অ্যাসটোরিয়া

ওয়ালডর্ফ।

জার্মানির এক অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম ওয়ালডর্ফ। জন জ্যাকব অ্যাসর্টর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

জন জ্যাকব ধনকুবের হওয়ার অত্যুগ্র বাসনা নিয়ে যৌবনের প্রারম্ভেই আমেরিকায় আসেন।

আমেরিকার শহরে শহরে ঘুরে তিনি কারবারের ধান্ধা করতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত বহু চিন্তা-ভাবনার পর তিনি চামরার কারবার ফেঁদে বসেন। এটা যে একটা কারবার হতে পারে, এতে নাম-যশ হওয়াও সম্ভব আর এ কারবারের মাধ্যমেই যে সরকারের সুনজরে আসা যেতে, পারে তা তিনি নিজের ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।

জন জ্যাকব দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে পালা দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেকারসমের সান্নিধ্যে এসে পশুচর্মের ব্যবসাকে রমরমা করে গড়ে তুলতে আগ্রহি হয়েছিলেন। আর এ-কাজের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, জনবসতিহীন জায়গায় বসতি গড়ে তোলা সম্ভব, সাম্রাজ্যের প্রসার ও সমৃদ্ধি ঘটতে পারে। দেশের অর্থকড়ি দেশেই চলে যাবে আর বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৌলতে দেশের অর্থ বিদেশে পাড়ি দেবে না।

জন জ্যাকবের ধন সম্পদ প্রচুরই ছিল। টাকাই তার কাছে আসল নয়। একমাত্র টাকার জন্যই তিনি এরকম একটা দুঃসাহসিক কাজে নিজেকে লিপ্ত করেননি।

তবে জন জ্যাকবের কারবার ফাদার পিছনে কোন্ উদ্দেশ্য ছিল? তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, আমেরিকার টাকাকড়ি যাতে দেশের বাইরে চলে না যায়।

আমেরিকাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে তিনি দেশের দুর্গমতম অঞ্চলেও অভিযান পাঠাতে দ্বিধা করেননি। আর এর জন্য তাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে যথেষ্টই। তিনি কেবলমাত্র স্থলপথেই নয়, পানিপথেও অভিযান পাঠিয়েছিলেন।

জন জ্যাকব নিজের টাকা খরচ করে কারবার স্থাপন করেছিলেন। সে টাকার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়।

কারবার গড়ে তোলার জন্য সরকার অর্থ সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। শুধু কি এই? এমনকি পাঁচ বছরে কারবার চালাতে গিয়ে কিছু লোকসান হয়। তবে সরকার তা বহন করাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

কথাটাকে কেউ কেউ নিছকই গালগপ্প মনে করতে পারেন। যাগে যে যা-ই বলুক বা ভাবুক না কেন, তারই গাটের টাকায় খরিদ করা জাহাজের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় তখন নৃশংস প্রকৃতির রেড ইন্ডিয়ানরা মওকা বুঝে জাহাজ আক্রমণ করে বসে। বেপরোয়া লুঠতরাজ চালায়। জাহাজের সব কর্মীকে খতম করে দেয়। এমনকি সব শেষে জাহাজটাকে ধ্বংস করে দিতেও তারা এতটুকু দ্বিধা করে না।

স্থলঅভিযাত্রীদের মন থেকে এ ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মুহূর্তের জন্যও মুছে যায়নি।

স্থলঅভিযাত্রীরা একদিন খোলাখুলিভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতিকে। বলেছিল–তোমরা কি ভুলে গেছ, গুটি বসন্ত যখন তোমাদের পল্লিতে মহামারীর রূপ নিয়েছিল তখন তোমাদের গ্রামকে গ্রাম উজার হয়ে গিয়েছিল? আজ তোমাদের পাখা গজিয়েছে দেখছি!

এবার একটা বেতাল তাদের দিকে এগিয়ে ধরে স্থলঅভিযাত্রীদের একজন। বলল–আমার হাতের এ বোতলটায় কী আছে তোমরা কেউ বলতে পার?

রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি বোতলটার দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। স্থলঅভিযাত্রী লোকটা এবার অপেক্ষাকৃত গম্ভীর স্বরে বলল–এর মধ্যে আমি গুটি বসন্তকে পুরে রেখেছি।

গুটি বসন্তের কথা শোনামাত্র রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি রীতিমত আঁতকে উঠল।

স্থলঅভিযাত্রী লোকটা পূর্বস্বর অনুসরণ করেই বলে চলল–বোতলের ছিপি খোলামাত্র বোতল থেকে গুটি বসন্ত বেরিয়ে এসে তোমাদের সবাইকে সাবাড় করে দেবে? কথাটা মনে রেখো।

ব্যস, আর যাবে কোথায়! নরঘাতক রেড ইন্ডিয়ানরা কথাটা শোনামাত্র ফুটো বেলুনের মতো একেবারে চুপসে গেল। আর লুঠতরাজ ও নরহত্যা করতে উৎসাহি হয়নি।

জন জ্যাকবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি নতুন উদ্যমে আবার কারবার শুরু করলেন। অচিরেই তার কারবার রীতিমত রমরমা হয়ে উঠল। রেড ইন্ডিয়ানরা নিতান্ত অনুগত ভূত্যের মতো তাকে পশুচর্ম যোগান দিতে। আরম্ভ করল।

কারবারের সুবিদার্থে জন জ্যাকব নদীর পাড় ঘেঁষে কিছুদূর বাদ দিয়ে একটি করে কেন্দ্র স্থাপন করলেন, যেখান থেকে রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে পশুচর্ম সংগ্রহ করা সহজতর হয়।

জন জ্যাবকবের কারবার ক্রমে ফুলে-ফেঁপে এমন বিশাল আয়তন ধারণ করতে লাগল যাতে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভড়কে গেল। তিনি তাদের সঙ্গে পুরোদমে পাল্লা দিয়েই কারবার চালাতে লাগলেন।

এভাবে ইংরেজ টেক্কা দিয়ে কারবার চালাতে চালাতে দেশ জুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। শুরু হলো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

জন জ্যাকবের পরিকল্পনা ছিল যথার্থই নিখুঁত। কিন্তু পরিকল্পনা নিখুঁত হওয়া সত্ত্বেও তাকে সফল করে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হলো না, কিছুতেই পারলেন না।

তবে এও সত্যি যে, পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করা যাবে না। দোষ যে তার নয়, এটাই সত্যি। কেন তার ঘাড়ে দোষ চাপানো যাবে না? ব্যাপারটা হচ্ছে, আমেরিকার দুর্গমতম অঞ্চলে তিনি একের পর এক অভিযান চালিয়ে পশুচর্ম সংগ্রহ করছিলেন। তারপর সংগৃহীত পর্বত প্রমাণ পশুচর্ম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আর চীনে রপ্তানি করেন। উদ্দেশ্য যাতে আমেরিকার চোখ খুলে যায়।

তার মনোবল ছিল বাস্তবিকই সুদৃঢ়। অন্তরে অফুরন্ত উচ্চাশা পোষণ করত, নিজের ওপর আস্থাও ছিল যথেষ্টই আর দুঃসময়কে কিভাবে সুসময়ে পরিণত করা যায়। সে ফন্দিও অবশ্যই তার জানা ছিল।

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাসটোরিয়া নামক একটা অভিযানের বই ছাপা হয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এর পাতায় পাতায় জন জ্যাকবের দুৎসাহসিক অভিযানের টুকরো টুকরো শ্বাসরোধকারী বিবরণ ছাপা হয়েছে। যারা পড়তে ও জানতে আগ্রহি তাদের জন্যই এ কথা বলা।

ইম্প অফ দ্য পারভাস

মানুষের বিবেগটা মাঝে মধ্যে নরবড়ে হয়ে যায়–যার ফলে তারা কুকর্মে লিপ্ত হয়। তার কাজকর্ম দেখে আমরা তখন বলাবলি করি, লোকটা মানসিক বিকৃতির শিকার হয়ে পড়েছে।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, শয়তান তার মধ্যে ভর করে তাকে কুকর্মে লিপ্ত করে। কোন কোন সময় এমনও দেখা যায়, অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ফলে তার ভালোই হয়েছে। কাণ্ডটা না ঘটানো পর্যন্ত তার ছোঁকছোঁকানি ভাবটা তাকে যে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত এখন তার কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে।

এবার আমার প্রসঙ্গে আসা যাক।

বহুদিন ধরেই খুন করার পরিকল্পনাটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে সাহসে ভর করে মতলবটাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারছিলাম না। একটা আতঙ্ক বুকের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই ধুকপুকানি শুরু হয়ে যেত গোয়েন্দারা যদি পাকড়াও করে ফেলে? বুকের ভেতরে জাঁকিয়ে বসে-থাকা এ আতঙ্কটার জন্যই আমি খুনটা করতে পারছিলাম না, গড়িমসি করছিলাম।

তারপর একদিন একটা ফরাসি বই হাতে পেলাম। সেটাকে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। তাতে লেখা হয়েছে, অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করে এক মহিলাকে খুন করা হয়েছে। কৌশলটা আমার খুবই মনে ধরে গেল। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বইটার আগাগোড়া আবারও পড়ে ফেললাম।

পরিকল্পনা যে শুধুমাত্র অত্যুড়ুত তা-ই নয়। রীতিমত মৌলিকও বটে।

বইটায় উল্লেখিত পরিকল্পনা হচ্ছে–মোমবাতির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোমবাতিটা জ্বলার সময় তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে বিষাক্ত গ্যাস নাকের মাধ্যমে তার ফুসফুসে ঢোকে। মহিলাটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি পুঁকতে ধুঁকতে এক সময় পটল তোলেন। ব্যস, কাজ হাসিল। চমৎকার! অত্যাধুনিক এক মৌলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে খুন।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে এ-বেড়ে মতলবটাকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করব না।

যে লোকটাকে খুন করার জন্য আমি মানসিক অস্থিরতা বোধ করেছিলাম, রীতিমত ছোঁকছোঁক করে বেড়াচ্ছিলাম, তার অনেকগুলো বাতিক ছিল, বদঅভ্যাসও বলা চলে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে অনেক রাত অবধি বই পড়ায় মেতে থাকা। তখন ভেতর থেকে জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরটাকে সে একটা পায়রার খোপে পরিণত কওে নিত। আমার মতলবটাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার মতো মোক্ষম পরিবেশই বটে।

ব্যস, আমি কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেলাম।

বিষ মিশিয়ে একটা জব্বর মোমবাতি তৈরি করে ফেললাম। এবার নিজেহাতে তৈরি মোমবাতিগুলোর একটা তার ঘরে দিলাম জ্বালিয়ে।

পরদিন সকালে দেখলাম, নচ্ছাড়টা বিছানায় মরে শক্ত হয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে।

ডাক্তার ডেকে আনা হলো। তিনি লিখলেন–ঈশ্বর সন্দর্শনে তার মৃত্যু হয়েছে।

আমার বাঞ্ছা পূরণ হলো। পথের কাঁটা নির্বিবাদেই দূর হয়ে গেছে। ব্যস, আমি তার বিষয় আশয়ের মালিক বনে গেলাম।

অগাধ অর্থ বাগিয়ে নিয়ে মৌজ করে সেগুলোর সদ্বব্যবহার করে কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে দিলাম।

গোয়েন্দারা যতই আশপাশ দিয়ে ছোঁকছোঁক করে বেড়াক না কেন, আমার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি নিঃসন্দেহ, আর এসব বাজে ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে সময় কাটানোর দরকারও মনে করি না।

নচ্ছার বুড়োর ঘরের মোমবাতির শেষাংশটুকু আমি গায়েব করে দিয়েছিলাম। সন্দেহ করার মতো তিলমাত্র চিহ্নও কোথাও রাখিনি।

অপরাধ? হ্যাঁ অপরাধ তো আমি অবশ্যই করেছি। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে চারদিক বজায় রেখে তবেই কাজটা করেছি। ফেঁসে যাওয়ার মতো সামান্যতম সূত্রও কোথাও রাখিনি। অতএব আমার গায়ে হাত দেওয়ার হিম্ম কার আছে? কে আমাকে পাকড়াও করবে? তাই আমি রীতিমত পুলকানন্দেই মেতে ছিলাম।

আমি নিজের নিশ্চিদ্র ও নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রতিটা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা মুহূর্ত নিরাপত্তার ভাবনায় ডুবে থাকতাম।

হ্যাঁ, খুন আমি করেছি। আমি খুনি। কিন্তু খুন করেও আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমি সর্বদা এসব ভাবনায় ডুবে থাকতাম আর অভাবনীয় এক পুলকানন্দে ফেটে পড়ার যোগাড় হতাম। খুন করেও আনন্দ উল্লাসের জোয়ারে নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে চলা–কম কথা!

একদিন রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটার সময় আপন মনে সে ঘটনাটার কথা ভাবছিলাম। আমি স্বগতোক্তি করলাম–আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমার ওপর কারো তিলমাত্র সন্দেহও নেই, থাকার কথাও নয়।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আবারও স্বগতোক্তি করতে লাগলাম–আরে ধ্যুৎ! কে আমার গায়ে হাত দেবে। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ার সাধ্যও কারো নেই। আমিনিজে থেকে যদি স্বীকার না করি তবে আমার গায়ে হাত দেয় কার সাধ্য!

আমার অন্তঃস্থলে সর্বক্ষণ যে নিরাপত্তাবোধ চক্কর মেরে বেড়াচ্ছে তা কখন যে আমার মুখ দিয়েও আচমকা বেরিয়ে এলো তা আমি খেয়াল করিনি।

পথ চলতে চলতে হঠাৎই বুঝতে পারলাম, আমি নিজের মনেই পাগলের মতো বক বক করে চলেছি–ধরবে? আমাকে ধরবে? কে আমার গায়ে হাত দেবে? কিছুমাত্রও প্রমাণ নেই, কোনো সূত্রও নেই, আর সন্দেহ করার মতো কারণও কিছু নেই। কে আমাকে ধরবে? কে ধরবে? আমিনিজে থেকে স্বীকার না করে নিলেই তো হলো! আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ারও কারো সাধ্য নেই।

যখন বুঝতে পারলাম, ঠিক সে মুহূর্তেই আমার বুকের ভেতরে অস্বাভাবিক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। তবে সে আর কতক্ষণ? খুবই অল্পক্ষণের জন্য। তা যদি

হতো তবে অনেক আগেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। ব্যস, কেল্লা ফতে হয়ে যেত। এ কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার! তবে কি শয়তান আমার কাঁধে ভর করেছে? হ্যাঁ, সে রকমই তো মনে হচ্ছে। তা নইলে আমার এমন আকস্মিক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে যাবেই বা কেন? মৃগী রোগের শিকার হলে মানুষ এমন করে আপন মনে প্রলাপ বকতে থাকে। হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড!

আমি অনবরত বকেই চললাম–হ্যাঁ, আমি খুন করেছি। খুন করেছি, বেশ করেছি। হাজার বার বলব, বেশ করেছি। এতদিন তো অন্তরের অন্তঃস্থলে গোপন। করেই চেপে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছে রে বাবা! তবে কি…তবে কি নিহত বুড়োটার প্রেতাত্মাই আমাকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে! তবে কি এটা প্রেতাত্মারই কারসাজি।

আমার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি মুহূর্তে যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। আমি কাণ্ডজ্ঞান রহিত অবস্থায় লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা জুড়ে দিলাম। না, হাঁটা বললে ঠিক বলা হবে না, বরং উর্ধশ্বাসে দৌড়ানোই বলা উচিত। আমি সদর রাস্তা ছেড়ে দিয়ে গলিপথ ধরলাম। একের পর এক বাঁক ঘুরে, গলি পাল্টাতে পাল্টাতে রীতিমত উৰ্দ্ধশ্বাসে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে আপন মনেই ভাবতে লাগলাম, পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলাই বরং উচিত। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেওয়াই তো উচিত। বরং চেঁচিয়ে বলেই ফেলি–শোন, তোমরা সবাই শোন, আমি খুনি, খুন করেছি। আমি নিজেহাতে খুন করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড়ও কেউ দিতে পারেনি। পারবেও না কোনোদিন!

আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রায়োন্মাদের মতো ইচ্ছাটা যতবার তীব্রতর হয়ে উঠছে ততবারই আমি আতঙ্কে একেবারে কুঁকড়ে গিয়েনিজেকে কোনোরকমে সামলেসুমলে দমিয়ে রেখেছি।

আমি আতঙ্ক-জ্বরের শিকার হয়ে হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে রীতিমত দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে নির্জন-নিরালা অঞ্চল ছেড়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলে এলাম। জোরে তখনও জোরে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কাউকে ঠেলে, কাউকে গোত্তা মেরে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে দৌড়েই চললাম।

দৌড় লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমি বুঝতে পারছি, এভাবে উন্মাদের মতো দৌড়ালে আমার আতঙ্কটা অনেকাংশে বেড়েই যাবে। আর সে সঙ্গে আমার প্রতি পথচারীদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হবে। আর কৌতূহল থেকে মনে দানা বাঁধবে সন্দেহ। ব্যস, সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটে যাবে। কিন্তু হায়! আমি যে কিছুতেই দৌড় থামিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছি না।

হায়! যা স্বাভাবিক, যা ঘটা উচিত ছিল তা-ই ঘটে গেল। উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো আমাকে অনবরত দৌড়াতে দেখে পথচারীদের একটা অংশ ধর! ধর রবে চিল্লাচিল্লি করতে করতে আমার পিছু নিল।

আমার বুঝতে দেরি হলো না অদৃষ্ট আমাকে শেষপর্যন্ত কোন দিকে নিয়ে চলেছে।

হায় ঈশ্বর! এ কী সর্বনাশ ঘটতে চলেছে! তখনও যদি আমার অবাধ জিভটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলতে পারতাম,নির্ঘাৎ অব্যাহতি পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মনের কোণে সদ্য জেগে-ওঠা জিভ ছেঁড়ার ইচ্ছাটা উঁকি মারতে না মারতেই আমার একেবারে কানের কাছে হেড়ে গলায় কড়া স্বরে কে যেন পিছন থেকে ধমক দিয়ে উঠল–হুঁশিয়ার! দাঁড়া! ব্যস আচমকা শক্ত একটা হাত আমার কাঁধটাকে সাড়াশির মতো চেপে ধরল।

ব্যস, আমার শরীরের সবটুকু শক্তি যেন মুহূর্তের মধ্যেই নিঃশেষে উবে গেল। আমার পথে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নড়তে চড়তেও পারলাম না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কালা মাছের মতো হাঁ করে অনবরত জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম। দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়ে আসছিল। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। দৃষ্টিশক্তি যেন লোপ পেতে বসেছে। কানেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। হায়! চোখ আর কান দুটোই একই সঙ্গে চলে গেল, অকেজো হয়ে পড়ল!

আমি কর্তব্য ভাববার আগেই অদৃশ্য শয়তানের মতো কার যেন বজ্রমুষ্ঠি আমার পিঠের ওপর দুম্ করে আছড়ে পড়ল না।

ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই অঘটনটা ঘটে গেল। অন্তরের অন্তরতম গোপন কোণে এতদিন যে কথাটাকে জোর করে চেপে রেখেছিলাম, সেটা অতর্কিতে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

পরে জানতে পারলাম, আমি নাকি খুবই স্পষ্টস্বরে আর খুবই ব্যস্ততার সঙ্গে আমার দোষ কবুল করেছিলাম–খোলাখুলি সবকিছু বলে ফেলেছিলাম। কথা বলতে গিয়ে যদি কিছু বাদ পড়ে, ছাড় ঘটে তাই মুহূর্তের জন্যও থামিনি।

আমার বুকের ভেতরে জোর করে চেপে রাখা কথাগুলোকে এক নিশ্বাসে বলেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর যা-কিছু ঘটনা সবই আমার অজান্তে।

গারদের ভেতরে আমি এখন ভাবছি, আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একদিন না একদিন আমার হাত পায়ের বেড়ি হয়তো খুলে যাবে। কিন্তু তারপর! তারপ আমার কি গতি হবে? আজ আমি জেলখানায় বসে আফসোস করছি কাল কোথায় আমার স্থান হবে?

শয়তানটার ভালোই জানা আছে।

ইলিওনোরা

সবাই আমাকে পাগল বলে।

আসলে মাত্রাতিরিক্ত কল্পনা আর আবেগের জন্য সবার কাছে পরিচিত এক বংশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। যাক গে, সবাই আমাকে পাগল বলেই সম্বোধন করে।

কিন্তু আজ অবধি তো একটা প্রশ্নে মিমাংসা হয়নি, যে, উন্মাদনাই কি মহত্তম বুদ্ধিবৃত্তি? আবার যা-কিছু গৌরবময়, যে সব সুদৃঢ়, সে সবকিছুই ব্যাধিগ্রস্ত চিন্তার মাধ্যমেই সম্ভব কি না, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির বিনিময়ে লাভ করা মনের একটা উদারতম ভাব থেকে সৃষ্ট কি না, এ প্রশ্নের মীমাংসা করা তো আজ অবধি সম্ভব হয়নি।

সমাজের যে সব মানুষ দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের পক্ষে এমন বহু কিছু অবগত হওয়া সম্ভব। যা যারা কেবলমাত্র রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাদের ধ্যান-ধারণার বহিভূত রয়ে যায়। দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে তাদের পক্ষে অনন্তের ক্ষণিক দর্শন লাভ করতে সক্ষম হয়।

ঘুম চটে গেছে তাদের অন্তর এ-কথা ভেবে কেঁপে ওঠে যে তারা এক সুমহান গভীর রহস্যের একেবারে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ না হলেও খুব সামান্য

অংশের জন্য হলেও তারা জ্ঞানের এ-রূপকে কল্যাণময় বলেই উপলব্ধি করেছে। যা। আমরা সচরাচর জ্ঞান বলে দেখে থাকি তার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য। আর তাদের জ্ঞান যতই লাগামছাড়া হোক না কেন তারা কিন্তু এক অনির্বচনীয় অবর্ণনীয় আলোর এক সুবিস্তীর্ণ মহাসাগরে প্রবেশ করেছে।

ঠিক আছে, আমি পাগল এটাই বলা হোক। আমি অন্তত এটুকু স্বীকার করে নিচ্ছি। যে, আমার মনের দু-দুটা পৃথক অবস্থা বর্তমান। একটা পরিষ্কার যুক্তির অবস্থা, যাকে বলব আমার প্রথম-জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনার স্মৃতিগুলো তার সাক্ষ্য বহন করছে, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে অনুমান, সন্দেহ আর ছায়া ছায়া অবস্থা যা বর্তমান আর জীবনের দ্বিতীয় অবস্থা স্মৃতিগুলো। অতএব আমার জীবনের প্রথম অবস্থার কথা যা-কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরব সে সবই কিন্তু বিশ্বাস করবেন। আর দ্বিতীয় অধ্যায় সম্বন্ধে যা-কিছু বলব তাদের যথাযোগ্য প্রাপ্য বিশ্বাসটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন না। আর তা যদি না ই সম্ভব হয় তবে সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে সন্দেহের চোখে দেখবেন, আপত্তি নেই। আর যদি তা নিতান্তই সম্ভব না হয় তবে ইডিপাস রহস্যকে নিয়ে খেলায় মেতে থাকবেন, কেমন?

