খিলাফতের কাজ শেষ হওয়ায় আমার কাজ শুরু হইল। শামসুদ্দিনের কাছে মনের কথা বলিলাম। তিনি আমাকে কিছু ‘কোদাল কাম’ করিবার পরামর্শ দিলেন। আমি ‘কোদাল কাম’ শুরু করিলাম। শামসুদ্দিনের কাগযে কিছু কিছু লেখা দিতে লাগিলাম। বংগীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কলেজ স্ট্রিট আফিসে যাতায়াত করিলাম। সমিতির সভাপতি ডাঃ শহীদুল্লাহ, সেক্রেটারি ভোলার কবি মোযাম্মেল হক, সমিতির সহকারী সম্পাদক মোযাফফর আহমদ (পরে কমরেড) ও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচিত হইলাম। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামানের সাথে খিলাফত কমিটিতেই পরিচিত হইয়াছিলাম। মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব এই সময় কলিকাতায় থাকিয়া ‘ছোলতান’ নামক সাপ্তাহিক কাগজ চালাইতেন। আমি শামসুদ্দিনের পরামর্শে ‘মোহাম্মদী’ ও ‘ছোলতান’ অফিসে যাতায়াত করিয়া আমার ‘কোদাল কামের’ পরিধি বাড়াইতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে ‘সভ্যতায় দ্বৈতশাসন’ নামক আমার এক অতিদীর্ঘ দার্শনিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধ শামসুদ্দিনের কাগযে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতে লাগিল। প্রাথমিক ‘কোদাল কাম’, যথেষ্ট হইয়াছে মনে করিয়া সেবারের মত ময়মনসিংহ ফিরিয়া আসিলাম। পরে আরও কয়েকবার যাতায়াত করিলাম।
একবার ময়মনসিংহে ফিরিবার অন্য কারণ ঘটিয়াছিল। শুধু আমার নন সারা জিলার নেতা মৌঃ তৈয়বুদ্দিন আহমদ সাহেব সেবার আইন সভায় প্রার্থী হইয়াছিলেন। বেংগল প্যাক্ট। তাঁর পক্ষে ক্যানভাস করা আমার কর্তব্য ছিল। ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রশ্নও এতে জড়িত ছিল। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়া কংগ্রেসের সভাপতিরূপে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কাউন্সিল এন্ট্রি প্রোগ্রাম পেশ করেন। কংগ্রেস তাঁর মত গ্রহণ না করায় ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতেই তিনি স্বরাজ্য দল গঠন করেন। ডাঃ আনসারী হাকিম, আজমল খী, বিঠলভাই প্যাটেল, পভিত মতিলাল নেহেরু, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুযযামান ইসলামাবাদী, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রভৃতি অনেক নেতা দেশবন্ধুকে সমর্থন করেন। আমি নিজে দেশবন্ধুর এই মত পরিবর্তনকে মডারেট নীতি মনে করিয়া গোড়ার দিকে এই নীতির বিরোধী ছিলাম। কিন্তু দেশবন্ধুর সাম্প্রদায়িক উদার নীতির জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাহেতু এবং আমার জিলার নেতা তৈয়বুদ্দিন সাহেব দেশবন্ধুর সমর্থক হওয়ায় আমিও মোটামুটি এই নীতির সমর্থক হইলাম। তারপর মার্চ মাসেই আইন সভার নির্বাচনে তৈয়বুদ্দিন সাহেব স্বরাজ্য দলের টিকিটে নির্বাচন প্রার্থী হওয়ায় আমার পক্ষে চিন্তা-ভাবনার আর কোনও পথ রইল না। নির্বাচনে তাঁকে সাহায্য করিবার জন্য আমি কলিকাতা ত্যাগ করিলাম।
দেশে ফিরিয়াই নির্বাচন যুদ্ধে আমি মাতিয়া উঠিলাম। কারণ তৈয়বুদ্দিন সাহেবের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নন, স্বয়ং ধনবাড়িয়ার বিখ্যাত জমিদার নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী সাহেব। জমিদারের প্রতি আমার চিরকালের বিদ্বেষ।তার উপর ধনবাড়ির নবাব সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশেষ কারণ ছিল। তাঁর প্রজাপীড়নের নিত্য নতুন কাহিনী আমাদের কানে আসিত। উহাদের সত্যাসত্য বিচারের আমাদের সময় ছিল না। জমিদারের যুলুমের কাহিনী বিশ্বাস করিবার জন্য আমরা উন্মুখ হইয়াই থাকিতাম। এইবার তাঁকে নির্বাচনে হারাইয়া শোধ নিবার জন্য কাজে লাগিয়া গেলাম। আমার নিজের জন্মস্থান এই নির্বাচনী এলাকায় পড়ায় আমার কাজ বাড়িয়া গেল, সহজও হইল। নবাব বাহাদুরের বাহাদুরি’ এই শিরোনামায় জীবনের সর্বপ্রথম নির্বাচনী ইশতাহার লিখিলাম। সকলেই এক বাক্যে তারিফ করিলেন। নবাব বাহাদুরের আর রক্ষা নাই।
নির্বাচনে সত্য-সত্যই নবাব বাহাদুর হারিয়া গেলেন। বিপুল বিত্তশালী সরকার সমর্থিত বড় লোকের গরিব জননেতার কাছে পরাজয় এতদঞ্চলে এই প্রথম। অতএব আমার কলমের ঐ এক খোঁচাতেই এত বড় নবাব ভুলুণ্ঠিত হইলেন, একথা আমার বন্ধু-বান্ধবসবাই বলিলেন। আমি বিশ্বাসকরিলাম।
নির্বাচনে জিতিয়াই শামসুদ্দিনের নির্দেশমত কালিকাতায় ফিরিয়া গেলাম। আইন সভার বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে তৈয়বুদ্দিন সাহেবও গেলেন। বলা আবশ্যক আমার ভাড়াটাও তিনিই দিলেন। শামসুদ্দিন আগেই আলাপ করিয়া রাখিয়াছিলেন। এবার যাওয়া মাত্রই ‘ছোলতানে’ ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি হইয়া গেল। পরে এই বেতন চল্লিশ টাকায় বর্ধিত হইয়াছিল। ছোলতানে যোগ দেওয়ায় আমি দেশবন্ধুর স্বরাজ্য দলের আরও সক্রিয় সমর্থক হইতে বাধ্য হইলাম। কারণ ‘ছোলতানের’ মালিক মওলানা ইসলামাবাদী সাহেব দেশবন্ধুর অনুরক্ত ও স্বরাজ্য দলের সমর্থক ছিলেন। আমাকেও কাজেই ঐ দলের সমর্থনে লিখিতে হইত।
২. দেশবন্ধুর বেংগল প্যাক্ট
এই সময় স্বরাজ্যদলের মোট বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ জন সদস্য ছিলেন। হিন্দু মুসলিম মেম্বর প্রায় সমান-সমান। নির্বাচিত মেম্বরদের মধ্যে এরাই ছিলেন মেজরিটি। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থায় সরকারী দফতরসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলির বেশির ভাগই ছিল ‘রিযার্ভ’। তারা আইন সভার বিচার্য বিষয় ছিল না। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়গুলি ছিল ট্রান্সফার্ড। অর্থাৎ ওদের উপর ভোটাভুটি করা যাইত। দেশবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি স্ট্রাটেজি ও টেকটিকসের দ্বারা এবং অসাধারণ বাগ্মীতার বলে স্বরাজ্য দল এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করিয়া সরকারী দলকে অনেক নাকানি-চুবানি খাওয়াইলেন।