- বইয়ের নামঃ নিম্নবর্গের ইতিহাস
- লেখকের নামঃপার্থ চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
মুখবন্ধ / সূচীপত্র
‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’-এর প্রথম সংকলন প্রস্তুত করার ভার আমাদের দু-জনের ওপর ন্যস্ত হয়েছিল কয়েক বছর আগে। প্রধানত আমাদের গাফিলতিতেই প্রকাশনায় এত দেরি হল। তা হলেও, বিলম্বের একটা কারণ এখানে বুঝিয়ে বললে ক্ষতি হবে না। সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বাংলা পত্রপত্রিকায় এ-বিষয়ে আলোচনা হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর সঙ্গে যুক্ত লেখকেরা অনেকে। তাঁদের গবেষণা নিয়ে মৌলিক বাংলা প্রবন্ধও লিখেছেন। বাংলা সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা যখন প্রথম নেওয়া হয়, তখন তা ইংরেজি সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রবন্ধের অনুবাদ সংকলন হিসেবে ভাবা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়। কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, বাংলায় নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা খানিকটা নিজের পথে এগিয়ে গিয়েছে। তার গুরুত্ব স্বীকার করতে গিয়ে পুরনো পরিকল্পনা বদলাতে হল। ইতিমধ্যে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মূল প্রকল্পেও নানা বিবর্তন ঘটতে থাকে। এইভাবে গত সাত-আট বছরে এই সংকলনের সূচি বেশ কয়েকবার পালটাতে হয়েছে। আশা করছি বর্তমান সংকলনটি থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার ধারা কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে, তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।
আমাদের কাজে অনেকের সাহায্য পেয়েছি। সংকলনে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করানো হয়েছিল। পরিকল্পনা বদলে যাওয়ায় অধিকাংশই এখানে নেওয়া হল না। অনুবাদের কাজ কষ্টসাধ্য। তাই অনুবাদকদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্জনাও চাইতে হচ্ছে তাঁদের সকলের অনুবাদ আমরা ব্যবহার করতে পারলাম না বলে। সম্পাদনার কাজে অমূল্য সাহায্য পেয়েছি অরুণ নাগ-এর কাছে। তাঁর সযত্ন পরামর্শ সত্ত্বেও যে-সব ভুলত্রুটি থেকে গেল তার জন্য দোষী আমরা। এক্ষণ, বারোমাস, যোগসূত্র ও অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দেওয়ার জন্য ওই পত্রিকার সম্পাদকদের ধন্যবাদ।
গৌতম ভদ্র
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা, ১ জানুয়ারি ১৯৯৮
সূচিপত্র
- পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ভুমিকা: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস - রণজিৎ গুহ
নিম্নবর্গের ইতিহাস - শাহিদ আমিন
গান্ধী যখন মহাত্মা - রণজিৎ গুহ
একটি অসুরের কাহিনী - ডেভিড হার্ডিম্যান
দেবীর আবির্ভাব - পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ইতিহাসের উত্তরাধিকার - দীপেশ চক্রবর্তী
শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি - বীণা দাস
হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর - গৌতম ভদ্র
কথকতার নানা কথা - জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে
ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?
ভূমিকা: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস : পার্থ চট্টোপাধ্যায়
১
সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। প্রথম সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মিলন হয় ১৯৮৩-তে। এরপর বারো বছরের মধ্যে আট খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৯৯৮-এর জানুয়ারি মাসে লখনৌতে।
গত পনেরো বছরে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর লেখাপত্রকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার মহল বেশ কিছুটা আলোড়িত হয়েছে। তার ঢেউ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞান, এমন কি ভাষা-সাহিত্য-শিল্পচর্চার এলাকাতেও গিয়ে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাস চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে আলোচনা এখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাসরচনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকে স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের নিজস্ব সাবলটার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর মূল লেখাগুলো সকলে পড়ে থাকুন আর না-ই থাকুন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান চর্চার মহলে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’এখন খুবই পরিচিত একটি নাম।
প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিরূপ সমালোচনাই শোনা গিয়েছিল বেশি। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রধান কেন্দ্রগুলির কর্তাব্যক্তিরা—ভারতবর্ষে, ইংল্যান্ডে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে—এবং প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকেরা অনেকেই সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর বিরোধিতায় মুখর হয়েছিলেন। বলে রাখা দরকার, সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এবং প্রথম সংকলনে যাঁদের লেখা ছাপা হয়েছিল, একমাত্র রণজিৎ গুহ ছাড়া অন্য সকলেই তখন নিতান্ত তরুণ এবং অপরিচিত লেখক। অনেকেরই প্রথম গবেষণার কাজ প্রকাশিত হয় সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ। সেদিক দিয়ে দেখলে, বিরূপ হলেও যে-পরিমাণ সমালোচনা এই সংকলনটি উদ্রেক করতে পেরেছিল তা খানিকটা বিস্ময়করই বলতে হয়। বোঝাই যাচ্ছিল, পাঠককে তুষ্ট করতে না পারলেও, তার অভ্যস্ত ধ্যানধারণাকে কোথাও একটা নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সাবলটার্ন স্টাডিজ৷
পর-পর তিন বছরে প্রথম তিনটি খণ্ড বেরিয়ে যায়। তার পাশাপাশি প্রকাশিত হয় ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর লেখকদের নিজস্ব গবেষণাগ্রন্থ—জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের দি অ্যাসেন্ডেন্সি অফ দি কংগ্রেস ইন উত্তর প্রদেশ(১৯৭৮), গৌতম ভদ্র-র মুঘল যুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ(১৯৮১), ডেভিড হার্ডিম্যান-এর পেজান্ট ন্যাশনালিস্টস্ অফ গুজরাট (১৯৮১), শাহিদ আমিন-এর সুগারকেন অ্যান্ড সুগার ইন গোরখপুর (১৯৮৪), পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর বেঙ্গল ১৯২০-১৯৪৭; দি ল্যান্ড কোয়েশ্চেন (১৯৮৪) এবং ডেভিড আর্নল্ড-এর পুলিশ পাওয়ার অ্যান্ড কলোনিয়াল রুল (১৯৮৬)। এই পর্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই রণজিৎ গুহ-র এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া (১৯৮৩)। ভারতবর্ষের ইতিহাসের লেখক-পাঠকদের সামনে প্রথম যে দুটি বিষয় উপস্থিত করে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’—(১) ঔপনিবেশিক ভারতে উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য এবং (২) কৃষক চৈতন্যের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য—সেই দুটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বিশদ এবং তথ্যপূর্ণ আলোচনা করা হয় রণজিৎ গুহ-র বইতে। প্রথম পর্যায়ের সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে প্রবল বিতর্কের ঝড় ওঠে এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।