এবার আমার মনের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি–যৌবনে যাকে আমি অন্তরের ভালোবাসা নিঙড়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম, যার কথা ও কাহিনী নিয়ে এ স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি, শান্ত-স্বাভাবিক আর স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করছি, সে আমার বহুদিন আগে পরলোকগতা মাতৃদেবীর একমাত্র বোনের একমাত্র কন্যারত্ন।

সে বোনের নাম ছিল ইলিওনোরা। আর এ নামেই তাকে সবাই সমোধন করে। আমরা প্রায় প্রতিটা মুহূর্ত একসঙ্গে পরস্পরের পাশাপাশি-কাছাকাছি অবস্থান করতাম। তৃণাচ্ছাদিত উপত্যকায় গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যরশ্মির নিচে আমরা উভয়ে একত্রে কাটিয়েছি। সেটা ছিল এমনই একটা উপত্যাকা যেখানে পথপ্রদর্শক ছাড়া কেউ একা কোনোদিন যায়নি। এরও কারণ আছে যথেষ্টই। কারণ স্থানটা সুউচ্চ একটা পর্বতমালার কেন্দ্রে অবস্থিত। আর তার ভালোলাগা কথাগুলো মর্মরশ্মির প্রবেশাধিকার ছিল না।

আর! মানুষ চলাচলের কোনো পথ সে অঞ্চলটার কাছাকাছি দিয়ে এগিয়ে যায়নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সে শান্তি-সুখের নীড়ে বনের ঝোঁপ ঝাড় গাছগাছালির কোনোটাকে দু হাতে সরিয়ে, না হয় কোনোটাকে ভেঙে তবেই যাওয়া যেত। আর লক্ষ লক্ষ সুগন্ধ ফুলকে দুপায়ে মাড়াতে হত। এ ভাবেই আমরা প্রতিদিন যাতায়াত করতাম। আমরা বলতে আমি, আমার বোনটা আর তার মায়ের কথা বলছি। আমরা এমনই সমাজ-সংসার থেকে দূরে, বহুদূরে একান্ত নির্জন-নিরালায় বাস করতাম। উপত্যকার বাইরেও সে এক বিশাল জগতের অস্তিত্ব রয়েছে তা আমাদের ধ্যান ধারণার বহির্ভূত ছিল।

আমাদের দেশটার চারদিক ঘিরে রেখেছিল যে পর্বতমালা, তারই শীর্ষদেশের এক স্থান থেকে উদ্ভুত একটা নদী পর্বত আর পার্বত্য বনাঞ্চলের গা-বেয়ে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে ছোট্ট একটা নদী নেমে এসেছিল। আবার ঘুরে গিয়ে পাহাড়ারের কোনো এক অজ্ঞাত অঞ্চলে সেটা হারিয়ে গেছে। একমাত্র ইলিওনোরার চোখের মণি দুটো ছাড়া আর সবকিছুর চেয়ে স্বচ্ছ ছিল তার জলরাশি।

আমরা সে নদীটাকে নিঃশব্দের নদী বলে সম্বোধন করতাম। কেন? কারণ, তার প্রবাহে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করত। আর আমরা যে নুড়ি পাথরগুলোকে খুবই ভালোবাসতাম সেগুলো পর্যন্ত নদীটার স্রোতের এক তিলও পড়ত না। গতিহীনতার জন্য সন্তুষ্ট হয়ে তারা যে, যার জায়গায়ই নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে থেকে ঝকমক করত। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।

আমি আর আমার ভালোলাগা ইলিওনোরা–আমাদের অন্তরে প্রেমের আর্বিভাব ঘটার পনেরোটা বছর আগে আমরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে উপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে এখানে ওখানে কতই না ঘুরে বেরিয়েছি তার হিসেব নেই। তারপর আমার চতুর্থ পঞ্চাব্দ আর আমার তৃতীয় পঞ্চাব্দ যখন শেষ হতে চলেছে ঠিক তখনই আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে, বুকে জড়িয়ে ধরে সর্পিল গাছটার তলায় বসেছিলাম। সেখানে বসে নিঃশব্দের নদীটার পানিতে আমাদের চঞ্চল প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। সে বহু আকাক্ষিত, মধুর দিনটায় অবশিষ্ট সময় আমরা কেউ-ই কারো সঙ্গে একটা কথাও উচ্চারণ করিনি।

পরের দিনও আমাদের মধ্যে আবেগের গুটিকয়েক কথা হয়েছিল। নদীর ঢেউয়ের এপাড় থেকে আমরা প্রেমের দেবতা এরবসকে তুলে আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে স্থান। করে দিয়েছিলাম।

এবার এতদিন পর আমরা উভয়েই উপলব্ধি করেছিলাম প্রেমের দেবতা এরস্‌ আমাদের বুকে পূর্বসূরিদের অগ্নিময় আত্মাকে অত্যুজ্জ্বল দ্যুতিময় করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রায় একশো বছর ধরে সে আবেগ-উচ্ছ্বাস আমাদের বংশের বৈশিষ্ট্যতার সঙ্গে এসে গাঁটছড়া বাঁধল নির্ভেজাল শিল্প না বিলাস, যাতেও আমাদের বংশের নাম ডাক যথেষ্টই ছিল।

একদিন সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল, পুরোপুরি বদলে গেল। কোনোদিন যে সব গাছে ফুল ফোটেনি সে সব গাছে তারার মতো অদ্ভুত উজ্বল ফুল দেখা দিল। সবুজ গালিচার মতো প্রান্তর ক্রমে ঘনতর হতে লাগল। ডেইজি ফুলগুলোর জায়গা দখল করল রক্তিম এসকোডাল। আমাদের জীবন চাঞ্চল্যে ভরে গেল। সে সুবিশাল চক্রবাক পাখি এক সময় চোখেই পড়ত না সেও খুশিতে ডগমগ পাখিদের সঙ্গী করে আমাদের চোখের সামনে পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল। সোনালি আর রূপালি মাছের ঝাঁকে নদীটা ভরে গেল। নদীর বুক থেকে এমন একটা সুর উঠে এসে ঘুম পাড়ানি সুর হয়ে আমার কানে বাজল, যা ইয়োলুস-এর বীণার চেয়ে স্বর্গীয় হয়ে উঠল। কেবলমাত্র ইলিওনোরা-র কণ্ঠস্বর ছাড়া অন্য কোনো সুর এমন মধুর নয়, কিছুতেই নয়। সে মুহূর্তে আমার মনে হল, আমরা বুঝি চিরদিনের জন্য আড়ম্বরপূর্ণ এক যাদুর কারাগারে বন্দিত্ব বরণ করে নিয়েছি।

রূপসি তম্বী যুবতি ইলিওনোরা-র কোমল স্বভাবের তুলনা একমাত্র দেবদূতের সঙ্গেই চলতে পারে। তার অল্পদিনের জীবনটা ফুলের দেশেই কেটেছে বলে সে ছিল সত্যিকারের সহজ-সরলনিষ্কলঙ্ক কুমারি। কোনোরকম ফস্টিনস্টিই তার মনের ভালোবাসাকে ঢেকে রাখতে পারেনি।

বহু বর্ণের ঘাসের গালিচা বিছানো উপত্যকায় বেড়াতে বেড়াতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম, ইদানিং মধুর প্রেম আমাদের দুজনকে কতই না বদলে দিয়েছে। আমরা যেন এখানে নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনো লোকে অবস্থান করেছি।

শেষমেষ একদিন নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে মানুষের জীবনের সর্বশেষ অনিবার্য পরিণতির প্রসঙ্গ উঠল। তারপর সেদিন, সে-মুহূর্ত থেকেই আমাদের যে কোনো প্রসঙ্গের কথাতেই এ বিষয়টা এসে পড়ত।

হায়! সে দেখতে লাগল, তার বুকের ওপর মৃত্যুর নিষ্ঠুর হাতটা তার বুকে চেপে বসেছে। ক্ষণজীবি পতঙ্গের মতো সে সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠেছে, কেবলমাত্র মৃত্যু আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করার জন্য। একটাই উদ্দেশ্য, মৃত্যুর হাতে নিজেকে তুলে দিতেই সে তৈরি হয়ে রয়েছে। মৃত্যুকেও না হয় বুক পেতে নেওয়া যায়, কিন্তু মাটির তলায় আশ্রয় চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া, মানে কবরকে সে খুব ভয় করে।

এক সন্ধ্যায় আলো-আঁধারির মুহূর্তে নিঃশব্দের নদীর তীরে কষ্ট দিচ্ছে যে, সবুজ গালিচা-বিছানো উপত্যকায় তাকে সমাধিস্থ করার পাট চুকিয়েই আমি এ শান্তি সুখের। আবাসস্থল থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেব। আর অন্য কোনো কুমারিকে তার প্রতি । আমার অন্তরের পুঞ্জীভূত প্রেমকে নিবেদন করব।

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই আমি ইলিওনোরা-র পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে তার আর পরম-পিতার নামে শপথ করেছিলাম, পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই আমি পত্নীরূপে গ্রহন করব না। আমার সে পবিত্র শপথের সাক্ষী রইলেন সর্বশক্তির আধার সে পরম পিতা।

তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আমি সে মুহূর্তে এও শপথ করেছিলাম, আমি যদি কোনো পরিস্থিতিতে এ শপথ ভঙ্গ করি, তবে যেন পরম পিতার অভিশাপ আমার মাথায় যেন নেমে আসে।

আমার কথায় ইলিওনোরা-র চোখের তারা দুটো অত্যুজ্বল হয়ে উঠল। সে অকস্মাৎ এমন এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মনে হলো তার বুকের ওপর থেকে পাকাপাকিভাবে অতিকায় একটা পাথর নেমে গেল। তার সর্বাঙ্গ থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল, তা সত্ত্বেও আমার শপথবাক্যকে খুশি মনেই বুকে ঠাই দিল। মৃত্যুশয্যাও ক্রমে তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে এলো।

সে ঘটনার মাত্র কয়দিন পরেই শান্ত-স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়ে সে আমাকে বলল, তার তৃপ্তির জন্য সেদিন আমি যা-কিছু বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে কবরে আশ্রয় নেবার পরও সে প্রতিটা মুহূর্ত আমার ওপর দৃষ্টি রেখে চলবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে রাতে সে অবয়ব ধারণ করে আমার কাছে উপস্থিত হবে। তবে পরলোকগত আত্মার পক্ষে তা যদি নিতান্ত অসম্ভব হয় তবে সে ইঙ্গিতে মাঝে মধ্যেই তার উপস্থিতির কথা জানাবে। তার দীর্ঘশ্বাস সন্ধ্যার বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে আমার দেহকে স্পর্শ করবে, নতুবা আমার প্রশ্বাসের বাতাস সুগন্ধময় করে তুলবে। এ কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতে সেনিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক উৎসর্গ করে দিল।

এভাবেই আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়টার পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। শেষ! সব শেষ!

এ পর্যন্ত আমি যা-কিছু বলেছি সবই বিশ্বস্ততায় ভরপুর, এতটুকুও খাদ নেই।

কিন্তু আমার অন্তরাত্মার মৃত্যু আমার জীবনে যে বিচ্ছেদের প্রাচীর গড়ে তুলেছে তাকে অতিক্রম করে আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রসঙ্গে উত্থাপন করতে গিয়েই আমি অনুমান করছি, আমার মাথার ওপর ঘন কালো একটা ছায়া ঘনিয়ে আসছে আর আমার এ বিবরণীর পূর্ণ সত্যতার ব্যাপারে আমি আস্থাও হারিয়ে ফেলছি।

সে যা-ই হোক না কেন, আমাকে যে মুখবুজে থাকলে চলবে না, আমার যে না বলে উপায় নেই।

আমার আড়ম্বরহীন ক্লান্ত বছরগুলো একটার পর একটা করে পেরিয়ে যেতে লাগল।

আমি তখনও বহু বর্ণের ঘাসের গালিচা বিছানো উপত্যকায় বসবাস করছি। কিন্তু আমার চারদিকের সবকিছুতেই দ্বিতীয় পরিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেউপত্যকার সবুজ ঘাসের গালিচার রং ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে এসেছে। তারা ফুলগুলো আর ফোটে না, গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। রক্তাভ এসকোডেল ঝরে পড়তে পড়তে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কালো চোখের মতো ভায়োলেট ফুলের থোকা তার স্থান দখল করেছে। অতিকায় ফ্লেমিঙ্গো পাখিটা আর আমার চোখের সামনে দিয়ে লোহিত বর্ণের ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় না। সে উপত্যকাটা ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

আর সেই বীণার সুরের চেয়ে মৃদুমন্দ ইয়োলুসের বাতাস–একমাত্র ইলিওনোরার কণ্ঠস্বর আর যাবতীয় সুরের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি স্বর্গীয়, তা-ও ক্রমে মিলিয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হয়ে গেল।

সব শেষে সে ঘন পুঞ্জীভূত মেঘও এক সময় পাহাড়ের শীর্ষদেশগুলোর আশ্রয় ছেড়ে সন্ধ্যাতারার দেশে পাড়ি জমিয়েছে, আর যাবতীয় রূপ-সৌন্দর্যকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।

এতকিছু সত্ত্বেও ইলিওনোরা কিন্তু তার শপথ ভুলে যায়নি। উপত্যকার ওপর দিয়ে পবিত্র সুগন্ধে ভরপুর একটা ঢেউ বয়ে চলল। বহু নির্জন ক্ষণে বহু দীর্ঘশ্বাস বাতাসের সঙ্গে ভর করে আমার দুটোকে স্পর্শ করে যায়। শন শন ধ্বনিতে রাতের বাতাসকে ভরিয়ে তোলে। একটা বার, মাত্র একবার হায়! আর মাত্র একবার! তার দুটো অতীন্দ্রিয় ঠোঁট আমার ঠোঁট দুটোকে স্পর্শ করে আমার মৃত্যুর মতো গভীর ঘুমকে চটিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু হায়! আমার বুকের হাহাকার আর হা-হুঁতাশ মিলিয়ে গিয়ে শূন্যতার তাতেও পূর্ণ হলো না। আমাকে এক সময় যে প্রেম ভাসিয়ে এক অচিন দেশে নিয়ে যেত, সে প্রেম ভালোবাসার জন্য আমি চাঞ্চল্য উপলব্ধি করতে লাগলাম।

শেষপর্যন্ত আমার পরিস্থিতি এমন হলো যে, ইলিওনোরা-র স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে উপত্যকার আশ্রয় আমার কাছে বিষাদক্লিষ্ট হয়ে দাঁড়াল।

অনন্যোপায় হয়ে একদিন বিশ্বের অসার বস্তু আর হৈহুল্লোড়মুখর জয়ের সন্ধানে চিরদিনের জন্য সে উপত্যকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এলাম।

দীর্ঘদিনের পরিচিত পাহাড়, জঙ্গল আর উপত্যকার সম্পর্ক ত্যাগ করে বিচিত্র এক । শহরে এসে মাথা গুঁজলাম। সেখানকার কোলাহলমুখর পরিবেশ, চাকচিক্য আর আনন্দ সূৰ্ত্তি হয়তো আমার মধ্য থেকে উপত্যকার স্বপ্নরাজ্যকে নিঃশেষে মুছে দিতে পারত। রাজ-দরবারের জৌলুস নারীদের সম্মোহিনীরূপ সৌন্দৰ্য্য আমার মন-প্রাণ-যাবতীয় সড়াকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলল। তবে আমার মন কিন্তু তখন অবধি তার শপথের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে চলেছে। তখনও রাতের অন্ধকারে, নিস্তব্ধতায় ইলিওনোরার উপস্থিতির ইঙ্গিত অনুভব করে চলেছি।

অকস্মাৎ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। আমার চোখের সামনের পৃথিবীটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। সে জ্বালাময়ী চিন্তা-ভাবনা আর ভয়ঙ্কর প্রলোভন আমাকে চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরল। তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে আমি আতঙ্কে মুষড়ে পড়লাম।

ব দূর, বহু দূরবর্তী এক অজানা অচেনা দেশ থেকে এক রূপসি যুবতি আমার দরজায় উপস্থিত হল। ব্যস, আমার ভীরু মন-প্রাণ সে মুহূর্তেই তার রূপের ডালির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দিলাম।

হ্যাঁ, সত্যি বলছি, ভালোবাসার এক আকুল লঘু ও ঘৃণ্য পূজার আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে বিনাসংগ্রামে আমি তার চরণকমলে আত্মনিবেদন করে বসলাম।

হ্যাঁ, আমি তাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধলাম। আমি শপথ ভঙ্গের সে নির্মম অভিসম্পাত নিজে বেঁচে মাথায় পেতে নিয়েছিলাম, তাকেও পরোয়া করলাম না। তবে এও সত্য যে, আমার মাথায় কিন্তু অভিশাপ নেমে আসেনি।

আরও মাত্র একবার–এবার রাতের অন্ধকারে নিঝুম-নিস্তব্ধতায়–আমার জাফরির ফাঁক-ফোকড় দিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো যা আমাকে ভুলেছিল। সে দীর্ঘশ্বাস যেন কণ্ঠস্বরে পরিণত হল। সুপরিচিত মিষ্টি-মধুর স্বরে বলল, ঘুমোও শান্তিতে ঘুমোও। ব্যাপারটা এমন যে প্রেমের দেবতাই রাজ্য চালায়, তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে রাজ্যের প্রতিটা কাজকর্ম চলে। তোমার অন্তরের প্রেমের মধ্যে এই মেগার্ড নামের মেয়েটাকে তুমি আপন করে নিয়েছ, ভালোবেসেছ। তারই মাধ্যমে ইলিওনোরার কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা থেকে তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ। কেন! কেন মুক্তি পেয়েছ তা অমরালোকে তোমাকে জানানো হবে, এখানে নয়–এখন নয়।

উইলিয়াম উইলসন

উইলিয়াম উইলসন!

হ্যাঁ, এখনকার মতো মনে করা যাক, উইলিয়াম উইলসন আমার নাম।

এ মুহূর্তে আমার সামনে যে সাদা পাতাটা রয়েছে সেটার গায়ে আমার প্রকৃত নামটাকে লিখে কলঙ্কিত করার কিছুমাত্র আগ্রহও আমার নেই। আর সে নামটা তো আমার পরিবারের সদস্যদের চোখে অনেক অবজ্ঞা, অনেক বিতৃষ্ণা আর অনেক ভীতি সৃষ্টি করেছে। ক্রুদ্ধ বাতাস কি এসব অতুলনীয় অখ্যাতিকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি।

হায় কী যে মারাত্মক, অবর্ণনীয় জাতিচ্যুৎ। সবার দ্বারা আমাকে পরিত্যক্ত হতে হয়েছে। পৃথিবীর আপামর জনগণের চোখে কি আজ তোমার পরিচয় মৃত জন নয়? তুমি কি মৃত বলে পরিচিত নও? পৃথিবীর মান সম্মান, রঙ-বেরঙের ফুলের মেলা আর রঙিন মুখ-স্বপ্ন থেকে কি তুমি নির্মমভাবে নির্বাসিত নও? ঘন কালো এক টুকরো জমাট-বাঁধা মেঘ কি তোমার বাসনা আর স্বর্গের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর সৃষ্টি করে না? হায়! আজ তুমি সবকিছু থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত।

আজ যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত তবে আমার জীবনের শেষ অবর্ণনীয় দুঃখ যন্ত্রণা আর অক্ষমতা-অযোগ্যতার অপরাধের কাহিনী লেখনির মাধ্যমে আজই এখানে। তুলে ধরতে উৎসাহি হতাম না।

আমার জীবনের এ পর্যায়টা শেষের দিককার বছরগুলো মতো খুব বেশি রকম চাঙা করে দিয়েছিল।

এ মুহূর্তে আমার লক্ষ্য একটাই, আমার নীতিচ্যুত হওয়ার প্রথম দিকের ঘটনাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ সাধারণত তিলে তিলে ধাপে ধাপে নিচে নামতে আরম্ভ করে, খুবই ধীরগতিতে অবনতির পথে এগিয়ে যায়, তাই না? আমার ক্ষেত্রে কিন্তু অবনতির ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার মধ্য থেকে সৎগুণাবলী একেবারে হঠাই বিচ্যুত হয়ে যায়।

খুবই নগণ্য একটা দুষ্টুমি থেকে আমি যেন দৈত্যের মতো ইয়া লম্বা একটা লাফ দিয়ে আকাশে পৌঁছাতে পারি।

হঠাৎ একেবারে হঠাই কিভাবে একটামাত্র ঘটনার মাধ্যমে চরমতম পাপ কর্মে ব্রতী হলাম–পরিণত হয়ে গেলাম জঘন্যতম পাপীতে, তা আমার বক্তব্য থেকেই

অবগত হওয়া যাবে।

মৃত্যু! নির্মম ও নিষ্ঠুর। মৃত্যু আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের ছায়া আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। একেবারেই অন্তিম মুহূর্ত।

নিতান্তই অজানা-অচেনা এ পথে পা-বাড়াবার পূর্বে আমি স্বাভাবিকভাবেই বন্ধু বান্ধবদের সহানুভূতির প্রত্যাশী হয়ে পড়লাম। তাদের কৃপার প্রত্যাশী বলতেও আমি কিছুমাত্রও কুণ্ঠিত নই।

সে মুহূর্তে আমার একটাই ইচ্ছা, আত্মজনরা জানুক এবং বিশ্বাস করুক, মানুষের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এরকম একটা ঘটনার জালে জড়িয়ে আমি নিছকই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমার একান্ত আগ্রহ, যে কাহিনী আমি রচনা করে চলেছি সেটা পড়ে সবাই জানুক, মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করুক, মানুষ যতই বড় প্রলোভনের ফাঁদে পা দিক না কেন, ইতিপর্বে কেউই এমন অসহায়ভাবে প্রলোভনের খপ্পরে পড়েনি। জীবনে এমন অভাবনীয় পতন ঘটেনি। তাই যদি হয়, তবে এজন্যই আমার মতো আর কোনো মানুষ, কোনোদিনই আমার মতো এমন দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার হয়ে তিলে তিলে দগ্ধে মরেনি?

সত্যি কি আমি এক স্বপ্নের ঘোরে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাইনি? পার্থিব জগতের উন্মাদনা সঞ্চারকারী দৃশ্য দেখার ভয় ভীতি আর রহস্যের ফাঁদে পড়েই আমার মৃত্যু আসন্ন হয়ে ওঠেনি?

আমি যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছি, অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষদের অনেকেই কল্পনার মাধ্যমে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করতে এবং উত্তেজনার শিকার হয়ে হঠাৎ-হঠাৎ কাজ করে বসতেই উৎসাহি ছিলেন। আমি কিন্তু বাল্যকালেই পূর্বসূরীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক নজির সৃষ্টি করেছি।

আমার বয়স আর গায়ে গতরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেসব প্রবণতাও উত্তরোত্তর বেড়েই গেছে। আর সে প্রবণতা বিভিন্নভাবে আমার বন্ধুবান্ধব আর সে সঙ্গে আমার নিজের অনিষ্টই ডেকে এনেছে।

উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গুণাবলী আমাকে ক্রমেই খুব বেশি রকম স্বেচ্ছাচারী, পরপীড়ক আর অসংযত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলল।

আমার মতোই শারীরিক অক্ষমতা আর দুর্বল মানসিকতার জন্যই আমার বাবা-মা। চারিত্রিক বিয়গুলোকে সামলে রাখতে সক্ষম হননি। সে রকম কোনো কাজে তারা যখনই উৎসাহি হয়ে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখনই তারা নির্মমভাবে পরাজয় স্বীকার করেছেন। তবে আমি কিন্তু পরাজিত তো হইনি বরং সর্বতোভাবে জয়ী হয়েছি।

আমার পরিবারের সবার ওপর উত্তরোত্তর সাফল্য আমার কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে। আর এরই ফলে আমার প্রবর্তিত বিধানই পরিবারের কাছে আইন বলে গণ্য হয়েছে, অর্থাৎ এক বাক্যে আমার কর্তৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছে। ব্যস, আর কথা নয়, সে-বয়স থেকেই আমি হয়ে উঠলাম আমার সর্বময় কর্তা, নিজেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্তা।

এলিজাবেথের যুগের একটা পুরনো বাড়ির ছবি আমার বিদ্যালয় জীবনের প্রথম স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেটা ইংল্যান্ডের কুয়াশার চাদরে মোড়া এক গ্রাম্য পরিবেশে অবস্থিত। স্বীকার না করে পারছি না। পুরনো সে শহরটা আমার যথার্থই এক স্বপ্নরাজ্য, একটা শান্তি-সুখের আধার হিসেবে গণ্য হত।

সে বাড়িটা যে গ্রাম্য পরিবেশের নিছকই সাদামাটা একটা বাড়ি তা তো আগেই বলেছি। আরও কিছু বলতে গেলে সেটা ছিল একেবারেই অপরিকল্পিত ও রীতিমত অগোছালো। বাড়িটায় যতগুলো ঘর ছিল তার মধ্যে পড়াশুনার ঘরটাই সবচেয়ে বড় ছিল। সেটাই ছিল আমাদের পাঠশালা আর বাড়ি।

সে পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িটার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ঘরয় ছিল অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্র্যানসবিরের থাকার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ছাত্র জীবনের স্মৃতি আর কিই বা থাকতে পারে? সেই কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে ওঠা, চেঁচিয়ে পড়া মুখস্ত করা রাতে ঘণ্টার শব্দ হলে ঘুমিয়ে পড়া, সাময়িক অধছুটি ভোগ করা, মানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো আর খেলতে গিয়ে মাঠে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি আর পরস্পরের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, মন কষাকষি আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা–ব্যস। কিন্তু সে ঘটনার স্মৃতি করেই আমার মধ্যে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

তবুও একটা ব্যাপার আমার স্মৃতিতে আজও ছবির মতো স্পষ্ট আঁকা হয়ে রয়েছে। আমার প্রভুত্ব, আবেগ-উচ্ছ্বাস আর অত্যুৎসাহী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমি সহজেই স্কুলের বন্ধু, বিশেষ করে সহপাঠিদের নজর কেড়ে নিলাম। আর এরই জন্য অচিরেই সমবয়ী বন্ধুদের নেতা বনে গেলাম। তবে একজন বাদে। কে সে? সে ছাত্রটা আমার আত্মীয় ছিল না। অথচ তার নাম আর পদবী আর আমার নাম আর পদবী একই ছিল। তাই অন্য উপায় না থাকাতে আমি এ কাহিনীতে নিজের নাম ব্যবহার করেছি উইলিয়াম উইলসন। আর পদবীটা কল্পনা প্রসূত হলেও আমার আসল পদবীর কাছাকাছিই ছিল।

স্কুলের ব্যবহৃত ভাষায় যাকে ‘দল অর্থাৎ আমাদের দল’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে তাদের মধ্যে কেবলমাত্র সে ছাত্রটাই, নামের ব্যাপারে যাকে আমার মিতা বলা যেতে পারে, পড়াশুনার ক্ষেত্রে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, খেলার মাঠেও অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সে আমার সব আদেশ অবলীলাক্রমে মেনেনিত না, আমার ইচ্ছার কাছেও নতি স্বীকার করত না।

প্রকৃতপক্ষে আমার নামের নামধারী ছাত্রটা সবক্ষেত্রে আমার জোর জুলুমের প্রতিবাদ করত, প্রবল বিরোধিতা করত। মাঝে মধ্যে কিশোর ছাত্রদের সর্দারি করতে গিয়ে আমি চরম ও নিঃশর্ত স্বেচ্ছাচার চালাতাম।

আমার স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সহপাঠী উইলসনের বিরোধিতাই আমার কাছে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। অসহ্য! একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতাম না।

একটা কথা অস্বীকার করতে পারব না, আমি বাইরে যত হম্বিতম্বি করি না কেন ভেতরে ভেতরে কিন্তু তাকে ভয়ই পেতাম। আর এও সত্য যে, আমি তাকে সমকক্ষ বলেই ভাবতাম, হয়তো বা আমার চেয়ে বড়ও মনে করতাম। তবে এও খুবই সত্য যে, এই যে ‘সমকক্ষ বা আমার চেয়ে ‘বড়’ এ-কথাটাকে একমাত্র আমি নিজে ছাড়া দলের দ্বিতীয় কেউই কিছুতেই মেনে নিত না। তবে এও খুবই সত্য যে, উইলসন নিজের কিন্তু বড় একটা উচ্চাভিলাষী বা আগ্রহি যে ছিল তা বলা যায় না।

সে অন্য দশজনের কাছে মুখে যা-ই বলুক বা যা-ই করুক না কেন, অন্তরের অন্তঃস্থলে কিন্তু আমার প্রতি অব্যক্ত একটা আকর্ষণ অনুভব করত।

আমার সহধ্যায়ী উইলসনের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, উভয়ের একই নামকরণ আর একই দিনে উভয়েরই স্কুলে ভর্তি হবার ঘটনা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একটা বিশ্বাসের দানা বেঁধেছিল যে আমরা দুই সহোদর। এ-বিশ্বাসটা আদৌ সত্যি নয়। কিন্তু আমরা যদি সত্যি সহোদর হতাম তবে অবশ্যই যমজ ভাইই হতাম।

‘যমজ ভাই’ কথাটা কেন বললাম? এর পিছনে যুক্তি অবশ্যই আছে। কারণ, অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্রাসরির স্কুলের পাঠ শেষ করে সবাই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর ঘটনাচক্রে আমি জানতে পেরেছিলাম, আমার নামের নামধারী সহপাঠী বন্ধুটা জন্মেছিল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি। আর ঠিক একই বছরে, একই তারিখে আমিও প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম।

একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, উইলসনের নিরবচ্ছিন্ন রেষারেষি আর প্রতিবাদের ফলে আমাকে বড়ই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হত সত্য বটে। তা সত্ত্বেও তাকে সম্পূর্ণরূপে ঘৃণা করা। অর্থাৎ মনে প্রবল। বিদ্বেষ পোষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কথাটা অবাক হবার মতো মনে হলেও এটাই ছিল প্রকৃত ব্যাপার।

কেন? কেন এমন কথা বলছি? কারণ, প্রায় রোজই তার সঙ্গে কোনো-না-কোনো ব্যাপারে আমার ঝগড়া বাঁধতই বাধত। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে কিন্তু বাক্যালাপ বন্ধ হত না। সমানে সমানেই লড়াই চলত। তবে একটা ব্যাপারে সে অন্তরের গভীরে দুর্বলতা পোষণ করত।

কোনো দীর্ঘরোগ ভোগের দরুণ হয়তো তার কণ্ঠনালিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যার ফলে সে তার কণ্ঠস্বর কিছুতেই করতে পারত না। কথা বললে কেবলমাত্র ফিসফিস শব্দসহ স্বর উচ্চারিত হত। তবে তার বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হত না, ব্যস এটুকুই। আমি তার এ দৈহিক দুর্বলতার সুযোগটা নিতে ছাড়তাম না। এ ব্যাপারে সে ছিল সত্যি অসহায়। সত্যি বলছি, আসলে আমি তার অসহায়ত্বটাকেই কাজে লাগাতাম।

আমার ওপর বদলা নেবার জন্য উইলসন চিন্তা-ভাবনা করে মাথা থেকে হরেক রকম উপায় বের করত। আর সেগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করে আমাকে ঘায়েল করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যেত। তবে সেগুলোর মধ্যে একটা রসিকতা সে প্রায়ই ব্যবহার করে আমাকে যারপর নাই ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। সত্যি, আমি তাতে বড়ই বিব্রত হয়ে পড়তাম। আমি যে অতি নগণ্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটা কারণে এমন বেশিমাত্রায় বিব্রত হব, রেগে মেগে একেবারে আগুন হয়ে যাব, এটা সে যে কি করে মাথা খাঁটিয়ে বের করেছে, তা আজও আমার পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার পৈত্রিক নামটার প্রতি আমার প্রথম থেকে, মনে জ্ঞান হওয়া অবধি একটা বিতৃষ্ণা অন্তরে পোষণ করে আসছিলাম। নামটার চেয়ে অনেক, অনেক বেশিমাত্রায় বিতৃষ্ণা ছিল আমার নামের আগে ব্যবহৃত পদবীটার প্রতি। সে শব্দগুলো ব্যবহার করে আমাকে সম্বোধন করল, ক্রমশ আমার সামনে যে কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করা মাত্র মনে হত কানে বুঝি বিষ ঢেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আমার মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার ঘটত। আমি ক্রোধে রীতিমত ফুঁসতে লাগলাম। সে কারণেই, আমি যেদিন ভর্তি হওয়ার জন্য প্রথম স্কুলে পা দিলাম সেদিন, সে মুহূর্তে দ্বিতীয় এক উইলিয়াম উইলসনও সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমার ভেতরে অবর্ণনীয় ক্রোধের সঞ্চার ঘটল। অব্যক্ত ক্রোধে আমি ভেতরে ভেতরে ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগলাম।

আমি কেন সেদিন এমন ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম? আমার ক্রোধের কারণ তো অবশ্যই ছিল। নামটার প্রতি গোড়া থেকেই যে আমার বিরক্তি ছিল, তা-তো আগেই বলেছি। তাই বিরক্তিকর নামটার অধিকারী আমি স্কুলে পা দিয়েই যখন সেখানে অন্য আর এক উইলিয়াম উইলসনের উপস্থিতি উপলব্ধি করলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায় একটা ব্যাপার ঘুরপাক খেতে লাগল–‘নাম বিভ্রাট’-এর জন্যই একজনের সুনাম বদনামের বোঝা অন্য একজনের ঘাড়ে এসে পড়বে।

তখনও অর্থাৎ স্কুল-জীবনের প্রথম দিন আমার মাথায় আসেনি, আসবেই বা কি করে যে, আমরা উভয়েই সমান বয়স্ক, একই দৈহিক উচ্চতাবিশিষ্ট, আর চোখ, মুখ আর নাকের দিক থেকেও আমাদের মধ্যে যারপরনাই সাদৃশ্য বর্তমান। আর দৈহিক গঠন বৈশিষ্টের দিক থেকেও আমরা উভয়ে অবিকল একই রকম।

তখন কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা ভাবতে পারিনি। আর প্রথম দর্শনেই এমন একটা ভাবনা তো কারো মাথায় আসারও কথা নয়। কি সে ব্যাপার, তাই না? ঠিক আছে খোলসা করেই বলছি–আমাদের উভয়ের নাম পদবী আর দৈহিক সাদৃশ্যের ব্যাপারটাকে সে যে ভবিষ্যতে আমাকে ঘায়েল মানে বিরক্ত ও অতিষ্ট করে তোলার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এরকম তিলমাত্র আশঙ্কাও আমার মনে জাগেনি।

সে ‘মোক্ষম অস্ত্রটা কি ছিল? অবিকল একটা ‘দ্বিতীয় আমি তার নাম-পদবী থেকে শুরু করেনিখুঁত দৈহিক বৈচিত্র্য পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যেই বিরাজ করছিলাম। হ্যাঁ, এটাকেই সে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে নিয়েছিল। কেবল পদবী আর দৈহিক গঠন বৈচিত্র্যের কথাই বা বলি কেন? এমনকি কথা বলার ধরণ-ধারণ তার কাজকর্ম করার পদ্ধতির দিক থেকেও আমাদের মধ্যে কম-বেশি মিল থাকলেও সেনিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন চালিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাকিটুকু রপ্ত করে যেটুকু ঘাটতি ছিল পূরণ করেনিল।

আর পোশাক আশাকের ব্যাপারটা? হুবহু একই রকম পোশাক ব্যবহার করা তো খুবই মামুলি ব্যাপার। অল্পায়াসেই সে সমস্যার সমাধান করে নেওয়া তো কোনো সমস্যাই নয়।

আর চলাফেরার যৎকিঞ্চিৎ বৈসাদৃশ্য যেটুকু ছিল অনুশীলনের মাধ্যমে দুদিনেই আয়ত্ব করেনিল। এবার সবশেষে সে নজর দিল কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটার দিকে। কণ্ঠস্বরকে অনুকরণ করতে এতটুকুও চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সে নিজের ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরকে অনুশীলনের মাধ্যমে কি করে আমার মতো ভরাট কণ্ঠস্বরে পরিণত করল? হ্যাঁ, এরকম জিজ্ঞাসা জাগা স্বাভাবিক। ব্যাপারটা হচ্ছে, সে কিন্তু তার ভরাট গলার কণ্ঠস্বরকে আমার মতো উচ্চস্বরে তোলার জন্য তিলমাত্র চেষ্টাও করল না। যা করতে চেয়েছিল তা কিন্তু ঠিকই সেরে ফেলল। তার বিশেষ। কণ্ঠস্বর–নিচু স্বরের ফ্যাসফ্যাসে শব্দটা যেন অবিকল আমার কণ্ঠস্বরকেই প্রতিধ্বনিতে পরিণত করে ফেলল। তার এ অত্যাশ্চর্য-অদ্ভুত ক্ষমতাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা। আমার অন্তত নেই।

উইলিয়াম উইলসন আমাকে সব দিক থেকে হুবহু নকল করে, অভিনয়ের মাধ্যমে আমাকেনিখুঁতভাবে নকল করার কাজটাকে এমন অভাবনীয়ভাবে সম্পন্ন করত, যা দেখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠত। সে মুহূর্তে অন্তত আমি কিছুতেই তাকে বরদাস্ত করতে পারতাম না। অস্বীকার করব না, তখন আমার মনে হত দৌড়ে গিয়ে তাকে চিবিয়ে খেলেও বুঝি তার ওপরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারব না।

এতকিছু সত্ত্বেও আমার একটা সান্ত্বনা অবশ্যই ছিল। সেটা কি? তার এ অদ্ভুত অভিনয়টা কেবলমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই হৃদয়ঙ্গম করে মজা লুটতে পারত না।

আরও আছে। নিজে সফল অভিনয়ের ফলে তার ঠোঁটে–চোখে-মুখে ব্যঙ্গের হাসি প্রকট হয়ে উঠত, একমাত্র আমিই সেটা বুঝতে পারতাম। দাঁত কিড়মিড় করে নীরবে হজম করে নিতাম। তবে স্কুলে অন্য কোনো ছাত্রই তার বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারত না। আর সেই কারণেই তার সঙ্গে যোগ দিয়ে কেউ আমাকে নিয়ে বিদ্রুপে মেতে উঠত না।

বহুদিন ধরে বহু চেষ্টা করেও এ অসহনীয় রহস্যটা ভেদ করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। ফলে নিতান্ত অসহায়ভাবে এ-কুটিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আমাকে মুখ বুজে হজম করতেই হয়েছে।

দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তার পর আজ আমার যতদূর মনে পড়ছে, তখন তার সঙ্গে আমার জোর বাকযুদ্ধ–কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি এমনই ক্ষেপে গিয়েছিলাম যে, গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে তাকে ঘা-কতক বসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আমি গায়ে হাত দেওয়ায় সে ক্রোধে একেবারে ফেটে পড়ার যোগাড় হল। এমন একটা ব্যাপার তার কাছে বাস্তবিকই অপ্রত্যাশিত ছিল। ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে সে রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে এমনকিছু কটুক্তি করল আর এমনকিছু কথা–গালমন্দ করল যা নিতান্তই তার স্বভাববিরুদ্ধ। তার আচরণে আমি যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি সে মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। সে এ ব্যাপারে মুখে কিছু না বললেও তার আচার ব্যবহারের মাধ্যমে আমি ঠিকই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

তবে একটাই সান্ত্বনা যে, ঘটনাটা আর বেশিদূর গড়ায়নি, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়াও লক্ষিত হয়নি।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আমার বিশ্বাস পুরনো বাড়িটায় ছোট-বড় অনেকগুলো ঘর ছিল, তাদেরই একটা ছিল খুবই বড়-সড়, যাকে আমরা হলঘর বলতাম। হলটার লাগোয়া কতকগুলো ছোট ছোট ঘরটায় পড়ুয়াদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিছুসংখ্যক ছাত্র ওই ঘরগুলোতেই থাকত।

আর অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসোবির থাকার ঘরটার কথা তো আগেই বলেছি–বাড়িটার এক্কেবারে শেষ প্রান্তের পায়রার খোপের মতো একটা ছোট্ট ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। আবার বড় হলো ঘরটাতেই অধিকাংশ থাকত। আর উইলিয়াম উইলসনের থাকার ব্যবস্থা ছিল হলঘরটার লাগোয়া ছোট ছোট ঘরগুলোর একটাতে।

একটু আগে যে উইলিয়াম উইলসনের গায়ে হাত দেবার ঘটনার উল্লেখ করেছি, সে ঘটনার ঠিক পর পরই, আমার স্কুলে ভর্তির ঠিক পাঁচ বছরের শেষার্ধের এক রাতের কথা বলছি। আমি তক্কে তক্কে ছিলাম, বাড়ির অন্য সব ছাত্ররা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে একেবারে পা টিপে টিপে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আগের মতোই সন্তর্পণে বারান্দাটা পেরিয়ে উইলিয়াম উইলসনের শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উত্তর্ণ হয়ে লক্ষ্য করলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি জেগে আছ? মোটামুটি নিঃসন্দেহ হলাম, ঘুমিয়েই পড়েছে। এবার দরজায় মৃদু আঘাত করলাম। না, ভেতর থেকে কোনো শব্দই ভেসে এলো না। সে যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে এ ব্যাপারে আমার মনে আর সামান্যতম সন্দেহই রইল না।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

সত্যি কথা বলতে কি, একটা কূটবুদ্ধির খেলায় তাকে ঘায়েল করে তৃপ্তি লাভের প্রত্যাশা বুকে নিয়ে উপযুক্ত সুযোগের প্রত্যাশায় তক্কে তক্কে ছিলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার। পর এবার বাঞ্ছিত সে মওকাটা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম।

আমি খুবই সন্তর্পণে, যাকে বলে অবিকল বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তাকের ওপরে রক্ষিত জ্বলন্ত বাতিটাকে চাপা দিয়ে আবার একই রকম সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঢাকা দেওয়া বাতিটাকে বাইরে রেখে দিয়ে আবার ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

দুপা এগিয়ে আমি একেবারে তার চৌকিটা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে একটু উৎকর্ণ হয়ে তার নিশ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করলাম।

সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হলাম, সে সত্যি সত্যি গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে।

ঘর থেকে আবার বেরিয়ে বাতিটা হাতে করে আবার ঘরের ভেতরে গেলাম। মশারি টাঙিয়ে সে শুয়েছিল। সেটা ফেলাই রয়েছে।

মশারিটা সামান্য ফাঁক করে বাতিটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিতেই উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা তার ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়ল। আমি অপলক চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।

মুহূর্তের একটা অভাবনীয় অসাড়তা, বরফের মতো ঠাণ্ডা ভাব যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলল। সত্যিকারের অভাবনীয় একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি।

কেবলমাত্র আমার বুকের ভেতরে যে ধুকপুকানিই শুরু হয়ে গেছে তা-ই নয়, হাঁপরের মতো বুকটা বার বার ওঠানামা করতে লাগল। আর হাঁটু দুটোও থর থর করে। কাঁপতে আরম্ভ করে দিল। কী যে অত্যাশ্চর্য রীতিমত অকল্পনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি হলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা মোটেই সম্ভব নয়। অহেতুক একটা আতঙ্ক আমাকে যেন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল।

আমি আরও অনেক, অনেক বেশি মাত্রায় হাঁপাতে আরম্ভ করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতেই আমি মোহমুগ্ধের মতো জ্বলন্ত আলোটাকে তার আরও কাছে নামিয়ে নিলাম।

আমি একেবারে হঠাৎই সচকিত হয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। বুকের ঢিবঢিবানিটা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল।

কে? কে এটা? উইলিয়াম উইলসন? এটা কি উইলিয়াম উইলসনেরই মুখ? আমার চোখের সামনে কে শুয়ে রয়েছে।

হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই দেখলাম। সত্যি সত্যি উইলিয়ামই বটে। কেন আমার মন এমন বিপরীত ভাবনার শিকার হয়ে গেল–কিভাবে? কেনই বা অসহ্য আতঙ্কে ভরে উঠল? অব্যক্ত তীব্র যন্ত্রণায় আমি যেন কেমন কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।

কেন? কেন? কেন আমার মন এমন অকল্পনীয় আতঙ্কে ভরে উঠল? এমনকি রয়েছে তার মুখে যা আমাকে এতটা বিচলিত আতঙ্কিত করে তুলল?

ভাবলাম, হয়তো বা চোখ আর মনের ভুলের জন্যই আমি এমন একটা অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। আবারও তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগল। কিছুটা সময় এলোমেলো হরেক রকমের চিন্তা আমার মাথায় আশ্রয় নিয়েছে। মাথাটা বার বারই চক্কর মেরে উঠতে লাগল। আর কানের ভেতরে শুরু হলো দদপানি।

হায় ঈশ্বর! এ কী দেখছি! এ আমি কাকে দেখছি! কিন্তু জাগ্রত আমার উইলিয়াম উইলসন তো এমনটা দেখতে নয়, কিছুতেই নয়। তবে? তবে চোখের সামনে এ আমি কাকে দেখছি! একই নাম-পদবী! একই দৈহিক গঠন! তারপর দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে আমার চালচলন অনুকরণ। নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগের মাধ্যমে আমার আচরণ আর স্বভাব নিখুঁতভাবে নকল করা–এ কী রক্ত-মাংসে গড়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? এই মাত্র চোখের সামনে যা চাক্ষুষ করলাম, তা কি তবে এ ব্যাঙ্গাত্মক অনুকরণের, নিরবচ্ছিন্ন অনুকরণের ফল ছাড়া কিছু নয়?

আতঙ্কে বার বার শিউরে উঠে ফুঁ দিয়ে হাতের বাতিটাকেনিভিয়ে দিলাম।

অসহ্য! রীতিমত অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় আমার মধ্যে অসহনীয় অস্থিরতা ভর করল। আর এক মুহূর্তও পুরনো পাঠশালা-বাড়িটায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।

আমি আগের চেয়েও সন্তর্পণে নিঃশব্দে তার ঘরটা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সদর দরজার বাইরে চলে এলাম।

আর কোনোদিন, একটা মুহূর্তের জন্যও আমি সে বাড়িটার ভেতরে ঢুকিনি। আমাকে জোর করেও কেউ আর সেখানে পাঠাতে পারেনি। অলসতা, শুধুমাত্র অলসভাবে শুয়ে বসে আরও মাসকয়েক আমি বাড়িতেই কাটিয়ে দিলাম।

তারপর ইনটন-এর স্কুলের খাতায় নাম লেখালাম। সেখানে নতুন করে পাঠাভ্যাস চালাতে লাগলাম।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমার মন থেকে অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডাঃ ব্র্যানসবির পাঠশালার অবাঞ্ছিত ঘটনার স্মৃতি অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর সে নাটকের সে দৃশ্যটার চিহ্নমাত্রও আমার মনে আর অবশিষ্ট থাকল না। পুরো ব্যাপারটাকেই আমি সাময়িক চোখ ও মনের ভুল বলেই ধরে নিলাম। তাই তার লেশমাত্রও আর মনের গভীরে টিকে থাকার কথাও নয়।

তারপর শোচনীয় স্বেচ্ছাচার আমার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গি করে নিলাম। স্কুলের প্রচলিত নিয়ম কানুন, কড়াদৃষ্টিকে কিছুমাত্রও আমল না দিয়ে চলতে লাগলাম। আমার তখনকার আচরণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা আর করলাম না। আর সে বিবরণ দিতে গেলে রীতিমত একটা পুস্তিকা তৈরি হয়ে যাবে। অতএব ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই সব দিক থেকে মঙ্গল।

সত্যি কথা বলতে কি, তিন-তিনটা বছরের বোকামির ফলে ফায়দা কিছুই হলো না। যা পেলাম তা হলো কেবলমাত্র কিছু পাপ কর্মের পাকাপাকি অভ্যাস।

একটা সপ্তাহ ধরে দৈহিক ভ্রষ্টাচারের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে একদিন আমি একদল চরম বখাটে ছাত্রকে আমার ঘরে ডেকে নিয়ে এলাম। উদ্দেশ্য, তাদের নিয়ে গোপনে কিছু আনন্দ-ফুর্তি করে মনটাকে একটু চাঙা করে নেয়া।

তারা আমার ঘরে একটু বেশি রাতেই হাজির হল। আলোচনার মাধ্যমে আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম, ভোর পর্যন্ত সবাই হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে থাকব।

আমরা অফুরন্ত উন্মাদনায় মত্ত হয়ে একের পর এক মদের বোতল খুলে গলায় ঢালতে লাগলাম। কেবলমাত্র যে গলা পর্যন্ত মদ গিলেই আমরা সেদিন ক্ষান্ত দিয়েছিলাম তাই নয়। সে আরও বহুরকম মারাত্মক বিপজ্জনক প্রলোভন তো ছিলই। ফলে ভোরের আলো যখন একটু একটু করে ফুটতে শুরু করল তখন আমাদের আনন্দ-ফুর্তি চরম রূপ ধারণ করল।

তখন মদ আর তাসের নেশায় একেবারে বদ্ধ উন্মাদ বনে গেছি। আর কারণে অকারণে একে ওকে অনবরত অকথ্য গালিগালাজ করে চলেছি। আমাদের, বিশেষ করে আমার মুখে যেন খই ফোঁটার মতো খিস্তি বেরোতে আরম্ভ করল।

আচমকা ঘরের দরজার পাল্লা দুটো সামান্য ফাঁক হল। পরিচারকের কথা শুনতে পেলাম। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই সে বলল, কে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। জরুরি দরকার। হলঘরে অপেক্ষা করছে।

মদের নেশায় আমার মধ্যে তখন উন্মত্ততা জাগিয়ে তুলেছে। ফলে হঠাৎ মজা লোটার বাধা পড়ায় অবাক না হয়ে আমি বরং আনন্দিতই হলাম।

চাকরের তলব পেয়েই আমি মদের ঘোরে টলমল শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে হলঘরের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

সামান্য এগিয়েই বাড়ির বারান্দার লাগোয়া ঘরটার দরজায় হাজির হলাম। ঘরটা ছোট্ট। ফলে জানালা দিয়ে সবে ভোরের আলো ফুটে ওঠা হালকা আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো বাতির আলো ছিল না। তাই ঘরটা প্রায় অন্ধকারই ছিল।

আমি টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে দরজার চৌকাঠের গায়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই চোখে পড়ল আমার মতোই লম্বাটে এক কিশোরের মূর্তি ঘরটার ভেতরে অবস্থান করছে। তার পরনে একটা সাদা ফ্র। তখন আমার পরনে যেমন জামা ছিল, ঠিক সেরকমই একটা ফ্রক আগুন্তুক কিশোরটা ব্যবহার করেছে। ভোরের হালকা আলোয় এটুকু কোনোরকমে দেখতে-বুঝতে পারলাম। কিন্তু ক্ষীণ আলোয় তার মুখটা ভালো দেখতে পেলাম না। আমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরের ভেতরে পা দিতেই সে ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে খুবই অস্থিরভাবে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল।

আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আগন্তুক কিশোরের মূর্তিটা একেবারে যন্ত্রচালিতের মতো নিজের মুখটাকে আমার কানের কাছে নিয়ে এসে অনুচ্চকণ্ঠে, একেবারই ফিসফিসানির স্বরে বলে উঠল–‘উইলিয়াম উইলিয়াম!

আকস্মিক চাবুক খেয়ে আমি যেন মুহূর্তের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সচকিত হয়ে ঝট করে একেবারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

অপরিচিত আগন্তুকের চালচলন দেখে আর যেভাবে সে আমার চোখ দুটো আর আলোর মধ্যবর্তী স্থানে তর্জনি তুলে বার বার নাড়াতে লাগল তা লক্ষ্য করে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। আমি যেন মুহূর্তে বাশক্তি হারিয়ে ফেললাম। কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিল না।

খুবই সত্য যে, কেবলমাত্র এটাই কিন্তু আমাকে এমন অভাবনীয় বিচলিত করে তোলেনি। তবে? তার সে অত্যাশ্চর্য রকমের হিস্ হিস্ করে বলা শব্দ দুটোর মধ্যে যেন এক গোপন তাৎপর্যপূর্ণ ভর্ৎসনার সুর বাজছিল। সবার ওপরে ওই দুটো সহজ সরল শব্দ, সুপরিচিত অথচ অনুচ্চ-অস্পষ্ট স্বরে বলা কথার বৈশিষ্ট্য আর বক্তব্য আমার ভেতরে অতীতের বহু, বহু স্মৃতিকে মুহর্তে মনের গভীরে জাগিয়ে তুলল। আমার অন্তরাত্মায় তীব্র খোঁচা মেরে সচকিত করে তুলল।

আমি যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। চোখ আর কানকে নতুন করে পুরোপুরি সজাগ করতে পারলাম তখন দেখলাম, কামরার মধ্যে সে অনুপস্থিত–উধাও হয়ে গেছে। চোখের ভুল ভেবে সাধ্যমত অনুসন্ধিৎসু চোখে ঘরটার সর্বত্র তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি সে যেন কর্পূরের মতোই উবে গেছে। স্তম্ভিত হলাম।

ব্যাপারটা নিয়ে সপ্তাহ কয়েক গভীর ভাবনায় ডুবে রইলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনা আমার মাথার ভেতরে জট পাকাতে লাগল।

আমার ভাবনা ওই আকস্মিক আর্বিভূত লোকটা আমার কাজে প্রতিবন্ধকতা করল, বিঘ্ন ঘটাল, অভিযোগের সুরে উপযাচক হয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেল, তাকে যে আমি চিনতে পারিনি তা তো সত্য নয়।

মনের গোপন করে তা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা থেকেই গেল, কে ওই আগন্তুক কিশোর? কে-ই বা ওই উইলিয়াম উইলসন? কোথায় তার ঘর, এসেছেই বা কোত্থেকে? আর কোন দরকারেই বা এখানে এসেছিল, আমার সঙ্গে দেখা করেছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার ভেতরে অস্থির পোকার মতো অনবরত কামড়াতে লাগল।

কিন্তু হায়! দীর্ঘসময় ধরে নিরলস প্রয়াস চালিয়েও ওইসব প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর খুঁজে পেলাম না। মানসিক স্বস্তি কিছুতেই ফিরে তো পেলামই না, বরং অস্থিরতা হাজার গুণ বেড়ে গেল।

তবে চেষ্টা-চরিত্রের মাধ্যমে, কেবলমাত্র যেটুকু জানতে পারলাম, আমি যেদিন অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডা, ব্র্যান্সরির স্কুল ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম সেদিন বিকালেই তার পরিবারে একেবারে হঠাৎই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আর এরই ফলে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া উপায়ও কিছু ছিল না।

আমি সে স্কুল ছেড়ে আসার পরই অক্সফোর্ডে যাওয়ার ব্যবস্থাদি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরি। অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবসর ও মানসিকতা কোনোটাই সে মুহূর্তে আমার বিন্দুমাত্র ছিল না। তাই জোর তৎপরতার সঙ্গে উদ্যোগ-আয়োজন সেরে আমি দিন কয়েকের মধ্যেই অক্সফোর্ডে পারি জমালাম। আর সেখানে পা দিয়েই। আমি বাবা-মায়ের টাকাকড়ির জোরে বিলাসে মেতে গেলাম। যাকে বলে একেবারে লাগামহীন বিলাসে গা ভাসিয়ে দিলাম।

অক্সফোর্ডে পাঠাভ্যাস শুরু করতে না করতেই আমি এমন সব ঘৃণ্য, একেবারে জঘন্যতম কাজকর্মে মেতে উঠলাম, যে, জুয়াড়ির কাজকর্মের কৌশল রপ্ত করতেও আমি দ্বিধা করলাম না। এতটুকুও রুচিতেও বাঁধল না।

কয়দিনের মধ্যেই আমি একজন পয়লা নম্বরের জুয়াড়ি হয়ে গেলাম। জুয়ার দিকেই আমার দিনের একটা বড় অংশ কাটতে লাগল। সে কাজে আমার দক্ষতা উত্তরোত্তর বেড়েই যেতে লাগল।

সর্বজনবিদিত ও ঘৃনিত জুয়াখেলার জঘন্য কাজটায় আমি অতিমাত্রায় দক্ষতা অর্জন করে আমি কলেজের জনাকয়েক বোকা হাঁদার পকেট দেখতে দেখতে ফাঁকা করে দিলাম। আমার কলা-কৌশলে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন জুয়া খেলায় জিতে আমি অচিরেই একজন টাকার কুমির বনে গেলাম আর অন্যরা হয়ে গেল পথের ভিখারী ।

আমি এভাবে রীতিমত দাপটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের দুটো বছর কাটিয়ে দিলাম।

তারপর, হ্যাঁ তারপরই ‘গ্লোণ্ডিনিং’ নামধারী এক যুবকের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটল। সত্যি কথা বলতে কি তার পরিচয়, এক ধনী যুবক। এর ওর মুখে শুনলাম, সে নাকি হেববাডেস এটিকাসের মতোই বিত্তশালী। যাকে বলে একজন ধনকুবের। আর যে ধন-সম্পদের পাহাড় আমার মতোই নির্ভেজাল সৎ পথেই অর্জিত। কিন্তু তার সে সৎ পথটা যে কি তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা সে মুহূর্তে অন্তত করিনি।

আর কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমে এও বুঝতে পারলাম, তার মাথায় ক্ষার পদার্থ বলতে যা বোঝায় তা তিলমাত্রও নেই। পুরোটাই গোবর ভর্তি।

ব্যস, আমি মতলব এঁটে ফেললাম। কূট-কৌশলে আমি অচিরেই তাকে সাথে ভিরাবার জন্য তৎপর হয়ে পড়লাম। কাজ হাসিল করতে কিন্তু আমার মোটেই বেশি সময় তো লাগলই না। বরং অচিরেই আমার পবিত্র জুয়াখেলায় ভিড়িয়ে নিলাম।

কেউ নতুন খেলতে নামলে, খেলা শুরু করলে বিচক্ষণ ও চতুর জুয়াড়িরা গোড়ার দিকে তাকে জিতিয়ে দিয়ে তার লোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে আকাশ-ছোঁয়া করে তোলে। আমিও একই বুদ্ধি-কৌশলকে কাজে লাগিয়ে নবাগত যুবক গ্লোণ্ডিনিংকে জিতিয়ে দিয়ে তার আকর্ষণকে ক্রমেই বাড়িয়ে তুলতে লাগলাম।

হ্যাঁ, আমার মতলবটা পুরোপুরি কাজে লেগেছে। যুবক গ্লোণ্ডিনিং অচিরেই আমার ফাঁদে মাথা গলিয়ে দিল। তাকে কজা করে ফেলতে পারায় আমার মনে যে কী অব্যক্ত খুশির জোয়ার বয়ে গেল তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

একদিন মওকা বুঝে উভয়েই সহাধ্যায়ী মি. প্লেন্টনের ঘরে আট-দশজনের বেশ জোরদার এক জুয়ার আড্ডা গড়ে তুললাম। সবাই আমার কলেজের বন্ধু, সহায়ধ্যায়ী।

আগেই বলে রাখা দরকার, আমার মাথায় যে কূট একটা মতলব কাজ করছিল তার তিলমাত্রও উইলিয়াম উইলসন জানত না। আমার আচরণের মাধ্যমেও বদ পরিকল্পনাটার বিন্দুবিসর্গও টের পায়নি।

সে যা-ই হোক, অনেক রাতে প্রায় গভীর রাতে জুয়াখেলা শুরু হয়। মদের নেশায় ধনকুবের ছাত্রটা একেবারে কুঁদ হয়ে আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে। কয়েক মুহূর্ত চোখ দুটো আধ-বোজা অবস্থায় বসে মদের জাঁকিয়ে বসা নেশাটাকে উপভোগ করল। এবার শুরু করল জুয়ার দান চালা।

ব্যস, আর যাবে কোথায়। সে যতইবারই দান চালল, ততবারই গো-হারা হেরে গেল। রাশি-রাশি কাড়িকাড়ি নোট সে পকেট থেকে বের করতে লাগল। আর প্রতিবারই নোটগুলো আশ্রয় নিতে লাগল আমার পকেটে। ফলে তার পকেট ক্রমে হালকা হয়ে আমার পকেটগুলো ফুলে ফেঁপে রীতিমত ঢোল হয়ে উঠতে লাগল।

এদিকে কার্যত দেখা গেল, গ্লোন্ডিনিং যত হারে তার জেদও ততই উৰ্দ্ধমুখি হতে লাগল। মোদ্দা কথা, সে যেন রীতিমত ক্ষেপে গেল। এখন তার পকেট একেবারেই শূন্য। একটা কানাকড়িও তার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখা এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু উপায়? জেদ বজায় রাখতে হলে উপায় তো একটা

একটা বের করতেই হবে।

মদের নেশায় জড়িয়ে-আসা গলায় গ্লোন্ডিনিং বলে উঠল–কোনো সমস্য নেই দোস্ত! খেলা চলবেই।

আমি ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে তুলে বললাম–সে না হয় বুঝলাম, খেলা চলবে। কিন্তু বন্ধু তোমার পকেটে যে একটা কানাকড়িও নেই। তবে খেলাটা চলবে কি করে দয়া করে বলবে কী?

‘তুমি আমাকে কিছু মালকড়ি ধার দাও। সময়মত শুধরে দেব, কথা দিচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, এটা অবশ্য সম্ভব হতে পারে। কথা বলতে বলতে তার পকেট থেকে আমার চলে আসা একটা নোটের গোছা তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।

জুয়ার আসর আবার জমজমাট হয়ে উঠল। আমার দাম্ভিক মদমত্ত বন্ধুবর এবারও একের পর এক দারুণভাবে হারতে লাগল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে আমার কাছে মোটা অর্থ ঋণী হয়ে গেল।

বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং এবার কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে বসে রইল। আপন মনে কি যে ভাবল, সে জানে। তারপর একটা ভরা মদের বোতল বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিল। ছিপিটার সঙ্গে দাঁত আটকিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে বোতলের মুখটা খুলে ফেলল। তারপর ঢ ঢক্‌ করে পুরো বোতলটা গলায় ঢেলে দিল। আমি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ঠিক যেমনটা প্রত্যাশা করছিলাম–সে একেবারে হঠাই রেগে অগ্নিমূর্তি! কোনো সমস্যা নেই, দানের অঙ্কটা এবার দ্বিগুণ করা হোক, রাজি?

আমি কয়েকবার আমতা আমতা করতে লাগলাম। আসলে আমি অভিনয়ে লিপ্ত হলাম। এভাবে কয়েকবার অনিচ্ছার অভিনয় করে আমি তার আকস্মিক প্রস্তাবটায় সম্মত হয়ে গেলাম। আর এরই ফলে তার ধারের পরিমাণ এবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে মিনিট কয়েকের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে উঠল। আর এক ঘণ্টার তা চারগুণ হয়ে দাঁড়াল।

একটা ব্যাপারের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। গোড়ার দিকে ভাবলাম, আমার চোখ ও মনের ভুল, তারপর অনুসন্ধিৎসু চোখে ব্যাপারটাকে লক্ষ্য কওে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। হ্যাঁ, ঠিকই তো বটে, তার মুখের রক্তের ছোপটা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছিল। চকের মতো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।

আমি প্রথম দর্শনের পরই বিশ্বস্তসূত্রের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছিলাম নতুন বন্ধুবর গ্লোণ্ডিনিং একজন সত্যিকারের ধনকুবের। তার মতো একজন ধনকুবের এতক্ষণ ধরে জুয়া খেলে যে পরিমাণ টাকাকড়ি হারিয়েছে তার জন্য তো এমন হতাশা আর হাহাকারে জর্জরিত হয়ে পড়ার কথা নয়।

আমি নিঃসন্দেহ হলাম, মাত্রাতিরিক্ত মদ গেলার ফলেই তার মধ্যে এমন আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। চোখ-মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই উপস্থিত সবার কাছে ভালো মানুষ সাজার জন্য আমি কণ্ঠস্বর বেশ চড়িয়েই খেলা বন্ধ করার প্রস্তাব দিলাম।

হ্যাঁ, আমার মতলবটায় কাজ অবশ্যই হয়েছে। খেলা বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব দিতেই উপস্থিত সবাই তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল। আর মাতাল গ্লোণ্ডিনিং সচকিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে গুঙিয়ে উঠল–‘না! কখনো না! খেলা বন্ধ করা চলবে না, কিছুতেই না।’

আমি নিজে এরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়লে কি যে করতাম তা বলা মুশকিল। সত্যি বলছি, নবাগত বন্ধু গ্লোন্ডিনিং-এর মর্মান্তিক দশা দেখে উপস্থিত সবার মন দারুণ বিষিয়ে উঠল। মিনিট কয়েকের জন্য ঘরটায় গভীর নীরবতা নেমে এলো। সবাই নির্বাক-নিস্তব্ধ। পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চলভাবে বসে রইল।

আমি লক্ষ্য করলাম, দলের সবার না হলেও অনেকেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তারা ঘৃণাভরে বার বার আমার দিকে যে তাকাতে আরম্ভ করেছে তা-ও আমার নজর এড়াল না। তবে এক আকস্মিক ও অত্যাশ্চর্য ঘটনায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে-বসা দুঃসহ ভারটা বেশি না হোক, কিছুক্ষণের জন্য হলেও নেমে গেল। নিজেকে অনেকাংশে হালকা বোধ করতে লাগলাম। স্বস্তি পেলাম।

হঠাৎ হ্যাঁ, একেবারে হঠাই ঘরটার ভারী বড় সড় জানালাগুলো দুম্ করে পুরোপুরি খুলে গেল। পর মুহূর্তেই আরও বিস্ময়কর ভোজবাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। যন্ত্রচালিতের মতোই সবগুলো মোমবাতি একই সঙ্গে নিভে গেল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের ভেতরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এলো। আর সেই সঙ্গে শ্মশানেরনিস্তব্ধতা তো রয়েছেই।

বাইরে থেকে আসা চাঁদের হালকা আলোয় আমি শুধুমাত্র এটুকুই উপলব্ধি করতে পারলাম, আপাদমস্তক আলখাল্লায় ঢাকা অবিকল আমার মতোই লম্বাটে একজন। বিদ্যুৎগতিতে ভেতরে ঢুকে এলো। কেবলমাত্র দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তাকে এক ঝলক দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢোকার পরই মূর্তিটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।

আমি আগন্তুককে দেখতে না পেলেও এটুকু অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারলাম, আমাদের মাঝখানে সে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঘরটার ভেতরে আমরা, যতগুলো প্রাণী অবস্থান করছি, সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম। কারো মুখে রা-সরছে না।

কয়েকমুহূর্ত পর সবার বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার আগেই সে আগন্তুক, অনধিকার প্রবেশকারীর কণ্ঠস্বর কানে এলো।

আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো যেন শিথিল হয়ে আসতে লাগল। রক্তের গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর। আর বুকের ভেতরে কোনো অদৃশ্য হাত যেন অনবরত হাতুড়ি পিটে চলেছে।

হ্যাঁ, সে কণ্ঠস্বরটা আমি অন্তত স্পষ্ট শুনতে পেলাম। অনুমান অভ্রান্ত বলেই মনে হল। তার কণ্ঠস্বরই বটে। হুবহু সেই চাপা ফ্যাসাসে কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত কথাগুলো যেন আমার শরীরের হাড়গুলো ভেদ করে মজ্জায় গিয়ে আঘাত হানতে আরম্ভ করল, রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। কোনোদিনই সে কণ্ঠস্বর আমি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব না। কিছুতেই না।

ফ্যাসফ্যাসে স্বরে সে বলতে আরম্ভ করল–উপস্থিত ভদ্র মহোদয়গণ, আমার এ আচরণের জন্য আমি অবশ্যই দুঃখিত নই। অতএব মার্জনা ভিক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ? কারণ একটাই, আজ আমি কেবলমাত্র কর্তব্য পালন করছি। ব্যস, এর। বেশি কিছু অবশ্যই নয়।

এরকম কথা আমি কেন বলছি আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? বলব, সবই বলব। ধৈর্য ধরে শুনুন, সবই খোলসা করে বলছি–যে লোকটা আজ রাতে জুয়া খেলায় হারিয়ে দিয়ে লর্ড গ্লোন্ডিনিং-এর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ জিতে নিয়েছে তার চরিত্র, মানে আসল পরিচয় আপনাদের জানা নেই। আর জানার কথাও নয়।

আমি এখন আপনাদের কাছে জানতে চাই, তার আসল পরিচয় জানার জন্য আপনাদের মনে কৌতূহল জাগছে না? আমি তো মনে করছি, তা জানার জন্য আপনারা অবশ্যই অত্যুৎসাহি। শুনুন তবে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা জানার পথ আমি আপনাদের বলে দিচ্ছি। এখন কি বলছি, সবই মন দিয়ে শুনুন–‘অনুগ্রহ করে সময় সুযোগ মতো তার জামার বাঁ-হাতের আস্তিনের ভেতরের দিকটা আর তার নকসা-করা চাদরটার ভেতর দিককার বড় বড় পকেটগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করবেন, বুঝলেন?

