ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লিখেছিলেন (৬ আগস্ট ১৭৫৭):১১১
উমিচাঁদ ওয়াটসের সঙ্গে মিলে বেশ ভাল কাজই করছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধূর্ততার সঙ্গে অনেক কুকর্মও করার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি তীর্থ করতে তাঁকে মালদহে যেতে পরামর্শ দিলাম। ঠিকমতো চালাতে পারলে এঁকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যাবে। সে কারণে এঁকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করাটা ঠিক হবে না।
তবে এর পরে উমিচাঁদ বেশিদিন বাঁচেননি। সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তিনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁকে শেষপর্যন্ত প্রতারিত করায় নিদারুণ আশাহত হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রায়দুর্লভ
মীরজাফর, জগৎশেঠ বা উমিচাঁদের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর যোগ অনেকটাই পরোক্ষ। নবাবের দেওয়ান এবং সৈন্যবাহিনীর একাংশের অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দুর্লভরাম নবাবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণত বলা হয় এর মূল কারণ সিরাজদ্দৌল্লা হঠাৎ মোহনলালকে সব অমাত্যদের ওপর বসিয়ে দিলেন এবং এই মোহনলাল আলিবর্দির আমলের সব পুরনো অমাত্যদের হেনস্থা ও অপমান করতে লাগলেন।১১২ ফারসি ঐতিহাসিকরা মীরজাফর ও রায়দুর্লভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা বলেছেন এবং তাঁদের ধারণা উক্ত দু’জন জগৎশেঠদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য পলাশির ষড়যন্ত্র করেছিলেন।১১৩ স্ক্র্যাফ্টনও বলেছেন যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকায় নবাব তাঁকে সন্দেহ করতেন। আর গোলাম হোসেন লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা সন্দেহ করেছিলেন যে দুর্লভরামের সঙ্গে মিলেই মীরজাফর দরবারের অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বা তাঁদের কারারুদ্ধ করার মতো সাহস সিরাজের হয়নি।১১৪
যদিও এটা সত্য যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল, তা সত্ত্বেও এটা বলা যায়, রায়দুর্লভ কিন্তু চক্রান্তের প্রথম দিকে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। খুব সম্ভবত ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার করা পর্যন্ত তিনি দরবারের ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের প্রতি অনুকূল গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেজন্যই জাঁ ল’ ভেবেছিলেন যে দরবারে রায়দুর্লভ একমাত্র ব্যক্তি যাঁর ওপর তাঁর সবচেয়ে বেশি ভরসা করা উচিত। তাঁর মতে, ক্লাইভ বাংলায় আসার আগে রায়দুর্লভকে ইংরেজ-বিরোধী বলে গণ্য করা যেতে পারে। রায়দুর্লভও এমন ভাব দেখাতেন যে তিনিই ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এসে ৫ ফেব্রুয়ারিতে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন তা দেখে রায়দুর্লভের চোখ ছানাবড়া। জাঁ ল’-র ভাষ্য অনুযায়ী ওই যুদ্ধে তিনি [রায়দুর্লভ] ইংরেজদের ভয়ে ল্যাজ তুলে পালানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। তখন থেকেই তিনি অন্য মানুষ। তিনি নাকি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো ভীতিপ্রদ আর কিছুকে মনে করতেন না। সম্ভবত ক্লাইভের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর রায়দুর্লভ দরবারের রাজনীতিতে তাঁর দলবদল করেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, ইংরেজদের প্রতি এই ভয় থেকেই যে-জগৎশেঠদের প্রবল প্রতাপ ও প্রতিপত্তির জন্য তিনি তাঁদের প্রচণ্ড ঈর্ষা করতেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের দিকেই তিনি ঝুঁকলেন। ফলে ফরাসিদের হয়ে তিনি একটা কথাও আর নবাবকে বললেন না। এটা ঠিক যে দেশীয় চক্রান্তকারীদের নিজেদের মধ্যেও নানা টানা-পোড়েন ছিল। জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভের মধ্যে মোটেই সদ্ভাব ছিল না যদিও দু’জনেই মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সবাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য—সিরাজদৌল্লাকে হঠানো—পূর্ণ করতে হাত মেলালেন। তবে অন্য দু’জনের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু প্রথম থেকে ষড়যন্ত্রে সামিল হননি। তিনি চক্রান্তে যোগ দেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। জাঁ ল’ লিখেছেন, ‘নিজেকে অন্যদের, বিশেষ করে জগৎশেঠদের তাঁবে চলে যেতে হবে ভয়ে রায়দুর্লভ ঠিক করেছিলেন যে তিনি আপাতত নিরপেক্ষ থাকবেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও একেবারে স্থির করে রেখেছিলেন যে, যে-দল শেষপর্যন্ত ভারী হবে এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তাঁর মনে হবে, সে-দলেই তিনি যোগ দেবেন।’১১৫
রায়দুর্লভ ছিলেন বিহারের ডেপুটি গভর্নর জানকীরামের পুত্র। তবে তিনি পিতার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন না। মৃত্যুর আগে জানকীরাম নবাব আলিবর্দিকে লেখেন যে, তাঁর পুত্ররা কেউ পাটনার (অর্থাৎ বিহারের) শাসনকার্য চালাতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় না। তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর পেশকার রাজা রামনারায়ণকে যেন বিহারের ডেপুটি গভর্নরের পদে নিযুক্ত করা হয়। এ-পরামর্শ মেনে আলিবর্দি জানকীরামের মৃত্যুর পর ১৭৫৩ সালে রাজা রামনারায়ণকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।১১৬ রায়দুর্লভ অবশ্য তাঁর পিতার জীবিতাবস্থায় মুর্শিদাবাদে সৈন্যবিভাগের হিসাবপত্র দেখার কাজে ডেপুটি দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন এবং তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আলিবর্দি তাঁকে ওই বিভাগেরই দেওয়ান পদে উন্নীত করেন। তাঁর কাজকর্ম এতই ভাল হচ্ছিল এবং তিনি সবার এতই প্রশংসা লাভ করেছিলেন যে মুর্শিদাবাদের দরবারে বিহারের স্বার্থ দেখার জন্য রামনারায়ণ তাঁকে দরবারে বিহারের ডেপুটি গভর্নরের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। আলিবর্দির বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যে রায়দুর্লভ ছিলেন অন্যতম।১১৭