এই মোলাকাতের ফল আশাতিরিক্ত ভাল হইল। তিনি সরলভাবে স্বীকার করিলেন, আমার মত লোকের নেতৃত্বে প্রজা-সমিতি শক্তিশালী সংগঠন হইলে সন্ত্রাসবাদী কংগ্রেসীদের প্রভাব কমিয়া যাইবে। আমি বলিলাম, প্রজা-সমিতির কর্মী নেতারা সভা-সমিতি করিতে গেলে পুলিশ তাঁদের পিছনে লাগে। তাতে জনসাধারণ ঘাবড়াইয়া যায়। প্রজাকর্মীদের কাজের খুব অসুবিধা হয়। এই অভিযোগের আও প্রতিকারের তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং আমার নিকট হইতে বিশিষ্ট প্রজা-কর্মীদের নাম নিজ হাতে লিখিয়া নিলেন।
অল্পদিন মধ্যেই ইহার সুফল পাওয়া গেল। প্রতি থানায় প্রজা-নেতাদের নামের তালিকা চলিয়া গেল। এস, পি, তাতে নির্দেশ জারি করিলেন। তালিকায় লিখিত নেতাদের কেউ ঐ এলাকায় সভা-সমিতি করিতে গেলে তাঁদের কাজে কোনও ব্যাঘাত না হয়, থানা-অফিসারদের সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আমাদের দেশের পুলিশ অফিসারদের ‘ডাকিয়া’ আনিতে বলিলে ‘ধরিয়া’ আনেন, ‘ধরিয়া’ আনিতে বলিলে কান ধরিয়া আনেন। তেমনি অপরদিকে বাধা না দিতে বলিলে একদম সহায়তা ও সমর্থন রু করেন। প্রজা-কর্মীদের বেলাও তাই হইল। আগে যেখানে পুলিশ তাঁদের কাজে বাধা দিতেন, ধমক দিতেন, এখন সেখানে তাঁরা সভার আয়োজনে সহযোগিতা করিতে ও উৎসাহ দিতে লাগিলেন।
ফলে কংগ্রেস-কর্মী ও নেতারা স্বভাবতঃই আমাকে ভুল বুঝিলেন এবং ঘরে বসিয়া কেউ কেউ ন্যায়তঃই আমার নিন্দাও করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাদের নিন্দায় বিচলিত হইলাম না। আমি ত আর ব্যক্তিগত স্বার্থে এটা করি নাই। সাধারণভাবে জিলার সর্বত্র পুলিশ যুলুম কমিয়া যাওয়ায় কংগ্রেস-কর্মীরাও পরে আমার উপর সন্তুষ্ট হইলেন। প্রজা-কর্মীরা পরম উৎসাহে কাজ করিতে লাগিলেন। প্রজা-সমিতির সুনাম ও প্রভাব দ্রুত বাড়িতে লাগিল। কিন্তু বেশিদিন আমরা এই সুবিধা ভোগ করিতে পারিলাম না। ময়মনসিংহ হইতে টেইলার সাহেব ট্রান্সফার হওয়ার দরুনই হউক, আর সরকারী নীতি পরিবর্তনের দরুনই হউক, আবার কর্মীদের উপর যুলুম হইতে লাগিল। সভা-সমিতি ও সংগঠনের কাজ কঠিন হইল।
আমি অগত্যা অন্য পথ ধরিলাম। প্রজা-সমিতি নিয়মতান্ত্রিক প্রজা সংগঠন বলিয়া সরকার হইতে স্বীকৃতি পাইবার একদম সনাতনী চেষ্টা শুরু করিলাম। জমিদার ও প্রজা দেশের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার দুইটা পক্ষ। জমিদার সমিতিকে সরকার স্বীকৃতি দিয়াছেন; প্রজা-সমিতিকে দিবেন না কেন? এই সব যুক্তিতর্ক দিয়া আমি সরকারের সহিত লেখালেখি শুরু করিলাম। কালে ভদ্রে সংক্ষিপ্ত উত্তর পাইতাম। তাতে শুধু বলা হইত? বিষয়টা সরকারের বিবেচনাধীন আছে। গবর্নর বা মন্ত্রীরা দেশ সফরে বাহির হইলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে অভিনন্দনপত্র দেওয়ার রেওয়াজ তৎকালেও ছিল। ঐ সময় এ জিলার আঞ্জুমনে ইসলামিয়া, ল্যান্ড হোলডার্স এসোসিয়েশন, গৌড়ীয় মঠ, হরি সভা, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ঐ সব উপলক্ষে দাওয়াতনামা পাইত। অভিনন্দন-অভ্যর্থনা তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কংগ্রেস মুসলিম লীগ ও প্রজা-সমিতি এইসব অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাইত না। কারণ সরকার এই সবকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলিতেন। আঙুমনে ইসলামিয়াও এই হিসাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। কারণ চাকুরিতে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করিয়া আঞ্জুমনে প্রস্তাব গৃহীত হইত। তবু সরকার সমস্ত সরকারী অনুষ্ঠানেই আজুনকে দাওয়াত দিতেন বোধ হয় এই জন্য যে, আমন কখনও সরকারী কাজের প্রতিবাদ করিত না।
