৩. সংবিধানের বিধানিক ক্রটি
ডিমক্র্যাসি, সোশিয়ালিম, ন্যাশনালিষম ও সেকিউলারিমঃ এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। এর সব কয়টির আমি ঘোরর সমর্থক। শুধু এমনি সমর্থক না, মূলনীতি হিসাবেও সমর্থক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক যুগে সব রাষ্ট্রকেই সেকিউলার ডিমক্র্যাটিক নেশন-স্টেট হইতে হইবে।
কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনওটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লিখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া আর বাকী সবকটিই সরকারী নীতি-রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। দেশে ঠিকমত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেই আর সব ভাল কাজ নিশ্চিত হইয়া যায়। ভাল কাজ মানে জনগণের জন্য ভাল; জনগণের ইচ্ছামতই সে সব কাজ হইবে। জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সবই জনগণের জন্য, সুতরাং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর। নিরংকুশ গণতন্ত্রই সে কল্যাণের গ্যারান্টি। গণতন্ত্র নিরাপদনা হইলে ওর একটাও নিরাপদ নয়।
এই কারণে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করিয়া আর-আর বিষয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মংগল। সাধারণ কথাবার্তার মতই শাসনতন্ত্রেণ্ড যত বেশী কথা বলা হয়, ভূল তত বেশী হইবার সম্ভাবনা বেশী। সে জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শুধু নিরংকুশ গণতন্ত্রের নিচ্ছিদ্র বিধান করিয়া বাকী সব ভাল কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ পার্লামেন্টের রচিত আইনের দ্বারা তা না করিয়া আইনের বিষয়বস্তুসমূহ সংবিধানে ঢুকাইনে সংবিধানের স্থায়িত্ব, পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তা আর থাকে না। নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হইবেন, সেই দলই তাঁদের পছন্দমত সংবিধান সংশোধন করিয়া লইবেন, এমন হইলে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের আর কোনও দাম থাকে না।
এই ধরনের একটি বিচ্যুতির কথা বলিয়াই আমি আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের ত্রুটির প্রমাণ দিতেছি। এটা সমাজবাদের বিধান। সমাজবাদ একটা অর্থনীতি। এটাকে সংবিধানের মূলনীতি করার কোনও দরকার ছিল না। যেকোনও গণন্ত্রী পার্টি যদি সমাজবাদ-প্রতিষ্ঠাকে তাঁদের পার্টি-প্রোগ্রাম রূপে গ্রহণ করেন, তবে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের জনগণের বিপুল সমর্থন তাঁরা পাইবেনই। তবু আওয়ামী লীগ পার্টি অনাবশ্যকভাবে সমাজবাদকে সংবিধানের মূলনীতিরূপে গ্রহণ করিয়াছেন। এ ব্যাপারে আমি মুখে-মুখে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে ভারতের নেতা পন্ডিত জওয়াহেরলালের পদাংক অনুসরণ করিতে উপদেশ দিয়াছিল। বর্তমান যুগে গণতন্ত্রী দুনিয়ায় জওয়াহেরলালই একমাত্র নেতা যিনি আজীবন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিয়াছেন।
কিন্তু আওয়ামী নেতারা সংবিধান রচনায় জওয়াহেরলাল-নেতৃত্বের কংগ্রেসের অনুসরণ না করিয়া চৌধুরী মোহম্মদ আলীর নেতৃত্বের মুসলিম লীগকেই অনুসরণ করিয়াছেন। এটা করিয়া আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুসলিম লীগের মতই ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। পাকিস্তানের দুইটি সংবিধানেরই প্রস্তাবনায় বলা হইয়াছে : পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানকে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করিতে চাহিয়াছিলেন। কথাটা সত্য নয়। কায়েদে আযম তাঁর গণ-পরিষদ উদ্বোধনী ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন : ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সহিত ধর্মের কোনও সম্পর্ক নাই।’ পাকিস্তানের সংবিধান-রচয়িতারা নিজেরা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ করিতে চাহিয়াছিলেন বলিয়াই যুক্তি হিসাবে কায়েদে-আযমের নামে ঐ ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছিলেন।
আমাদের সংবিধান রচয়িতারাও তাই করিয়াছেন। প্রস্তাবনায় তাঁরাও বলিয়াছেন : ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শই আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল।‘ তথ্য হিসাবে কথাটা ঠিক না। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র এ্যাকশন কমিটির এগার-দফার দাবিতেই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। এইসব দফার কোনটিতেই ঐ সব আদর্শের উল্লেখ ছিল না। ঐ দুইটি দফা ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি মেনিফেস্টো ছিল। তাতেও ওসব আদর্শের উল্লেখ নাই। বরঞ্চ ঐ মেনিফেস্টোতে ব্যাংক-ইনশিওরেন্স পাট-ব্যবসা ও ভারি শিল্পকে জাতীয়করণের দাবি ছিল। ঐ ‘দফা’ মেনিফেস্টো লইয়াই আওয়ামী লীগ ৭০ সালের নির্বাচন লড়িয়াছিল এবং জিতিয়াছিল। এরপর মুক্তি সংগ্রামের আগে বা সময়ে জনগণ, মুক্তি যোদ্ধা ও শহীদদের পক্ষ হইতে আর কোনও দফা বা মেনিফেস্টো বাহির করার দরকার বা অবসর ছিল না। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ঐ মহান আদর্শকে সংবিধানভুক্ত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তি যোদ্ধাদের নামে ঐ ভূল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।
রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত বা ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহু বার বহু দেশে। সব সময়েই যে তার খারাপ হইয়াছে, তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালও হয় নাই। পাকিস্তানের সংবিধানের বেলায় ইসলাম ও বাংলাদেশের সংবিধানের বেলায় সমাজতন্ত্র, জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতাও তেমনি অনাবশ্যকভাবে উল্লিখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। এসব জটিলতার গিরো খুলিতে আমাদের রাষ্ট্র নায়কদের অনেক বেগ পাইতে হইবে।