অতঃপর সরকারী মহলে এবং আঞ্জুমন নেতাদের কাছে আমার কদর বাড়িয়া গেল। আজকালকার পাঠকরা হয়ত আস্তিনের আড়ালে হাসিতেছেন। কিন্তু মনে রাখিবেন ওটা ইংরাজের আমল। তৎকালে দেশে বিশেষতঃ মুসলিম সমাজে মানুষের মর্যাদা সরকারী স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির অনুপাতে উঠা-নামা করিত। অনারেবল মিনিস্টার আমার খাতির করায় পরদিন হইতে জিলা অফিসাররা আমাকে খাতির করিতে লাগিলেন। তাতে কোট-আদালতেও আমার দাম বাড়িল। রাস্তা-ঘাটেও আদাব-সালাম বেশ পাইতে লাগিলাম। ফলে প্রজা-সমিতির শক্তি বাড়িল।
০৬. প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল
প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল
ছয়ই অধ্যায়
১. সিরাজগঞ্জ প্রজা-সম্মিলনী
ময়মনসিংহ জিলার সর্বত্র যখন প্রজা আন্দোলনের বিস্তৃতি সুনাম ও শক্তি ক্রমশঃ বাড়িতেছিল, এমন সময় আরেকটি ঘটনায় প্রজা-সমিতির আরও শক্তি বৃদ্ধি পাইল। মওলানা আবুল হামিদ খাঁ ভাসানী সাহেব এই সময় (১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে) সিরাজগঞ্জে এক প্রজা সম্মিলনী ডাকিলেন। মিঃ শহীদ সুহরাওয়াদী সম্মিলনী উদ্বোধন করিলেন। খান বাহাদুর আবুদল মোমিন সভাপতি। এই সম্মিলনী নিখিল-বংগ প্রজা সমিতির উদ্যোগে হয় নাই। মওলানা ভাসানী নিজের দায়িত্বেই ডাকিয়াছিলেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ইহা একটি জিলা প্রজা সম্মিলনীতেই পর্যবসিত হইত। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনায় এই সম্মিলনী সারা দেশীয় গুরুত্ব লাভ করিল। সিরাজগঞ্জের এস, ডি, ও. মওলানা ভাসানী ও সম্মিলিনীর অভ্যর্থনা সমিতির মেম্বারদের উপর ১৪৪ ধারা জারি করিলেন। শহীদ সাহেব ও মোমিন সাহেব এই লইয়া গবর্নরের সহিত দরবার করেন। শেষ পর্যন্ত গবর্নর এস.ডি.ওর আদেশ বাতিল রান। এই ঘটনা খবরের কাগযে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলার প্রায় সকল জিলা হইতে প্রজা কর্মীরা বিনা-নিমন্ত্রণে এই সম্মিলনীতে ভাংগিয়া পড়েন। ময়মনসিংহ জিলার বহু কর্মী লইয়া আমিও এই সম্মিলনীতে যোগদান করি। গিয়া দেখি এলাহি কারখানা। সম্মিলনী ত নয়, একেবারে কুম্ভ মেলা। জনতাকে জনতা। লোকের মাথা লোকে খায়। হয়তবা লক্ষ লোকই হইবে। সদ্য-ধান-কাটা ধান ক্ষেতসমূহের সীমাহীন ব্যাপ্তি। যতদূর নযর যায় কেবল লোকের অরণ্য। এই বিশাল মাঠের মাঝখানে প্যাণ্ডেল করা হইয়াছে। প্যাণ্ডাল মানে একটা চারদিক খোলা মঞ্চ। উপরে একখানা শামিয়ানা। সেই বিশাল জনতার মাথায় সে শামিয়ানাটা যেন একটি টুপিও নয় টিকি মাত্র।
সম্মিলনীর কাজ শুরু হইবার অনেক দেরি ছিল। মনে হইল একবার ডেলিগেট ক্যাম্পটা ঘুরিয়া আসি। আমার জিলার সহকর্মী ডেলিগেটরা সেখানে ছিলেন। আমি নিজে আমার এক বন্ধুর অনুরোধে তাঁর শশুর বাড়িতে মেহমান হইয়াছিলাম। কাজেই সহকর্মীদের তত্ত্ব-তালাশ লওয়া কর্তব্য। ডেলিগেট ক্যাম্পে গিয়া দেখিলাম, স্বয়ং মওলানা সাহেবই ডেলিগেটদের খোঁজ-খবর করিতেছেন। মওলানা ভাসানী সাহেবের সহিত এই আমার প্রথম পরিচয়। মওলানাকে ভাবিয়াছিলাম ইয়া বড় বুড়া পীর। দেখা পাইলাম একটি উৎসাহী যুবকের। আমার সময়বয়স্কই হইবেন নিশ্চয়। দাড়ি-মোচে একটু বেশি বয়সের দেখায় আর কি? আলাপ করিয়া খুশী হইলাম। হাসিখুশী মেজ। কর্ম চঞ্চল অস্থিরতার মধ্যেও একটা বুদ্ধির দীপ্তি ও ব্যক্তিত্ব দেখিতে পাইলাম।