সবাই নির্বাক। ঘরের ভেতরে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।

এদিকে কথাগুলো বলেই আগন্তুক মূর্তিটা যেমন দ্রুতগতিতে ঘরটায় ঢুকেছিল, ঠিক তেমনি দ্রুত চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেল। মুহূর্তে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল।

আমার তখনকার মানসিক অবস্থার বর্ণনা কীই বা দেব? দেওয়া সম্ভব হবে কি? আমার কি না বললেই নয় যে, অভিশপ্ত এক জীবনের নিরবচ্ছিন্ন হাহাকার আর হা হুতাশে আমার বুকটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল?

না, কোনোকিছু ভাববার মতো অবসর আমর নেই, মোটেই নেই। অনেকগুলো হাত একই সঙ্গে এগিয়ে এলো। সেখানেই আমাকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল।

ঘরের ভেতরে আবার মোমবাতি জ্বলে উঠল। আগের মতোই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল। মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে জোর তল্লাসি শুরু করে দেওয়া হল।

ছায়ামূর্তিটার কথাগুলো উপস্থিত সবার মনেই দাগ কেটে দিয়ে গেছে। তার পরামর্শমাফিক সবাই আমার জামার আস্তিন আর গায়ে নকশা-করা চাদরটার ভেতরের দিকটা পরীক্ষা করার কাজে মেতে গেল। আস্তিনের লাইনিংটা ঘাটাঘাটি করতেই তার ভেতর থেকে, চাদরের ভেতরের পকেটগুলো থেকে জুয়াখেলার জাল জুয়াচুরির সব কটা নকল তাস নানারকম মার্কা-দেওয়া তাস দমাদম মেঝেতে পড়তে আরম্ভ করল। আমার ধাপ্পাবাজির কারসাজি সবই ফাঁস হয়ে গেল।

তারপরই ঘরটার মালিক বন্ধুটা মেঝে থেকে, পায়ের তলা থেকে একটা দুপ্রাপ্য ও বহুমূল্য পশমের আলখাল্লা তুলে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল–‘মি. উইলসন, এটা আপনার নিন, ধরুন।

আমি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে দেখলাম, আমার আলখাল্লাটাই বটে। নিজের ঘর ছেড়ে আসার সময় চাদরের ওপর সেটাকে চাপিয়ে এসেছিলাম। শীত খুব আঁকিয়ে পড়েছিল। তাই সেটাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখানে এসে সেটাকে খুলে জানালার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।

ঘরের মালিক-বন্ধুটা আবার সরব হল- মি. উইলসন, নিঃসন্দেহ হচ্ছি, জুয়াখেলার হাত সাফাইয়ের আরও প্রমাণ খুঁজে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজনীয় সে প্রমাণ তো অনেকেই ইতিমধ্যেই আমরা হাতে পেয়ে গেছি। আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে অন্যমনষ্কভাবে আলখাল্লাটার ধুলো ঝাড়াঝাড়ি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম।

ঘরের মালিক-বন্ধুটা এবার একটু বেশ কড়া মেজাজেই বলল–‘আমি আশা করছি, আপনি আজই অক্সফোর্ড থেকে বিদায় নেবেন। আর এও আশা করছি, কথাটা আর দ্বিতীয়বার বলতে হবে না।

আমি নিতান্ত অপরাধীর দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সে এবার বলল–আরও আছে, এ মুহূর্তেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাধিত হব।’

তখন আমি কী লজ্জায় পড়লাম, অপদস্থ হলাম তা আর বলার নয়। সে মুহূর্তে আমি এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম যে, নিজেকে সামলে-সুমলে না রাখতে পারলে হয়তো বা তার পিঠে কয়েক-ঘা বসিয়েই দিতাম। আর ঠিক সে মুহূর্তে আর একটা বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল, যার ফলে আমার মনোযোগ সেদিকেই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। ঘরের মালিক-বন্ধুর আজ্ঞা পাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ বটে।

বিস্ময়কর ঘটনাটা হচ্ছে, ঘরের মালিক মি. প্রেস্টন যখন মেঝে থেকে আলখাল্লাটা আমার হাতে তুলে দিল তখন আমি খেয়ালই করিনি যে, আমার নিজের আলখাল্লাটা আমারই অন্য হাতে ধরা রয়েছে। আর যে আলখাল্লাটা সে আমার হাতে তুলে দিল সেটা অবিকল আমার আলখাল্লাটারই মতো।

এবার ব্যাপারটা আমার মনে পড়ে গেল, যে বিশেষ লোকটা অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে আমার নিষ্ঠুরভাবে জারিজুরি ফাঁস করে, মুখোশটা মুহূর্তের মধ্যে খুলে দিয়ে উল্কার বেগে চম্পট দিল, তার গায়েও একটা আলখাল্লা দেখেছিলাম। সে আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গায়েই আলখাল্লা ছিল না।

যাক, যে কথা বলতে যাচ্ছি, ঘরটার মালিক-বন্ধু মি. প্রেস্টনের দেওয়া আলখাল্লাটা আমার নিজের আলখাল্লাটার ওপর চাপিয়ে নিয়ে বীরদর্পে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চরম নির্দেশ পাওয়ার পর আর সেখানে থাকাও তো সম্ভব ছিল না।

আমার প্রতি পরবর্তী নির্দেশ, আমাকে অক্সফোর্ড ছেড়ে চলে আসতে হবে। অনন্যোপায় হয়েই পরদিন কাকডাকা ভোরে, দিনের আলো ফোঁটার আগেই ভয় ও লজ্জায় অক্সফোর্ড ছেড়ে মহাদেশের উদ্দেশে পা-বাড়াতেই হল।

অক্সফোর্ড ছেড়ে পালিয়ে এসে ভাবলাম, বুঝি অব্যাহতি পেয়ে গেলাম। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, বৃথাই পালিয়ে এসেছি।

আমার অশুভ ভাগ্য বুঝি অধিকতর উল্লাসে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত। একটা কথাই বুঝি আমাকে বিশেষ করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে, এখানেই শেষ নয়, বরং আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো সবে তো শুরু হয়েছে।

অক্সফোর্ড ছেড়ে এসে আমি এবার প্যারিস নগরীতে মাথা গুঁজলাম।

প্যারিসে হাজির হওয়া মাত্রই আমার সম্বন্ধে উইলিয়াম উইলসনের মধ্যে যে অবাঞ্ছিত আগ্রহ ভর করেছে তার প্রমাণ হাতে-নাতে পেয়ে গেলাম। একের পর এক বছর পেরিয়ে গেল তবু কিন্তু আমার দুঃখ-যন্ত্রণা ঘুচল না।

হতচ্ছাড়া শয়তান! আমি রোমে অবস্থানকালে কত অসময়ে, কী এক ভৌতিক পরিবেশে সে যে কতবার আবার আমার উচ্চাকাঙ্খর মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে বিপর্যস্ত করেছে, যারপরনাই হেনস্তা করেছে, সে-সব কথা ভাবতে গেলে আজও আমার। গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়ে ওঠে, শরীর শিথিল হয়ে আসতে থাকে।

কেবলমাত্র রোমের কথাই বা বলি কেন? ভিয়েনাতেও সে আমাকে কম উত্যক্ত করেনি। তারপর বার্লিন আর মস্কোতেও শয়তানটা আমার পিছন ছাড়েনি। যাকে বলে, সে আমার সঙ্গে যেন আঠালির মতো লেগেছিল। এক জায়গার কথা বলা যাবে না, যেখান থেকে আমার অন্তরের বিতৃষ্ণা নিঙড়ে তাকে অভিসম্পাত দেবার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল না।

অতিষ্ট! আমি তার দুর্বোধ্য অত্যাচারে রীতিমত অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। উপায়ান্তর না দেখে আমি তার জঘন্য অত্যাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষ যেভাবে মহামারীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য উন্মাদের মতো পালায়, আমিও ঠিক তেমনই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে পালিয়ে যাই। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। পালিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু ফায়দা কিছুই হলো না! শয়তানটা একটা দিনের জন্যও আমার সংস্রব থেকে দূরে থাকেনি। অতএব দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গি হয়ে দাঁড়াল।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুর্বেধ্য অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে আমি বার বার নিজের মনকেই প্রশ্ন করেছি–কে? সে কে? কোথা থেকেই বা আমাকে উত্যক্ত করতে ছুটে আসে? তার উদ্দেশ্য কি? কোন্ প্রত্যাশায়ই বা আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছে? আ িদিনের পর দিন নিজেকে এমন সব প্রশ্ন করেছি। কিন্তু হায়! কোনো জবাবই পাইনি। তবে এও সত্য যে, একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি, শয়তানটা যেখানে, যতবারই আমার সামনে আবির্ভূত হয়েছে, আমার ইচ্ছায় যখনই সে নাক গলিয়েছে, নানাভাবে বাধা দিয়েছে–কোনো বারই আমার পক্ষে তার মুখটা দেখা সম্ভব হয়নি, কিছুতেই না।

উইলিয়াম উইলসন নামধারী লোকটা যেই হোক, যেখান থেকেই এসে আমার সামনে হাজির হোক না কেন, সে কি একটা মুহূর্তের জন্যও মনে স্থান দিয়েছে, ইটন শহরে যে আমাকে বিশ্রিভাবে তিরস্কারের মাধ্যমে উত্যক্ত করেছিল, আমি অক্সফোর্ডে অবস্থানকালে সে আমার অপমানের চূড়ান্ত করে সম্মানকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল, রোমে সে প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে আমার উচ্চাকাঙ্খকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল, প্যারিসে আমার প্রতিহিংসাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল আর আমার অত্যুগ্র ভালোবাসাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মন-প্রাণ হতাশা আর হাহাকারে ভরিয়ে তুলেছিল– যে লোকটা আমার সবচেয়ে বড় চিরশত্রু, আমার অশুভ অদৃষ্ট, আমি কিন্তু তার মধ্যে আমার স্কুলের সহপাঠী, আমার নামের সঙ্গে যার হুবহু মিল ছিল, সে জঘন্য ঘৃণিত ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পাইনি, অবশ্যই নয়।

অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব! এ শয়তানটা কিছুতেই অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্রানসবির স্কুলে আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী উইলিয়াম উইলসন হতে পারে না।

যাক আর নয়, অকল্পনীয় সে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কথাই তো বলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, শয়তানটার ন্যাক্কারজনক কাজের পুরো ফিরিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এ নাটকের শেষ ঘটনাবহুল দৃশ্যের অবতারণা করাই শ্রেয়।

আঠারো খ্রিস্টাব্দের কথা।

আমি তখন রোমে বাস করছি। সে বছরের উৎসবে আমি উপস্থিত ছিলাম। নেপলসের ডিউক ডি ব্ৰগলিওর পালাজ্জোতে এক মনোজ্ঞ মুখোশ-নৃত্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। সে নৃত্যানুষ্ঠানে আমি দর্শকের আসনে ছিলাম।

আমি ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মদের টেবিলে বসে মদ গিলতে গিলতে মুখোশ নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। আর খুব বেশি রকম হৈ-হুঁল্লোড়ে মেতে গিয়েছিলাম, অস্বীকার করা যাবে না।

ঘরটায় তখন গাদাগাদি ভিড়। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর সে সঙ্গে অসহ্য গরমও ছিল। আবহাওয়া নিতান্তই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমি আর এক মুহূর্তও টিকতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এবার অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে জবুথুবু হয়ে পড়া বুড়ো ডি ব্ৰগলিওর রূপসি যুবতি স্ত্রীর খোঁজে ভিড়ের ভেতরে দাপাদাপি শুরু করে দিলাম।

সে রূপসি যুবতি তার পোশাকের গোপন কথাটা আমাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল। অতএব আমার মধ্যে তাকে খুঁজে বের করার আগ্রহটা যে আরও অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল, অস্বীকার করব না।

আমি ভিড়ের মধ্যে তাকে হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করে দিলাম। শেষপর্যন্ত ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখতে পেলাম। ব্যস, আমি উদ্রান্তের মতো একে ওকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

ঠিক সে মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন আচমকা আমার কাঁধে হাত রাখল। ঘাড় ফিরিয়ে হাতের মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করার আগেই আমার কানে এলো সে চিরস্মরণীয়, ফ্যাসফ্যাসে, ক্ষীণ অভিশপ্ত কণ্ঠস্বরটা।

আমি মুহূর্তে যেন রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলাম। ক্রোধে আমার সর্বাঙ্গ থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল আর মাথায় রক্ত উঠে যাওয়ার যোগাড় হলো। আমি গর্জে উঠলাম–‘শয়তান। হতচ্ছাড়া! নচ্ছাড় কাহাকার। না, কিছুতেই না। এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে আমি আঠার মতো আমার সঙ্গে সেঁটে থাকতে দিচ্ছি না, কিছুতেই না।’

সেনির্বাক। টু-শব্দটিও করল না।

আমি আগের মতোই তর্জন গর্জন করতে লাগলাম–‘শয়তান, আমার সঙ্গে এসো। আসতেই হবে তোমাকে। তা যদি না কর তবে যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই ছুরির ফলাটা তোমার বুকে আমুল গেঁথে দেব, বলে দিচ্ছি!’

আমার মেজাজ মর্জি তখন এমনিতেই খুবই বিগড়ে ছিল। আমার বাঞ্ছিতা রূপসি যুবতিকে কাছে পাবার জন্য ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলাম। ফলে আমার কাঁধে তার হাতটা পড়ামাত্র দুম্ করে সেটাকে চেপে ধরে ফেলেছিলাম।

হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্তই বটে। অবিকল আমার মতোই পোশাক সে গায়ে চাপিয়েছিল। একটা স্পেনি আলখাল্লা। প্রায় পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছিল। নীল ভেলভেটের তৈরি। লাল বেল্টের সঙ্গে সুতীক্ষ তরবারিটা ঝুলছিল। আর কালো রেশমি মুখোশ দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রাখা ছিল। ফলে তার মুখের সামান্যতম অংশও নজরে পড়ছিল না। তবে শয়তানটাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি।

আমি আবার গর্জে উঠলাম–‘এসো আমার সঙ্গে।

আবারও বলছি কোনোরকম ধান্ধাবাজির চেষ্টা করলে চোখের পলকে তোমার বুকে ছুরির ফলাটা গেঁথে দেব, শুনে রাখ!’

আমি কথা বলতে বলতে তার কলারটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাকে নাচের আসর থেকে পাশের ছোট ঘরটায় নিয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! সে কিন্তু বাধা দেওয়ার চেস্টা করা তো দূরের ব্যাপার কোনোরকম আপত্তি পর্যন্ত করল না। বরং নিতান্ত অনুগতের মতোই আমার সঙ্গে সে ঘরটায় ঢুকল।

আমি তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই সজোরে একটা ধাক্কা দিলাম। সেনিজেকে সামলাতে না পেরে টলতে টলতে সামনের দেওয়ালটায় দুম করে আছড়ে পড়ল।

আমি ব্যস্ত হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। প্রায় গর্জে উঠেই বললাম–‘খাপ থেকে আমার তরবারিটা বের কর।’

মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে চাপা নিশ্বাস ফেলল। তারপর নীরবে খাপ থেকে তরবারিটা বের করে হাতে নিল।

আমি হুঙ্কার ছাড়তেই সে আত্মরক্ষার জন্য তরবারিটা শক্ত করে ধরে তৈরি হয়ে নিল।

আমাদের উভয়ের মধ্যে লড়াই হলো। তবে খুবই অল্পসময়ের লড়াই। মনে করা যেতে পারে, লড়াই ভালোভাবে শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল।

আমার মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা ভর করেছে। উত্তেজনায় প্রায় উন্মদদশা প্রাপ্ত হয়েছি। আমার একটা হাতে যেন হাজার হাতের শক্তি এসে ভর করেছে। অসুরের শক্তি অনুভব করলাম।

লড়াই শুরু হবার মাত্র সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই একমাত্র দৈহিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দেওয়ালের কাঠের আবরণটার সঙ্গে সজোরে চেপে ধরলাম। তার নড়াচড়া করার মতো সামান্যতম শক্তিও রইল না। আমার মধ্যে তখন নেকড়েরনিংস্রতা ভর করেছে। আমার চরমতম শত্রুটাকে পেয়ে নেকড়ের মতো হিংস্রতায় আমার হাতে ঝকঝকে চকচকে তীক্ষ্ম তরবারির ফলাটাকে বার বার তার বুকে গেঁথে দিতে লাগলাম।

ঠিক সে মুহূর্তেই মনে হলো কে যেন দরজায় অনবরত ধাক্কা মারছে, খোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দরজাটা খুলে কেউ যদি ঘরে ঢুকে আসে, ব্যাপারটা জানা জানি হয়ে যায়, তাই দৌড়ে গিয়ে সিটকিনিটাকে ভালোভাবে আটকে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার এক লাফে আমার চরমতম শত্রুর কাছে ফিরে গেলাম।

কিন্তু হায়! যে অভাবনীয় দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার ফলে আমার মধ্যে যে বিস্ময়ের সঞ্চার হলো, যে আতঙ্ক আমার বুকে চেপে বসল, আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে আমি কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করব। সে যে নিছকই বর্ণনাতীত ব্যাপার।

মুহূর্তের জন্য আমি চোখ ফিরিয়ে ছিলাম, সেটুকু সময়ের মধ্যেই ঘরের সব ব্যবস্থা রীতিমত বদলে গেছে। যাকে বলে ঘরের সবকিছুরই আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। কয়েক মুহূর্ত আগে যেখানে কিছুই আমার নজরে পড়েনি এখন সেখানে আমার দৃষ্টি গেল। অন্তত সে মুহূর্তে আমার এরকমই মনে হয়েছিল। দেখলাম বিশাল একটা আয়না।

আমি চরম আতঙ্ক বুকে নিয়ে দুপা এগিয়ে গিয়ে যখন আয়নাটার মুখোমুখি দাঁড়ালাম, তখন একেবারেই অবিশ্বাস্য এক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলাম। মনে হলো আমার নিজের মূর্তিই আঁকাবাঁকা গতিতে আমার মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে এসেছে। তবে সে মূর্তি তখন চকের মতো ফ্যাকাশে, বিবর্ণ আর রক্তাপ্লুত। ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি যেন একেবারে আমার মুখোমুখি স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এরকম দেখলাম, বলছি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদৌ তা নয়। মৃত্যুযন্ত্রণা আর হতাশা হাহাকারে জর্জরিত হয়ে যে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল, সে উইলসনই বটে। নিজের গায়ের আলখাল্লা আর মুখোশটাকে সে খুলে যে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল সে দুটো তেমনি সেখানেই পড়ে থাকতে দেখলাম।

অবাক না হয়ে পারলাম না, তার মুখের কোথাও এমন কোনো একটা রেখা নেই যা আমার মুখে অনুপস্থিত। অর্থাৎ হুবহু আমারই মুখের মতো। আমারই মুখটা যেন তার কাঁধের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটো মুখই যেন একই ছাঁচে গড়া।

কেবলমাত্র মুখের কথাই বা বলি কেন? তার পোষাক-আশাকে এমন একটা সূতোও নেই যা আমার পোশাকে নেই। আর পোশাক তৈরির কায়দা-কৌশলও অবিকল একই রকম। যেন একই কাপড় আর একই দর্জি দিয়ে উভয়ের পোশাকই তৈরি করানো হয়েছে।

হ্যাঁ, স্বীকার না করে উপায় নেই। সত্যি বলছি, সে অন্য কেউ নয়, অন্য কিছুই নয়, উইলসনই বটে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কিন্তু অনুচ্চ কণ্ঠে, ফাঁসাসে কণ্ঠস্বরে কথা বলল না। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি অনায়াসেই ধরেনিতে পারতাম যে, কথাগুলো সে নয়, আমিই বলে চলেছি।

সে বলে চলল, হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি, আমি হেরে গেছি। তুমিই জয়ী হয়েছ। তবু আজ, এ-মুহূর্ত থেকে তুমিও মৃত–পৃথিবীবাসীর কাছে, পরম পিতার কাছে, আর আমার কাছে তুমিও মৃত।

তুমি এতকাল আমারই মধ্যে বেঁচেছিলে। আর আজ, এ-মুহূর্তে আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ-মূর্তি যা তোমার মতো নয়–তোমারই মূর্তি তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই আমার কথার সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে, চূড়ান্তভাবে আমাকে নয়, তুমি নিজেকেই হত্যা করেছ। হত্যা! আত্মহত্যা করেছ তুমি।

এ টেল অব জেরুজালেম

৩৯৪১ বিশ্বাব্দ!

সে বছরেরই তামুজা মাসের দশ তারিখে আবেশ ফিস্তি বুজি-বেন-লেভি আর ফ্যারিসীয় সাইমিয়নকে বলল–চল, আমরা যতশীঘ্র সম্ভব এখান থেকে কেটে পড়ি।

চোখে-মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে বুজি-বেন-লেভি আর ফ্যারিসীয় সাইমিয়ন সমস্বরে বলে উঠল– কোথায়? কোথায় কেটে পড়তে চাইছ?

