- বইয়ের নামঃ ইতিহাসের উত্তরাধিকার
- লেখকের নামঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০০. ভূমিকা: রাষ্ট্র, জাতীয়তা, ইতিহাস
ইতিহাসের উত্তরাধিকার – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯
প্রথম সংস্করণ – এপ্রিল ২০০০
.
আমার লেখক জীবনের আদি কমরেড
অরূপ মল্লিক ও দীপেশ চক্রবর্তী-কে
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
‘রাষ্ট্র ও সামাবাদ’, এক্ষণ, শারদীয় ১৩৮৭ (১৯৮০)।
‘কৃষকবিদ্রোহ ও রাষ্ট্রবিপ্লব’, অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৮৩। ‘গণতন্ত্রে মানবাধিকার, কপিল ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতা, ৮ অক্টোবর ১৯৯৬, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এ.পি.ডি.আর.) আয়োজিত। ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত।
‘ক্ষমতা প্রসঙ্গে দুই প্রেক্ষিত: গ্রামশি ও মিশেল ফুঁকো’, শোভনলাল দত্তগুপ্ত সম্পাদিত আনলতানিও গ্রামশি বিচার-বিশ্লেষণ, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: পার্ল পাবলিশার্স, ২০০০) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
‘বন্ধন-ছেদন’, চতুরঙ্গ, জুলাই ১৯৮৬।
‘জাতীয় একাংকিকা’, অনুইপ, শীত ১৯৮৭।
‘জাত-জাতি-জাতীয়তা’, সুজিত সেন সম্পাদিত জাতপাতের রাজনীতি (কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ১৯৮৯) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
‘জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ আর তার বিরোধীরা’, (মূল শিরোনাম ‘এই গেল গেল রব নতুন নয়’), আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯০।
‘বাংলার গ্রাম-সমাজ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস’, বারোমাস, শারদীয় ১৯৮৭। ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’, বারোমাস, এপ্রিল ১৯৯১।
‘আমাদের আধুনিকতা’, শ্রীজ্ঞান হালদার স্মারক বক্তৃতা, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪, শ্রীজ্ঞান হালদার স্মারক কমিটি আয়োজিত।
.
সুচি
ভূমিকা: রাষ্ট্র, জাতীয়তা, ইতিহাস
রাষ্ট্র
১। রাষ্ট্র ও সাম্যবাদ
২। কৃষকবিদ্রোহ ও রাষ্ট্রবিপ্লব
৩। গণতন্ত্রে মানবাধিকার
৪। ক্ষমতা প্রসঙ্গে দুই প্রেক্ষিত: গ্রামশি ও মিশেল ফুঁকো
জাতীয়তা
৫। বন্ধন-ছেদন।
৬। জাতীয় একাংকিকা
৭। জাত-জাতি-জাতীয়তা
৮। জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ আর তার বিরোধীরা
ইতিহাস
৯। বাংলার গ্রাম সমাজ প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস
১০। ইতিহাসের উত্তরাধিকার
১১। আমাদের আধুনিকতা।
নির্ঘণ্ট
.
ভূমিকা : রাষ্ট্র, জাতীয়তা, ইতিহাস
এই বই-এর প্রবন্ধগুলি গত বিশ বছরে নানা সময়ে লেখা। স্বভাবতই, প্রবন্ধের উপলক্ষ, প্রেক্ষিত, অনুষঙ্গ, এমনকী উদ্দেশ্য, রচনার সময় যা ছিল, এখন আর তা নেই। এই পরিবর্তনের কথা মনে রেখে প্রবন্ধগুলো নতুন করে লেখা যেত হয়তো। অন্তত সংস্কার করা যেত। কিন্তু তাতে মূল রচনার প্রামাণিকতা নিশ্চিতভাবে ক্ষুণ্ণ হত, এই মনে করে সেগুলি এখানে অবিকল ছাপা হল।
তা হলেও প্রবন্ধগুলোকে একটা আর-একটার সঙ্গে গেঁথে দেওয়া এবং আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আলোচিত বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমার এখনকার মত ব্যক্ত করা এই দুটো দায়িত্ব পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। প্রবন্ধগুলোকে তিনটি বিভাগে সাজিয়েছি রাষ্ট্র, জাতীয়তা, ইতিহাস। তাই এই তিনটি প্রসঙ্গ ধরে প্রবন্ধের বিষয়গুলো নিয়ে খানিকটা বিস্তার করছি।
১.
