ওয়াটসের [পালানোর] খবর সোমবার সকালে জানাজানি হয়ে যায়। এতে নবাব বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। আমাকে খুশি করা একান্ত প্রয়োজন মনে করে তিনি নিজেই আমার কাছে আসেন।বৃহস্পতিবার বিকেলে হুগলি থেকে চিঠি এসেছে যে তারা [ইংরেজরা] তাদের অভিযান [পলাশি অভিমুখে] শুরু করেছে। নবাব চাইলেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। তিনটে শর্তে আমি রাজি হলাম।প্রথম, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কাজ করব না; দ্বিতীয়, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব না আর শেষ শর্ত, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেব না। আমি তাঁকে খবর পাঠালাম তিনি যদি এ-সব শর্তে রাজি থাকেন তা হলে তাঁর সঙ্গে যেতে আমি প্রস্তুত। যেহেতু আমাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি সব সেনাপতি ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে লিখিয়ে নিলাম যে ইংরেজদের পরাজিত করার পর আমি এবং আমার পরিবারের সকলে যেখানে যেতে চাই তারা আমাদের সেখানে যেতে দেবে।
সিরাজদৌল্লার পক্ষে অপমানজনক শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনের আশায় তিনি সব মেনে নিলেন। কিন্তু সব বিফলে গেল কারণ ক’দিনের মধ্যেই মীরজাফর নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। পলাশির রঙ্গমঞ্চ অবশেষে তৈরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র এখন পাকা। ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন ষড়যন্ত্র সফল করতে আপ্রাণ করেছেন। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে, শীলমোহর দিয়ে তা ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পুরো খসড়া তৈরি এবং সব আয়োজন সমাপ্ত।পলাশির যুদ্ধ অবধারিত হয়ে গেল—পলাশি অভিমুখে যাত্রার আর কোনও পিছুটান রইল না।
নবাবও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন অনুমান আছে—স্ক্র্যাফ্টনের মতে তার সংখ্যা ৭০,০০০, ক্লাইভ ও আয়ার কুটের অনুমান ৬০,০০০ আর ওয়াটসের মতে ৩৫-৪০,০০০৷ তবে কাশিমবাজারের ডাচ কর্মচারী ভেরনেটের (Vernet) অনুমান যে, নবাবের বাহিনীতে প্রকৃত যোদ্ধার (vanguard) সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ এবং এটাই অনেকটা সঠিক অনুমান বলে মনে হয়।৬৪ নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীতে সাঁ ফ্রে-র নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মতো ফরাসিও ছিল। কামানের সংখ্যা ৪০টির মতো। ইংরেজদের ফৌজে ছিল এক হাজার ইউরোপীয়, দু’হাজার সেপাই, ৫০জন নৌসেনা আর ৮টি কামান।৬৫ যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায় দুর্লভরাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।নবাবের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর অনুগত সেনাপতিরা—মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি এবং নবসিং হাজারী প্রভৃতি। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একেবারে যেন দর্শক হয়ে, নিতান্ত মজা দেখতেই যেন যুদ্ধে আসা।৬৬ আর রিয়াজ-এর লেখক বলছেন মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাঁকে বার বার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও একবিন্দু নড়লেন না।৬৭
তা সত্ত্বেও পলাশির তথাকথিত যুদ্ধে হার-জিৎ আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি, প্রথমে যথেষ্ট অনিশচয়তাই ছিল.২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন:৬৮
…when the Soubah’s army appeared marching from their fortified camp…and what with the number of elephants all covered with scarlet cloth and embroidery; then horses with their drawn swords glistering in the sun; their heavy cannon drawn by vast trains of oxen; and their standard flying, they made a most pompous and formidable appearance. And their disposition as well as the regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them.
পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন।সকাল আটটায় (ক্লাইভের ভাষ্যে ছ’টায়) যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ পর ইংরেজদের দিকে নবাবের বাহিনীর এগিয়ে আসা দেখতে দেখতে ক্লাইভের ব্যাপারটা খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি ভাবলেন দিনের বেলা কোনও রকমে যুদ্ধ করে রাত্রে কলকাতা ফিরে যাবেন। এমন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সিরাজদৌল্লার দিক থেকে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, তাঁর সঙ্গে এখনও বেশ কয়েকজন দক্ষ এবং অনুগত সেনাপতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী প্রভৃতির নেতৃত্বে নবাবি সৈন্য ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে চলেছিল। সাঁ ফ্রে-র অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে চলেছিল। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেন: ‘[আম্রকুঞ্জে] আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে,’ ‘তাদের [নবাবের গোলন্দাজদের] কামান স্তব্ধ করে দেওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।’ তাই ইংরেজরা চুপ করে তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে রাত্রে শত্রুদের তাঁবু আক্রমণ করার অপেক্ষায় ছিল।৬৯