যথা সময়ে সম্মিলনী শুরু হইল। সমবেত জনতার এক-চতুর্থাংশ লোক প্যান্ডালের চারিপাশ থেরিয়া বসিল। মঞ্চোপরি বসিয়া চারিদিক চাহিয়া অবাক হইলাম। জনতার তিন-চতুর্থাংশ লোক কচুরিপানার মত ভাসিয়া বেড়াইতেছে। বাকী মাত্র এক-চতুর্থাংশ লোক সভায় বসিয়াছে। তবু সভার আকার এত বিশাল যে উহাদের সকলকে শুনাইয়া বক্তৃতা করিবার মত গলা অনেক নেতারই নাই। তখনও মাইকের প্রচলন হয় নাই। কাজেই তৎকালে সভার মাঝখানে প্যাণ্ডাল করিয়া যাত্রাগানের আসরের মত বক্তারা মঞ্চের উপরে চারিদিকে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বক্তৃতা করিতেন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, তৎকালে মাইক ছাড়াই নেতারা বড়-বড় সভায় বক্তৃতা করিতেন এবং শ্রোতারা নীরবে কান পাতিয়া শুনিত। সুরেন্দ্র নাথ বানার্জী, বিপিন পাল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী, অধ্যাপক জে, এল, বানাজী, মৌলবী ফযলুল হক, মওলানা আযাদ, মওলানা আকরম খাঁ, মৌঃ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী ও কাফী, আমার শস্ত্র মওলানা আহমদ আলী আকালুবী, আমার চাচা শশুর মওলানা বিলায়েত হোসেন প্রভৃতি নেতাদের গলা সানাইর মত স্পষ্ট ও বুলডগের গলার মত বুলন্দ ছিল। তরুণ নেতাদের মধ্যে শহীদ সাহেবের গলাও উপরোক্ত নেতাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল। কিন্তু টাইপ রাইটার আবিষ্কারের ফলে যেমন লোকের হাতে লেখা খারাপ হইয়াছে, মাইক আবিষ্কৃত হওয়ায় বক্তাদের গলাও তেমনি ছোট হইয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়।
যা হোক সম্মিলনীর কাজ সাফল্যের সহিত সমাধা হইল। খান বাহাদুর মোমনের ডিক্টেশনে আমার হাতের লেখা অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সম্মিলনীতে গৃহীত হইয়াছিল। ঐ সব প্রস্তাবের মধ্যে জমিদারি উচ্ছেদ, খানার নিরিখ হ্রাস, ন্যর সেলামি বাতিল, জমিদারের প্রিয়েমশনাধিকার রদ, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণ, চক্র বৃদ্ধি সুদ বে-আইনী ঘোষণা, ইত্যাদি কৃষক-খাতকদের স্বার্থের মামুলি দাবিসমূহ ত ছিলই। তার উপরে ছিল দুইটি নয়া প্রস্তাব। কয়েক মাস আগেই ম্যাকডোনান্ড এওয়ার্ড নামে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বাহির হইয়াছিল। সকল দলের হিন্দুরা উহার প্রতিবাদ করিতেছিলেন। কাজেই মুসলিম নেতারা মনে করিলেন, আমাদের এটা সমর্থন করা দরকার। অতএব রোয়েদাদের সমর্থনে প্রস্তাব পাস হইল। অপরটি ছিল কৃষি খাতকদের ঋণ আদায়ের উপর মরেটরিয়ম এয়োগর দাবি। এটা ছিল মোমিন সাহেবের নিজস্ব কীর্তি। তাঁরই কাছে ‘মরেটরিয়াম’ শব্দটা প্রথম শিখি। তাঁরই উপদেশমত এই প্রস্তাবটিতে কৃষি-খাতক ঋণের উপর দস্তুরমত একটি থিসিস লিখিয়া ফেলিয়াছিলাম। প্রস্তাবে বলা হইয়াছিল বাংলার কৃষি-খাতকদের ঋণের বোঝার প্রায় সবটুকুই চক্রবৃদ্ধি, সুতরাং অন্যায়। উহা শোধ করার সাধ্য কৃষকদের মাই। মূলতঃ ইহারই উপর ভিত্তি করিয়া পরবর্তীকালে ১৯৩৬ সালে বংগীয় কৃষি-খাতক আইন পাস হইয়াছিল এবং ১৯৩৭ সালে সালিশী বোর্ড স্থাপিত হইয়াছিল। এই দিকে সিরাজগঞ্জের এই কনফারেন্সের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রহিয়াছে। এই সম্মিলনীর ফলে মওলানা ভাসানী, মোমন সাহেব ও শহীদ সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা খুবই বাড়িয়া যায়।