৬. মন্ত্রি-অভিনন্দন
এই সময় সার আবদুল করিম গয়নবী একযিকিউটিভ কাউন্সিলার হিসাবে এ জিলায় তশরিফ আনেন। জমিদার সভা ও আঞ্জুমন তাঁকে অভিনন্দন দেওয়ার আয়োজন করে। পাঁচ বছর আগে ‘গজ চক্র’ মন্ত্রী হিসাবে তাঁর নিন্দা করিয়াছিলাম, সে কথা ভুলিয়া আমি প্রজা-সমিতির তরফ হইতে তাঁকে অভিনন্দন-পত্র দিবার দাবি করি। সংশিষ্ট ব্যক্তির বিনা অনুমতিতে অলিন্দন-পত্র দেওয়া যায় না বলিয়া জিলা ম্যাজিস্ট্রেট আমার পত্ৰখানা কলিকাতা পাঠাইয়া দিলেন। গনবী সাহেব আসিলেন এবং চলিয়া গেলেন। কিন্তু আমার পত্রের জবাব আসিল না।
বছর খানেক পরে আমার চেষ্টা ফলবতী হইল। এই সময় নবাব কে. জি, এম. ফারুকী কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী হন। আমি যখন ‘দি মুসলমানের’ সহ-সম্পাদক তখন হইতেই আমি ফারুকী সাহেবের সহিত পরিচিত। তাঁরই ময়মনসিংহ সফর উপলক্ষে আমি প্রজা-সমিতির তরফ হইতে তাঁকে অভিনন্দন দিবার প্রস্তাব করিয়া জিলা ম্যাজিট ও নবাব ফারুকী উভয়ের কাছে পত্র দিলাম। আমার প্রার্থনা মনযুর হইল। আমি অভিনন্দন-পত্রের মুসাবিদায় বসিলাম।
তৎকালে অভিন্দনপত্রের এ্যাডভান্স কপি জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করার নিয়ম ছিল। তিনি সেজন্য আমাকে তাগিদ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আমি দিলাম না। কারণ তা দেখিলে আমাকে উহা পড়িবার অনুমতি দেওয়া হইত না। আমি জানিতাম জিলা ম্যাজিস্ট্রেট যাই করুন অনারেবল মিনিস্টার আমার অভিনন্দন গ্রহণ করিবেনই।
যথাসময়ে শশী লজের বিশাল আংগিনায় সুরম্য সুসজ্জিত প্যাণ্ডলে মন্ত্রি অভিনন্দনের কাজ শুরু হইল। আমি বিশিষ্ট প্রজা-নেতাদের সংগে লইয়া সভায় উপস্থিত হইলাম। বুনিয়াদী অভিনন্দন-দাতা হিসাবে আঞ্জুমনের দাবি অগ্রগণ্য। আঞ্জুমনের অভিন্দন পড়া শেষ হইলেই আমি দাঁড়াইলাম। আমন ও অন্যান্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অভিনন্দন-পত্ৰ বরাবর ইংরাজীতে হইত। সেবারও তাই হইল। কিন্তু আমি বাংলায় অভিনন্দন-পত্র লিখিয়াছিলাম। সব অভিনন্দন পত্রেই মন্ত্রী মহোদয়ের এবং সরকারের দেদার প্রশংসা থাকিত। প্রজা-সমিতির অভিনন্দনে মন্ত্রী বা সরকারের আরিফের একটি কথাও থাকিল না। তার বদলে থাকিল জমিদার মহাজনের অত্যাচার ও প্রজা-খাতকের দুরবস্থার করুণ কাহিনী। লিখিয়াছিলাম মনোযোগ দিয়া মর্মস্পর্শী ভাষায়। পড়িলামও প্রাণ ডালিয়া। পড়া শেষ হইলে এক মিনিট স্থায়ী করতালি-ধ্বনি এবং মারহাবা-মারহাবা আওয়ায হইল। অভিনন্দনের বাঁধাই কপিটা মন্ত্রী মহোদয়ের হাতে দেওয়ার সময় তিনি আমার হাত ধরিয়া বেশ খানিকক্ষণ এমন জোরে ঝাঁকি দিতে লাগিলেন যে তাতেও আবার নূতন করিয়া কলি–ধ্বনি হইল। আমি মঞ্চ হইতে নামা-মাত্র সুট-পরা একজন অফিসার আগ বাড়িয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। বলিলেন : ‘কি শুনাইলেন আজ। কানা রুখতে পরি না।‘ দেখিলাম সত্যই ভদ্রলোকের দুই গাল বাইয়া পানি পড়িতেছে। এর হাত হইতে। একরূপ ছিনাইয়া আরেক জন অফিসার আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। তারপরে আরেকজন-আরেকজন এইভাবে চলিল। পরে জানিয়াছিলাম, প্রথমে যে ভদ্রলোক আমাকে জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন এবং যাঁর চোখে আমি আসু দেখিয়াছিলাম তিনি ছিলেন ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্রেশন খান বাহাদুর ফযলুল কাদির এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন কো-অপারেটিভ সহ-রেজিষার (পরে রেজিয়ার খান বাহাদুর আরশাদ আলী। সভাশেষে আমি যখন শশী লজ হইতে বাহির হইয়া আসি, তখন বহুলোক আমাকে ঘেরিয়া মিছিল করিয়া বাহির হন। আমি যেন কোনও যুদ্ধ জয় করিয়া আসিয়াছি।