বৈনামিন সদর দরজার গায়ের দুর্গপ্রাকারে। সেখানে ডেভিড শাসনাধীন। আর সেখান থেকে কায়েরদের শিবির অদূরে দেখাও যায়। এটাই সূর্যোদয়ের মুহূর্ত–চতুর্থ প্রহরের শেষ ঘণ্ট। পৌত্তলিকরা পম্পের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অবশ্যই আমাদের জন্য কুরবানির ভেড়া নিয়ে অধীর অপেক্ষায় প্রতিটা প্রহর কাটাচ্ছে।

বুজি-বেন-লেভি, সাইমিয়ান, আবেশ আর ফিস্তিম তিনজনই সুপবিত্র শহর জেরুজালেমের কুরবানির উপ-সংগ্রহে নিযুক্ত।

এবার ফ্যারিসীয় বলল–আর এক মুহূর্তও দেরি করা মোটেই সমিচিন নয় বলেই আমি মনে করছি। চল, যতশীঘ্র সম্ভব এ জায়গা ছেড়ে চল। কারণ, উদারচেতা নয় বলে এ-পৌত্তলিকদের অখ্যাতি রয়েছে।

হুম্! বুজি-বেন-লেভি প্রায় অক্ষু স্বরে উচ্চারণ করল।

ফ্যারিসীয় বলে চলল–আর জানোই তো বাস-পূজারীদের পক্ষে তো চপল মতিত্ব অবশ্যই বিশেষ একটা গুণ বলে গণ্য হয়।

তারা চপলমতিই কেবল নয়, বিশ্বাসঘাতকও বটে।

তবে?

তবে তারা কেবলমাত্র এডোনাইয়ের লোকদের ব্যাপারেই তারা বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে থকে। এমোনটারা সেনিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সদা সতর্ক নয় এমন কথা কে, কবে শুনেছে বলতে পার?

বটে!

আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের হাতে গোটা কয়েক ভেড়া আল্লাতাল্লার বেদির জন্য তুলে দিয়ে আর প্রতিটা মাথার বিনিময়ে ত্রিশ সেকেল রোজগার করে। নেওয়াটাকে উদার মনোভাবের পরিচায়ক বলে মনে করা যেতে পারে কি?

বেন লেভি, তোমার কিন্তু ভুল হচ্ছে, মানে তুমি ভুলে যাচ্ছ এভাবে আল্লাতালার বেদির জন্য খরিদ করা ভেড়াগুলোকে আমাদের পেটের জ্বালা নেভানোর কাজে ব্যবহার করব না, তার কোনো নিশ্চয়তা কিন্তু আমাদের দিক থেকে রোমক পস্পেকে দেওয়া হয়নি, ঠিক কি না?

হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিকই।

এবার ফ্যারিসীয় গলাছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–আমার কথা শোন, মোল্লা হিসেবে যে আমার পক্ষে দাড়ি-গোঁফ কামানো নিষিদ্ধ তার পাঁচটা কোন্টের দোহাই।

একটু নীরবতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে সে আবার বলল–তবে কি আমরা সে বিশেষ দিনটার অপেক্ষায়ই বেঁচে রয়েছি, রোমের এক পাপাত্মা নরাধম, পৌত্তলিক বাদশা যেদিন হঠাৎই আমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করে বসবে যে, সে সব পবিত্র বস্তুকে আমরানিজেদের দেহের ক্ষিদে, পেটের জ্বালা নেভানোর জন্য আত্মসাৎ করব? সেদিনটার অপেক্ষাই কি আমরা পৃথিবীতে টিকে রয়েছি, যেদিন

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আবেশ কিস্তিম বলে উঠল-থাক, আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি। আমার কথা শোন, আমরা ফিলিস্তিমির অভিপ্রায়ের ব্যাপারে একটাও প্রশ্ন করব না, কোনো প্রশ্নই না।

সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু কারণটা জানতে পারি কী?

হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই কিছু না কিছু আছে।

কী সে কারণ?

কারণটা হচ্ছে, আমরা তার লিলা বা উদারতার দ্বারা আজই প্রথম লাভবান হচ্ছি না।

বুঝলাম।

যাক, পা চালাও। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে হেঁটে যত শীঘ্র সম্ভব মসজিদের কাছে পৌঁছে যাই। যাতে সে মসজিদটার জন্য প্রয়োজনীয় ভোজ্যদ্রব্যের অভাব না ঘটে। যার জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ থেকে বৃষ্টি দিয়ে নেভানোর ক্ষমতা রাখে না। কোনো ঝড় ঝাঁপটা যার ধোঁয়ার কুণ্ডলিকে স্থানচ্যুত করে দিতে পারে না।

নগরের যেখানে আমাদের উপযুক্ত গিকারিমটা গিয়ে দাঁড়াল, সে স্থানটার সঙ্গে দোণ্ড প্রতাপশালী স্থাপিত রাজা ডেভিডের নাম জড়িত রয়েছে, তাকেই জেরুজালেমের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও নিরাপদ অঞ্চল মনে করা হয়।

তাই বুঝি? এ রকমটা মনে করার কারণ কী বল তো?

হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই আছে। যাক, কারণটা বলছি, তবে ধৈর্য ধরে শোন কারণ, জায়গাটা অনেক উঁচুতে অবস্থিত, আর তার অবস্থান খাড়া জিরম পাহাড়টার শীর্ষদেশে। এখানে পাথর খোদাই করে করে গভীর পরিখা তৈরি করা হয়েছে। তারপর সেটাকে আরও খোদাই করে অধিকতর সুরক্ষিত করে তোলা হয়েছে। তার ভেতরের মালের ওপর সোজা ও লম্বা প্রাচীর গেঁথে। আর সেটার উচ্চতাও অবশ্যই লক্ষণীয়, যার ফলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা অধিকতর জোরদার হয়ে উঠেছে। শুধু কী এই? শ্বেতপাথরের বেশ কয়েকটা চৌকোনা গম্বুজ তৈরি করে সে প্রাচীরটার মাঝে মাঝে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম উচচতাবিশিষ্ট গম্বুজটার উচ্চতা ষাট হাত আর সবচেয়ে উঁচুটা একশো বিশ হাত। সব জেরুজালেমের সবচেয়ে উঁচু গম্বুজটার নাম এডম-বেজেক।

সাইমিয়ন তার সঙ্গি সাথীদের নিয়ে যখন এডুমি-বেজেক গম্বুজটার শীর্ষদেশে উপস্থিত হলো তখন তারা যে উচ্চতম স্থানটা থেকে নিচে অবস্থানরত শত্ৰু ছাউনিগুলোর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে আরম্ভ করল, সেটার উচ্চতা কিয়সের পিরামিডের চেয়ে অনেক অনেক ফুট ওপরে অবস্থিত, আর বেলুস মন্দিরটার চেয়ে ফুট কয়েক বেশি উঁচু। অতএব সেটার উচ্চতা সম্বন্ধে অনায়াসেই ধারণা করে নেওয়া সম্ভব।

নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে-যাওয়া উচ্চতা থেকে নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ফ্যারীসয় চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–হ্যাঁ, কথাটা খুবই সত্য যে, কাফেররা তো এক-একজন সমুদ্র উপকূলের এক-একটা বালির কন্টার সমতুল্য। অন্যভাবে বললে, সুবিশাল প্রান্তরে পঙ্গপাল যেমন অবস্থান করে ঠিক তেমনি তারাও হাজারে হাজারে লাখে-লাখে ছড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে রাজার উপত্যকা তো আর রাজার নিজের উপত্যকা নেই।

এ কী কথা! রাজার উপত্যকা তবে এখন কাদের?

আরে কথাটা অবাক হবার মতো শোনালেও খুবই সত্য।

ভালো কথা, রাজার উপত্যকা এখন কাদের দখলে গেছে?

এডমিন-এর উপত্যকায় পরিণত হয়ে গেছে।

তার কথা শেষ হতে-না-হতেই একজন যুদ্ধের সাজে সজ্জিত রোম সৈন্যের গলা শোনা গেল। সে রীতিমত কর্কশ ও হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল–রৌপ্য সেকালের ঝুড়ি, এখনও ওপরে রেখে দিয়েছ কেন?

তার কথার কোনো উত্তরই কেউ দিল না।

সে আবার একই সরবে চেঁচিয়ে বলল–ওই রৌপ্য সেকেলের ঝুড়িটাকে নিচে, এখানে নামিয়ে নিয়ে এসো।

মুহূর্তের জন্য থেকে কোনো উত্তর তার উদ্দেশ্যে ভেসে আসে কিনা লক্ষ করে নিয়ে রোমক সৈন্যটা পূর্বপ্রসঙ্গে জের টেনে আবার বলতে আরম্ভ করল রোমক মহাপুরুষ যে মুদ্রার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হয়েছিলেন, চোয়াল বেঁকে যাওয়ার জো সে অভিশপ্ত মুদ্রাগুলোসমেত ঝুড়িটাকে ওপর থেকে এখানে নামিয়ে নিয়ে এসো। তোমাদের আচরণে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি। আমাদের প্রভু পম্পেসুসের অনুগ্রহের প্রতিদান কি তোমরা এমনভাবেই দিতে চাচ্ছ? ভুলে যেও না আমাদের প্রভু যে অসীম কৃপাবশত তোমাদের পৌত্তলিক প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এবং প্রার্থনা শুনতে সম্মত হয়েছেন, তার বিনিময়ে তোমরা এভাবেই কৃতজ্ঞতা জানাতে উৎসাহি?

মুহূর্তের জন্য থেমে একটু দম নিয়ে সে আবার মুখ খুলল–শোন, এখন যা বলছি মন দিয়ে শোন–সত্যিকারের দেবতা ফিবুস এক ঘণ্টা রথে চেপে। পূর্ব আকাশে সূর্যদেব উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দূর্গ-প্রাকারে জড়ো হওয়া কি তোমাদের উচিত ছিল না? ঈডিপোল! তোমাদের আচরণে আমি যারপরনাই অবাক না হয়ে পারছি না। একটা কথা, তোমাদের কি ধারণা পৃথিবীবাসী কুকুরগুলোর সঙ্গে আদান প্রদান চালাবার জন্য প্রত্যেক কুকুর শালার ভাঙ বেড়ার গালে মু থুবড়ে পড়ে থাকা ছাড়া তোমাদের কি আর কোনোই করণীয় নেই? আমার তো মনে হচ্ছে, এটাই সত্যি। কি হল, সবাই যে নীরবে হাত গুটিয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলে! যাও–ওই সেকেলে ঝুড়িটাকে নিচে নামিয়ে দাও। আমি তোমাদের বলছি, নামিয়ে দাও। আর একটা কথা, তোমাদের আজে-বাজে জিনিসগুলোর রং যেন লোভনীয় হয়, আর ওজনের দিকেও নজর রেখো, ঠিকঠাক থাকে যেন।

এল এলোহিম! এল এলোহিম! আবেগ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথাটা পর পর দুবার উচ্চারণ করেই ফ্যারিসীয় সংজ্ঞা হারিয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। পরমুহূর্তেই সংজ্ঞাহীন আবস্থাতেই বার দুই কাতরে মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে গিয়ে থামল।

এলো এলোহিম! দেবতা জবুখ কে? কার কথা বলছে ওই পাপাত্মাটা! কে সে? তুমি বুঝি বেন লেভি, জেন্টিলদের গ্রন্থগুলো তো তুমি পড়েছ, ঠিক কি না? আর টেরাফিমদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছ। কিন্তু ওই পৌত্তলিক কী বলছে, বলতে পার? সে কি নেরুগালের সম্বন্ধে বলছে? তা যদি নাই হয় তবে কী আসিমাহ সম্বন্ধে। তা না হলে নির্ভজ অথবা টাটকির কথা। তা না হলে এড্রামালে? তা না হলে এনামালেক? তা না হলে সুকোথ বেনিথ? তা না হলে ড্রাগন? তা না হলে বেলিয়াল? তা না হলে বালপিওর? আর এদের কথা না-ই হয়ে থাকে তবে কি বলজিবাবের কথা বলছে?

না, এদের কারো কথাই না। অবশ্যই এদের কথা বলতে চাইছে না। তবে খুবই সাবধান! সাবধান! করছ কী! দড়িটাকে আঙুলের ফাঁকে এত দ্রুত, এত বেশি পরিমাণে ছাড়ছ! কেন? অসুবিধা কি? অসুবিধা তো আছেই। দ্রুত নেমে আসা ঝুড়িটা যদি ওই মাথা বেরিয়ে থাকা পাথরগুলোর গায়ে ধাক্কা মারে তবেই সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ঝুড়ির যাবতীয় পবিত্র মালপত্র দুম দুম করে নিচে পড়তে আরম্ভ করবে। এক সময় দেখা যাবে খালি আর ভাঙা ঝুড়িটা নিচে নেমে এসেছে।

এক সময় নিচে অবস্থানরত জনসাধারণের মাঝখানে অতিকায় ও ভারী ঝুড়িটাকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো। বেশ বড়সড় যন্ত্রপাতির সাহায্যে সেটাকে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির বুকে কুয়াশা এমন গাঢ় হয়ে জমেছিল যার জন্য গায়ে কাটা দেওয়া কাজকর্ম কারো পকেই দেখা সম্ভব হলো না। এতে সবার মনেই কিছু না কিছু আক্ষেপ তো থেকেই গেল।

এক মিনিট দুমিনিট করে এসে আধঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেল।

ফ্যারিসীয় বহু নিচে অবস্থানরত স্থানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

এক সময় চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্যারিসীয় বলল–এ যে দেখি বহু সময়ের ব্যাপার। আমাদের অনেক দেরি হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত কাঠোলিস আমাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবে দেখছি!

তার কথা সমর্থন করে আবেল ফিত্তিম বলল–দেশে ফিরে আমাদের উপোষ করেই কাটাতে হবে দেখছি। পেটের ভাত যোগাড় করার কোনো সুযোগই থাকবে না। দাড়িতে আতর মাখা বন্ধ হয়ে যাবে, আর মন্দিরে গিয়ে সূক্ষ্ম বস্ত্র কোমরে জড়ানো পাটও ঘুচে যাবে। কী সমস্যার মুখোমুখিই যে আমাদের হতে হবে তা বে কিনারা পাচ্ছি না।

বেন-লেভি এতক্ষণ নিজেকে কোনোরকমে সামলে সুমলে রেখেছিল। এখন আর নিজেকে সামলে রাখা তার পক্ষ সম্ভব হলো না। শেষপর্যন্ত সে গালমন্দই করে বসল এক্কেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে দেখছি! অপদার্থ, বিশ্ব বখাটে! তারা কি আমাদের মালকড়ি, মানে টাকা পয়সা হজম করে দেওয়ার ধান্ধায় আছে নাকি?

আবেশ ফিত্তিম গম্ভীর মুখে প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল–হুম! বেন- লেভি থামল না, বলেই চলল মালকড়ি মেরে দেবার ধান্ধা যদি নাও থাকে, হায় পবিত্র মোজেস!

কিছু সময় উত্তর্ণ হয়ে লক্ষ্য করে সে আবার মুখ খুলল–হায় পবিত্র মোজেস! তারা কি তবে গীর্জার শেঁকলগুলো ওজন করতে লেগে গেছে?

ফ্যারিসীয় এবার আরনিজেকে সংযত রাখতে না পেরে শেষে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–কী আশ্চর্য! কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তারা শেষপর্যন্ত কোন্ ইঙ্গিত দিচ্ছে।–আর তুমি বুঝি বেন লেভি, –তুমিও টান?

এবার গিজকরিম টানতে আরম্ভ করল। টানের চোটে ক্রমে গাঢ় হয়ে জমতে থাকা কুয়াশা ভেদ করে ভারী বোঝাটা এদিক-ওদিক দোল খেতে খেতে ওপরের দিকে উঠে যেতে লাগল।

এক সময় এক ঘণ্টা পরে দড়িটার বিপরীত প্রান্তে কোনো একটা বস্তুকে দেখতে পাওয়া মাত্র বেন লেভি আচমকা সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।

বুশোহ্ হে! বুশোহ্ হে! বুশোহ্ হে!

বুশোহ্ হে! ইস্ কী লজ্জার কথা! কী লজ্জার কথা! কিন্তু এ যে দেখছি এঙ্গোড়ির বনাঞ্চল থেকে নিয়ে আসা একটা অতিকায় ভেড়া। আর এটা জোহসোকাটি উপত্যকার মতো লোমশ ভেড়া। ঘাড় কাৎ করে ভালোভাবে দেখে নিয়ে আবার একই স্বরে সে বলে উঠল–হ্যাঁ, সে রকম লোমশ ভেড়াই বটে না।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আবেশ ফিত্তিম বলে উঠল–আরে এটা তো বুড়ো ধাড়ি ভেড়া নয়, বাচ্চা একেবারেই কম বয়স। তার পায়ের ভাঁজ আর ঠোঁট বাঁকানোর রকম সকম দেখেই আমি নিঃসন্দেহ হতে পারছি–নিতান্তই একটা বাচ্চা ভেড়া।

হুম্! ফ্যারিসীয় প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল। আবেশ ফিত্তিম পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চলল–এরচোখ দুটো কী সুন্দর। একমাত্র পেক্টোরলের মুক্তার সঙ্গেই এর তুলনা চলতে পারে। না, ঠিক বলা হলো না। পেক্টোরালের মুক্তোর চেয়েও সুন্দর–অনেক বেশি সুন্দর। আর মাংসের সাদ অবশ্যই হেনের মধুর মতোই সুস্বাদু আর উপাদেয়ও বটে।

ফ্যারিসীয় এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সে বলল– এটাকে বালনের চারণভূমি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। যাক, যে কথা বলতে চাইছি– পৌত্তলিকরা কিন্তু আমাদের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছে, অস্বীকার করতে পারব না।

মুহূর্তকাল নীরব থকে ফ্যারিসীয় এবার বলল–এক কাজ করা যাক। আমরা সমস্বরে মন্ত্র পাঠ করি, আপত্তি আছে?

মন্ত্র, অর্থাৎ স্তোত্র পাঠে কারোরই তো আপত্তি থাকার কথা নয়। ইতিমধ্যে গিজবারিম থেকে ফুট কয়েক নিচে ঝুড়িটা পৌঁছে গেল। ব্যস, ঠিক সে মুহূর্তে সচকিত হয়ে সবাই সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে দাঁড়িয়ে রইল। পরমুহূর্তেই সবাই দেখতে পেলঝুড়িটায় একটা শুয়োরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ বড়সড় আর নাদুস নুদুস একটা শুয়োরের বাচ্চা।

ব্যাপারটা দেখামাত্র তিনজনেরই চোখ ট্যারা হয়ে যাবার যোগাড় হলো। সবাই প্রায় সমস্বরেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল–এবার এল এমনু! এবার এল এমনু!

তিনজনই একই সঙ্গে কথাটা বলেই হাতের দড়ির প্রান্তটা দুম করে ছেড়ে দিল।

ব্যস, দড়িটা আল্গা হওয়া মাত্র শুয়োরের বাচ্চাটা তর তর করে সোজা নেমে গিয়ে ফিলিস্থিনদের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

এল এমনু! এল এমনু!–হে পরম পিতা, তুমি আমাদের সহায় হও! হায়! এ কী কেলেঙ্কারী ব্যাপার! উফ শুয়োর! শুয়োরের মাংস! এ মাংস যে আমাদের পক্ষে জিভে ঠেকানোও সম্ভব নয়।

এ টেল অব জেরুসালেম

সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে এক দুর্গ-শহর।

শত্রুসৈন্য দুর্গ-শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। তারা পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থান করছে। শত্রু-শিবির থেকে নিচের দিকে তাকালে নজরে পড়ছে উঁচু, প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ-শহরটা, আর ঐ একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থান করছে শহর আর দুর্গটা।

নিচের পাহাড়ের গায়ের ওই দুর্গ-শহরে কিছুক্ষণের মধ্যেই উপহার আসার কথা। নাদুসনুদুস ভেড়া জবাই করবে। তারপর সে মাংস দিয়ে শত্রুসৈন্যরা পরমানন্দে ভোজ সারবে।

শত্রুসৈন্যরা ছিন্নমুষ্ক।

কিন্তু পাহাড়ের গায়ের দুর্গ শহরের মানুষগুলো কিন্তু ছিন্নমুষ্ক না, সবাই বিধস্য। তাই শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে তাদের আহার্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দিক থেকে পার্থক্য তো থাকারই কথা। আত্মম্ভরী ছিন্নমুষ্ক সেনাপতি পাহাড়ের চূড়ায় বসে সদম্ভে স্বগতোক্তি করছে–আমরা উদারচিত্ত। আমাদের ঔদার্যের কথা লোকের কাছে বুক ফুলিয়ে বলার মতোই বটে। আমাদের সমতুল্য কাউকেই দেখছি না। দুর্গ শহরের মানুষগুলো তো আমাদের কাছে মেষ শাবকের তুল্য। দেবতাজ্ঞানে আমাদের পূজা করা ছাড়া তাদের কোনো গতিই নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কথায় তারা উঠছে-বসছে।

আমরা তাদের চারদিক থেকে অবরোধ করে রেখেছি। কেন? এর পিছনে কোন্ উদ্দেশ্য আছে, তাই না? আমরা তাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব। আমরা যদি অন্য ধান্ধা করতাম, সেলামিস্বরূপ মোটা টাকা চেয়ে বসতাম, অনায়াসে তা যে পেয়ে যেতাম, এতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমরা ভুলেও সে পথে হাঁটলাম না। আমরা তো আর কাঙাল নই যে, অন্যের কাছে হাত পাততে যাব। তবে আমরা কি চাচ্ছি? মোটামোটিনাদুসনুদুস ভেড়া, জবাই করার জন্য, মজা করে ভুরিভোজ খাবার জন্য।

একটু পরেই বাঞ্ছিত বস্তু ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। ওপর থেকে ভেড়ার মাংস ভর্তি পেটি দড়িতে বেঁধে নিচে নামিয়ে দিল। পিঠে পাথর বেঁধে ভারি করা হল, যার জন্য দড়িটা টানটান হয়ে গেল।

বেশ কয়েকজন মিলে বাক্সটাকে টানাটানি করে তুলে নিল। এর জন্য তাদের বেশ কসরত করতে হয়েছে। গা দিয়ে রীতিমত ঘাম ঝড়ছে। যারা এতক্ষণ মাথা নুইয়ে বাক্সর চারপেয়ে প্রাণীটাকে দেখছিল, তারা সোল্লাসে বলতে লাগল। আরে বাস! দারুণ ভেড়া! খাসা ভেড়া। তাদের একজন দু বাহু তুলে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে গলা ছেড়ে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল। বাজাও, কাড়া নাকড়া আর তুরীভেড়ি। গলাছেড়ে গান ধরো সবাই! কী মজা! খাসা ভেড়া! নাদুসনুদুস ভেড়া!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ইয়া পেল্লাই বাক্সটা ওপরে উঠে গেল। বাক্সটার ঢাকনা খুলতেই শত্রুসৈন্যদের সবার মুখ আমসির মতো শুকিয়ে গেল।

ফ্যাকাশে-বিবর্ণ মুখে সবাই বাক্সটার দিকে তাকিয়ে রইল। কারো মুখেই বাক্ সরছে না। আর চোখের তারায় বিস্ময়ের সুস্পষ্ট ছাপ।

এমন সময় নাদুসনুদুস চারপেয়ে প্রাণী এক লাফে বাক্সটার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। তবে এটা অবশ্যই ভেড়া নয়। সুবিশাল ছিন্নমুষ্ক শূকর। একেবারেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ড।

যার নরম মাংস অতি পবিত্র বিরোচিত হয়–আহারের কথাও মুখে উচ্চারণ করতে নেই। তোবা! তোবা!

