মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার থেকে পণ্য, বিশেষ করে কাঁচা রেশম, সংগ্রহ করার জন্য ওখানে গুজরাট, লাহোর, মুলতান, দিল্লি, আগ্রা, বেনারস, গোরখপুর, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু সওদাগর ভিড় জমাত।৮৩ তা ছাড়া ছিল আর্মানিরা—মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে তাদের বড় ঘাঁটি ছিল। তবে কাঁচা রেশমের বাজারে সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল গুজরাটিরা—দামের কোনও তোয়াক্কা না করে তারাই সবচেয়ে ভাল রেশম কিনত, যার জন্য সবথেকে উৎকৃষ্ট রেশমের নামই হয়ে যায় ‘গুজরাটি সিল্ক’। অবশ্য বাজারে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীও ছিল, যাদের সাধারণত পাইকার বলা হত। এরা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশমের জোগান দিত। এ সব ব্যপারীদের মধ্যে বাঙালি ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অবাঙালি এবং আর্মানিরাও ছিল। ১৭৫৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে ৪২ জন ব্যাপারীর সঙ্গে চুক্তি করে তার মধ্যে অন্তত ১০/১২ জন ছিল গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের ব্যবসায়ী। বাঙালিদের মধ্যে উঁচু নিচু সব জাতের লোকই ছিল—ব্রাহ্মণ, বৈদ্য থেকে তেলি পর্যন্ত।৮৪
এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জাতির, গোষ্ঠীর হলেও তাদের মধ্যে একটা জোটবদ্ধতা ছিল যার ফলে কলকাতার দাদনি বণিকদের চেয়েও তারা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তারা অনেক সময়ই এরকম ‘জোট’ (ring) তৈরি করে ইউরোপীয় কোম্পানি বা বড় বড় এশীয় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত এবং নিজেদের দাবিতে অটল থাকতে পারত। ১৭৪১ সালে ইংরেজ কোম্পানির এসব দাদনি বণিকরা চুক্তিমতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করার চেষ্টা করা হলে তারা জোটবদ্ধভাবে তা দিতে অস্বীকার করল কারণ এরকম জরিমানা তাদের কোনওদিন দিতে হয়নি। তাই এখনও তারা তা দেবে না। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি কলকাতা কাউন্সিলকে জানাল, কোম্পানির দাদনি বণিকরা জোটবদ্ধ হয়ে এমনই দৃঢ়তার সঙ্গে জরিমানা দিতে অস্বীকার করছে যে ইংরেজদের ক্ষমতা নেই তাদের বাধ্য করে।৮৫
এসব ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে থাকায় তাদের ওপর জোরজুলুম করার প্রচেষ্টাকে তারা অনেকাংশেই প্রতিহত করতে পারত। সাধারণভাবে কোম্পানিগুলি ব্যবসায়ীদের যে অগ্রিম (দাদনি) দিত, তার জন্য তাদের কাছ থেকে জামিন নিত। কিন্তু মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী এরকম কোনও জামিন দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল। এরা যে কত স্বাধীনভাবে কাজ কারবার করত তা কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট: (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৪২)৮৬
…as to giving security as demanded of them [the merchants] is what they would not do on any account that some of them did business for Guzzeraters, Multaners, Armenians and other merchants and for greater amounts than with us and yet no such thing was ever demanded of them…besides there were none among them but what were esteemed men of credit and many of them substantial men….In short that none of them would submit to the reproaches/as they call it/ of giving security.
কোনওমতেই এ ব্যবসায়ীদের জামিন দিতে রাজি করাতে না পেরে কোম্পানি তাদের শর্ত মেনে নিয়েই তাদের সঙ্গে কাঁচা রেশম সরবরাহের চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৭
আসলে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী অগ্রিমের জন্য জামিন দিতে এত অনিচ্ছুক ছিল কারণ তারা অনেকেই বিশিষ্ট সওদাগর এবং তারা বড় বড় ভারতীয় ও এশীয় ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ করত। তাদের আশঙ্কা ছিল, একবার যদি তাদের জামিন দেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে তা হলে বাজারে তাদের যে সুনাম আছে তা নষ্ট হয়ে যাবে এবং সবাই ভাববে যে তারা তেমন নির্ভরযোগ্য নয়।৮৮ ১৭৪৪ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি থেকে কলকাতায় জানাচ্ছে যে তাদের যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সরবরাহ করতে বলা হয়েছে, তা ওখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য তাদের মুর্শিদাবাদ-সৈয়দাবাদ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এদের মধ্যে অনেকে বেশ ধনী এবং বাজারে এদের খুব সুনাম, বিশেষ করে রাম সিং, গোঁসাইরাম, রামনাথ ইচ্ছানাথ প্রভৃতি। এদের সাহায্য ছাড়া ওই পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এরাই প্রধানত এই পণ্যের ব্যবসায়ী এবং এরা সবচেয়ে ভাল মানের জিনিস সরবরাহ করে—অন্যান্য ব্যবসায়ীরা এই পণ্য সরবরাহ করতে একেবারে চাইত না। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীরা অগ্রিমের জন্য কিছুতেই জামিন দিতে নারাজ। আর যদি এদের সঙ্গে রেশমিবস্ত্রের জোগান দেওয়ার জন্য ইংরেজরা চুক্তি না করে, তাহলে ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে এদের লুফে নেবে। তাই শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি জামিন ছাড়াই এদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৯
সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সুরাটে যেমন বণিকদের ‘মহাজন’ বা ‘গিল্ড’ গোছের জিনিস ছিল,৯০ তেমনি মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের ব্যবসায়ীদেরও পঞ্চায়েত ছিল (রেকর্ডে ‘punch or whole body’)। পঞ্চায়েত যা ঠিক করত, সব ব্যবসায়ী তা মেনে নিত। ১৭৫৫ সালের কাশিমবাজার কুঠির লেখা থেকে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ও বিধান সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে:৯১