রাষ্ট্র নিয়ে আমার আলোচনা শুরু হয়েছে মার্কস থেকে, শেষ হয়েছে ফুঁকো-তে। প্রথম প্রবন্ধটি লেখা ১৯৮০-তে। শেষ প্রবন্ধটি ১৯৯৮-এ। বলা বাহুল্য, এই প্রায় দুই দশকে বিশ্ব জুড়ে রাজনীতির খোলনলচে বদলে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মার্কস থেকে যাত্রা শুরু করে ফুঁকো-তে এসে অবতীর্ণ হওয়া ঐতিহাসিক যুগ-পরিবর্তনের ইঙ্গিত। তা আদৌ ঠিক নয়। সম্প্রতিকালে, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অবলুপ্তির পর, চতুর্দিকে শোনা যাচ্ছে যে কার্ল মার্কসের তত্ত্ব নাকি অবশেষে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন থেকে মার্কসসহ আধুনিক যুগের সবরকম বিপ্লবচিন্তার অবসান ঘটল। আধুনিকতার পালা শেষ, এবার শুরু উত্তর-আধুনিক প্রবহমানতা, যার কোনও কেন্দ্র নেই, কোনও। নির্দিষ্ট চালিকাশক্তি নেই, নেই কোনও বন্ধন মোচনের স্বপ্ন। অর্থাৎ কার্ল মার্কসের প্রস্থান, মিশেল ফুঁকোর প্রবেশ।
এই বর্ণনায় নাটকীয়তা আছে হয়তো কিন্তু সারবস্তু কিছুই নেই। বরং সমাজদর্শন-চিন্তার উদ্দেশ্য ও প্রয়োগ সম্বন্ধে যথেষ্ট মুখামি প্রকাশ পায় এ ধরনের মন্তব্যে। অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব সঠিক না ভ্রান্ত? কান্ট অথবা রুসো ঠিক লিখেছিলেন না ভুল? সমাজতত্ত্ব নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে এরকম প্রশ্ন নিতান্তই বাঁচালের প্রগতা। এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সম্ভব নয়। বস্তুত, প্রশ্নটাই অর্থহীন। মার্কসের সমাজ-বিশ্লেষণ পঞ্চাশ কি একশো বছর আগেও যতটা অর্থপূর্ণ ছিল, এখনও ততটাই অর্থপূর্ণ। যদিও পঞ্চাশ বছর আগে যে অর্থগুলো প্রাসঙ্গিক মনে করা হত, এখন হয়তো। আর তা হয় না। আবার আজকে মার্কসের লেখায় অনেক নতুন অর্থ আমরা খুঁজে পাই। যা পঞ্চাশ বছর আগে কারও নজরেও আসেনি। মহান দার্শনিকদের চিন্তার ভাঁড়ার সহজে শূন্য হয় না।
সোভিয়েত সমাজবাদ আর নেই, তাই মার্কসের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গিয়েছে–এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। মার্কস সোভিয়েত সমাজবাদের তাত্ত্বিক ছিলেন না। মার্কস ছিলেন আধুনিক পুঁজিবাদের বিশ্লেষক। তাই আধুনিক পুঁজিবাদ যতদিন টিকে থাকবে, মার্কসের চিন্তাও অন্তত ততদিন তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না।
কলেত্তি প্রসঙ্গে আমার আলোচনায় একটা মন্তব্য করেছিলাম যা আজকে, সোভিয়েত সমাজবাদের বিপর্যয়ের পর, অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা দরকার। বিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদী রাজনীতি-চিন্তায় বিপ্লবের রণকৌশল, পার্টির সংগঠন, বিপ্লবোত্তর সমাজে পার্টির নির্ণায়ক ভূমিকা–এইসব বিষয় এত বেশি প্রাধান্য পেয়েছে যে আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের মূল প্রতিপাদ্যগুলো নিয়ে মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায় কোনও মৌলিক আলোচনাই নেই। আজ যখন বিপ্লবচিন্তায় ভাটা পড়েছে, আবার সুযোগ এসেছে রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে মার্কসের লেখায় ফিরে যাওয়ার।
পুঁজির বিশ্লেষণের পাশাপাশি আধুনিক রাষ্ট্র নিয়ে মার্কসের চিন্তায় দুটো দিক লক্ষ করার আছে। একদিকে মার্কস দেখাচ্ছেন যে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার শ্লোগান পুঁজির অবাধ বিচরণ ও প্রসারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ পুঁজি-অধ্যুষিত সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা অথবা সকলের সমান। অধিকার মোটেই ফাঁকা বুলি নয়, কিংবা শ্রমিকের চোখে ধূলো দেবার কৌশল নয়। সাম্য-স্বাধীনতা হল উত্তমূল্য আহরণ ও পুঁজির সম্প্রসারণের আবশ্যিক আইনগত শর্ত। এইজন্য প্রাক-ধনতান্ত্রিক ভূসম্পত্তি, ভূস্বামীর কাছে ভূমিদাসের বশ্যতাস্বীকার, দৈনন্দিন জীবনে এই বশ্যতা কার্যকর করার জন্য যতরকমের সামন্ততান্ত্রিক আচার অথবা বিধান–এ সবই আধুনিক ধনতন্ত্রের পরিপন্থী। অন্যদিকে কিন্তু মার্কস আবার এমন দাবিও করছেন যে বিপ্লব-পরবর্তী সমাজের আসল লক্ষ হবে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবাধ প্রসার, সাম্য ও স্বাধীনতার নীতিকে প্রতিনিধিত্বমূলক বুর্জোয়া সাংবিধানিক ব্যবস্থার কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে দৈনন্দিন ও স্থানিক জনজীবনে কার্যকর করে তোলা। এদিক থেকে দেখলে মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব আসলে রুসোর অবাধ গণতন্ত্রের অবিকল প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়।
মার্কস ঠিক কী বলেছিলেন অথবা বলেননি, সেটা তত জরুরি প্রশ্ন নয়। জরুরি প্রশ্ন হল, বিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় রাষ্ট্র নিয়ে কী ভাবা হয়েছে? এ প্রশ্নের সঠিক ও নির্মম উত্তর হল, বিশেষ কিছুই ভাবা হয়নি। কি সোভিয়েত সমাজবাদে, কি চীনে, কি কিউবায়, একটা জগাখিচুড়ি সাংবিধানিক ব্যবস্থা খাড়া করা হয়েছে ঠিকই। তাতে ব্যক্তির অধিকার, গোষ্ঠীর অধিকার ইত্যাদি নানা বুর্জোয়া সাংবিধানিক উপাদান জড়ো করা হয়েছে। একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু তাতে বুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রাণশক্তি অনুপস্থিত। তার বদলে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে রেখেছে। বিপ্লবোত্তর সমাজ নির্মাণের প্রধান চালিকাশক্তি কমিউনিস্ট পার্টির একাধিপত্য। সবকিছুর মধ্যে এই ধারণাটাই কাজ করেছে যে এই রাষ্ট্রবিন্যাস একটা কাজ চালানোর মতো সাময়িক ব্যবস্থা। যখন সারা দুনিয়ায় পুঁজিবাদের অবসান ঘটবে, প্রকৃত সমাজবাদ অথবা সাম্যবাদ গড়ে উঠবে, তখন সমাজ প্রশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা তৈরি করা যাবে। যতদিন তা না হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামের রণকৌশল অনুযায়ী। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতিগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সময় এখনও আসেনি। এখন কৌশলগত প্রয়োজন মেটানোর দাবিটাই প্রধান।
