এবার শস্ত্রের কথায় আসি। শস্ত্র হল লোহা, কাঠ ইত্যাদি পদার্থ জাতীয়। যেমন গদা, ধনুক, তলোয়ার ইত্যাদি, যা দিয়ে সরাসরি আঘাত করা যায় বা হত্যা করা যায় অন্য একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে। আধুনিক যুগের যেমন গাদার রাইফেল, একে-৪৭, কালাশনিকভ অ্যাসল্ট, রিভলভার, গ্রেনেড ইত্যাদি সবই শস্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে যুগের দৈবাস্ত্র কি এখনও কেউ পান তপস্যাবলে? দেবতারা কি বর দেন? পাওয়া যায় অভীষ্ট সিদ্ধির অস্ত্র? পাওয়া যায় বইকি। পুরাণ যুগে সবচেয়ে বেশি দৈবাস্ত্র ও অমরত্বের বর প্রদান করেছেন স্বয়ং অনার্য ‘দেবতা’ শিব। এরপর সেই তালিকায় আছেন যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র।
এ সময়ের শিবের ভূমিকা পালন করছেন আমেরিকা এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা। তাঁরা তাঁবেদার দেশগুলিকে ভয়ংকর ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করছেন, সেইসব অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ তুলনামূলক দুর্বল দেশের উপর আক্রমণ করছে এবং হত্যালীলা সম্পন্ন করছে। এইসব অস্ত্রশস্ত্র দেবতাদের অস্ত্রের চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধ্বংসকারী। এক লিটল বয়’ নামে নিউক্লীয় বোমার আঘাতেই হিরোসিমায় মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ। নাগাসাকিতে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ, অস্ত্রের নাম ‘ফ্যাট ম্যান’। এমন বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা দেবতাদেরও হয়নি। অতএব আজকের এই মানুষগুলো দেবতাদের চেয়েও ভয়ংকর এবং শক্তিশালী। দেবতারা অত্যাচারী শাসকদের হত্যা করত, মানুষ অসামরিক মানুষদের হত্যা করে। শুধু আমেরিকাই নয়–যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করেন ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মান–এমনকি ভারতও। অস্ত্র প্রদানের বাজার তৈরি করার সাধনায় ব্রতী থাকেন এরা, সারা বছর। দেশে দেশে শত্রুতা আর যুদ্ধ জিইয়ে রাখেন তাঁরা। এদের ভয়ে সারা বিশ্ব থরথর করে কাঁপছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায়। যেমন পুরাণে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপত। এখন আর অস্ত্র ও শস্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই।
অস্ত্রধারণ করেন যিনি তাঁকে বলা হয় অস্ত্রধারী। রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার হতে দেখা যায়। এইসব অস্ত্রের নাম, ব্যবহারের রীতিনীতি, ফলাফল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। বিশ্বামিত্র রামের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে অস্ত্রগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি হল–বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বক্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত। আরও অনেক নাম-না-জানা অস্ত্র! বিশ্বামিত্রের কি অস্ত্রের কারখানা ছিল আমেরিকার মতো? শুধু বিশ্বামিত্রই নন, অস্ত্র দিয়েছেন অগস্ত্যও। এঁরা তথাকথিত মুনিঋষি হলেও প্রত্যেকেই এক একজন বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের মালিক।
অনার্যদেবতা শিবের পৃষ্ঠপোষকতায় রাবণ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় শক্তিমান। তিনি ছিলেন শিবের ও ব্রহ্মা পদাধিকারীদের একনিষ্ঠ ভক্ত। পুরাণে আছে, অমরত্ব লাভের জন্য শিবের কাছে তপস্যা তথা দরবার করেছেন। শিব যতবারই তাঁকে পরীক্ষা করছেন, রাবণ নিজ মস্তক তরবারির আঘাতে কেটে গুরুর পায়ের কাছে ফেলে দিচ্ছেন। প্রতিবারই শিবের কৃপায় রাবণের মস্তক আবার যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এইভাবেই রাবণ দশ মস্তকের অধিকারী হলেন। নাম হলো দশানন। আসল কথা হল, দশানন বা দশ মস্তকের অধিকারী কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাবণের শক্তি, সামর্থ্যের কথা। জৈন মতে রাবণের ছিল দশমুখ। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণের একটাই মাথা, দুটি হাত, দুটি পা।
রাবণের মৃত্যু হয়েছিল রাম নয়, ইন্দ্রের হাতে। এ ইঙ্গিত রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরীই দিয়েছেন। পুরাণ বলছে, পরবর্তী জীবনে রাবণ তীর্থঙ্কর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্মীকির রাবণ শিবের কাছে তপস্যার পর শিব। সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ অমরত্ব চাইলেন। শিব অমরত্ব দিলেন না। রাবণের নাভির নিচে লুক্কায়িত। রইল অমৃত, যার উপস্থিতিতে রাবণ হলেন অপরাজেয়। অমৃত বিনষ্ট না-করে রাবণকে বধ করা যাবে না। লাভ করলেন অনন্ত শক্তি, যাতে মানুষ ছাড়া দেবকুল, অসুরকুল ইত্যাদি যত কুল আছে, সকলেই তাঁর কাছে পরাজিত হবেন। অবধ্য, অপরাজেয় হবেন রাবণ। আর দিলেন চন্দ্রহাস তরবারি। কিন্তু অকারণে এই শস্ত্রের প্রয়োগে তা কার্যকরী হবে না, পুনরায় ফিরে যাবে দেবতার কাছে। এছাড়াও শিব ও ব্রহ্মা অনেক অস্ত্র দিয়েছিলেন তাঁকে, যা দিয়ে তিনি লাভ করবেন সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য। এই সব অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছিল লঙ্কার যুদ্ধে। সাধারণের মানুষের প্রতি তাঁর কোনো ভয় ছিল না। মানুষকে তিনি শত্রু বলেই মনে করেন না। তাঁর প্রধান শত্রু ছিলেন দেবকুল এবং অসুরকুল। তাই তিনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা ভেবে শিবকে তুষ্ট করতেন। বিভীষণ রাবণের মৃত্যু কীভাবে সম্ভব একথা রামকে জানালে রামচন্দ্র প্রসাভপন অস্ত্র দিয়ে রাবণের অমৃতকে বায়বীয় পদার্থরূপে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন।