তখনও অর্থাৎ স্কুল-জীবনের প্রথম দিন আমার মাথায় আসেনি, আসবেই বা কি করে যে, আমরা উভয়েই সমান বয়স্ক, একই দৈহিক উচ্চতাবিশিষ্ট, আর চোখ, মুখ আর নাকের দিক থেকেও আমাদের মধ্যে যারপরনাই সাদৃশ্য বর্তমান। আর দৈহিক গঠন বৈশিষ্টের দিক থেকেও আমরা উভয়ে অবিকল একই রকম।
তখন কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা ভাবতে পারিনি। আর প্রথম দর্শনেই এমন একটা ভাবনা তো কারো মাথায় আসারও কথা নয়। কি সে ব্যাপার, তাই না? ঠিক আছে খোলসা করেই বলছি–আমাদের উভয়ের নাম পদবী আর দৈহিক সাদৃশ্যের ব্যাপারটাকে সে যে ভবিষ্যতে আমাকে ঘায়েল মানে বিরক্ত ও অতিষ্ট করে তোলার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এরকম তিলমাত্র আশঙ্কাও আমার মনে জাগেনি।
সে ‘মোক্ষম অস্ত্রটা কি ছিল? অবিকল একটা ‘দ্বিতীয় আমি তার নাম-পদবী থেকে শুরু করেনিখুঁত দৈহিক বৈচিত্র্য পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই বিরাজ করছিলাম। হ্যাঁ, এটাকেই সে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে নিয়েছিল। কেবল পদবী আর দৈহিক গঠন বৈচিত্র্যের কথাই বা বলি কেন? এমনকি কথা বলার ধরণ-ধারণ তার কাজকর্ম করার পদ্ধতির দিক থেকেও আমাদের মধ্যে কম-বেশি মিল থাকলেও সেনিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন চালিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাকিটুকু রপ্ত করে যেটুকু ঘাটতি ছিল পূরণ করেনিল।
আর পোশাক আশাকের ব্যাপারটা? হুবহু একই রকম পোশাক ব্যবহার করা তো খুবই মামুলি ব্যাপার। অল্পায়াসেই সে সমস্যার সমাধান করে নেওয়া তো কোনো সমস্যাই নয়।
আর চলাফেরার যৎকিঞ্চিৎ বৈসাদৃশ্য যেটুকু ছিল অনুশীলনের মাধ্যমে দুদিনেই আয়ত্ব করেনিল। এবার সবশেষে সে নজর দিল কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটার দিকে। কণ্ঠস্বরকে অনুকরণ করতে এতটুকুও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সে নিজের ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরকে অনুশীলনের মাধ্যমে কি করে আমার মতো ভরাট কণ্ঠস্বরে পরিণত করল? হ্যাঁ, এরকম জিজ্ঞাসা জাগা স্বাভাবিক। ব্যাপারটা হচ্ছে, সে কিন্তু তার ভরাট গলার কণ্ঠস্বরকে আমার মতো উচ্চস্বরে তোলার জন্য তিলমাত্র চেষ্টাও করল না। যা করতে চেয়েছিল তা কিন্তু ঠিকই সেরে ফেলল। তার বিশেষ। কণ্ঠস্বর–নিচু স্বরের ফ্যাসফ্যাসে শব্দটা যেন অবিকল আমার কণ্ঠস্বরকেই প্রতিধ্বনিতে পরিণত করে ফেলল। তার এ অত্যাশ্চর্য-অদ্ভুত ক্ষমতাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা। আমার অন্তত নেই।
উইলিয়াম উইলসন আমাকে সব দিক থেকে হুবহু নকল করে, অভিনয়ের মাধ্যমে আমাকেনিখুঁতভাবে নকল করার কাজটাকে এমন অভাবনীয়ভাবে সম্পন্ন করত, যা দেখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠত। সে মুহূর্তে অন্তত আমি কিছুতেই তাকে বরদাস্ত করতে পারতাম না। অস্বীকার করব না, তখন আমার মনে হত দৌড়ে গিয়ে তাকে চিবিয়ে খেলেও বুঝি তার ওপরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না।
এতকিছু সত্ত্বেও আমার একটা সান্ত্বনা অবশ্যই ছিল। সেটা কি? তার এ অদ্ভুত অভিনয়টা কেবলমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই হৃদয়ঙ্গম করে মজা লুটতে পারত না।
আরও আছে। নিজে সফল অভিনয়ের ফলে তার ঠোঁটে–চোখে-মুখে ব্যঙ্গের হাসি প্রকট হয়ে উঠত, একমাত্র আমিই সেটা বুঝতে পারতাম। দাঁত কিড়মিড় করে নীরবে হজম করে নিতাম। তবে স্কুলে অন্য কোনো ছাত্রই তার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারত না। আর সেই কারণেই তার সঙ্গে যোগ দিয়ে কেউ আমাকে নিয়ে বিদ্রুপে মেতে উঠত না।
বহুদিন ধরে বহু চেষ্টা করেও এ অসহনীয় রহস্যটা ভেদ করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। ফলে নিতান্ত অসহায়ভাবে এ-কুটিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আমাকে মুখ বুজে হজম করতেই হয়েছে।
দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তার পর আজ আমার যতদূর মনে পড়ছে, তখন তার সঙ্গে আমার জোর বাকযুদ্ধ–কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি এমনই ক্ষেপে গিয়েছিলাম যে, গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে তাকে ঘা-কতক বসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
আমি গায়ে হাত দেওয়ায় সে ক্রোধে একেবারে ফেটে পড়ার যোগাড় হল। এমন একটা ব্যাপার তার কাছে বাস্তবিকই অপ্রত্যাশিত ছিল। ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে সে রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে এমনকিছু কটুক্তি করল আর এমনকিছু কথা–গালমন্দ করল যা নিতান্তই তার স্বভাববিরুদ্ধ। তার আচরণে আমি যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি সে মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। সে এ ব্যাপারে মুখে কিছু না বললেও তার আচার ব্যবহারের মাধ্যমে আমি ঠিকই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
তবে একটাই সান্ত্বনা যে, ঘটনাটা আর বেশিদূর গড়ায়নি, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়াও লক্ষিত হয়নি।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আমার বিশ্বাস পুরনো বাড়িটায় ছোট-বড় অনেকগুলো ঘর ছিল, তাদেরই একটা ছিল খুবই বড়-সড়, যাকে আমরা হলঘর বলতাম। হলটার লাগোয়া কতকগুলো ছোট ছোট ঘরটায় পড়ুয়াদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিছুসংখ্যক ছাত্র ওই ঘরগুলোতেই থাকত।
আর অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসোবির থাকার ঘরটার কথা তো আগেই বলেছি–বাড়িটার এক্কেবারে শেষ প্রান্তের পায়রার খোপের মতো একটা ছোট্ট ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। আবার বড় হলো ঘরটাতেই অধিকাংশ থাকত। আর উইলিয়াম উইলসনের থাকার ব্যবস্থা ছিল হলঘরটার লাগোয়া ছোট ছোট ঘরগুলোর একটাতে।