‘গণতন্ত্রে মানবাধিকার’ বক্তৃতায় মন্তব্য করেছিলাম যে গোটা শতাব্দী জুড়ে সমাজবাদী রাষ্ট্রচিন্তার দৈন্যই শতাব্দীর শেষে তার বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। এখন নতুন শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তিন ধরনের ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এক হল, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিপক্ষ বা বিকল্প হিসেবে এক ধরনের আধুনিক কৌমব্যবস্থার কল্পনা। দ্বিতীয়, দৈনন্দিন রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বা দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়ে নিষ্পত্তি করা যায় না, এমন সব বিতর্কিত বিষয়কে রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করা, অর্থাৎ সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রটাকেই সীমিত করে ফেলা। আর তৃতীয়, রাজনৈতিক বাদানুবাদ বা সংগ্রামের বদলে বিভিন্ন নিদিষ্ট সমস্যার প্রশাসনিক সমাধান খোঁজা। অর্থাৎ সোজা কথায় রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনিকতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। ‘কৃষকবিদ্রোহ ও রাষ্ট্রবিপ্লব’, ‘গণতন্ত্রে মানবাধিকার এবং গ্রামশি ও মিশেল ফুঁকো’–এই প্রবন্ধগুলোতে ওই তিন ধরনের রাজনীতি চিন্তার আলোচনা করা হয়েছে।
মার্কসবাদী আলোচনায় কোম বা কমিউনিটির ধারণা থেকে ভয়ানক জটিলতা আর ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কৌমচেতনা প্রাকধনতান্ত্রিক সমাজের অঙ্গ। শিকার অথবা পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল তথাকথিত ‘আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৌমভাব স্বভাবতই প্রবল। এই ধরনের সমাজে শ্রেণীবিভাজন তেমনভাবে দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রসংগঠন হয় নেই অথবা খুবই দুর্বল। জাতি-গোষ্ঠী-আচার-লোকধর্মের ভেতরে বিন্যস্ত নানা নিয়মকানুন, বাধানিষেধ, কর্তব্য-দায়িত্বের জালে জড়িয়ে এই কৌমচেতনাই আদিম সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে কার্যকর রূপ দিতে সক্ষম হয়। অপেক্ষাকৃত উন্নত ও জটিল কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যদিও শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রও অনেক সক্রিয়ভাবে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট হয়, তা সত্ত্বেও বিরোধী শ্রেণীস্বার্থ ছাপিয়ে, অথবা বলা উচিত তাকে স্বীকার করেই, এক বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় বা ঐক্যের আদর্শ রূপায়িত হয়ে থাকে নানাস্তরে বিন্যস্ত কৌমব্যবস্থায়। ধর্ম, লোকাঁচার, মার্গসংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি, সবেতেই এই কৌমচেতনার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, সমাজদর্শনের ভাষায় এই কমিউনিটি (community) বা গেমাইনশাট (gemeinschaft) অর্থেই ‘বাংলা সমাজ’ শব্দটির অর্থ সবচেয়ে পরিস্ফুট, যদিও আধুনিক বাংলায় আমরা সোসাইটি (society) বা গেসেশাট (gesellschaft) অর্থেই সমাজ’ শব্দটা ব্যবহার করছি। আধুনিক সোসাইটি’ কিন্তু কৌমসমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধারণা। সোসাইটির সদস্য হল ব্যক্তিমানুষ। সোসাইটি তৈরি হওয়ার আগেও ব্যক্তিমানুষ তার ব্যক্তিচরিত্র ও স্বার্থ নিয়ে পুরোপুরি ব্যক্তি। অন্য ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতায় তার ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধ হবে, এই ভেবে ব্যক্তি সমাজের সদস্য হয়। অনুমান এরকমই যে স্বার্থসিদ্ধি না হলে সে সমাজের সদস্যপদ ত্যাগ করতে পারে। কৌমসমাজের গঠনতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে সমাজ শুধু ব্যক্তিসমষ্টির যোগফল নয়। সমাজ ব্যক্তির আগে, সমাজের দাবিই প্রধান। সে সমাজে ব্যক্তিসত্তা আদৌ স্বীকৃত হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্থান বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজন ও নিয়মের বশবর্তী।
এহেন কৌমসমাজ আধুনিক সোসাইটি সমাজের বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। বস্তুত, পুঁজিবাদী সমাজের পরিপূর্ণ বিকাশের আবশ্যিক শর্ত হল কৌমসমাজের অবলুপ্তি। অর্থাৎ পুঁজি আর কমিউনিটি একে অপরের বিরোধী। এই কারণে মার্কসবাদী আলোচনায় সাধারণভাবে কৌমসমাজের প্রবক্তাদের সনাতনপন্থী, রক্ষণশীল কিংবা রোমান্টিক বলে ভাবা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে রাশিয়ার বিপ্লবীদের মধ্যে নারদনিক আর মার্কসবাদীদের বিতর্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কৃষকসমাজকে আরও শক্তিশালী করে পুঁজির প্রসার রোধ করা যাবে এবং পুঁজিবাদের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে সরাসরি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে, নারদনিকদের এই ধারণাকে লেনিন নির্দয়ভাবে আক্রমণ করেন। সেই থেকে অন্তত মার্কসবাদী তত্ত্বের আলোচনায় কৌমসমাজকে আধুনিক সমাজতন্ত্র কিংবা বিপ্লবোত্তর সমাজগঠনের অঙ্গ হিসেবে আর ভাবা হয়নি।
