৎ ব্যবহার করেছিল রাজার সঙ্গে যে ‘রাজা সমগ্র উপজাতিকে নিজের ধর্মে দীক্ষা দিলেন।’৬১ এই কারণেই ডোমেরা বলে, তারা রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রতিনিধিরূপে গ্রহণকালে দান গ্রহণ করে। তাদের মতে, ‘রাজা যখন ভিক্ষাচরণের উদ্দেশ্যে স্বর্গ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, ভগবান বললেন, কেউ যদি তাঁকে খাওয়াতে স্বীকৃত না হয়, চন্দ্র-সূর্য তবে অদৃশ্য হবে। গ্রহণলগ্নে ডোমেরা তাই দান গ্রহণ করে, কারণ রাজার আত্মা তখন ক্ষুধার্ত।’৬২ হরিশ্চন্দ্রের ভূমিকা সম্পূর্ণ উলটে গেছে; আদি পুরাণে তিনি ছিলেন দাতা, এখানে তিনি দানগ্রহণকারী। কিন্তু একজনের চাওয়া এবং আর একজনের দেওয়ায় মিলে দানের যে তাৎপর্য, তা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত আছে। দানের কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতিতে চাওয়া-দেওয়ার পরম্পরা যদি ব্যাহত হয়, তবে শুধু এক গৃহস্থ নয়, সমগ্র বিশ্বই ধ্বংস হতে পারে গ্রহের প্রবর্তনে কোনও এক অসঙ্গতির আক্রমণে।
গ্রহণ-বিষয়ক আর এক উপাখ্যানেও দানের রূপকল্প পুনরায় ফিরে আসে। তবে এ কাহিনীতে পুরো বিন্যাসের তাৎপর্য অনেক কম।
তৃতীয় উপাখ্যান
চন্দ্র-সূর্য দুই ভাই। এক ক্ষুধার্ত পূজারী একদিন তাদের কাছে এসে বললে, ‘আমি দরিদ্র, ক্ষুধার্ত। আমাকে কিছু খেতে দাও।’ ভ্রাতৃদ্বয় তাই এক মেথরানির কাছে গিয়ে বলে ‘এই লোকটিকে কিছু শস্য দাও।’ মেথরানি এক বছরের জন্য কিছু শস্য ভিক্ষুককে দিতে সম্মত হল। ভ্রাতৃদ্বয় মেথরানিকে আদেশ করল, পাত্রের নীচের থেকে শস্য বের করে ভিক্ষুককে দিতে। এই ক্ষতি তারা পূরণ করে দেবে পাত্রের উপর থেকে শস্য ঢেলে ঢেলে। বছর চলাকালীন সূর্য-চন্দ্র পাত্র ভরে দিতে পারল না। বছর অতিক্রান্ত হলে মেথরানি বললে, ‘আমাকে ক্ষতিপূরণ দাও, কারণ পাত্র এখনও ভরেনি।’ ক্ষতিপূরণে অক্ষম চন্দ্র-সূর্য নিজেদের গোপন করে রাখল। আজও যখন গ্রহণ লাগে, চন্দ্র-সূর্যের পূজারীরা বিভিন্ন শস্য সংগ্রহপূর্বক, তা একসঙ্গে মিশিয়ে ভিক্ষুকদের মধ্যে বিতরণ করে—চন্দ্র-সূর্যকে লজ্জা থেকে মুক্তি দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।৬৩
পৌরাণিক প্রকাশভঙ্গি বাদ দিয়েই এ কাহিনী সম্পূর্ণ, সেখানেই আখ্যানটি অসাধারণ। গল্পে রাহুর কোনও উল্লেখ নেই, নেই এক প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাকল্পে জীবজন্তু সম্বন্ধে হিন্দুরূপকের ব্যবহার। আমরা এখনও কল্পনার জগতেই আছি ঠিকই, তবু তার ভিতরে বাস্তব-বিশ্বের অংশবিশেষকে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয় না। স্বর্গে শান্তিভঙ্গের বিশ্লেষণ উপাখ্যানে পাই, কিন্তু অশান্তির উপাদান আমাদের অতি পরিচিত গ্রামীণ পরিপার্শ্ব থেকেই গৃহীত। ফসলের যখন মন্দা, এমন বছরের ক্ষুধা এবং অভাব, খাদ্যের জন্য ভিক্ষা, দরিদ্রের প্রতি সামাজিক কর্তব্য পালনে প্রতিবেশীর কাছে ঋণ চাওয়া, সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পারার লজ্জা, এই সবই সেই উপাদান। স্বর্গের চিত্রনাট্যকে পার্থিব বাস্তবে মেলাতেই এমন উপাদানসমূহ গল্পে একত্র হয়। আখ্যানটিতে দেখি, নিম্নবর্গের অলংকারবিহীন শিল্পের উদ্দেশ্যই হল, যা যথার্থই অভাবনীয়, তার সম্পর্কে অবিশ্বাস কাটাতে চাওয়া। সূর্য-চন্দ্রের উচ্চবর্ণ পূজারী অভুক্ত, শস্যপূর্ণ পাত্র আছে ভাঙ্গি বা মেথরের কাছে, উচ্চবর্ণের মানুষ ভিক্ষা চাইছে, তাদের দৈব পৃষ্ঠপোষক ধার চাইছে, আর নিম্নবর্ণের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনের অধিক শস্যের মালিক, এর থেকে অবিশ্বাস্য আর কীই বা হতে পারে? মনে হয়, গ্রামীণ সমাজ যেন সম্পূর্ণ উলটে গেছে, শুধু দুর্ভাগ্য এই যে এমন প্রতিবিধান ধর্মীয় চিন্তার সীমাকে পেরিয়ে যেতে পারছে না।
তবু এই প্রতিবিধানকে তাৎপর্যবিহীন বলে অস্বীকার করা ভুল হবে। কারণ সমাজের দরিদ্র এবং ঘৃণ্যরা নিজেদের দুর্দশা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে, বুঝছে এই দুর্দশাকে অতিক্রম করবার প্রয়োজন, সেই দ্বৈত চেতনার প্রকাশ এমন প্রতিবিধান। বাস্তবে কোনও প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে ইচ্ছা পূরণের স্বপ্নকেই তারা সত্যি বলে ভাবতে চায়। মৌলিক কোনও তাড়নায় স্বপ্ন এক বাস্তব পরিণতি পাবে, এমন ইচ্ছা আজও বড় দুর্বল। তবুও নিম্নবর্গের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান, তার বিরুদ্ধতাই এই ইচ্ছার ভিত্তি।
একদিকে এই বিরুদ্ধতা শিশুর মতো অসহায়, তবু এক পরিণতির আভাস তার ভিতরে নিহিত আছে। আমাদের আলোচনার পক্ষে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশের আদিপর্বে সংশয়ে আকুল এই বিরোধ উচ্চবর্গের কাছে ধার করা ভাষাতেই সবাক হয়ে ওঠে উচ্চবর্গের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে; তখনই আমরা দেখি পরিণতির প্রথম মুহূর্ত। কিন্তু এই সমালোচনা পৌরাণিক উপাদানসমূহকে ঢেলে সাজাতে পারে, যাতে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত রূপকল্পে এই নতুন মূর্তি সংগতি খুঁজে পায়; দ্বিতীয় উপাখ্যানেই এমন ইঙ্গিত আছে। তার পর তৃতীয় উপাখ্যানে নিম্নবর্গের ধর্মচেতনাকে দেখি তার নিজের স্বরূপে। ব্রাহ্মণ্য পুরাণতত্ত্বের জটিল অলংকৃতভারের জায়গায় এই বিরুদ্ধতা নিয়ে এল এক কল্পনার জগৎ, যার সূত্র মিলবে নিম্নবর্গের প্রাত্যহিক জীবনে। পরিবর্তনের এই ধারায় দানের সনাতন রূপকল্প অন্তরালে সরে যায়, আখ্যানের কেন্দ্রে আসে সেইসব ঋণের প্রসঙ্গ যা শোধ হয়নি আজও। সব মিলে আর্থনীতিক ধর্মতত্ত্ব থেকে পলিটিকাল ইকনমির দিকে এ এক সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৭
রাহু বনাম চন্দ্র-সূর্যের আখ্যান বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শেষে তার নতুন চেহারা পেল আমাদের সমাজের প্রকৃত এক বিরোধের প্রসঙ্গে। ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার পারস্পরিক বিরোধ বাস্তবিক একান্তই যন্ত্রণাদায়ক। মধ্যপ্রদেশ অঞ্চল থেকে দেওয়া যায় একটি প্রতিভূ দৃষ্টান্ত:
চতুর্থ উপাখ্যান
চন্দ্র এবং সূর্য রাহুর কাছে ঋণী; রাহু এসে ঋণ শোধের দাবি জানায়; একেই বলে গ্রহণ। ভিক্ষার যে দান মেথররা পায়, তা ওই ঋণ শোধের এক উপায়।৬৪
একই কাহিনীর বহু পাঠান্তরের মধ্যে কয়েকটি বাস্তবের বিন্যাসে বিশিষ্ট, যেমন,
পঞ্চম উপাখ্যান।
সূর্য মেথরের কাছে ঋণী, কিন্তু অর্থ ফেরত দিতে সে অস্বীকার করে। মেথরও নাছোড়বান্দা, সূর্যের দুয়ারে সে ধরনা দেয়। তার কালো ছায়া খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে। কালক্রমে সেই ঋণ শোধ হয় এবং মেথর চলে যায়।৬৫
ষষ্ঠ উপাখ্যান।
কোনও এক সময় সূর্য চন্দ্র উভয়েই ধ্রুভ অর্থাৎ রাহুর কাছে কিছু ঋণ করেছিল।… ঋণ শোধ দেওয়া প্রয়োজন; যদি কখনও সূর্য বা চন্দ্র ঋণ পরিশোধে সক্ষম না হয়, তবে রাহু তাকে আক্রমণপূর্বক গ্রাস করতে থাকবে। কিন্তু কখনওই রাহু তাকে পূর্ণগ্রাস করতে পারে না, উদ্গীরণ করে দেয়। যেহেতু ঋণ শোধ এখনও শেষ হয়নি, অর্থ দিয়ে যেতেই হবে।৬৬
এমন-সব কাহিনীসূত্রে রাহু তার আদি নিবাস পুরাণের সেই স্বর্গ ত্যাগ করে। যেখানে তার ভক্তদের জীবন, সেই পার্থিব জগতে রাহু খুঁজে পায় তার বাসভূমি। স্বর্গীয় হিংস্রতায় যে কাহিনী শুরু হয়েছিল, সে উপাখ্যান তাই সামাজিক হিংস্রতায় পরিণাম পায়। বাস্তব জগৎ পৌরাণিক বিশ্ব থেকে আলাদা; বাস্তবে এই হিংস্রতা দীর্ঘস্থায়ী ঋণানুবদ্ধতা অথবা ক্রীতদাস প্রথার মারাত্মক চেহারা নেয়; ডোম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষই হয় এই হিংস্রতার চরম শিকার। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষভাগে ব্রিগ্স ডোম নামে পরিচিত এই জাতির বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা ওই সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই সত্যি, যথা ‘যেসব আর্থিক বোঝায় তারা ভারাক্রান্ত, তার মধ্যে ঋণের ভারই সর্বাধিক।… প্রতি মাসে টাকায় চার আনা সুদ, অর্থাৎ বার্ষিক সুদের হার শতকরা তিনশো ভাগ ছিল একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সাত পুরুষ ধরে পূর্বপুরুষের ঋণ উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তায়, আর সেই ঋণ তারা শোধ করে চলে।’৬৭ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলের এক পর্যবেক্ষক বলেছিলেন, ডোম হল ‘ক্রীতদাসদের মতো, বংশানুক্রমে কোনও ঠকদারি পরিবারের কাছে তার চিরাচরিত বশ্যতা’, অথবা ‘সে জীবনভর কোনও মহাজনের দাসত্ব করে।’৬৮ তাদের দারিদ্র্য, সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রায়শই অসৎ কর্মপ্রবণতা, এসবেরই ব্যাখ্যা মেলে সেই ঋণের সূত্রে, যে ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত তাদের পরিশ্রম।
ডোম সদাই ঋণানুবদ্ধ, তাই শক্তির ধারণায় সে স্বভাবতই ভাবত নিজের পরিপ্রেক্ষিতে তার ঋণদাতার ক্ষমতার কথা। কারণ, সর্বত্রই নিপীড়িত মানুষ কর্তৃত্বের মূর্তি গড়ে প্রত্যক্ষ অত্যাচারীর প্রতিরূপ সামনে রেখে। তাই যেসব জাতি বা গোষ্ঠী কখনও দীর্ঘমেয়াদী, কখনও বা বংশানুক্রমিক ঋণ বহন করে জীবন্ত ঐতিহ্যের মতো, তাদের লোকগাথায় মহাজন ফিরে ফিরে আসে আদর্শ কল্পনার ছবিতে। তাই বাস্তারে ধুরুয়াদের মধ্যে অনাথ শিশুর সাফল্য নিয়ে যেসব প্রবাদকাহিনী প্রচলিত, সেখানে শিশুটি সাহুকার হতে পারলেই তার জীবনের চরম কীর্তি।৬৯ বোম্বাই এবং রাজস্থান অঞ্চলের গ্রাসিয়ারা বানিয়ার হাতে নিষ্ঠুরভাবে শোষিত; গ্রাসিয়ারা বিশ্বাস করে যে, বানিয়া পারে বৃষ্টিপাত কমিয়ে খরা নিয়ে আসতে; তখন শস্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের অধিক মুনাফালাভে সহায় হয়।৭০ মহাজনের পক্ষে এমন আদর্শ কল্পনার ভূষণ সীমায় পৌঁছিয়ে যায়, রাহু-বিষয়ক উপাখ্যানেই। মহাজনের আচরণে যারা প্রায় দাসে পরিণত হয়েছিল, মহাজনকে নিজেদের আরাধ্য দেবতা বানিয়ে তারা চূড়ান্ত নতিস্বীকার করে। সুদখোরকে ভগবান বানানোর এই বোধ হয় চরম নিদর্শন।
ডোম, দোসাদ, ভাঙ্গি আর মাঙ্গরা ঋণদাতার ক্ষমতাকে যেমন স্বীকার করে নেয়, একই উপায়ে তারা ওই শক্তি থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। কারণ তারা রাহুর সঙ্গে একাত্ম, তা সে সন্তানরূপেই হোক, পূজারীরূপেই হোক অথবা রাহুর থেকে উদ্ভূত বলেই হোক; ভাবজগতের ওই একই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেদের দেয় উত্তমর্ণের চেহারা; বাস্তবে যার সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না, নিজেদের সেই বন্দিদশাকে ভেঙে দেয় তারা তাদের কল্পনার আদর্শ জগতে। নিজেদের সমাজে তারা খাতক (খাদক)৭১ , অর্থাৎ ঋণের ভোগী, কিন্তু রাহুর সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বর্গীয় অধমর্ণদের গ্রাস করবার অধিকার পেয়ে যায়। এতদিন যারা ছিল নিপীড়িত, তারা আজ নিজেদের অত্যাচারীর ভূমিকায় সাজাচ্ছে; সেখানে রয়েছে অর্থে প্রত্যর্থে এক বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা। বাস্তব জগৎকে উলটে দেওয়ার বহু প্রয়াসেই নেতিবাচক চৈতন্যের সেই ছাপ থেকে যায়। ধর্মের জগতেও প্রতিবিধান এমন বিপরীতের ব্যঞ্জনায় চিহ্নিত। চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ উপাখ্যানে তেমন ব্যঞ্জনারই দৃষ্টান্ত।
৮
এ কথা সন্দেহাতীত যে রাহুর স্বর্গ থেকে মর্ত্যে গমন অলীক এক মুক্তি ছাড়া কিছুই অর্জন করে না। তা সত্ত্বেও এমন সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে যে আমরা এখনও সেই আরম্ভেই দাঁড়িয়ে আছি। বরং এখন আমরা ধারাবাহিক এক ক্রমের শেষ প্রান্তে, প্রথম উপাখ্যান থেকে যার দূরত্ব অনেক। যেদিন অমৃতের ভাগ নিয়ে দেবতা আর দানব লড়াই করেছিল, সেই সমুদ্রমন্থন আজ থেকে কত যুগ আগে? অমৃতের ভোজসভায় সেই মুণ্ডচ্ছেদই বা কবেকার কথা? আজ আমরা দাঁড়িয়েছি আমাদের সময়ের সঙ্গে, আমাদের পদক্ষেপ হয়তো ততখানি নিশ্চিত নয়, যতখানি নিশ্চিতি আছে আমাদের আকাঙ্ক্ষায়, তবু সেই পদক্ষেপ আজ নিজেদের অভিজ্ঞতার ভূমিতে। অস্বীকার করব না যে গ্রহণের মতো প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা আজও খোঁজা হয় পুরাণে, বিজ্ঞানে নয়। কিন্তু আজকের পুরাণে মূল চরিত্র আর দেবতা দানব নয়, মুখ্য ভূমিকা আজ জনগণের। পৌরাণিক কাহিনীর কেন্দ্রে ছিল অমৃতের প্রতিযোগিতা; সে লড়াইয়ের চেহারা বদলে গেছে; আজকের প্রতিযোগিতা মানুষের জীবনধারণের উপযোগী সব পার্থিব সম্পদের মালিকানা নিয়ে। ব্রাহ্মণ্যের আজব কল্পনায় যার উদ্ভব, দরিদ্র আর নিপীড়িতের সরল কল্পনা তাকে আমাদের কালের উপকথায় গ্রথিত করে। কাহিনীর যে পাঠ আমরা মৎস্যপুরাণে পাই, তাতে দেখি, রাহুর সঙ্গে চন্দ্র-সূর্যের শত্রুতা হয়েছিল এবং আজও গ্রহণের সময় রাহু দুজনের উপরেই প্রতিশোধ নেয়।৭২ এখনও সে তার আশানুরূপ পুরোপুরি প্রতিশোধ নিতে পারেনি, অবিরাম চলছে তার অন্বেষণ। সে যে নিজের শত্রুকে মর্ত্যেই খুঁজে পেয়েছে, এটা রাহুর পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি। উপরোক্ত কাহিনীসমূহের বিচারে এই সংগ্রাম এখনও ভাবজগতেই সীমিত; কিন্তু সেই সামাজিক সংগ্রামে পরিণতির সম্ভাবনা আজ অনেক বেশি; সেই সংগ্রামেরই রূপক শেষ তিনটি উপাখ্যান।
অনুবাদক: রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, রুশতী সেন
টীকা
১ D.D. Kosambi, An Introduction to the Study of Indian History, rev. 2nd ed. (Bombay, 1975), ch. 2: The Culture and Civilisation of Ancient India in Historical Outline (reprint, Delhi, 1972), ch. 1; এবং ঐ গ্রন্থের অন্যত্র।
২ Kosambi, Culture and Civilisation, p. 15.
৩ ঐ, পৃ. ১৬।
৪ প্রথম উপাখ্যানের পাঠ নেওয়া হল The Mahabharata: 1. The Book of the Beginning, tr. and ed. J.A.B. Van Buitenen (Chicago, 1973), p. 74-5। জর্জ দুমেজিল বলেন যে, এই আখ্যান বেদেও উপস্থিত, কিন্তু সেখানে দানবের নাম স্বরভানু। এই আখ্যানের সঙ্গে অমৃতের যোগাযোগ নেই। দুমেজিল-এর মতে, অমৃতের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে পরবর্তী কাহিনীটি হিন্দুদের উদ্ভাবন। G. Dumezil, Le Festin d’ Immortalite (Paris, 1924), p. 20.
৫ W.D.O’Flaherty, Hindu Myths (Harmondsworth. 1975), pp. 273-4-এ এই দ্বন্দ্বময়তার বিষয়ে সংবেদনশীল মন্তব্য আছে।
৬ C. Levi-Strauss, The Raw and the Cooked (London, 1970), p. 244.
৭ এই ধরনের বেনিয়মের বিবাহে অস্বাভাবিকতাগুলি হল, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান, একে অপরের প্রতি বেমানান আচরণ, পোয়াতি মেয়ের বিবাহ, আর বিবাহ উৎসবের জন্য ভোজসভার আয়োজন না করা (ঐ, পৃ. ২৪৪)। Levi-Strauss, ঐ, Part 5 (১)-এ গ্রহণ এবং মশকরার কাঠামোগত সাদৃশ্যের আলোচনা করেছেন।
৮ H.A. Rose. A Glossary of the Tribes and Castes of the Punjab and North-West Frontier Province, vol. I (Lahore, 1919), pp. 127, 738.
৯ G.W. Briggs. The Dams and their Near Relations (Mysore, 1953). [এর পর Briggs,] p. 547.
১০ E. Thurston, Ethnographic Notes in Southern India (Madras, 1906), p. 289
১১ Briggs, p. 547.
১২ S. Stevenson, The Rites of the Twice-Born (London, 1920) pp. 351-2.
১৩ ঐ, পৃ. ৩৫২; Briggs, p. 547.
১৪ Rose, Glossary, p. 869.
১৫ The Laws of Manu, ed. G. Buhler, Sacred Books of the East Series, vol 25 (reprint, Delhi, ১৯৭৫) [এর পর থেকে Manu]: IV, 110. এই অনুচ্ছেদটির টীকায় বিউলার বলছেন, ‘অবশ্যই, সূর্যের গ্রহণও এতে অন্তর্ভুক্ত।’
১৬ Thurston, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯০।
১৭ ঐ, পৃ ৩০৭।
১৮ N.M. Penzer. ‘Note on Rahu and Eclipses’ in The Ocean of Story, vol. II, tr. CH. Tawney (reprint, Delhi, 1968), p. 81-এ চীন ও পেরু সম্বন্ধে তথ্য আছে। লেভি-স্ত্রোসের যে গ্রন্থ টীকা ৬-এ উল্লিখিত, সেখানে এই কোলাহলের সর্বজনীনতা আলোচিত হয়েছে।
১৯ Penzer, ‘Note on Rahu’ pp. 81-2; M.N. Srinivas, Religion and Society among the Coorgs of South India (Oxford, 1952), pp. 239-40.
২০ Levi-Strauss, The Raw, p. 289.
২১ Stevenson, p. 352. W. Crooke, The Popular Religion and Folklore of Northern India, vol. I (reprint, Delhi, 1968), p. 22.
২২ উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য Briggs, পৃ. ২৬, ৬৬।
২৩ O’Flaherty, পূর্বোক্ত পৃ. ২২২, n. ৫৭।
২৪ এই প্রলয়ের আশঙ্কা মহাভারতে এইভাবে প্রতিফলিত: ‘রাহু কেতু যথাকাশে উদিতৌ জগতঃ ক্ষয়ে’ (কর্ণ পর্ব, ৪৭।৯২)
২৫ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সুত্রের মধ্যে আছে ব্রিগস-এর উপরোক্ত গ্রন্থটি; F. Buchanan [Buchanan-Hamilton), An Account of the District of Purnea in 1809-10 (Patna, 1928): Crooke, Popular Religion; Crooke, The Tribes and Castes of the North-Western Provinces and Oudh, vol. II (Calcutta, 1896); E.T. Dalton, Descriptive Ethnology of Bengal (Calcutta, 1872); G.A. ‘Note on Grierson, Bihar Peasant Life (rev. 2nd ed. Patna, 1926), Penzer, ‘Note on Rahu’; H.H. Risley, The Tribes and Castes of Bengal, vol. I [এর পর থেকে Risley] (reprint, Calcutta, 1981); R.V. Russell and H. Lal, Tribes and Castes of the Central Provinces, vol. 4 (London, 1916); Thurston, Ethnographic Notes.
২৬ M. Kennedy, Notes on the Criminal Classes in the Bombay Presidency (Bombay, 1908); Briggs, p. 147.
২৭ উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য Briggs, প্রথম পরিচ্ছেদ এবংঐ গ্রন্থের অন্যত্র। রিসলির সময় ডোমদের প্রায়শই চণ্ডাল বলা হত, এখনও হয়তো ভারতের পূর্বাঞ্চলে তাই বলা হয়।
২৮ Manu, 10, 51, 52, 55.
২৯ Kosambi, Culture and Civilisation, p. 14.
৩০ Risley, p. 241; Kosambi, Introduction, p.41.
৩১ Risley, pp. 252-3; Crooke, Tribes and Castes, pp. 348-9. Briggs, p. 97.
৩২ Risley, pp. 250, 257; Briggs, pp. 197, 200.
৩৩ Risley, p. 241; Briggs, pp. 174-5.
৩৪ Briggs, ষষ্ঠ, সপ্তম এবং বিংশ অধ্যায়ে এই সব গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব্স অ্যাক্ট’-এর প্রক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা আছে।
৩৫ Russell and Lal. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৯। বাল্মীকির সাহায্যে কেমনভাবে মেথরেরা ওই কলঙ্কচিহ্নের বাধা অতিক্রম করল, ত্যর একটি আখ্যানের জন্য Briggs, পৃ. ৫৮-৯ দ্রষ্টব্য।
৩৬ Briggs, p. 123.
৩৭ Risley, p. 241: Crooke. Tribes and Castes, p. 319.
৩৮ এই তথ্য এবং অনুচ্ছেদে আরও যে-সব তথ্য আছে, তার জন্য Briggs, পৃ ৬৩-৪, ৬৫, ৭৬ দ্রষ্টব্য।
৩৯ Kosambi, Culture and Civilisation, p. ৪৮.
৪০ এই উপভোগের বিষয়ে দ্রষ্টব্য Briggs, পৃ. ৪৬৫-৭; Grierson, পূর্বোক্ত পৃ. ৪০৬, ৪০৯; Buchanan, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯-৫০।
৪১ Briggs, পৃ. ৪১; এই অনুচ্ছেদের বাকি অংশের তথ্য একই গ্রন্থের পৃ. ৫২, ৫৪-৫৬, ৬০-৬২, ৬৪-৬৫ ভিত্তি করে।
৪২ রামায়ণম্, আদিকাণ্ড: II. ১৫-১৮। বলা হয়, কাব্যের অনুরূপ কাঠামো রামায়ণ-এর থেকে পুরনো, কারণ এই ছন্দ বেদ-এও পাওয়া যায়। G. Dowson. A Classical Dictionary of Hindu Mythology (London, 1950), p. 333
৪৩ এইসব কাহিনীর ভিন্ন পাঠের জন্য দেখুন Briggs, পৃ. ৫৫, ৫৯, ৬১
৪৪ Briggs, পৃ. ৬৪-৫-তে এই কাহিনী আছে।
৪৫ বেণ সম্বন্ধে এই অনুচ্ছেদের কাহিনীর সূত্রগুলি হলো Briggs, পৃ. ২৬, ৬৬, ৬৭ এবং Dowson, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৪।
৪৬ Buchanan, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৯-৫২।
৪৭ পরবর্তীকালের এই অনুষ্ঠানের বিবরণের জন্য Risley, পৃ. ২৫৫-৬ এবং Dalton, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২৬ দ্রষ্টব্য।
৪৮ Buchanan. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫২।
৪৯ Penzer, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮২।
৫০ Russell and Lal. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩২।
৫১ A. Cunningham and H.B.W. Garrick, Report of Tours in North and South Bihar in 1880-81 (reprint, Delhi, 1969), p. 28.
৫২ Crooke, Tribes and Castes, pp. 349-50.
৫৩ Briggs, pp. 543-4.
৫৪ Karl Marx, Grundrisse (Harmondsworth, 1973), pp. 331-2.
৫৫ Crooke, Popular Religion, p. 320.
৫৬ Risley, p. 247.
৫৭ Russell and Lal, Tribes p. 232.
৫৮ ঐ।
৫৯ কাণে-র মতে অশ্ব, রথ, গাভী, ভূমি, তিল, ঘৃত ইত্যাদি, এমন কি স্বর্ণমূর্তিও এই আচার-অনুষ্ঠানে নৈবেদ্যর অন্তর্ভুক্ত। এই অনুষ্ঠানে রাহুর উদ্দেশে যে দানমন্ত্র, তাতে রাহুকে শান্ত করার চেষ্টা স্পষ্ট:
তমোময় মহাভীম সোমসূর্যভিমর্দন
হেমতারাপ্রদানেন মম শান্তিপ্রদ ভব।
P.V. Kane, History of Dharmasastras, vol. V, pt. II (Poona, 1962), p. 766.
৬০ M. Mauss, The Gift (London, 1974), p. 55.
৬১ Risley, p. 246.
৬২ Briggs, p. 546।
৬৩ ঐ, পৃ. ৫৪৫।
৬৪ Russell and Lal, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩২।
৬৫ Penzer, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২।
৬৬ W.G. Griffiths, The Kol Tribe of Central India (Calcutta, 1946), p. 131.
৬৭ Briggs, p. 187.
৬৮ ঐ।
৬৯ K.N. Thusu, The Dhurwa of Bastar (Calcutta, 1965), pp. 219-20.
৭০ P.C. Dave, The Grasias (Delhi, 1960), p. 65.
৭১ হিন্দি এবং সংস্কৃতে এই দুটি কথা একে অপরের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায় ‘ভোগী’ এবং ‘অধমর্ণ’ অর্থে। প্রসঙ্গত দ্রষ্টব্য রামচন্দ্র ভর্মা, মনক হিন্দী কোশ, দ্বিতীয় খণ্ড, এবং রাধাকান্ত দেব, শব্দকল্পদ্রুম, দ্বিতীয় পর্ব।
৭২ মৎস্যপুরাণম্, pt. II. ed. B.D. Basu (Allallabiid. 1917), পৃ. ২৯০।
দেবীর আবির্ভাব – ডেভিড হার্ডিম্যান
১
উনিশশো বাইশের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে, দক্ষিণ গুজরাটে কাতারে কাতারে আদিবাসী বা উপজাতীয় কৃষকরা সলাহবাই নামে এক দেবীর উপদেশ শোনার জন্য জমায়েত হতে শুরু করে। এই ‘দেবী’ বা ‘মাতা’-র কোনও মূর্তি নেই, ভক্তদের ধারণা তিনি পুবের পাহাড় থেকে আসেন আর লোকের ওপর ‘ভর’ করে তাঁর আদেশ জানান। এইরকম একএকটি জমায়েতে বেশ কতকগুলি গ্রামের আদিবাসীরা এসে জড়ো হত এবং সেখানে তাদের অনেকেরই ভর হত। ভরগ্রস্তরা প্রচণ্ড মাথা ঝাঁকাত আর সেই অবস্থায় যেসব কথা বলত, লোকের ধারণা ছিল সেসব হচ্ছে দেবীর প্রত্যক্ষ আদেশ। প্রধান আদেশগুলি ছিল, মাংস ও মদ বর্জন, প্রতিদিন স্নান, শৌচের জন্য পাতার পরিবর্তে জল ব্যবহার, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখা, খাওয়া বা বলিদানের জন্য পালিত ছাগল, মুরগি ইত্যাদি ছেড়ে বা বিক্রি করে দেওয়া, পারসি শুঁড়ি আর জোতদারদের বয়কট করা। সাধারণের বিশ্বাস ছিল, দেবীর এই সব আদেশ যে মানবে না, তার ওপর নানান বিপদ নেমে আসবে, সে পাগল হয়ে যেতে পারে এমনকী তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। সাধারণত একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন এই রকম জমায়েত চলার পর দেবী সরে যেতেন আর এক গ্রামে এবং সেখানে একই ঘটনার পুনরাভিনয় হত।
দেবীর দ্বারা ভূতাবিষ্ট হওয়ার এই ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। বরোদা রাজ্যের শোনগড় (Songadh) ও ভিয়ারা (Vyara) মহকুমার পুরোটাই এর আওতায় চলে আসে। এই বিস্তৃত অঞ্চলের কোনও আদিবাসী গ্রামই এর আওতা থেকে মুক্ত ছিল না। নভেম্বর শেষ হওয়ার আগেই বারদোলি আর মাণ্ডবী (Mandvi) তালুকে এই হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে, ২ ডিসেম্বরের মধ্যে পৌঁছে যায় জালালপুর তালুকে, আর ১৪ তারিখের মধ্যে সুরাট শহর এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে। ডিসেম্বরে দেবীর নতুন কিছু কিছু আদেশ কানে আসতে শুরু করে। সলাহবাই এবার আদিবাসীদের বলছিলেন গান্ধীর নামে শপথ নিতে, খাদির কাপড় পরতে, আর জাতীয়তাবাদী স্কুলগুলিতে যোগ দিতে। গুজব শোনা গেল যে মাকড়সারা গান্ধীর নামের আদলে বুনছে তাদের জাল। এও শোনা গেল যে গান্ধী জেল থেকে পালিয়েছেন এবং এক পাতকুয়োর মধ্যে তাঁকে সলাহবাইয়ের পাশে বসে চরকা কাটতে দেখা যাবে।১
সরকারি কর্মচারীরা ভেবেছিল যে এই আন্দোলন হবে ক্ষণস্থায়ী। বারদোলির মামলতদার মন্তব্য করে; ‘আমার অভিজ্ঞতায় এই নিয়ে দশবার কালিপরজদের মধ্যে মদ্যপান বন্ধ করার গুজব ছড়াতে দেখলাম।২ এসব গুজব ছড়ায় খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু এদের প্রভাব কখনই বেশিদিন টেঁকেনি।’৩ মামলতদারের প্রত্যাশা অবশ্য ফলেনি, কারণ এই এলাকায় দেবী আন্দোলনের প্রভাব হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী। সুরাট জেলার কালেক্টর এ. এম. ম্যাকমিলানের ১৯২২-২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে এই অঞ্চলে, বিশেষত চোধ্রী (Chodhri) আদিবাসী-অধুষিত এলাকায়, দেবীর প্রভাব তখনও বজায় ছিল। এখানে মদ আর তাড়ি খাওয়া অনেকখানিই বন্ধ হয়েছিল, আর সেইসঙ্গে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থার ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য উন্নতি। জনসাধারণের দাবিতে ম্যাকমিলান সাহেব মাণ্ডবী তালুকে তেরোটি, বারদোলি তালুকে একটি, এবং ভালোড় মহলে একটি মদের দোকান বন্ধ করে দেন।৪ এর পরের বছরের রিপোর্টে তিনি লেখেন:
আন্দোলন চালু থাকায় মাণ্ডবীর চৌধ্রা [চোধ্রী-অধ্যুষিত] এলাকাগুলি স্পষ্টতই উপকৃত হয়েছে। রাজস্বের কিস্তি মেটানোর জন্য লোকজনকে সাহুকারদের কাছে ধার করতে হয়নি—যা আগে সবসময়েই তাদের করতে হত, বছরটা ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন। উৎসব-অনুষ্ঠানের খরচাপাতি তারা কমিয়ে দিয়েছে, ফলে তাদের এর জন্য সাহুকারদের কাছ থেকে আগাম নেওয়ারও প্রয়োজন হয়নি। তাদের চেহারার স্পষ্টতই উন্নতি হয়েছে, যেমন হয়েছে তাদের ঘরদোর এবং গ্রামেরও। রান্নার জন্য পিতলের বাসনপত্র এখন তারা কিনতে পারছে, বউকেও কিনে দিতে পারছে ভাল কাপড়চোপড় এবং গয়নাগাঁটি।৫
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার ভারতবর্ষের অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী আন্দোলনের সঙ্গে দক্ষিণ গুজরাটের এই দেবী আন্দোলনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মোটের উপর এই আন্দোলনগুলি পণ্ডিতদের মনোযোগ বিশেষ আকর্ষণ করতে পারেনি। প্রধান ব্যতিক্রম অবশ্য বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলের ওরাওঁদের মধ্যে ১৯১৪ সালের টানা ভগৎ আন্দোলন, দেবী আন্দোলনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে যার সাদৃশ্য চমকপ্রদ।৬ সারা ভারতবর্ষের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে এই ধরনের আরও আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া গেছে। পূর্ব তথা উত্তর-পূর্ব গুজরাট৭ এবং উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রের৮ ভিলদের মধ্যে এই ধরনের আন্দোলন দেখা গেছে। দেখা গেছে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের খোন্দ৯, বিহারের ওরাওঁ, সাঁওতাল ও ভূমিজ১০, এবং উড়িষ্যার গোন্দ১১ উপজাতির মধ্যেও। মোটামুটি একই ধরনের কার্যসূচি সম্বলিত বিভিন্ন আন্দোলনের এক মিলিত জোয়ার আশ্চর্যরকম দ্রুততা ও শক্তির সঙ্গে এই এলাকার আদিবাসী গ্রামগুলিকে গ্রাস করেছিল। আন্দোলনের চেহারা ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ, এবং বহুক্ষেত্রে তার প্রভাব হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী। এছাড়া ছিল অসংখ্য সহিংস আদিবাসী আন্দোলন, যেমন বিরসা মুণ্ডার বিদ্রোহ, যাতে স্থান পেয়েছিল সমাজসংস্কারের কর্মসূচি।১২
এই ধরনের আন্দোলনগুলিকে আরও ভাল করে বোঝার উদ্দেশ্যে এই প্রবন্ধে আমি দেবী আন্দোলন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করব। আলোচ্য বিষয়গুলি হল, পর্যায়ক্রমে, সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি, আন্দোলনের যথাযথ ইতিহাস, এবং আদিবাসীদের গৃহীত সংস্কারসূচির নিহিতার্থ ও তাৎপর্য।
২
যাদের জীবন এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু, সেই আদিবাসীদের অধিকাংশই বাস করত ‘রানিমহল’ নামে পরিচিত দক্ষিণ গুজরাটের এক জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায়। রানিমহল মোটামুটি সমতল এলাকা; সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণীর খাড়া পাহাড়গুলি দাঁড়িয়ে আছে এর পূর্বসীমানার উপর। উনিশ শতকের গোড়ায় রানিমহলের অধিকাংশই ছিল জঙ্গলে ছাওয়া। অবশ্য এই এলাকার গাছপালা কেটে ফেলে মাঠ বানানো হয়েছিল এই শতকের মধ্যেই। ১৯২০ সাল নাগাদ ঘন জঙ্গল বলতে আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা এই এলাকার উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রানিমহলের মাটি ছিল উর্বর, আর বৃষ্টিপাতও হত প্রচুর, ফলে একবার চাষের আওতায় এলে একই জমি থেকে বছরের পর বছর ভাল ফসল পাওয়া যেত।
‘কালিপরজ’ নামে পরিচিত প্রধান উপজাতিগুলি ছিল চোধ্রী (Chodhri), গমিৎ (Gamit), ধোড়িয়া (Dhodiya) আর কোঙ্কনী (Konkani)। এছাড়া নায়েক (Naikas), কোতওয়ালিয়া (Kotvaliya) আর কাঠোড়িয়ার (Kathodiya) মতো ছোটখাটো উপজাতিও ছিল। রানিমহলের যে অঞ্চলগুলিতে প্রধান চারটি উপজাতি বাস করত সেগুলি ছিল পরস্পরসংলগ্ন, এমন কী এক এলাকা আর-একটিতে উপচে পড়েছিল অনেকখানি। চোধ্রীদের বাস ছিল প্রধানত মাণ্ডবী, ভালোড়, ভিয়ারা আর মাহুবা (Mahuva) তালুকে। গমিৎরা আস্তানা গেড়েছিল ভিয়ারা আর সোনগড় তালুকে, আর পশ্চিম খান্দেশে। ধোড়িয়ারা থাকত দক্ষিণের দিকে, মাহুবা, পশ্চিম ভাঁসদা (Vansda), চিখ্লি (Chikhli), পূর্ব ভালসাদ (Valsad), পশ্চিম ধরমপুর আর পার্দিতে (Pardi)। আর কোঙ্কনীরা ছড়িয়ে পড়েছিল রানিমহল ছাড়িয়ে সহ্যাদ্রি পর্বতমালায়—ভাঁসদা, ধরমপুর, দাং (Dang), সুরগনা (Surgana) আর নাসিক জেলায় বাসা বেঁধেছিল তারা। পশ্চিম ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে যারা বৃহত্তম, সেই ভিলদের রানিমহলে খুঁজে পাওয়া যেত না বিশেষ; তাদের এলাকা শুরু হয়েছিল বাজপুর (Vajpur) আর রাজপিপলা (Rajpipla) রাজ্য থেকে। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল দাং—যেখানে প্রভুত্বকারী গোষ্ঠীনেতারা ছিল ভিল, আর চাষিদের অধিকাংশই কোঙ্কনী। ভিলদের সঙ্গে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির কৃষ্টিগত তফাৎ ছিল অনেক; শেষোক্তদের কোনওমতেই এই প্রধান উপজাতিটির প্রশাখা বলা চলত না।
রানিমহলের আদিবাসীদের অধিকাংশই ছিল স্থায়ী কৃষক, যারা থাকত ছোট ছোট গ্রামে বা ‘ফলিয়ায়’ (faliya)। রাজস্ব আদায়ের একক হিসেবে পরিগণিত হত যে গ্রাম, তা গঠিত হত বেশ কয়েকটি ‘ফলিয়া’ নিয়ে। কারিগর বা অন্যান্য বিশেষ জীবিকানির্বাহী জাতির অস্তিত্ব না থাকায় এইসব গ্রামের কোনও নাভিকেন্দ্র ছিল না। এদিক থেকে বিচার করলে, ব্রাহ্মণ পুরোহিত, আধিপত্যশালী জাতি, অধস্তন শ্রমজীবী জাতি, বানিয়া দোকানদার, কারিগর জাতি আর অস্পৃশ্যদের স্তরবিন্যাস নিয়ে গড়ে-ওঠা তথাকথিত ‘সনাতন’ ভারতীয় গ্রামের সঙ্গে এইসব আদিবাসী গ্রামের বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। অধিকাংশ আদিবাসী ফলিয়ার সদস্যই ছিল একই উপজাতির লোক। হয় তারা ছিল নিজেরাই জমির মালিক, অথবা তারা জমি ভাড়া খাটাত, এবং সাধারণত তাদের নিজস্ব চাষবাসের সরঞ্জাম আর হালটানার বলদ থাকত।
আদিবাসী গ্রামের উদাহরণ হিসেবে মাণ্ডবী তালুকের সাতভাও (Sathvav)-কে বেছে নেওয়া যেতে পারে। তিরিশের দশকের প্রথমদিকে সমাজতত্ত্ববিদ বি. এইচ. মেহ্তা এই গ্রামটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করেন।১৩ সেই সময়ে সাতভাও-এর জনসংখ্যা ছিল ৫৮৮, যা ১১৪টি পরিবারে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ১০৬টি ছিল চোধ্রী আদিবাসী পরিবার, ৪টি ভিল, ২টি অস্পৃশ্য ঢের (Dhed) জাতের এবং ২টি পারসি। প্রত্যেক পরিবার কি পরিমাণ জমির মালিক ছিল এবং/অথবা কতটা জমি ভাড়া খাটাত সে সম্পর্কে মেহ্তার সংগৃহীত তথ্য থেকে নীচের সারণীটি তৈরি করা সম্ভব:
অধিকৃত জমির পরিমাণ (একর হিসেবে) পরিবারের সর্বমোট সংখ্যা পরিবারের শতাংশ
শূন্য ২১ ১৮
৫-এর কম ২১ ১৮
৫ থেকে ১০ ১৪ ১২
১০ থেকে ২০ ৩৪ ৩০
২০ থেকে ৩০ ১২ ১১
৩০ থেকে ৪০ ৫ ৪
৪০ থেকে ৫০ ৩ ৩
৫০-এর বেশি ৪ ৪
মোট ১১৪ ১০০
সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ছিল এক পারসি, যার দখলে ছিল ১০৮ একর জমি। তিনজন চোধ্রী যথাক্রমে ৬৪, ৬০ এবং ৫২ একর জমির মালিক ছিল। মেহ্তার মতে একটি পরিবারের উপযুক্ত ভরণপোষণ যোগানোর জন্য দরকার তো অন্তত কুড়ি একর জমি।১৪ এর চেয়ে কম জমির মালিক অথবা একেবারেই ভূমিহীন ছিল ৮৮টি (৭৭ শতাংশ) পরিবার। সুতরাং সাতভাওয়ের আদিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ যে বেশ দারিদ্রের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিল, এমন মনে করাটা অযৌক্তিক হবে না। এবং এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে, শুধু যে তারা দরিদ্র ছিল তাইই নয়, তিরিশের দশকের মধ্যেই গ্রামগুলিতে বৈষম্য ছড়িয়ে পড়েছিল ভালভাবেই। অবশ্য যেখানে অসংখ্য চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক উচ্চবর্ণের ভূম্যধিকারীদের হয়ে কাজ করত, দক্ষিণ গুজরাটের সেই আদিবাসীহীন গ্রামগুলির তুলনায় আলোচ্য আদিবাসী গ্রামগুলিতে বৈষম্যের তীব্রতা ছিল অনেক কম।
এইসব বৈষম্য সত্ত্বেও এক আদিবাসী আর এক আদিবাসীকে শোষণ করত সামান্যই। শোষণ তার চরমতম রূপ পরিগ্রহ করেছিল উচ্চবর্ণের মহাজন এবং পারসি সুরা-ব্যবসায়ীদের হাতে। বলপূর্বক শ্রম আদায় ছাড়াও বিভিন্ন আইনসম্মত ও বেআইনি কর আরোপ করার মাধ্যমে আদিবাসী শ্রমশক্তি শোষণের কাজে যোগ দিয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র। পুলিশ, এবং রাজস্ব, আবগারি ও বনবিভাগের অফিসাররা প্রত্যেকেই এতে ভাগ বসাত। মহাজনদের অধিকাংশই ছিল বানিয়া, পারসি আর ব্রাহ্মণ। বানিয়া আর ব্রাহ্মণরা থাকত তালুকের সদর শহরগুলিতে। তারা টাকা ধার দিত হয় তাদের শহরের বাড়ি থেকে, অথবা সাপ্তাহিক হাট থেকে, যেগুলি বসত সমগ্র আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন জায়গায়। যারা মহাজনী কারবার এবং মদের ব্যবসা দুইই একসঙ্গে চালাত, সেই পারসির সাধারণত থাকত বড় বড় আদিবাসী গ্রামগুলিতে। এই সব গ্রামে তাদের মদ বিক্রি করার একচেটিয়া অধিকার ছিল। মাণ্ডবী তালুকের ১৩৫টি গ্রামে ১৩টি, অর্থাৎ গড়পড়তা প্রতি দশটি গ্রামপিছু একটি মদের দোকান ছিল। এই তথ্য থেকে গ্রামবাসী পারসিদের সংখ্যা ও তাদের প্রভাব সম্বন্ধে খানিক ধারণা করা যায়। প্রায়ই তারা একাধিক গ্রামে জমির মালিকানা ভোগ করত। বিশ শতকের গোড়ার দিকের মধ্যেই তাদের কেউ কেউ বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়, এবং স্থানীয় গোমস্তাদের হাতে এগুলির ব্যবস্থাপনার ভার ছেড়ে দিয়ে শহরে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু ছোটখাটো পারসি ভূস্বামীদের অনেকে আদিবাসী গ্রামগুলিতেই থেকে যায়। আদিবাসীদের খড়ে-ছাওয়া মাটির কুঁড়ের পাশাপাশি এদের বাড়ি হত দোতলা, ইঁট আর টালির তৈরি। সারা বছর ধরে এরা মদ আর তাড়ি ধার দিয়ে যেত, আর ফসল কাটার সময় আদায়ীকৃত শস্যের হিসেবে বহুগুণ বর্ধিত হারে ফিরে পেত তাদের দাম। ভূমিহীন আদিবাসীরা তাদের ধার শোধ দিত পারসিদের ক্ষেতে গায়ে খেটে।১৫ আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পারসিরা যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করত তার অসংখ্য বিবরণ মেলে।১৬ শ্রম আদায় করা ছাড়াও, যৌন উদ্দেশ্যে আদিবাসী মেয়েদের অপব্যবহার করা হত।১৭ গরিব আদিবাসীরা সবসময়েই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। যে কোনও প্রতিবাদকে চটপট উত্তম-মধ্যম দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিত পারসি মালিক নিজে অথবা তার পোষা গুণ্ডাবাহিনী। স্থানীয় সরকারি কর্মচারি এবং পুলিশ সবসময়েই পারসিদের পক্ষই অবলম্বন করত।
পারসিদের হাত শক্ত করেছিল মদব্যবসা সংক্রান্ত সরকারি আইনকানুনও, যার মধ্যে মুখ্য ছিল ১৮৭৮ সালের বোম্বাই আবগারি আইন। ওই বছরের আগে মদ চোলাই এবং বিক্রি করার অধিকার ইজারা-বিলি করা মদের উপর শুল্কও ছিল কম। মদ (যা গুজরাটে ‘দারু’ নামে পরিচিত) চোলাই করা হত গ্রামে, আর এর প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হত ‘ম্হৌরা’ (mhowra) গাছের শর্করাসমৃদ্ধ ফুল। তাড়ি ছিল গেঁজে-ওঠা তালের রস, যা প্রায় বিয়ারের মতোই কড়া। যেসব তালগাছের রস থেকে তাড়ি বানানো হত সেগুলির উপর সামান্য শুল্কের মাধ্যমে এর উপর কর আরোপ করা হয়েছিল। দারু এবং তাড়ি, উভয়ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকায় এই ব্যবস্থা ব্রিটিশদের পছন্দসই ছিল না। ১৮৭৮ সালের আইন স্থানীয় ভিত্তিতে মদ উৎপাদন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পর কেবল জেলা সদরগুলিতে একটি করে কেন্দ্রীয় ভাটিখানা চালু রাখার অনুমতি দেয়। এই কেন্দ্রীয় ভাটিখানাগুলি চালাত জেলার একচেটিয়া ব্যবসাদারেরা, যাদের ফি বছর সরকারকে মোটা টাকা দিতে হত। কেন্দ্রীয় শুল্কব্যবস্থার আয়ত্তাধীন এই মদ যারা গ্রামে বিক্রি করত, পরওয়ানা বাবদ তাদেরও ফি বছর সরকারকে দিতে হত নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। তাড়ির সঙ্গে দামের তারতম্যহেতু এই নতুন মহার্ঘ্য মদের ক্রয়যোগ্যতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকায় তালগাছগুলির উপর কর প্রচুর বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আরও নিখুঁতভাবে গাছগুলিকে তালিকাভুক্ত করা হয়।১৮
এমন নতুন ব্যবস্থায় আবগারি রাজস্বের যে বিপুল বৃদ্ধি হয়েছিল তা নীচের সারণী থেকেই স্পষ্ট হবে। বাঁ-দিকের স্তম্ভে প্রদত্ত সংখ্যাগুলির মাধ্যমে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির সর্বমোট রাজস্বের শতাংশকে বোঝানো হয়েছে। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ভূমিরাজস্বের যে অনুরূপ শতাংশের হিসেব এই সারণীতে দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে একই সময়সীমার নিরিখে আগের সংখ্যাগুলির তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে।১৯
বছর আবগারি ভূমিরাজস্ব
১৮৬৫-৬৬ ৪.৪ ৪০.৩
১৮৭৫-৭৬ ৪.২ ৩৮.৮
১৮৮৫-৮৬ ৮.২ ৩৮.৭
১৮৯৫-৯৬ ৭.৭ ৩৪.৭
১৯০৫-০৬ ৮.৯ ২৪.২
১৯১৫-১৬ ১৩.৭ ৩১.৪
১৯২৫-২৬ ২৯.৩ ৩৮.১
আলোচ্য সময়সীমার মধ্যে একটি জেলায় (সুরাট) দেশি মদ ও তাড়ির উপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তা নীচে টাকার অঙ্কের হিসেবে দেখানো হয়েছে।২০
রাজস্ব বছর রাজস্ব (টাকার অঙ্কে)
১৮৭৭-৭৮ ৩,৭০,৪২৩
১৮৮৫-৮৬ ৭,৯৪,২২১
১৮৯৫-৯৬ ১১,৬৪,৫৮৫
১৯০৫-০৬ ১১,৬৭,৭১৮
১৯১৫-১৬ ১৭,৪৪,৮৬৭
১৯২৫-২৬ ৩৪,৩৬,২৯১
সুরাট জেলায় এই শুল্কবৃদ্ধির ভার নিচুজাতের লোকেদের, বিশেষত আদিবাসীদেরই বহন করতে হয়েছিল। এই নতুন ব্যবস্থার মুনাফা ভালভাবেই লুটেছিল মদবিক্রেতারা। তাদের মদ চোলাইয়ের অধিকার চলে গেলেও, গ্রামকে গ্রাম জুড়ে কারখানায়-তৈরি মদ বিক্রি করার একচেটিয়া অধিকার ছিল। গ্রামে বাস করার দরুন মদবিক্রেতারা বেআইনি মদচোলাইয়ের বেশির ভাগটাই রুখতে পেরেছিল। কারখানায় তৈরি চড়াদামের মদের উপর লাভ করা হত ওজনে মেরে, জল মিশিয়ে বা চড়া সুদে এই মদ ধার দিয়ে। দোকানদারেরা ঠগবাজি আর জুলুমের মাধ্যমে তাদের পকেট ভারি করত, আর আবগারি বিভাগের কর্মচারীদের ঘুষ দেওয়া হত এ ব্যাপারে নাক না গলানোর জন্য।২১ ১৯২৩ সালে বোম্বাই আবগারি কমিটির কাছে দেওয়া সুরাটের হরিভাই দেশাই-এর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে কোনও মদের দোকান পরিদর্শনে যাবার আগে আবগারি অফিসাররা বেশ ভালরকমই আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখত। দোকানদারেরা প্রায়ই অফিসারদের টাকা ধার দিত এবং অন্যান্যভাবেও তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করত। দেশাই আরও বলেন:
বস্তুত বর্তমান ব্যবস্থায় একজন মদের দোকানি গ্রামের একজন অধিকর্তাবিশেষ, আগে যেখানে তাকে থাকতে হত ‘পারিয়া’ হিসেবে। সত্যিকথা বলতে কি, আমার দেখা অনেক গ্রামেই আবগারি দোকানদাররাই একমাত্র পয়সাওয়ালা লোক। আর্থিক স্বাচ্ছল্য আর সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ, এই দুইয়ে মিলে তাদের গ্রামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি বিপজ্জনক শক্তিতে পরিণত করেছে। তারাই ঝগড়া বাধায়, আবার মেটায়, আর সরকারি প্রশ্রয় এবং অনুগ্রহের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অনেক মানী লোকের সম্মান নষ্ট করতেও দ্বিধা করে না। এইসব দোকানদারদের সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল।২২
মহাজনী কারবার এবং মদের ব্যবসা থেকে লব্ধ মুনাফার অনেকটাই জমিতে বিনিয়োগ করা হত। ১৮৬০-এর দশকের ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তগুলির আগে পর্যন্ত আদিবাসীরা তাদের চিরাচরিত রীতি অনুসারেই জমি ব্যবহার করত, অর্থাৎ কৃষিযোগ্য জমির সন্ধানে তারা প্রত্যেক বছরই সরে যেত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে আলাদা আলাদা জমির মালিক হিসেবে ভাবার রেওয়াজ তাদের মধ্যে ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০-এর দশকে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী কৃষকরা যে জমি চাষ করত, সেই জমির মালিকানাস্বত্ব তাদের দেওয়া হয়, এবং জমি এই প্রথম একটি বিপণনযোগ্য পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু আদিবাসীদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি না থাকায় এবং তারা তুলনামূলকভাবে বশংবদ হওয়ায় (কারণ নিজেদের জমিকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অতীতে তাদের কোনওদিনই ছিল না) মহাজন এবং মদব্যবসায়ীরা শীঘ্রই তাদের মালিকানাস্বত্ব থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করে। স্বভাবভীরু হওয়ার ফলে আদিবাসীদের এই রূপান্তর হয়েছিল অত্যন্ত অনায়াসসাধ্য।
সুতরাং জমির উপর মালিকানাস্বত্বের আবির্ভাব এবং সুরাসংক্রান্ত আইনকানুন এই নতুন শোষণব্যবস্থার ভিত গড়ে দিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে বরোদা এবং তার সংলগ্ন নৃপতিশাসিত রাজ্যগুলি একই ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করার ফলে অবস্থা সেখানেও দাঁড়ায় প্রায় একই রকম। আদিবাসীদের উপর তাঁদের শাসনের ভয়ঙ্কর প্রভাব খুব তাড়াতাড়িই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, কিন্তু এই ব্যবস্থার যাথার্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে তাঁরা আদিবাসী কৃষকদের কল্পিত নৈতিক ভ্রষ্টতার উপরই দোষ চাপান। বিশেষভাবে তাঁরা দায়ী করেন আদিবাসীদের সুরাসক্তিকে। মাণ্ডবী তালুকের চোধ্রীদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১৮৮১ সালে সুরাট জেলার এক ডেপুটি কালেক্টর মন্তব্য করেন:
এইসব কালিপরজরা সুরার প্রতি বেশ ভালরকমই আসক্ত। সত্যি বলতে কি, [মাণ্ডবী তালুকে] যে আবগারি শুল্কের মোট পরিমাণ পঁচিশ হাজার টাকারও বেশি, তার বেশির ভাগটাই ওঠে এদের কাছ থেকেই। মদের পিছনে খরচের অর্ধেকটাও যদি এরা জমিতে খাটাত অথবা চাষবাসের উন্নতমানের সরঞ্জাম কেনার জন্য ব্যয় করত তাহলে এদের অবস্থা আস্তে আস্তে ফিরে যেত। সে জায়গায়, সাহুকারদের ধার মেটাতে এখন তাদের চাল ইত্যাদি ভাল ভাল শস্যের পুরোটাই দিয়ে দিতে হয়। তাদের নিজস্ব খোরাকের জন্য পড়ে থাকে কৌ দ্রা নাগ্লী আর অন্যান্য নিকৃষ্ট শস্য।২৩
মনে করা হয়েছিল যে এই সমস্যার সমাধান হবে আদিবাসীদের লেখাপড়া শেখানো যাতে তারা পানাহারের ব্যাপারে মিতাচার ও সংযমের সুফলগুলি বুঝতে শেখে। সুরাটের এক সহকারী কালেক্টরের ভাষায়, ‘যতদিন না তারা পর্যাপ্ত শিক্ষালাভ করছে এবং মিতাচারের নিয়মকানুন বোঝার মতো অবস্থায় পৌঁছচ্ছে, ততদিন কাল্পনিক দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র।’২৪ একই সুর শোনা যাচ্ছে সাত বছর পর, আরেক সহকারী কালেক্টরের লেখাতেও:
এটা আদৌ অত্যুক্তি নয় যে একজন গড়পড়তা চোধ্রা (আদিবাসী) দশের উপর গুনতে জানে না, এবং স্কুলকে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতিয়ার ভেবে ঘৃণা করে। তবে শত প্রচেষ্টাতেও তাকে কিছুই শেখানো যায় না—এমন ধারণাটা যে ভুল তা ভালোড়-এর দৃষ্টান্তই প্রমাণ করে। মাণ্ডবীর তুলনায় এই এলাকা [সরকারি] নজর পেয়েছে বেশি। এই মহলটিতে শুধুমাত্র চোধ্রাদের জন্যই নির্দিষ্ট দুই বা তিনটি স্কুল রয়েছে, এমনকি দু-তিনজন চোধ্রা স্কুলশিক্ষকও আছেন। আমি লক্ষ্য করেছি যে যেসব গ্রামে স্কুল রয়েছে, একমাত্র সেগুলিতেই এমন চোধ্রাদের খুঁজে পাওয়া যাবে যারা পাকা বাড়িতে বাস করে, কোদ্রা এবং নাগলী-র থেকে ভাল খাবার জোটাতে পারে, গ্রীষ্মের কথা ভেবে আগাম জমিয়ে রাখে গবাদি পশুর খাবার, এবং জানে যে পাওনা আদায়ের অজুহাতে হাল-বলদ কেড়ে নেওয়াটা বেআইনি।২৫
এইভাবে ঔপনিবেশিক সরকারের চোখে শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় আদিবাসী দারিদ্রের সর্বরোগহর উপশমক।
আদিবাসী গ্রামগুলিতে প্রাথমিক স্কুল খোলা হয়েছিল। এই পরীক্ষা বড় একটা সফল হয়নি। উচ্চবর্ণের শিক্ষকরা দূরবর্তী আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে কাজ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, এবং খুব কমসংখ্যক আদিবাসীই ছিল শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা শিক্ষার উন্নয়নে আদৌ আগ্রহী। অনেকেই বিশ্বাস করত যে স্কুলে-পড়া ছেলেরা অল্পবয়সে মারা যায়।২৬ স্কুলগুলিতে উপস্থিতির হার ছিল খুবই নগণ্য এবং বেশ কয়েকটিকে তো বন্ধই করে দিতে হয়েছিল। পরিস্থিতি অবশ্য সম্পূর্ণ নৈরাশ্যজনক ছিল না, কারণ বরোদা রাজ্য আদিবাসী প্রশিক্ষণে ছোটমাপের কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল। ১৮৮৫ সালে রানিমহল পর্যটনের পর সয়াজীরাও গাইকোয়াড় আদিবাসী ছাত্রদের জন্য সোনগড়ে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণের আদেশ দেন, যাতে তারা শহরের প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার জন্য তাদের পূর্ণ সময় নিয়োজিত করতে পারে। প্রথম প্রথম আবাসিক খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর। কিন্তু এর প্রথম সুপারিন্টেন্টে ফতেহ্খান পাঠান ছিলেন সাফল্য অর্জনে বদ্ধপরিকর, এবং তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছাত্রসংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাঁর দর্শনমাত্রেই আদিবাসীরা জঙ্গলে পালিয়ে যেত। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় যখন ফতেহ্খান গমিৎ সম্প্রদায়ের এক চাঁইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁর দুই ছেলেকে সোনগড়ের ছাত্রাবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদের একজন, অমর সিং গমিৎ, পরে একজন অগ্রণী সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিত হন।২৭ ১৯০০ সালের মধ্যে এই ছাত্রাবাসের আবাসিকসংখ্যা সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এর আদিবাসী আবাসিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতিবছরই সপ্তম স্ট্যান্ডার্ডের গুজরাটি পরীক্ষায় পাশ করে শিক্ষকতার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে মাণ্ডবী তালুকে একটি অনুরূপ ছাত্রাবাস খুলতে মনস্থ করে। গড়সাম্বা (Godsamba) বোর্ডিং হাউস নামে পরিচিত এই আবাসটিতে সারা সুরাট জেলা থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে। এই হস্টেল থেকে পাশ-করা ছাত্রদের অনেকেই পরে রানিমহলের আদিবাসী সমাজ সংস্কারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।
এই সমাজসংস্কারকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন সোনগড়ের প্রাক্তন ছাত্র অমর সিং গমিৎ (১৮৭৩-১৯৪১)। ১৯০৫ সালে ফতেহ্খান পাঠানের সঙ্গে তিনি ভিয়ারা তালুকে তাঁর নিজস্ব গ্রামে একটি আদিবাসী সম্মিলনের আয়োজন করেন। এখানে আদিবাসীদের মদ্যপান ও কুসংস্কারভিত্তিক আচারপালন ছেড়ে দিতে, লেখাপড়া শিখতে, এবং মহাজনদের ঋণের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে উৎসাহিত করে কয়েকটি প্রস্তাবও পাশ করা হয়।২৮ এর পরের কয়েকবছর অমর সিং গমিৎ গ্রামে গ্রামে ঘুরে আদিবাসীদের জীবনাচরণের বিধিগুলি পালটাতে উৎসাহিত করেন। তাদের মধ্যে রোজ স্নান করা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা এবং অসুস্থতার সময় ওঝা-ঝাড়ফুঁকের পরিবর্তে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সাহায্য নেওয়ার প্রথা তিনি প্রচলন করতে চেয়েছিলেন।২৯ একইসঙ্গে তিনি প্রচার অভিযান চালান রতনজী দাবু নামে এক বড় পারসি জমিদারের বিরুদ্ধেও, যে খোলাখুলিভাবেই আদিবাসীদের শোষণ করে যাচ্ছিল। অমর সিং-এর এই অভিযান অবশ্য নিষ্কন্টক হয়নি, এবং এর সাফল্যও ছিল সীমিত।
ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত মাণ্ডবী তালুকে, গড়সাম্বা বোর্ডিং হাউসে শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণবয়স্ক চোধ্রীরা ‘ভজনমণ্ডলী’ নাম দিয়ে ছোট ছোট গানের দল গড়তে শুরু করে। এগুলির উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার সংক্রান্ত ধ্যানধারণার প্রসার। এর একজন চাঁই ছিলেন মারবাড়ী মাস্টার নামে এক চোধ্রী যিনি ১৯০৯ সালে গড়সাম্বা থেকে গুজরাটির ফাইন্যাল পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন মাণ্ডবী তালুকের এক গ্রামের কৃষক, প্রায় চল্লিশ একর জমির মালিক। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে মারবাড়ী ছিলেন মোটামুটি সম্পন্ন এক চোধ্রী পরিবারের প্রতিনিধি। পরে স্কুলশিক্ষক হয়ে তিনি মাণ্ডবী তালুকের বিভিন্ন গ্রামে পড়িয়েছিলেন। তিনি এবং গড়সাম্বার আরও কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র মিলে একটি গানের দল গড়ে তোলেন। ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে এরা ঘুরে বেড়াত। এইসব গানে সাধারণত মিতাচার ও আত্মনির্ভরতার গুণকীর্তন করা হত, আর বলা হত বিদেশী মহাজন আর পারসিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা। এমন একটি গান ছিল:
ও ভাইসকল! দারু বা তাড়ি খেওনা হে।
ও ভাইসকল! মদ খেলে যে লুটে নেবে পারসি তোমার জমিজিরেত।
তার কাছে যাও যদি তবে বিষয়-আশয় বেহাত হবে হে।
ও ভাইসকল! দারুর নেশা ছেড়ে দাও।
দারুর পিছে ছোটো যদি বানিয়া আর ঘাঁচী [তেলি] মিলে
তাবৎ বিষয় আশয় তোমার লুটে নেবে হে।৩০
গান শোনার জন্য লোকজন জমায়েত হলেই সংস্কারকরা এইসব বিষয়ের উপর চোধ্রী উপভাষায় বক্তৃতা দিতে শুরু করত।
এইভাবে বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে আদিবাসী তরুণরা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজসংস্কারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করে। বহুক্ষেত্রেই এরা আসত অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী আদিবাসী পরিবারগুলি থেকে, যাদের সঙ্গতি ছিল দু-একটি ছেলেকে চাষবাসের কাজ থেকে রেহাই দিয়ে স্কুলে পাঠানোর। বাইরের শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এমন এক ধরনের নেতৃত্ব এই পরিবারগুলি থেকেই উঠে এসেছিল। শিক্ষিত হওয়ার ফলে এইসব সমাজসংস্কারকেরা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সম্মান ভোগ করত, এবং তাদের কয়েকজনের উদ্যোগপ্রসূত কয়েকটি আন্দোলন দেবী আন্দোলনের পথ প্রস্তুত করেছিল। যেমন ১৯০৫ সালে সুরাট জেলার সহকারী কালেক্টর লেখেন:
এই বছরের গত দুমাস ধরে কালিপরজদের মধ্যে এক চমকপ্রদ ও ব্যাপক সুরাবর্জন আন্দোলন লক্ষ করা গেছে। এর সূত্রপাত হয় যখন বরোদার এক স্কুলমাস্টার বলে যে এক দেবতার কাছ থেকে সে উত্তেজক সুরা পানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে। এ-খবর প্রথম পৌঁছয় বালসারে (Bulsar) এবং সেখানে প্রচুর সংখ্যক নিষেধাজ্ঞাপক ইস্তাহার বিলি করা হয়। কোনও কোনও অনাভিল (Anavil) প্যাটেলও সোৎসাহে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। শোনা যায় অনেক গ্রামে ‘দেবতার’ রহস্যময় চিঠিপত্রও পাওয়া গেছে। বিরাট বিরাট জমায়েতে সম্মিলিত হয়ে কালিপরজরা সিদ্ধান্ত নেয় যে শেষবারের মতো এক বড়মাপের আমোদপ্রমোদের পর তারা মদ্যপান পুরোপুরি ছেড়ে দেবে। এখন পর্যন্ত তাদের এই শপথ তারা কঠোরভাবে পালন করে এসেছে। আবগারি রাজস্বহানির আশঙ্কায় ত্রস্ত সরকার প্রতিবেশী দেশীয় রাজ্যে এই মিতাচারীদের কড়া ধরনের হুমকি দিয়েছে। কিন্তু লোকজন জবাব দিয়েছে যে সরকারি আদেশের চেয়ে দেবতার আদেশ বড়, এবং মিতাচার তারা ছেড়ে দেয়নি। আমার মনে হয় এই আন্দোলন কোনওমতেই মদের চড়া দামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, এবং এর ভেতর রয়েছে এক নৈতিক ও ধর্মীয় চরিত্র।৩১
এর পরের বছর আন্দোলন ঝিমিয়ে আসার খবর আসে। অবশ্য এই সময় দেখা দেয় একই ধরনের আরও বেশ কয়েকটি আন্দোলন, যার দরুন ১৯২২ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে আন্দোলনের এক ঐতিহ্য।
৩
এইভাবে প্রস্তুত হয়েছিল দেবীর আগমনের পথ। অবশ্য এই আন্দোলন দক্ষিণ গুজরাটের রানিমহলে শুরু হয়নি, হয়েছিল বোম্বাই শহরের ঠিক উত্তরদিকে, বেসিনের উপকূলবর্তী গ্রামগুলিতে। এই আন্দোলনের উৎপত্তি অনথিবদ্ধ এবং ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আমার সমস্ত তথ্যই তাই সংগ্রহ করতে হয়েছে এই অঞ্চলের বৃদ্ধ জেলেদের সাক্ষাৎকার থেকে।৩২ মনে হয় ১৯২২-এর গোড়ার দিকে ‘মাঙ্গেলা কোলি’ জেলেদের মধ্যে এক গুটিবসন্তের মড়ক দেখা দেয়। এরা বিশ্বাস করেছিল যে এই মড়কের জন্য দায়ী এক দেবী, অতএব তাঁকে সন্তুষ্ট করা দরকার। এই সময়কার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঙ্গেলা কোলি মেয়েদের উপর এই দেবীর ভর হয়। ভরগ্রস্তাদের মাধ্যমে দেবী মাঙ্গেলা কোলিদের জানান যে তিনি খুশি হবেন একমাত্র তখনই, যদি তারা কিছুদিনের জন্য মাছমাংস এবং মদ বা তাড়ি খাওয়া ছেড়ে দেয়। মাঙ্গেলা কোলিরা এই আদেশ মেনে চলে। যেসব মেয়েদের উপর এই দেবীর ভর হয়েছিল তাদের নাম দেওয়া হয় ‘সলাহ বাই’, অর্থাৎ এমন মেয়ে (বাই) যারা পরামর্শ (সলা) দেয়। দেবীর সন্তোষবিধানের এই আন্দোলন উপকূলরেখা ধরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে উত্তরদিকে, থানা, দমন এবং সুরাট জেলার অন্যান্য ধীবর-অধ্যুষিত গ্রামে। দমন, পার্দি এবং ভালসাদ তালুকের উপকূলবর্তী গ্রামগুলি থেকে আবার তা ছড়িয়ে যায় ধোড়িয়া আদিবাসী-অধ্যুষিত অন্তবর্তী গ্রামগুলিতে। ইত্যবসরে দেবী নিজেই ‘সলাহ বাই’ নামে পরিচিতি পান, এবং নারী-পুরুষ উভয়েই ভরগ্রস্ত হতে শুরু করে। অবশ্য এই পর্যায়ে এই মাহাত্ম্যের প্রচারের গতি তুলনামূলকভাবে ধীর হয়ে আসে, কারণ ভর হওয়ার অনুষ্ঠানগুলি তখন হত লোকজনের বাড়িতে, স্বল্প উপস্থিতির ভিতর। তখনও এর উপর সরকারি কর্তৃপক্ষের নজর পড়েনি। ভালসাদ এবং পার্দি থেকে এই আন্দোলন পূর্বে ধরমপুর রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এবং কোঙ্কনী উপজাতির মধ্যে স্থিতি লাভ করে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমঘাটের গা বেয়ে সুরগনা রাজ্য এবং নাসিক জেলায় এবং একই সময়ে উত্তর-পূর্ব দাং-এ। শেষোক্ত জায়গায় এই আন্দোলন পোঁছয় ১৯২২ সালের অগস্ট মাস নাগাদ।৩৩
দাং অঞ্চলে এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটে। এতদিন পর্যন্ত আন্দোলনের সুর ছিল নিচু পর্দায় বাঁধা, এবং এর মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যাকে স্থানীয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গণ্য করা যেতে পারত। দাং অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে লোকেরা সংঘবদ্ধভাবে সভায় যোগ দিতে শুরু করে। ফলত বনবিভাগের কর্মচারীদের পক্ষে কাঠ-কাটা ও পরিবহণের জন্য শ্রমিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। আন্দোলনের সংগঠন আরও উন্নত হয়েছিল, কারণ দাঙ্গি ওঝারা—যারা ‘গৌলা’ (Gaula) নামেও পরিচিত ছিল—আন্দোলনকে নিয়ে যেত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। দাং-এর অনেক আদিবাসী মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ায় স্থানীয় পারসিরা চটপট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে তাদের বিক্রিবাটা এবং মুনাফা গুরুতরভাবে হ্রাস পেয়েছে। দাং অঞ্চল থেকে গৌলারা নিজেরাই এই আন্দোলনকে নিয়ে যায় উত্তর-পূর্বে খান্দেশে এবং উত্তর-পশ্চিমে সোনগড় তালুকে। দাঙ্গি গৌলারাই এই অঞ্চলগুলিতে প্রথম দেবীর সমাবেশ সংগঠিত করতে শুরু করে।৩৪ কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আন্দোলনকে নিজের থেকে ছড়ানোর সুযোগ দিয়ে তার সঙ্গে আসে। খান্দেশে যেসব অঞ্চলে গৌলারা গিয়েছিল তার বাইরে আন্দোলন বিস্তৃত হয়নি, কিন্তু দক্ষিণ গুজরাটের রানিমহলে এ আন্দোলন পশ্চিমমুখীভাবে আরব সাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল।
আন্দোলনকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে প্রসারিত করেছিল সেইসব লোকেরা যারা হয় দেবীর দ্বারা ইতিমধ্যেই আবিষ্ট হয়েছিল নয়তো দেবীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজেদের এলাকায়। দেবী যে আসছেন তা স্থানীয় আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই আঁচ করেছিল, কারণ এ ধরনের জনশ্রুতি কিছুকাল ধরেই ছড়াচ্ছিল। যখন কোনও সভা আহ্বান করা হত—সাধারণত কোনও গ্রামের নেতৃস্থানীয়দের দ্বারা—তখন আশপাশের পল্লীগুলি থেকে অনেকসংখ্যক মানুষ সেখানে জড়ো হত। একবার জমায়েত হলে যে কোনও পুরুষ বা স্ত্রীলোকই ভরগ্রস্ত হতে এবং দেবীর আদেশ উচ্চারণ করতে পারত। যাদের ভর হত তাদের অনেকেই ছিল সাধারণ চাষী। তাদের ভর হবার কোনও ব্যক্তিগত ইতিহাস ছিল না এবং পরে আর কখনওই তারা এইভাবে ভরগ্রস্ত হয়নি। সভাগুলি সাধারণত চলত বেশ কয়েকদিন ধরে, এবং অংশগ্রহণকারীরা হয় সভাস্থলেই থাকত অথবা প্রত্যেকদিন সকালে সমবেত হত। খাবার প্রলোভন এড়ানোর জন্য তারা তাদের মুরগি ও ছাগলগুলিকে ছেড়ে অথবা বিক্রি করে দিয়েছিল। এছাড়াও তারা প্রতিদিন স্নান করতে শুরু করে এবং যাতে এক ফোঁটাও দারু বা তাড়ি না ছুঁতে হয়, সেজন্য সতর্ক হয়। গোপনে ‘অপবিত্র’ অভ্যাসগুলি চালিয়ে যেতে গিয়ে অসংস্কৃত ব্যক্তিরা অলৌককভাবে দেবীর মাধ্যমদের দ্বারা উদঘাটিত হয়েছে এবং সর্বসমক্ষে তাদের অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, এরকম অসংখ্য ঘটনার কথা শোনা গিয়েছিল। সভাগুলির সমাপ্তি সূচনা করেছিল এক গণভোজ এবং দেবীবন্দনার এক চূড়ান্ত অনুষ্ঠান।
এটি ছিল একটি রীতিমতো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যাতে যে কোনও আদিবাসী ভর-হওয়ার ফলে কিছু সময়ের জন্য একজন উচ্চকর্তৃত্বসম্পন্ন ও সম্মানীয় নেতা হয়ে উঠতে পারত। সুতরাং কাঠামোর দিক থেকে দেবী আন্দোলন ঠিক ‘মেসায়ানিক’ আন্দোলন ছিল না।৩৫ ঈশ্বরের দ্বারা আবিষ্ট হওয়াই ছিল এই পর্যায়ে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। সারা দুনিয়ার দরিদ্র ও নিম্নবর্গের মানুষেরা তাদের সমষ্টিগত ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার জন্য প্রায়শই এই উপায়টিকেই বেছে নিয়েছে। আই. এম. লিউইস তাঁর দৈবাবেশ-সংক্রান্ত ধর্মাচরণ সম্পর্কে সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে যেসব উপজাতিরা গত শতাব্দীতে কঠিনতম ক্লেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল তাদের মধ্যেই প্রেবেশের বহিঃপ্রকাশের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।৩৬ এভাবেই তারা তাদের উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি খুঁজে পায়। ভারত প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রিচার্ড ল্যানয় বলেছেন যে ‘দৈবাবেশ কেবল বিশৃঙ্খল একটি মূর্ছারোগমাত্র নয়, বরং কাঠামোবদ্ধ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত রীতিবদ্ধ একটি ঘটনা যা সংস্কৃতি-সৃষ্টিকারী হতে পারে এবং ব্যক্তির ও দলের চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।’৩৭ ১৯২২-২৩-এর সলাহ বাই-সংক্রান্ত ঘটনাসমষ্টিকে এই শর্তের নিরিখেই বোঝা প্রয়োজন। দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী সাধারণের আকাঙ্ক্ষা ও তাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত অন্যায়ের ধারণাকে ব্যক্ত করতে সাহায্য করেছিল দৈবাদেশের তরঙ্গ।
৪
প্রেতমাধ্যমের সাহায্যে উচ্চারিত দেবীর প্রত্যাদেশগুলি এক জমায়েত থেকে আর এক জমায়েতে রীতিমতো ভিন্নরকমের চেহারা নিত—একটি বিক্ষিপ্ত সংগঠনহীন আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা প্রত্যাশিত। স্থানীয় পরিবেশ স্পষ্টতই এই প্রত্যাদেশগুলির কয়েকটিকে নির্দিষ্ট করেছিল। উদাহরণ হিসেবে, ভিয়ারা তালুকে দেবী আদিবাসীদের আদেশ দেন খ্রিস্টান না হবার জন্য।৩৮ ভিয়ারা ছিল মিশনারি কার্যকলাপের একটি কেন্দ্র। যাই হোক, এই সমস্ত রকমফেরের মধ্যেও আদেশগুলির একটি সারাৎসার শনাক্ত করা, এবং সেটিকে নীচের শীর্ষকগুলির মাধ্যমে শ্রেণীবিভক্ত করা সম্ভব:
১. মাদক(ক) সুরা বা তাড়ি খেয়ো না।
(খ) সুরা বা তাড়ির দোকানে কাজ কোরো না।
(গ) তাড়ি গাছ থেকে তাড়ি নিষ্কাশন কোরো না।
২. মাংস(ক) মাংস বা মাছ খেয়ো না।
(খ) (খাওয়া বা বলির জন্য রেখে দেওয়া) সমস্ত জ্যান্ত মুরগি, ছাগল ও ভেড়া বিক্রি করে দাও।
(গ) মাংস রান্নার সমস্ত পাত্রগুলি নষ্ট করে ফেল।
(ঘ) বাড়ির চালগুলি (আদিবাসী গ্রামে সাধারণত খড়ে-ছাওয়া) সরিয়ে ফেল এবং পুড়িয়ে দাও, কারণ মাংস রান্নার জন্য ব্যবহৃত আগুনের ধোঁয়া এই চালগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
৩. পরিচ্ছন্নতা(ক) প্রত্যেকদিন স্নান করো (কোনও কোনও ক্ষেত্রে দিনে দুবার বা তিনবার)।
(খ) মলত্যাগের পর শৌচকর্মের জন্য জল ব্যবহার করো।
(গ) বাডি ও উঠোনগুলি ঠিকঠাক পরিষ্কার রাখে।
৪. প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী(ক) পারসিদের বয়কট করে।
(খ) মুসলমানদের বয়কট করো।
(গ) সুব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এমন কারও জন্য কাজ কোরো না।
(ঘ) বেতনবৃদ্ধি দাবি করো।
(ঙ) কোনও পারসির ছায়া মাড়ালে স্নান করো।
এই আদেশগুলি আদিবাসীদের জীবনচর্চায় এক সার্বিক পরিবর্তন দাবি করেছিল। দারু ও তাড়ি খাওয়া ছিল এদের সংস্কতিরই এক সম্যক অঙ্গ। এই পানীয়গুলি মূল্যবান খাদ্যবস্তু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তো ছিলই—বিশেষত গ্রীষ্মকালে, যখন খাদ্যের ভাণ্ডারে টান পড়ত। উপরন্তু বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও এগুলি ব্যবহৃত হত এবং অনেক ধর্মীয় উৎসবে তথা বিবাহে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও অবাধে পান করা হত।৩৯ একই ভাবে আদিবাসী ক্রিয়াবিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বলি। বলির মাংস পরে খাওয়া হত। প্রাত্যহিক স্নানের প্রথা সেই সময়ে সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল না, কেননা আদিবাসী গ্রামগুলিতে জল সরবরাহের ব্যবস্থা প্রায়শই শুধুমাত্র জলপানের উদ্দেশ্যেও যথেষ্ট ছিল না। অতএব, অনুগামীদের জীবনযাত্রাকে সহজতর করে তোলাই দেবীর যাবতীয় আদেশের উদ্দেশ্য ছিল না। এগুলির অন্তর্নিহিত যুক্তিগুলিকে আমাদের আরও ভাল করে পরীক্ষা করা দরকার।
সেই সময় বেশ কিছু পর্যবেক্ষক একে দেখেছিলেন আদিবাসীদের ‘বিশুদ্ধীকরণ’ আন্দোলন হিসেবে। যেমন, গান্ধীবাদী নেতা সুমন্ত মেহতা একে আদিবাসীদের ‘আত্মশুদ্ধি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।৪০ দেখা যাচ্ছে যে এই উপলব্ধিকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে ‘সংস্কৃতায়ন’ প্রক্রিয়াটি, যাকে এম. এন. শ্রীনিবাস বর্ণনা করেছেন এইভাবে:
সংস্কৃতায়ন হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি ‘নিচু’ হিন্দু জাতি বা উপজাতি বা অন্য কোনও গোষ্ঠী তার লোকাচার, ক্রিয়াবিধি, মতাদর্শ ও জীবনচর্যাকে একটি উঁচু, এবং প্রায়শই ‘দ্বিজ’ জাতির আদলে পরিবর্তিত করে। বর্ণভিত্তিক স্তরকাঠামোয় ওই জাতির যে স্থান স্থানীয় সমাজের দ্বারা সনাতনভাবে স্বীকৃত। তার থেকে উচ্চতর স্থানের দাবি সাধারণত এই ধরনের পরিবর্তনের পরেই আসে। এই দাবির স্বীকৃতি পেতে লেগে যায় বেশ কিছু সময়, বলতে কি, দু-এক পুরুষও।৪১
এই প্রত্যয়টির নিরিখে ভারতীয় সমাজের গতিসূত্রগুলিকে সাপলুডো খেলার মতোই মন্থরতায় আক্রান্ত বলে দেখানো হয়েছে। এই খেলায় যোগদান করার সময় খেলুড়েরা থাকে অশুদ্ধ, এবং পুরুষানুক্রমে তারা ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতার পথে এগিয়ে যায়। এই অগ্রগতির পথে থাকে নানা খানাখন্দ, এবং বেশিরভাগ সম্প্রদায়ের পক্ষেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভবই হয় না। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অবশ্য অবিসংবাদিত: ‘সংস্কৃতায়নের ব্রাহ্মণ্য, এবং মোটের উপর শুদ্ধাচারনিষ্ঠ পথটিই এযাবৎ সার্বিক প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। এমনকি মাংসাশী এবং মদ্যপায়ী ক্ষত্রিয় তথা অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিও অন্যান্য পথের তুলনায় এই পথটির শ্রেষ্ঠত্বকেই পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে।’৪২
শ্রীনিবাস আরও বলেন, ‘সংস্কৃতায়ন শুধুমাত্র হিন্দু বর্ণগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিম ভারতের ভিল, মধ্যভারতের গোন্দ এবং ওরাওঁ এবং হিমালয়ের পাহাড়িদের মতো উপজাতি এবং আধা-উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যেও এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ করা যায়। এর ফলে সাধারণত যে উপজাতি সংস্কৃতায়নের সাহায্য নিচ্ছে তারা নিজেদের হিন্দু বর্ণপ্রথার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে।’৪৩ বলা যেতে পারে যে দেবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সুরাবর্জন, নিরামিষাহার এবং পরিচ্ছন্নতার মতো নব্য শুদ্ধাচারগুলি পালনের মাধ্যমে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসীরা শুদ্ধ বর্ণ হিসেবে হিন্দু বর্ণভিত্তিক সমাজকাঠামোর ভিতর অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাচ্ছিল। অতএব এই আন্দোলনকে আদিবাসী সমাজে সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার একটি নাটকীয় উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
অবশ্য এই প্রত্যয়টির ব্যবহারে কিছু অসুবিধা রয়েছে। শ্রীনিবাসের উপরোক্ত উক্তিটি ওরাওঁদের সম্বন্ধে। ওরাওঁ সমাজে সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে এস. সি. রায়ের উৎকৃষ্ট গ্রন্থটি পড়লে বোঝা যায় যে রায় নিজে এই ধরনের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেননি। তিনি লেখেন যে আর্য সমাজ প্রভৃতি হিন্দু সংস্কারক গোষ্ঠীগুলি ‘শুদ্ধি’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওরাওঁদের হিন্দু সমাজের আওতার মধ্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। কারণ রায়ের মতে, ‘আলোকপ্রাপ্ত ওরাওঁ নেতারা স্বভাবতই এই ধরনের প্রচারকদের এড়িয়ে চলত। কারণ তাদের ভয় ছিল (এবং এই ভয় আদৌ অমূলক ছিল না) যে দ্বিজ বর্ণগুলির ধর্মীয়-সামাজিক বিশেষ মর্যাদা নিয়ে গড়ে-ওঠা শাস্ত্রানুগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম বর্ণান্তরিত আদিবাসীদের স্থান দেবে হিন্দু বৰ্ণস্তর কাঠামোর একেবারে নীচে না হলেও বেশ নীচের দিকে।’৪৪ অন্যান্য তথ্যসূত্র থেকেও অনুমান করা যায় যে মোটের উপর আদিবাসীরা বর্ণস্তরকাঠামোয় কোনও স্থান দাবি করেনি। অবশ্য একথা সত্যি যে ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করেছে।৪৫ এই ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ক্ষত্রিয়রা মাংসাহার এবং সুরাপানের মতো ‘অপবিত্র’ ক্রিয়াকর্মের শরিক হয়েও উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষত্রিয়োচিত প্রতিষ্ঠার দাবিদার আদিবাসীরা চায় যে ‘অপবিত্র’ আচারবিধিতে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো হোক। কিন্তু সম্প্রতিকালে এই ধরনের উদাহরণগুলি ব্যতিক্রমী হয়ে দাঁড়িয়েছে।৪৬ দেবী আন্দোলনের মতো বিশুদ্ধিকরণ আন্দোলনগুলির কার্যপ্রণালীতে এসেছে পরিবর্তন। এই ধরনের আন্দোলনে আদিবাসীরা কিছু কিছু হিন্দু মূল্যবোধ গ্রহণ করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে বর্ণপ্রথায়। অন্তর্ভুক্তির দাবি থেকে বিরত থেকেছে। সুতরাং এই উদাহরণগুলি থেকে আদিবাসীরা যে বর্ণপ্রথাকে মেনে নিয়েছে, এমন মনে করে নেওয়াটা অযৌক্তিক হবে। বরং বলা যেতে পারে উচ্চবর্ণোচিত জীবনচর্যা গ্রহণের মাধ্যমে আদিবাসীরা উচ্চবর্ণের হিন্দুর সমমর্যাদার দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংস্কৃতায়ন তত্ত্বের আর একটি অসুবিধা হল এই যে, এই তত্ত্বে যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি সেই সংঘাতময় প্রক্রিয়ার উপর, যার মাধ্যমে এইসব দাবিদাওয়াকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে হয়। শ্রীনিবাসের তত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে লুই দুমঁ দেখিয়েছেন, যেসব নিম্নবর্গের বর্ণ বা উপজাতি তাদের জীবনচর্যায় সংস্কার নিয়ে আসে, তাদের পক্ষেও এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক সংস্থানকে উন্নত করা খুবই কঠিন। রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উচ্চবর্ণগুলির কাছ থেকে বলপূর্বক এই সংস্থান আদায় করে নিতে হয়। এইভাবে কোনও সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং বর্ণকাঠামোয় তাদের অবস্থান পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে পড়ে।৪৭ ফলত আদিবাসীদের পক্ষে উচ্চতর মর্যাদা বা সামাজিক সমস্থিতি দাবি করা বৃথা, যদি না একইসঙ্গে ক্ষমতাশালী সম্প্রদায়গুলির প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে তারা একটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। দেবীর আদেশগুলিকে বিশ্লেষণ করলে ঠিক এই জিনিসটিই চোখে পড়ে: এইজন্যই আদিবাসীরা উচ্চবর্ণোচিত মূল্যবোধ গ্রহণের কার্যসূচির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় প্রতিপত্তিশালী পারসি ভূস্বামী ও সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এক বয়কট আন্দোলন। প্রচলিত সমাজকাঠামোর উপর যে আক্রমণ এই ধরনের আন্দোলনের একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ, সংস্কৃতায়ণ তত্ত্বে তাকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র ‘বিশুদ্ধীকরণের’ দিকটির উপরেই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়াও, কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক মাত্রা এই তত্ত্বে অনুপস্থিত। এতে মনে করা হয়েছে যে অনন্তকাল সবাই শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতার লক্ষমাত্রায় পৌঁছানোর জন্যই চেষ্টা করে যাবে। শ্রীনিবাসের কথায়, ‘…সংস্কৃতায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত যে সচলতা, তা প্রচলিত সমাজে শুধুমাত্র অবস্থিতিগত পরিবর্তন নিয়ে আসে, অবয়বগত পরিবর্তন নয়। অর্থাৎ একটি বর্ণ তার প্রতিবেশী বর্ণদের উপরে উঠে যায়, এবং আর একটি নেমে আসে; কিন্তু এই সমস্ত কিছুই ঘটতে থাকে একটি মূলত দৃঢ়বদ্ধ স্তরবিভাজিত সমাজকাঠামোর মধ্যে। এই সার্বিক প্রথার কোনও পরিবর্তন হয় না।’৪৮ আমাদের পূর্বব্যবহৃত রূপকের নিরিখে বলা যায় যে সাপলুডো খেলা চলতে থাকে, কিন্তু এই খেলার ছক কখনওই পালটায় না। অথবা বিকল্প ঐতিহাসিক এবং দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে যে-কোনও সমাজব্যবস্থাই তার পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থাগুলি থেকে উদ্ভূত এক সংশ্লেষ। আদিবাসী ও হিন্দুসমাজের বহু বছরব্যাপী মিথস্ক্রিয়ার থেকে জন্ম নেয় এমন এক নতুন সংশ্লেষ যা পুরোপুরি উপজাতীয় বা বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ্য, কোনওটিই নয়। দেবী আন্দোলনের মতো আন্দোলনগুলি তাদের বিশিষ্টতা লাভ করে এমন এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের প্রেক্ষিতে, যখন উপজাতীয় এবং অনুপজাতীয় উপাদানগুলির তীব্র বৈপরীত্য সংশ্লেষের প্রয়োজনকে জোরালো করে তোলে।
তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে এই ধরনের আদিবাসী আন্দোলনগুলি ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। আজ পর্যন্ত এগুলি চলে আসছে। অতীতে আদিবাসীরা ভারতীয় জনজীবনের মূলস্রোতটি থেকে নিজেদের অনেকখানিই বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছিল। অনুপজাতীয় উচ্চবর্গের মুল্যবোধগুলি তারা আত্তীকৃত করবে এমন আশা করা হত না, এবং সেরকম করার কোনও পার্থিব তাগিদও তাদের ছিল না। আত্তীকরণ কখনও-সখনও ঘটলেও তা হত অতিমাত্রায় আংশিক, অথবা তা প্রভাবিত করত আদিবাসীদের একটি ক্ষুদ্রাকার উচ্চবর্গকে, যারা ‘রাজপুত’ ইত্যাদি প্রতিপত্তিসূচক উপাধি গ্রহণ করে স্বীয় সম্প্রদায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখত। এই অবস্থার পরিবর্তন আসে উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ, যখন ব্রিটিশরা আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিজয় ও বশীভূত করতে সমর্থ হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ঔপনিবেশিক আইন বলবৎ হয়, এবং আদিবাসী অঞ্চলগুলি অর্থনৈতিক শোষণের সম্মুখীন হয়। এইভাবে আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাব-প্রক্রিয়াই গড়ে দেয় এই আন্দোলনগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। এর থেকে আবির্ভূত আদিবাসী সংস্কারপ্রবক্তারা একটি কৃষ্টিগত সংশ্লেষ গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে এই সংশ্লেষ নতুন সমাজে তাঁদের সম্প্রদায়কে একটি সম্মানজনক স্থান এনে দেবে।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী শ্রেণীগুলির মূল্যবোধই আদিবাসীদের অনুমোদন লাভ করেছিল। তাদের কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আদিবাসীরা মূল্যবোধ ও ক্ষমতার সম্বন্ধ সম্পর্কে তাদের সচেতনতা প্রকাশ করেছিল। কেননা, মূল্যবোধের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ক্ষমতার সেই উপাদান যার মাধ্যমে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলি ন্যূনতম বলপ্রয়োগের সাহায্যে অধীনস্থ শ্রেণীগুলিকে বশীভূত করে। এর সুস্পষ্ট উদাহরণ, যেমন, ‘শুদ্ধতা’-র ব্রাহ্মণ্য ধারণাটি ভারতের তথাকথিত ‘অপবিত্র’ অধীনস্থ শ্রেণীগুলির উপর একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আত্মসাৎকরণের মাধ্যমে এ-ধরনের মূল্যবোধগুলির উপর একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র আরোপ করে আদিবাসীরা এদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যশক্তি হরণ করতে চেষ্টা করেছিল।
অতএব ক্ষমতাকেন্দ্রিক সম্পর্কই আমাদের আলোচ্য বিষয়। বিভিন্ন মূল্যমান-ব্যবস্থা নয়। এই মোদ্দা কথাটি বুঝতে পারলেই নানা ক্ষেত্রে আদিবাসীদের গৃহীত বিভিন্ন কার্যসূচির কেন্দ্রীয় যুক্তিটিকে বোঝা সহজতর হয়ে ওঠে। দেশীয় জনসাধারণের মধ্যে স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির মূল্যবোধ অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসীরা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে আদিবাসীরা ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে, কারণ তারা খ্রিস্টীয় মিশনারিদের মূল্যবোধকে ব্রিটিশদের ক্ষমতার সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছিল। দক্ষিণ গুজরাটে তারা তাদের প্রত্যক্ষ শোষক পারসিদের মূল্যবোধগুলিকে বর্জন করেছিল কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ও বানিয়াদের প্রতিপত্তিশালী আঞ্চলিক সংস্কৃতির অনুমোদন করে। যে মূল্যবোধগুলিকে আত্মসাৎ করা হত সেগুলি হয় ছিল ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর মূল্যবোধ, নতুবা কোনও আঞ্চলিক প্রতিপত্তিশালী দেশীয় শ্রেণীর, নয়তো আদিবাসীদের স্থানীয় শোষকদের। অনুমোদিত মূল্যবোধগুলির মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর, কিন্তু ক্ষমতাচর্চার অনুষঙ্গ ছিল তাদের সাধারণ ধর্ম।
আধিপত্যশালী মূল্যবোধ আত্তীকরণের এই কার্যসূচিগুলির একটি প্রধান শক্তি ছিল এই যে এগুলি আদিবাসী সম্প্রদায় এবং প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির কিছু কিছু প্রগতিশীল সদস্যের মধ্যে এক ধরনের সংযোজক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এখানেই ছিল এদের সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর মূল্যবোধ সরাসরি বর্জন করার কার্যসূচিগুলির মূল তফাৎ। উচ্চশ্রেণীর প্রগতিশীলদের মধ্যে কেউ কেউ উন্নত ধরনের উদারপন্থী মতামত পোষণ করতেন, অর্থাৎ জাতীয় সংহতি এবং একটি গণতান্ত্রিক ভারতীয় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলায় বিশ্বাস করতেন। এছাড়া ছিলেন সেইসব রাজনীতিকরা যাঁরা আদিবাসীদের দেখতেন ক্ষমতার একটি সম্ভাব্য উৎস হিসেবে। উপজাতীয় জনসাধারণের দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এবং তাঁদের স্বীয় শ্রেণীর অন্যান্য সদস্যের বিশ্বাস উৎপাদনের ব্যাপারে এই মানুষগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারতেন। সুতরাং এই ধরনের আদিবাসী আন্দোলনগুলি উচ্চবর্গের অন্তর্বিভেদের সুযোগ নিয়েছিল।
এইবার যদি আমরা দেবীর প্রত্যাদেশগুলির দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব যে সেগুলি দুটি দিক থেকে আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। একদিকে সেগুলি আঞ্চলিক প্রতিপত্তিশালী উচ্চবর্ণের হিন্দু মূল্যবোধগুলিকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। এই গণতন্ত্রীকরণ-প্রচেষ্টার মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। এই প্রসঙ্গে যে ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, যদিও বানিয়া ও ব্রাহ্মণ বণিক এবং কুসীদজীবীরা আদিবাসীদের শোষণ করত, তৎসত্ত্বেও দেবীর প্রত্যাদেশগুলিতে কখনওই তাদের বয়কট করার কথা বলা হয়নি। এই বয়কট আরোপ করা হয়েছিল শুধুমাত্র পারসি এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর। এর যুক্তি ছিল এইরকম যে, যেখানে বানিয়া ও ব্রাহ্মণদের ‘পবিত্র’ জীবনাচরণ আদিবাসীদের মধ্যে আত্তীকরণের তাগিদ জাগিয়ে তুলেছিল, সেখানে পারসি এবং মুসলমানেরা ছিল ‘অপবিত্র’। অন্যদিকে স্থানীয় শোষণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে লোভী বলে পরিচিত পারসিদের বিরুদ্ধে দেবীর প্রত্যাদেশগুলি ছিল এক আত্মঘোষণা। সুরাপান থেকে বিরত হয়ে এবং সুরাব্যবসার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় ব্যক্তির হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করে আদিবাসীরা পারসিদের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক বন্ধনসূত্রগুলি ছিন্ন করেছিল। এদিক থেকে সুরাপান ছেড়ে দেওয়া ছিল বেআইনি মদ-চোলাই প্রভৃতি ছলনামূলক কার্যকলাপের থেকে অনেক বেশি কার্যকর আত্মঘোষণা, কারণ এই বর্জনের পিছনে কাজ করেছিল এক বিরাট নৈতিক শক্তি।
