কংগ্রেসীরা শুধু প্রজা-আন্দোলনে সমর্থন দিলেন না, তা নয়। তাঁরা কৌশলে ইহার বিরুদ্ধতা করিতে লাগিলেন। কিছুসংখ্যক কংগ্রেস-কর্মী দিয়া তাঁরা একটা কৃষক সমিতি খাড়া করিলেন। সেই সমিতির পক্ষ হইতে প্রচার চলিল যে প্রজা আন্দোলন আসলে জোতদারদের আন্দোলন। ঐ আন্দোলনে কৃষকদের কোন লাভ ত হইবেই না, বরঞ্চ কৃষকদের দুর্দশা আরও বাড়িবে। জোতদারদের শক্তি ও অত্যাচার দ্বিগুণ হইবে। প্রমাণ হিসাবে তাঁরা বর্গাদারদের দখলী, স্বত্বের কথাও তুলিলেন। কংগ্রেসের সাথে প্রজা সমিতির প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বাধিয়া গেল।
এ অবস্থায় কংগ্রেসের সাথে আমার সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদের কথা। সে সংকল্পও একবার করিলাম। কিন্তু পারিলাম না। আমার প্রাদেশিক নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রজা সমিতির সেক্রেটারি মওলানা আকরম খাঁ সাহেব সেই মুহূর্তে ছাড়িবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি সহকারী সেক্রেটারি মোঃ নযির আহমদ চৌধুরী সাহেবের দ্বারা সমস্ত জিলা সমিতির সেক্রেটারিদের নামে কনফিডেনশিয়াল সারকুলার জারি করাইলেন : পূর্ব বাংলার মুসলিম মেজরিটি জিলাসমূহের কংগ্রেস কমিটিগুলি মুসলমানদের দ্বারা ক্যাপচার করার চেষ্টা হওয়া উচিৎ। আমার নিজেরও মত ছিল তাই।
৩. সাংগঠনিক অসাধুতা
আমি তদনুসারে কাজে লাগিয়া গেলাম। এ ব্যাপারে এ জিলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শ্রদ্ধেয় সর্বজনমান্য ঋষিতুল্য কংগ্রেস নেতা ডাঃ বিপিন বিহারী সেন আমাদেরে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। তিনি প্রকাশ্য সভায় ঘোষণা করিলেন : যে-জিলার শতকরা আশি জন অধিবাসী মুসলমান, সে জিলার কংগ্রেস নেতৃত্ব মুসলমানদের হাতেই থাকা উচিৎ। মুসলমান ছাড়া এ জিলার কংগ্রেসকে তিনি ‘রামহীন রামায়ণ’ বলিয়া বিদ্রূপ করিয়াছিলেন। তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের সহায়তায় আমরা পর-পর দুই বছর কংগ্রেস ক্যাপচার করিবার চেষ্টা করিলাম। দুইবারই ব্যর্থ হইলাম। ইতিহাসটি এইঃ যে বছরে আমরা এই প্রয়াস শুরু করি, সে বছর পঞ্চাশ লক্ষ অধিবাসীর এই জিলার কংগ্রেসের প্রাইমারি মেম্বর-সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত হাজার। আমাদের দলের পক্ষে ভোট হইয়াছিল মাত্র আড়াই হাজার। আমরা মনে করিলাম, আগামী বছর আমরা প্রাইমারি মেম্বর করিব সাত দ্বিগুণে চৌদ্দ হাজার। দেখি, বেটারা আমাদের কেমনে হারায়। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করিয়া পরের বছর মেম্বর করিলাম পনর হাজার। কিন্তু ফাঁইনাল ভোটার তালিকার সময় দেখিলাম, আমাদের পনরর মোকাবেলা অপর পক্ষ করিয়াছেন সাড়ে সতর হাজার। কাজেই সেবারও হারিয়া গেলাম। পরের বছর আমরা করিলাম বাইশ হাজার। কিন্তু ফাঁইনাল ভোটার তালিকায় তাঁদের হইল পঁচিশ।