বিপ্লবী রাজনীতির কৌশল হিসেবে কিন্তু চীন অথবা ভিয়েতনামে, কিংবা আরও সাধারণভাবে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কৃষিজীবীবহুল দেশগুলিতে, কৃষকসমাজের আভ্যন্তরীণ শক্তি, পুঁজির বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা, এমনকী পুঁজি-অধ্যুষিত বাজার, ঋণ ও বণ্টনব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অথবা বোঝাঁপড়ার জন্য কৃষকসমাজের ভেতর নতুন নতুন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা–এ সবই কিন্তু লক্ষ করা হয়েছে, আলোচিত হয়েছে এবং বিপ্লব-প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় যেটা লক্ষণীয়, তা হল এই কৌশলগত ভাবনাগুলোকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির তত্ত্বের স্তরে নিয়ে যাওয়া। সোভিয়েত সমাজবাদের বিপর্যয়ের পর এখন সুযোগ এসেছে নতুন করে সমাজতন্ত্রের গঠন, বিন্যাস, চরিত্র নিয়ে তত্ত্ব কল্পনার জানলা-দরজা খুলে দেওয়ার। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কসের শেষ জীবনের লেখা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে।
ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রসঙ্গে অনেক কিছু শেখার আছে বলে আমার বিশ্বাস। একদিকে ভারতীয় কৃষকের জীবনে পুঁজির অনুপ্রবেশ কোনও না কোনওভাবে অন্তত গত একশো-দেড়শো বছর ধরে ঘটে চলেছে। আজকের ভারতবর্ষে পুঁজির। উপস্থিতি, আধিপত্য এবং প্রসার প্রশ্নাতীত। অথচ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভারতে আধুনিক পুঁজির বিস্তার যে অপেক্ষাকৃত মন্থর, তার কর্তৃত্ব যে নানাভাবে। খর্বিত, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। আবার সেইসঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে দেখা গেছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দ্রুত ও ব্যাপক প্রসার। এই গণতন্ত্র কতটা বুর্জোয়া, আর কতটা তা কৃষক-কৌমসমাজের আচার-আচরণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিসারিত ব্যঞ্জনা, তা বিচারসাপেক্ষ। কৌমসমাজ মানেই যে তা সনাতনপন্থী, অনড়, পরিবর্তনবিমুখ, এমন কথা অন্তত আধুনিক ভারতবর্ষে বসে বলা সম্ভব নয়। অথচ ভারতীয় কৃষক আধুনিক পুঁজি আর আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কোন উপায়ে, কী কী শর্তে এবং কোন উদ্ভাবনীশক্তির সাহায্যে আপন করে নিয়েছে, তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা প্রায় শুরুই হয়নি বলা চলে। বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে যে অভূতপূর্ব সমাজ-সংগঠন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় তার থেকে শিক্ষণীয় বহু জিনিস আছে। এ নিয়ে যথার্থ তাত্ত্বিক আলোচনা হয়নি বললেই চলে। এমনকী, উপযুক্ত তত্ত্বের অভাবে এই ঐতিহাসিক উদ্যোগ বিফল অথবা বিপথগামী হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। এই তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করতে গেলে পুঁজি আর কৌমসমাজের আপাতবিরোধিতার জায়গা থেকেই শুরু করা প্রয়োজন বলে আমার ধারণা।
রাষ্ট্র-প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনায় দ্বিতীয় যে প্রবণতার কথা বলেছি, তা হল রাজনৈতিক বিবাদের সীমানা সংকুচিত করে দেওয়ার তত্ত্ব। এটা প্রধানত লিবেরাল মতাবলম্বীদের প্রস্তাব। এখানে মূল ধারণা হল, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আইন বা প্রশাসন সংক্রান্ত যত বিতর্ক, তা কেবল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং প্রয়োজন হলে ভোট গুণে নিষ্পত্তি করা উচিত। কিন্তু যে সব বিষয়ে বিভিন্ন মতের মধ্যে বিরোধ এত গভীর যে কোনও আলোচনা অথবা পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কী করে? যদি ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা হলে যারা সংখ্যালঘু তারা অবশ্যই মনে করবে যে সমাজ বা ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তাদের মৌলিক বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা অশ্রদ্ধা বা অস্বীকার করছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে রাষ্ট্রের মূল গঠননীতি নিয়েই প্রবল মতানৈক্য দেখা দেবে। বস্তুত, সংখ্যালঘু মতাবলম্বীরা রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেবে। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাই দু-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে।
এই বিপর্যয় এড়াতে হলে দরকার দলমতগোষ্ঠী-নির্বিশেষে একটা সাধারণ স্বীকৃতি যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সব বিষয়ে সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়, সে সব বিষয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের আওতায় আদৌ আনা হবে না। অর্থাৎ সকলে মেনে নেবে যে এই ধরনের বিষয় সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে, অর্থাৎ নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অথবা আইনসভায় প্রস্তাব হিসেবে কেউ তুলবে না। ওই বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চাওয়া হবে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বাইরে, অর্থাৎ বৃহত্তর সামাজিক জীবনে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা মতাবলম্বীর মধ্যে সহাবস্থান বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ সকলকে মেনে নিতে হবে যে অন্য গোষ্ঠীর আচার-আচরণ যদি পছন্দসই না-ও হয়, তা হলেও নিজস্ব সামাজিক ক্ষেত্রে সেই গোষ্ঠীর নিজেদের মতবিশ্বাস অনুসারে জীবনযাপনের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।
এ হল আধুনিক লিবেরালদের অধিকারতত্ত্ব ও সহনশীলতার নীতি। দার্শনিক অথবা সাংবিধানিক সমাধান হিসেবে এ তত্ত্বের যথেষ্ট জোর থাকলেও, মুশকিল হল বাস্তব রাজনীতির জগতে এমন আদর্শ সমাধানের শর্ত পূরণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। যে সব বিষয় নিয়ে মতানৈক্য সবচেয়ে গভীর, সাধারণত সে সব বিষয় নিয়ে আন্দোলন ও উত্তেজনাও সবচেয়ে প্রবল। সুতরাং এইসব উত্তেজক বিষয় রাজনীতির গণ্ডির বাইরে সরিয়ে দাও বললেই তো আর সকলে তা মেনে নেবে না। আন্দোলন আর উত্তেজনা তীব্র হলে রাষ্ট্রকেও হস্তক্ষেপ করতে হবে। তখন রাজনীতির ক্ষেত্র সীমিত রাখা যাবে কীভাবে?
