মেঘাবৃত চাঁদ – আবু রুশদ
মালেকা যতই খুশি হবার ভান করুক, এটা সে অনেকদিন থেকেই বুঝেছে যে সে অসুখি। অথচ অসুখি হওয়ার কোন কারণ নেই। রউফ খুব সুশ্রী না হতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে মালেকার মনে কদাপি আফসোস্ জাগেনি। হতে পারে, রউফের বুদ্ধি খুব প্রখর নয়—সেটা কিছু না। আর তাদের আর্থিক অবস্থাও এখন এত খারাপ হয়ে পড়েনি যাতে সে সম্বন্ধে তাদের মন খুব শঙ্কিত হয়ে উঠতে পারে। না, সে-সব কিছু নয়। রউফ যথার্থই অত্যন্ত ভদ্র ছেলে ও তাদের আর্থিক অবস্থা রীতিমত সচ্ছল। তবুও……।
নারী-পুরুষের মনের কামনায় এমন এক সূক্ষ্ম রহস্য আছে যা গোপন ও অনির্দেশ্য। অর্থের অজস্র প্রাচুর্য, যশের অপরিমাণ পরিবৃদ্ধি এবং রূপ-গৌররে জাজ্বল্যমান মহিমা কোনটাই সে শিথিল অথচ গৃঢ় কামনাকে শৃঙ্খলিত করবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে মালেকার পক্ষে কি কারণে যে এ-ভাবটা ক্রমেই কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে, অবান্তর, অশোভন ও পরিমাণহীনভাবে বিস্ময়কর, সেক্ষেত্রে অসুখি হওয়ারও কয়েকটা বিরক্তিকর দিক আছে। অস্বস্তিকর উদ্ধত পরিব্যাপ্তি যুবতী মালেকার কামনা-অন্ধ মনকে নিরন্তর বিব্রত ও বিমূঢ় করছে। এক এক সময়ে তার মনে জাগে বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র-উন্মাদ আলোড়ন, মন দুরন্ত তীব্রতায় ঝক্কাসক্ত কুটিলতায় হয়ে ওঠে অশাসনীয়, হৃদয়ারণ্যের প্রতি পুষ্প ও মুকুলে, আকাঙ্খরুদ্ধ প্রতি গোপন স্তরে অতৃপ্ত কানার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি ভীতিপ্রদ উত্তাল বিক্ষোভ জাগিয়ে তোলে। চঞ্চলবিহারী পৃথিবী যৌবনের মাতাল গরিমায় শরাহত হয়ে যখন কুহকমুগ্ধ আবেশে শিথিলিত, যুবতী মালেকা তখন তার নিরুদ্ধ আবেগকে কি করে শান্ত রাখতে পারে? হে অনন্ত আকাশ! মদির আনন্দের মায়াস্পর্শে লীলনারসোচ্ছল ধরণী মহিমময়ী, কিন্তু মালেকার মনে এ কি ব্যথার গুঞ্জরণ!