সুতরাং এই বিশেষ অঞ্চলটিতে দেবীর প্রত্যাদেশগুলিকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল আদিবাসী আত্মঘোষণার এক শক্তিশালী কার্যসূচি। রানিমহলে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিল তাদের সবাইকেই এই আন্দোলন বেশ ধাক্কা দেয়। বিশেষত পারসি সুরাব্যবসায়ী তথা ভূস্বামীদের প্রতি এটি ছুঁড়ে দেয় এক চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন সম্পর্কে আদিবাসী সমাজ-বহির্ভূত অংশের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি এবার খতিয়ে দেখা যাক।
৫
ভূতাবেশ-সংক্রান্ত ধর্মীয় আচারবিধি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে কোনও বড় ধরনের আঘাতকে সূচিত করে না। আই. এম. লিউইস দেখিয়েছেন যে প্রতিপত্তিশালী শ্ৰেণীরা প্রায়শই এগুলিকে, অস্বস্তির সঙ্গে হলেও, মেনে নেয়। ভুতাবেশকে মনে করা হয় এমন এক চাপ-নিষ্কাশক যন্ত্র যা ন্যূনতম সামাজিক সম্ভোগের বিনিময়ে নিম্নবর্গের প্রচ্ছন্ন নাশকতামূলক অনুভূতিগুলিকে প্রশমিত করতে পারে।৪৯ যাই হোক, প্রতিরোধের সম্পূর্ণ আচারভিত্তিক এবং অপেক্ষাকৃত স্পষ্টতর ধারাদুটির মধ্যে বিভাজক রেখাটি কিন্তু সহজেই অতিক্রম্য। এইজন্যই প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলি এ-ধরনের ধর্মাচরণবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে, যাতে কোনওরকম বাড়াবাড়ি ঘটলেই তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। দেবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির টনক নড়েছিল তখনই যখন আদিবাসীরা দলে দলে জমায়েত হতে শুরু করে, কেননা এ ধরনের বিশাল জনসভার মধ্যেই নিহিত ছিল সক্রিয়তর প্রতিরোধ ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের বীজ।
দেবী আন্দোলন নে এক দুর্ঘটনা তা পারসিরা তাড়াতাড়িই বুঝতে পেরেছিল। তাদের সুরাব্যবসা কমতে কমতে শূন্যে এসে দাঁড়ায়, আদিবাসীরা তাদের তাল গাছগুলি থেকে তাড়ি নিষ্কাশন করতে প্রত্যাখ্যান করে, প্রত্যেকেই তাদের জমিতে কাজ করতে অথবা বাড়ির চাকর হতে অস্বীকার করে, এবং তার সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হয়। আরও অপমান করার উদ্দেশ্যে পারসিদের ছায়া মাড়ালেই আদিবাসীরা নিজেদের ‘পবিত্র’ করার জন্য স্নান করতে শুরু করে; কেউ কেউ এমনকি পারসিদের পারস্যে ফিরে যাওয়ার জন্যও উপদেশ দেয়। আন্দোলন সম্পর্কে পারসিদের প্রতিক্রিয়ার ধরন থেকেই বোঝা যায় যে তাদের সামাজিক অবস্থানের উপর এই আঘাতকে তারা কত গুরুতরভাবে দেখেছিল। কখনও কখনও আবগারি বিভাগের কর্মচারিদের সহায়তায় পারসিদের গুণ্ডাবাহিনী একজন আদিবাসীকে পাকড়াও করে জবরদস্তি মদ গিলিয়ে দিত। এইভাবে ওই আদিবাসীটির ব্রত ভঙ্গ করে তাকে আবার শাস্ত্রমতে অপবিত্র বানিয়ে দেওয়া হত। প্রতিরোধকারীদের মারধর করা হত, এমনকি সাজানো অভিযোগে গ্রেফতারও করা হত।৫০ কোনও কোনও ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের পানীয়জলের সঙ্গে মদ খেতে বাধ্য করার জন্য পারসিরা গ্রামের কুয়োগুলিতে তাড়ি ঢেলে দিত। এছাড়াও আদিবাসীদের নব্য ‘শুদ্ধাচার’-কে উপহাস করার জন্য তারা তাদের মন্দির ও পবিত্র স্থানগুলিতে মলমূত্র ত্যাগ করত।৫১
দেবী আন্দোলন এমনকি বহু স্থানীয় কর্মচারীর কাছেও জনপ্রিয় ছিল না। তাদের কাছে আদিবাসীরা বরাবরই ছিল নিকৃষ্ট ও বশংবদ এক জনগোষ্ঠী যাকে অতি সহজে এবং কোনওরকম বিবেক দংশন ছাড়াই শোষ করা যায়। কিন্তু এখন আত্মঘঘাষণার এই নতুন সুর তাদের বুঝিয়ে দেয় যে বিনামূল্যের জিনিসপত্র, পরিচর্যা এবং শ্রমের যোগান এখন থেকে আর সুনিশ্চিত থাকবে না। ঘুষ থেকে তাদের রোজগারের পথটি বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আন্দোলনকে হীনবল করতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে, এবং বহু ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মনোবল ভাঙার কাজে পারসিদের সঙ্গে হাত মেলায়। ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে স্থানীয় কর্মচারীরা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিশেষ মদত পায়নি, কিন্তু পেয়েছিল বরোদা রাজ্যভুক্ত অঞ্চলগুলিতে। এর পরে আমাদের আলোচ্য বিষয় হবে যথাক্রমে বরোদা রাজ্যে এবং ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলে আন্দোলন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়ার রকমফের।
‘বাইরে থেকে এসে যেসব লোক এ-ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বেঁধে ফেলার জন্য’৫২ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়াই ছিল ভিয়ারা তালুকস্থিত বরোদার রাজকর্মচারীদের প্রথম প্রতিক্রিয়া। মদ ছেড়ে দিয়েছে, এমন আদিবাসীদের আর একবার সুরাপান করতে প্ররোচিত করার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়। মাদক-পরিহারের একজন সমর্থক, ভিয়ারা মিশনের রেভারেন্ড ব্লান্ট, এই ঘটনা শোনার পর বরোদার গাইকোয়াড়ের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী সি. এন. সেনের কাছে প্রতিবাদ জানান। সেডন আদেশ জারি করেন যে কর্মচারীরা দেবী আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করবে না এবং একে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ার অবকাশ দেবে।৫৩ আন্দোলন রোধ করার জন্য জেলা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করার উদ্দেশ্যে পঁচিশজন পারসির একটি প্রতিনিধিমণ্ডলী ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে নৌসারিতে যায়। কিন্তু পুলিশ-প্রধান অথবা সুবা-র (জেলা কালেক্টরের সমতুল) কেউই তাদের কথা শুনতে রাজি ছিলেন না।৫৪
এর অল্প কিছুকাল পরেই বরোদার দেওয়ান স্যার মনুভাই মেহতা সিদ্ধান্ত নিলেন আন্দোলন বন্ধ করতেই হবে। পরে তাঁর নিজের যুক্তিগুলি জানিয়ে তিনি গাইকোয়াড়কে (যিনি তখন ছিলেন ইউরোপে ভ্রমণরত) এক চিঠি দেন।৫৫ তিনি জানান যে রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীরা এবং অসহযোগীরা আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে; পারসিদের ভয় দেখানো হচ্ছে এবং জাতিগত বিবাদের সূচনা হয়েছে; আন্দোলনকারীরা অনেকগুলি তালগাছ কেটে ফেলার ভয় দেখাচ্ছে, যা সরকারি আবগারি রাজস্বের ক্ষতি করবে; বহু স্কুলশিক্ষক আন্দোলনকে সমর্থন করছেন এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে সরকারি আবগারি রাজস্ব-নীতির সমালোচনা করে ভাষণ দিচ্ছেন; ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে; বনবিভাগের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে; আদিবাসীরা তাদের জমি চাষ না করে এবং পারসিদের হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করে (যার ফলে তারা বেতন হারাচ্ছে) অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিজেদেরই ধ্বংস করছে। আন্দোলনের লক্ষের প্রতি মনুভাই মেহতার সহানুভূতির অভাব এইভাবে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তাঁর বক্তব্যে একই সঙ্গে দেখা গিয়েছিল যে কোনও মূল্যে আবগারি রাজস্ব বজায় রাখার এক আমলাতান্ত্রিক ইচ্ছা, পারসিদের দৃষ্টিকোণের প্রতি প্রবল পক্ষপাতিত্ব, আন্দোলন সম্পর্কে অজ্ঞতা (আদিবাসীরা কখনোই নিজেদের জমিতে কাজ করতে অস্বীকার করেনি), এবং এক আশঙ্কা যে রাজ্যের জাতীয়তাবাদী নেতারা নৌসারি জেলার আদিবাসীদের মধ্যে একটি জোরদার ঘাঁটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আন্দোলনটিকে ব্যবহার করতে পারে।
রানিমহলে জনসমাবেশ অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করা হয়। দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যকলাপে অংশ না নেওয়ার জন্য সরকারি চাকুরে এবং স্কুলশিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়। গোটা নৌসারি জেলা জুড়ে তালগাছ কাটা নিষিদ্ধ হয়।৫৬ পারসি ও আদিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেখানে সবচেয়ে তীব্র ছিল, সেই মাহুবা তালুকে পাঠানো হয় বাড়তি পুলিশ।৫৭
বরোদা রাজ্যের জাতীয়তাবাদীরা এসব ব্যাপার-স্যাপার শান্তভাবে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিগত তিন বছর ধরেই নৌসারি শহরে গান্ধীবাদী আন্দোলন বেশ জোরদার সমর্থন পেয়ে আসছিল।৫৮ ১৯২৩ সালের গোড়ার দিকে এই শহরের মুখ্য জাতীয়তাবাদীরা ‘কালিপরজ সংকট নিবারণমণ্ডল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বরোদা শহরের নেতা সুমন্ত মেহতা এর সভাপতি হতে রাজি হন। সমিতির সদস্যরা কর্তৃপক্ষের হাতে হয়রানি থেকে আদিবাসীদের রক্ষা করার জন্য গ্রামে যেতে শুরু করেন। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সরকারি অত্যাচার সম্পর্কে স্বয়ং তদন্ত করার উদ্দেশ্যে সুমন্ত মেহতা ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে নৌসারিতে যান। বরোদায় ফেরার পর তিনি দেখা করেন দেওয়ানের সঙ্গে, যিনি আবার তাঁর এক আত্মীয়। এঁর কাছে তিনি দাবি করেন যে নৌসারি জেলায় মদ্যপান ও সুরাব্যবসা নিষিদ্ধ করা হোক। সুরার উপর নিষেধাজ্ঞা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যর্থ হয়েছে, এই যুক্তিতে মনুভাই মেহতা এই অনুরোধ খারিজ করে দেন, কিন্তু যে অঞ্চলে আন্দোলন ছিল সবচেয়ে বেশি জোরদার সেখানে কয়েকটি মদের দোকান বন্ধ করে দেবার আদেশ দিতে তিনি রাজি হন।৫৯
রানিমহলে সমাবেশ করার অভিযোগে বরোদা সরকার ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে কালিপজ সংকট নিবারণমণ্ডলের পাঁচজন প্রধান সদস্যের বিরুদ্ধে নালিশ আনে। এই মোকদ্দমার শুনানি হয় আগস্ট মাসের গোড়ায়, এবং গোপানজী দেশাই নামে ভিয়ারার এক প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ অভিযুক্ত নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে নৌসারির নেতাদের সঙ্গে আদিবাসীদের কথাবার্তা ছিল একান্তই অনিয়মিত, এবং দু পক্ষের মধ্যে সে অর্থে কোনও সমাবেশ হয়নি। ফলত এই নেতাদের উপর থেকে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।৬০ শহরের নেতাদের নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়ে নৌসারির সুবা অতঃপর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আদিবাসীর বিরুদ্ধে এক মামলা শুরু করেন। পারসি এবং অন্যান্য মালিকদের খামারে কাজ করা থেকে স্বীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের বলপূর্বক নিবৃত্ত করার দায়ে এদের অভিযুক্ত করা হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয় যে ওই সময়ের মধ্যে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে হবে, এবং তা করতে ব্যর্থ হলে আবার আদালতে হাজির হতে হবে।৬১ এই দমননীতি সত্ত্বেও সুরাবর্জন ও পারসি-বয়কট আন্দোলন বরোদার রানিমহলে, বিশেষত মাহুভা তালুকে, বেশ ভালভাবেই চলতে থাকে।৬২ এতেই বোঝা যায় যে বাইরের জাতীয়তাবাদী নেতাদের প্রচেষ্টা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। হতাশ হয়ে মনুভাই মেহতা ১৯২৩ সালের ১ নভেম্বর এক আদেশ জারি করে রানিমহলে সভাসমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও ছমাস বাড়িয়ে দেন, এবং দেবীমাহাত্ম সংক্রান্ত যাবতীয় সমাবেশও নিষিদ্ধ করে দেন।৬৩ এইভাবে অবশেষে বরোদা সরকার দেবীকে নিষিদ্ধ করেন। মেহতার বিজ্ঞপ্তিতে (যা জারি করা হয়েছিল নৌসারির সুবার নামে) প্রকাশিত কিছু কিছু ধারণা আন্দোলন সম্পর্কে বরোদা সরকারের মনোভাব সম্বন্ধে চিত্তাকর্ষক আলোকপাত করে। এতে এরকম ইঙ্গিত ছিল যে শহরের গোলযোগকারীরাই দেবীকে সৃষ্টি করেছে:
কোনও কোনও যড়যন্ত্রকারী লোক শাসক এবং শাসিতের কিসে মঙ্গল হবে তা না জেনেই কালিপরজদের কাছে ব্যাপারটা ভুলভাবে সাজিয়েছে, তাদের ভয় দেখিয়েছে, এবং তাদের বড় বড় জমায়েত ডাকতে প্ররোচিত করেছে…এইসব লোকেরা রাজকর্মচারীদের বিরুদ্ধে কালিপরজদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে, এবং ফলত সরকারের প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে ক্ষুণ্ণ করে। এছাড়াও তারা সরকারি বিচারব্যবস্থার উপর কালিপরজদের আস্থা ভাঙতে চায়, এবং তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে সরকার তাদের সম্প্রদায়ের প্রকৃত মঙ্গল সম্পর্কে উদাসীন।৬৪
এই আদেশ কিছুটা অসংলগ্নভাবেই দেখানোর চেষ্টা করেছিল যে দেবী জনগণের ভ্ৰান্তদিশারী এক অশুভ শক্তিমান এবং এই দেবীর ‘দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ’ সহ্য করা যায় না। এই বক্তব্যগুলি যে শুধু পরস্পরবিরোধী তাই নয়, পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ দেশীয় রাজ্যগুলি আদিবাসীদের আত্মঘোষনাকে মেনে নিতে পারছিল না। উনিশ শতকের শেষভাগে যে রাজ্য আদিবাসী-প্রশিক্ষণের পথিকৃৎ হিসাবে কাজ করেছিল, এক প্রজন্মের ব্যবধানে সেই রাজ্যই আর ওই নীতির পরিণাম গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।
গাইকোয়াড় স্বয়ং তাঁর দেওয়ানের চেয়ে বেশি বদান্য বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জায়গায় দীর্ঘ প্রবাসের পর ১৯২৩ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ডিসেম্বর মাসে মাহুভা, ভিয়ারা এবং সানগড় তালুক থেকে দুশোরও বেশি আদিবাসীর এক প্রতিনিধিবর্গ মহারাজকে তাদের বিক্ষোভ সম্পর্কে জানাতে বরোদায় এসে উপস্থিত হয়।৬৫ এর কিছুদিন পরেই নৌসারির সুবাকে তার চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং এক আদেশ জারি করে রানিমহলে মিতাচার এবং মদ্যপান নিবারণ সংক্রান্ত কাজকর্মের উদ্দেশ্যে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। স্থানীয় কর্মচারীদের এইসব কাজকর্মে সহযোগিতা করতে আদেশ দেওয়া হয়।৬৬ এই নতুন আবহাওয়ার প্রতি সাড়া দিয়ে সুমন্ত মেহতা ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে রানিমহল সফর করেন, যে সফরে তিনি আদিবাসীদের কয়েকটি বৃহৎ গোষ্ঠীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। সাম্প্রতিক আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই জমায়েতগুলি কেবলমাত্র মিতাচারের প্রতিই মনোযোগী ছিল। কিন্তু এর বিশেষ কোনও তাৎপর্যই ছিল না। আদিবাসীদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই যে, ভূস্বামী ও সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের ঐক্যকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে তাদের আবার জমায়েত হবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সুমন্ত মেহতা দেখেছিলেন যে বিগত বছরের দমননীতি আন্দোলনকে ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। আদিবাসীরা তাঁর কাছে আত্মোন্নতি ও সমাজসংস্কারের এক তীব্র বাসনা প্রকাশ করেছিল। এই সফরের সময়ই সুমন্ত মেহ্তা প্রথম ‘কালিপরজ’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ব্রিটেনে লোকেরা যখন তাঁকে ‘নিগার’ বা ‘ব্ল্যাকি’ বলে ডাকতে তখন যে তিক্ত যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছিলেন, তা তাঁর মনে ছিল। রানিমহলের আদিবাসীদের উল্লেখ করার জন্য এরপর থেকে তিনি ‘রানিপরজ’ (জঙ্গলের মানুষ) শব্দটি ব্যবহার করা স্থির করেছিলেন।৬৭ আত্মঘোষণার মাধ্যমে আদিবাসীরা দক্ষিণ গুজরাটের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল সদস্যদের কাছ থেকে যে বাড়তি শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পেরেছিল, এই শব্দটি ছিল তারই একটি তাৎপর্যপূর্ণসূচক।
দেবী আন্দোলনের প্রতি ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া ছিল গুণগত বিচারে বরোদা রাজ্যের থেকে আলাদা। এর আগে সুরাবিরোধী গণ-আন্দোলনগুলির প্রতি তারা প্রায়ই বেশ কড়া নীতি অবলম্বন করে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৬ সালে যখন থানা ও কোলাবা জেলার প্রচুরসংখ্যক কৃষক সুরাপান বর্জন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চটপট এই আন্দোলনের নেতাদের কারাবন্দী করে ফেলে। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আবগারী কমিশনার তাঁর এই আচরণের সাফাই গেয়েছিলেন এই ভাষায়: ‘যে প্রশ্নের সমাধান আবশ্যক তা হল এই যে, আমরা কি চুপচাপ বসে থেকে আন্দোলনকে চলতে এবং ছড়াতে দিয়ে বেশ মোটা টাকার রাজস্ব জলাঞ্জলি দেব, নাকি লোকজনের বিচারবুদ্ধি যতে ফিরে আসে সেরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করব?’৬৮
১৯২১-২৩ সাল নাগাদ এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আর প্রত্যাশিত ছিল না। মন্টেগু-চেম্স্ফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী আবগারি শুল্ক একটি ‘হস্তান্তরিত’ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম গণনিবার্চিত মন্ত্রী ছিলেন স্যার চুনিলাল মেহ্তা, যিনি পুনর্গঠিত পরিষদের সর্বপ্রথম অধিবেশনেই ‘সুরারূপ শয়তানের’ বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।৬৯ মদের দোকানগুলিতে সুরাসরবরাহের উপর উত্তরোত্তর কঠোরতর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে তিনি ক্রমিক ভিত্তিতে মদ্যপান-নিবারণ নীতির প্রচলন করেছিলেন। বোম্বাই প্রেসিডেঙ্গিতে মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণের প্রশ্নটি বিবেচনা করার জন্য তিনি একটি কমিটিও নিযুক্ত করেন। ফলত, সুরাটের কালেক্টর এ. এম. ম্যাকমিলানের পক্ষে দেবীর মিতাচার-সংক্রান্ত কার্যসূচির প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রদর্শন করা ছাড়া উপায় ছিল না।
যেহেতু ব্রিটিশরা ছিল বিদেশি, সে জন্য স্থানীয় সমাজত্তর-কাঠামোয় এই ওলটপালটের থেকেও তারা বেশি চিন্তিত ছিল আদিবাসী সম্প্রদায় এবং গুজরাটের গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে আপাতনির্মীয়মান এক মৈত্রীকে নিয়ে। প্রথমদিকে এই আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক’ এই আখ্যা না দিয়ে ‘ধর্মীয়’, অতএব সহনীয়, বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু পাছে এর মধ্যে রাজনীতির দিকে মোড় নেবার কোনও ইঙ্গিত দেখা দেয়, সেজন্য এর উপর সতর্ক নজর রাখার নির্দেশ ছিল৭০ বারদোলির জাতীয়তাবাদীরা এই আন্দোলনকে প্ররোচিত করেছে কিনা তা অনুসন্ধান করার জন্য ম্যাকমিলান একবার রানিমহল সফর করেন। সফরশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে আন্দোলনটি ছিল বাস্তবিকই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’, এবং তা ‘জনসাধরণের বিশেষ কোনও ক্ষতিসাধন করছিল না।’৭১ যাই হোক, ডিসেম্বরের শেষের দিকে রিপোর্ট আসতে থাকে যে দেবী বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর এবং সরকারি স্কুল বয়কটের ডাক দিয়েছেন। দুটিই ছিল অসহযোগ কর্মসূচির মূল বৈশিষ্ট্য। অতএব ১৯২৩-এর জানুয়ারির মধ্যেই ম্যাকমিলান বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেন:
আমি ভাবছি প্রভাবশালী লোকেদের সাহায্যে ‘মাতা’ আন্দোলনের গতিরোধ করার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, কারণ এই আন্দোলন আপত্তিজনক চেহারা নিতে শুরু করেছে। এর জন্য দায়ি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ, এবং এই ধরনের আন্দোলনের অত্যন্ত মোটাদাগের উদ্ভট চেহারা নেবার সেই সাধারণ প্রবৃত্তি যা বাইরের সমালোচনার সংযতকারী প্রভাব এবং সাধারণ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে দেখা যায়।৭২
একজন পারসি তাড়ির দোকানের মালিককে একটি স্থানীয় জাতীয়তাবাদী স্কুলে ১২০ টাকা জরিমানা দিতে বাধ্য করার অভিযোগে জালালপুর তালুকে দেবীর মাধ্যম হিসাবে কার্যরত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা আনা হয়।৭৩ অবৈধ জুলুমের দায়ে দোষী সাব্যস্ত এই ব্যক্তির শাস্তি হয় পনেরো দিনের হাজতবাস এবং তিনশো টাকা জরিমানা।৭৪ জালালপুর তালুকে দেবী আন্দোলন ছিল দুর্বল (এটি আদিবাসী এলাকা ছিল না), এবং ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকেই স্থানীয় পুলিশপ্রধান এই মর্মে রিপোর্ট দিতে সক্ষম হন যে এই মোকদ্দমার ফলে আন্দোলন ক্ষীণ হয়ে এসেছে।৭৫
রানিমহলে অবশ্য এই আন্দোলনকে অত সহজে দমানো সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে ম্যাকমিলান সাহেব হস্তক্ষেপ না করাই যুক্তিযুক্ত স্থির করেন। বরং তিনি ভেবেছিলেন যে আদিবাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলাই ভাল, যাতে তারা জাতীয়তাবাদীদের দলে গিয়ে না ভেড়ে। এই নীতি অনুসারে তিনি আবগারি কমিশনারের কাছ থেকে রানিমহলে ষোলোটি মদের দোকান বন্ধ করে দেবার অনুমতি আদায় করেন। পরে ম্যাকমিলান তাঁর বার্ষিক রিপোর্টে দাবি করেন যে তাঁর নীতি সফল হয়েছে: ‘অসহযোগ আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যর কারণে আন্দোলনটিকে করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। যেখানে যেখানে এই আন্দোলন ছিল কমজোরী, যেমন জালালপুরে, সেখানে সেখানে এটি চলাকালীন তাঁরা ভালরকমই সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু মাণ্ডবীর মতো জায়গায়, যেখানে আন্দোলন ছিল তীব্র এবং অকৃত্রিম, তাঁদের চেষ্টা খুব বেশি পাত্তা পায়নি।’৭৬ এই রায় কি গ্রহণযোগ্য? কেবলমাত্র আংশিকভাবে, কারণ গান্ধীবাদীরা অতীব দক্ষতার সঙ্গে দেবী আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগস্থাপন করে। এটা করার জন্য তারা কার্যসূচির সেই সেই অংশগুলির উপর ঝোঁক দেয়, যেগুলি তাদের নিজস্ব পরিকল্পনার সঙ্গে খাপ খেয়েছিল। যে অংশগুলি এভাবে মেলেনি, সেগুলিকে তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল।
১৯২১-এর শেষের দিক থেকেই গান্ধীবাদীরা বারদোলি তালুক এবং ভালোড় মহলের আদিবাসীদের মধ্যে তাদের কাজকর্ম চালাচ্ছিল। ঐ বছর গান্ধী জোর দিয়ে বলেন যে এই দুই মহকুমায় আইন অমান্য অভিযান শুরু করার আগে আদিবাসীদের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে টেনে নেওয়া দরকার। সেই সময় অবধি আদিবাসীরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। আদিবাসী গ্রামগুলিতে কংগ্রেস নেতা কুঁয়ারজী মেহ্তার এক চমকপ্রদ অভিযানের ফলে আদিবাসীরা শুধু গান্ধীর নামের সঙ্গে পরিচিতই নয়, আন্দোলনের প্রতিও অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে।৭৭ সুতরাং পরের বছর দেবীর মাধ্যমরা যখন চটপট দেবীর নামের সঙ্গে গান্ধীর নামকে জড়িয়ে ফেলে, তখন সেটা আদৌ বিস্ময়কর ছিল না। অনেক গান্ধীবাদীর কাছে দেবী আন্দোলন এক দৈব বিধানের মতো ঠেকেছিল, কারণ মনে হয়েছিল আদিবাসীরা যেন এক লহমায় গান্ধীর আদেশবাণীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের জীবনচর্যাকে শুদ্ধিকৃত করে নিয়েছে। এই ব্যাপারটি শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই বারদোলি তালুকের কয়েকজন গান্ধীবাদী নেতা আদিবাসী অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করেন এবং দেবীর কয়েকটি জনসভায় উপস্থিত হন। দেবীর মাধ্যম হিসেবে কার্যত কয়েকজন ব্যক্তির কাছে তাঁরা প্রস্তাব দেন যে খদ্দর পরিধানের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে দেবীর আজ্ঞাসূচিটিকে আরও জোরদার করা যেতে পারে। মাধ্যমদের অনেকেই এই প্রস্তাবগুলিকে মেনে নিয়েছিলেন।৭৮
বারদোলির কংগ্রেসিরা একটি কালিপরজ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে বল্লভভাই প্যাটেলের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। তারা আদিবাসীদের জানায় যে গান্ধী নিজে এখন জেলে, কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর গদিতে আসীন রয়েছেন। আদিবাসীদের তারা সম্মিলনে উপস্থিত হয়ে বল্লভভাই এবং গান্ধীপত্নী কস্তুরবার বক্তব্য শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। দলে দলে আদিবাসী আসার প্রতিশ্রুতিও দেয়। এইভাবে ১৯২৩ সালের ২১ জানুয়ারি বরোদা রাজ্যের মাহুভা তালুকের শেখপুরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কালিপরজ সম্মিলন। এতে আদিবাসী উপস্থিতি ছিল প্রায় কুড়ি হাজার—যা তাদের বিক্ষিপ্ত এবং নাতিবৃহৎ জনসমষ্টির তুলনায় বেশ বড় সংখ্যাই ছিল (উদাহরণস্বরূপ, ভালোড়ো চোধ্রীদের মোট জনসমষ্টি ছিল মাত্র আট হাজার)। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে সম্মিলনটিকে ভাগ করা হয়েছিল দুটি পৃথক অংশে। এর একটি নির্দিষ্ট ছিল সম্মিলনের আনুষ্ঠানিক কার্যাবলির জন্য, যার মধ্যে ছিল এক সুশৃঙ্খল শ্ৰোতৃমণ্ডলীর প্রতি গান্ধীবাদী নেতাদের ভাষণ। আদিবাসীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে এক জোরদার অভিযানের প্রতি জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের পূর্ণ সমর্থন কবুল করেন। তাল গাছ কেটে ফেলা, মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া, এবং খাদির প্রসারের ডাক দিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ করা হয়।৭৯ সম্মিলনের অন্য অংশটিকে দেবীর মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অনেকসংখ্যক ব্যক্তিকে একত্রিত করা হয়। তাদের পৃথক করে রাখা হয়েছিল এই আশঙ্কায় যে তারা সম্মিলনের আনুষ্ঠানিক কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। আনুষ্ঠানিক সম্মিলনটি শেষ হলে বল্লভভাই এবং কস্তুরবা দেবী মাধ্যমদের উদ্দেশে ভাষণ দেবার জন্য আসেন। তাঁরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমরা একযোগে ভরগ্রস্ত হয়ে প্রচণ্ডবেগে মাথা ঝাঁকাতে এবং হাতে লাল কাপড় ওড়াতে থাকে। দশ মিনিট পরে তারা কিছুটা শান্ত হলে বল্লভভাই বলতে শুরু করেন, কিন্তু তাঁর গলার আওয়াজ শোনামাত্র তারা আবার আবিষ্ট হয়ে পড়ে, এবং ‘গরম, গরম, গরম’ বলে চেঁচাতে থাকে। উপস্থিত সকলেই এই সভাটিকে এক বিরাট সাফল্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।৮০
পুরনো থেকে নতুন কায়দায় রাজনীতিতে রূপান্তরের এক চমকপ্রদ প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রথম কালিপরজ সম্মিলনে পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে রানিমহলের আদিবাসী জনসমাবেশগুলি ক্রমেই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধারণ করতে থাকে। কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে দৈবী সমাধিদশার শক্তি ক্রমশই দুর্বল হতে থাকে, এবং ক্রমে তার স্থান দখল করে গণভোটের মাধ্যমে গৃহীত প্রস্তাব। এছাড়া এই সন্ধিক্ষণে আদিবাসীদের মধ্যে এক নতুন নেতৃত্বের উদ্ভবও লক্ষ করা যায়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের বহিরাগত নেতৃত্বের সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে, কারণ বহুবার তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিল। যাই হোক, এই সময় থেকে তারা গান্ধীবাদী নেতাদের উপর আস্থা স্থাপন করতে এবং তাদের সভাসমিতিতে এই নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা দান করতে থাকে।
আদিবাসীদের কাছে একবার গৃহীত হওয়ার পর গান্ধীবাদীরা দেবী আন্দোলনের তীব্রতাকে প্রশমিত করার আরও চেষ্টা করেন। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী আন্দোলনটির প্রধান মূল্য আদিবাসীদের আত্মশুদ্ধির মধ্যে নিহিত ছিল। ভাবা হয়েছিল যে এইভাবে এক নতুন জীবনের প্রতি পা বাড়িয়ে আদিবাসীরা স্বাধীন ভারতের যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠবে। এরকম শুদ্ধিকরণ নিজে থেকেই নিম্নবর্গের উন্নয়ন নিয়ে আসবে এমন ধারণা যদি গান্ধীবাদীদের মনে কাজ করে থেকে থাকে, তবে এই অর্থে তাঁদের সংস্কৃতায়ন-তাত্ত্বিকদের পূর্বদিশারী বলে মনে করা যেতে পারে। সুতরাং আন্দোলনের যে দিকটিকে তাঁরা কম গুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিক বিভেদসষ্টিকারী, অতএব জাতীয় সংহতির পক্ষে প্রতিকূল, বলে মনে করতেন—যেমন পারসি আধিপত্যের প্রতি আদিবাসীদের চ্যালেঞ্জ—সেটির উপর তাঁরা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেন। কয়েকজন পারসি যখন বয়কটের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে তখন গান্ধীবাদীরা আদিবাসীদের বলেন যে যদিও পারসিদের হয়ে মদের দোকানে খাটা, তাল গাছ থেকে তাড়ি নিষ্কাশন ইত্যাদি অপবিত্র কাজ বন্ধ করে তারা ঠিকই করেছে, তবুও পারসিদের জমিতে কাজ করতে অস্বীকার করার সিদ্ধান্তটি ভুল। ১৯২৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন সোনগড় তালুকের দোসওয়াড়ায় (Dosvada) দ্বিতীয় কালিপরজ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় তখন বল্লভভাই প্যাটেল নিম্নলিখিত বার্তাটি পড়ে শোনানোর জন্য পাঠান:
তোমাদের সমাজে জাগরণ প্রত্যেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু তোমাদের খুব সাবধান হতে হবে। বেশি তাড়াহুড়ো করলেই আছাড় খাবার সম্ভাবনা। পারসি ও মুসলমানদের শ্রমিক হিসেবে কাজ না করার যে সিদ্ধান্ত তোমার নিয়েছ, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে পদক্ষেপ তোমরা নেবে তা সুচিন্তিত হওয়া দরকার।৮১
সম্মিলনের সভানেত্রী কস্তুরবা গান্ধীর বক্তব্য ছিল আরও খোলামেলা: তিনি আদিবাসীদের বলেন যে পারসিদের হয়ে কাজ করার জন্য তাদের ফিরে যাওয়া উচিত।৮২ আদিবাসীরা এই পরামর্শ গ্রহণ করেনি। প্রত্যুত্তরে তারা বলে যে পারসিরা অত্যন্ত ধূর্ত, এবং অতীতে বহুবারই মদ ছেড়ে দিতে গিয়ে তারা তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। তাদের ভয় ছিল এই যে একবার শ্রমদানের মাধ্যমে পারসিদের কবলে পড়লেই তারা আবার মদ ধরতে বাধ্য হবে। তাদের প্রলুব্ধ করার জন্য পারসিরা তাদের মধ্যে বিনামূল্যে মদ বিতরণ করতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আদিবাসীরা আর পারসিদের প্রতি সদয় হতে রাজি ছিল না। সুতরাং পরিপূর্ণ বয়কট চলতে থাকে।৮৩
গান্ধীবাদী এবং আদিবাসীদের মধ্যে এই ধরনের মতভেদের কথাই সম্ভবত কালেক্টর ম্যাকমিলানের স্মরণে এসে থাকবে যখন তিনি রিপোর্ট লেখেন যে আদিবাসীরা গান্ধীবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ে আদিবাসীদের বেশ বড় একটা অংশ গান্ধীর অনুগামীদের এবং গান্ধীবাদী কর্মসূচির প্রতি তাদের আগ্রহ প্রদর্শন করতে থাকে। খাদির প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। খাদির উৎপাদন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই আকর্ষণীয় ছিল না, আদিবাসীদের কাছে তার তাৎপর্য ছিল কিছুটা ঐন্দ্রজালিক। স্মরণ করা যেতে পারে যে তাদের দেখা স্বপ্নদৃশ্যে কুয়েতে উপবিষ্ট গান্ধীকে চরকা কাটতে দেখা গিয়েছিল। আদিবাসীদের বিশ্বাসোৎপাদন হয়েছিল যে চরকার সুতোকাটাটা এমন এক ধর্মীয় আচার যা জাতির স্বাধীনতা এবং তাদের নিজেদের মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে।
চরকার প্রতি এরকম আগ্রহ থেকেই আদিবাসীরা এমন প্রশিক্ষকের জন্য প্রার্থনা করে, যে তাদের সুতো কাটা এবং চরকার রক্ষণাবেক্ষণ শেখাতে পারে। ১৯২৪ সালে একজন সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত খাদি কর্মচারীকে রানিমহলে পাঠানো হয়। নির্বাচিত ব্যক্তিটি ছিলেন চুনিলাল মেহ্তা, আহ্মেদাবাদের কাছের এক গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মণ। তিনি ভালোড় তালুকস্থিত বেদ্ছি গ্রামের একজন উৎসাহী চোধ্রী সমাজসংস্কারক জীবন চোধ্রীর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন।৮৪ তিনি বেদ্ছিতে একটি ট্রেনিং ক্লাস শুরু করেন, এবং খাদির প্রচলন ব্যাপকতর করার উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি পরিভ্রমণ করেন।৮৫ ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে বেদ্ছিতে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় রানিপরজ সম্মিলন (ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলের গান্ধীবাদীরা তার মধ্যে আদিবাসীদের সম্পর্কে সুমন্ত মেহ্তার ব্যবহৃত অভিধাটি পরিগ্রহণ করেছে)। কারামুক্ত গান্ধী ছিলেন সভাপতি। প্রচুরসংখ্যক আদিবাসীকে খদ্দরের সুতো কাটতে দেখে তিনি বিশেষ প্রীত হন।৮৬ জীবন চোধ্রী ছিলেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, এবং তাঁর ভাষণে তিনি গান্ধীর প্রতি তাঁর সম্প্রদায়ের মনোভাব বিবৃত করেন: ‘জগদ্গুরু ভগবান মহাত্মা গান্ধীকে আমাদের সঙ্গে পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট এবং প্রীত হয়েছি। সর্বগুণান্বিত ভগবানকেই আমাদের ভজনা করা উচিত। এই ভগবান আমাদের যতখানি প্রজ্ঞা দিয়েছেন, এখন থেকে আর কোনও ভগবানই তা পারবেন না।’৮৭
পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে ১৯২৮, ১৯৩০-১, এবং ১৯৪২ সালে বহু চোধ্রী গান্ধীবাদী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে তাঁদের এই প্রতিশ্রুতির সারবত্তা প্রমাণ করেন। সুতরাং আদিবাসীরা গান্ধীবাদীদের মোটের উপর উপেক্ষাই করেছে, ম্যাকমিলানের এই বক্তব্য ছিল ভুল। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মৈত্রী সমস্যাকণ্টকিত হলেও যথেষ্ঠ বাস্তব ছিল।
৬
বছরখানেক বাদে বহু আদিবাসীই তাদের মিতাচার এবং নিরামিষাহারের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে শুরু করে। ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ কালেক্টর ম্যাকমিলান রানিমহল অঞ্চলে সুরার চাহিদা বৃদ্ধির কথা রিপোর্ট করেন। মাণ্ডবী তালুকে চারটি, ভালোড়ে একটি এবং বারদোলিতে একটি মদের দোকান তিনি আবার খুলে দেন।৮৮ মিতাচার আন্দোলনের শক্তিহ্রাসের জন্য শুধুমাত্র পারসি এবং রাজকর্মচারীরাই নয়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভিতরের লোকও দায়ী ছিল। প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে যারা ব্যর্থ হয়েছিল এমন অনেকে ছাড়াও এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল আদিবাসী ওঝারা, সনাতন সমাজে যাদের সম্মানিত অবস্থানকে বিপন্ন করেছিল এই সংস্কারমুখী তাগিদ। বর্ণহিন্দুর জীবনচর্চা এবং নেতৃত্বের উপর আস্থা রাখার সম্পর্কে অনেকেই তখনও সন্দিহান ছিল। বছর দুয়েকের মধ্যেই সম্প্রদায়ের অন্তর্বিরোধ তীব্র হয়ে দাঁড়ায়। ‘বরজেলা’, অর্থাৎ যারা দেবীর নির্দিষ্ট নব্য জীবনধারাকে অনুসরণ করেছিল, এবং ‘সরজেলা’, অর্থাৎ যারা তাদের প্রাক্তন অভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করেছিল, তাদের মধ্যে বিভেদের সূচনা হয়। ‘বরজেলা’-রা ছিল গান্ধীবাদী কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য গ্রামবাসীদের দ্বারা বর্জিত একটি বিচ্ছিন্ন ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হয়ে থাকলেও বেদ্ছির মতো অন্যান্য জায়গায় তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সামগ্রিক বিচারে বরজেলারা ছিল সংখ্যালঘু। কখনও কখনও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়ে দাঁড়াত। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন চোধ্রী সুরজেলা চোধ্রী দেবতা আহীনের উদ্দেশে পশুবলি দেবার উদ্যোগ করলে মাণ্ডবী তালুকের পিপলওয়াড়ায় (Phipalvada) সরজেলা এবং বরজেলাদের মধ্যে এক তুমুল সংঘর্ষ হয়।৮৯ আদিবাসীদের সকলেই অবশ্য শুদ্ধিকরণ সম্পর্কে দেবীর কয়েকটি প্রত্যাদেশ মেনে চলতে থাকে। প্রত্যেকদিন স্নান করা, মলত্যাগের পর পরিষ্কৃত হবার জন্য জল ব্যবহৃত করা, এবং বাড়িতে অধিকতর পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসগুলি ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত হয়েছিল।
যদিও কৃষ্টিগত সংস্কার আন্দোলন হিসাবে এর সীমাবদ্ধতাগুলি অনস্বীকার্য, তবুও ভূস্বামী, মহাজন এবং সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আত্মনির্ঘোষ হিসাবে এই আন্দোলন যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিল বলা যেতে পারে। দেবী আন্দোলনের পর ঐ অঞ্চলের পারসিদের অবস্থা কখনওই ঠিক আর আগের মতো হয়নি। কেননা, যেমনভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশদের সম্বন্ধে জনগণের ভয় কমিয়েছিল, ঠিক তেমনই পারসিদের সম্পর্কে আদিবাসীদের ভীতিতে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছিল দেবী আন্দোলন। সংগ্রাম যে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল তা নয়, পরবর্তী দশকগুলিতে পারসিরা আবার পুনরুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা আদিবাসীদের ভালরকমই মদত দিয়েছিল; এবং তাছাড়া ভারতের স্বাধীনতা যেসব ভূমিসংস্কারের সূচনা করেছিল তাদের শক্তি দেশের অন্যান্য অংশের থেকে গুজরাটে ছিল বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারসি এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ভূস্বামীদের জমি রানিমহলের আদিবাসী কৃষক সমাজের কাছে হস্তান্তরিত হয়।৯০ ১৯৩৮ সালে বারদোলি এবং ভালোড় তালুকে এবং ১৯৫০ সালে দক্ষিণ গুজরাটের অন্যান্য অঞ্চলে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ পারসিদের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি করেছিল। এর ফলে তাদের মদ ও তাড়ির ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর থেকে আদিবাসীরা খেয়ে এসেছে তাদের বাড়িতে বেআইনিভাবে চোলাই-করা শস্তা দারু। এই পানীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, শোষণের হাতিয়ার হিসাবে সুরার দিন যে শেষ হয়ে গেছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সুতরাং দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী এবং তাদের শোষণকারীদের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাসে দেবী আন্দোলনকে একটি দিক্চিহ্ন হিসেবে দেখা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই আন্দোলন আদিবাসী সমাজের মধ্যে এক বিত্তশালী কৃষক শ্রেণীর বিকাশের একটি স্তরকে সূচিত করেছিল। দেবী আন্দোলনের আগেই শুরু হলেও এই প্রক্রিয়াটি শক্তি সঞ্চয় করেছিল আন্দোলন থেকেই, কেননা এর সাহায্যেই অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন আদিবাসীরা গুজরাটি সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর থেকে পারসিদের ক্রমাবনতির সঙ্গে তাল রেখে সম্পন্ন আদিবাসী কৃষকেরা রানিমহল অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শোষণকারী গোষ্ঠী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এই আন্দোলনকে মহিমামণ্ডিত করার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এর প্রকৃত চরিত্রটিই স্বীকৃতির দাবি রাখে—একদিকে যেমন এটি এনে দিয়েছিল মুক্তি, অন্যদিকে তেমনি এই আন্দোলন নব্য আঙ্গিকের শোষণের ভিত্তিস্থাপন করেছিল।
অনুবাদ: জয়ন্ত সেনগুপ্ত
টীকা
১ বি. পি. বৈদ্য, রেক্তিমা বাহন (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৭৭) পৃ. ১৭৭, সুরাটের কালেক্টরের রিপোর্ট, 14 ডিসেম্বর 1922, Maharashtra State Archives. Bombay (এরপর থেকে BA বলে উল্লিখিত), Home Department (Special) (এরপর থেকে H. D. Sp.). 1922 সালের 637 নং।
২ ‘কালিপরজ’—অর্থাৎ ‘কালা আদমি’—ছিল একটি অবজ্ঞাসূচক অভিব্যক্তি, যার মাধ্যমে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসীদের বোঝানো হত।
৩ বারদোলির মামলতদারের রিপোর্ট, 15 নভেম্বর 1922, BA, H. D. (Sp.), 1922 সালের 637 নং।
৪ Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency, including Sind, for 1923-24 (Bombay, 1925), p. 39. গুজরাটের কালেক্টরের অফিসের রেকর্ড রুম থেকে প্রাপ্ত ১৯১৪ সালের একটি তালিকা থেকে দেখা যায় মাণ্ডবীতে তেরোটি এবং ভালোড়ে আটটি সুরার দোকান ছিল; এর থেকে মনে হয় যে মাণ্ডবীর সবকটি দোকানই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
৫ তদেব, পৃ. ৩৯-৪০।
৬ টানা ভগৎদের বিষয়ে সর্বোত্তম গ্রন্থটি হল S. C. Roy. Oraon Religion and Customs (1928; পুনর্মুদ্রিত, Calcutta, 1972), p. 246-97.