আসলে লিবেরালদের ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়াটিকেই যথাসম্ভব রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ রাজনীতি কমাও, প্রশাসনিক প্রকরণ আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করো। এখানেই সাম্প্রতিক রাজনীতিচর্চার তৃতীয় প্রবণতাটির কথা এসে পড়ছে। এই প্রবণতাটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন মিশেল ফুঁকো। এক অর্থে প্রশাসনিক অন্তত উনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক রাষ্ট্রপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রশাসনিক প্রকরণই আসল কথা। সার্বভৌমত্ব, অধিকার ইত্যাদি নৈতিক শ্লোগান অপেক্ষাকৃত গৌণ। এখানে গণতন্ত্র মানে জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়। প্রশাসনযন্ত্রের কাছ থেকে প্রত্যাশামতো কাজ কিংবা সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে কি না, জনগণ কেবল সেটাই যাচাই করতে চাইবে। এর ফলে নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ নেওয়ার প্রবণতা অনেক কমবে। ভোট দেওয়ার ইচ্ছা, রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে কৌতূহলী হওয়া, এ সবই অনেক স্তিমিত হয়ে আসবে। অন্যদিকে বহুগুণে বাড়বে প্রশাসনিক প্রকরণ, জনগণের বিভিন্ন অংশের আচার-আচরণ প্রয়োজন প্রত্যাশা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রশাসনিক সমাধান বাতলে দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের দল। সম্প্রতিকালে প্রশাসনিকতার ব্যাপ্তি নিয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল বিশ্বজুড়ে এইসব প্রকরণ ও তার আনুষঙ্গিক জ্ঞানপ্রক্রিয়ার প্রসার। জনকল্যাণ, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম, ত্রাণকার্য, পুনর্বাসন, জনস্বাস্থ্য, সাক্ষরতা, প্রশাসনিক শিক্ষার প্রসার–এইসব কাজে ব্যবহৃত প্রশাসনিক প্রকরণ আজ আন্তর্জাতিক স্তরে সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে সে সব প্রকরণ এখন কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হাজার-হাজার বেসরকারি সংস্থার কাছেও পৌঁছে গেছে। ভাল করে দেখলেই দেখা যাবে যে এই সব প্রশাসনিক প্রকরণ সাংবিধানিক চরিত্র অথবা রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে সব দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একই কাজে এবং একই উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনিকতার এই প্রায়-সর্বজনীন প্রসার এক অর্থে লিবেরাল বর্ণিত রাজনৈতিক বিবাদের তাপমাত্রা কমানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। উত্তর আমেরিকা কিংবা পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে দেখা যাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভেতর রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রায় কোনও পার্থক্যই নেই। সব দেশেই নাগরিকদের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক বিষয়ে উৎসাহ নেওয়া, ভীষণভাবে কমে গেছে। ভোট দেওয়ার হারও অত্যন্ত কম। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও প্রবণতা এইদিকে। ভারতবর্ষের মতো দেশেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতি, ঘন ঘন সরকার বদল, ঘন ঘন নির্বাচন–এত সব সত্ত্বেও বিভিন্ন দলের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের মধ্যে তফাত খুবই সামান্য। এক দলের সরকার চলে গিয়ে অন্য দলের সরকার এলেও আর্থিক-প্রশাসনিক নীতি কিংবা কাজকর্মের প্রায় কোনও পরিবর্তনই হয় না। যে সব বিষয়ে বাদানুবাদ এবং বিরোধ খুব তীব্র, তা হল ধর্ম-জাতি-অঞ্চল-সম্প্রদায় ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অধিকার দাবি করা, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তাদের যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব আদায় করা এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ভাগ নিজের গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য টেনে নেওয়া। এইসব আপাত রাজনৈতিক বিরোধ যে আসলে প্রশাসনিকতার প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে, তারই রূপরেখা অনুযায়ী পরিস্ফুট হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে সাময়িকভাবে নিপুন্ন হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আগামী শতাব্দীতে কোনও এক নতুন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি যদি গড়ে ওঠে, তবে তাকে এই প্রশাসনিকতার যন্ত্রজালের মোকাবিলা করতেই হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, প্রশাসনিকতার প্রকরণ-নির্ভর, বিশেষজ্ঞ-নির্ভর প্রক্রিয়ার একমাত্র যোগ্য উত্তর আসতে পারে নতুন কোনও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠলে। আবার বলছি, আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক নতুন কৌমচেতনাই এমন রাজনৈতিক আন্দোলনের উপযুক্ত অবলম্বন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একশো-বিশ বছর আগে কার্ল মার্কসের ভাবনা মোটেই অমূলক নয়।
২.