কারণ এটা সাধু প্রতিযোগিতা ছিল না। কৌশলটা ছিল এই : আমরা অপযিশন দলের পক্ষ হইতে প্রাইমারি মেম্বর তালিকা দাখিলের পরে ‘পযিশন’ দল তাঁদের মেম্বর তালিকা দাখিল করিতেন। নিজেরা পযিশনে থাকায় অর্থাৎ আফিস তাঁদের হাতে থাকায় রাতারাতি জাল মেম্বর তালিকাভুক্ত করিয়া নিজেদের পক্ষের তালিকা ভারি করা অতি সহজ ছিল। যে কোনও গণ-প্রতিষ্ঠানের অফিস-কর্তারা এটা করিতে পারেন। স্বাধীনতা লাভের পর লীগ কর্তারা আলাদা পার্টি না করিয়া মুসলিম লীগ দখল করার যে দাওয়াত দিতেন, সেটাও ছিল এইরূপ দাওয়াত। আমরা এ কৌশলের কথা জানিতাম বলিয়াই একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান দখল করিয়া মসজিদ ত্যাগ না করিয়া ইমাম বদলাইবার চেষ্টা করি নাই। কংগ্রেসের নির্বাচন এই ভাবে ‘রিগ’ করিবার অভিজ্ঞতা হইতেই তৎকালে সব দলের রাজনৈতিক নেতারা একমত হইয়া সকল প্রকার নির্বাচনে ‘ইলেকশন ট্রাইবুন্যালের’ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। আমাদের বেলায় কিন্তু ইলেকশন ট্রাইবুন্যালেও কুলায় নাই। ময়মনসিংহ জিলায় ঐরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আমরা প্রাদেশিক কংগ্রেসের কাছে নিরপেক্ষ ইলেকশন ট্রাইবুন্যালের তদন্ত দাবি করি। প্রাদেশিক কংগ্রেস সুদূর মাদ্রাজ হইতে নিরপেক্ষ মিঃ এ্যানিকে ট্রাইবুন্যাল নিযুক্ত করিয়া পাঠান। আমরা মিঃ এ্যানির কাছে জাল ভোটের অনেক সাক্ষ্য-সাবুদ দেই। কিন্তু আফিস-কর্তারা এমন নিখুঁতভাবে কাগয-পত্র ‘মিছিল’ করিয়া ফেলেন যে বিচারকের বিশেষ কিছু করিবার থাকে নাই।
এইভাবে কংগ্রেস ক্যাপচারের চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া একাগ্রচিত্তে প্রজাসংগঠনে লাগিয়া গেলাম। উপরোক্ত অবস্থাধীনেই আমি সংগঠনের মোড় শহর হইতে মফস্বলের দিকে ফিরাইলাম। উপরে যে সব নেতা আলেম ও বন্ধু-বান্ধবের নাম উল্লেখ করিয়াছি, তাঁদের সকলের ও প্রত্যেকের চেষ্টায় এ জিলার প্রজা-আন্দোলন দুর্বার ও প্রজা সমিতি অসাধারণ শক্তিশালী হইয়া উঠে।
৪. খান বাহাদুর ইসমাইল
আরেকটা ব্যাপারে অবস্থা আমাদের অনুকূলে আসিল। আমাদের সাংগঠনিক মর্যাদাও বাড়িয়া গেল। এই সময় জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ গ্রাহাম এ জিলার সর্বজনমান্য প্রবীণ নেতা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবকে পাবলিক প্রসিকিউটরি ও জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হইতে সরাইয়া খান বাহাদুর সাহেবেরই অন্যতম শিষ্য শরফুদ্দিন আহমদ সাহেবকে পাবলিক প্রসিকিউটরি, চেয়ারম্যানি ও খান বাহাদুরির ‘ট্রিপল ক্রাউন’ পরাইয়া দেন। বিনাকারণে বহুঁকালের পদ-মর্যাদাহারাইবার ফলে খান বাহাদুর সাহেবের চিরজীবনের স্বপ্ন ভংগ হয়। এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ খান বাহাদুর সারা জিরার মুকুটহীন রাজা হঠাৎ একদিন নিজেকে অসহায় সর্বহারা দেখিলেন। এত কালের শিষ্য-শাগরেদরা তাঁকে দূর্গা-প্রতিমার মতই বিসর্জন দিলেন। পারিষদবর্গের ভগ্নাবশেষ অতি অল্পসংখ্যক লোকই বিপদে আহাজারি এবং ইংরাজ জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশ্যে গালাগালি করিয়া শান্ত হইলেন। সান্ত্বনার কথা শুনিলেন তিনি আমার মুখে। আমি তাঁর গুণ, শক্তি ও জনপ্রিয়তার কথা বলিতাম। তিনি এ জিলার মুসলমানদের জন্য কি কি কাজ করিয়াছেন, সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতাম। জনগণের প্রিয় নেতা সরকারী দরবার হইতে জনগণের মধ্যে নামিয়া আসায় তাঁকে আমি মোবারকবাদ দিতাম। তিনি যে অন্তরে বল ও সান্ত্বনা পাইতেন চোখে মুখেই তা প্রকটিত হইত।