এ টেল অব দ্য র‍্যাগড মাউন্টেইনস

১৮০৭ সাল।

সে বছরের প্রথমের দিকে আমি ভার্জিনিয়ার চার্লোটিস ভিলাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতাম। এক সকালে একেবারেই অভাবনীয়ভাবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয়। তাঁর নাম অগ্যাস্টাস বেড়লো।

মি. বেডলো ছিলেন বয়সে যুবক। আর সত্যিকারের ভদ্রলোক বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন ঠিক সেই রকমই সজ্জন। তাঁর আচরণ ছিল অমায়িক, কথাবার্তায়ও সাধ্যমত শিষ্টতা বজায় রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা করতেন। তার সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে যারপরনাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সৌজন্যবোধের পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আর এ কারণেই আমি তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানা ও বোঝার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়ি।

মি. বেডলোর সম্বন্ধে বিশেষভাবে জানার আগ্রহ আমার যত গভীরই হোক না কেন, নীতিগত বা দেহগত সম্পর্কের দিক থেকেও তাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাধ্যমত সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে সংযত রেখে খোঁজখবর নিয়েও তার পরিবার সম্বন্ধে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য সংগ্রহ করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি কোন অঞ্চলের লোক, কোথা থেকে যে এসেছেন, বহু চেষ্টা করেও করে এ-তথ্যটুকুও সঠিকভাবে জানতে পারলাম না। আর আমি তাকে যুবক বলে মনে করলেও তার বয়সের ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারলাম। কারণ, তার মধ্যে আমি এমনকিছু লক্ষ্য করেছি যা আমাকে তার বয়সের ব্যাপারে পাকাপাকি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার জন্যই আমাকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ-ই যদি সত্য হয় তবে আমি তাকে যুবক বলে বর্ণনা দিলাম কেন, তাই না? প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত, অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার বক্তব্যের যুক্তিও আছে যথেষ্টই। আসলে প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোককে আমার যুবক বলেই মনে হয়েছিল। আবার তিনি কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই যৌবনের কথা বলতেন। তবুও মাঝে মধ্যে তিনি এমন সব কথাও বলতেন যার ফলে তাঁকে যুবক মনে করা তো দূরের ব্যাপার একশো বছরের এক বৃদ্ধ মনে করতেও এতটুকুও দ্বিধা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হত না। তাই তো না বলে পারছি না, অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই প্রাধান্য পেত। মোদ্দা কথা, তার চেহারার বৈশিষ্ট্যটুকুই আমাকে বিভ্রান্তির মুখে সবচেয়ে বেশি করে ঠেলে দেয়। এবার দু-চার কথায় তার চেহারার বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। মি. বেডলোর শরীরটা ছিল রোগাটে, একেবারেই লিকলিকে। আর তিনি লম্বাও কম ছিলেন না। সংক্ষেপে বললে, তিনি ছিলেন ইয়া লম্বা এক রোগাটে চেহারার মানুষ। আর পথ চলার সময় সামনের দিকে একটু বেশি রকমই ঝুঁকে চলতেন। অস্বাভাবিক লম্বা আর পাটকাঠির মতো লিকলিকে। হাড়ের ওপর মাংসের লেশমাত্রও ছিল বলে মনে হত না। আর কপালটা ছিল একটু বেশি রকমই চওড়া ওনিচু। তাঁর মুখটা ছিল চওড়া আর দুপাশে হাড় বের করা। আর নমনীয়ও ছিল বটে। মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকালে সেখানে ছিটেফোঁটা রক্ত ছিল বলেও মনে হত না। তাঁর মুখের আর যে একটা বিশেষত্ব খুব বেশি করে নজরে পড়ত তা হচ্ছে, অসমান দাঁতের পাটি। এমন এলোমেলো এবড়ো খেবড়ো দাঁতের পাটি ইতিপূর্বে অন্য । কারো মুখে আমার অন্তত চোখে পড়েনি।

মি. বেডলো কথা বলার সময় থেকে থেকে অভাবনীয়ভাবে হেসে উঠতেন। এ হাসিটুকু তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনে করা যেতে পারে। তার সে হাসিটুকু বৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও কিন্তু মোটেই আমার বিরক্তির সঞ্চার করত না। আর তার সে হাসিতে কেমন যেন এক অবর্ণনীয় বিষণ্ণতার প্রলেপ মাখানো থাকত। গভীর বিষণ্ণতা। তাঁর চোখ দুটো ছিল বিড়ালের চোখের মতো গোলাকার আর বড়ও ছিল অস্বাভাবিক। কেবলমাত্র আকৃতির দিক থেকেই নয়, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও বিড়ালের চোখের সঙ্গে তার চোখ দুটোর সাদৃশ্য খুব বেশি করে লক্ষিত হত তা হচ্ছে–বিড়াল ও বিড়ালের মতো অন্যান্য প্রাণীর মতো আলো কমা-বাড়ার সঙ্গে চোখ দুটো ছোট-বড় হয়ে যেত। আর যদি তার মধ্যে উত্তেজনা ভর করত তবে মুহূর্তের মধ্যেই চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠত। রীতিমত জ্বল জ্বল করত আর সে দুটো থেকে যে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত তা অবশ্য প্রতিফলিত আলো নয়। তবে? সূর্যরশ্মি বা মোমবাতির আলোর মতো মৌলিক আলো। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ পরিস্থিতিতে তার চোখের উভয় গোলকই একেবারেই নিষ্প্রভ-নিস্তেজ, ঝাপসা আর অস্পষ্ট। সে দুটোর দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘদিন ধরে কবরস্থ থাকা মৃত ব্যক্তির চোখের কথা মনের কোণে উঁকি মেরে উঠত। সত্যি তার চোখ দুটোর দিকে তাকালেই সর্বাঙ্গে যেন কেমন একটা অব্যক্ত কম্পন অনুভব করতাম। আর আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যেত।

আমার সঙ্গে দেখা হলে ভদ্রলোক কথা প্রসঙ্গে বহুবারই নিজের চেহারার এসব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে আফশোস করেছেন। ক্ষোভপ্রকাশও কম করেননি। তারপর দীর্ঘসময় ধরে ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছেন। আমি তার কথা কতখানি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি আর কতখানিই বা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি যাচাই করে উঠতে পারিনি, তার ধারণা নিতেও চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।

সে ভদ্রলোকের সব কথা ধৈর্য্যের সঙ্গে শুনে ও বিচার বিশ্লেষণ করে আমি এ সিদ্ধান্তইনিতাম যে, তিনি দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে আমার মধ্যে যে ধারণা সঞ্চার করতে চাইতেন তা সংক্ষেপে অর্থাৎ সারমর্ম বললে এরকম দাঁড়ায়–আজ আমি তার চেহারা যেমন দেখছি, তিনি কিন্তু চিরদিন হুবহু এমনটা ছিলেন না। তার আগেকার চেহারা ছবির সঙ্গে আজকের চেহারার সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি। আর কারণস্বরূপ তিনি যা আমার কাছে ব্যক্ত করেছেন তা হচ্ছে–একের পর এক বহু স্নায়ুবিক রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে আজ তার এ হাল হয়েছে। তবে এও সত্য যে, তিনি কিন্তু রোগব্যাধি সম্বন্ধে কোনোদিনই উদাসীন ছিলেন না। তিনি অতীতের দীর্ঘদিন টেম্পলটন নামক কোনো এক চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক নাগাড়ে দীর্ঘদিন ধরে হরেকরকম রোগের চিকিৎসা তিনি করেছেন।

ডা. টেম্পলটনের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয় সবরাটোগেতে। তার বয়স তখন সত্তর বছর। প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই তিনি ডাক্তারের কাছে নিজের দৈহিক সমস্যার কথা খোলাখুলি বলতে অনুরোধ করেন, তিনি সুচিন্তিত চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর রোগমুক্তি ঘটলে যারপরনাই বাধিত হবেন। তাঁর অমায়িক সহজ সরল ব্যবহার ও মধুর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে ডা. টেম্পলটন তার চিকিৎসা করতে সম্মত হন।

ডা. টেম্পলটন এবার প্রভূত বিত্ত সম্পদের অধিকারী বেডলোর চিকিৎসায় হাত দিলেন। দিন কয়েক চিকিৎসা করার ফলে তিনি আশাতীত ফল পান।

এবার ডা. টেম্পলটন টাকার কুমির বেডলোর সঙ্গে একটা পাকাপাকি চুক্তি করার প্রয়োজন বোধ করলেন। সে চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল, কি পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি তার চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তারা স্থির সদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন। চুক্তির শর্ত হল–বার্ষিক মোটা অর্থের বিনিময়ে তিনি একমাত্র এ পঙ্গু লোকটার চিকিৎসায় নিজেকে লিপ্ত রাখবেন। নিঃস্বার্থভাবে বা অর্থের বনিময়ে কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি অন্য কারো চিকিৎসাই করতে পারবেন না।

ডা. টেম্পলটন যৌবনে একজন পর্যটক ছিলেন। দেশভ্রমণ করা নেশা ছিল তার, রক্ত মাংস মজ্জার সঙ্গে মিশেছিল। আর এক সময় তিনি যখন প্যারিসে বাস করতেন তখন মেসমারের দলের সঙ্গে মিশে যান। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান।

বর্তমানে ডা. টেম্পলটন তীব্র ব্যথা বেদনার উপশম ঘটানোর জন্য চুম্বকঘটিত ওষুধই ব্যবহার করেন।

ধনকুবের বেড়লো ডা. টেম্পলটনকে দিয়ে চিকিৎসা করানো সুবাদে কথা প্রসঙ্গে তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতির গুপ্তকথা জানতে পারলেন। আর মৈসুরিক গবেষণা, ভাবনা চিন্তা থেকে ওষুধগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর প্রতি তাঁর আস্থা অনেকাংশে বেড়ে গেল। তবে এও সত্য যে, তিনি তার নতুন ছাত্রটার মধ্যে নিজের ভাবনা চিন্তা সঞ্চারিত করতে, পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে দিনের পর দিন প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। তারপর শেষপর্যন্ত দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে সম্মত করতে পারলেন। বেডলো এবার ডা. টেম্পলটনের ওপর পুরোপুরি আস্থাবান হয়ে উঠলেন।

তারপর থেকে রোগ নিরাময়ের বিভিন্ন কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে ডা. টেম্পলটন এবং বেডলোর মধ্যে একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যায়। আর এভাবেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। আমি কিন্তু এমন কথাও বলছি না যে, উভয়ের বোঝাপড়া সহজ-সরল ঘুম-পাড়ানি ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও বিস্তার, লাভ করেছিল। তবে এও খুবই সত্য যে, সে-শক্তিটাই খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু সৈস্নব-বিদ্যার শরবারীর চৌম্বকন্দ্রিালু সৃষ্টির প্রথম প্রয়াস পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল। তিনি কিন্তু এত সহজেই দমলেন না। একের পর এক প্রয়াস চালিয়েই যেতে লাগলেন–চার-চারবার তার প্রয়াস ব্যর্থ হলেও তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না। শেষপর্যন্ত তিনি পঞ্চম বারের প্রয়াসে আংশিক সাফল্য লাভ করলেন। তারপরের বার অর্থাৎ ষষ্ঠবারের প্রয়াসেও তিনি কিছুটা সফল হলেন। অবশ্য প্রতিবারেই তিনি কঠোর পরিশ্রম, নিরবচ্ছিন্ননিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন।

কিন্তু আংশিক সাফল্যে তার মন তো ভরার নয়। তাঁকে পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতেই হবে। অতএব অধিকতর ধৈৰ্য্য ওনিষ্ঠার সঙ্গে তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন হতে হবে। তিনি করলেনও তাই। আবারও গবেষণায় লিপ্ত হলেন–একের পর এক ব্যর্থতা আর আংশিক সাফল্যের পর শেষপর্যন্ত দ্বাদশ প্রয়াসে সৈসব-বিদ্যার চিকিৎসক সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হলেন।

পরীক্ষার সম্পূর্ণ সাফল্যলাভের পর থেকেই রোগীর ইচ্ছাশক্তি খুবই দ্রুত চিকিৎসকের ইচ্ছাশক্তির কাছে নিজেকে সঁপে না দিয়ে পারল না। এবার থেকে উভয়ের ইচ্ছাশক্তির একই মিলিত ধারায় প্রবাহিত হতে লাগল।

আর এ কারণেই রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় ঘটল তখন কেবলমাত্র চিকিৎসকের ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাভূত হয়ে, রোগীর ইচ্ছাশক্তি ক্রমে স্তিমিত হতে হতে এক সময় ম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে, ঘুমিয়ে পড়ে। অচিরেই ঘুমে একেবারে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। এমনকি পঙ্গু রোগীর যদি চিকিৎসকের উপস্থিতির কথা জানা না-ও থাকত, তবু এ রকম কাণ্ড ঘটত। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।

বর্তমানকালে অর্থাৎ ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এমন একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অযৌক্তিক ঘটনা হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন চোখের সামনে দেখছে। আজকের মানুষ আর এরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়ে কিছুমাত্রও অবাক হচ্ছে না। কিন্তু যে সময়ের কথা আমি এখানে ব্যক্ত করছি তখনকার মানুষ এরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা মনে করে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যেত।

একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, বেডলোর কথাবার্তা খুবই মিটমিটে, সহজেই রেগে যান। তবে তার মধ্যে আগ্রহের বিন্দুমাত্রও অভাব কোনোদিনই লক্ষিত হত না। তার কল্পনাশক্তি ছিল বিশেষ রকমের শক্তিশালী, সৃজনশীলও বটে। অবশ্য এ রকমটা ছিল নিয়মিত আফিমের গুলি উদরস্থ করার জন্যই। আর আফিমের পরিমাণ একটু বেশি মাত্রায়ই গ্রহণ করতেন। এও সত্য যে, প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে আফিম না গিলে তার পক্ষে বেঁচে থাকাই ছিল কঠিন সমস্যা। সমস্যা বললে ঠিক বলা হবে না, বরং আফিম না গিলে তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তার কল্পনাশক্তি আরও অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে।

প্রতিদিন সকালে কিছু আহারাদির পর, এক কাপ কফি পানের পরই বেশ কিছু পরিমাণে আফিম খাওয়া ছিল তার অভ্যাস। এ অভ্যাসের এতটুকুও হেরফের হবার জো ছিল না।

আফিম সেবনের পর তিনি মেজাজ চাঙা করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন হাঁটাহাঁটি করতে। কখনও একা, আবার কখনও বা পোষা-প্রিয় কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে চার্লোটেস্–ভিলের দক্ষিণ-পশ্চিমের অরণ্যে ছায়া মনোরম প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পর্বতশ্রেণির গা ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথ ধরে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি যখন নিজের আস্তানায় ফিরে আসতেন, তখন সূর্যদেব পাহাড়ের মাথায় না উঠলেও পাহাড়ের গা-বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠে আসত। সেখানকার অধিবাসীরা ওই পর্বতশ্রেণিকে বন্ধুর পর্বতমালা বলে সম্বোধন করে সম্মান প্রদর্শন করত।

নভেম্বরের শেষের দিকে একদিন। সেদিন সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরম চলছিল। ঘন কুয়াশা প্রকৃতিকে ছেয়ে রেখেছিল। আর কুয়াশার দাপটে সূর্যের আলো একেবারেই ম্লান হয়ে পড়েছিল। এমনই কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে মি. বেড়লো প্রতিদিনের অভ্যাসমত বেড়াতে বেরোলেন। পাহাড়ের প্রায় গা ঘেঁষে এঁকে বেঁকে এগিয়ে-যাওয়া পথ ধরে তিনি হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি কোথায়, কতদূর চলে গেলেন তা তিনি ছাড়া আর কেউ-ই জানতে পারল না। সকাল গিয়ে দুপুর এলো, তারপর এলো দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, আর সবশেষে রাতও ঘনিয়ে এলো। কিন্তু হায়! তিনি ফিরলেন না।

রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। রাত আটটা বেজে গেলেও তিনি ফিরে না আসায় আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে, তাকে খোঁজ করতে লাগলাম। ঠিক তখনই একেবারে অভাবনীয়ভাবে তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে এলেন। তাঁকে দেখে আমরা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।

আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে মি. বেডলোর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিসন্দেহ হলাম, তার শরীরের অবস্থা যেমন থাকার কথা ঠিক তেমনই আছে। তার মধ্যে অসুস্থতার চিহ্নমাত্রও নজরে পড়ল না। একটা ব্যাপার দেখে আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম। কেবল তাঁর চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপই অনুপস্থিত নয়, উপরন্তু চোখের তারায় অবর্ণনীয় হাসির ঝিলিক। তার মেজাজটা বেশি মাত্রায় চাঙা বলেই মনে হল। অর্থাৎ মেজাজ মর্জি খুশিতে ভরপুর।

আমাদের জিজ্ঞাসা দূর করতে গিয়ে মি. বেডলো তার অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ সম্বন্ধে যা-কিছু ব্যক্ত করলেন তা কেবলমাত্র অসাধারণ নয়, যারপনরাই অবিশ্বাস্যও বটে।

মি. বেডলো ঘরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে শরীর এলিয়ে দিলেন। আমরাও তার মুখোমুখি চেয়ার দখল করলাম। আমরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মি. বেডলো এক সময় সোজা হয়ে বসলেন। আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি বাড়ি ফিরতে বিলম্বের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন–আশা করি আপনাদের অবশ্যই মনে আছে, সকাল নয়টার কাছাকাছি আমি চার্লোটেসৃভিল ছেড়ে বেড়াতে বেরোই। সদর দরজা থেকে বেরিয়েই সোজা হাঁটার পর দশটা নাগাদ একটা গিরিখাতের কাছে হাজির হই। আমার কাছে সে জায়গাটা একেবারেই নতুন, অপরিচিত। আমি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে তার ভেতর ঢুকে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুবই উৎসাহের সঙ্গে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে এগিয়ে যাওয়া গিরিখাতটা ধরে কিছু সময় হাঁটলাম। সেখানের চারদিকের দৃশ্যাবলী এমনকিছু মনলোভা না হলেও তাতে এমন এক ভয়ঙ্কও নির্জনতা বিরাজ করছিল যা আমাকে অভিভূত করছিল। তাই আমি অকৃত্রিম আগ্রহের সঙ্গেই পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম, অস্বীকার করতে পারব না।

হাঁটতে হাঁটতে একটা কথাই বার বার আমার মনে হচ্ছিল, আমি যে ধূসর পাহাড়–সবুজ ঘাস আর লতা-গুল্মের ওপর দিয়ে হাঁটছি এখানে ইতিপূর্বে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ দেখা যায়নি। অর্থাৎ আমিই প্রথম মানুষ যে প্রথম এই গিরিখাত ধরে পথ পাড়ি দিচ্ছি। গিরিখাতের প্রবেশ পথটা খুবই নির্জন ছিল। আশপাশ থেকে সামান্যতম শব্দও ভেসে আসছিল না, তার ওপর পথটা খুবই দুর্গম ছিল। অতএব আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমিই সে- যে গিরিখাতটার প্রথম অভিযাত্রী। ব্যাপারটা কিছুমাত্রও অসম্ভব নয়, আর সম্পূর্ণ সত্যও বটে।

ঘন কুয়াশার একটা চাদর, ধোয়াও হতে পারে, সবকিছুকে মুড়ে রেখেছে। সবই অস্পষ্ট, একেবারেই ঝাপসা, আর এজন্যই পরিবেশটা সম্পর্কে আমার ধারণাটা ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে পড়তে লাগল।

অসম্ভব! আমি সামনে-পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কি করেই বা সম্ভব হবে? কুয়াশার আস্তরণটা এতই গাঢ় ছিল যে, আমার সামনের পথটার বারো গজ দূরের কোনোকিছুকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না, সবই সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, ঝাপসা, আর পথটা ছিল খুবই দুর্গম। সত্যি কথা বলতে কি, এমন পথে হাঁটাচলা করা নিতান্তই সমস্যার-ব্যাপার।

কুয়াশায় চারদিক এমনভাবে ছেয়ে রেখেছে যে, সূর্যের অস্তিত্বও বুঝা যাচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অল্প সময়ের মধ্যেই দিক হারিয়ে ফেললাম। কোন্ দিকে যে চলেছি কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।

দিকভ্রম হলেও আমি কিন্তু চলা অব্যাহত রাখি। এরই মধ্যে আমার ভেতরে আফিমের কাজও শুরু হয়ে যায়। ব্যাপারটা আমি কিছুটা অনুমানও করতে পারছিলাম। আর এরই ফলে সমস্ত বৰ্হিজগষ্টা সম্বন্ধে আমার মনে আগ্রহ-উৎসাহ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। সবকিছু জানার, বুঝার আগ্রহের কথা বলতে চাচ্ছি।

আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা ভাবনার উদয় হল। বিশ্বব্যাপী এক ইঙ্গিতের কথা বলতে চাইছি, এলোমলো ভাবনা-চিন্তার এক আনন্দমধুর ধারা। একটা পাতা তির তির করে কেঁপে ওঠার মাধ্যমে, ঘাসের ডগার ঘন সবুজ রঙে, একটা ত্রিপটের আকৃতির মধ্যে একটা মৌমাছির গুণ গুণ ধ্বনিতে, ঘাসের ওপর জমে-থাকা একটা শিশির বিন্দুর ঝকমকিতে হালকা বাতাসের একটা নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আর বনের ভেতর থেকে ভেসে-আসা অজানা অচেনা অস্পষ্ট গন্ধের মধ্য দিয়ে আমি বিশ্বব্যাপী একটা ইঙ্গিত খুঁজে পাই। আর সব মিলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে এলোমেলো চিন্তার অদ্ভুত একটা ধারা। সত্যি, সে কী বিচিত্র এক ধারা তা সত্যি আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না–আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।

এমন বহু কথা ভাবতে ভাবতে আমি পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। আমি ঘন কুয়াশার আস্তরণ অগ্রাহ্য করে হাঁটছি তো হাঁটছিই। একটু একটু করে এগোতে এগোতে কয়েক ঘণ্টায় অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে ফেললাম। কিন্তু কয় ঘণ্টা ধরে হাঁটলাম, আর পথই বা কতখানি পাড়ি দিয়েছি, কিছুই সঠিক করে বলতে পারব না।

ইতিমধ্যে কুয়াশার চাদরটা ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে, পথ চলাই আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দেখা দিল। কিন্তু তবুও আমার গতি স্তব্ধ করে দিতে পারল না। কোন্ মোহের বশবর্তী হয়ে, কোন্ আকর্ষণে যে আমি এগিয়ে চলার দুর্নিবার আকর্ষণ ভেতর থেকে অনুভব করতে লাগলাম তার কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। আসলে আমি যেন তখন বাধা বন্ধনহীন এক আজন্ম পথিক। পথ যেন আমাকে অনবরত হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। আর সে ডাকে সাড়া না দিয়ে আমার যেন দ্বিতীয় কোনো উপায়ই ছিল না।

কুয়াশা! কুয়াশা! আর কুয়াশা! কোনো অদৃশ্য হাত যেন ঘন কুয়াশার পাহাড়, পার্বত্য উপত্যকা আর অদূরবর্তী পার্বত্য বনানীর ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। আর এরই জন্য আমার অতি কাছের একেবারে হাতের নাগালের মধ্যের জিনিসগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখন উপায়। এ পরিস্থিতিতে পথ পাড়ি দেওয়া যে বাস্তবিকই মহাসমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

না, এত সহজে হার মানার পাত্র আমি নই। আমাকে এগিয়ে যেতেই হবে, দেখতে হবে এ পথের শেষ কোথায়।

আমি পথ হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে ধীর-পায়ে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। ঠিক তখনই আমি একটা অভাবনীয়, একেবারেই অবর্ণনীয় অস্বস্তির শিকার হয়ে পড়লাম। কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে যে আমার পা দুটো থেমে গেছে বলতে পারব না।

অস্বস্তি! হ্যাঁ, অবর্ণনীয় অস্বস্তিই বটে। এক অভাবনীয় স্নায়ুবিক দ্বিধা আমার মধ্যে ভর করল। এক অভাবনীয় কম্পনও অনুভব করতে লাগলাম। একেই বুঝি বলে, অনিশ্চিত বিপাশঙ্কায় কুঁকড়ে যাওয়া।

.