জাতীয়তা নিয়ে আমি নানাসময় বিস্তারিত লিখেছি। এই বই-এ সংকলিত প্রবন্ধগুলি ভারতের জাতীয়তা প্রসঙ্গের দুটি বিশেষ দিক সম্বন্ধে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এক হল, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আর দুই, জাতিভিত্তিক দাবি নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতি। দুই বিষয়েই আমার মত খুব স্পষ্ট। গণতন্ত্রের প্রসার হতে হলে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যাপক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আর দেশের বর্তমান জাতি-শ্রেণী আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে দলিতবহুজন গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আগামী দিনে নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে বলে আমার ধারণা।
ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক তুমুল হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে। ইন্দিরা গান্ধীর দ্বিতীয় দফা রাজত্ব এবং তারপর রাজীব গান্ধীর আমলে একদিকে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ক্ষমতা, অন্যদিকে বেশ কয়টি রাজ্যে কংগ্রেস-বিরোধী দলের সরকার গঠন–এই অবস্থায় রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা দেবার জোরালো দাবি ওঠে। সেইসঙ্গে ছিল পঞ্জাবে খালিস্তানি আন্দোলন, অসমে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ আন্দোলন, দার্জিলিঙে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন এবং কাশ্মীরে ভারত-বিরোধী আন্দোলন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে নতুন প্রস্তাব দেওয়ার জন্য গঠিত সারকারিয়া কমিশনের কাছে শুধু বিরোধীদলই নয়, এমনকী কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মন্ত্রিসভারাও দাবি করেছিল, রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা চাই, রাজ্যের ব্যাপারে কেন্দ্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা চাই। সবকিছু মিলে যা অবস্থা ছিল, তাতে এমন অনুমান অসঙ্গত ছিল না যে গোটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটা নতুন করে না সাজালে সাংবিধানিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
১৯৯০-এর দশকে এই দাবি অনেক কমে এসেছে। তার কারণ এই নয় যে আগেকব দাবি অন্যায় বলে প্রমাণিত হয়েছে। আসল কারণ হল যে কেন্দ্রীয় রাজনীতির পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আগেকার কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা হঠাৎই কমে যায়। ১৯৮৯ থেকে নতুন দিল্লিতে পর পর যত সরকার গঠিত হয়েছে, তার একটারও ক্ষমতা ছিল না ইন্দিরা কংগ্রেসের কায়দায় রাজ্য রাজনীতির স্বাতন্ত্র সম্পূর্ণ অস্বীকার করে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দেশ চালানোর। প্রত্যেকটি সরকারের ক্ষেত্রে, এমনকী নরসিংহ রাও-এর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের ক্ষেত্রেও, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাশীল দলের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। অন্তত রাজ্য সরকারদের অযথা ঘাঁটিয়ে বিরোধিতা সৃষ্টি করার সামর্থ্য বা আগ্রহ তার ছিল না। তাই ১৯৭০ কিংবা ১৯৮০-র দশকের তুলনায় ১৯৯০-তে কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক সাধারণভাবে রাজ্যগুলির দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। এর পেছনে আরও একটা কারণ আর্থিক উদারনীতি এবং শিল্প বাণিজ্য কৃষি উৎপাদন ইত্যাদি নানা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা। এর ফলে আগে যেখানে বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত শিল্প বাণিজ্য পরিচালনা অথবা নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাবের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির ওপর নির্ভর করে থাকতে হত, এখন লাইসেন্স-প্রথা প্রায় উঠে যাওয়ার ফলে সেই অবস্থা একেবারে পালটে গেছে। এর সুযোগ অবশ্য এক-এক রাজ্য এক-এক ভাবে নিতে পারছে–সকলে যে নতুন ব্যবস্থায় খুশি, এমন নয়। কিন্তু কেন্দ্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ অথবা বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে আগে যেমন অভিযোগ শোনা যেত, এখন তা অনেক কম শোনা যায়।
এই অবস্থা সাময়িক। যেহেতু বেশির ভাগ সময় কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার চলছে, এবং হয়তো আগামী কিছুদিন চলবে, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লাটা আগের তুলনায় অনেকটা রাজ্যগুলির দিকে ঝুঁকে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কেন্দ্রে বহুদলীয় সরকার মানে আসলে বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির কেন্দ্রীয় স্তরে বাড়তি প্রভাব। এই অবস্থা যতদিন চলবে, ততদিন বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হয়তো রাজ্যস্তরের দাবিদাওয়া মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। যদি কেন্দ্রে আবার ইন্দিরা কংগ্রেসের মতো কোনও একদলীয় কেন্দ্রীভূত সংগঠন ক্ষমতায় আসে, তা হলে নিমেষের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
অন্য এক ধরনের সম্ভাবনার কথাও ভেবে রাখা উচিত। তা হল বর্তমান রাজ্যস্তরের নীচের আঞ্চলিক দাবিকে ভিত্তি করে আন্দোলন। এই ধরনের আন্দোলন কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কম দেখা যায়নি। উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড, গোর্খাল্যান্ড–এ সবই এই ধরনের আন্দোলন। কিছুদিন আগে নতুন সমর্থন জোগাড় করার আশায় ভারতীয় জনতা পার্টি এরকম বেশ কয়টি ছোট ছোট রাজ্য সৃষ্টি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এই দাবি জোরদার হলে নতুন দুটি সম্ভাবনা দেখা দেবে। এক হল, বর্তমান বড় রাজ্যগুলি ভেঙে একাধিক ছোট রাজ্য গঠন। দুই হল, বর্তমান রাজ্যস্তরের নীচে আর একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় স্তর সৃষ্টি, যার ফলে বর্তমান কেন্দ্র-রাজ্য দ্বিস্তর কাঠামোর বদলে কেন্দ্র-রাজ্য-উপরাজ্য এই ত্রিস্তর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠিত হতে পারে। এক অর্থে এরকম তৃতীয় স্তর এখনকার ব্যবস্থাতেও আছে–যেমন ত্রিপুরা উপজাতি অঞ্চল কিংবা দার্জিলিঙের ক্ষেত্রে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ। এই স্তরটির সংজ্ঞা আরও ব্যাপক ও নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হলে তা এক নতুন যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দিতে পারে।
জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ নিয়ে কয়েক বছর আগে সারা উত্তর ভারত জুড়ে ভয়ানক হাঙ্গামা হয়েছিল। আসলে উত্তর ভারতে এই সমাজবিপ্লবের অস্থিরতা খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের বিদ্রোহ কয় দশক আগেই শুরু ও সম্পন্ন হয়। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে ব্রাহ্মণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক জমায়েত এবং সংখ্যাধিক্যের ক্ষমতার সমবেত প্রভাবে এক ধরনের নতুন স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে যাতে নিম্নবর্ণের কয়েকটি জাতির রাজনৈতিক আধিপত্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ-নীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি ছিল ব্রাহ্মণবিরোধী আন্দোলনের ডাকে ব্যাপক জমায়েত তৈরি করার ক্ষমতা। উত্তর ভারতের সাম্প্রতিক আন্দোলনে এই দুই প্রক্রিয়া আবার একত্র হয়েছে। তাতে একদিকে আছে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ফলে এক নতুন নিম্নবর্ণের এলিট-শ্রেণীর উদ্ভব, অন্যদিকে দলিত বহুজন ভাবধারার আন্দোলনে সমস্ত নিম্নবর্ণ তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর জমায়েত সৃষ্টি। দুই-এ মিলে উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক আধিপত্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে উত্তর ভারতের একটা বিরাট অংশ, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান, আধুনিক শিল্পায়নের দিক দিয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়া জায়গা। ফলে সরকারি ক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের চাপ এড়িয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি জোগাড় করার সুযোগ সেখানে বেশি নেই। সুতরাং আর্থিক উদারনীতি ও সরকারি বিনিয়োগের সংকোচন উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণের কাছে নিম্নবর্ণের রাজনৈতিক চাপ এড়াবার কৌশল হিসেবে তেমন একটা কার্যকর নয়। উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণ এখনও পর্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও রাষ্ট-পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের কায়েমি আধিপত্যের ওপর নির্ভরশীল। স্বভাবতই নিম্নবর্ণের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের সামনে পড়ে তারা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের মধ্যে এখনও তারা সাময়িক আশ্রয় খুঁজে চলেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক গণিতের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টিকেও নিম্নবর্ণের জমায়েতের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট বাঁধতে হচ্ছে। ফলে উত্তর ভারতের জাতি বিপ্লব বেশিদিন আটকে থাকবে বলে মনে হয় না।
৩.
ইতিহাস নিয়ে তিনটি প্রবন্ধে আমার মূল প্রসঙ্গগুলি আবার ঘুরে ফিরে এসেছে পুঁজি, কৌমচেতনা, জাতীয়তা, রাষ্ট্র। আর একটি প্রেক্ষিত সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে: প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জটিল, সংঘাতপূর্ণ, অথচ গভীর অনুরাগময় সম্পর্ক।
উনিশ শতকের গ্রাম বাংলা প্রসঙ্গে মার্কসের নোটবই থেকে অনুবাদ একটা কথাই জোর দিয়ে বলছে প্রায় একশো বছর ঔপনিবেশিক শাসনে পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থা আর সামাজিক স্থিতি প্রায় ধ্বংসের মুখে পৌঁছেছে, অথচ উন্নত পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার শর্ত তখনও অনুপস্থিত। ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংসাত্মক ভূমিকার পাশাপাশি যে পুনরুজ্জীবক ভূমিকার চিহ্ন ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময় মার্কস দেখেছিলেন, ১৮৮০-র দশকে তা সম্পূর্ণ অলীক প্রমাণিত হয়ে গেছে তাঁর কাছে। এই অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন কৃষিজীবীবহুল দেশে, বিশেষ করে রাশিয়া আর ভারতবর্ষে, কৃষক সমাজের নিজস্ব গতিপ্রকৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে তার নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার জন্ম দেবার ক্ষমতা–এই নিয়ে মার্কস বিশেষ কৌতূহলী হয়ে পড়েন। তারই প্রমাণ গ্রাম বাংলা সম্পর্কে তাঁর বিশদ নোট।
প্রসঙ্গটা ঘুরে আসে এই বই-এ অন্তর্ভুক্ত শেষ প্রবন্ধটিতে। সেখানে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, আধুনিক হওয়ার পরিপূর্ণ ইচ্ছা নিয়েও কেন যেন আমরা বারে বারে ইতস্তত করেছি, অন্যের সৃষ্ট আধুনিকতার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে রাজি হইনি। এখানে একাধিক দ্বন্দ্ব লক্ষণীয়, বিশেষ করে বাঙালির আধুনিকতার ইতিহাসে। একদিকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র, ইতিহাসের গর্ব, রাষ্ট্রক্ষমতার দেখনদারি, সবই আমরা পেয়েছি। তার প্রমাণ, ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে জাতির আত্মগৌরবের ইতিহাস লেখার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের মধ্যে সর্বাধুনিক নেতৃস্থানীয়দের চিন্তাতেও দেখি এমন এক আধুনিক জাতীয় সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা যাতে আছে এক কাল্পনিক ফেলে-আসা নিরিবিলি দ্বন্দ্বকলহহীন গ্রামসমাজের স্মৃতি, তার প্রতি গভীর মমতা; এমন এক আধুনিকতা যাতে প্রতিযোগিতার ধার নেই, লাভ-লোকসানের হিসেব কষার রূঢ়তা নেই, শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর মাপকাঠিতে সময় বা পরিশ্রমের মূল্য যাচাই করার কদর্যতা নেই। এই আধুনিকতায় পুঁজির স্থান আছে, কিন্তু তার কোনও দম্ভ নেই, একাধিপত্য তো অবশ্যই নেই।
বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে বাঙালির এই আধুনিক সংস্কৃতি কিন্তু পুঁজির সাম্প্রতিকতম প্রসার প্রচেষ্টার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে খুবই কষ্টে পড়েছে। প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে প্রথমে ঔপনিবেশিক প্রশাসনযন্ত্রের ছত্রছায়ায়, তারপর জাতীয় আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে আর স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। এখন রাষ্ট্রের আর সে ক্ষমতা নেই যে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের সংস্কৃতির বাহক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর কার্যক্রমকে সে অনন্তকাল ভরণপোষণ করে চলে। বেঁচে থাকার তাগিদে সংস্কৃতিকে বাজারে নামতে হচ্ছে, যা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় হবারই কথা। কিন্তু তাতে প্রায় দেড়শো বছর ধরে লালিত ভদ্রলোকের সংস্কৃতি প্রবলভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু যে তার আধুনিকতার দাবি কিংবা বুদ্ধিবৃত্তির অহমিকা অস্বীকৃত হচ্ছে তাই নয়, তার বিনা কাজের উৎসব-প্রবণতা আর প্রতিযোগিতা-বিমুখ মনোভাব ভয়ানক নিন্দাবাদ কুড়োচ্ছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এই যে বাজার আর প্রতিযোগিতার চাপে নতুন প্রজন্মের বাঙালি বুঝি তার মাতৃভাষা আর সংস্কৃতির প্রতিই বিমুখ হয়ে পড়ছে।
ইতিহাসতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখলে, আমার বিশ্বাস, এই সংকটেও মূলত পুঁজি আর কৌমচেতনার দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ ঘটেছে। ঔপনিবেশিক শাসনকালে পুঁজি-অধ্যুষিত বাজার আর আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার দাবি এসেছিল বাঙালি সমাজের সামনে। আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির স্রষ্টারা সেই দাবি মেটানোর চেষ্টা করেও এমন এক নতুন সামাজিকতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থার হুবহু অনুকরণ হবে না, যেখানে পুঁজি আর বাজারের প্রয়োজন সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে না, যেথানে প্রয়োজন-অতিরিক্ত সামাজিকতার আনন্দ আর মার্জিত চিত্তবৃত্তি সমাদৃত হবে। পুঁজির দাবি আর কৌমস্মৃতির প্রতি মমতা, এই দুই-এর যে সূক্ষ্ম ও জটিল মিশ্রণ তাঁরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই সূত্র আর বোধহয় কাজে লাগছে না–তার কার্যকারিতা ফুরিয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন: সর্বভারতীয় পুঁজির পরিপ্রেক্ষিতে তার অবস্থান কোথায়? যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমস্যার কথা আগে বলেছি। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের সাংস্কৃতিক দিক যদি বিচার করি, তা হলে ভাষার প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। মোটামুটি ১১৯৫০-এর দশক থেকে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের মাধ্যমে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা তার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র আর বিকাশের সম্ভাবনা খুঁজে পাবে। তখনও পর্যন্ত সর্বভারতীয় পুঁজি ভাষার প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বলেই মনে হয়। একদিকে প্রশাসনিক কাজে ইংরেজির ব্যবহারিক সুবিধা, অন্য দিকে গণ-মাধ্যম হিসেবে হিন্দির প্রসার (বিশেষ করে বেতার ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে), এই দুই প্রবণতাই কাজ করেছিল। সেইসঙ্গে ছিল রাজ্যস্তরে আঞ্চলিক বুর্জোয়াশ্রেণীর আঞ্চলিক প্রভাববৃদ্ধির চেষ্টা–যেমন গুজরাট, তামিলনাড়ু অথবা অন্ধ্রপ্রদেশে। গত দশ-পনেরো বছরে বিশ্বায়ন ও আর্থিক উদারনীতির প্রেক্ষিতে সর্বভারতীয় পুঁজি নিশ্চিতভাবে মনস্থির করে ফেলেছে যে তার পছন্দের ভাষা হল ইংরেজি। এই পছন্দের ফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। কারণ এখন থেকে আধুনিকতার সবচেয়ে ঝকঝকে তকমাগুলো লাগবে ইংরেজি বলতে পারা সংস্কৃতির গায়ে। এর ধাক্কা যে শুধু বাংলাভাষা আর বাঙালি সংস্কৃতিকেই সামলাতে হবে, তা নয়। প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রেই মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এর উত্তর হিসেবে রাজ্য বা রাজধানীর নাম পালটে বাঙালিয়ানা জাহির করা নিতান্তই হাস্যকর অপচেষ্টা। আইন জারি করে কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ভাষা-সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আর নেই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিন্দি। হাজার হাজার প্রশাসনিক নির্দেশ আর কোটি কোটি সরকারি টাকা খরচ করে যা করা যায়নি, সিনেমা টেলিভিশনের বিনোদনের মাধ্যমে আধুনিক হিন্দির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র। ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলির পুনরুজ্জীবনের দুটি মাত্র উপায় খোলা আছে বলে মনে হয়। এক, পুঁজির প্রয়োজনের বাইরে এমন প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সুযোগ তৈরি করা যা পুঁজির নিয়মে নয়, নিজের নিয়মে চলতে পারে। এর শর্ত হল, উনিশ-বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনের সমকক্ষ এক প্রবল শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, যার কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় পথ হল পুঁজির আধুনিকতম প্রকরণ ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করে আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে হিন্দি ছাড়া তামিল, তেলুগু, মালয়ালম আর পঞ্জাবি এই দিক দিয়ে অনেক নতুন উদ্যম দেখিয়েছে, বিশেষ করে সিনেমা, টেলিভিশন, ভিডিও, পপ সংগীত, স্যাটেলাইট মাধ্যম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। বাংলা যে এই দিক দিয়ে ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমাদের আধুনিকতা আসলে খুবই সেকেলে হয়ে পড়েছে। তাকে একালের উপযোগী করা প্রয়োজন। ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়ে শুধু বসে থাকলে চলবে না, তাকে খাটাতে হবে, লগ্নি করতে হবে, নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার শ্রীবৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক সংস্কৃতি তা ছাড়া কখনও সমৃদ্ধ হতে পারে না।
.
টীকা
১. এ রকম ভয়ংকরী অল্পবিদ্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ Francis Fukuyana, The End of History and the Last Man (New York: Free Press, 1992).
২. যেমন Partha Chalerjec. Nationalist Thought and the Colonial World (London : Zed Books: Delhi : Oxford University Press, 1986) The Nation and Its Fragments (Princeton : Princeton University Press; Delhi : Oxford University Press, 1993).