‘রামায়ণ’ বইটির নায়কের নাম রাম, নায়িকার নাম সীতা, খলনায়ক রাবণ। প্রায় ত্রুটিহীন চিত্রনাট্য। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ বলেন রামায়ণ হল আর্য আর অনার্যের দ্বন্দ্ব। কে আর্য? কে অনার্য? কেউ বলেন রাম আর্য, অনার্য রাবণ। কেউ বলেন রাম অনার্য, রাবণ আর্য। অনেকে বলেন রাম অন্ত্যজ, তথা অস্পৃশ্যের প্রতিনিধি। আর্যরাই কৌশলগতভাবে অনার্য রামকে দিয়েই অনার্যদের বিনাশ করেছেন। রাবণ আর্য তথা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধি। অনেকে রামকে আর্য তথা দেবতার প্রতিনিধি বলেন এবং রাবণকে রাক্ষস তথা অসুর তথা অনার্যের প্রতিনিধি বলেন।
তবে কি রামায়ণ ইক্ষ্বাকু বংশ আর কেকয় বংশের সংঘাত? বিশ্বামিত্র আর বশিষ্ঠের সংঘাত? ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণের সংঘাত? রাম আর ভরতের সংঘাত? দশরথ আর কৈকেয়ীর সংঘাত? এক মহাকাব্য, অনেক অভিমুখ। একটি মহাকাব্য–যে যেদিক দিয়ে পারে ব্যাখ্যা করে, বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় করে। রামকে কেউ অলৌলিক ক্ষমতার অধিকারী দেবতা মনে করেন, কেউ কেউ আবার রামচন্দ্রকে দোষেগুণে বিচক্ষণ মানুষ ভাবেন। কেউ কেউ রামকে একটি মহাকাব্যের একটি কাল্পনিক চরিত্রের বেশি ভাবতে চান না।
মূল কাব্যের ভিতরে যাওয়ার আগে গ্রন্থের নামকরণে ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে পারি।”নামে কী আসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, সুগন্ধ সে ছড়াবেই”–জুলিয়েটে মুখে শেক্সপিয়রের এই আপ্তবাক্য যে ব্যাপ্তির দিকে মন টানে সেদিকে না এগিয়ে বলা যায় সবক্ষেত্রেই নামের একটা গুরুত্ব আছে। চেনার জন্য, চেনানোর জন্য, জানার জন্য, স্বাতন্ত্রের জন্য নাম চাই। হতে পারে সেই নাম বিষয়ভিত্তিক, বস্তুভিত্তিক, ভাবভিত্তিক, ব্যঞ্জনাভিত্তিক, চরিত্রভিত্তিক ইত্যাদি। রচনাকার তাঁর রচনার নাম অনেক ভেবেচিন্তেই দেন। অনেকে বলেন কাব্যটি রামকেন্দ্রিক বলেই কবি রামায়ণ নামকরণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন নায়ক চরিত্রের নাম রাম, সেই কারণেই রামায়ণ নামকরণ করা হয়েছে–এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রামের ‘অয়ন’, অর্থাৎ যাওয়া। রামায়ণের ‘অয়ন’ অংশটি নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক জল ঘোলা করেছেন। বলা হয়েছে–রামায়ণকে “রামস্য চরিতান্বিতং অয়ন শাস্ত্রম্”। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ‘অয়ন’ শব্দের অর্থ শাস্ত্র’, এটা কল্পনার ফসল। এইচ. এইচ. উইলসন তাঁর ‘Sanskrit-English Dictionary’ গ্রন্থে আর-এক কায়দায় নামটির ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন, বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ বাসস্থান, অর্থাৎ রামায়ণ মানে দাঁড়াল রামের বাসস্থান। এল, এ. ওয়াডেল তাঁর “The Makers of Civilization in Race and History’ গ্রন্থে বলেছেন–‘অয়ন’ শব্দের অর্থ ‘দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘অ্যাডভেঞ্চার’। অর্থাৎ রামায়ণের মানে দাঁড়াল ‘রামের দুঃসাহসিক অভিযান’ বা ‘রামের অ্যাডভেঞ্চার। কেউ কেউ ‘অয়ন’ মানে কীর্তি’ বলেছেন, সেই হিসাবে রামায়ণের অর্থ দাঁড়ায় ‘রামের কীর্তি। পাণিনীর সূত্রানুসারে কেউ কেউ বলেন রামায়ণ’ শব্দের অর্থ ‘রামের বংশধর’, অর্থাৎ ‘রামবংশ। সুকুমার সেন বলেন, “কিন্তু শব্দটি (রামায়ণ) যে খাঁটি তাতে সন্দেহ নেই এবং শব্দটির মূলে যে রাম আছে তাতেও সন্দেহ করা চলে না”। আরও হরেক রকমের অর্থ পাওয়া যায়, পাছে বিরক্তির উদ্রেগ হয়, তাই আর উল্লেখ করলাম না। সহস্র পণ্ডিতের সহস্র মত। অয়ন’ শব্দযোগেই যদি নামটা বানানো হয়ে থাকে, তবে তিন ঘর আগে ‘র’ থাকার কারণে ‘অয়ন’-এর ‘ন’ (দন্ত্য) কীভাবে ‘ণ’ (মূর্ধন্য হয়ে যায়? ব্যাকরণে কোন্ নিয়মে এটা সম্ভব হল? তাহলে ‘রসায়ন’ কেন ‘রসায়ণ’ নয়? প্রশ্ন হল রাম বা। শ্রীরামচন্দ্রের নামে ওই রামায়ণের সম্পর্ক ছিল কি না।
বাংলায় ‘রামধনু’ বা ‘রামদা’-র সঙ্গে কিংবা হিন্দি ভাষায় ‘রামতরোই’ বা ‘রামদানা’-র সঙ্গে কিংবা ওডিশায় ‘রামতালি’ বা ‘রামফল’-এর সঙ্গে অথবা গুজরাতি রামপাতর’ বা ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে কিংবা মারাঠি ভাষায় ‘রামপাত্র’ ও ‘রামবাণ’-এর সঙ্গে রামনামের বা রামায়ণের সম্পর্ক থাকলে তা আজগুবি। বস্তুত রামায়ণ’ শব্দটি সংস্কৃত বলে চালানোর চেষ্টা হলেও, এটি মূলত খাঁটি গুজরাতি শব্দ। A long series of woes–অর্থে এই ভাষাতে রামায়ণ লোকচল শব্দ হিসাবে চলে। হিন্দি এবং মারাঠিতেও ‘A long series of woes’ রামকথা বা রামকাহানি লোকচল শব্দ হিসাবে প্রচলিত। মারাঠি ভাষায় রামায়ণ শব্দের অর্থ হয় বিরক্তিকর গল্প’ (Tedious yarn)। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“ “রামায়ণ’ শব্দের সংস্কৃতে কোন অর্থ হয় না, কিন্তু বাঙ্গালায় সদর্থ হয়। বোধ হয়, রামায়ণ’ শব্দটি ‘রামা যবন’ শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। কেবল ‘ব’-কার লুপ্ত হইয়াছে। রামা যবন বা রামা মুসলমান নামক কোন ব্যক্তির চরিত্র অবলম্বন করিয়া কৃত্তিবাস প্রথম ইহার রচনা করিয়া থাকিবেন। পরে কেহ সংস্কৃতে অনুবাদ করিয়া বল্মীকমধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। পরে গ্রন্থ বল্মীকমধ্যে প্রাপ্ত হওয়ায় বাল্মীকি নামে খ্যাত হইয়াছে।”
‘ব্যাস’ (মহাভারতকার) গুজরাতি পদবি হলেও, বাল্মীকি (রামায়ণকার) পদবিটি কিন্তু মগহি-ভোজপুরী। রামায়ণকে বাংলা ভাষায় শ্রীরামের পাঁচালী’ বলা হত। শ্রীরামের পাঁচালী’ লিখেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাস ওঝা ‘রামায়ণ’ নামে কোনো গ্রন্থ লেখেননি। তাতে কী হল? বাজারে তো ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ নামেই গ্রন্থ পাওয়া যায়। রামায়ণ’ শব্দের অর্থবহতা বাংলা ভাষায় ছিল না। মারাঠি আর গুজরাতি ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষায় এর কোনো ব্যঞ্জনা নেই। কবির নিজের মাতৃভাষা এক, কাব্য করতেন অন্য ভাষায়? কেমনভাবে সম্ভব হল? কেন সম্ভব নয়? ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী ঘোষের মাতৃভাষা বাংলা। সাহিত্য করেছেন ইংরেজি ভাষায়। যেমন শঙ্করাচার্য কেরলিয়ান বা মালয়ালম ভাষায় না-লিখে রহস্যজনকভাবে ‘দুর্বোধ্য’ সংস্কৃত ভাষায় লেখেন। “মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে শ্রীবিবস্বান লিখেছেন–“কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের নানান ভাষাভাষী পণ্ডিতদের যে ডাকা হয়েছিল এ খবর ইতিহাসেই পাচ্ছি। ডাকা হয়েছিল আঠারো শতকের সাতের ও আটের দশকে। মারাঠি পণ্ডিতদের, গুজরাতি বিদ্বানদের, ওড়িয়া বিদগ্ধদের অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।…দুনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত কুটির শিল্পের পত্তন হয়েছিল তথাকথিত ক্লাসিক্যাল ভাষাগুলোয় ক্লাসিক্যাল কাণ্ডকারখানা বানিয়ে রাখার ক্লাসিক্যাল মতলবেই। আর তা হয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার নানান দেশেই। লাতিন, হিব্রু ও প্রাচীন গ্রিক ভাষা প্রাচীন বলে প্রচার করা নানান কেতাব লেখানোর উদ্যোগ আয়োজন নেওয়া হয়েছিল। ভারতে নেওয়া হয়েছিল সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, আরবি, ফারসি কেতাব লেখানোর ব্যবস্থা। সরকারি উদ্যোগে কলকাতা, বেনারস, নদিয়া (নবদ্বীপ) মিথিলায় গড়ে উঠেছিল সংস্কৃত মাধ্যম মিথ্যাসৃষ্টির আঁতেলি কর্মশালা। বেনারস, গাজিপুরে তথাকথিত বৈদিক সংস্কৃত ভাষার নেপথ্য কর্মকাণ্ডও চলেছিল। বাংলা, ওডিশা, মারাঠি (প্রাকৃত), গুজরাতি ও হিন্দি প্রধানত এই পাঁচটি ভাষায় (অন্য ভাষায় শব্দ রাখারও ব্যবস্থা হয়েছিল) বেশ কিছু শব্দ অবিকল একইভাবে কিংবা কিছুটা ঘষেমেজে নিয়ে ওই সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ঠাটের শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, আর এটা ঘটেছিল আঠারো শতকের শেষ চতুর্থাংশে। ইংরেজি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ কী রাখা যায় এই নিয়েও নানান কায়দায় জল্পনাকল্পনা হত। ভারতের নানান ভাষার কোন্ কোন্ শব্দ সংস্কৃতে ঠাঁই দেওয়া যায় সেটা নিয়েও ভাবনাচিন্তা কম হত না।…ব্যাকরণসর্বস্ব লাতিন ও সংস্কৃত ভাষা সৃষ্টির পিছনে যেসব নেপথ্যশিল্পী ছিলেন তাঁদের কেউই প্রাচীন যুগের ছিলেন না। ছিলেন অর্বাচীন যুগের। লাতিন এবং সংস্কৃত দুই ভাষায় লেখা কেতাবগুলির প্রায় সবই উনিশ শতকে প্রকাশিত হয়েছে কেন? কেন আঠেরো শতকে সংস্কৃত একখানা কেতাবও ছাপা হয়নি? সংস্কৃত রামায়ণের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। ক্রমশ অন্য খণ্ডগুলির প্রকাশ হতে হতে শেষ খণ্ডটির প্রকাশ ঘটেছিল ১৮৭৫ সালে।… বাংলা রামায়ণ ১৮০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ ৭২ বছর পরে সংস্কৃত। রামায়ণ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের সম্পূর্ণ কলেবরে পুথি কেউ কি দেখেছেন?