৭ Stephen Fuchs, Rebellious Prophets (Bombay, 1965), p. 240. T. B. Naik, The Bhils (Delhi, 1956), p. 324.
৮ BA, H. D. (Sp.), 1938-42 সালের 982 নং।
৯ Fuchs, p. 79. L. K. Mahapatra & C. Tripathy, ‘Raj Mohini Devi: A Social Refomer among Tribals of North Central India’, Vanyajati, 4: 4 (October 1956).
১০ Fuchs, p. 57, p. 68; Surajit Sinha, ‘Bhumij-Kshatriya Social Movement in South Manbhum’, Bulletin of the Department of Anthropology, 8: 2 (July 1959), p. 16-19.
১১ Report of the Excise Committee Appointed by Government of Bombay, 1922-23, vol. I (Bombay, 1924), p. 32-3.
১২ Suresh Singh, Dust-Storm and Hanging Mist: A Study of Birsa Munda and his Movement in Chhotanagpur (1874-1901) (Calcutta, 1966).
১৩ B.H. Mehta, ‘Social and Economic Conditions of the Chodhras, an Aboriginal Tribe of Gujarat’ (M. A. thesis, University of Bombay, 1933), ভূমিস্বত্ব সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলি পরিশিষ্ট খণ্ডের পরিবার-তালিকা থেকে সংকলিত হয়েছে।
১৪ তদেব, পৃ. ৪৭০; সাতভাও-এ সেচের কোনও সুবিধা না থাকায় এই অঞ্চলে জীবিকানির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ অন্যান্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল।
১৫ Gazetteer of the Bombay Presidency, volume II, ‘Surat and Broach’ (Bombay, 1877), p. 190.
১৬ উদাহরণ হিসেবে দেখুন, সুমন্ত মেহতা, সমাজ দর্পণ (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৬৪), পৃ. ৩৪০।
১৭ Dr. U. L. Desai of Vyara to A. D. C. to Gaikwad of Baroda, 5 December 1923, Baroda Records Office (এরপর থেকে BRO), Confidential Department, File 301.
১৮ Report of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay, 1922-3, vol. I, p. 43; vol. II, p. 301.
১৯ পরিসংখ্যানগুলি বার্ষিক Reports on the Administration of the Bombay Presidency থেকে গৃহীত।
২০ পরিসংখ্যানগুলি বার্ষিক Reports on the Administration of the Abkari Department in the Bombay Presidency, Sind, and Aden থেকে গৃহীত।
২১ Reports of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay, 1922-23, vol. I. p. 49.
২২ তদেব, vol. II, p. 526.
২৩ ডিষ্ট্রিক্ট ডেপুটি কালেক্টরের বিপোর্ট, 1880-1. BA Revenue Department, (এরপর থেকে R. D) 1881, vol. 22, Comp. 1435.
২৪ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট, 1886-7, BA, R. D. 1887, vol. 26, Comp. 1548.
২৫ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরেল রিপোর্ট, 1893-4, BA, R. D. 1894, vol. 36, Comp. 1305.
২৬ আই. আর. দেশাই, রানিপরজমা জাগ্রতি (গুজরাটি) (সুরাট, ১৯৭১), পৃ. ১৯।
২৭ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
২৮ তদেব, পৃ. ১০।
২৯ তদেব, পৃ ১১।
৩০ মারবাড়ী মাস্টারের গানের দলের একজন প্রাক্তন সদস্য—মাণ্ডবী তালুকের শলাইয়ের দলুভাই চোধ্রী— আমাকে গানটি শুনিয়েছিলেন। এই গানটি আমি সুরাটের অধ্যাপক আই. পি. দেশাইয়ের সহায়তায় চোধ্রী উপভাষা থেকে অনুবাদ করেছি। এতে ‘পারসি’দের বোঝাতে ‘পার্হা’ এবং ‘বানিয়া’দের বোঝাতে ‘ভাঙ্গি’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। অধ্যাপক দেশাইয়ের মতে এই শব্দ দুটি পারসি এবং বানিয়াদের কাছে অত্যন্ত অপমানজনক বলে গণ্য হত।
৩১ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট, 1904-5, BA. R. D. 1906, vol. II, Comp, 511, Pt VI.
৩২ এই প্রসঙ্গে বোম্বাইয়ের এস, এন. ডি. টি. বিশ্ববিদ্যালয়ের সুধা মোকাশি আমাকে যে সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ইনি আমাকে থানা জেলার বাসিন এবং পালঘাট তালুকের ধীবর গ্রামগুলিতে নিয়ে যান।
৩৩ আন্দোলনের যাত্রাপথটিকে অনুসন্ধান করা আমার পক্ষে একটি চিত্তাকর্ষক কিন্তু শ্রমসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিষয়টি সম্বন্ধে সমসাময়িক নথিপত্রের বক্তব্য খুবই ধোঁয়াটে যে জন্য খান্দেশ থেকে শুরু করে গ্রামকে গ্রাম ধরে পিছিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে কালক্রম নির্ধারণ করা কঠিন, কিন্তু সুবাটের তৎকালীন কালেক্টরের মতে দেবী দাং-এ ছিলেন ১৯২২ সালের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency for 1922-3. p. 43.
৩৪ এই ধরনের সমাবেশের বর্ণনার জন্য দেখুন, রানিপরজমা জাগ্রতি পৃ, ১৩৮-৪১।
৩৫ মাইকেল অ্যাডাস দেখিয়েছেন যে ‘মেসায়ানিক’ আন্দোলনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল একজন ত্রাতারূপী অথবা সত্যদ্রষ্টা নেতার অস্তিত্ব। দ্র. Michael Adas, Prophets of Rebellion: Millernarian Protest Movements Against the European Colonial Order (Chapel Hill, 1979). pp. 92-3 & 115. এখানে অ্যাডাস যে প্রবন্ধটির উপর নির্ভর করেছেন সেটি হল Norman Cohn, Medieval Dreanis in Action (New York, 1970), Pp 32-43. ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি আদিবাসী আন্দোলন, যাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিরসা মুণ্ডার আন্দোলন, ত্রাতাধর্মী নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু দেবী ইত্যাদি বহু আন্দোলনে যে এই ধরনের নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল, এই ঘটনা থেকে মনে হয় যে এরকম আন্দোলনের একমাত্র ব্যাখ্যা হিসেবে এই প্রত্যয়টিকে গ্রহণ করার যথার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ। এই প্রসঙ্গে স্টিফেন ফুসের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। Rebellious Prophets গ্রন্থে তিনি ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কারকামী আন্দোলনের (যদিও দেবী আন্দোলনের নয়) বর্ণনা করেছেন, এবং সেগুলিকে ‘ত্রাতামুখাপেক্ষী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রারম্ভিক অধ্যায়ে তিনি ‘ত্রাতামুখাপেক্ষী’ আন্দোলনের চোদ্দোটি বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করে বলেছেন যে এধরনের আন্দোলনে এই বৈশিষ্ট্যগুলি হয় একত্রে নয়তো খণ্ডিতভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ, এবং একটি আন্দোলনের ভিতর সবকটি বৈশিষ্ট্যকে দেখতে পাওয়াটা অসম্ভব। অতএব ফুক্স্ এ-ধরনের আন্দোলনগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনও তত্ত্ব পেশ করেননি, কেননা কোনও তত্ত্বের সারকথাই হল এই যে, খণ্ডগুলির পরম্পর জোড়া লাগা উচিত। সুতরাং এটি একটি দুর্বল প্রত্যয়, যেটি কোনও কোনও আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রকৃতিকে বর্ণনা করার পর আর আমাদের বোধকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যায় না।
৩৬ এর একটি উদাহরণ জিম্বাবোয়ের ‘শোনা’, দ্র. I. M. Lewis, Ecstatic Religion: An Anthropological Study of Spirit of Possession and Shamanism (Harmondsworth, 1978). pp. 141-3.
৩৭ Richard Lannoy. The Speaking Tree: A Study of Indian Culture and Society (New York, 1975). pp. 198-9.
৩৮ 1922 সালের 28 নভেম্বর পুলিশ বিপোর্ট, BRO, Confidential Department, 327.
৩৯ Papers Relating to the Revision Survey Settlement of the Mandvi Taluka of the Surat Collectorate. Selection from the Records of the Bombay Government, No. CCCCXXVI—New Series (Bombay, 1904), p. 41. F. S. P. Lely to J. G. Moore, 22 May 1886, BA, R. D. 1887. Vol. 7, Comp. 26, অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট 1885-6. BA, R. D. 1886, vol. 32, Comp. 1548.
৪০ এস. মেহতা, ‘কালীপরজ’, যুগধর্ম (গুজরাটি), 2: 3 (1923), p. 220.
৪১ M. N. Srinivas, Social Change in Modern India (Bombay, 1972). p. 6. এটি হল সংস্কৃতায়ন সম্পর্কে শ্রীনিবাসের সংশোধিত সংজ্ঞা। Caste in Modern India (Bombay. 1962) গ্রন্থের ‘A Note on Sanskritization and Westernization’ প্রবন্ধে শ্রীনিবাস যে আদি বক্তব্য রেখেছিলেন, তার বিবিধ সমলোচনার প্রতি এখানে নজর দেওয়া হয়েছে। শ্রীনিবাসের তত্ত্ব এবং তাঁর বক্তব্যের ক্রমপরিবর্তন সম্বন্ধে একটি বিশ্লেষণাত্মক সমীক্ষার জন্য দ্র. Yogendra Singh, Modernization of Indian Tradition: A Systematic Study of Social Change (Delhi, 1973), p. 7-12.
৪২ Srinivas, Social Change, p. 26.
৪৩ তদেব, পৃ. ৭।
৪৪ Roy. p. 9 সুরেশ সিং বিরসা মুণ্ডার আন্দোলন সম্পর্কে একই কথা বলেছেন, পৃ. ১৯৮-৯।
৪৫ Rebellious Prophets গ্রন্থে ফুক্স্ অনেকগুলি আদিবাসী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়েছেন। শুধু দুটি ক্ষেত্রে (পৃ. ৬৭ এবং ৬৯-এ উল্লিখিত) আদিবাসীরা বর্ণীয় মর্যাদার দাবি করে, এবং উভয় ক্ষেত্রেই তা ছিল ক্ষাত্ৰ-মর্যাদার জন্য।
৪৬ সুরজিৎ সিংহ যাকে আদিবাসীদের ‘রাজপুতায়ন’ (Rajputization—অর্থাৎ রাজপুত বা ক্ষাত্র-মর্যাদার জন্য দাবি—বলছেন, তা সম্ভবত মধ্যযুগে যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল (‘Bhumij-Kshatriya Social Movement in South Manbhum’)। বহু শতাব্দী ধরে রাজপুত শক্তির পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই ছকটিও মনে হয় ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
৪৭ Louis Dumont, Homo Hierarchicus,/i> (London, 1972). pp. 244 & 283.
৪৮ Srinivas, Social Change, p. 7
৪৯ I. M. Lewis, Ecstatic Religion, p. 128.
৫০ মেহতা, সমাজ দর্পণ, পৃ. ৩৪১-২।
৫১ মেহতা, ‘কালীপরজ’, পৃ. ২২২।
৫২ Report by Police Naib Suba, Navsari, 13 November 1922, BRO, Confidential Department. 327.
৫৩ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923. BRO, Confidential Department, 273.
৫৪ Report by Police Commissioner, Baroda, 16 December 1922, BDO, Confidential Department, 327.
৫৫ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923. BRO, Confidential Department 273.
৫৬ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৫৭ এস. মেহতা, ‘কালীপরজ কে রানিপরজ’, যুগধর্ম (গুজরাটি) 3(1924),444.
৫৮ Bombay Chronicle, 27 April 1922.
৫৯ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923, BRO, Confidential Department 273.
৬০ Times of India. 4 August 1923; Servant of India, 30 August 1923, p. 363.
৬১ Times of India. 18 September 1923.
৬২ Manubhai Mehta to Gaikwad, 5 October 1923. BRO, Confidential Department 273.
৬৩ Bombay Chronicle. 30 November 1923.
৬৪ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৬৫ Bombay Chronicle, 11 December 1923.
৬৬ Bombay Chronicle, 28 January 1924.
৬৭ মেহতা, ‘কালীপরজ কে রানিপরজ’, পৃ ৪৪৬।
৬৮ Reports of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay. 1922-23, vol. I. p. 45.
৬৯ তদেব, পৃ. ৫০।
৭০ M. S. Jayakar to Macmillan, 16 November 1922, BA. H. D. (Sp.), 1922 সালের 637 নং।
৭১ Macmillan to Crerar, 1 December 1922, তদেব।
৭২ Report by Macmillan, 19 January 1923, তদেব।
৭৩ Reports of 12 and 13 January 1923, তদেব।
৭৪ Report by Macmillain, 20 January 1923, তদেব।
৭৫ Report of 10 February 1923, তদেব।
৭৬ Land Revente Administration Report of the Bombay Presidency for 1922-3. p. 43.
৭৭ বিশদ আলোচনার জন্য দ্র. বি. পি. বৈদ্য রচিত কুঁয়ারজী মেহতার জীবনী, রেন্তিমা বাহন, পৃ. ১৬৫-৭৭।
৭৮ তদেব, পৃ. ১৭০।
৭৯ Bombay Chronicle, 7 February 1923. বরোদার পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট, 25 January 1923, BRO, Confidential Department 327.
৮০ রেন্তিমা বাহন, পৃ. ১৭১। রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ২৫-৬।
৮১ রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ৭০।
৮২ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৮৩ তদেব, পৃ. ২৯।
৮৪ জগৎরাম দাভে, খাদিভক্ত চুনিভাই (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৬৬), পৃ ১৩-২০।
৮৫ রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ৫২-৩।
৮৬ তদেব, পৃ. ৫৩-৪, ঐ সময়ের মধ্যে চুনিলাল মেহ্তা ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে ৫২০টি চরকা বিক্রি করে ফেলেছেন। তদেব, পৃ. ৭২
৮৭ তদেব, পৃ. ৭১।
৮৮ Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency for 1923-4. pp. 39-40.
৮৯ B.H. Mehta, ‘Social and Economic Conditions of the Chodhris’,p. I78. সংস্কার আন্দোলনের ফলে মাঝে মাঝেই আদিবাসীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এই ধরনের বিভেদ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংস্কারপ্রাপ্ত গোষ্ঠীটি একটি পৃথক জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণের জন্য দ্র. Roy. পূর্বোক্ত, pp. 286-90.
৯০ এই জমি যে সুষমভাবে বণ্টিত হয়েছিল, তার কোনও মানে নেই, বৃহৎ আদিবাসী ভূস্বামীদের সুবিধেই হয়েছিল বেশি, যার ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বছরগুলি সম্পন্ন এবং দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যে মেরুপ্রমাণ ব্যবধান গড়ে দেয়। Ghanshyam Shah, ‘Tribal Identity and Class Differentiations: A Case Study of the Chodhri Tribe’, Economic and Political Weekly. Annual Number, February 1979, pp. 459-65.
ইতিহাসের উত্তরাধিকার – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
১
সম্প্রতি উগ্রহিন্দুর আক্রমণে সেকুলার মতাবলম্বীরা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ভারতবর্ষ যে নানা ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর মিলনভূমি, ভারতের জাতীয়তা যে ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের স্বার্থ যে আসলে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী—এসব কথা এখনও বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব এসে পড়েছে। ওদিকে উগ্রহিন্দুরা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, গণতান্ত্রিক ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও হিন্দুর স্বার্থ কেন স্বীকৃত হবে না, অথচ সংখ্যালঘুর স্বার্থ কেন মর্যাদা পাবে? রাষ্ট্রের আইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেওয়াটাই তো সাম্প্রদায়িকতা, তা তুলে দেওয়ার দাবিই যথার্থ সেকুলার রাষ্ট্রের দাবি। উগ্রহিন্দু আরও বলছেন, বিদেশি আক্রমণের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে প্রকৃত জাতীয়তার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হবে; এক্ষেত্রে ইংরেজ যে-অর্থে বিদেশি, পাঠান বা মুঘল শাসকেরাও সেই অর্থেই বিদেশী। উগ্রহিন্দুর অভিযোগ, এই দাবির বিরোধিতা করে সেকুলাররা প্রকৃত জাতীয়তারই বিরোধিতা করছেন।
প্রকৃত জাতীয়তার সংজ্ঞা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষ্য একটা বিরাট ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। অযোধ্যায় মসজিদের ব্যাপারে সেকুলার ঐতিহাসিকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে সেখানে আদৌ কোনও মন্দির ছিল না। একাধিক রাজনৈতিক দল, এমন কি সরকারের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে প্রত্নতত্ত্ব আর ইতিহাসের সাক্ষ্য বিচার করে স্থির হোক, বাবরি মসজিদ তৈরি হওয়ার আগে সেখানে কোনও মন্দির ছিল কি না। যেন মন্দির থেকে থাকলে উগ্রহিন্দুর দাবি যথার্থ বলে প্রমাণিত হবে। সেকুলার ইতিহাসচর্চার সংকট এইখানেই—আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান। সত্যি বলতে কি, বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলে একটা সাংঘাতিক সত্য বেরিয়ে আসবে। সেটা হল যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদেরই প্রতিচ্ছবি, আয়নায় মুখ দেখার মতো—তার রূপ, আকৃতি, গড়ন, অবিকল এক।
অন্য অঞ্চলের কথা বলতে পারব না, বাংলার ইতিহাসচর্চার ইতিহাস থেকে এরকমই দেখতে পাচ্ছি।
২
বঙ্কিম যে অত ক্ষোভ করে বলেছিলেন ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই’, তাঁর ক্ষোভের অনেক কারণ ছিল বটে, কিন্তু কথাটা তিনি সম্পূর্ণ সত্যি বলেননি। ইতিহাস যথেষ্টই ছিল। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস সমালোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিম ঐ প্রবন্ধেই বলেছেন, ‘বালকশিক্ষার্থে যে সকল পুস্তক বাঙ্গালা ভাষায় নিত্য নিত্য প্রণীত হইতেছে…’ ইত্যাদি। ইতিহাসের বই লেখা হচ্ছিল অনেক। বঙ্কিমের আপত্তি, তাতে বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস থাকছিল না। এই প্রকৃত ইতিহাস কী, তা নিয়েও বঙ্কিমের মত ছিল স্পষ্ট। প্রকৃত ইতিহাস হল পূর্বপুরুষের গৌরবের স্মৃতি। ‘এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে, কীৰ্ত্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীৰ্ত্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙ্গালী।’ কথাটা যে কতটা লজ্জার তা বোঝাবার জন্য বঙ্কিম তারপর জুড়ে দিয়েছেন, ‘উড়িয়াদিগেরও ইতিহাস আছে’। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আসলে তাঁর ক্ষোভ হল, বাঙালির স্বরচিত বাংলার ইতিহাস নেই। ‘আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই’। কেন? কারণ সাহেবরা কেবল বিজাতীয় মুসলমানদের সাক্ষ্য অবলম্বন করে বাংলার ইতিহাস লিখেছেন, তাতে বাঙালির সাক্ষ্য নেই। বাঙালির কাছে এই ইতিহাস গ্রহণীয় নয়। ‘আত্মজাতি গৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়।’ তার পর এই ‘স্বকপোলকল্পিত’ ইতিহাসের মুসলমান লেখকদের ওপর বঙ্কিমের উষ্মা—‘গোহত্যাকারী, ক্ষৌরিতচিকুর’ ইত্যাদি— তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য সত্ত্বেও এগুলো নিছকই গালাগাল, সুতরাং উদ্ধৃতি না বাড়ানোই ভাল।
বিদেশি শাসকের লেখা ইতিহাসে পরাধীন জাতি তার নিজের কথা খুঁজে পাবে না, নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে—জাতীয়তাবাদের এ হল প্রাথমিক শ্লোগান। স্বরচিত ইতিহাসের অভাব নিয়ে বঙ্কিমের ক্ষোভ নিঃসন্দেহে তাঁর জাতীয়তাবাদেরই প্রকাশ।১ কিন্তু এখানে প্রথম যা লক্ষণীয় তা হল, পরাধীন স্বজাতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্কিম যদিও কখনও বলছেন ‘বাঙ্গালী’, কখনও বলছেন ‘ভারতবর্ষীয়’, উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু মুসলমান শাসক বিদেশী, আক্রমণকারী। (বাংলার স্বাধীন সুলতানদের নিয়ে অবশ্য কিছুটা দোটানা আছে বঙ্কিমের ভাবনায়, সে প্রসঙ্গে পরে আসব।) দ্বিতীয় লক্ষণীয়: ‘হায়! বাঙ্গালীর ঐতিহাসিক স্মৃতি কই?’ বলে তিনি যখন আক্ষেপ করছেন, তখন যে-ইতিহাসবোধ তাঁর কাম্য তা কিন্তু কোনও ‘দেশী’ ইতিহাসবোধ নয়। এই ঐতিহাসিক স্মৃতির কাঠামো সম্পূর্ণ আধুনিক এবং ইউরোপীয়। তৃতীয়, ১৮৮০ সালে বঙ্কিম যখন আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে’, ততদিনে কিন্তু অনেক বাঙালি লেখকই বাংলা এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখেছেন। সে-সব বই বিস্তর লোক পড়ত। প্রতি বছর নতুন সংস্করণ বেরোত, এমন বইও ছিল তার মধ্যে। বঙ্কিম সেগুলিকে ‘বালপাঠ্য’ বলে অবজ্ঞা করলেও আশ্চর্যের কথা হল এইসব বই-এর লেখকদের ইতিহাসবোধ কিন্তু বঙ্কিমেরই অনুরূপ। তৎকালীন ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ইতিহাস-লেখকদের মধ্যে বঙ্কিম মোটেই ব্যতিক্রম ছিলেন না।২
৩
এই ইতিহাসবোধ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। উনিশ শতকের গোড়ায় লেখা ইতিহাসের বই সম্পূর্ণ অন্য ঐতিহাসিক স্মৃতি ধারণ করে আছে। ঐ গোড়ার যুগের সবচেয়ে সুলিখিত বইটির কথাই ধরা যাক—মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের রাজাবলি (১৮০৮)।৩ সাহেবদের ফরমায়েশে লেখা কিন্তু বাংলা ছাপা বই-এর মধ্যে প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাসটি লিখতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে (আনুমানিক ১৭৬২-১৮১৯) যে নতুন করে গবেষণা করতে হয়েছিল, এমন মনে হয় না। তাঁর রচনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, ইতিহাসের ঘটনা এবং তার পারম্পর্য সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণ নিশ্চিতি। দিল্লি ও বাংলার সিংহাসনে ‘যে যে রাজা ও বাদশাহ ও নবাব হইয়াছেন’, তার একটা প্রচলিত বিবরণই মৃত্যুঞ্জয় লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলার পণ্ডিতসমাজ, বিশেষ করে কুলগ্রন্থ-রচয়িতাদের মহলে যে এ-রকম একটা ইতিহাস সুপ্রচলিত ছিল, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।৪ বাঙালির ঐতিহাসিক স্মৃতি অবশ্যই ছিল।
এই স্মৃতিকথনে কালপরিমাপের ব্যবস্থা ছিল নিশ্ছিদ্র। মৃত্যুঞ্জয়ের ইতিহাস শুরু হচ্ছে এইভাবে:
পিতৃকল্পাদি ত্রিংশত কল্পের মধ্যে ঘটীযন্ত্রের ন্যায় কালচক্রের ভ্ৰমণবশতো বর্ত্তমান শ্বেতবরাহ কল্প যাইতেছে একৈক কল্পেতে চতুর্দ্দশ মনু হয় তাহাতে শ্বেতবরাহ কল্পের মধ্যে বৈবস্বত নামে সপ্তম মনু যাইতেছে। একৈক মনুতে ২৮৪ দুই শত চৌরাশি যুগ হয়। তাহার মধ্যে বৈবস্বত নামে সপ্তমে মনুতে ১১২ এক শত বার যুগের যুগ এই কলিযুগ যাইতেছে। ইহার পরিমাণ ৪৩২০০০ চারি লক্ষ বত্রিশ হাজার বৎসর ইহার মধ্যে ১৭২৬ সতের শত ছাব্বিশ শকাব্দ পর্য্যন্ত গত ৪৯০৫ চারি হাজার নয় শত পাঁচ বৎসর। বাকি ৪২৭০৯৫ চারি লক্ষ সাতাইশ হাজার পঁচানব্বুই বৎসর। (পৃ. ৩-৪)
বছর গোনার হিসেবও একই রকম সুনিশ্চিত—কলিযুগের শুরু থেকে শেষ অবধি কোনও ফাঁক নেই। প্রথম ৩০৪৪ বছর ধরে প্রচলিত ছিল যুধিষ্ঠির রাজার শক। তার পরের ১৩৫ বছর বিক্রমাদিত্য রাজার শক। এই দুই শক গত।
বর্ত্তমান নর্মদা নদীর দক্ষিণ তীরে শালিবাহন নামে রাজার শক যাইতেছে এ শক বিক্রমাদিত্য রাজার শকের পর ১৮০০০ আঠার হাজার বৎসর থাকিবে তাহার পর বিজয়াভিনন্দন নামে রাজা চিত্রকূট পর্বত প্রদেশে হইবেন তাহার শক শালিবাহন রাজার শকের পর ১০০০০ দশ হাজার বৎসর পর্য্যন্ত হইবে।
তাহার পর পরিনাগার্জুন নামে এক রাজা হইবেন তাহার শক এই কলির ৮২১ আট শত একুশ বৎসর শেষ থাকা পর্যন্ত থাকিবে তাহার পর সম্ভল দেশে গৌতব্রাহ্মণের ঘরে কল্কিদেবের অবতার হইবে এই মতে ৬ ছয় শককৰ্ত্তা রাজারদের মধ্যে ১ এক গত ১ এক বর্তমান ও তিন ভাবী। (পৃ. ৮)
এই কালগণনা পদ্ধতির আর যাই দোষ থাক, অনিশ্চয়তার অভিযোগ নিশ্চয় আনা যাবে না এর বিরুদ্ধে।
কালের মতো স্থানের ব্যাপারেও মৃত্যুঞ্জয় সমান সতর্ক। এই ইতিহাস কোথাকার ইতিহাস?
আকাশ বায়ু তেজো জল ভূমি এই পঞ্চভূতের মধ্যে পৃথিবীর আট আনা অন্য অন্য আকাশাদি চারিভুতের দুই দুই আনা…এই ভূমিপিণ্ডের অর্ধ্বেক লবণ-সমুদ্রের উত্তর এই জম্বুদ্বীপ। …এই পৃথিবী সপ্তদ্বীপা। এ সপ্তদ্বীপের মধ্যে জম্বুদ্বীপ নামে এই দ্বীপ। এই জম্বুদ্বীপ নয় খণ্ড…এই নববর্ষের মধ্যে ভারতবর্ষ নামে পৃথিবীর নব ভাগের এক ভাগ এই। ভারতবর্ষের নব ভাগ সে সকল ভাগের নাম এই ঐন্দ্র কসেরু তাম্রপর্ণ গভস্তিমত নাগ সৌম্য বারুণ গন্ধর্ব কুমারিকা এই নবখণ্ডের মধ্যে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা যাহাতে আছে সে কুমারিকা খণ্ড এই।
আর আর খণ্ড সকলের মধ্যে অন্ত্যজ লোকের বসতি। (পৃ. ৪-৬)
এহেন যে সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, তার মধ্যে জম্বুদ্বীপ, তার আবার নয় বর্ষ ইত্যাদি, সেই পৃথিবীর শাসনকর্তাদের ইতিহাস রাজাবলি। ইতিহাসের শুরু কোথায়?