মফঃস্বল শহরের অনেকরকম অসুবিধার মধ্যে এটা অন্যতম প্রধান যে, এখানে বেড়াবার জায়গা কম। সময় যখন নির্জনতা রউফের মন্দ লাগে না, কিন্তু নীরবতা ও নির্জনতার বিরামহীন ভারে তার মন জর্জরিত। রউফ বার্ণাড শ’ বা সলোমান না হলেও সে একথা চমৎকার বোঝে যে ব্বিাহে মালেকা সুখি নয়। কেন নয় তা রউফ-এর কাছে এক আশ্চর্য রহস্য। সুতরাং সে নির্জনতা না পেতে চাইলেও নির্জনতা তার মধ্যে কামনা করে। স্থূপীকৃত নীরবতা রউফের সক্রিয় কর্মচঞ্চল মনকে ক্রমশ পঙ্গু করছে।
নদীর দিকে রউফ বেড়াচ্ছিল। আশ্বিনের মাঝামাঝি। সন্ধ্যা আসন্ন। বিবাহের পর থেকে একটা নিতান্ত অস্বস্তিকর ভাব রউফের মনকে অভিভূত করে আসছে। স্পষ্টত রউফ একথা নির্বিবাদে মানে যে মালেকাকে সে ভালবাসে। প্রতিদানে মালেকার সামান্য ভালবাসা পেলেও সে নিজকে ধন্য মানবে। বিবাহের প্রথম রাত থেকেই ধরা যাক না কেন। অবশ্য তাতে বোঝা যাবে না, মালেকা রউফের প্রতি এত নির্দয় কেন। বিবাহের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তকারী বাক্যের বাণ ছেড়ে আমরা আকাশে আগুন ধরাতে পারি, কিন্তু মনের নিভৃততম কামনায় এটা আমরা মানবই যে একেবারে বিয়ে না করার চেয়ে বিয়ে করে অসুখি হওয়াই বরং ভাল। অতএব বিবাহের যে একটা অনাস্বাদিত ও স্বতন্ত্র মাধুর্য আছে তা সর্বদা স্বীকার্য। তাই রউফ যদি বিয়ের প্রথম রাতে নবপরিণীতা বধুর সঙ্গে খানিকটা হৃদ্যতা করবার চেষ্টা করে থাকে, আমরা তাকে দোষতে পারি না। কিন্তু রউফের সে একান্ত স্বাভাবিক প্রয়াস করুণ অধ্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল মাত্র। যে কামনা স্বতঃস্ফূর্ত তা কৃত্রিমতার অনুশাসনে কক্ষভ্রষ্ট হতে পারে না। হদয়ের-উচ্ছল মাধুরী মালেকার শীতল কঠোরতায় প্রতিহত হয়ে রউফকে ব্যথিত করছিল। মানব-মনের গতি বিচিত্র বিচিত্রতম প্রেমের গতি। মালেকা যে খুশি হতে পারছে না সে-দোষ নিশ্চয়ই রউফের নয়। বরং বিপরীত। কিন্তু মালেকা নিজের যৌবনকে ব্যর্থ করছে কেন? রউফের প্রতি মালেকার এমন কি অপরিসীম করুণা থাকতে পারে যাতে সে তার নিজের সুখকেও সমাধি দিতে কুণ্ঠিত নয়? রউফ একটা কসম খেয়ে বলতে পারে, মালেকা নিজের সুখের পথ বেছে নিলে সে দুঃখিত হলেও রুষ্ট হবে না। মালেকার সুখেই তার সুখ। এটা নিশ্চয়ই আশা করা যেতে পারে না যে একটা মেয়ে তোমাকে ভালবাসতে না পারলেও ভালবাসবে। একথা বুঝবার মত বুদ্ধি রউফের আছে যে ডাকাতি করে কারও হৃদয় জয় করা যায় না। তবে এটা হাস্যকর যে মালেকা তাকে না ভালবাসলেও তার ঘর করবে, কোন কোন রাত্রে একই বিছানায় শুয়ে দাসীদের সাথে কথা বলে মাঝে মাঝে তাদের ধমকাবে প্রেমের বাহ্যিক একটা কৃত্রিম আবরণে নিজের মনের ক্ষুব্ধ কামনা সব রাখবে আবৃত। এখন দুঃসহ কষ্টদায়ক কৃত্রিমতার কুটিল তরঙ্গ যদি ক্লান্তিকর প্রাত্যহিকতায় নিত্যই তাদেরকে আবৃত করতে থাকে, তবে একদিন রউফ নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাবে।
সংশয়হীন ভাবে একথা বলা যেতে পারে, রউফ ও মালেকা কেউ এ-বিবাহে সুখি হতে পারছে না। দীর্ঘ তিন বৎসর পারস্পরিক প্রবঞ্চনার কুহেলিকায় কেটে গেছে। এখনও কাটছে এবং মনেতে দুঃখ হয়, হয়ত এমনি করেই তাদের জীবনের হবে যবনিকাপতন ব্যর্থতার শুষ্কতায়, যৌবনের করুণ অপমৃত্যুতে, অতৃপ্তির সীমাহীন হাহাকারে।