পরেমশ্বর এই পৃথিবীর পালন নিমিত্ত ইক্ষ্বাকু নামে অশ্বত্থ বৃক্ষরূপ রাজাকে সত্যযুগে প্রথমত আরোপিত করিয়াছিলেন ঐ রাজার স্কন্ধ শাখাদ্বয় রূপ সূৰ্য্যবংশ ও চন্দ্রবংশ এই দুই বংশের ধারাবাহিক সন্তান-পরম্পরাতে চারি যুগে এই পৃথিবী মণ্ডল অধিকৃত ছিলেন। এই উভয়বংশীয় রাজারদের মধ্যে মহত্তম ধর্ম্ম তপোবল প্রভাবে কেহ কেহ সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর শাসন করিয়াছেন কেহ্ কেহ্ মহত্তর ধর্ম্ম তপস্যা বল ও প্রতাপে জম্বুদ্বীপ মাত্রের অধিকার করিয়াছেন। কেহ কেহ মহাধর্ম্ম তপোবল বশতঃ ভারতবর্ষ মাত্রের অধিকার করিয়াছেন কেহবা কুমারিকা খণ্ড মাত্রের রাজা ছিলেন এই দুই বংশের রাজারদের মধ্যে একতর সম্রাট হইলে অন্যতর মণ্ডলেশ্বর হইতেন। ইহারদের বিবরণ পুরাণেতিহাসাদি শাস্ত্রে বিস্তারিত আছে। (পৃ. ৬-৭)
কয়েকটা কথা এখানে পরিষ্কার বলে রাখা যাক। মৃত্যুঞ্জয়ের ধারণায় পৃথিবীর প্রতিপালক শাসনকর্তারা পরমেশ্বর প্রেরিত। ধর্মের তপস্যাবলে তাঁরা এই অধিকার ভোগ করেন। সেই তপস্যা শুধু মহৎ, না মহত্তর, না মহত্তম, তার ওপর নির্ভর করছে এঁদের আধিপত্যের সীমানা। মহত্তম ধর্মতপস্যার প্রভাবে সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি হওয়াও সম্ভব ছিল। এমন ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের ইতিহাসকে আমরা অনেকেই হয়তো ইতিহাস বলে মানতে রাজি হব না, যদিও একটু পরেই দেখা যাবে যে নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিও এই ধারণার সঙ্গেই গ্রথিত হয়ে রয়েছে। যাই হোক, অকারণ ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মৃত্যুঞ্জয়ের কাহিনীগুলিকে ওঁরই সূত্র অনুসারে বলা যাক—‘পুরাণেতিহাস’।
তবে পুরাণ হোক আর যা-ই হোক, রাজাবলি-র হিসেবে কোনও ফাঁক নেই। ‘এই কলির আরম্ভ অবধি ৪২৬৭ চারি হাজার দুই শত সাতষট্টি বৎসর পর্যন্ত ১১৯ এক শত উনিশ জন নানাজাতীয় হিন্দু দিল্লীর সিংহাসনে সম্রাট হন।’ (পৃ. ১০) গণনা শুরু হচ্ছে রাজা যুধিষ্ঠির থেকে—হ্যাঁ, সেই মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠির। তাঁর রাজত্বের শুরু থেকে ২৮ জন ক্ষত্রিয় রাজা ১৮১২ বছর শাসন করেন। ‘এই পর্য্যন্ত কলিতে বাস্তব ক্ষত্রিয় জাতির বিরাম হইল।’ তার পর এল ‘মহানন্দ নামে ক্ষত্রিয়ের ঔরসেতে শূদ্রা গর্ভজাত’ নন্দবংশীয় ১৪ জন রাজার ৫০০ বছরের শাসন। ‘এই নন্দ অবধি রাজপুত জাতির সৃষ্টি হয়।’ এর পর বৌদ্ধ রাজাদের পালা—‘গৌতম বংশজাত বীরবাহু, অবধি আদিত্য পৰ্য্যন্ত নাস্তিক মতাবলম্বি ১৫ পনের জনেতে ৪০০ চারি শত বৎসর। এই সময়ে নাস্তিক মতের অত্যন্ত প্রচার হওয়াতে বৈদিক ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন প্রায় হইয়াছিল।’ তার পর বিচিত্র সব রাজবংশের তালিকা—ময়ূর বংশীয় নয় জন, ষোল জন যোগী, চার জন বৈরাগী ইত্যাদি। অবশ্য ‘বিক্রমাদিত্যেরা পিতাপুত্রে দুই জনেতে ৯৩ বৎসর’ আছেন। আর আছেন ‘ধী সেন অবধি দামোদর সেন পৰ্য্যন্ত বঙ্গদেশীয় বৈদ্য জাতি ১৩ তের জনেতে ১৩৭ এক শত সাইত্রিশ বৎসর এক মাস৷’ সেনেরা বঙ্গদেশীয় বৈদ্য জাতি এবং দিল্লির সিংহাসনে! তার পর ‘চোহান রাজপুত জাতি’-র রাজত্বের শেষে
পৃথারায় এক জনেতে ১৪ চৌদ্দ বৎসর সাত মাস।…এই পর্য্যন্ত হিন্দু রাজারদের সাম্রাজ্য ছিল।
তাহার পর মুসলমানেরদের সাম্রাজ্য হইল। যবনদের সাম্রাজ্য হওয়া অবধি ১৭২৬ শকাব্দ পর্য্যন্ত ৫১ জনেতে ৬৫১ ছয় শত একান্ন বৎসর তিন মাস আটাইশ দিন গত হইয়াছে। (পৃ. ১২-৩)
পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা ছাড়াও এই তালিকার বৈশিষ্ট্য হলো বংশানুক্রমিক পারম্পর্যে মহাভারতের চরিত্র থেকে মগধের সম্রাট পর্যন্ত অনায়াসে চলে আসা। এবং রাজবংশের পারম্পর্যে ‘আমীর তৈমুরের সন্তান’ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম পর্যন্ত এসে তালিকা শেষ করা। পুরাণ, ইতিহাস এবং সমসাময়িক, সবটাই একই কালানুক্রমিক ছকে বাঁধা, একটার সঙ্গে আর-একটার কোনও বিরোধ নেই, একটা থেকে আর-একটাতে যেতেও তাই কোনও অসুবিধা নেই। বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে-সব আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তার আভাসটুকুও নেই। ইংরেজের ফরমায়েশে লেখা হলেও রাজাবলি-র ইতিহাসবোধ সম্পূর্ণ প্রাক-ঔপনিবেশিক।
তাই হিন্দু রাজবংশের অবসান আর ‘যবন সম্রাট’-দের অভ্যুত্থানের বিষয়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের মতো এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কী বলেন, তা জানতে কৌতূহল হয়। আরও কৌতূহল হয় যখন দেখি যে শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি-র হাতে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের বিবরণ জড়িয়ে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে। কাহিনীটা এইরকম।
পৃথ্বীরাজের পিতার দুই স্ত্রী ছিল। এক স্ত্রী মানুষের মাংস খেত। স্বামীকেও সে নরমাংস খাওয়া অভ্যেস করায়। অপর স্ত্রীর পুত্রকে একদিন সেই রাক্ষসী খেয়ে ফেলে। অপর স্ত্রী তখন পালিয়ে ভাইয়ের আশ্রয়ে যায় এবং সেখানে এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। তার নাম হয় পৃথু। পৃথু বড় হয়ে তার পিতার সঙ্গে মিলিত হয়। পিতার অনুরোধে পৃথু তার পিতার শিরচ্ছেদ করে একুশ জন স্বজাতীয় স্ত্রীলোককে সেই মাংস খাওয়ায়। পরে রাজা হয়ে পৃথু সেই একুশ জনের পুত্রকে তার সামন্ত করে। ‘এইরূপে পৃথুরাজার পিতৃহত্যা করাতে পূৰ্ব্ব হইতেও অধিক অখ্যাতি দিনে দিনে বাড়িতে লাগিল ও পূৰ্ব্বে যে রাজারা কর দিত তাহারা কেহ কর দিল না।’ মোট কথা রাজা হিসেবে পৃথ্বীরাজ বড় একটা লোকমান্য ছিলেন না।
এমন সময় শিহাবুদ্দিন ঘুরির আক্রমণ উপস্থিত হলো।
রাজা যবনদের প্রাগল্ভা শুনিতে পাইয়া অনেক বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরদিগকে আনাইয়া কহিলেন হে পণ্ডিতেরা এমন কোনহ যজ্ঞের আরম্ভ কর যাহাতে যবনেরদের প্রতিভা ও প্রাগল্ভা উৎরোত্তর হ্রাস হয়। পণ্ডিতেরা আজ্ঞা করিলেন হে মহারাজ এমন যজ্ঞ আছে আমরা কহিতেও পারি কিন্তু আমরা যে সময়ে অবধারণ করিব সে সময়ে যজ্ঞের যূপস্থাপন যদি হয় তবে সে যূপ যাবৎ থাকিবে তাবৎ যবনেরা এ দেশে কখনও আসিতে পারিবে না। রাজা পণ্ডিতেরদের এই বাক্যে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া বড় সমারোহ করিয়া যজ্ঞের আরম্ভ করিলেন। যূপস্থাপনের সময় হইলে পণ্ডিতেরদের অনুমতি মাত্রে যূপস্থাপন করিতে যূপ উঠাইতে নানা যত্ন করিলেন যূপ কদাচ উঠিল না। তদনন্তর পণ্ডিতেরা কহিলেন হে মহারাজ ঈশ্বরের যে ইচ্ছা সেই হয় পুরুষ ঈশ্বরেচ্ছার ওপর প্রবল নয় কিন্তু তাহার সহকারী বটে ঈশ্বরেচ্ছা সহকৃত পুরুষ কার্য্যসাধক হয় অতএব নিবৃত্ত হও বুঝি এ সিংহাসন যবনাক্রান্ত হইবে।
পণ্ডিতদের কথায় পৃথ্বীরাজ ‘যুদ্ধে শৈথিল্য করিলেন’। শিহাবুদ্দিন শত্রুসৈন্য ধ্বংস করে দিল্লি পৌঁছে গেলেন। পৃথ্বীরাজ তখন
অন্তঃপুর হইতে নির্গত হইয়া শাহাবুদ্দীনের সহিত ঘোরতর রণ করিলেন কিন্তু ঈশ্বরেচ্ছাতে শাহাবুদ্দীন যবন ঐ রঙ্গভূমিতে পৃথুরাজাকে ধরিয়া পৃথুরাজা জয়চন্দ্র রাজার জামাতা হন [স্মরণীয়, জয়চাঁদ ইতিমধ্যেই মুহম্মদ ঘুরির সহায়তা করেছেন] এই অনুরোধে তাহাকে নষ্ট করিলেন না কিন্তু কএদ করিয়া খাড়া খাড়া আপন দেশে গজনেনে পাঠাইয়া দিলেন। (পৃ. ১০৯-১০)
আবার মনে করিয়ে দিই, রাজবংশের পত্তন হয় ঈশ্বরেচ্ছায়। ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে তবেই সেই রাজত্ব বজায় থাকে। নরমাংস ভক্ষণ এবং পিতৃহত্যার মতো চরম পাপাচারের দোষ লেগেছিল চৌহান রাজবংশে। পৃথ্বীরাজ যে ঈশ্বরের বিরাগভাজন হয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল যজ্ঞের আসরে। সুতরাং মুহম্মদ ঘুরির যুদ্ধজয় এবং ‘যবন রাজত্ব’-র প্রতিষ্ঠা একান্তই ঈশ্বরের ইচ্ছায় সম্পন্ন ঘটনা: ‘পুরুষ ঈশ্বরেচ্ছার ওপর প্রবল নয় কিন্তু তাহার সহকারী বটে ঈশ্বরেচ্ছা সহকৃত পুরুষ কাৰ্যসাধক হয়’। মৃত্যুঞ্জয়ের অর্ধশতাব্দী পর যখন পুরাণেতিহাস বর্জন করে দস্তুরমতো ইতিহাস লেখা হবে, তখন কিন্তু থানেসরের যুদ্ধের এই বিবরণ আপাদমস্তক বদলে যাবে। ইংরেজি-শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা ঈশ্বরেচ্ছাকে অত সহজে মেনে নেবেন না।
তবে রাজার অধর্মাচরণের কারণ সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় এর পর আরও দু-একটা কথা বলেছেন। সে আলোচনাটা মৃত্যুঞ্জয় শুরু করছেন এই বলে: ‘শাহাবুদ্দীন যবনের দিল্লীর সিংহাসন অধিকার হওয়ার বিষয়ে যবনেরা যে রূপ বলে তাহা লিখি।’ (পৃ. ১১২-৩) বলতে গিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন মাহমুদ গজনভির পিতা নাসরুদ্দিন সবুক্তগিনের হিন্দুস্থান আক্রমণের সময়ে।
এই নাসরুদ্দীন হিন্দুস্থানে যে সময়ে আইল তখন হিন্দুস্থানের রাজা সকলের পরম্পর একবাক্যতা কাহারও ছিল না এবং যে যে দেশের রাজা সে সে দেশের বাদশাহ করিয়া আপনাকেই জানিত কেহ কাহারও আয়ত্ত ছিল না। এবং এমন রাজা একও ছিল না যে স্বপরাক্রমে অন্য অন্য রাজারদিগকে স্বাধীন করে ইহা অনুসন্ধান করিয়া এ হিন্দুস্থানে যবনেরদের সঞ্চার হইল। কেননা শত্রুসঞ্চারের ও রাষ্ট্র বিভ্রাটের প্রধান কারণ পরস্পর অনৈক্য ও স্ব স্ব প্রাধান্য ও যখন সেকন্দর শাহ যবনস্থানে বাদশাহ হইয়াছিলেন তখন তিনি এ হিন্দুস্থানে একবার আসিয়া দেশের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরদের ধার্ম্মিকতা ও পাণ্ডিত্যাদি দেখিয়া কহিলেন যে এ দেশে এ রূপ হকিমেরা আছেন সে দেশের রাজারদের পরাজয় কখনও অন্য দেশীয় রাজারদের হইতে হইতে পারে না। এই কহিয়া স্বদেশে গেলেন আর কখনও এ হিন্দুস্থানে আইলেন না। সম্প্রতি তাদৃশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের অভাব প্রযুক্ত এ দেশীয় রাজারা দৈববলেতে হীন হইয়া যবন হইতে ক্রমে ক্রমে সকলেই পরাজিত হইলেন। (পৃ. ১২১-২)
সুলতানী ও মুঘল রাজত্বের বিবরণ মৃত্যুঞ্জয় মোটামুটি প্রচলিত ফারসি গ্রন্থ থেকেই নিয়েছেন। হিন্দুস্থানের রাজাদের অনৈক্য কিংবা ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে আলেকজান্ডারের মন্তব্য ফেরিশ্তা বা অন্য কোনও ফারসি ইতিহাসে থেকে থাকতে পারে। কিন্তু রাজারা ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হলেন এবং দৈববলে হীন হয়ে পড়লেন, তার কারণ যে ব্রাহ্মণদের ব্যর্থতা, এই যুক্তি বলা বাহুল্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরই যুক্তি। ধর্মরক্ষা এবং রাজাকে সৎপথে চালিত করা ব্রাহ্মণের কর্তব্য। সেই কর্তব্য তারা পালন করেনি, তাই দেবরোষে হিন্দু রাজত্বের পতন ঘটল এবং দৈব ইচ্ছায় যবনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। ব্রাহ্মণের অধঃপতনের জের হিসেবে ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি অন্যের ওপর গিয়ে পড়ল। পরে দেখব, ইতিহাস-রচনায় দৈব হস্তক্ষেপের ভূমিকা যত ক্ষীণ হয়ে আসবে, এই অধঃপতনের গল্পটা ততই এক সামগ্রিক সামাজিক অবক্ষয়ের কাহিনীতে পরিণত হবে।
মৃত্যুঞ্জয়ের বিবরণে গজনির মাহমুদ কর্তৃক সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের ঘটনার কথা এখানে বলে রাখা যাক। তা হলে পরবর্তীকালের ইতিহাস-রচনার সঙ্গে এর তুলনা করা যাবে। মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা মোটামুটি আমাদের পরিচিত বর্ণনাই—ফারসি সূত্র থেকে নেওয়া। কিন্তু সোমনাথ মন্দিরের বিগ্রহ সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় একটি কথা বলছেন যা পরবর্তীকালে আর কোথাও পাব না। ‘সোমনাথ নামে অতি বড় এক দেব প্রতিমা ছিলেন সে প্রতিমা পূৰ্ব্বে মক্কাতে ছিলেন যবনেরা যে অবধি মনুষ্য সৃষ্টি বলে তদবধি চারি হাজার বৎসর যখন গত হইয়াছিল তখন হিন্দুস্থানের এক রাজা মক্কা হইতে সে প্রতিমা উঠাইয়া আনিয়া ঐ স্থানে স্থাপন করিয়াছিলে…।’ (পৃ. ১২৯) সোমনাথের মূর্তি আদিতে মক্কায় ছিল, কোনও হিন্দু রাজা তা গুজরাটে নিয়ে আসেন, মাহমুদ আবার সেই মূর্তি দখল করে গজনিতে নিয়ে যান—এরকম কাহিনী কোনও ফারসি বইতে আছে কি না বলতে পারব না, কিন্তু পরবর্তীকালে কোনও বাঙালি ঐতিহাসিক যে এ-কথা আর লেখেন নি, তা প্রায় নিশ্চিত।
এই পরের যুগের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে দু-জন মুঘল সম্রাটকে নিয়ে খুব উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, তাই এঁদের বিষয়ে মৃত্যুঞ্জয় কী বলছেন, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। আকবর সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় উচ্ছ্বসিত। ‘শ্রীবিক্রমাদিত্যের পর এই হিন্দুস্থানে এখন পর্য্যন্ত গুণেতে অকবর শাহের সম সম্রাট আর কেহ হয় নাহি।’ (পৃ. ১৯৫) ধর্মরক্ষা ও প্রজার প্রতিপালনে আবশ্যক সবরকম গুণ ছাড়াও আকবরের চরিত্রের যে-দিকটি মৃত্যুঞ্জয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন, সেটা হল যে আকবর ‘নানাবিধ শাস্ত্রজ্ঞান জন্য পারমার্থিক বুদ্ধি প্রতিভাতে মহম্মদের মতে অনাস্থা করিয়া মনে মনে হিন্দুরদের মতেই আস্থা করিতেন অতএব ইরান ও তুরানের রাজারা ইহাকে অনুযোগ করিয়া লিখিতেন।’(পৃ. ১৯১) এমন কি ‘ইনি গোমাংস ভক্ষণ করিতেন না এবং কিল্লার মধ্যেতেও গোবধ বারণ করিয়া দিয়াছিলেন তৎপ্রযুক্ত তদবধি এখনও তাঁহার কিল্লাতে গোবধ হয় না।’ (পৃ. ১৯৪) অপর পক্ষে আওরঙজেব সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন:
ইনি মহম্মুদী মতে অতি বড় তৎপর হইলেন। আর প্রধান প্রধান অনেক দেবস্থান নষ্ট করিলেন। হিন্দুরদের মতে সূৰ্য্যার্ঘ্য ও গণেশপূজাদি দেবকৃত্য সকল বাদশাহি কিল্লার মধ্যে অকবর অবধি নিয়মিত ছিল যে সকল আইনের মধ্যে অনেক আইনের অন্যথা করিয়া স্বকপোলরচিত অনেক আইন জারি করিলেন। (পু. ২১৪)
কিন্তু সেইসঙ্গে আবার একথাও লিখছেন:
ইনি প্রধান প্রধান অনেক দেবস্থানের ব্যাঘাত করিয়াছিলেন কিন্তু জ্বালামুখী ও লছমনবালাতে বিলক্ষণ প্রতিফল পাইয়া তাঁহারদিগকে মানিয়া সেবার্থে অনেক টাকার ভূমি নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। পরে ঐ আওরঙ্গাবাল ১২ বার বৎসর থাকিয়া এক ব্রাহ্মণের শাঁপে বিকৃত শব্দ করিতে করিতে মরিলেন। (পৃ. ২২১)
রাজা যেখানে ঈশ্বরপ্রেরিত, ঈশ্বরের অনুগ্রহেই যেখানে তাঁদের রাজ্যপাটে অধিকার, সেখানে রাজচরিত্রের মতিগতি বিচার করা মোটামুটিভাবে ঈশ্বর আর রাজাদের মধ্যেকার ব্যাপার। সাধারণ প্রজার সেখানে একমাত্র ফলভোগ করা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। অবশ্য ভাল রাজা আর মন্দ রাজার প্রভেদ প্রজা জানে, কারণ সুশাসন কিংবা অপশাসনের ফল সে-ই ভোগ করে। সুতরাং আকবরের মতো মহান সম্রাটের সে গুণগান করে। আবার আওরঙজেব যখন তাঁর দুষ্কর্মের ফলস্বরূপ ‘ব্রাহ্মণের শাঁপে বিকৃত শব্দ করিতে করিতে’ মারা যান, সে-গল্প বলতে বলতে প্রজা যেন দেবরোষের কঠোরতায় খানিক শিউরে উঠে শেষ পর্যন্ত ধর্মের জয় সম্বন্ধে আশ্বস্তই হয়। কিন্তু শাসনকার্যের অনুষ্ঠানের সঙ্গে সে কখনও নিজেকে জড়ায় না, রাজার জায়গায় নিজেকে বসাবার কথা ভাবতেই পারে না। রাজত্বের ইতিহাসে সে নিজের ইতিহাস খোঁজে না। ‘কীর্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তি’ বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে যে সমগ্র জাতির ইতিহাস প্রকাশ করা যায়, এমন কথা মৃত্যুঞ্জয়ের আদৌ বোধগম্য হত বলে মনে হয় না। কয়েক হাজার বছরের রাজপুরুষদের বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁর নিজের অবস্থান একটিই—স্থির এবং অপরিবর্তনীয়। সে অবস্থান প্রজার অবস্থান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি পৃথ্বীরাজের অপকর্মের প্রতিফল যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমনি আকবরের গুণপনাকে ধন্য ধন্যও করেছেন। কিন্তু স্বজাতীয় অথবা বিজাতীয় বলে পৃথ্বীরাজ কিংবা আকবরের কৃতকর্মের ঐতিহাসিক দায় তাঁর ওপর এসে বর্তাতে পারে, এমন সম্ভাবনা তাঁর চিন্তাতেও আসেনি। রাজাবলি জাতীয় ইতিহাস নয়, কারণ ইতিহাসের কর্তা এখানে রাজা এবং দৈবশক্তি; কোনও জাতীয় ঐক্যবন্ধনের সূত্র ধরে ঐতিহাসিকের নিজস্ব চৈতন্য ইতিহাসের কর্তার স্থানটি এখানে দখল করে নিতে পারে নি। বঙ্কিম যে জাতীয় ইতিহাসের কথা বলবেন, তার রচয়িতা যেমন ‘তুমি, আমি, সকলে’, সে-ইতিহাসের কর্তাও তেমনি ‘তুমি, আমি, সকলে’। এই নতুন ইতিহাসবোধে আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার সৌভাগ্য মৃত্যুঞ্জয়ের হয়নি। তাই বাঙালি ব্রাহ্মণ প্রজার একান্ত বিশিষ্ট অবস্থান থেকেই তিনি রাজারাজড়ার কাহিনী বলে গেছেন।
বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসের গল্প শোনাবার সময়ই মৃত্যুঞ্জয়ের অবস্থানটি সব চেয়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। মৃত্যুঞ্জয়ের জন্ম পলাশির যুদ্ধের সামান্য পরে, সুতরাং সেই সময়কার ইতিহাস তাঁর বাল্য-যৌবনের জনশ্রুতি। সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচার সম্বন্ধে তাঁর ঘৃণা প্রবল। ‘বিশিষ্ট লোকেরদের ভার্য্যা ও বধূ ও কন্যা প্রভৃতিকে জোর করিয়া আনাইবাতে ও কৌতুক দেখিবার নিমিত্তে গর্ভিণী স্ত্রীরদের উদর বিদারণ করানেতে ও লোকেতে ভরা নৌকা ডুবাইয়া দেওয়ানেতে দিনে দিনে অধৰ্ম্ম-বৃদ্ধি হইতে লাগিল।’(পৃ. ২৬৮-৯) সিরাজ যখন রাজা রাজবল্লভের ‘জাতিধ্বংস করিতে উদ্যত হইলেন’, তখন রাজবল্লভ কলকাতায় ইংরেজদের শরণাপন্ন হলেন। ইংরেজরা তাঁকে নবাবের হাতে তুলে দিতে রাজি হল না। তখন ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা কম্পানি বাহাদুরের কুঠী ও কলিকাতা শহর লুট করিয়া আপন সৰ্ব্বনাশের হেতু করিয়া মুরশিদাবাদে [গেলেন]।’(পৃ. ২৭০) ইংরেজরা সাময়িকভাবে কলকাতা ত্যাগ করতে বাধ্য হল। এর পরের কাহিনী মৃত্যুঞ্জয়ের কথাতেই শুনুন:
[সাহেব লোকেরা] পুনরায়…আসিয়া কলিকাতা শহরের লুটেতে মহাজন ও মুদি বকালি গৃহস্থ প্রভৃতি লোকেরদের মধ্যে যাহার যে ক্ষতি হইয়াছিল তাহার যে যেমন জায় করিয়া দিলেক তাহাকে তেমনি বেবাক দিয়া খ্বাজে পিৎরুস আরমানি দ্বারা মহারাজ দুর্লভরাম ও ফৌজ বকসী জাফরালী খাঁ ও জগৎ সেঠ মহতাবরায় ও তাঁহার ভ্রাতা মহারাজ স্বরূপচন্দ্র প্রভৃতি কথক প্রধান লোকেরদের সহিত সাহিত্য করিয়া অর্থ ও কিঞ্চিৎ সৈন্য সংগ্রহ করিয়া শরণাগত প্রতিপালনরূপ ধর্ম্মতাকা উঠাইয়া যুদ্ধার্থে পলাশিতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। (প. ২৭১)
যুদ্ধে যা হবার তা তো হল। সিরাজ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালালেন। পরে ধরা পড়লেন।
তাহার পর ঐ জাফরালী খাঁর পুত্র মীরণ সাহেব লোকেরদিগকে ও মহারাজ দুর্লভরাম প্রভৃতিকে সম্বাদ না দিয়াই নবাব সিরাজদ্দৌলার মৃত্যু ভয়েতে নানাপ্রকার কাতরোক্তি না শুনিয়া আপন হস্তে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ঐ ছিন্ন-শরীর হাতির ওপর চড়াইয়া শহর ভ্রমণ করাইয়া ঈশ্বরেচ্ছামতে নবাব মহাবৎজঙ্গের আপন মুনিবের পুত্র অথচ আপন মুনিব নবাব সরফরাজ খাঁকে কপটে মারিয়া নবাব হওয়ার ও অলীভাস্কর প্রভৃতি মহারাষ্ট্রেরদের সরদার লোকেরদিগকে কপটে কাটাইবার ও স্বয়ং সিরাজদ্দৌলার বলাৎকারে পরস্ত্রীদিগের আনয়ন প্রভৃতি দৌরাত্ম্যের প্রতি ফল লোকতঃ প্রকাশ করিল। (পৃ. ২৭৬)
ঈশ্বরেচ্ছার সহকারী হলেন মীরন, সিরাজ তাঁর দুষ্কর্মের ফল ভোগ করলেন। কিন্তু মীরনের পরিণাম কী হল?
তদনন্তর নবাব মীরণ আজীমাবাদ হইতে মুরশিদাবাদে আসিতেছেন পথে রাজমহল মোকামে নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামী করার ফলস্বরূপ বজ্রাঘাতে মরিলেন। এইরূপে নবাব মীরণ মরিলে পর তাহার কবরের ওপরেও দুইবার বজ্রাঘাত হইল। (পৃ. ২৮১)
আর মীরজাফর? ‘এইরূপে নবাব জাফরালী খাঁ পুনর্বার দুই বৎসর সুবেদারী করিয়া সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামীর ফল গলৎকুষ্ঠ রোগে অতিশয় ব্যামোহ পাইয়া মরিলেন।’ (পৃ. ২৮৯)
ইতিহাসের প্রধান শক্তি দৈব। তার ক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত জয় হয় ধর্মের। এই বিশ্বাস নিয়েই মৃত্যুঞ্জয় বাংলার ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম পর্বের কথা বলে তাঁর কাহিনী শেষ করছেন। তখন তাঁর অবস্থান কোম্পানিরূপ বৃক্ষের একেবারে নীচে আলবালের ভেতর—সেই কোম্পানি যে শরণাগতের প্রতিপালনের দায় কাঁধে নিয়ে ধর্মপতাকা উড়িয়ে পলাশির যুদ্ধ জিতেছে।
এইরূপে নন্দবংশজাত বিশারদ অবধি শাহ আলম বাদশাহ পর্যন্ত ও মুনইম খাঁ নবাব অবধি নবাব কাসমলী খাঁ পৰ্য্যন্ত কোন কোন সম্রাট রাজারদের ও নবাবদের ও তাঁহারদের চাকর লোকেরদের স্বামিদ্রোহাদি নানাবিধ পাপেতে এই হিন্দুস্থানের বিনাশোন্মুখ হওয়াতে পরমেশ্বরের ইচ্ছামতে ঐ হিন্দুস্থানের রক্ষার্থ আরোপিত কম্পানি বাহাদুরের অধিকার রূপ বৃক্ষের পুষ্পিতত্ত্ব ও ফলতত্ত্বের সমাবধায়ক যে বড় সাহেব তৎকর্ত্তৃক ঐ কম্পানি বাহাদুরের অধিকার রূপ বৃক্ষের আলবালতে নিরূপিত পাঠশালার পণ্ডিত শ্রীমৃত্যুঞ্জয় শর্মাকর্তৃক গৌড়ীয় ভাষাতে রচিত রাজতরঙ্গ নামে গ্রন্থ সমাপ্ত হইল। (পৃ. ২৯৪-৫)
মনে রাখা যাক, ঈশ্বরেচ্ছায় কোম্পানির অধিকার লাভ। উদ্দেশ্য প্রজার প্রতিপালন। সেই উদ্দেশ্য সাধিত না হলে, প্রজাপালনের পরিবর্তে উৎপীড়ন হলে, দৈবশক্তির ক্রিয়ায় রাজ্যাধিকার আবার অন্যের হাতে ন্যস্ত হবে, আবার ধর্মের জয় হবে।
৪
আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবোধ শিক্ষিত বাঙালির মনে গেঁথে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এরকমই ছিল ঐতিহাসিক স্মৃতির গড়ন। মৃত্যুঞ্জয়ের রচনায় এই স্মৃতির একটা বিশেষ ধরনের প্রকাশ ঘটেছে যা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি ব্রাহ্মণ-সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাক-ব্রিটিশ যুগের মুসলমান লেখকদের ইতিহাসচিন্তাও কি একই রকম ছিল? পাঠান বা মুঘল শাসকশ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত দরবারের ঐতিহাসিকদের কথা এখানে উঠছে না, কারণ সে-সব তারিখ-সাহিত্য বাংলায় লেখা হতো না। বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে ভারতবর্ষ বা বাংলার রাজারাজড়ার ইতিহাস নিয়ে যে-ধরনের রচনা প্রচলিত ছিল, তার একটা নমুনা দিলে দেখা যাবে যে ইতিহাসে দৈবশক্তির প্রভাব, কৃতকর্মের প্রতিফল এবং পরিশেষে ধর্মের জয়, এই লক্ষণগুলি সেখানেও সমানভাবেই উপস্থিত। নমুনাটির ছাপার সময় অবশ্য অনেক পরে, ১৮৭৫ সালে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ কবিদের লেখা পুঁথিসাহিত্যের আদলটি এখানে এতই স্পষ্ট এবং ইউরোপীয় ইতিহাসশিক্ষার প্রভাব এমনই অনুপস্থিত যে ধরে নিতে অসুবিধা নেই, বরিশালের কবির ব্যবহৃত ‘দীল্লির রাজাদির নাম’ বিবৃত করার ছকটি অনেক দিনের প্রচলিত একটি ছক।৫ ‘শ্ৰীযুক্ত মুন্সী আলিমদ্দিন দ্বারায় বিরচিত নিবাস রুকন্দী থানে মেহেন্দিগঞ্জ’ এই তালিকাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে :
দীল্লিনাম কিহেতু হইল হিন্দুস্থান।
আদ্যন্ত নৃপতি গণ নির্ণয় বিধান ॥
এই নির্ণয় কিন্তু হিন্দু লেখকের পক্ষে করা সম্ভব নয়:
হিন্দুগণ চৌযুগী যে, কহয় তাহারে।
সৰ্ব্বত্রে মরম এরা বুঝিবারে নারে ॥
সত্য ত্রেতা দ্বাপরাদি কলি চারিযুগ।
হিন্দুতে রাজত্ব তথা করে সুখভোগ ॥
এই মুখবন্ধের পর ‘সাহাআলম বাহাদুর বাদসাহেগাজী’ পর্যন্ত ৫৯ জন বাদশাহের নামের তালিকা। কেবল নামেরই তালিকা; কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা বা বাদশাহ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য, কিছুই নেই। তারপর ঘটল দৈবের এক আশ্চর্য কাণ্ড।
দৈবেতে ইংরাজ আইলেন এ আলয়।
করিলেন নবাবেরে যুদ্ধে পরাজয় ॥
ইংরাজ লইল রাজ্য বেশির পাইয়া।
তদবধি রাজত্ব মহারাণী ভিক্টোরিয়া ॥
কুমার সিংহের দফা সারিয়ে কোম্পানি।
ইজারা বর্খাস্তে এসে খাস মহারাণী ॥
১৮৫৭-র সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কুঁয়ার সিং-এর বিদ্রোহ দমন, এটাও বেশ আশ্চর্যের। এর পর মহারাণীর রাজত্বের স্তুতি এবং আধুনিক শিল্পের অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানার ফিরিস্তি।
সাশিতের সীমা বিচারের একশেষ।
যাঁহার আমলে নাহি প্রজাদের ক্লেশ ॥
আছিল কড়ির চল দিল উঠাইয়া।
পয়সা হতে যথা যেই লইছে কিনিয়া ॥
ডাকেতে চালায় লোকে খবরাখবর।
গ্যাসের বাতিতে আলো করিল সহর ॥
আগ্বোটে মানিল হারি পিনিস্ আর নায়।
রেলেতে সপ্তাহ পথ দণ্ডকেতে যায় ॥
কলিকাতা বসিয়ে বিলাতে কে কি করে।
পলকেতে পায় তত্ত্ব তারের নির্ভরে ॥
ন্যায় বিচারে কার অন্যায় যদি হয়।
অপর আফিসে তাহা শুধরিয়ে লয় ॥
কিন্তু এমন যে সুশাসিত মহারাণীর রাজত্ব, তার পরমায়ু কতদিন?
প্রজাদের সুভাগ্যে রাজত্ব মহারাণী।
পরেতে প্রজার ভাগ্যে কি হয় না জানি ॥
বিশেষ করে ইংরেজরা যদি তুরস্ক অধিকার করে বসে, তা হলে এক সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবে।
যবে রূম আমল করিবেন সে রাণি।
মক্কা ও মদিনা বাকি রহিবেক জানি ॥
হাহাকার রাজ্যেতে হইবে উৎপাত।
সবজাত ভাঙিয়ে হইবে এক জাত ॥
কিন্তু তার পর নানা প্রলয়ংকর ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার সুধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে।
উত্তরিবে ইসানবি হইতে আকাশ।
পুনঃ মুসলমানি মত পাইবে প্রকাশ ॥
পূর্ব্ব কি পশ্চিম আদি উত্তর দক্ষিণ।
তবেসে হইবে খণ্ড প্রলয়ের চিন ॥
আয়াত কুদ্দিয়াতে এহেন নিরূপণ।
হাদিস হইতে যাহা উত্তম গণন ॥
পশ্চিমেতে উদয় হইলে দিবাকর।
তোবাদ্বার আবদ্ধ জানহ তদন্তর ॥
হাতেক দো উপরে উঠিয়া দিনমণি।
অস্ত হইবেক দীর্ঘ হইবে রজনি ॥
হবে রাত্র ছ সাত রাত্রের পরিমিত।
জাগিয়া ভাবিয়া লোক হইবে নিদ্রিত ॥…
হিজিরি সন তেরশত হইলে পূরণ।
চৌদ্দশত না পূরিতে জান সৰ্ব্বজন ॥
দেখিবেক যে সকল রহিবে জীবিত।
অধিক আশ্চৰ্য্যকাণ্ড হবে পৃথিবীত ॥
এর সঙ্গে তুলনীয়: ‘তাহার পর পরিনাগার্জুন নামে এক রাজা হইবেন তাহার শক এই কলির ৮২১ বৎসর শেষ থাকা পর্য্যন্ত থাকিবে তাহার পর সম্ভল দেশে গৌত-ব্রাহ্মণের ঘরে কল্কিদেবের অবতার হইবে…’ ইত্যাদি। ইতিহাসবোধের খুব একটা পার্থক্য আছে কি?
৫
পার্থক্যটা তা হলে এল কখন? স্বভাবতই ইংরেজি শিক্ষা, এবং আরও বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদির চর্চা শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে যখন চালু হল, তখনই ইতিহাসের গল্প বলার পুরনো ছকটা ভেঙে একটা নতুন ছক তৈরি হতে শুরু করল। তা ছাড়া আধুনিক ইউরোপীয়ের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসটা কেমন দেখাবে, সেটা ইউরোপীয় লেখকরা নিজেরাই ততদিনে আঁকতে শুরু করে দিয়েছেন। আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণ থেকে যখন ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা চালু হল, তখন থেকেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রকরণ অবলম্বন করে ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার কাজ শুরু হয়ে গেল।
ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় গোড়া থেকেই উৎসাহী ছিল। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শুরু করে বহু প্রতিষ্ঠান সেই উৎসাহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কিন্তু মজার কথা হল, ইংরেজের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাস কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারল না। প্রাচ্যবিদ্যার ফসল সে কিছু কিছু নিল; অনেক কিছুই নিল না। যা নিল, তাও সে সাজাবার চেষ্টা করল সম্পূর্ণ নতুন একটা ছকে। সেই ছকের সে নাম দিল ‘জাতীয় ইতিহাস’। এই জাতীয় ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের জাতীয়তাবোধেরও ইতিহাস।
এই প্রসঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের দিকপাল ব্যক্তিদের রচনার সঙ্গে আমরা যথেষ্ট পরিচিত। অপেক্ষাকৃত অল্পখ্যাত লেখকদের কিছু উদাহরণ দেব এখানে। এঁদের লেখায় মৌলিকতা কম। বরং পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ধারণাগুলিকে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠী, বিশেষ করে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিই এঁরা আরও ভাল পারতেন। সুতরাং ব্যাপক অর্থে শিক্ষিত বাঙালির ধ্যানধারণার একটা ছবি এই জাতীয় বই থেকে পাওয়া যাবে, এটা মনে করা অসঙ্গত নয়।
১৮৫৭-৫৮ নাগাদ অনেকগুলো স্কুলপাঠ্য বাংলা ইতিহাসের বই প্রকাশিত হয়। সম্ভবত নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্স পরীক্ষার পাঠ্যসূচীর দিকে দৃষ্টি রেখে স্কুলের মাঝারি ক্লাসের জন্য লেখা হয়ে থাকবে এই বইগুলো। ততদিনে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের রাজাবলি প্রকাশিত হবার পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহেব ছাত্রদের বাংলা ভাষা ও সেইসঙ্গে দেশীয় ইতিহাস শেখাবার জন্য লেখা হয়েছিল সেই বই। এখন লেখা হতে লাগল বাঙালি ছাত্রদের শেখাবার জন্য সাহেবদের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাসের বঙ্গানুবাদ।
মার্শম্যানের বাংলার ইতিহাসের একটি খণ্ড অনুবাদ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অপর অংশটি বিদ্যাসাগরের অনুরোধে অনুবাদ করেন রামগতি ন্যায়রত্ন।৬ মূল ইংরেজি বই-এর প্রভাব ফুটে উঠেছে এর ভাষাতেও। ‘সুলতান সুজা বাঙ্গালার গভর্ণর হইয়া আগমন করিলেন’, ‘মুরশিদ জামাতাকে আপনার ডেপুটি করিয়া উড়িষ্যাতে পাঠাইয়া দেন’—প্রশাসনিক শব্দের ব্যবহারই জানিয়ে দিচ্ছে যে এই ইতিহাসের রচয়িতা ইংরেজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আলিবর্দি খাঁ-র আমলে মারাঠা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে বই যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে কিন্তু রামগতি পরবর্তী ইতিহাসের আকস্মকিতার কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন।
তৎকালে [মহারাষ্ট্রীয়দিগের] এতাদৃশ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল যে তাঁহারাই এই দেশের অধীশ্বর হইবেন বলিয়া সকলে সম্ভাবনা করিত। কিন্তু দৈবের কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা! যাঁহারা এই দেশে কেবল সামান্য রূপ বাণিজ্য করিতে আসিয়াছিলেন; মধ্যে মধ্যে যাঁহাদের এদেশ পরিত্যাগ করিয়া যাইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা হইত; যাঁহাদের এদেশের রাজা হওয়া স্বপ্নেরও অগোচর ছিল সেই ইঙ্গরেজরা আলীবর্দ্দির সিংহাসনারূঢ় সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিয়া ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের প্রায় একেশ্বর হইয়া উঠিয়াছেন। (পৃ. ১৭৯-৮০)
১৮৫৯-এ যা দৈবের মহিমা, তার দু-বছর আগেই এক চরম সংকটমুহূর্তে যে ইংরেজ রাজত্বের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি জানিয়েছিল পরিপূর্ণ আস্থা, ১৮৬৯-এ এক ‘মেড ইজি’ গোছের বইতে দেখছি৭ সেই ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার উপায় সম্বন্ধেই সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। ‘ক্লাইব কিরূপে জয়ী হল?—যদি মীরজাফর কৃতঘ্নতা পূৰ্ব্বক ক্লাইবকে বঞ্চনা না করিতেন, তাহা হইলে ক্লাইবের জয়লাভ সহজ হইত না।’ (পৃ. ১১০-১) অথবা পরবর্তী ইংরেজ শাসনকর্তাদের ন্যায়নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন: ‘নন্দকুমারের প্রাণবধ কি ন্যায়ানুসারে বিহিত হইয়াছিল?—তাঁহার অপরাধ কোন মতেই প্রাণদণ্ডের উপযুক্ত নহে, কেবল দুরাচার হেস্টিংসের অন্যায় অনুরোধে প্রধান জজ ইলাইজা ইম্পি ঐ মহাপাপের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন।’ (পৃ. ১২৬-৭)
১৮৭২-এর এক শিশুপাঠ বাঙ্গালার ইতিহাস-এ আবার পাচ্ছি৮ সেই ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। লেখক ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারে সিরাজ অত্যাচারী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু অন্ধকূপ হত্যার জন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। অথচ তাঁরই বিরুদ্ধে পাতা হল ষড়যন্ত্রের জাল। মীরজাফর সম্বন্ধে সিরাজ সন্দিহান ছিলেন। ‘তিনি সেনাপতি মীরজাফরকে কোরাণ স্পর্শ করাইয়া দিব্য করান। তাহাকে সেনাপতি “আমি কখন কৃতঘ্ন হইব না” এই কথা বলেন।’ (পৃ. ২০) মীরজাফর প্রতিশ্রুতি রাখলেন না, যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।
মোহনলাল নামক নবাবের অন্য একজন সেনাপতি ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিলেন। যদি এই যুদ্ধ আর কিছুক্ষণ চলিত, তাহা হইলে ক্লাইবকে নিশ্চয় হারিতে হইত। কিন্তু তৎকালে রাজলক্ষ্মী ইংরাজদিগের ভাগ্যে প্রসন্ন থাকায়, মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব পরাজিত ও ক্লাইব জয়ী হইলেন। (পৃ. ২২)
ক্ষেত্ৰনাথের ঘৃণা প্রধানত মীরজাফর ও মীরণের প্রতি। ‘মীরজাফর নিষ্ঠুর, নির্ব্বোধ, অর্থলোভী ও অকর্ম্মণ্য ছিলেন। তিনি নবাব হইয়া প্রধান প্রধান হিন্দুদিগের সর্ব্বস্ব হরণ মানস করেন।’ (পৃ. ২৭) ‘মীরণ অতি নরাধম ও নির্ব্বোধ এবং নিষ্ঠুর, সে এরূপ দুরাত্মা ছিল যে তার অত্যাচারে লোকেরা, সিরাজের সমুদায় কুব্যবহার ভুলিয়া যায়।’ (পৃ. ৩১)
মীরকাসিমের বেলাতেও সেই একই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। মীরকাসিম যেমন
সকল জিনিষের মাশুল উঠাইয়া দিলেন। ইহাতে কি ইংরাজ, কি বাঙ্গালী সকলকেই সমান করা হইল, এবং পূৰ্ব্বে ইংরাজ ভিন্ন অপরাপর লোকদের ব্যবসাতে অনেক হানি হইত, এরূপ হওয়াতে তাহাদের লাভ হইতে লাগিল। ইহাতে ইংরাজেরা তাঁহার উপর রাগিয়া উঠিলেন ও যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক হইলেন।…মীরকাসিমের যে সৈন্য বাঙ্গালার সমুদায় রাজার সৈন্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, তাহারা যে কোন যুদ্ধে জয় লাভ করিতে পারিল না, অবশ্যই ইহার কোন গুপ্ত কারণ ছিল, তাহার কোন সন্দেহ নাই। গার্গিনের বিশ্বাসঘাতকতাই তাহার প্রধান কারণ। (পৃ. ৩৪-৫)
ওদিকে দিল্লির সম্রাটের অবস্থা তখন করুণ।
সম্রাট এই সময়ে বড় দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন, এমনকি, তাঁহার নিজের রাজধানী পর্য্যন্ত পরের হস্তগত ছিল। বসিবার সিংহাসন ছিল না। ইংরাজদিগের খানা খাইবার টেবেল এক্ষণে তাঁহার সিংহাসন হইল। সমুদায় ভারতবর্ষের সম্রাট তাহাতে বসিয়া ইংরাজদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানীর সহিত তিন কোটি প্রজা অৰ্পণ করিলেন। যে দিল্লীর সম্রাটের জাঁকজমকের পরিসীমা ছিল না, যাঁহার প্রতাপে সমুদায় ভারতবর্ষ কম্পিত হইয়াছিল, এক্ষণে সেই সম্রাটের এরূপ অবস্থা অবশ্যই দুঃখজনক তাহার আর সন্দেহ নাই। (পৃ. ৪১)
শুধু রাজ্য দখলেই নয়, রাজ্যচালনাতেও ইংরেজরা প্রায়শই চক্রান্ত আর বলপ্রয়োগের রাস্তা নিত।
ক্লাইব এইরূপে রাজ্যে সুনিয়ম স্থাপন করায়, দেশীয় দিগের উপর যে দৌরাত্ম্য হইতেছিল তাহার অনেক কম হইয়া আসে। ইহার পূর্ব্বে ইংরাজেরা দেশীয় লোকদিগের উপর এমনি অত্যাচার করিয়াছিলেন যে, তাহাতে সমুদায় বাঙালিরা ইংরাজদের নাম শুনিয়া ঘৃণা করিতেন!…ক্লাইব চলিয়া গেলে, কোম্পানির কার্য্যের আবার গোলযোগ ঘটিতে লাগিল। (পৃ. ৩৯)
নন্দকুমারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জন্য হেস্টিংস ‘সকলেরই নিকট এবং ইতিহাস মধ্যে অতিশয় ঘৃণিত হইয়া রহিয়াছেন।’ (পৃ. ৫৯) ১৮৫৭-তে সিপাহিরা যেমন ইংরেজদের ওপর অত্যাচার করেছিল, ‘বিদ্রোহ শান্তির সমকালে খ্রীষ্টধৰ্ম্মাভিমানী ইংরাজেরাও বিপক্ষদিগের অপকারের প্রতিশোধ ও আপনাদের হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য ফাঁসী কাষ্ঠে বদ্ধ মৃতদেহের অভ্যন্তর হইতে যকৃত বাহির করিয়া অগ্নিতে দগ্ধ করেন।’ (প. ৯৮)
কিন্তু সিপাহিদের বিদ্রোহ দমন করার পরেও যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল, তা নয়।
কোন কালেই গরিবের ও দুৰ্ব্বলের মা বাপ নাই। সকল স্থানের গোলবোগ চুকিয়া গেলে, বাঙ্গালায় একটী হুলস্থূল কাণ্ড ঘটিয়া উঠিল। ঐ সময়ে বাঙ্গালার নীল প্রধান দেশে নীলকর সাহেবদের কার্দ্দানী বাড়িতে লাগিল। তাহারা গরিব প্রজাদিগের প্রতি যেরূপ নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিল, তাহাতে তাহাদিগকে কখনোই মানুষের মধ্যে গণনা করা যাইতে পারে না। (পৃ. ১০০)
সত্যি কথা বলতে কি, ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাস লিখতে গিয়েই কিন্তু ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির ইতিহাসচিন্তা থেকে ঈশ্বর, ধর্ম, ন্যায়নীতি ইত্যাদি মাপকাঠিগুলো লোপ পেয়ে গেল। চূড়ান্ত নীতিহীনতার আশ্রয় নিয়েও যে ক্ষমতা দখল এবং ভোগ করা যায়, বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাস যেন সেই সত্যটাকেই হাজির করে দিল ইউরোপীয় শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির কাছে।
১৮৭০-এ প্রকাশিত কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর জনপ্রিয় পাঠ্যবই-এর৯ নবম সংস্করণে দেখছি ইংরেজের রাজত্ব লাভের কাহিনীটিকে সম্পূর্ণ নীতিবিগর্হিত ক্ষমতার লড়াই হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। যেমন উমিচাঁদের সঙ্গে ক্লাইভের প্রতারণা: ‘ক্লাইবের এই কাৰ্যটী অতিশয় গর্হিত বলিয়া সকলেই তাঁহার নিন্দা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহার মতে শঠের সহিত শঠ্যতা করায় কোন পাতিত্য নাই “শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ”।’ (পৃ. ৪৩-৪)
অথবা ১৭৭২ সালে সরাসরি গভর্নর কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থার প্রবর্তন :
‘জোর যার মুলুক তার’। এই অবধি কোম্পানির দেওয়ানত্ব গিয়া প্রকৃত পক্ষে রাজত্ব আরম্ভ হইল। সম্রাট সবল থাকিলে এই কর রহিত করা উপলক্ষে তুমুল কাণ্ড ঘটিত। কিন্তু এখন আর তাঁহাতে কিছুই ছিল না; সুতরাং হেস্টিংস যাহা মনে করিলেন তাহাই হইল। (পৃ. ৭০)
সিরাজউদ্দৌলার রাজত্ব সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয়ের লেখায় যে সুস্পষ্ট ঘৃণার ভাব ছিল, কৃষ্ণচন্দ্রে তার কিছুই নেই। বরং সিরাজের কার্যকলাপের একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন ইংরেজরা যখন কলকাতার দুর্গ সংস্কার শুরু করল, সিরাজ তা ভেঙে ফেলার আদেশ দিলেন।
কোন্ রাজাই বা বিদেশীয় লোককে আপনার অধিকার মধ্যে দুর্গ নির্ম্মাণ করিতে দেন?…কোথা হইতে কতগুলা বণিক আসিয়া তাঁরই অধিকার মধ্যে থাকিয়া তাঁহারই আদেশ অমান্য করিতেছে, এ অবমাননা আর সহ্য হইল না; ক্রোধ উদ্বেল হইয়া উঠিল। (পৃ. ৩৮)
কিংবা অন্ধকূপ হত্যা।
সিরাজউদ্দৌলা কি অশুভক্ষণেই কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াছিলেন, তিনি এই অন্ধকূপ-হত্যার বিন্দু বিসর্গও জানিতেন না, তাঁহার আজ্ঞানুসারে কিছু ইংরেজ বন্দী দিগের ঐ কারাবাস নির্দ্দিষ্ট হয় নাই, অথচ ইহা হইতেই তাঁহার সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছিল। নিতান্ত মদমত্ততা প্রযুক্ত তিনি মার্জ্জার ভ্রমে ব্যাঘ্র শরীরে হস্তাৰ্পণ করিয়াছিলেন। শেষে সেই অজ্ঞানতাদোষে স্বয়ং রাজ্যভ্রষ্ট ও প্রাণে নষ্ট হইয়া আপন বংশের দুর্দ্দশার একশেষ ঘটাইলেন। বলিতে কি, কলিকাতার এই অন্ধকূপ হত্যা ঘটাতেই ভারতভূমিতে ইংরেজ অভ্যুদয়ের সূত্রপাত হইয়াছিল। (পৃ. ৪০)
সিরাজের পতনের কারণ অধর্মাচরণ নয়, নিছক অজ্ঞানতা। আর সে অজ্ঞানতা কী? বেড়াল ভেবে বাঘের গায়ে হাত দেওয়া।
ইতিহাস এখন দৈবশক্তির লীলাক্ষেত্র কিংবা ধর্মাধর্মের যুদ্ধ থেকে নিছক ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। ইংরেজ রাজত্বের সূত্রপাত এখন আর দৈবের অনির্বচনীয় মহিমা নয়। কোন রাজনৈতিক অবস্থায় ইংরেজের জয়লাভ অসম্ভব করে তোলা যেত, শিক্ষিত বাঙালি এখন তাই নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
যদি এদেশ এক জন প্রবল অধিপতির অধীন থাকিত, অথবা স্থানে স্থানে যাঁহারা প্রভু ছিলেন, তাঁহাদের পরস্পর একতা এবং প্রণয় থাকিত, তাহা হইলে ইংরেজরা এদেশে কদাপি ঈদৃশ প্রভাবশালী হইতে পারিতেন না, তাহা হইলে এদেশ অদ্যাপি মুসলমান রাজাদিগেরই অধিকৃত থাকিত। হয়ত এদেশে কেহই ইংরেজদিগের নামও শুনিতে পাইত না। (পৃ. ২১৪)
বই শেষ হচ্ছে ইংরেজ রাজত্বের সুফলের একটা ফিরিস্তি দিয়ে, কিন্তু তাতে যে রাজত্বলাভের নৈতিক দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় না, সে ইঙ্গিতও কৃষ্ণচন্দ্র দিচ্ছেন বেশ খোলাখুলিই। ‘সে যাহা হউক, যে উপায়ে ইংরেজদিগের এই সুবিস্তীর্ণ রাজ্য উপার্জিত হইয়া থাকুক না কেন, বস্তুত তাঁহাদের দ্বারা এদেশের অশেষবিধ হিত সম্পাদিত হইয়াছে একথা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক।’ (পৃ. ২৩৮) জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি আমরা।
১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরির বই-এর১০ বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকছে: ‘ইংরাজী ইতিহাসের অনুবাদ পাঠ করিয়া যাঁহাদিগের ভ্রান্তি জন্মিয়াছে তাঁহাদিগের জন্য এই পুস্তকখানা লিখিয়াছি।’ আধুনিক ইউরোপীয় জাতীয় ইতিহাস-রচনার সারমর্মটি ক্ষীরোদচন্দ্রের মনে কতটা দাগ কেটেছে তার প্রমাণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এই মন্তব্যটি:
ফরাসি ও ইংরাজেরা চিরদিন পরস্পরের বিদ্বেষী। ভারতবর্ষে মোগল পাঠানের কলহ যেমন প্রবাদ মধ্যে পরিগণিত হইয়া পড়িয়াছে, ইয়োরোপে ইংরাজ ও ফরাসির বিদ্বেষ সেই রূপ গণ্য হয়। সুতরাং ভারতবর্যেও যে তাহারা পরস্পরকে পীড়ন না করিয়া নির্ব্বিবাদে এক স্রোতের জলপান করিবে কেহ বিশ্বাস করে নাই। (পৃ. ১১৫) বই শেষ হচ্ছে এই মন্তব্য দিয়ে:
সামান্য বণিকভাবে ভারতবর্যে বাণিজ্য করিতে আসিয়া ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ঘটনা স্রোতে বিংশতি কোটী প্রজার অধীশ্বর হইয়া উঠেন, এবং কোম্পানির অংশীদারেরা লক্ষপতি ও ক্রোরপতি হইয়া বিদেশীয় বিভিন্ন জাতির রীতি নীতির স্থাপয়িতা হইয়া দাঁড়ান। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরূপ অমানুষী ঘটনা আর হয় নাই। (পৃ. ২১১)
৬
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম, তাঁর অবস্থান প্রজার অবস্থান। ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। কিন্তু এই দুই প্রজা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সত্তর বছরের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি নামক জীবটি অনেক বদলে গেছে। ক্ষেত্রনাথের সময় সে নিজেকে ইউরোপের ‘মিডল ক্লাস’-এর অনুকরণে ‘মধ্যবিত্ত’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছে। শুধু যে বিত্তের দিক দিয়েই সে মধ্যবর্তী, তাই নয়। সামাজিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রেও সে এখন মধ্যস্থের ভূমিকা নিয়েছে। যারা বিত্তশালী, সমাজের মাথা হিসেবে স্বীকৃত, তারা যে কর্তৃত্ব করার পক্ষে অযোগ্য—নতুন মধ্যবিত্ত এই অভিযোগ এনে হাজির করেছে সমাজের সামনে। অন্যদিকে যারা দরিদ্র, অত্যাচারিত, তাদের হয়ে বলার দায়িত্বটাও সে তুলে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে। এখন মধ্যস্থ হওয়ার অর্থ, একদিকে শাসকবর্গের বিরোধিতা, অন্যদিকে প্রজাবর্গের নেতৃত্ব। প্রজা হয়েও ক্ষেত্ৰনাথের সমসাময়িক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিন্তু চৈতন্যের স্তরে অন্তত নিজেকে রাষ্ট্র চালনার উপযুক্ত বলে ভাবতে শুরু করেছে।
সেই সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল নীতিগুলিও গভীর ভাবে গেঁথে গেছে তার মনে। দেশের পুরনো সমাজব্যবস্থা যে কাম্য নয়, তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, এই বিশ্বাস ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে ততদিনে প্রায় সর্বজনীন হয়ে গিয়েছিল। কথাটা মনে রাখা দরকার, কারণ উনিশ শতকের শেষদিকে এসে সমাজচিন্তার যে ধারাটিকে ‘সনাতনপন্থী’ বা ‘রক্ষণশীল’ বলা হয়, হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যে ধারা, তার নেতারাও যে প্রবলভাবে সংস্কারপন্থী এবং হিন্দুসমাজের আধুনিকীকরণের প্রবক্তা, এ-কথাটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। তথাকথিত ‘উদারপন্থী’ আর ‘রক্ষণশীল’দের মধ্যে অন্য যা-ই তফাত থাকুক, পুরনো সমাজকে বদলে আধুনিক জগতের উপযোগী করে তুলতে হবে, এ-বিশ্বাস দুজনের মনেই সমান দৃঢ় ছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের অসংখ্য গৌণ লেখকদের নিতান্ত মামুলি রচনা পড়লেও এই নতুন মূল্যবোধের কথা পাওয়া যাবে। সামাজিক কর্তৃত্বের বেলায় যেমন একটা নতুন ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল—সমদর্শিতা। ১৮৬৬ সালে তারাকৃষ্ণ হালদার নামে একজন বারাণসী থেকে নানা সামাজিক বিষয়ে একটি প্রবন্ধের বই লেখেন।”১১ নিঃসন্দেহে রক্ষণশীল হিন্দু। ‘যুবতীগণের প্রতি ব্যবহার বিষয়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘কি গৃহমধ্যে কি অন্য স্থানে, কোন খানেই কোন যুবতী যেন একাকিনী অবস্থান করিতে না পান।’ (পৃ. ৬৯) অথচ তিনি পণপ্রথার বিরোধী, কুলীনবিবাহের বিরোধী। এই তারাকৃষ্ণ ‘রাজভক্তি বিষয়ক’ প্রবন্ধে লিখছেন,
পূৰ্ব্বকালে যখন এই দেশ হিন্দুজাতির শাসনাধীন ছিল তখন রাজগণের পক্ষপাতিতা দোষে জাতি বিশেষ অপর সমস্ত জাতির উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ব করিতেন, ঐ সকল জাতিকে স্বর্গ বা নরকগামী করণের কর্ত্তা ছিলেন। …যখন এই রাজ্য যবনদিগের হস্তে ছিল তখন তাঁহারা হিন্দুবর্গকে নাস্তিক ও অধার্মিকের শেষ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। স্বজাতি প্রজাবর্গের প্রতি যাবতীয় বিষয়েই অনুগ্রহ, হিন্দু প্রজাদিগের প্রতি সৰ্ব্বতোভাবেই নিগ্রহ করিতেন। …ব্রিটিস জাতির রাজনিয়মাবলীতে এ সকল দোষের লেশও নাই, তাঁহারা আপন জাতীয় ধর্ম্মোপদেষ্টাকে এবং এ দেশস্থ ডোমপ্রভৃতি যৎপরোনাস্তি নীচ ব্যক্তিকে বিচারকালে সমান দেখেন। …ঐ জাতির পক্ষপাতশূন্যতা গুণের অধিক প্রশংসা কি করিব? (পৃ. ১৩৪-৬)
এখান থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেই পরের কথাটা পেয়ে যাচ্ছি। বর্তমান হিন্দু সমাজের যে জীর্ণ অধঃপতিত অবস্থা, তার কারণই মুসলমান শাসন। ১৮৭৬-এ ভোলানাথ চক্রবর্তী নামে একজন বক্তৃতা দিচ্ছেন:১২
যে দিন যবনের উষ্ণীষ বঙ্গ রাজ্যে প্রবেশ করে, সেই দিন হইতেই এদেশের দুর্ভাগ্য ও অবনতির সূত্রপাত হয়। নিষ্ঠুর যবনশাসনে এদেশ ক্রমশঃ উৎসন্ন হইয়া যায়। যেমন এক প্রবল বাত্যা আসিয়া বন উপবন ভগ্ন ও হতশ্রী করে, সেই রূপ নৃশংস দুরাচার যবন জাতি আসিয়া আমাদের জন্মভূমি বঙ্গভূমির সমুদায় সুখসৌভাগ্য বিনষ্ট করিয়াছিল। অজস্র অত্যাচার স্রোত সহ্য করিয়া—নিরন্তর নিপীড়িত হইয়া বঙ্গ সন্তানেরা নিতান্ত নিবীর্য ও হীনসাহস হইয়া পড়ে। ধৰ্ম্ম বিকৃত ভাব ধারণ করে। স্ত্রীশিক্ষা একেবারে রহিত হয়। যবনাক্রমণ নিবারণ জন্য স্ত্রীজাতিকে নিভৃত নির্জ্জন গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইতে লাগিল। এক সময় দেশের এমনি দুরবস্থা ঘটিয়াছিল, যে, ধনীর ধন, মানীর মান ও সতীর সতীত্ব সমূহ বিপদের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। (পৃ. ১০)
জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের কাঠামোর অর্ধেকটা পেয়ে গেলাম এখানে। আদিতে জাতির ইতিহাস ছিল গৌরবের আলোয় উজ্জ্বল—ধন, বল, বিদ্যা, ধর্ম, সব দিক দিয়েই সভ্যতার চরম উৎকর্যে পৌঁছেছিল সে। এখানে জাতি বলতে কখনো বাঙালি, কখনো হিন্দু, কখনো আর্য, কখনো ভারতবর্ষীয়, যে-কোনও একটা বলা যেতে পারত, কিন্তু যুক্তির কাঠামোটা একই। তার পর এল জাতির অবক্ষয়ের যুগ। অবক্ষয়ের কারণ মুসলমান শাসন, অর্থাৎ জাতির পরাধীনতা। জাতীয়বাদী ইতিহাসের এই কাঠামোর বাকি অংশটা ভোলানাথ চক্রবর্তীর লেখায় পাচ্ছি না। কারণ জাতীয় সমাজের সংস্কার এবং পুনরুজ্জীবনের কথা বললেও, এই সংস্কারের সম্ভাবনা তাঁর মতে একান্তভাবেই ইংরেজ শাসনের ওপর নির্ভরশীল।
সকল বিষয়েরই সীমা আছে। যখন মুসলমানদিগের অত্যাচার নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল, তখন জগদীশ্বর তাহা হইতে পরিত্রাণের উপায় বিধান করিলেন। …যে দিন এদেশে বৃটিশ পতাকা প্রথম উড্ডীন হয়, সেই দিন হইতেই এদেশের পুনঃ সৌভাগ্যের সূত্রপাত হইয়াছে। বলুন দেখি, যদি এ পর্য্যন্ত যবনাধিকার অব্যাহত থাকিত, তবে আজ দেশের কি দশা ঘটিত? অতএব একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে যে পরমেশ্বরের মঙ্গলের জন্য ইংরাজ জাতিকে এদেশে আনয়ন করিয়াছেন। বৃটিশ অধিকারে যবনদিগের অত্যাচার নিবারিত হইয়াছে। …যবন শাসনের সহিত বৃটিশ শাসনের তুলনাই হইতে পারে না। অন্ধকার ও আলোকে যত অন্তর, দুঃখ ও সুখে যত প্রভেদ, যবন শাসন ও বৃটিশ শাসনে তদপেক্ষাও অধিক প্রভেদ প্রতীয়মান হয়। (পৃ.১১-২)
অবশ্য ভোলানাথ চক্রবর্তী না মানলেও, ১৮৭০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের যুক্তির বাকি অংশটুকুও যথেষ্ট চালু হয়ে গিয়েছে। তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস-এর অষ্টাদশ সংস্করণ বেরোয় ১৮৭৮ সালে।১৩ তারিণীচরণ (১৮৩৩-১৮৯৭) ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক এবং সমাজ-সংস্কারক। তাঁর লেখা স্কুলপাঠ্য ইতিহাস আর ভূগোলের বই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি নামে সমসাময়িক অন্য অনেক স্কুলপাঠ্য বই-এ দেখা যাচ্ছে তারিণীচরণেরই সংক্ষিপ্তসার। অনেক সময় হুবহু উদ্ধৃতি। এই বইটি থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের নানা কাহিনী একটু বিস্তারিতভাবে উপস্থিত করতে চাই। তা হলে আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের মালমসলা জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার ভেতর তার জন্মলগ্ন থেকেই কীভাবে সঞ্চিত হয়ে এসেছে, তার একটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
৭
প্রথম বাক্যেই চমক লাগে। ‘ভারতবর্ষ ক্রমান্বয়ে হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টানদিগের অধিকৃত হইয়াছে, এবং তদনুসারে এদেশের ইতিবৃত্ত হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান এই তিন রাজত্বকালে বিভক্ত।’ (পৃ. ১) রাজাবলি থেকে দেশের ইতিহাস-এ উত্তরণটি লক্ষণীয়। ‘রাজাবলি’ আর লেখা হবে না, এখন থেকে যা লেখা হবে সবই ‘দেশের ইতিবৃত্ত’। কিন্তু এই যে দেশের ইতিবৃত্ত, তার পর্ব ভাগ করা হল রাজত্বের চরিত্র অনুযায়ী। আর রাজত্বের চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে শাসকের ধর্ম অনুসারে। দেশ আর রাজত্বের মধ্যে সম্বন্ধ এখানে নিত্য এবং অভেদ্য। শুধু তাই নয়, আপাতদৃষ্টিতে নানা সময় নানা রাজ্য আর রাজা দেখতে পাওয়া গেলেও, প্রকৃত অর্থে রাজত্ব একটিই। তা দেশেরই সমব্যাপী। তার চিহ্ন রাজধানী অথবা সিংহাসন। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজত্ব হল দেশের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ; রাজধানী বা সিংহাসন সেই সার্বভৌম রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র। দেশটা যেখানে ভারতবর্ষ, তার সমব্যাপী সার্বভৌমত্ব’ তাহলে একটিই। সেই সার্বভৌমত্বের চিহ্নস্বরূপ কেন্দ্রও একটিই। তা না হলে মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করলেন, তাতে সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের র্ব বদলে যাবে কেন? অথবা পলাশির যুদ্ধকে মুসলমান রাজত্বের অবসান এবং খ্রিস্টান রাজত্বের সূত্রপাত বলব কেন? দেশ বা জাতি, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র—আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে এই তিনটি ধারণার মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির মনেও তা এবার আশ্রয় পেল।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতার আর-একটি দৃষ্টান্ত পরের পৃষ্ঠাতেই পাওয়া যাবে। ‘অধুনা যে সকল সংস্কৃত গ্রন্থ পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশই কাব্য ও কল্পিত উপন্যাসে পূর্ণ; রাজতরঙ্গিনী ভিন্ন একখানিও প্রকৃত পুরাবৃত্ত দেখা যায় না।’ (পৃ. ২) প্রকৃত পুরাবৃত্ত কাকে বলে, তা অবশ্য ততদিনে ইউরোপীয় ইতিহাসবিদেরা স্থির করে দিয়েছেন। ‘ভারতের প্রকৃত পুরাবৃত্ত নাই’, এটা সাহেবদের ভারতবিদ্যাচর্চার একটা বিশেষ আবিষ্কার। মৃত্যুঞ্জয়ের এমন কথা কখনো মনে হয় নি। তারিণীচরণ কিন্তু নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়েছেন কথাটা।
এর পর ভারতবর্ষের অধিবাসীদের কথা।
অতি প্রাচীন সময়ে ভারতবর্ষে, পরস্পর অতিশয় বিভিন্ন, দুই সম্প্রদায়ের লোকের বসতি ছিল। তন্মধ্যে এক সম্প্রদায় শরীরের দৈর্ঘ্য ও গঠন প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের অনেক অনুরূপ। অধুনা সেই সম্প্রদায়ের সন্ততি হিন্দু নামে খ্যাত। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা খর্ব্বকার, কৃষ্ণবর্ণ ও অতিশয় অসভ্য ছিল। ইদানীং ইহাদের সন্ততি খস, ভিল্ল, পুলিন্দ, সাঁওতাল প্রভৃতি জঙ্গলা জাতি নামে পরিচিত। (পৃ. ২)
আদিতে ভিন্ন, কিন্তু পরে মিশে গেছে, এমন সম্প্রদায়ও ছিল। হিন্দুদের মধ্যে প্রথম তিন বর্ণ দ্বিজ নামে পরিচিত, কিন্তু শূদ্রেরা ঐ নামে অধিকারী নয়। ‘ইহাতেও প্রতীয়মান হইতেছে যে, আদৌ প্রথমোক্তেরা শেষোক্তদিগের হইতে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিলেন। পরে শেষোক্তরা সেই সম্প্রদায়ে গৃহীত, কিন্তু সৰ্ব্ব-নিকৃষ্ট শ্রেণীতে গণিত হয়।’ (পৃ. ৪)
তা ছাড়া ভারতের উত্তর ভাগ থেকে ক্রমশ দক্ষিণের দিকে হিন্দু ধর্মের প্রসারের একটি ধারণাও তারিণীচরণে আছে। সেই প্রসার স্পষ্টতই রাজত্বের প্রসার।
আদৌ দক্ষিণাবর্ত্ত জঙ্গলময় এবং অহিন্দু সভ্য জাতিদিগের নিবাসস্থল ছিল। রামচন্দ্র সর্ব্বপ্রথম ভারতবর্ষের ঐ ভাগে হিন্দু পতাকা উড্ডীন করেন। …অদ্যাপি দক্ষিণাবর্ত্ত হিন্দুদিগের আদিম উপনিবেশ সংস্থাপনের অনেক জনশ্রুতি শুনিতে পাওয়া যায়। (পৃ. ২৭)
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পত্পত্ করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল। তবে এ-হেন রামচন্দ্র যে দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের দমন করে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, এ-কথায় আজকের উগ্রহিন্দু বোধ হয় বিব্রতই হবেন।
প্রকৃত পুরাবৃত্তের অভাবে ইতিহাসের কাহিনী নির্মাণে বড় বড় ফাঁক থেকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মৃত্যুঞ্জয়ের ইতিহাসভাবনা থেকে আমরা কত দূর সরে এসেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে তারিণীচরণের এই মন্তব্যে :
ইয়ুরোপীয় পুরাবিদেরা, বিবিধ যুক্তি দ্বারা প্রতিপন্ন করিয়াছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খৃষ্টীয়-শকারম্ভের চতুর্দশ শতাব্দীর পূৰ্ব্বে ঘটিয়াছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর বহুকাল পৰ্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত এরূপ অপরিয়ে, অসম্বন্ধ ও গোলযোগে আবৃত যে তাহা হইতে কোনরূপ বিবরণ সঙ্কলন করা দুঃসাধ্য। (পৃ. ১৬-৭)
যেটুকু বিবরণ তারিণীচরণ সংগ্রহ করেছেন, তাতে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। মোটামুটিভাবে ইংরেজদের লেখা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস যে সময় যেমন প্রচলিত ছিল, সেরকমই লিখেছেন তিনি। শুধু বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে একটি কৌতূহল জাগাবার মতো মন্তব্য করেছেন।
[বুদ্ধ] হিন্দুধর্মের পরম শত্রু হইয়া উঠেন; এ জন্য হিন্দুরা তাঁহাকে নাস্তিক ও ধর্মলোপক বলিয়া বর্ণনা করিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, তাঁহার প্রণীত ধৰ্ম্মে অতি পবিত্র বিবিধ উপদেশ প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি যুক্তিহীন কিছুই মান্য করিতেন না। কোন জাতি যতই কেন প্রাচীন সংস্কারের পরতন্ত্র হউক না, চিরাগত মতের বিরুদ্ধে প্রবলতর যুক্তি প্রদর্শন করিতে পারিলে পরিণামে অবশ্যই অন্ততঃ কিয়দংশেরও মত পরিবর্তন ঘটিয়া উঠে। (পৃ. ১)
এখানে লক্ষণীয়, বৌদ্ধ ধর্মমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা হচ্ছে না। বরং হিন্দুধর্মের আভ্যন্তরীণ একটি যুক্তিবাদী সমালোচনা হিসেবেই তাকে উপস্থিত করা হচ্ছে। তা না হলে, পর্বভাগের প্রথম সূত্র অনুসারে বৌদ্ধ রাজাদের আমলটিকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের স্বতন্ত্র একটি পর্ব বলতে হত। তার আর প্রয়োজন হচ্ছে না; হিন্দু রাজত্বকালের মধ্যেই তাকে জায়গা করে দেওয়া যাচ্ছে।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত বহুলাংশে অস্পষ্ট হলেও একটি বিষয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের কোনও অভাব নেই। সেটি হল ‘আদিম ভারতবর্ষীয়দিগের সভ্যতা ও পাণ্ডিত্য’। তারিণীচরণের ষষ্ঠ অধ্যায়ের এই হল বিষয়। মূল প্রতিপাদ্য এইরকম:
প্রাংশু ও বামনে, বলী ও ক্ষীণে যা বৈলক্ষণ্য, আদিম ও আধুনিক হিন্দুতে তদপেক্ষাও অধিক। পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্বকালে বৈদেশিক ভ্রমণকারীরা ভারতবর্ষে আসিয়া আৰ্য্যবংশের সাহসিকতা, বাঙ্নিষ্ঠা, সারল্য প্রভৃতি সদ্গুণের পরাকাষ্ঠাদর্শনে বিস্মিত ও চমৎকৃত হইতেন, অধুনা ঐ সকল গুণের অভাবই প্রধানরূপে কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। তখন হিন্দুরা দিগ্বিজয়ে নির্গত হইয়া সময়ে সময়ে তাতার চীন প্রভৃতি দেশে আপনাদিগের পতাকা উড্ডীন করিতেন; অধুনা বহুদূর হইতে এক ক্ষুদ্র দ্বীপের কতিপয় সৈনিক আসিয়া ভারতভূমির উপরে কর্তৃত্ব করিতেছে। তখন হিন্দুরা স্বজাতীয় ভিন্ন সকলকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেন: অধুনা সেই স্নেচ্ছেরা আসিয়া আর্য্যসন্তানগণের উপরে নিয়ত অবজ্ঞা বর্ষণ করিতেছে। তখন হিন্দুদিগের অর্ণবতরী সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপে নিয়ত যাতায়াত করিত, অদ্যাপিও তাহার সন্নিহিত বালিদ্বীপে তাহার ভূরি নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায়; অধুনা সমুদ্রগমণের নামেই হিন্দুদিগের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, এবং কেহ কোনরূপে যাইলে তিনি সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া আইসেন। (পৃ. ৩২)
প্রাচীন গৌরব, বর্তমান অধঃপতন। পুরো গল্পটা কিন্তু আমাদের নিয়ে। প্রাচীন ভারতের শৌর্যবান নায়কেরা আমাদেরই পূর্বপুরুষ। আর আজকের হীনবল ভারতীয় বলা বাহুল্য আমরা। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা যে ‘তাতার চীন প্রভৃতি দেশ’ জয় করেছিলেন, সমুদ্র পেরিয়ে তাঁরা যে বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন এবং ভিন্ন জাতীয়দের ‘ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেন’, এ আমাদেরই গৌরব। আর আজকে ‘আর্যসন্তানেরা’ যে নিজেরাই অপরের পদানত, অন্য জাতির অবজ্ঞার পাত্র, তা আমাদের কলঙ্ক। ক্ষমতার মাপকাঠিতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভারতবাসীর স্থান আজ নেমে গেছে বহু নীচে, কিন্তু এককালে সেই স্থান ছিল ওপরে।
কেবল বীরত্বই নয়, বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও প্রাচীন ভারতের কৃতিত্ব সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
পূৰ্ব্বকালে যখন প্রায় সমুদয় মেদিনী ঘোর মূর্খতা-রজনীতে আচ্ছন্ন ছিল, তখনও ভারতবর্ষে বিদ্যার নির্ম্মল আলোক কোনরূপেই নিষ্প্রভ ছিল না। তীক্ষ্ণমণীষা-সম্পন্ন হিন্দুরা দর্শনশাস্ত্রে অতি আদিম কালে যে সকল মত উদ্ভাবিত করিয়া গিয়াছেন, এখনও ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা তৎসমুদায় লইয়া আন্দোলন করিতেছেন। (পৃ. ৩৩)
লক্ষণীয়, এই বিষয়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সাক্ষ্য তারিণীচরণের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত প্রাচীন ভারতে বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষের যে-কটি দৃষ্টান্ত তিনি দিচ্ছেন— জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, তর্কশাস্ত্র, আর ভাষা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে—তার সব ক-টিই উনিশ শতকের প্রাচ্যবিদ্যাবিৎ সাহেবদের আবিষ্কার। যুক্তিটা যেন এই রকম: আজকের ভারতবাসীদের হীন অবস্থা দেখে ইউরোপীয়েরা তাদের অবজ্ঞা করে বটে, কিন্তু চিরকাল ভারতীয়রা এরকম ছিল না; ইউরোপীয় পণ্ডিতেরাই স্বীকার করছেন যে প্রাচীন ভারতে জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা উৎকর্যের শিখরে পৌঁছেছিল। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের পুরো কাহিনীটা সাজানোর ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার এই অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
তারিণীচরণের ইতিহাসটি যে জাতীয়তাবাদী, তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রাচীন গৌরব আর পরবর্তী অবক্ষয়ের এই কাহিনীটির শেষে নীতিকথার গল্পের মতো একটি উপদেশ আছে। সেটি হল, সমাজের সংস্কার করো, অবক্ষয়ের চিহ্ন এইসব কুসংস্কার মুছে ফেলে প্রাচীন আদর্শের পুনরুদ্ধার করো। যে-সব ভ্রান্ত আচার আর বিশ্বাসের জন্য ভারতবাসী আজ সকলের ঘৃণার পাত্র, প্রাচীনকালে তার কিছুই ছিল না, কারণ ইউরোপীয়েরাই স্বীকার করেছেন প্রাচীনকালে আমরা অতি সভ্য ছিলাম।
অধুনা হিন্দু সীমন্তিনীগণ দাসীর ন্যায় ব্যবহৃত, বন্দীর ন্যায় অবরুদ্ধ ও ইতর জন্তুর ন্যায় নিরক্ষর দৃষ্ট হয়। কিন্তু সার্দ্ধ সহস্র বর্ষ পূর্বে অবলোকন করিলে স্ত্রীদিগকে আদরণীয়, শিক্ষণীয় ও অনেক পরিমাণে অনবরুদ্ধ দেখা যায়। তখন বাল্যবিবাহ কোথায়? কেহই চতুর্ব্বিংশতি বর্ষের ন্যুন বয়সে দারপরিগ্রহ করিতেন না। (পৃ. ৩৩)
জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্লাসিকাল আদর্শ। আর প্রাচীন থেকে বর্তমানের মাঝের অংশটা হল তমসাবৃত মধ্যযুগ। বলা বাহুল্য এই ছকও ইউরোপীয় ইতিহাসে অনুমোদিত। উনিশ শতকের সুট-বুট পরা ইংরেজ যদি প্রাচীন গ্রিসকে তার ক্লাসিকাল উত্তরাধিকার বলে দাবি করতে পারে, তা হলে উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিই বা ‘ব্যাদে আছে’ বলে গর্ব করবে না কেন?
আধুনিক ইউরোপের আদলে ইতিহাসচর্চা চালু হওয়ার পর ঐতিহাসিক স্মৃতির গড়নে পরিবর্তনগুলো কোথায় এল, সেটা একটু লক্ষ করা উচিত। রাজাবলির-কালক্রম ছিল নিচ্ছিদ্র; এখন বিশ্বাসযোগ্য পুরাবৃত্তের অভাবে সেখানে অনেক ফাঁকফোকর দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, আগে যা ছিল কেবল রাজারাজড়ার ইতিবৃত্ত, এখন তা হয়ে গিয়েছে ‘আমাদের’ ইতিহাস—পুরাবৃত্তের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমগ্র জাতির অখণ্ড ইতিহাস। রাজত্ব হস্তান্তর আগে যেখানে ছিল দৈবের ইচ্ছা, এখন তা সমগ্র সমাজনীতির উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সূচক। সেই উৎকর্ষ বা অপকর্ষ আবার বিচার করতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য জাতির সঙ্গে তুলনার মধ্যে দিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়ের সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, তার মধ্যে জম্বদ্বীপ, ইত্যাদি পৌরাণিক কল্পনা এখন বাতিল; এখন ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তার জায়গা খুঁজে নিতে হচ্ছে অন্যান্য জাতির ইতিহাসের প্রতিযোগী হিসেবে।
এই যে নতুন এক বিশ্ব ইতিহাস, তা বিভিন্ন জাতির স্বতন্ত্র ইতিহাসের যোগাযোগে উৎপন্ন। এর প্রমাণ তারিণীচরণের কাহিনীর পরের অংশেই পাওয়া যাচ্ছে। ‘আদিম ভারতবর্ষীয়দিগের সভ্যতা ও পাণ্ডিত্য,’ এই অধ্যায়ের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস শেষ। এর পর তারিণীচরণ পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতবর্ষের বাইরে, সপ্তম শতাব্দীর আরবে। প্রশ্ন করতে পারি, দ্বাদশ শতকে ভারতবর্ষে রাজত্বের পরিবর্তনের গল্পই যদি বলতে হয়, তবে সপ্তম শতকের আরবে গিয়ে সে-গল্প শুরু করতে হবে কেন? উত্তরটা অবশ্য আমরা সকলেই জানি, অত্যন্ত সহজ উত্তর সেটা। কিন্তু এই সহজ উত্তরের পেছনে উনিশ শতকের ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার অনেক গঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে।
মহম্মদ স্বীয় শিষ্যদিগের নাম মুসলমান অর্থাৎ ভক্ত এবং তদ্ভিন্ন যাবতীয় মনুষ্যের নাম কফির অর্থাৎ ধর্মভ্রষ্ট রাখিলেন। …স্বীয় শিষ্যগণকে কাফরদিগের বিনাশের জন্য তরবারি ধারণের আজ্ঞা দিয়া [মেহম্মদ] কহিলেন, পরমেশ্বর সম্প্রতি আদেশ করিয়াছেন ভ্রান্তির উচ্ছেদ জন্য যে সকল মুসলমান সমরশায়ী হইবেন, তাঁহারা বিবিধ বিলাসবস্তু-সমন্বিত স্বর্গধামে যাইয়া, কজ্জলনয়না অপ্সরাগণের সহবাসে, পরমসুখে কালহরণ করিবেন; কিন্তু রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিলে, পরকালে নরকে পতিত ও দুঃসহ দুঃখ-দাবদাহে অজস্র দগ্ধীভূত হইতে থাকিবেন। আরব জাতি স্বভাবতই নির্ভীক ও সমরপ্রিয়; তাহাতে ইহলোকে শত্রুর ধন-লুণ্ঠন ও পরলোকে প্রাগুক্তরূপ সুখভোগের প্রত্যাশা পাওয়াতে মুসলমানদিগের খড়ঙ্গ সৰ্ব্বত্রই অনিবার্য হইয়া উঠিতে লাগিল, সমস্ত আরব মহম্মদের অধীন হইল এবং তাঁহার মৃত্যুর অল্পকাল পরেই কাবুল হইতে স্পেন পর্যন্ত তাবৎ দেশে মুসলমান পতাকা উড্ডীন হইয়া উঠিল। যেরূপ স্বল্পকালের মধ্যে এক রাজ্যের পরেই অন্য রাজ্য, এক দেশের পরেই অন্য দেশ, মুসলমানদিগের পদানত হইয়াছিল, পুরাবৃত্তে সেরূপ আর কখনই দেখা যায় নাই। ঈদৃশ দিগ্বিজয়োন্মত্তেরা যে নতুন সম্পদের আকর ভারতবর্ষ লাভে লোলুপ হয় নাই ইহা কখনই সম্ভব নহে। (পৃ. ৩৬-৭)
গল্পের শুরুতেই যতগুলো কথা বলে নেওয়া হল, তাতেই পাঠককে পরের ঘটনার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হচ্ছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারায় এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতির ইতিহাস এসে মিশবে। সেই ভিন্ন ইতিহাসের উৎপত্তি মুহম্মদের সময়। অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় দিল্লিতে যে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং পরের সাড়ে তিনশো বছরে যে-রাজত্বে একাধিক পরিবর্তন হবে, তার পরিচয় শুধু তুর্কো-আফগান বা মুঘল রাজত্ব নয়, সামগ্রিকভাবে তা ইসলামের ইতিহাসের অংশ। এই ইতিহাসের যারা নায়ক, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বলে দেওয়া হচ্ছে এখানে। তারা সমরপ্রিয় এবং বিশ্বাস করে যে বিধর্মীদের বিনাশ করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। ধনলুণ্ঠন আর স্বর্গে অপ্সরাদের সঙ্গে সহবাসের লোভে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করতেও প্রস্তুত। তারা দিগ্বীজয়ী নয়, ‘দিগ্বিজয়োন্মত্ত’। ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যের আকর্ষণে তারা স্বভাবতই লোলুপ।
উনিশ শতকের ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাই জানবেন যে একদিকে যেমন উইলিয়াম জোনস প্রভৃতি প্রাচ্যবিদ্যাবিদের গবেষণায় প্রাচীন ভারতের কাব্য-দর্শন নিয়ে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক তেমনি প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে মুসলিম রাজত্বের অপদার্থতা সম্বন্ধেও ইংরেজ লেখকেরা মোটামুটি একমত ছিলেন। এই অপদার্থতার কাহিনী বলা বাহুল্য ব্রিটিশ শাসনের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস্থিত করা হত। জেমস মিল-এর অবশ্য প্রাচীন ভারত এবং মুসলিম শাসন, উভয় পর্ব সম্বন্ধেই সমান অশ্রদ্ধা ছিল। তা ছাড়া সুলতানী এবং মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রতত্ন আদতে ইসলামী, সুতরাং তার গুণাগুণ ইসলামের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য, এ-ধারণাও ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই চালু করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় এডওয়ার্ড গিবনের সময় থেকে সুপ্রচলিত ইসলাম সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের যাবতীয় প্রেজুডিস।১৪ আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এ-দেশেও যখন জাতীয় ইতিহাস লেখা শুরু হল, তখন একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতকে কল্পনা করে নেওয়া হল সমস্ত আধুনিকতার ক্লাসিকাল সূত্র হিসেবে, তেমনি মুসলিম শাসনকে ঠেলে দেওয়া হল মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। এবং আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপের ইসলাম সম্বন্ধে সবরকম কুসংস্কার আরোপ করা হল ‘মুসলিম জাতীয় চরিত্র’ নামক একটি কাল্পনিক ধারণার ওপর। দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তী অধ্যায়ের ভারতের ইতিহাসে এই চরিত্রটিকে এবার সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে। এই মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, সে ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু, যুদ্ধপ্রিয়, দুর্নীতিপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর।
আরবে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা থেকে যে নতুন কাহিনী শুরু হল, তারিণীচরণ তাকে ভারতবর্ষের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় তথাকথিত দাস রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে আরবদের সিন্ধ আক্রমণ, মাহমুদ গজনভির দফায় দফায় পঞ্জাব, সিঁন্ধ, গুজরাট আক্রমণ—এই সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তারিণীচরণ। প্রতিটি কাহিনীর মোটামুটি একই ছক। মুহম্মদ ইব্ন-কাসিমের সিন্ধ আক্রমণ, মাহমুদ গজনভির পঞ্জাব আক্রমণ এবং মুহম্মদ ঘুরির যুদ্ধ জয়—এই তিনটি দৃষ্টান্ত দিলে ছকটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মুহম্মদ কাসিম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ‘সিন্ধুরাজা ডাহিরের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধে নামলেন।
দৈব তাঁহার অনুকূল হইল। তাঁহার সেনাদিগের নিক্ষিপ্ত একটা জ্বলৎ গোলক আসিয়া রাজার হস্তীকে আহত করাতে হস্তী একান্ত ভীত হইয়া রণস্থল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। রাজসেনারা, রাজা পলায়ন করিলেন ভাবিয়া, চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। পরে দৃষ্ট হইবে যে, এইরূপ দুর্দ্দৈব হেতু ভারতবর্ষীয়েরা জয়লাভের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা সত্ত্বেও, অনেকবার মুসলমানদিগের নিকট পরাভূত হইয়াছেন। (পৃ. ৩৮)
বলে রাখা দরকার, এই ‘দৈব’ কিন্তু মৃতুঞ্জয়ের দৈব নয়। দুর্দৈব এখানে নিছকই দুর্ঘটনা, অধর্মাচরণের প্রতিফলস্বরূপ দৈবরোষ নয়। ‘ভারতবর্ষীয়দের’ দুর্ভাগ্য যে জয়লাভের সম্পূর্ণ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র দুর্ঘটনার জন্য তারা বারে বারে যুদ্ধে পরাজিত হয়।
অবশেষে, প্রচুর সাহসিকতা প্রকাশ করিয়া [সিন্ধুরাজা] শক্তহস্তে নিধন প্রাপ্ত হইলেন। পরে রাজধানী আক্রান্ত হইল; কিন্তু ডাহিরের পত্নী স্বামীর অনুরূপ সাহস অবলম্বন করিয়া নগর-রক্ষার চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে আহারসামগ্রীর অপ্রতুল হইয়া উঠিল। তখন শক্তহস্তে পতনের অপেক্ষা মরণ শ্রেয়ঃ জ্ঞান করিয়া তিনি নগরবাসীদিগকে তাহার আয়োজন করিতে কহিলেন। সকলে সম্মত হইল; সর্ব্বত্র চিতা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। তদনন্তর পুরুষেরা স্নানাদি সমাপন করিয়া, অসিহস্তে বহির্গত হইয়া, অনতিদীর্ঘকাল-মধ্যেই মুসলমানদিগের কর্তৃক নিহত হইল। (পৃ. ৩৮)
যুদ্ধে পরাজয়ের এই গল্পটি পরে আবার পাব। তার দুটি উপাদান বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। এক, শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে হিন্দু রমণীর সাহস। আর দুই, যুদ্ধে প্রাণত্যাগ হিন্দু পুরুষের কাছে একটি যজ্ঞ—আত্মাহুতির অনুষ্ঠান: ‘সর্বত্র চিতা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল’, ‘স্নানাদি সমাপন করিয়া…নিহত হইল’। এর সঙ্গে তুলনীয়, ‘কজ্জলনয়না অপ্সরাগণের সহবাসে’ প্রলুব্ধ মুসলমান সৈন্যের যুদ্ধলিপ্সা।
কাসিম প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প বলছেন তারিণীচরণ, সেটিও এই ছকেরই অংশ।
সিন্ধুদেশের জয়াবসানে কাসিম ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশের উদ্যোগ পাইতেছিলেন, এমন সময়ে, এক স্ত্রীর চাতুৰ্য্যজাল তাঁহার কাল হইয়া উঠিল। সমরশেষে সিন্ধুদেশে যে সমস্ত স্ত্রী বন্দী হয়, তন্মধ্যে রাজা ডাহিরের দুই দুহিতা ছিল। উহারা যেমন উচ্চকুলজাতা তেমনি অসাধারণ রূপলাবণ্যসম্পন্না ছিল। কাসিম ইহাদিগকে খলিফার উপযুক্ত উপঢৌকন জ্ঞান করিয়া তৎসন্নিধানে প্রেরণ করিলেন। মুসলমানপতি জ্যেষ্ঠার রূপে মোহিত হইয়া তাহার প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। অমনি সে বিগলিত অশ্রুধারা বর্ষণ করিয়া কহিল, হায়! আমি এক্ষণে ভবৎসদৃশ জনের অনুরাগের যোগ্য নহি, কাসিম পূর্ব্বেই আমার ধর্ম নষ্ট করিয়াছে। খলিফা ভৃত্যের ঈদৃশ ব্যবহার শ্রবণমাত্র, ক্রোধান্ধ হইয়া আজ্ঞা করিলেন, কাসিমকে চৰ্ম্মে বদ্ধ করিয়া আমার সন্নিধানে আনয়ন কর। আজ্ঞা সম্পন্ন হইলে, খলিফা রাজকুমারীকে কাসিমের শব প্রদর্শন করাইলেন। তখন সে হর্ষোৎফুল্ল নয়নে কহিল, কাসিম সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী; জনকজনকীর মৃত্যু ও তাঁহাদের প্রজাবর্গের অবমাননার প্রতিশোধ দিবার জন্যই আমি তাহার এরূপ মিথ্যাপবাদ করিয়াছিলাম। (পৃ. ৩৯)
হিন্দুনারীর সাহসিকতার সঙ্গে আরও একটি বৈশিষ্ট্য যোগ হল—উপস্থিত বুদ্ধি। আর যুদ্ধে আত্মাহুতির পাশাপাশি আরও একটি কাহিনীরও সৃষ্টি হল— আত্মীয়-স্বজন-স্বজাতির মৃত্যুর শোধ নেওয়ার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা।
একাদশ শতাব্দীর গোড়ায় মাহমুদ গজনভির সময়ে চলে আসা যাক। ‘মুসলমানদিগের মধ্যে ইহারই দৌরাত্মে সর্ব্বপ্রথম ভারতবর্ষ বিপৰ্য্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠে, এবং ইঁহারই পর হইতে হিন্দুদিগের স্বাধীনতা, কৃষ্ণপ্রতিপচ্চন্দ্ৰমার ন্যায়, ক্রমশই ক্ষয়গ্রস্ত ও বিলুপ্ত হইয়া আইসে।’ (পৃ. ৪১) মাহমুদের কয়েকটি গুণ তারিণীচরণ স্বীকার করছেন, যেমন সাহস, বিচক্ষণতা, যুদ্ধকুশলতা এবং অধ্যবসায়। অবশ্য মাহমুদ যে জ্ঞান-বিজ্ঞান-কাব্য-শিল্পচর্চার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, সে-কথা বলছেন না।
কিন্তু তিনি যেমন ঐ সকল গুণান্বিত ছিলেন তেমনি, অন্ততঃ লোকতঃ মুসলমান-ধর্ম্মে একান্ত ভক্ত, দেবদেবীর অর্চনার দারুণ বিদ্বেষী, এবং যৎপরোনাস্তি অর্থপিশাচ ও গৌরবাকাঙ্ক্ষীও ছিলেন। ভারতবর্ষ তাঁহার তাবৎ আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের প্রকৃত ক্ষেত্র ছিল। (পৃ. ৪২)
তথাকথিত ‘মুসলমান চরিত্রের’ এ আর-একটি বৈশিষ্ট্য। ইসলামের প্রতি অনুরাগ যেখানে যুদ্ধের কারণ, সেখানেও তা প্রকৃত ভক্তি নয়, লোকদেখানো ধার্মিকতা।
মাহমুদ শাহিয়া বংশের রাজা আনন্দপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন (তারিণীচরণ লিখছেন অনঙ্গপাল)।
‘মুসলমানেরা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ধ্বংস ও হিন্দুধর্মের বিলোপ সঙ্কল্প করিয়াছে এবং লাহোর গ্রহণ করিতে পারিলেই অমনি অন্যান্য ভাগ আক্রমণ করিবে, সুতরাং সকলে একযোগ হইয়া ম্লেচ্ছদিগের দমন করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে’ এই বলিয়া [অনঙ্গপাল] সুমুদয় প্রধান প্রধান হিন্দু রাজার নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাঁহার আবেদনও নিষ্ফল হয় নাই। দিল্লী, কনোজ, উজীন, গোয়ালিয়ার, কালিঞ্জর প্রভৃতির রাজারা অনঙ্গপালের সহিত একযোগ হইলেন: রাশি রাশি সেনা আসিয়া পাঞ্জাবে উপস্থিত হইল। মামুদ তাদৃশ আকস্মিক বলোপচয়ে ভীত হইয়া আত্মরক্ষার উদ্দেশেই পেশোয়ারের সন্নিধানে অবস্থিত রহিলেন। দিন দিন হিন্দুসৈন্য বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দূরদেশ হইতেও হিন্দু মহিলাগণ, হীরকাদি বিক্রয় ও স্বর্ণালঙ্কার দ্রবীভূত করিয়া, যুদ্ধের সংস্থান পাঠাইতে লাগিলেন…। (পৃ. ৪৩-৪)
মাহমুদ লাহোর দখল করলে ‘সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা’ ধ্বংস হবে, এই ইতিহাস-জ্ঞান বলা বাহুল্য রাজা আনন্দপালের থাকা সম্ভব ছিল না। এ তারিণীচরণেরই কথা। কিন্তু কথাগুলিকে তাঁর সৃষ্ট ‘অনঙ্গপাল’ চরিত্রটির মুখে বসিয়ে দিয়ে তিনি কিন্তু এই কাহিনীটিকে সমগ্র হিন্দু জাতির যুদ্ধে পরিণত করে ফেলতে পারছেন: ‘রাজারা একযোগ হইলেন’, ‘রাশি রাশি সেনা আসিয়া পাঞ্জাবে উপস্থিত হইল’, ‘দূরদেশ হইতে হিন্দু মহিলাগণ যুদ্ধের সংস্থান পাঠাইলেন’ ইত্যাদি। কিন্তু তার পরেই এল দুর্দৈব। ‘অতঃপর মুসলমান-শিবির হইতে একটা জ্বলৎ-বন্দুক অথবা তীক্ষ্ণশর আসিয়া হিন্দু-সেনানায়ক অনঙ্গপালের হস্তীর অঙ্গে বিদ্ধ হইল। মাতঙ্গ রণক্ষেত্র হইতে রাজাকে পৃষ্ঠে করিয়া পলায়ন করিল। অমনি হিন্দুসৈন্য ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।’ (পৃ. ৪৪) এ-গল্পের শেষেও আছে প্রতিহিংসার ঘটনা, তবে এবারে একটু অন্য ধরনের।
মামুদের সহিত মৈত্রীনিবন্ধন কনোজরাজ হিন্দুভূপাল সমাজে ঘৃণা ও নিগ্রহের ভাজন হইয়াছিলেন; তচ্ছ্রবণে গজনিপতি শরণাগতের প্রতিপালন সঙ্কল্পে দশম বার ভারতবর্ষে উপস্থিত হন। কিন্তু তিনি পহুঁছিবার পূর্বেই কালিঞ্জরধিপতি কনোজ-রাজের প্রাণসংহার সম্পন্ন করেন। (পৃ. ৪৬)
বলা বাহুল্য, এটিও একটি অনুষ্ঠান, সুতরাং ‘প্রাণসংহার করেন’ নয়, ‘প্রাণসংহার সম্পন্ন করেন’।
মুহম্মদ ঘুরির সেনারা ছিলেন
পৰ্বতবাসী, কষ্টসহ ও সমরচতুর; এ দিকে হিন্দু রাজারা পরস্পর অনৈক্যদৃষিত, তাঁহাদের সৈন্যকুল অপেক্ষাকৃত শান্ত ও বিশৃঙ্খলা; সুতরাং মহম্মদ অনায়াসেই জয়লাভ করিবেন আপাতত এরূপ বোধই হইতে পারে, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা হয় নাই। প্রায় কোন হিন্দু রাজাই ঘোর সংগ্রাম বিনা স্বাধীনতা বিসর্জ্জন করেন নাই। বিশেষ রজঃপূতেরা কখনই পরাভূত হয় নাই। মুসলমান রাজত্বের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ সম্পন্ন হইয়াছে, রজঃপূতের অদ্যাপিও স্বাধীন রহিয়াছে। (পৃ. ৫৩)
হিন্দু রাজারা শুধু যে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন নি, তাই নয়, মুহম্মদের প্রথম আক্রমণের পর ‘হিন্দুরা বিংশতি ক্রোশ পর্যন্ত মুসলমানদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাড়াইয়া গিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।’ (পৃ. ৫৪) দ্বিতীয় বার জয়চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুহম্মদের কপটাচারের ফলে পৃথ্বীরাজের পরাজয় ঘটে। মৃত্যুঞ্জয়ের কাহিনীর সঙ্গে তারিণীচরণের এই বিবরণের কোনওই মিল নেই। শেষে প্রতিহিংসার গল্পও আছে। ‘গোক্ষুর’ নামে এক পার্বত্য জাতি মুহম্মদের হাতে পরাস্ত হয়েছিল। তাদের কয়েকজন সুযোগ পেয়ে রাত্রে মুহম্মদের তাঁবুতে প্রবেশ করে নিদ্রিত সুলতানকে হত্যা করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে।
এর পর ভারতে সুলতানদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধর্মান্ধ শাসকদের হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী একাধিকবার আসবে। যেমন সিকন্দর লোদি।
সেকেন্দর তীর্থ-পর্য্যটন ও পৰ্ব্বাহ্নে গঙ্গা প্রভৃতি পবিত্র সরিতে স্নান নিষেধ এবং নানাস্থানের দেবালয় চূর্ণ করিলেন। একদা কোন ব্রাহ্মণ ঘোষণা করেন ‘কায়মনোবাক্যে অনুষ্ঠান করিলে সকলপ্রকার ধর্ম্মই পরমেশ্বরের সমান গ্রাহ্য’। সেকেন্দর তাঁহাকে ধরিয়া আনিলেন, এবং তিনি আপনার অনন্যবিদ্বেষী মত পরিত্যাগে অস্বীকৃত হইলে, নিষ্ঠুর নৃপতি তাঁহার প্রাণসংহার করিলেন। কোন ইষ্টনিষ্ট মুসলমান তীর্থযাত্রা প্রতিষেধ অন্যায় বলাতে ‘পাষণ্ড! পৌত্তলিকদিগের পোষকতা করিতেছিস’ বলিয়া রাজা কর্তৃক ভর্ৎসিত হইলে, তিনি উত্তর করিলেন, “না, আমি তাহা করিতেছি না, আমি বলিতেছি রাজাদিগের প্রাজাপীড়ন অতিশয় অন্যায়’। তচ্ছ্রবণে সেকেন্দর ক্ষান্ত হইলেন। (পৃ. ৮৩)
অওরঙজেবের প্রতি তারিণীচরণের লেখনীর খোঁচা বলা বাহুল্য সব চেয়ে তীক্ষ্ণ। ‘আরাঞ্জিব প্রতারক, পরস্বাপহারক ও মনুষ্যঘাতক ছিলেন।’ (পৃ. ২২০) ‘মুসলমান ধৰ্ম্মে আস্থাপ্রকাশ তাঁহার স্বার্থসাধনের পক্ষে উপকারীই হইয়াছিল।…বস্তুতঃ আরাঞ্জিব ধৰ্ম্ম বা সন্নীতি কিছুরই অনুরোধে আপন স্বার্থ পরিত্যাগ করিতেন না।’ (পৃ. ১৭৩)
অপর পক্ষে আকবর সম্বন্ধে তারিণীচরণ প্রশংসার কথাই বলেছেন, তবে প্রশংসার কারণটি তাৎপর্যপূর্ণ।
আকবর মুসলমান ধৰ্ম্ম-নির্দ্দিষ্ট কতিপয় অযৌক্তিক কর্ম্ম-কলাপের বিলোপ সাধনের চেষ্টা পাইয়াছিলেন। হিন্দুদিগের পক্ষেও তিনি অনেক অযৌক্তিক পদ্ধতি রহিত করিবার প্রয়াস পান। তিনি অগ্নি-পরীক্ষা, বিধবাদিগের অমতে তাহাদিগকে স্বামীর চিতায় আরোপণ এবং বাল্য বিবাহ নিষেধ করেন। বিধবাদিগের পুনৰ্ব্বার বিবাহ করিতেও অনুমতি দেন।…ধর্ম্ম বিষয়ে আকবরের প্রাগুক্তরূপ উদার মত দেখিয়া গোঁড়া মুসলমানেরা তাঁহার অত্যন্ত বিদ্বেষী হইয়াছিল। অনেকেই তাঁহাকে নাস্তিক বলিত। (পৃ. ১৪১)
ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষতা নয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মেরই অযৌক্তিক আচারের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন বলে আকবর প্রশংসনীয়।
মুসলমান রাজার ছলনার সাহায্যে যুদ্ধজয়ের কাহিনীও আরও আছে। যেমন শের শাহ-র রাইসিন দুর্গদখল। দুর্গে অবরুদ্ধ ‘হিন্দু রাজা’-র সঙ্গে আক্রমণকারীদের চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু
মুসলমানেরা পূৰ্ব্বকৃত নিয়ম অসিদ্ধ, এই ভান করিয়া, তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। তাহারা অতিশয় সাহসের সহিত আত্মরক্ষা করিতে লাগিল, কিন্তু অবশেষে পরাস্ত ও মুসলমানদিগের নিষ্ঠুর হস্তে নিহত হইল। ….সেরের এই বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্রূরতার বিশেষ উদ্দেশ্য কি ছিল জানা যায় না। যাহা হউক, পরিণামে তাঁহাকে এই ঘোর অপরাধের জন্য বিলক্ষণ শাস্তি ভোগ করিতে হইয়াছিল। (পৃ. ১০৪)
মুসলমান শাসকদের সঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু রাজার মৈত্রীর বিষয়টিও আবার এসেছে। যেমন মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের বৈবাহিক সম্পর্ক।
যে সকল রজঃপূত রাজারা এইরূপ বিবাহদানে সম্মত হইতেন, তাঁহারা সম্রাটের বিলক্ষণ অনুরাগভাজন ও অনুগৃহীত হইয়া উঠিতেন। তন্নিবন্ধন তাদৃশ বিবাহ জাতিভ্রংশক ও অবমানকর জ্ঞান করা দূরে থাকুক, উদয়পুরের অধিপতি ভিন্ন, সমুদয় রজঃপূত রাজারাই তদ্দ্বারা আপনাদিগকে কৃতার্থ ও সম্মানিত বোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু উদয়পুরপতি সেই সমুদয় যবনান্ত রাজাদিগের সহিত আদান-প্রদান পর্য্যন্তও পরিত্যাগ করিলেন। সেই হেতু অধুনা উদয়পুরের রাজবংশ জাত্যাংশে রজঃপূতদিগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পবিত্র বলিয়া সম্মানিত হইয়া থাকে। তাঁহার সহিত আদান প্রদানে অন্যান্য রাজারা অতিশয় শ্লাঘা জ্ঞান করেন। (পৃ. ১২৫-৬)
৮
আগেই বলেছি, তারিণীচরণের ইতিহাস বই-এর শুধু যে প্রতি বছর নতুন সংস্করণ বেরোত তাই নয়, অন্য অনেক পাঠ্যবই-ই তারিণীচরণকে মডেল ধরে নিয়ে লেখা হত।১৫ এরকম বেশ কয়টি বই-এর মধ্যে একটি হল ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর, ‘বরিশাল জিলার অন্তর্গত গোপালপুরে নিবাসী শ্রীছৈয়দ আবদুল রহিম দ্বারা সংগৃহীত।’১৬ অধিকাংশটাই তারিণীচরণ অবলম্বনে লেখা। কিন্তু অল্প কয়টি জায়গায় পরিবর্তন আছে: সেগুলি লক্ষ্য করার মতো।
প্রথমেই আর্যদের কথা। আবদুল রহিম কথাটা অন্যভাবে লিখছেন। ‘হিন্দুর ভারতবর্ষের আদি নিবাসী নহেন, ইহারা সিন্ধু নদের পশ্চিম তীর হইতে আসিয়া, বাহুবলে ভারতবর্ষের অধিবাসী হইয়াছেন।’ (প. ২) তারিণীচরণ লিখেছিলেন, ‘অনার্যেরা আর্যসম্প্রদায়ে গৃহীত হয়’, ‘আর্যের উপনিবেশ স্থাপন করে’, ‘হিন্দুপতাকা উড্ডীন করে’ ইত্যাদি। আবদুল রহিম লিখছেন, ‘বাহুবলে ভারতবর্ষের অধিবাসী হইয়াছেন’।
এর পর ইতিহাসের ঘটনার বর্ণনায় কিন্তু মোটামুটি তারিণীচরণকেই অনুসরণ করছেন তিনি। যেমন, মহম্মদ গজনবী ও মহম্মদ গোরী এতদুভয়ের মধ্যে মহম্মদ গোরীই হিন্দুদিগের প্রধান অপকারী, কারণ মহম্মদ গজনবী কেবল ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়া লুঠপাঠ পূৰ্ব্বক ডাকাইতি করিতেন, আর মহম্মদ গোরী হিন্দুদিগের পরম স্বাধীনতা-রত্ন হরণ করেন।’ (পৃ. ১৬)
অথবা, ‘মহাত্মা আকবর জিজিয়া কর উঠাইয়া দিয়াছিলেন, দুরাত্মা আরঞ্জিব তাহা পুনঃ সংস্থাপিত করিলেন।’ (পৃ. ৭৮) এমন-কি, ‘মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আরঞ্জিবের গোঁড়ামি ও দৌরাত্ম’, এই বিষয়ে তারিণীচরণের প্রতিধ্বনি করে একটি প্রশ্নের উত্তরও আছে।
পরিবর্তন আবার আসছে একেবারে শেষ প্রশ্নে এসে। প্রশ্নটা এই: ‘শিক্ষক। তুমি মুসলমান রাজত্বের বিবরণ পাঠ করিয়া কি উপদেশ পাইলে?’ এর উত্তরে সৈয়দ আবদুল রহিম লিখছেন :
ছাত্র। আৰ্য! আমি মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত পাঠ করিয়া নিশ্চয় জানিয়াছি। রাজত্ব ইহকাল ও পরকালের ভয়ানকাম্পদ। ইহাতে ঈশ্বর দত্ত ক্ষমা ও দয়াবৃত্তি এককালীন বিসর্জন দিতে হয়। হায়! কি আক্ষেপের বিষয়, যাহার সঙ্গে একত্র আহার বিহার ও শয়ন উপবেশন করিয়া বহুদিন অতিক্রম করা হইয়াছে। …ভয়ঙ্কর রাজত্বের নিমিত্ত এমন স্নেহাস্পদ সহোদরের শোণিত পাত পূৰ্ব্বক অম্লানবদনে মেদিনীকে রঞ্জিত করিতেছে। রাজত্ব তুমি মনুজ নিকরের মনকে কিরূপ পাষাণময় কর, তাহা আমি মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস পাঠ করিয়া সুন্দররূপ বুঝিয়াছি। তোমার জন্য পিতা মাতা ভ্রাতা ভগ্নীর ও অন্য অন্য মানব কুলের শিরোচ্ছেদ এমন কি, স্থায়ীধন ধর্মও তুচ্ছ বলিয়া গণিত হয়। হায় রাজত্ব! ধন্য তোমার প্রলোভন শক্তি। (পৃ. ১০০-১)
তারিণীচরণের কাছে পাঠ নেওয়া সত্ত্বেও আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার সারমর্ম এই ছাত্রটির মনে মোটেই প্রবেশ করে নি। সৈয়দ আবদুল রহিমের নিজস্ব বয়ানে আমরা। সেই মৃত্যুঞ্জয়ের প্রজার কথাই এখনও শুনতে পাচ্ছি।
এখনও পাচ্ছি, কিন্তু বেশিদিন আর পাব না। ভারতীয় সমাজসংস্কৃতির ক্লাসিকাল সূত্রগুলির মধ্যে যদি ইসলামের কোনও জায়গা না থাকে, তা হলে বিকল্প ঐতিহ্য হিসেবেই ইসলামকে ভাবা হবে। ১৮৮৬ সালে শেখ আবদুর রহিম হজরত মহম্মদের জীবনী১৭ লিখতে গিয়ে ঠিক তারিণীচরণেরই মতো ইংরেজ পণ্ডিতদের উদ্ধত করে দাবি করছেন:
ইসলাম ঈসায়ী ধৰ্ম্ম অপেক্ষা মানবজাতির বিশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছে। দর্শন ও বিজ্ঞান শাস্ত্র প্রভৃতি এসিয়া মহাদেশের মোসলমান ও স্পেনদেশীয় মুরগণ কর্ওৃক ইউরোপ মহাদেশে আনীত হইয়াছিল।…স্পেনদেশীয় মোসলমানগণ ইউরোপের দর্শন শাস্ত্রের জন্মদাতা। (পৃ. ১৭৩)
কিন্তু তার পরই ইসলাম সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদ:
ইতিপূৰ্ব্বে বঙ্গভাষায় হজরত মহম্মদের যে কয়খানি জীবনী বাহির হইয়াছে, তাহা প্রায় সমস্তই অসম্পূর্ণ বিশেষতঃ ঐ সকল পুস্তক ইংরাজী গ্রন্থাবলম্বনে লিখিত বলিয়া কোন কোন বিষয় মোসলমানদিগের উপযোগী হয় নাই। হজরতমহম্মদ তরবারি বলে স্বীয় ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছেন বলিয়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণ তাঁহার নামে যে বৃথা দোষারোপ করিয়া থাকেন, এই পুস্তক পাঠ করিলে তাহা কতদূর সত্য, সকলেই সহজে বুঝিতে পারিবেন। (ভূমিকা)
এর পর আরও সরাসরি ভারতে মুসলিম শাসন সম্বন্ধে প্রচলিত মতের—বলা উচিত হিন্দু লেখকদের দ্বারা প্রচলিত মতের—খণ্ডন করা হচ্ছে :
যদিও কোন কোন মোসলমান শাসনকর্তা ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে লোকের ওপর অত্যাচার করিয়াছেন, কিন্তু তাহা ধৰ্ম্মবিগর্হিত কার্য্য, তথাপিও তাহা দেখিয়া যে, ইসলামের উপর উক্তরূপ দোষারোপ করা উচিত নহে। (পৃ. ১৭৮)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এই আবদুর রহিম সম্পাদিত মিহির ও সুধাকর পত্রিকাতে প্রায় বঙ্কিমের সুরেই ‘বঙ্গীয় মুসলমানদিগের উপযোগী জাতীয় ইতিহাস’ লেখার আহ্বান জানানো হবে।১৮ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে শতাব্দীর শেষ বছরগুলিতে আবদুল করিম লিখবেন ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস (১৮৯৮) কিংবা ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখবেন ইতিহাসাশিত কাব্য অনল প্রবাহ(১৮৯৯)।১৯ এঁদের চেতনা বাংলার আধুনিক ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেতনা। প্রজাবর্গের নেতা, এইক্ষেত্রে বাংলার মুসলমান প্রজার নেতা হিসেবে তাঁদের অবস্থান সম্বন্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ সচেতন। ‘হায় রাজত্ব! ধন্য তোমার প্রলোভন শক্তি!’ বলে আর তাঁরা বই শেষ করবেন না।
৯
একদিকে আধুনিক ইতিহাসবিদ্যা, রাষ্ট্র আর জাতির সমীকরণ, জাতীয় একাত্মবোধ এবং জাতির স্বাধীনতারক্ষায় বাহুবলের ভূমিকা, আর অন্য দিকে জাতীয় ইতিহাস বলতে কেবল হিন্দুর স্মৃতি, হিন্দুর ঐক্য, হিন্দুর বাহুবল—বিশেষ করে বঙ্কিমের রচনায় এই দু-টি ধারণার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ বলেছেন, এখানে একটা স্ববিরোধ আছে। বঙ্কিম আহ্বান জানাচ্ছেন বটে যে নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে, এবং এ-ও দাবি করছেন যে সে ইতিহাস হবে বাহুবলের ইতিহাস, কারণ বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত পরতন্ত্র একমাত্র বাহুবলের সাহায্যেই ধ্বংস করা যায়, কিন্তু এই বাহুবলের ইতিহাস বঙ্কিম খুঁজেছেন প্রাক-ব্রিটিশ যুগে। উপনিবেশের পর্বে পরাধীন জাতির ঐতিহাসিক মুক্তি যে আধুনিক চেতনা, তার শর্তগুলো উপস্থিত করেও বঙ্কিম কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাহুবল প্রয়োগের কথা বলছেন না। তিনি শোনাচ্ছেন কেবল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতির বাহুবলের কাহিনী। এর ফলে বঙ্কিম তাঁর নিজের প্রস্তাবটি নিজেই ভেস্তে দিচ্ছেন।
বঙ্কিমকে যদি তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস-রচয়িতাদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেখি, তাহলে প্রথমেই দেখতে পাব যে সে-সময়কার নগণ্য পাঠ্যপুস্তক লেখকদের মধ্যে অনেক কম পরিশীলিত হলেও মোটামুটি একই ধরনের ইতিহাসবোধ প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয়ত, এই নতুন ইতিহাস-রচনার সব চেয়ে প্রভাবশালী ধারাটির মধ্যেও ঠিক একই স্ববিরোধ উপস্থিত। তৃতীয়ত, এই স্ববিরোধের কারণ বোঝাতে গিয়ে বঙ্কিমের ক্ষেত্রে যদিও বা বলি—রণজিৎ গুহ যেমন বলেছেন-যে চেতনার অন্তরালে স্বাধীনতার আসল লড়াই ব্রিটিশের বিরুদ্ধেই ছিল কিন্তু প্রস্তাবটা তখনও প্রকাশ্যে হাজির করা যায়নি, অন্য লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু সে-কথাটা বলতে পারব না। কারণ ইতিহাস লেখার স্বাধীনতা আর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, এই দুই সংগ্রামই যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, একথা ১৮৮০-র দশকে একাধিক বাঙালি লেখক বেশ সরাসরিই বলেছেন। সমস্যা হল, ব্রিটিশ শাসন এবং মুসলিম শাসন, দুটোকেই তাঁরা বলেছেন পরতন্ত্র। উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায় বাহুবল। কোনও স্ববিরোধ নেই এখানে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নতুন বাংলা সাহিত্য এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় ইতিহাসের এই ছকটির যে কী-একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তা আবিষ্কার করলে একটু চমকেই যেতে হয়। আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ইতিহাস-রচনা চালু হওয়ার পর থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত এর প্রায় কোনও ব্যতিক্রম নেই। জাতীয়তাবোধের ইতিহাসের এই দিকটা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি আছে বলেই বোধ হয় কথাটা ভুলে যাওয়ার একটা ঝোঁক আছে আমাদের মধ্যে। তাতে কিন্তু উগ্রহিন্দু প্রচারের সব চেয়ে জোরাল উপাদানটিকেই হিসেবের বাইরে রেখে দেওয়া হয়।
বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের ভগ্নাবশেষ বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিক অর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয় ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী। এই মতবাদের মুল আবেদন ধর্মীয় নয়, রাষ্ট্রীয়। সেই অর্থে এর যুক্তির কাঠামো সম্পূর্ণ সেকুলার। একটু ভাবলেই দেখা যাবে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ইতিহাসবোধ কোনও অর্থেই সেকুলার ছিল না। তুলনায় তারণীচরণ আদ্যোপান্ত সেকুলার।
সত্যি কথা বলতে কি, এই মতবাদে ‘হিন্দুত্ব’ ধারণাটির আদপেই কোনো ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। ‘হিন্দু’ হওয়ার জন্য কোনও বিশেষ ধর্মীয় আচার বা বিশ্বাস বা চিহ্নের প্রয়োজন নেই। হিন্দুদের মধ্যে অজস্র সাম্প্রদায়িক পার্থক্য এই মতবাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এমন-কি বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের মতো বেদবিরোধী ব্রাহ্মণবিরোধী ধর্মকেও অনায়াসে হিন্দু বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। একই ভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং বর্ণসমাজের বাইরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলিকেও হিন্দুজাতির অংশ বলে দাবি করা চলে; কিন্তু ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম নিশ্চিতভাবে এই জাতীয়তার বাইরে।
অন্তর্ভুক্তি এবং বহিষ্কারের যুক্তিটা তাহলে কী? যুক্তিটা আসলে ঐতিহাসিক উৎপত্তির যুক্তি। বৌদ্ধ বা জৈনধর্ম ‘হিন্দু’, কারণ তা ভারতে উদ্ভূত। ইসলাম বা খ্রিস্টানধর্ম ভারতীয় নয়, বিদেশি। এখানে ‘ভারত’ বলতে সম্পূর্ণ আধুনিক অর্থে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানাবিশিষ্ট সার্বভৌম রাষ্ট্রই বোঝাচ্ছে। আগেই দেখেছি, জাতীয়তাবোধের জন্ম থেকেই আমাদের ইতিহাসকল্পনায় এই সার্বভৌমত্বের ধারণা এসে গেছে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যই এই যে সার্বভৌমত্বের ভৌগৌলিক সীমা আর নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে কোনও দ্বিধা বা অসঙ্গতি সে বরদাস্ত করতে পারে না। হিন্দু জাতীয়তাবাদ গত একশো বছর ধরে এই আধুনিক ঐতিহাসিক যুক্তি ব্যবহার করেই নিজেকে প্রকৃত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলে দাবি করে চলেছে।
তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়? এর একাধিক উত্তর আছে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রত্ব মেনে নিয়ে যে-উত্তর, তাতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই হল প্রধান নির্ণায়ক। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু, বাকিরা সংখ্যালঘু। উগ্রহিন্দুর বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে সংখ্যালঘুদের কর্তব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব এবং প্রাধান্য মেনে নেওয়া। এই উত্তরটি আধুনিক জাতীয়তাবাদের আদিপর্ব থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। ভূদেব মুখখাপাধ্যায়ের স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৭৬) মনে করুন।২০ পানিপতে আহমদ শাহ আবদালির সঙ্গে মারাঠাদের যুদ্ধ চলেছে। এমন সময় মারাঠা সেনাপতির দূত আহমদ শাহ-র কাছে গিয়ে বললেন যে যদিও মুসলমানেরা চিরকাল হিন্দুদের প্রতি অন্যায় করে এসেছে, তবু হিন্দুরা ক্ষমাশীল।
…আপনি নিজ দলবল সহিত নির্ব্বিঘ্নে স্বদেশ গমন করুন। ভারতবর্ষনিবাসী যদি কোন মুসলমান আপনার সমভিব্যাহারে যাইতে ইচ্ছা করেন, তাহাতেও কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। তবে তাদৃশ মুসলমানের পক্ষে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এ দেশে প্রত্যাগমন নিষিদ্ধ।
কাল্পনিক ইতিহাস। তাই আহমদ শাহ বললেন,
তুমি মহারাষ্ট্র-সেনাপতিকে গিয়া বল…আর কখনও ভারতবর্ষ আক্রমণে উদ্যম করিব না।
এই কথা শুনিয়া দূত অভিবাদনপূৰ্ব্বক কহিল, মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য্য। আমার প্রতি আর একটি কথা বলিবার আদেশ আছে। এ দেশীয় যে সকল মুসলমান নবাব, সুবাদার, জমিদার, জায়গীরদার প্রভূতি আপনার সমভিব্যাহারী না হইবেন, তাহারা অবিলম্বে যে যাঁহারা আপনাপন অধিকার এবং আবাসে প্রতিগমন করুন। মহারাষ্ট্রীয় সেনাপতি বলিয়াছেন ‘ঐ সকল লোকের পূর্ব্বকৃত সমস্ত অপরাধ মার্জ্জনা হইল’। (পৃ. ৩৪৪)
এর পর ভারতের সমস্ত প্রান্তের শাসকবৃন্দের সভা বসল। ‘একজন গম্ভীর প্রকৃতির মধ্যবয়স্ক পুরুষ’ বললেন:
‘ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দিগেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইহার পর নহেন, ইনি উহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইহার পালিত সন্তান।
‘এক মাতারই একটি গর্ভজাত ও অপরটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়—সকলের শাস্ত্র মতেই হয়। অতএব ভারতবর্ষ-নিবাসী হিন্দু এবং মুসলমানদিগের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ জন্মিয়াছে…
‘এক্ষণে সকলকে সম্মিলিত হইয়া মাতৃদেবীর ভার গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু সকলের কৰ্ত্তা একজন না থাকিলেও সম্মিলন হয় না। কোন ব্যক্তি আমাদিগের সকলের অধিনায়ক হইবেন? দৈবানুকুলতায় এ বিষয়েও আর বিচার করিবার স্থল নাই। রাজাধিরাজ রামচন্দ্রের নিমিত্ত এই যে সিংহাসন প্রস্তুত হইয়াছে,…পৃথিবী টলিলেও আর ইহা টলিবে না—আর ঐ দেখ, মহামতি সাহ আলম বাদশাহ স্বেচ্ছাতঃ রাজা রামচন্দ্রকে আপন শিরোভূষণ মুকুট প্রদান করিয়া তাঁহার হস্তে সাম্রাজ্য পালনের ভার সমর্পণ করিবার নিমিত্ত আসিতেছে।’(পৃ. ৩৪৫-৬)
মুঘল বাদশাহ মারাঠা রাজা রামচন্দ্রের হাতে শাসনভার তুলে দিলেন।
নিমেষ মধ্যে সকলের গাত্রোত্থানের আজ্ঞা হইল। উঠিয়া আর কেহই সাহ আলমকে দেখিতে পাইলেন না। দিল্লীর সিংহাসনোপরি শিবাজী বংশ-সস্তৃত রাজা রামচন্দ্র একাকী উপবিষ্ট—তাঁহার শিরোদেশে সাহ আলম প্রদত্ত সেই রাজমুকুট। (পৃ. ৩৪৬-৭)
যাঁরা ভূদেবের এই আশ্চর্য রচনাটি পড়েননি, তাঁদের জানাই যে এর পর একটি ব্যবস্থাপক সভায় ভারতবর্ষের নতুন শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। সম্পূর্ণ আধুনিক শাসনতন্ত্র, নিঃসন্দেহে ভূদেবের সমসাময়িক নবপ্রতিষ্ঠিত জার্মান রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায় রচিত। তাতে এমনই শক্তিশালী এক সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক শক্তিকে চিরতরে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর হিসেব করে অন্য যে-উত্তরটি আমরা পাই, তাকেই স্বাধীন ভারতে ‘সেকুলার’ বলা হয়ে থাকে। এই মতটির বক্তব্য, সংখ্যাগুরুর উৎপীড়ন থেকে বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রের উচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে রক্ষা করা। সমস্যা হল, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় সম্প্রদায় অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বের কোনও ব্যবস্থা নেই, অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হচ্ছে। ফলে স্বাতন্ত্রের সব চেয়ে প্রকট চিহ্নধারী ব্যক্তি বা সংগঠনই সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত হয়। স্বাধীনতার পর ভারতের মুসলিম সমাজে সংস্কার-আন্দোলন যতটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে, পৃথিবীর কোনও মুসলিম দেশে তা হয়নি।
তৃতীয় একটি উত্তরও অবশ্য আছে। তবে সেটি সমাজ-জীবনে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা স্বীকার করে না। বাংলায় এই মতটির একাধিক প্রবক্তা ছিলেন। স্বদেশী-পরবর্তী যুগে রবীন্দ্রনাথের লেখায় এই মতটির প্রতিফলন সুপরিচিত। রাষ্ট্রনীতির সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর জনজীবনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পরিক আদানপ্রদান ও সৌহার্দ্যের যে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, এই মতের প্রবক্তারা সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরা বলেন, রাজারাজড়ার যুদ্ধবিগ্রহে নয়, এই লোকাচার-দেশাচারের জগতেই ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবে। এই ইতিহাস, বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের ইতিহাস। ভারতীয় জনজীবনের বিভিন্নতা সবরকম ধর্মবিশ্বাসকেই ধারণ করতে পারে; রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত বিবাদ তাকে স্পর্শ করে না।
এই উত্তরটা নিয়েও অবশ্য মুশকিল আছে। প্রথম অসুবিধা হল, আধুনিক ইতিহাসবোধের সঙ্গে একে কিছুতেই খাপ খাওয়ানো যায় না। এর যুক্তিটা আসলে ইতিহাসের ঊর্ধ্বে অবস্থিত। ইতিহাসে যা-ই পরিবর্তন ঘটে থাকুক না কেন, ভারতের সমাজজীবনের অন্তর্নিহিত সত্য এক এবং অপরিবর্তিত—এই হল এর বক্তব্য। ফলে কোথাও না কোথাও আধুনিক ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতীয় সমাজদর্শনের একটা মৌলিক পার্থক্য এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ন্যাশনালিজম নামে ইংরেজি বক্তৃতায় যেমন সরাসরিই বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ আধুনিক ইউরোপের এক মারাত্মক আবিষ্কার, ওটা আমাদের ঘাড়ে না চাপলেই আমাদের মঙ্গল। দ্বিতীয় অসুবিধা, উৎপত্তির সমস্যাটা এখানেও এড়ানো যাচ্ছে না। লোকাচারের ঢিলেঢালা ঐক্যের কাঠামোয় ইসলামকে সেই ভূদেবের মতো ‘পালিত সন্তান’ হিসেবেই একমাত্র জায়গা দেওয়া যায়। ফলে এই ধরনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ধর্মীয় ‘সমন্বয়’-এর উদাহরণ—ইসলাম যেখানে দেশীয় জল-হাওয়ার প্রভাবে ‘ভারতীয়’ চেহারা ধারণ করেছে। তৃতীয় অসুবিধা, লৌকিক আচার-বিশ্বাসকে যতই খাতির করা হোক না কেন, উচ্চমার্গের সংস্কৃতির সঙ্গে তার মৌলিক বিরোধ মুছে ফেলা যায় না। লোকসমাজের স্বাতন্ত্র্য সত্যি সত্যি স্বীকার করে নিলে আধুনিক সংস্কার-আন্দোলনের যৌক্তিকতাই হারিয়ে যায়। ‘বিভেদের মাঝে ঐক্য’-র এইসব নিদর্শনকে আধুনিক জাতীয় জীবনের মঞ্চে হাজির করতে হলে তাকে রীতিমতো সাবান ঘষে সাফসুতরো করে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাই করেছিলেন। আজকালকার ‘ফেস্টিভাল অফ ইণ্ডিয়া’ বা ‘অপনা উৎসব’ অন্যভাবে তাই করছে। তাতে লোকজীবনের নিজস্বতা বজায় থাকছে কি?
এই তিনটে উত্তরের কোনওটাতেই কিন্তু ইসলামের উত্তরাধিকারে সমগ্র ভারতীয় জাতির কোনো দাবি থাকতে পারে, এ সম্ভাবনাকে স্বীকার করা হয় নি। জাতীয় ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণা অনিবার্যভাবে টেনে নিয়ে গেছে একটিমাত্র সূত্রের দিকে, যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্যের উৎপত্তি এবং যার নাম প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা। ইসলাম এখানে হয় বিদেশী আক্রমণের ইতিহাস, না হলে দেশজ লোকাচারের অন্তর্গত। ইসলামের নিজস্ব ক্লাসিকাল ঐতিহ্যের স্থান ভারতের ইতিহাসের বাইরে।
মজার কথা হল, ইউরোপের ক্লাসিকাল ঐতিহ্যকে কিন্তু আমাদের আধুনিকতা অনায়াসেই আপন করে নিয়েছে। ইউরোপের ঐতিহ্য বিশ্বজনীন, এটাই বোধ হয় যুক্তি। এতে যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষণটি প্রকাশ পাচ্ছে, সেটা অবশ্য আমরা স্বীকার করি না। ইউরোপ যত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আমাদের পরাধীন করতে পেরেছে, পাঠান-মুঘল সৈন্যেরা তার ধারে কাছেও কোনওদিন পৌঁছতে পারে নি। কিন্তু আমাদের স্বাদেশিকতা ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে আজও অনুকরণীয় মনে করে।
১০
চতুর্থ একটি উত্তরও অবশ্য ছিল। সেটি এতই অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ যে তাকে উত্তর না বলে বলা উচিত উত্তরের সম্ভাবনা। তাতে ভারতের ইতিহাসের অখণ্ডতা সম্বন্ধে একটা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। উৎপত্তির প্রশ্নটাও সেখানে অনিশ্চিত। এই ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় না বলে বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয়।
বঙ্কিমের লেখাতেই এই আভাস রয়েছে।২১ ‘রাজা ভিন্ন-জাতীয় হইলেই রাজ্যকে পরাধীন বলিতে পারা যায় না। ‘বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলকেই বঙ্কিম প্রকৃত রেনেসাঁসের যুগ মনে করতেন।
পরাধীনতার একটি প্রধান ফল ইতিহাসে এই শুনা যায় যে, পরাধীন জাতির মানসিক স্ফূৰ্ত্তি নিবিয়া যায়। পাঠানশাসনকালে বাঙ্গালীর মানসিক দীপ্তি অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল। …এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালার যেরূপ মুখোজ্জল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্ব্বে বা তৎপরে আর কখনও হয় নাই। (পৃ. ৩৩২)
আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দীপ্তি হইল? …এ আলোক নিবিল কেন? (পৃ. ৩৩৯)
যে আকবর বাদশাহের আমরা শতমুখে প্রশংসা করিয়া থাকি, তিনিই বাঙ্গালার কাল। তিনিই প্রথম প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালাকে পরাধীন করেন। …মোগলই আমাদের শত্রু, পাঠান আমাদের মিত্র।’ (পৃ. ৩৩২)
ভারতের ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাস, দুই ধারায় ঘোর অসংগতি এসে যাচ্ছে এখানে। রাষ্ট্র বা জাতির সার্বভৌম কেন্দ্র কোনটা, তাও আর স্থির থাকছে না। একদিকে দেখা যাচ্ছে, আর্যদের বাংলায় অনুপ্রবেশ অপেক্ষাকৃত দেরিতে। তা হলে আর্যসভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে বাঙালির দাবি কি দুর্বল হয়ে পড়ে?
অনেকেই মনে করিবেন যে, বাঙ্গালার ও বাঙ্গালীর বড় লাঘব হইল। আমরা আধুনিক বলিয়া বাঙ্গালীজাতির অগৌরব করা হইল; আমরা প্রাচীন জাতি বলিয়া আধুনিক ইংরেজদিগের সম্মুখে স্পর্দ্ধা করি—তা না হইলে আমরাও আধুনিক হইলাম। আমরা দেখিতেছি না যে, অগৌরব কিছু হইল। আমরা সেই প্রাচীন আর্যজাতিসম্ভূতই রহিলাম—বাঙ্গালায় যখন আসি না কেন, আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ সেই গৌরবান্বিত আৰ্য। বরং গৌরবের বৃদ্ধিই হইল। আর্যগণ বাঙ্গালায় তাদৃশ কিছু মহৎ কীৰ্ত্তি রাখিয়া যান নাই—আৰ্যকীৰ্ত্তিভূমি উত্তর পশ্চিমাঞ্চল। এখন দেখা যাইতেছে যে, আমরা সে কীৰ্ত্তি ও যশেরও উত্তরাধিকারী। সেই কীর্তিমন্ত পুরুষগণই আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষ। দোবে, চোবে, পাঁড়ে, তেওয়ারীর মত আমরাও ভারতের আর্য্যগণের প্রাচীন যশের ভাগী বটে। (পৃ. ৩২৬)
কিন্তু অন্য দিকে প্রশ্ন উঠছে, বাঙালিদের মধ্যে আর্য কারা? জাতি হিসেবে বাঙালির উৎপত্তি কোথায়? সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এক দীর্ঘ প্রবন্ধে বঙ্কিম ভাষাতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের নানা আবিষ্কার জড়ো করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন। সেইসব বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যের অধিকাংশই এখন মনে হবে সম্পূর্ণ আষাঢ়ে। এই প্রবন্ধটিও বঙ্কিমের অন্যান্য লেখার তুলনায় এখন প্রায় বিস্মৃতই বলা চলে। কিন্তু প্রবন্ধের সিদ্ধান্তটি অখণ্ড জাতীয় ইতিহাস লেখার পক্ষে খুব স্বস্তিজনক ছিল না।
ইংরেজ একজাতি, বাঙ্গালীরা বহুজাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আৰ্য, দ্বিতীয় অনাৰ্য্য হিন্দু, তৃতীয় আযানার্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙ্গালীসমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনাৰ্য বা মিশ্ৰিত আৰ্য্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে প্রায় কেবলই আৰ্য। এই জন্যে দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালীজাতি অমিশ্রিত আৰ্যজাতি বলিয়াই বোধ হয় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস এক আৰ্য্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিতে হয়। (পৃ. ৩৬৩)
শুধু বঙ্কিমেই নয়, অন্য লেখকদের রচনাতেও এই সম্ভাব্য স্বতন্ত্র ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের যে বইটিকে বঙ্কিম ‘সুবর্ণের মুষ্টিভিক্ষা’ বলেছিলেন, তাতে দেখছি বলা হচ্ছে যে ভারতের অন্যত্র যা-ই ঘটে থাকুক, বাংলায় অন্তত বাহুবলের কারণে মুসলমান ধর্মের প্রসার ঘটেনি।২২ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ইংরেজ আমলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে মুসলমান সুলতান বা নবাবদের সময় বাংলায় ‘এদেশীয়দিগের উচ্চ রাজ কর্ম্ম প্রাপ্তির কোন বাধা ছিল না।’২৩ আর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ‘জাতীয়করণ’ প্রক্রিয়াটা আমরা আগেই লক্ষ করেছি।
কথা হলো, দুটি স্বতন্ত্র ‘জাতীয়’ ইতিহাস—একটি আৰ্য-সভ্যতা-উদ্ভূত, প্রধানত উত্তরভারত কেন্দ্রিক, ‘ভারতবর্ষীয়দিগের’ ইতিহাস, অন্যটি অনিশ্চিত সূত্র থেকে উদ্ভূত, ‘বহুজাতিক’ বাঙালির ইতিহাস—এই দুই ইতিহাসের ক্রমপর্যায়, গতিপথ, ছন্দের যে বৈসাদৃশ্য, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের যে জটিলতা, তাতে ভিন্নতর কোনও ইতিহাসবোধের সম্ভাবনা নিহিত ছিল কি? এ-প্রশ্নের বিশদ আলোচনার জায়গা এই প্রবন্ধে আর নেই। বাংলায় ইতিহাস রচনার এই ধারাটি অন্তঃশীলা। গত একশো বছর ধরেই আর্য হিন্দু-ভারতবর্ষের পর্বতপ্রমাণ ভারে তা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছে। তবে সামান্য যে কটি উদাহরণ দিলাম, তা থেকেই তো দেখা যাচ্ছে যে এই ভিন্ন ইতিহাসে পাঠান আর মুঘলকে একত্র করে ‘মুসলমান শাসনকাল’ নাম দিয়ে পর্ব ভাগ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাঠানপর্ব আর মুঘলপর্বের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ এসে যাচ্ছে। অথবা বাংলায় মুসলমান ধর্মের প্রসারের কথা বলতে গিয়ে ‘মুহম্মদ বলিলেন, তরবারি লইয়া কাফেরদের নির্মূল করো’, এইভাবে গল্প শুরু করা যাচ্ছে না।
ভাবা যেতে পারে, এরকম স্বতন্ত্র ইতিহাস যদি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লেখা হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এর ভারকেন্দ্রটা আর্যাবর্তে কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে দিল্লির সিংহাসনে আর বেঁধে রাখা যাবে না। ইতিহাসের কেন্দ্রিকতার প্রশ্নটাই অনেক অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বিষয়টা তখন আর ‘জাতীয়’ ইতিহাস আর ‘আঞ্চলিক’ ইতিহাসের ব্যাপার থাকবে না। কোনটা সমগ্র আর কোনটা অংশ, কে অবয়ব কে অবয়বী, এ-প্রশ্নও নতুন করে বিচার করতে হবে। তাই বলছিলাম, এই বিকল্প ইতিহাসের সামগ্রিকতা যদি কিছু থাকে, তবে তা রাষ্ট্রীয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয়।
কিন্তু এই বিকল্প ইতিহাস রচনার জন্য প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত আমাদের নেই। ভারতের ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণাটাই যে আজ পর্যন্ত ভারতের অধিবাসীদের খণ্ডিত করে চলেছে, এই সত্যটা না বুঝতে পারলে বিকল্প ইতিহাস খোঁজার পথ প্রশস্ত হবে না।
টীকা
১ উনিশ শতকে বাঙালির ইতিহাসচিন্তা এবং সেই পটভূমিতে বঙ্কিমের ইতিহাস-বিষয়ক রচনার তাৎপর্য নিয়ে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেছেন Ranajit Guha, An Indian Historiography for India :A Nineteenth Century Agenda and its Implications (Calcutta, 1988)
২ ‘বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত বাংলার ইতিহাস সংক্রান্ত বঙ্কিমের প্রবন্ধগুলি সুপরিচিত। এখানে শুধু ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ এবং ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ প্রবন্ধ দুটি থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৫৪), পৃ. ৩৩০-৩, ৩৩৬-৪০।
৩ মৃত্যুঞ্জয় শর্মণঃ, রাজাবলি (শ্রীরামপুর, ১৮০৮)।
৪ অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রচলিত রাজবংশের তালিকা সম্বন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদারের একটি আলোচনা আছে। ‘সংস্কৃত রাজাবলী গ্রন্থ’, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৬, ৪ (১৩৪৬), পৃ. ২৩২-৯। গৌতম ভদ্র আমায় এই সূত্রটির খোঁজ দিয়েছেন।
৫ মুন্সী আলিমদ্দিন, দীল্লির রাজাদির নাম (বরিশাল, ১৮৭৫)।
৬ রামগতি ন্যায়রত্ন, বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম ভাগ, ‘হিন্দু রাজাদিগের চরমাবস্থা অবধি নবাব আলীবর্দি খাঁর অধিকার কাল পর্যন্ত’ (হুগলি, ১৮৫৯)।
৭ রামসদয় ভট্টাচার্য, বাঙ্গালা ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর (কলকাতা, ১৮৬৯)।
৮ ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশুপাঠ বাঙ্গালার ইতিহাস, বীর হাঙ্গাম হইতে লার্ড নর্থব্রুকের আগমন পর্য্যন্ত (কলকাতা, ১৮৭২)।
৯ কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরেজদিগের অধিকারকাল (কলকাতা, ১৮৭০; প্রথম প্রকাশ, ১৮৫৯)।
১০ ক্ষিরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, সমগ্র ভারতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (কলকাতা, ১৮৭৬)।
১১ তাবাকৃষ্ণ হালদার, চমৎকার স্বপ্নদর্শন (কলকাতা, ১৮৬৮)।
১২ ভোলানাথ চক্রবর্তী, সেই একদিন আর এই একদিন, অর্থাৎ বঙ্গের পূর্ব ও বর্তমান অবস্থা (কলকাতা, ১৮৭৬)।
১৩ তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রথম ভাগ (কলকাতা, ১৮৭৮; প্রথম প্রকাশ ১৮৫৮)।
১৪ এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য J.S. Girewal, Muslim Rule in India: The Assessments of British Historians (Calcutta, 1970)
১৫ একটি বই দেখেছি যা সম্পূর্ণভাবেই তারিণীচরণের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ—গোটা গোটা অনুচ্ছেদে হুবহু এক। জীবনকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত (কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ, ১৮৭৫; প্রথম প্রকাশ ১৮৬৮)।
১৬ ছৈয়দ আবদুল রহিম, ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর (ঢাকা, ১৮৭০)।
১৭ শেখ আবদুর রহিম, হজরত মহম্মদের জীবন চবিত ও ধর্ম্মনীতি (কলকাতা, ১৮৮৬)।
১৮ এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য Rafiuddin Ahmed. The Bengal Muslims 1871-1906. A Quest for Identity (Delhi. 1981), p.93-7,
১৯ Guha. An Indian Historiography.p. 62-67
২০ ভূদেব রচনা সম্ভার, প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত, (কলকাতা, ১৯৬২), পৃ. ৩৪১-৭৪।
২১ বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয় খণ্ডের এই প্রবন্ধগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিলাম এখানে ‘বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস,’ ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’। বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৩১৯-২৭, ৩৩০-৩, ৩৩৬-৪০, ৩৪১-৬৩।
২২ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস (কলকাতা, ১৮৭৫), পৃ ৬১-২।
২৩ কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরাজদিগের অধিকাবকাল (কলকাতা, চতুর্দশ সংস্করণ, ১৮৭৫), পৃ. ২৪৫।
শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র : ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি – দীপেশ চক্রবর্তী
সাম্প্রতিককালে ভারত-বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মহামারি, মড়ক, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির সামাজিক ইতিহাস রচনায় মন দিয়েছেন। বিষয়টির গুরুত্ব এঁদের রচনায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য এঁদের গবেষণালদ্ধ তথ্যসমূহের পুনর্বিবেচনা করা। আমার বৃহত্তর উদ্দেশ্য ভারতবর্ষে তথা সাধারণভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র ও ক্ষমতার কয়েকটি দিক তুলে ধরা। এই চেষ্টার সপক্ষে দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি।
আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে অন্যান্য সামাজিক বন্ধনকে আত্মসাৎ, দমন বা শিথিল করে বা প্রয়োজনবোধে হটিয়ে দিয়ে—নাগরিকের ওপর নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেও অগ্রাধিকার দেয়—ভারতীয় ইতিহাস রচনায় সে আলোচনা শুরু হয়নি বললেই চলে। ‘শান্তি বজায় রাখা’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলা’ রক্ষা করা, ‘আর্থিক উন্নতি’ ও ‘জনস্বাস্থ্য’ রক্ষা করা রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখ্য কর্তব্য বলে ধরা হয়। এগুলো যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য, তেমনি তার মতাদর্শগত হাতিয়ারও বটে। এই রাষ্ট্রিক মতাদর্শের একটি ভান থাকে—যা সংবাদপত্র থেকে ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত ছড়ানো—যেন রাষ্ট্রের স্বনির্বাচিত কর্তব্যগুলি ইতিহাস-বহির্ভূত কোনও ‘প্রাকৃতিক’ বিধানের অংশ, যেন রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যের মূল মতাদর্শগত সূত্রগুলি (যেমন, প্রগতি, উন্নতি, স্বাস্থ্য) মানুষের স্বাভাবিক ও আদিমতম আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। যদি কোনও প্রতিষ্ঠান ও মানুষ মৌলিকভাবে ‘প্রগতি’, ‘উন্নতি’ ইত্যাদির মূলমন্ত্রের বিরোধিতা করে, তাঁদেরই বর্ণনা করা হবে ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ বা ‘মূর্খতার অন্ধকারে’ নিমজ্জিত বলে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সম্প্রতি এমন কথাও পড়েছি যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মৌলিক সমালোচনা হয় এমন ইতিহাস রচনা করা নাকি দেশদ্রোহিতারই নামান্তর।
এ-প্রবন্ধের কেন্দ্রে আছে শরীর, সমাজ ও ব্যাধি। মহামারি বিষয়ক কতগুলো ধারণা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। শরীরের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? একটু ভাবলেই বোঝা যাবে সম্পর্কটি জটিল ও গভীর। পরিবার-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যায় আমাদের এই তথাকথিত নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ বস্তুটির সঙ্গে সরকারের সম্বন্ধের নজির। বুর্জোয়া সভ্যতা মানুষের শরীরকে যেভাবে ব্যবহার করে ও যে তাৎপর্য দেয়, তা প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শরীরের যে অবস্থান থাকে তার থেকে আলাদা। ‘কৃষ, শরীর’, ‘আদিবাসী-শরীর’কে ভেঙে-চুরে, দুমড়ে-মুচড়ে, নতুন অভ্যাসের ফাঁদে ফেলে, নতুন রুটিনের ছাঁচে ঢেলে তবে তো তৈরি হয় শ্রমিকের শরীর, বিপণন সমাজের অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর ক্রেতার শরীর, ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের স্বাস্থ্য-পত্রিকার শরীর।
এই পরিবর্তন এক দিনে হয় না। পুরোপুরিও ঘটে না কোনও সময়। পরিবর্তনের পথটিও সর্বত্র মসৃণ নয়। স্থান-কালভেদে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের সংঘর্য দেখা যায়। যেমন জরুরি অবস্থা চলাকালীন সাধারণ মানুষের ‘নাসবন্দি’-বিরোধিতা। এই অসম ও বন্ধুর পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার ইতিহাসে রাষ্ট্রের হাতে ‘অস্ত্র’ থাকে নানা ধরনের—আইনব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, আর্থনীতিক ব্যবস্থা। কিন্তু একটি বিরাট ‘অস্ত্র’ আধুনিক শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞান-ভিত্তিক ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতি।
আমাদের দেশে উনিশ শতকের শেষ দিকে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে সরকারের প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে দাঙ্গা হয়, এ খবর অনেকেরই জানা আছে। এ ছাড়া বসন্ত, কলেরা ইত্যাদি মহামারি নিয়ন্ত্রণ-বিষয়ে অনেক সময়ই সরকার, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষ যে একমত হননি এ-ও সুবিদিত। হাসপাতাল সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ভীতি, ‘সুঁই’ নিতে অনিচ্ছা, এ সব হয়তো আমাদের মধ্যবিত্ত অনেকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ। এ বিষয়ে কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী অংশগুলিতে আলোচনা করব। তা থেকেই বেরিয়ে আসবে শাসনের সঙ্গে শরীরের, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ইতিহাস। আলোচনার বৃহত্তর পটভূমিতে আমরা আবার ফিরে আসব বর্তমান নিবন্ধের শেষে।
জনস্বাস্থ্য ও ভারতশাসন
জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ইত্যাদি ‘আধুনিক’ ধারণা এদেশে আমদানি করে ইংরেজ। জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটির সঙ্গে ঔপনিবেশিক ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশশাসনের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সাম্রাজ্যবাদের গর্ভে যেমন নৃতত্ত্ববিদ্যার জন্ম ঘটে, চিকিৎসাশাস্ত্রেরও অনেক শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে উপনিবেশের কাণ্ডটিকে বেষ্টন করে।
এর একটা ভাল উদাহরণ ‘ট্রপিক্যাল মেডিসিন’ বিষয়টি। ১৮৯০-এর দশকে এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন স্থাপিত হয় ১৮৯৯ সালে। সেই বছরই প্রথম প্রকাশিত হয় জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন। একটি সাম্প্রতিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে দেখতে পাই যে, যে-আলোচনা-বিতর্ক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির জন্ম, তার মূল ছিল একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে: শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন? অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদরা অনেক রোগের ব্যাখা দিতেন ‘মায়াস্মা’ বা ‘পূতিবাষ্প’র তত্ত্বের মাধ্যমে। ওয়রবয়স দেখাচ্ছেন যে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধেও এই ধারণা খুব চালু ছিল—জে, লিন্ড রচিত ১৭৬৮ সালের বই এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস-এর ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে গত শতাব্দীর গোড়ায়, ১৮০৮ সালে।১ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকাল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে।২ ১৮১৯ সালেও তাদের ভারতগামী কর্মচারীদের ‘ডিসিসেস অফ হট ক্লাইমেটস’ বিষয় অধ্যয়ন করতে হত।৩ পৃতিবাষ্পের তত্ত্বে বিশ্বাসীরা বলতেন, গরম দেশগুলি স্বভাবতই শ্বেতাঙ্গ মানুষদের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর, তাই সেখানে দীর্ঘস্থায়ী রাজত্ব বা উপনিবেশ চালানো মুশকিল। এই তত্ত্বের বিরোধী যে গবেষণা চলে চিকিৎসাবিদ্যায় তারই ফল ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ১৮৬০-এর পর থেকে পাস্তুর প্রমুখের গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয় জীবাণু তত্ত্ব। বিভিন্ন রোগের মূল বিভিন্ন জীবাণুতে, এবং এই জীবাণু সনাক্ত করা ও তদনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটাই চিকিৎসাশাস্ত্রের মূল দায়িত্ব—এটাই ছিল এই তত্ত্বের মূলকথা। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ তা বোঝাতে গিয়ে এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন ওয়রবয়স। উদ্ধৃতিটির উৎস ১৮৯৮ সালের ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নাল, এবং উক্তিটি করেছিলেন প্যাট্রিক ম্যানসন যাঁকে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক বলে অনেক সময় ভাবা হয়। ম্যানসন বলেছিলেন:
আমি এখন এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব। শুধু তাপ বা বাষ্পই যে গরম দেশে সমস্ত অসুখের উৎস, তা নয়। এইসব অসুখের শতকরা নিরানব্বই ভাগের কারণ হল বিভিন্ন ধরনের জীবাণু।…তাদের বিনাশ করা হল জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের প্রয়োগের প্রশ্ন।৪
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিতর্কে যার অস্তিত্ব প্রতিফলিত, সেই সাম্রাজ্যবাদ তো আর সঠিক স্বাস্থ্যতত্ত্বের আশায় বসে থাকেনি। ট্রপিক্যাল মেডিসিন যতদিনে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে তার আগেই ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও নতুন রাষ্ট্র কায়েম হয়ে বসেছে। পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে এই নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হিংসার ভেতর দিয়ে। পরে ‘শান্তি স্থাপনা’র নাম করে যতই বাহাদুরি নিতে চান না কেন ইংরেজ, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে একশো বছর ধরে ছোট-বড় লড়াই চালিয়েছে কোম্পানি। এই নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতার অন্যতম উপাদানই ছিল এর শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়মাশ্রিত সেনাবাহিনী। একচেটিয়া সামরিক শক্তি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের একটি প্রাথমিক শর্ত।
সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি পরিষ্কার যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের গোড়ার দিকে (এবং পরেও) ‘জনস্বাস্থ্য’-বিষয়ক সমস্ত ভাবনাচিন্তাই উৎপন্ন হচ্ছে সেনাবাহিনীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে। কোম্পানির সৈন্যদের যুদ্ধপ্রস্তুতি ও ক্ষমতার একটি প্রধান অন্তরায় ছিল সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারি। বিশেষত যে সেনাবাহিনীকে ভারতের নানা অঞ্চলে ঝটিকার মতো ঘুরে বেড়াতে হবে, তার পক্ষে সৈন্যদের অসুস্থতা ছিল এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডে পিন্ডারি ও মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে জমায়েত করা সৈন্যরা অনেকেই কলেরার কবলে পতিত হন। এক সপ্তাহে ৭৬৪ জন সৈন্যের পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে। সমসাময়িক রিপোর্টে বলা হয়: ‘প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে (অসুস্থ) সৈন্য ভূপতিত হচ্ছিল ও মৃত ও মুমূর্ষু মানুষে রাস্তা ঢেকে যাচ্ছিল’। কলেরার আক্রমণ এ-যাত্রা চলে ১৮২১ সাল পর্যন্ত।৫ একটি হিসেবে দেখতে পাচ্ছি ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত কোম্পানির অধীনে যত ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসার ছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর মাত্র ছয় শতাংশের কারণ ছিল সরাসরি যুদ্ধকাৰ্য। বাকিদের গ্রাস করে নানাবিধ অসুখ; জ্বর (ম্যালেরিয়া-জাতীয়) রক্ত-আমাশা, উদরাময়, যকৃতের অসুখ ও কলেরা। এর মধ্যে কলেরার প্রকোপ ছিল ভয়ানক।৬
সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে সমস্যাটি নগণ্য ছিল না। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে শ্বেতাঙ্গ সৈন্যের সংখ্যা প্রভূতভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের সৈন্যবাহিনীর মোট ২২৭,০০৫ জনের মধ্যে ব্রিটিশ অফিসার ও সৈন্যের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮২,১৫৬। অসুস্থতা ও মৃত্যুর দরুণ যে পরিমাণ সৈন্য ও অফিসার অসমর্থ বা বাতিল হয়ে যেতেন, তাদের বদলি সরবরাহ করতে গেলে প্রতি বৎসর দশ হাজার করে নতুন লোক আমদানি করতে হত।৭ কোম্পানির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি একটি খুবই গুরুত্ব প্রশ্ন ছিল।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্যনীতির সূত্রপাত এই ইতিহাসে। সংক্রামক ব্যাধির উৎস অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও অভ্যাস-সৃষ্ট পরিবেশে, এমন একটা মতবাদ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে জন্ম নিচ্ছিল। শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা শ্রমিক বসতিগুলোই অস্বাস্থ্য, অসুস্থতা ও এমন কি ‘অমানবিকতা’রও ডিপো—এই ধারণা এঙ্গেলসের অল্প-বয়সের রচনা ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা(১৮৪৪) ও আরও অনেক সমসাময়িক পুস্তিকা ও সরকারি রিপোর্টে পাওয়া যাবে। এর ফলে ভারতের যেসব জায়গায় জনসমাগম হত তাকে খুব ভয় পেতেন ব্রিটিশ সরকার। বাজার, গঞ্জ, মেলা, তীর্থক্ষেত্র—তাদের চোখে এই সব জায়গাগুলোই ছিল রোগ ছড়ানোর কেন্দ্র। ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন কেমন করে হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়াগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, মহারাষ্ট্রের নাসিক ও পান্ধারপুরের তীর্থস্থান, অন্ধ্রের তিরুপতি, তামিলদেশে কাঞ্চিপুরম—এই সমস্ত ক্ষেত্রে নজর পড়ে রোগভয়ে ভীত বিদেশি সরকারের।৮ ১৮৬১ সালে কনস্ট্যানটিনোপলে অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্যকর পরিবেশ’ বিষয়ক প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মিলনে আলোচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল ‘ভারত’। ভারতে তীর্থযাত্রীদের ভিড় ও দলবেঁধে ভ্রমণ করার রীতি এখানে বর্ণনা করা হয় ‘কলেরা সংক্রমণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কারণ’ হিসেবে।৯ এই মনোভাব থেকে ব্রিটিশ সরকার মেলা-পরিচালনার বিশাল আয়োজন গড়ে তোলেন। পুলিশ, ডাক্তার, ওষুধ, পানীয় জল, মলমূত্রত্যাগের ব্যবস্থা, বাঁশের বেড়া ইত্যাদি দিয়ে ‘ভিড়’কে কীভাবে সুশৃঙ্খল ও সংযত করা যাবে, এ বিষয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা খরচ করেন সরকার। হাতের কাছে বইটি নেই, তাই নাম উল্লেখ করতে পারছি না এক্ষুণি, কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় পুলিশ প্রকাশিত মেলা ম্যানেজমেন্টের ম্যানুয়াল দেখেছি। যাতে বিভিন্ন সাবধানবাণী ছাড়াও জনপ্রতি কতখানি বাঁশ, দড়ি, জল, পায়খানা, ডাক্তার ও পুলিশ প্রয়োজন, তার একটা বাঁধা হিসেব দেওয়া ছিল।১০
কোম্পানির প্রথম দায়িত্বই ছিল ভারতবর্ষে চাকুরিরত ইংরেজ অফিসার ও সৈন্যদের এখানকার ‘দূষিত’ আবহাওয়া ও জায়গা থেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে রাখা। ইংরেজ-অধ্যুযিত অঞ্চলগুলি খোলামেলা হবে, অফিসারদের বাংলো হবে আলোবাতাস ভরা সুবিশাল কাঠামো, শ্বেতাঙ্গ-পাড়ার সড়ক, নালা ইত্যাদির স্বাস্থ্যকরতার প্রতি রাখা হবে কড়া নজর। ১৮৬৪ সালে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টস্ অ্যাক্ট রচিত হল এই উদ্দেশ্যে। ১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্ ম্যানুয়াল-এ লেখা হল: ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা…। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে’।১১ এই নীতি অনুসারে জন্ম হল ভারতের নানান শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন ইত্যাদি। সাম্রাজ্যবাদী জনস্বাস্থ্যের মূল কথাই ছিল জাতিবৈষম্যকে বাঁচিয়ে রাখা।১২
এর ‘কারণ’ ছিল বিবিধ। একটি নিশ্চয়ই খরচা-সম্পর্কিত। ভারতীয় রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপের ভয়ও ছিল। তা ছাড়া ছিল এই বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, ব্রিটিশজীবন ভারতীয় সাধারণ মানুষের জীবনের চাইতে মূল্যবান। এই বিশ্বাস ব্রিটিশের ভারতে অনুসৃত ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতিকে শহরমুখীও করে তোলে। এমনকী বিশ শতকেও গ্রামাঞ্চলে ম্যালেরিয়া-বিষয়ক যে অনীহা ছিল, তা সম্প্রতি গবেষণা করে দেখিয়েছেন তামিলনাড়ুর ঐতিহাসিক ডি. আর. মুরলীধরণ।১৩
মোট কথা, ঔপনিবেশিক সরকার আধুনিক রাষ্ট্রের একটি শর্তপালনে অক্ষম ছিল। সব শরীরই এক, সকলে ব্যক্তিগতভাবে ‘স্বাস্থ্যকর’ ব্যবস্থা নিলে তবেই ‘জনস্বাস্থ্য’র বিকাশ হবে, সকল গৃহেরই পরিমার্জনা প্রয়োজন—ব্যক্তিগত শরীর-গৃহ-জনস্বাস্থ্য এই তিনের সমীকরণের যে-নীতির বিকাশ আমরা ইংল্যান্ডে দেখতে পাই, তা ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে পুরোদস্তুর পালন করেনি। এককভাবে ভারতীয় শরীরগুলো দুর্বল হোক, অল্পায়ু হোক, তাতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বা পুঁজির কিছু এসে যেত না তেমন। এমন কী শিল্পায়নও এমনও ধরনের হয়েছিল যে শ্রমিক-শরীরের ব্যক্তিগত পুষ্টির প্রতি নজর দেবার বিশেষ প্রয়োজন বোধ হত না। বাংলা পাটশিল্পের আলোচনায় আমি অন্যত্র দেখাবার প্রয়াস পেয়েছি যে ‘সংক্রামক ব্যাধি’ নিয়ন্ত্রণই ছিল চটকলগুলোর স্বাস্থ্যনীতির মূল উদ্দেশ্য।১৪ ভয়ের কারণ ছিল ভারতীয় শরীরের একত্রীকরণ। তার সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চললেই ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় শরীর ‘নীরোগ’ থাকবে—এই নীতির ব্যতিক্রম কিন্তু সময় সময় বড় শহরগুলোতে করতেই হত। যদিচ শ্বেতাঙ্গপাড়া ও নেটিপাড়া আলাদা করা ছিল, সংক্রামক ব্যাধি এলে তা কেবল গরিব, শ্রমজীবী মানুষের বস্তিতেই আটকে থাকবে এমন তো কোনও কথা ছিল না। ১৮৯৮ সালে বোম্বাই নগরীতে সরকারের প্লেগ-দমননীতির বিরুদ্ধে যেসব দাঙ্গা হয়, তার ইতিহাসে কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দোমনা ভাবটিই বেরিয়ে আসে। এক দিকে তখন শহরের শ্রমিক-অঞ্চলে রাষ্ট্রের জোরাল অনুপ্রবেশ ছাড়া উপায় নেই। ‘ভারতীয়’ শরীরকে চিকিৎসাধীন না করতে পারলে ‘ইউরোপীয়’ জীবনের আশঙ্কা বাড়বে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সরকারের ভয় ‘ধর্ম’ নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে যদি আবার ১৮৫৭ ফিরে আসে!
জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সরকারি সমালোচনা করেছিলেন—সে প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরে আসব। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার: ‘জনস্বাস্থ্য’ বা ‘পরিবেশ’-এর প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদীর রাষ্ট্রের নীতি ছিল ‘মিনিমালিস্ট’, রাষ্ট্রশক্তির নিজস্ব বাঁচার প্রয়োজনে ন্যূনতম যা করার ছিল তা-ই তাঁরা করতেন। ভারতের আধুনিক রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের এটাই ইতিহাস। এই ইতিহাসে ষদি স্বাস্থ্য ও শাসনের প্রশ্ন দুটিকে পরস্পর সম্পৃক্ত অবস্থায় দেখি, তাকে আকস্মিক বা সন্নিপাতিক বলে ধরে নেবার কোনও কারণ নেই। ইতিহাসের পাঠকমাত্রেই জানেন যে অনেক সম্পর্কই তার জন্মলগ্নের ইতিহাসে উলঙ্গভাবে ধরা পড়ে, কালক্রমে অভ্যাসের আস্তরণ পড়ে মূলসূত্রটিই অনেক সময় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। মিশেল ফুকোর কথাই ভাবুন। বর্তমান সমাজে ক্ষমতার বন্টন ও ব্যবহার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁকে রচনা করতে হয় কয়েদখানা, পাগলাগারদ বা চিকিৎসাগারের ‘জন্ম’বৃত্তান্ত। সেই রকম ভারতের স্বাধীন রাষ্ট্র ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অনেক ফারাক থাকলেও, আমাদের দেশে আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঔপনিবেশিক সময়ে, তাই বর্তমান শাসনব্যবস্থার অনেক অনুচ্চারিত সত্য তার জন্মের ইতিহাসে—অর্থাৎ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে—অনেক নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত।
রাষ্ট্র, সমাজ, মহামারি ও জনমানস
অসুস্থতা, ব্যাধি, সংক্রামকব্যাধি—এরা মনুষ্য-সভ্যতার চিরন্তন সঙ্গী। সব সমাজেই এরা আছে, সব সমাজকেই এদের নিয়ে ভাবতে হয়, কিন্তু সব সমাজে বা ইতিহাসে ভাবনার ‘ক্যাটিগরি’ এক নয়। আমাদের গত দুশো বছরের ইতিহাসে দেখছি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা যেভাবে ভেবেছেন, সাধারণ মানুষ সেভাবে সবসময় ভাবেননি। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে হাকিম-বৈদ্যদের দর্শনও ছিল অন্যরকম। রাষ্ট্রের ভাবনা ও আমাদের সমাজের অন্তর্গত ভাবনায় বিরোধ ছিল, সে-বিরোধ স্থানে স্থানে খোলাখুলি সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে। এর সবচেয়ে নাটকীয় নিদর্শন ১৮৯৭-৯৮-তে বোম্বাই শহরে সরকারি প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ, যা নিয়ে ভাল গবেষণা করেছেন ডেভিড আর্নল্ড ও ইয়েন ক্যাটান্যাক।১৫
বোম্বাই নগরে প্লেগ-জনিত প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮৯৬ সালের আগস্ট মাসে। সে-বছর অক্টোবর মাস থেকে সরকার ব্যাপক ও জোরদার ব্যবস্থা নেন প্লেগ প্রতিরোধের জন্য। আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়— প্রয়োজন হলে জোর খাটিয়ে প্লেগ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার, মেলা তীর্থযাত্রা (বিশেষত হজ-যাত্রা) বন্ধ করার, রেলযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার, এমনকী প্লেগ-সন্দেহে মানুষকে আলাদা করে পরীক্ষা করার। সরকারি নীতির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ জমতে থাকে ও প্রকাশ পায়। ১৮৯৬র ২০ অক্টোবর প্রায় এক হাজার মিলশ্রমিক আক্রমণ করেন বম্বের আর্থার রোড হাসপাতাল। গুজব রটেছিল যে, এক মহিলাকে জোর করে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। ৯ মার্চ ১৮৯৮ একটি বারো বছরের বালিকাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সরকারি চেষ্টাকে শহরের জোলা-সম্প্রদায়ভুক্ত তাঁতিরা একজোট হয়ে ব্যর্থ করে দেন। প্লেগ-কানুনবিরোধী আন্দোলন চলে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে, কলকাতায়ও তার প্রভাব পড়ে। এই বিক্ষোভের কারণেই পুণার প্লেগ-কমিশনার ডব্লিউ. সি. র্যান্ড খুন হন ১৮৯৭ সালের জুন মাসে।১৬
বসন্ত, কলেরা বা ম্যালেরিয়া নিয়ে এমন সাংঘাতিক সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের নজির নেই। কিন্তু প্লেগসহ অন্যান্য মহামারি বা মড়ক, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদরা যে আলোচনা ও তথ্যসংযোজন করেছেন, তার ভিত্তিতে একটি সাধারণ সূত্রের নির্দেশ করা যায়—তা হল রাষ্ট্র বনাম সমাজ বা গোষ্ঠীর সংঘর্ষের কথা। এই সংঘর্যের ব্যাপ্তি আমাদের গণ-ইতিহাসের নানা স্তরে। মহামারির ইতিহাস ঘাঁটলে একথাই মনে হয় যে ‘সমাজ’-এর চোখে রাষ্ট্র অনেক সময়ই একটি বাইরের অনুপ্রবেশকারী শক্তি। তাই জনমানসের মহামারি-চিন্তায় একটি রাজনীতিক বিষয় থাকে যার প্রকাশ অনায়াসেই রাষ্ট্রবিরোধিতা হতে পারে। দ্বিতীয়ত দেখা যায় মহামারিকে ঘিরে ‘সমাজ’-এর আত্মসংবদ্ধ হবার প্রয়াস। দুটি বিষয় নীচে একটু বিশদ আলোচনা করছি।
মহামারি ও রাজনীতিক চেতনা
সাম্প্রতিক ইতিহাস-আলোচনার ক্ষেত্রে পাঠক লক্ষ করে থাকবেন যে, একটি বক্তব্য বহুবারই উত্থাপিত হয়েছে। তা হল এই যে, নিম্নবর্গের ও সাধারণভাবে প্রাক-ব্রিটিশ রাজনীতিক চেতনায় মহামারি, মড়ক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি বিশেষ স্থান আছে; আমাদের জনসংস্কৃতিতে মহামারি, মড়ক, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি অনেক সময়েই রাজধর্মের ব্যত্যয় সূচিত করে। পশ্চিমবঙ্গে শীতলা পুজা নিয়ে তাঁর রচনায় র্যালফ নিকোলসও এই সূত্রটির নির্দেশ দিয়েছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাঁচটি দৈব-দুর্বিপাকের কথা বলা আছে, যা রাজা ও রাজ্যের বিনাশকারী: অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক। নিকোলাসের মতে এটি কাকতালীয় কোনও ঘটনা নয় যে, বাংলার অষ্টাদশ শতকের মারাঠা আক্রমণ ও অরাজকতার মুখেই ছড়িয়ে পড়ে শীতলার পালাগান:
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শীতলা বিষয়ক রচনার প্রচার দেখে মনে হয়…বসন্ত রোগের অভিজ্ঞতা যেন একটি নতুন তাৎপর্য গ্রহণ করেছিল তখন। এই পালাগানের জনপ্রিয়তা ও মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলমাল সমসাময়িক ঘটনা। তাছাড়া যে অঞ্চলে এগুলোয় উদ্ভব হয় সেই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণের শিকার হয়েছিল।১৭
‘রাজত্ব’ আর ‘ধর্ম’—এই দুটি ধারণা একসূত্রে গাঁথা।১৮ তাই দৈবদুর্বিপাক নীতির স্খলন, অধর্মের সূচনা ও (ধর্ম) রাজত্বের বিনাশের ইঙ্গিত দেয়। এই ভাবনার আনুষঙ্গিকভাবে উনিশ শতকে মহামারি উপলক্ষে জনমানসে যা প্রতিফলিত হয়েছে তাকে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনাই বলা চলে। আর্নন্ড ক্যাটান্যাক-প্রমুখেরা এর অজস্র উদাহরণ দিয়েছেন। বুন্দেলখণ্ডে হেস্টিংসের সেনাবাহিনী যখন কলেরা-আক্রান্ত হয়, তখন তার ভিন্নরকম অর্থ করেছিলেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় রাজা হর্দুকোনের স্মৃতিতে পবিত্র কোনও স্থানে শ্বেতাঙ্গ সৈনিকেরা জনৈক ব্রাহ্মণের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে গোমাংস খেয়েছিল—এই অর্ধমাচরণেরই ফল কলেরা।১৯ আর রাজা, যাঁর ধর্মকে পালন করার কথা, অধার্মিকতাকে প্রশ্রয় দিলে বা নিজে অধার্মিক হলে তাঁর পতনও অনিবার্য হয় জনমানসের কল্পনায়।
এ-কথা অনেক ঐতিহাসিকই লক্ষ করেছেন যে, জাতীয়তাবাদী কৃষক বা গণ আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তগুলোতে অনেক সময়ই এই গুজব স্বতঃস্ফূর্তভাবে রটেছে যে, ইংরেজ শাসন শেষ প্রায়। তার নিজের অধর্ম-ই তাকে ভেতর থেকে জীর্ণ করে ফেলেছে, পচা-গলা সরকার শীঘ্রই ধরাশায়ী হবে।
এটা লক্ষণীয় যে, প্লেগ-বিরোধী জনবিক্ষোভ ও দাঙ্গার সময় ঠিক এই ধরনেরই গুজব ছড়িয়েছিল। কলকাতায় মুসলমানদের মধ্যে বলা হয়েছিল, ইংরেজের দিন শেষ, তুর্কী সুলতান সৈন্য পাঠাচ্ছেন কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করতে। হজ-যাত্রা বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে একজন সাংবাদিক লিখেছে যে, শহরে সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাস, এই সব হজ-বিরোধী নিয়মাবলীর জন্য ‘প্লেগ’ একটা অজুহাতমাত্র। আসলে সরকার চান না যে, মুসলমানেরা মক্কায় যান, কারণ ব্রিটিশের ভয় যে মক্কাগামী মুসলমানেরা ফিরে আসবেন সুলতানের সৈন্যবাহিনী সমেত, আর তাহলেই তো ব্রিটিশ-রাজের খেল খতম!২০
গুজরাটের খেড়া পরগনার চাকালাসি গ্রামে ১৮৯৮ সনে দাঙ্গা হয় এই গুজবের ভিত্তিতে যে, ‘মহীনদীর দক্ষিণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে…আর প্লেগসংক্রান্ত সতর্কতা ও বিচ্ছিন্নতা-নীতির উদ্দেশ্য একটিই—যাতে এই খবরটি নদীর উত্তরে না পৌঁছয়।’২১ উত্তর-ভারতে রটনা হয়েছিল ইংরেজ ইচ্ছে করেই মারাত্মক ব্যাধি এনেছেন দেশে, যাতে রুশরা ভারত আক্রমণ না করেন।২২ কলকাতায় রটেছিল যে হিমালয়বাসী এক সাধুর উপদেশে ও ইংরেজ রক্ষার্থে সরকার স্থির করেছেন যে মা-কালীর কাছে দুলক্ষ প্রাণ বলিদান করা হবে। তাই ওষুধ, টিকা আমদানি করে নরমেধযজ্ঞ!২৩
ইংরেজ-বিরোধিতা ও সরকার বা রাষ্ট্র-বিরোধিতা মিলেমিশে আছে এই মনোভাবে। সরকার প্রজাবিরোধী, তাই খাবারে, কুয়োর জলে, রুটিতে, হাসপাতালের ওষুধে বিষ মেশানো হচ্ছে—এই রকম প্রচুর রটনার খবর দিয়েছেন ক্যাটান্যাক ও আর্নল্ড। মারকুটে সরকার সম্বন্ধে এ-ও রটেছিল মোরাদাবাদ, কানপুর, গুজারাটের অংশে, যে হাসপাতালে রোগীদের শরীর থেকে তেল নিষ্কাশন করে মলম তৈরি হচ্ছে ও সেই মলম পাঠানো হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধে রত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের কাছে। হ্যাফ্কিন-প্রবর্তিত টিকা-বিষয়ে পঞ্জাবে বলা হয় তার সূচের সাইজ লম্বায় এক গজ, শরীরে ফোটালেই হয় মৃত্যু নয় বন্ধ্যাত্ব, ডেপুটি কমিশনার সাহেব এতেই মারা গেছেন (আধঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণাভোগের পর), ইত্যাদি।২৪ বসন্ত-টিকার প্রসঙ্গেও আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, অনুরূপ রটনা হয়েছিল—টিকার উদ্দেশ্য জাত-ভাঙানো, ধর্মনাশ করা, নতুন করে বসানো বা জোর করে কুলি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।২৫
রাষ্ট্রের জুলুম—এই গুজবগুলির একটি অন্যতম বিষয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অধার্মিক ইংরেজের অনাচারের কথা। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে কীভাবে মানুষ বুঝতেন আধি-ব্যাধির অভিজ্ঞতাকে? ঔপনিবেশিক ও আধুনিক রাষ্ট্র সংক্রামক-ব্যাধির যে মানে করতেন, তার বাইরে নিম্নবর্গের জীবনে কী ‘মানে’ হত দুর্দৈবের?
দুর্দৈব ও সমাজ
শীতলাপুজোর ব্যাখ্যায় একটি অনুধাবন-যোগ্য কথা বলেছেন নিকোলাস—‘ক্যালামিটি’ থেকে ‘কমিউনিটি’। কমিউনিটি’র বাংলা যদি ‘গোষ্ঠী’ বা ‘সমাজ’ করি (অর্থাৎ ‘সমাজ’ কথাটির যে-অর্থে আমরা বাংলায় ‘সমাজচ্যুত’ কথাটা ব্যবহার করি), তাহলে বলা যায় শীতলাপুজোয়, ওলাবিবির বা ওলাইচণ্ডীর উপাখ্যানে বা দক্ষিণাংশে মারিআম্মার কাহিনীতে এমন একটি মানসিকতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি, যা কোনও দুর্দৈবকে সমস্ত সমাজের সমস্যা বলে গণ্য করে। ফলে এইসব দেবীদের পুজো-আর্চায় এমন সব পদ্ধতি ও আচার অন্তর্ভুক্ত হত যা সামাজিক বন্ধনেরই পরিচয় দেয়, ও যা পালন করতে গিয়ে একটি গোষ্ঠী তার অন্তির্নিহিত যূথবদ্ধ চরিত্রই আবার নতুন করে অনুভব করত, একেই নিকোলাস বলেছেন ‘দুর্দৈবকে সমাজে পরিণত করা’। অসুখ কারুর একার নয়, কারণ ব্যক্তির তার শরীরের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানাস্বত্ব নেই, আমার শরীরের বসন্তগুটিকায় লেখা আছে আমার সমাজ বা গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ, সেই অর্থে ব্যক্তির শরীরও সামাজিক বা গোষ্ঠীগত—এই রকম একটা মনোভাব।
উদাহরণ অজস্র। বোম্বাই-এর প্লেগের সময় আবির্ভাব হয়েছিল এক প্লেগমাতার। তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’ ও তাঁর পুজো হত শীতলা মন্দিরে।২৬ পঞ্জাবের গ্রামে প্লেগের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে একটি সরকারি রিপোর্ট উদ্ধৃত করেছেন ক্যাটান্যাক, তার অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি:
যখনই প্লেগের আশংকা করা হয়, তখনই ধার্মিক অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয়। একজন গ্রন্থীকে নিয়োজিত করা হয়…গ্রন্থ-পড়ার জন্য; ‘হওয়ন’-এর ব্যবস্থা করা হয় উন্মুক্তভাবে। গ্রামের মসজিদে সাধারণভাবে প্রার্থনা করা হয়; কঠোর পরিশ্রমে খোঁড়া হয় পুষ্করিণী; দরিদ্র-ভভাজনের আয়োজন করা হয়; নিম্নস্তরের দেবতা-দানোরাও বাদ যান না; ফকিরদের ডেকে ভূরি-ভোজন করানো হয় তাদের কেরামতির আশায়; আর গোটা গ্রামের চারপাশে বেড়া পড়ে, তার ওপরে খোদাই করা থাকে দানোদের মুণ্ডু, গ্রামের অতিপ্রাকৃত পাহারাদার হিসেবে।২৭
হেনরি হোয়াইটহেড-রচিত দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ দেবদেবী বিষয়ক যে বইটি আছে, তাতেও মড়ক-মহামারির মোকাবিলায় এই গ্রামীণ সমাজ বা গোষ্ঠী-ভাবনার প্রকাশ খুবই চোখে পড়ে। তামিল দেশের বসন্ত রোগের দেবী মারিআম্মার (বা দক্ষিণ আরকটের ক্ষেত্রে কান্নিআম্মার) পুজোয় এর প্রমাণ আছে। ত্রিচির কলেরা-দেবীর পূজায় গ্রামের সমস্ত পরিবার অংশগ্রহণ করেন ও পূজার পর পূজার উপকরণাদি একটি ঘটে ভরে গ্রামের সীমান্তে রেখে দিয়ে মনে করা হয় রোগ এখন গ্রামের বাইরে চালা হল।২৮ এইভাবে নানাগ্রামে ঘুরতে ঘুরতে দেবীর প্রকোপ দুরে সরে যায়। তেলেগুদেশে মাসুলিপটমের নিকটবর্তী গুটিভড়া গ্রামেও হোয়াইটহেড সাহেব অনুরূপ গ্রামীণ আচারের বর্ণনা দিয়েছেন। কর্ণাটকের বেল্লারি পরগনায় কলেরা প্রাদুর্ভাবে যে পূজা ও অন্যান্য আচারের বর্ণনা পাই, তাতেও গ্রামীণ সমাজের ‘গোষ্ঠী’গত মনোভাব ও গ্রামভেদের ছবিই পাওয়া যায়।২৯ সম্প্রতি ডেভিড হার্ডিম্যানের গ্রন্থে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে কোঙ্কনস্থ অঞ্চলে ১৯২০-২১ সালে বসন্ত রোগের আবির্ভাব ও সেই প্রসঙ্গে বসন্তদেবী ‘বায়া’ মাতা-পুজার বর্ণনা আছে। তাতেও রোগ চালাবার কথা পাই গ্রামের সীমান্ত ধরে ধরে।৩০
বলাবাহুল্য, এই যে ‘গোষ্ঠী বা ‘সমাজ’ যার পুনর্জন্ম হয় দুর্দৈবের মুখোমুখি, তার ভৌগোলিক প্রসার অনেক সময়ই খুব বিস্তৃত নয়। প্রায়শঃই দেখা যাচ্ছে একটি গ্রামের সীমা দ্বারাই এই ‘সামাজিকতা’ সীমিত। অতি সাম্প্রতিককালে এর সাক্ষ্য পাই নিকোলাসের গবেষণায়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন:
সমুদ্র-উপকূলবর্তী দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে আজ শীতলাই সর্বাধিক প্রচলিত গ্রামদেবতা। প্রায়শই মনসার পাশে তাঁকে পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে দুজনকেই একসাথে পেয়েছি, সেখানে আমার অভিজ্ঞতায়—শীতলারই প্রাধান্য।…শীতলা পূজার বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই ধারণাটি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয় যে কোনও একটি বিশেষ গ্রামই তাঁর পূজার ফলাফলের অধিকারী। এটা কখনও দেখানো হয় পূজারীদের একটি মিছিল নিয়ে সারা গ্রামটিকে প্রদক্ষিণ করে, বা গ্রামের সীমান্তপথ ধরে নিয়ে নিশানা পুঁতে পুঁতে, অথবা পুজোর শুরুতেই অন্যে কোনও পদ্ধতি দ্বারা গ্রামটিকে [প্রতীকীভাবে] ঘিরে ফেলে।…পূর্ব মেদিনীপুরে কোনও বিশেষ গ্রামের শীতলাকে সাধারণত ‘অমুক গ্রামের মা’ বলেই অভিহিত করা হয়। ‘শীতলা’ নামটি চালু হয় পুজোর সময়টুকুতেই।৩১
এই গোষ্ঠীগত মনোভাবের কথা বলা মানে এই নয় যে গ্রামের দলাদলি ও অন্যান্য কলহ-দ্বন্দ্বের কথা ভুলে যাওয়া। বসন্ত-মহামারি বা শীতলাপূজা উপলক্ষে কীভাবে ‘সমাজ’ তার সামাজিকতা পুনরানুভব করে তারও সুন্দর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করছেন। নিকোলস। শীতলাপূজায় শীতলার পালা অভিনয় হয়, তার খরচা দেন গ্রামের সমস্ত পরিবার। অন্তত গ্রামের মানুষদের ধারণা এই চাঁদা দেবার সদিচ্ছা বা অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামের জাগতিক ও নৈতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। দলাদলি ও নানা দৈনন্দিন কোন্দলবিধ্বস্ত এই গ্রামীণ সমাজে নৈতিক সমৃদ্ধির অর্থ দলাদলিমুক্ত মনোভাব, যা প্রাত্যহিকে অবশ্যই অনুপস্থিত। নিকোলাস লিখেছেন:
মা যেমন তার বিবাদরত সন্তানদের [সময়ে সময়ে] একত্র করে মনে করিয়ে দেন যে তারা সকলেই সমানভাবে তাঁর দেহের অংশ, তেমনই যেন শীতলা মাতা বৎসরে একবার শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ় হস্তে গাঁয়ে তাঁর ছেলেদের এক জায়গায় এনে, তাদের সাহায্য করেন [দলীয়] রাজনীতি ও স্বার্থানুসন্ধানের কথা—অল্প সময়ের জন্য হলেও—ভুলে থাকতে।৩২
এই মানসিকতায় শরীরকে যে-দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, তা বুর্জোয়া-চিন্তায় শরীর ভাবনা থেকে খুবই আলাদা। এখানে শরীরের তাৎপর্য সামাজিক বা গোষ্ঠীগত। কল্পনায় এই শরীরকে আমরা ‘সামাজিক শরীর’ নাম দিতে পারি। বলা যেতে পারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী চিন্তায় শরীরের অবস্থান এর বিপরীত মেরুতে। সপ্তদশ শতকের বুর্জোয়া চিন্তাধারায়, যাকে সি. বি. ম্যাকফারসন ‘পসেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিস্ম বলেছেন, তাতে শরীরকে ভাবা হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানাস্বত্বের তত্ত্বকে আশ্রয় করে। ‘নিজের শরীরে নিজের অধিকার’ এই চিন্তা বুর্জোয়া ‘স্বাধীনতা’র ও ব্যক্তিগতস্বাতন্ত্র্যবাদের একটি প্রধান ও প্রাথমিক শর্ত।৩৩ আজ যখন পাশ্চাত্যের নারীবাদী আন্দোলন ওম্যান্স বডি: অ্যান ওনার্স ম্যানুয়াল গোছের বই দেখি তখন বোঝা যায় এই চিন্তার প্রভাব কত গভীর ও সুদূরপ্রসারিত।
‘বসন্ত’, ‘কলেরা’, ‘প্লেগ’ ইত্যাদি মহামারির যে অভিজ্ঞতা হয়, ‘সামাজিক শরীরে’ তাকে কেবল ‘অসুখ’ বলে বর্ণনা করলে এই অভিজ্ঞতার সামাজিক, নৈতিক, রাজনীতিক ও ধার্মিক দিকগুলোকে অবহেলা করা হয়। এই ‘শরীর’-এর লক্ষণ ও ব্যঞ্জনাশক্তিতে যে-ভাষার প্রকাশ, তা জটিল ও বিচিত্র। সমাজ নিজেকে ‘সমাজ’ হিসেবে প্রত্যক্ষ করে এই দুর্দৈবের মাধ্যমে, তা তো আগেই বলেছি। পরন্তু দেখা যায় ‘অসুখের’ দেবদেবীবিষয়ক উপাখ্যানগুলির ও পূজা-পদ্ধতিরও অঞ্চলভেদে প্রভেদ হয়, তা-ও এই অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের প্রতি ইঙ্গিত করে।৩৪ সম্প্রতি এক গবেষক মাদ্রাজে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, মানুষের অভিজ্ঞতায় ‘মারিআম্মা’ অর্থ কেবল অসুস্থতা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রেণীর, জাতের ও পরিবারের অভিজ্ঞতা।৩৫ শীতলার উপ্যাখ্যানও কেবল ‘অসুখে’র কথা নয়। এতে আছে ধর্মের কথা, রাজত্বের কথা, এমনকী নারীর সতীত্বের কথা:
স্বামী আত্মা স্বামী প্রাণ স্বামী ত জীবন।
স্বামী বিনে স্ত্রীলোকের বিফল জীবন॥৩৬
তাছাড়া এই পালাগানে শীতলা কেবল বসন্তের দেবীই নন, অন্য সমস্ত রোগও তাঁর বশানুগ, আর শীতলার প্রকোপের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে বিরাট রাজার ধার্মিকতার কাহিনী।৩৭
এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই সমস্ত পুজো পালাগান ইত্যাদির মধ্যে সবসময়ই রয়েছে একটা অভিনয়কার্য। মানুষের ওলাবিবি, শীতলাদেবী বা ‘বায়া’ দেবী সাজার খবর আর্নল্ড ও হার্ডিম্যান দুজনেই দিয়েছেন।৩৮ এতে প্রাক-আধুনিক মানসিকতার একটি প্রায় সার্বজনীন চরিত্র প্রকাশ পায়। এই মানসিকতায় ঐহিক ও পারত্রিক জগত মিলেমিশে যায়, একই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েন মর্তবাসী মানুষ ও অর্মত্যবাসী সব চরিত্র, তাই গল্পে মানুষের ভূমিকায় আসেন দেবতা, আর কখনও পৃথিবীর মানুষ অভিনয় করে দেবচরিত্রে। এখানে ‘অভিনয়’ কথাটিও আসলে ঠিক নয়, কারণ ‘অভিনয়’ ও ‘অভিনেতার’র মধ্যে তফাৎ থাকে না এই অভিজ্ঞতায়। অন্য এক সময়ের গণ্ডিতে, অপার্থিব এক জগতে অংশ নেন দর্শক, শ্রোতা, পাঠক, অভিনেতা সকলেই।৩৯
শরীর চেতনা ও মানসিকতার সংঘাত
শরীরের এই যে ‘সামাজিক’ অবস্থান তাকে পরিবর্তন না করে ধনতান্ত্রিক শিল্পায়ন দুষ্কর। ‘সামাজিক’ শরীর সম্পূর্ণ অবলুপ্ত না হোক তাকে হার মানতে হবে অন্য এক শরীর-চেতনার কাছে—যেখানে শরীরের সঙ্গে শরীরের মালিকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত, যেখানে সংক্রামক ব্যাধি কোনও সামাজিক, রাজনীতিক বা ধার্মিক সংকেত বয়ে আনে না, ‘কলেরা’ ‘বসন্ত’র অর্থ যেখানে হ্রস্ব হয়ে এসেছে ‘জীবাণু’তে, স্বাস্থ্যের প্রশ্নে যেখানে কোনও রাষ্ট্র-বিরোধিতার বীজ নেই। তখনই সম্পূর্ণ হবে শিল্পায়নের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের সরবরাহের আয়োজন, আর উৎপাদন-ক্ষমতা তো খানিক পরিমাণে ‘সুস্বাস্থ্য’-র ওপর নির্ভরশীল। এমনিভাবেই একদিন তৈরি হবে সুদূর গ্রামাঞ্চলে ও হাসপাতাল-গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র-পরিকল্পনা কেন্দ্রের শাসনব্যবস্থা।
প্রশ্নটা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের, এবং এটা কেবল পিটিয়ে হয় না। উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীকে উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ্য করে যে ‘স্বাস্থ্যকর পরিবেশ’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে রাষ্ট্র ও এলিটশ্রেণী পরস্পরকে মদত যুগিয়েছিল।৪০ এদের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল এইরকম একটি ধারণা যে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, পরিচ্ছন্ন গৃহ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ—এই তিনটি গুণনীয়কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জনস্বাস্থ্য। উনিশ শতকের শেষে এই ধারণার কতটা প্রসার ঘটেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সাধারণ একটি সাক্ষ্যে—একটি সাবানের বিজ্ঞাপনে। ১৮৯১ সালের দি গ্রাফিক পত্রিকায় বেরিয়েছিল এই বিজ্ঞাপন।৪১
PUBLIC HEALTH!
THE SANITARY WASHING OF LINEN
Dirt Harbours Germs of Disease
…
HUDSON’S
EXTRACT OF SOAP
Dirt cannot exist where Hudson’s soap is used
…
Home, Sweet Home! The Sweetest, Healthiest
Homes are those where Hudson’s Extract of SOAP
is in Daily Use.
পাঠক অনায়াসেই লক্ষ করে থাকবেন, কীভাবে ‘গৃহ’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘জনস্বাস্থ্যে’র ধারণা—যার গোড়ায় রয়েছে জীবাণু তত্ত্ব—মিলেমিশে আছে একটি সাধারণ, নিত্যব্যবহার্য বস্তুর বর্ণনায় ও বিজ্ঞাপনে।
এই মনোভাব ভারতের মাটিতে প্রোথিত করার মতো ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনওটাই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ছিল না। একদিকে তার ছিল ভারতীয় শরীরবিষয়ে ছুতমার্গ (যার আলোচনা আগেই করেছি)। অন্যদিকে বিদ্রোহের ভয় ভারতীয় অনেক প্রথাকে ‘কুসংস্কার’ বলে চিহ্নিত করলেও, তাতে হস্তক্ষেপ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে করতে চাইতেন না সরকার। প্লেগ-বিষয়ে প্রথমদিকে কড়াকড়ি চললেও, পরে অনেক নরম নীতি নেওয়া হয়েছিল দাঙ্গা এড়াবার জন্য। এর অনেক আগে ১৮৭০-এর দশকে প্রকাশিত টিকাদারদের প্রতি উপদেশ-এ দেখছি সরকারের সাবধানী ভাব। ওই পুস্তিকার ‘ব্যক্তিদিগের প্রতি ব্যবহার’-বিষয়ক পরিচ্ছেদে বলা হচ্ছে টিকাদারেরা যেন অত্যাচার না করেন বা অপ্রিয় কথা না বলেন, অন্যথায় ‘পর বৎসর সেই স্থানে টিকা দেওয়া কষ্টকর হইবে’। আরও বলা হচ্ছে:
জুর, উদরাময়, কাশী, কি হাম যাহার ইংরাজী টিকার সহিত কোন সম্বন্ধ নাই এরূপ প্রকার পীড়া উপস্থিত হইলে ইংরাজী টিকা দেওয়া প্রযুক্ত উহার উপপত্তি হয়ে নাই এই বিষয়টি ব্যক্তিগণকে বুঝাইয়া দিতে বিশেষ কষ্ট স্বীকার করিবে।৪২
আমরা আগেই দেখেছি—স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়েও বস্তুত বিশেষ নজর দেননি ইংরেজ সরকার। গা বাঁচিয়ে চলাই ছিল তার নীতি। বলা যেতে পারে, সামাজিক যে বন্ধনের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিল মড়ক-মহামারির ধারণা ও অভিজ্ঞতা, সেই বন্ধনগুলিকে প্রচণ্ড আঘাত করার মতো ক্ষমতা ছিল না ওই সরকারের। সাম্রাজ্যবাদের তা প্রয়োজনও ছিল না। ‘আধুনিকতা’র প্রয়োজনীয় সব আয়োজন ‘আমাদের’ মনের মতো করে করেননি, এ তো জাতীয়তাবাদের পুরনো অভিযোগ।
বরঞ্চ জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ও মধ্যবিত্তশ্রেণীরই আকাঙ্ক্ষা ছিল যে দেশে ‘আধুনিক’ ও ‘স্বাস্থ্যসম্মত’ বিধিব্যবস্থা নেওয়া হোক ও সাধারণ মানুষের ‘কুসংস্কার’ দূর করার জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার ব্যাপক প্রচার হোক।৪৩ প্লেগের সময় তিলকের মারাঠা পত্রিকায় বলা হয়েছিল যে শিক্ষিত ভারতীয়ের কর্তব্যই হল গরিব মানুষের ‘ভুল’ ধারণা ও ‘কুসংস্কার’ দূর করতে চেষ্টা করা। মারাঠা আরও বলেছিল:
এটা সত্যি যে জনসাধারণ প্লেগকে দৈবপ্রেরিত মনে করেন ও আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উপায়গুলির কার্যকারিতা সম্বন্ধে তাঁদের খুব একটা বিশ্বাস নেই। কিন্তু জনগণ মূর্খ বলেই এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে শীর্ষস্থানীয় ও বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিগুলোর গুরুত্ব বোঝেন না।৪৪
আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ও চিকিৎসাবিদ্যার প্রচার চাইলেও, তিলকের চিন্তায় দ্বিধা ছিল। আর্নল্ড লিখেছেন তিলকের ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ তাঁকে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের প্রতিও আকৃষ্ট করত ও মারাঠা-র পাতায় তিনি পাশ্চাত্য-চিকিৎসা-বিদ্যা ও আয়ুর্বেদের চিন্তাধারা দুটির একটি ‘সুচিন্তিত সংমিশ্রণ’কেই কাম্য বলে প্রচার করতেন।৪৫
এখানে কথাটা বলে নেওয়া প্রয়োজন। পাশ্চাত্য তথা আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে যে বিমূর্ত ব্যক্তিশরীরের ভাবনা আছে তা যতদূর জানি