হায়! এ কী মহাসঙ্কটে পড়ে গেলাম। আতঙ্কে বুকের ভেতরে রীতিমত ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেল। পা ফেলতেও ভরসা হচ্ছে না, ভয় হচ্ছে, পা ফসকে যদি কোনো গভীর ফাঁদে পড়ে যাই তবে মৃত্যুর নিশ্চিত শিকার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।

কুয়াশার চাদর গায়ে চাপিয়ে, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কর্তব্য নির্ধারণে মগ্ন হলাম। সে অবস্থানকালে কতসব অদ্ভুত গল্প-কথা যে মনের কোণে উঁকি দিতে লাগল তা বলে শেষ করা যাবে না। এখানকার পাহাড়ের গুহা আর বনজঙ্গলে নাকি বিচিত্র আর খুবই হিংস্র প্রকৃতির মানুষ বাস করে। তারা সুযোগের সন্ধানে এখানে ওখানে ওৎ পেতে বসে থাকে। মওকা বুঝে অতর্কিতে পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্যস, তারপরের কথা না-ই বা বললাম।

একের পর এক, হাজার হাজার অদ্ভুত কল্পনা আমার মধ্যে ভর করল। আমার মন-প্রাণ সে সব কাল্পনিক বিপদাশঙ্কায় অবশ হয়ে পড়তে লাগল। তবে এও স্বীকার না করে উপায় নেই, আবছা বলেই সেগুলো আমার মধ্যে আরও বেশি করে প্রভাব। বিস্তার করেছে, আরও–বেশি আতঙ্ক সঞ্চার করেছে।

আমি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে, অন্ধকার পথের মাঝে দাঁড়িয়ে কর্তব্য স্থির করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই মাদলের বাদ্য বাতাস বাহিত হয়ে আমার কানে এসে লাগল। আওয়াজটা খুব জোরোলোই শোনাল। মনে হল, কাছেই কে বা কারা জোরে জোরে। মাদল বাজাচ্ছে।

আমি উকর্ণ হয়ে সে আওয়াজটা শুনলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, মাদলই বটে।

ব্যস, মুহূর্তে আমার বিস্ময় তুঙ্গে উঠে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও আমার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বিস্ময় বিমূঢ় অবস্থায় আমি ভাবতে লাগলাম, এখানকার পর্বত আর পার্বত্য বনাঞ্চলের মানুষ তো কোনোদিন মাদল দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে? এখানে কে বা কারা মাদল বাজাচ্ছে। এ কী অদ্ভুত কাণ্ডরে বাবা!

।মাদলের বাদ্য না শুনে আমি যদি শ্রেষ্ঠ দেবদূতের বাঁশির সুর শুনতে পেতাম তবুও হয়তো বা বিস্ময়ে এমন হতবাক হয়ে পড়তাম না। আমি যখন মাদলের বাদ্যের রহস্য ভেদ করতে ব্যস্ত ঠিক সে মুহূর্তেই আমার বিস্ময়, আগ্রহ, বিহ্বলতার মধ্যে আরও অদ্ভুত, একেরারেই অবিশ্বাস্য একটা কারণ আমার সামনে দেখা দিল। আচমকা একটা শব্দ আমার কানে এলো। মনে হল, আমার কাছে, একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে অবস্থানরত কেউ একজন একটা চাবির গোছা হাতে নিয়ে ঘন ঘন নাচিয়ে চরেছে। আগের বারের মতোই উকর্ণ হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। হ্যাঁ, চাবির ‘গাছার শব্দ ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না।

আরে বাবা। আমি সচকিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক লাফে দুপা পিছিয়ে গেলাম। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল। নাড়ির গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর।

পরমুহূর্তেই এক দীর্ঘাকৃতি কালো অর্ধনগ্ন মানুষ বিকট স্বরে আর্তনাদ করতে করতে আমার পাশ দিয়ে ধরতে গেলে প্রায় গা-ঘেঁষে উদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। সে আমার এত কাছ দিয়ে দৌড়ে গেল যে আমার মুখে তার গরম নিশ্বাস পর্যন্ত স্পষ্ট অনুভব করলাম। অজানা-অচেনা জায়গায়, জমাটবাধা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে এমন অভাবনীয় একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হলে এমন কোন্ বীরপুরুষ আছে যে নিজেকে স্থির রাখতে পারে? সত্য গোপন না করলে, বলতেই হয় সে মুহূর্তে আকস্মিক আতঙ্কে আমি রীতিমত মুষড়ে পড়েছিলাম। পরিস্থিতি খারাপ অনুমান করে আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে সাধ্যমত পথের একধারে সরে গেলাম। আমার হাঁটু দুটো অজানা বিপদাশঙ্কায় থর থর করে কাঁপতে লাগল।

ভয়ালদর্শন লোকটার হাতে নোঙরেরর মতো ইস্পাতের একটা যন্ত্র অনেকগুলো ইস্পাতের আংটা একত্রিত করে যন্ত্রটা তৈরি করা হয়েছে।

লোকটা আমাকে অতিক্রম করে যেতে না যেতেই প্রকাণ্ড একটা জন্তুকে তার দিকে ধেয়ে যেতে দেখলাম।

অনুসন্ধিৎসু নজরে ভয়ঙ্কর সে জন্তুটার দিকে তাকিয়ে খুবই আবছা আলোয় মনে হলো সেটা অতিকায় একটা হায়না। প্রচণ্ড আক্রোশে সেটা অনবরত তীব্র গর্জন করে চলেছে। গর্জন করার ফাঁকে ফাঁকে ইয়া বড় হাঁ করছে। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।

এবার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। লোকটা কেন তার হাতের ইস্পাতের আংটার মতো যন্ত্রটাকে বার বার এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে ছুটে চলেছে। হায়না। ক্ষুধার্ত হায়না।

ক্ষুধার্ত রাক্ষসটাকে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আতঙ্কে, অনিশ্চিত বিপদামঙ্কায় আমার বুকের ভেতরে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু অতিকায় হিংস্র জন্তুটাকে দেখামাত্র আমার আতঙ্ক বেড়ে না গিয়ে বরং দ্রুত কমে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে লাগলাম।

আমার মধ্যে এমন অভাবনীয় আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ কি? কারণ খুবই স্বাভাবিক। আমি যে এতক্ষণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছিলাম সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে এবার আমি জাগ্রত চেতনায় ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমি নিজেকে সামলে সুমলে বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলাম। এবার সাহসে ভর করে ধীরপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

সামনের দিকে দু-তিন পা এগোতে না এগোতেই আমার গলা দিয়ে বুক ফাটা আর্তস্বর বেরিয়ে এলো। আমার বিকট আর্তনাদে চারদিক কেঁপে ওঠার জোগাড় হল। হাত দুটো পিঠ দিয়ে চোখ দুটোকে কচলে নিলাম আবার! আবার আগেকার মতো

বুকের ধুককুড়ানি শুরু হয়ে গেল। নখ দিয়ে নিজের শরীরেই সাধ্যমত বল প্রয়োগ করে। চিমটি কাটলাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে কোনোরকমে আরও কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কুল কুল শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগল। নিচু হয়ে, বার বার এদিক-ওদিক হেলে নিঃসন্দেহ হলাম, কুল কুল ধ্বনিটার উৎস আর কিছু নয়, পর্বতের গা-বেয়ে নেমে-আসা একটা ঝর্ণা।

আমি গুটি গুটি হেঁটে ঝর্ণাটার একেবারে গা-ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালাম, কোমর বাঁকিয়ে ঝর্ণাটার ওপর ঝুঁকে, প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হাত ভরে ঠাণ্ডা পানি তুলে তুলে চোখ-মুখে, কানে ও কপালে দিতে লাগলাম।

ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে আমার শরীর কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। মনের ঘোরও ক্রমে কেটে যেতে লাগল। অচিরেই আমার দেহ-মনের অস্বস্তি কেটে যাওয়ায় আমি একজন সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বনে গেলাম। আমি উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। না, আমার মধ্যে আর তিলমাত্র দ্বিধাও অবশিষ্ট নেই। আমি যেন সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ।

এবার আমার আবার নতুন করে হাঁটা শুরু করার পালা। অজানা অচেনা পথে, ধীর-স্থির-শান্ত পদক্ষেপে আমি আবার চলতে শুরু করলাম। আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই। এ হাঁটার যেন আর বিরাম নেই, শেষ নেই।

আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। পা দুটো যেন বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে। নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমি পথের ধারের একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গাছের পাতার ছায়া পড়ল সবুজ ঘাসের ওপরে। আমি অপলক চোখে টুকরো টুকরো ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছায়ার আকৃতি আমার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করল। মনের দ্বিধা কাটাতে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, যা অনুমান করেছিলাম ঠিক তা-ই। আমি একটা তালগাছের তলায় বসে।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বসে আরাম আয়েশ করে নষ্ট করার মতো যতেষ্ট সময় আমার হাতে নেই। স্বপ্ন দেখার মতো সময় তো অবশ্যই নেই। আমি লক্ষ্য করলাম, দেখলাম, বুঝতেও পারলাম স্পষ্টই। আমার ইন্দ্রিয়গুলো এখনও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি, বরং বশেই আছে। আর সেগুলোই আমার সামনে, অন্তরের অন্তঃস্থলের সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতির জগতের দরজা খুলে দিল।

অনেকক্ষণ পর নিজের সম্বন্ধে ভাববার মতো অবকাশ ও মানসিক অবস্থা ফিরে পেলাম। একেবারে মুহূর্তের মধ্যেই যেন গরমটা অসহ্য বোধ হতে লাগল। এতক্ষণ গরম বা ঠাণ্ডা কোনো কিছুই অনুভব করিনি।

মন চাঙা-করা সুগন্ধ বাতাস বাহিত হয়ে আমার নাকে এসে লাগতে লাগল। আর বর্ষার ভরা নদীর শান্ত স্রোতের মতো চাপা একটা কুল কুল ধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আর তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে অগণিত মানুষের গুণগুণানি। এ যেন এক সম্পূর্ণ নতুনতর অনুভূতি।

আমি যখন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সে গুণগুনানি শুনছি ঠিক সে সময়েই সেখান থেকে দমকা একটা বাতাসের যাদুকাঠি ছুটে এসে যেন ঘন কুয়াশার আস্তরণটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। চারিদিক একেবারে স্বচ্ছ। কুয়াশা বা অন্ধকারের লেশমাত্রও নেই।

আমি যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। অনুসন্ধিৎসু নজরে চারদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি যেন সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ওপর চোখের মণি দুটো বুলিয়ে চলেছি। আর প্রান্তরটার বুক চিড়ে আকাবাঁকা পথে হেলে দুলে বয়ে চলেছে বিশাল একটা নদী। আর নদীটার গা-ঘেঁষে অবস্থান করছে প্রাচ্য ধরনের একটা নগর। আমার আরব্য উপন্যাসের পাতায় যেরকম নগরের বিবরণ দেখতে পাই, ঠিক সে-রকম কোনো নগর অবশ্যই নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের।

আমি তখন শহরটা থেকে বেশ দূরে এবং অনেকটা উঁচুতে অবস্থান করছিলাম। তাই শহরটার বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট ও বাগান প্রভৃতি সবকিছুকে পটে আঁকা ছবির মতোই আমার মনে হতে লাগল।

শহরটার অসংখ্য রাস্তাগুলো বেশ চওড়া। তবে সদর রাস্তার তুলনায় ছোট-বড় ও আঁকাবাঁকা গলির সংখ্যাই বেশি।

আর পথে পথে মানুষ যেন একেবারে গিজগিজ করছে, অনবরত মানুষের মিছিল চলেছে।

পথের ধারে সারিবদ্ধভাবে একের পর এক বাড়ি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তাদের বারান্দা, গাড়ি-বারান্দা, আকাশচুম্বি মিনার আর মনলোভা কারুকার্যমণ্ডিত জানালাগুলো যে কোনো সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষের বিস্ময় উৎপাদন করতে বাধ্য।

শহরটার এখানে-ওখানে বাজার তো রয়েছেই, আর সুসজ্জিত দোকানপটেরও অভাব নেই। দোকানগুলোতে কতরকম জিনিসপত্র যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার । ইয়ত্তা নেই। দোকানে দোকানে দেখা যাচ্ছে কাঁচের আলমারিতে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পান্না, হীরা, মণি, মুক্তার অলঙ্কারাদি। কোনোটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বহুমূল্য মসলিন আর রেশমিবস্তু আবার কোনোটিতে বা শোভা পাচ্ছে চকচকে ঝকঝকে ছুরি-কাঁচি ও অন্যান্য ও অত্যাবশ্যক অস্ত্রপাতি। আরও কত কী যে দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

আর সদর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে, অবগুণ্ঠনে ঢাকা পাল্কি, মহিলা বহনকারী শিবিকা। আর বহুমূল্য মসলিন ও জরি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো হাতি মনিবকে পিঠে, নিয়ে দুলকি চালে পথ পাড়ি দেওয়ার দৃশ্যটাও কম দৃষ্টিনন্দন নয়।

পথচারীদের কতাবার্তা চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর হৈ চৈ আর ভিড়ের মধ্যে ঝলমলে রাজপোশাকে সজ্জিত হয়ে, মাথায় বাহারি পাগড়ি চাপিয়ে বুক পর্যন্ত নেমে-আসা লম্বা দাড়িওয়ালা লক্ষ লক্ষ কুচকুচে কালো ও হলদেটে মানুষের ভিড়ে অগণিত পবিত্র ষাঁড় নির্ভয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আকাশচুম্বি মিনার, মসজিদের কার্নির্স আর উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর পবিত্র জানালায়র গায়ে ময়লা জড়ানো হাজার হাজার হনুমান বিচিত্র ভঙ্গিতে ঝুলে রয়েছে। এ যেন সত্যি বড় অদ্ভুত এক দৃশ্য।

নদীর তীর ঘেঁষে জনবহুল সদর রাস্তা এগিয়ে গেছে। সেটা থেকে নদীর পানি পর্যন্ত বহু ঘাট নেমে গেছে। এগুলো শহরবাসীদের স্নানের ঘাট।

আর নদীর হালকা ঢেউয়ের ওপর দিয়ে মাল বোঝাই বড় বড় জাহাজ এগিয়ে চলেছে। পালতোলা নৌকার সংখ্যাও কম নয়।

শহরের সীমানার বাইরে থেকে সারি সারি তাল ও অন্যান্য আকাশছোঁয়া গাছ উঁকি দিচ্ছে। ছোট-বড় বহু ফল বাগিচার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চাষের ক্ষেত। কোনো কোনোটাতে ফসলও ফলেছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর। সুবিশাল একটা জলাশয় আর নির্জন পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ অথচ বেশ বড় সড় একটা মন্দির। পথের ধারে, মাঠের গায়ে বেদেদের তাঁবুও দেখা যাচ্ছে। মাথায় কলসি নিয়ে এক মেয়েমানুষ সিঁড়ি বেয়ে নদীর ঘাটে নামতে দেখা যাচ্ছে। আমি স্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলেই এমন কথা শোনাচ্ছি, আপনারা হয়তো বলবেন। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। আমি যা-কিছু চাক্ষুষ করেছি, যা-কিছু শুনেছি, অন্তর দিয়ে যা-কিছু উপলব্ধি করেছি আর ভেবেছি–তার মধ্যে স্বপ্ন দেখার কোনো ব্যাপার-স্যাপার তো দূরের ব্যাপার সামান্যতম খামখেয়ালির স্থানও ছিল না। আরও পরিষ্কার করে বললে সবকিছুর মধ্যেই সামঞ্জস্যের ছোঁয়া ছিল পুরোদস্তুর।

তবে স্বীকার করছি, গোড়ার দিকে আমি সন্দেহের দোলায় দুলছিলাম। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বার বার সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। আমি ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছি, নাকি পুরোপুরি জেগে আছি। ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কম করিনি। আর তার পরই আমি বুঝতে পারলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, আমি সত্যি সত্যি জেগেই আছি। তাই তো এসব দৃশ্যকে আমি সম্পূর্ণ বাস্তব, শতকরা একশো ভাগই সত্য ঘটনা বলেই মনে। করছি, অতএব,

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ডাক্তার টেম্পলটন আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন–‘দেখুন ভাই, আমি অবশ্য ব্যাপারটা, নিয়ে বড় একটা ভাবিত নই, তবে বলছি, আপনি নির্দিধায় চালিয়ে যান, আমি শুনছি।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মি. বেডলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘আপনি গাছতলা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে এগোতে লাগলেন, তাই তো বললেন, ঠিক কি না?

‘হ্যাঁ, আমি শহরের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

‘তারপর? তারপর কী হল?

চোখের তারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে মি. বেডলো ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যেই বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটিয়ে নিয়ে আবার মুখ খুললেন–হ্যাঁ, বলেছেন ঠিকই। আমি গাছের তলার ঘাসের বিছানার আশ্রয় ছেড়ে উঠে পায়ে পায়ে শহরের দিকে এগোতে লাগলাম।

ডাক্তার টেম্পলটন চশমার ফাঁক দিয়ে মি. বেডলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তার কথাগুলো গিলতে লাগলেন।

মি. বেডলো বলে চললেন–‘শহরের দিকে এগোবার সময় পথে বহু লোকজনের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হল। দেখলাম, সবাই ভিড় করে ব্যস্ত পায়ে একই দিকে চলেছে। আর এও লক্ষ্য করলাম, সবার মুখেই উত্তেজনার ছাপ সুস্পষ্ট। ব্যাপারটা আমাকে যে কেন এত ভাবিয়ে তুলল বুঝতে পারলাম না। সত্য গোপন না করলে বলতেই হয়, ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি যারপরনাই কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়লাম। আর এও। স্বীকার করে নিচ্ছি, ভীড় করে এগিয়ে চলা লোকজনের ওপর আমার মনে তীব্র একটা শত্রুতার ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

আমি পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো সেখান থেকে সরে পড়লাম। সাধ্যমত দ্রুততার সঙ্গে পা চালিয়ে ঘুর পথে শহরে হাজির হয়ে গেলাম।

আমি শহরে পা দিয়েই দেখি, শহর জুড়ে হৈ হট্টগোল চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলমাল তুঙ্গে উঠে গেল। ব্যস, দেখতে দেখতে বেঁধে গেল তুমুল লড়াই। দল দুইটির মধ্যে একদল আধা বৃটিশ ইউনিফর্ম পরিহিত পদস্থ অফিসারগণ আর আধা বৃটিশ ও আধা ভারতীয় পোষাক পরিহিত মানুষের ছোট একটা দল। আর বিপক্ষে লড়াই করছে, বিভিন্ন গলিপথ থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্ট প্রকৃতির একদল লোক।

হ্যাঁ, তুমুল গণ্ডগোল চলতে লাগল। আমি অদূরবর্তী পথের ধারে দাঁড়িয়ে কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবতে লাগলাম। মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললাম, লড়াইয়ে ভিড়ে যাওয়াই সঙ্গত মনে করলাম। আমি এক লাফে এগিয়ে গিয়ে কোনো এক মৃত অফিসারের হাত থেকে ছিটকে পড়া অস্ত্রপাতি কুড়িয়ে নিয়ে দুর্বলতর দলটার হয়ে লড়াইয়ে মেতে গেলাম।

কাদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে, কেনই বা লড়াইয়ের সূত্রপাত কোনোকিছু বিচার বিবেচনা না করেই আমি এলোপাথাড়ি অস্ত্র চালাতে লাগলাম। সে যে কী লড়াই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আমাদের দলটা হেরে গেল। একমাত্র সংখ্যাধিক্যের চাপে পড়ে আমাদের পরাজয় স্বীকার করতেই হল। কোনো উপায় না দেখে আমরা রণক্ষেত্র ছেড়ে চম্পট দিলাম। উর্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম ছাদহীন একটা ঘরে। মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে চারদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে তখনকার মতো কিছুটা অন্তত নিরাপদ এবং নিশ্চিন্ত হলাম।

ছাউনিটার মাথার দিকের একটা বড়সড় ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে পেলাম, উত্তেজিত জনতার বিরাট একটা দল নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদোপম সুবিশাল একটা বাড়ির ওপর চড়াও হয়েছে, তীব্র আক্রমণ চালাচ্ছে।

বাড়িটার দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। উপরের দিককার খোলা-জানালা ভেতর থেকে যেন ইয়া মোটা একটা দড়ি নিচে নেমে এসেছে। পাগড়ির কাপড় দিয়ে তৈরি দড়ি। আর সে দড়িটা বেয়ে মেয়ে মানুষের মতো দেখতে একটা লোক তরতর করে নিচে নেমে যাচ্ছে।

নদীর পাড়ে একটা নৌকা আগে থেকেই মোটা একটা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মেয়েলি চেহারার লেকটা দড়ি বেয়ে নিচে নেমেই ব্যস্ত পায়ে নৌকাটায় চেপে বসল। বাঁধন খুলতেই সেই নৌকাটা স্রোতের টানে এগিয়ে চলল। লোকটা নদীর বিপরীত তীরে গিয়ে উঠল। পালিয়ে গেল নির্বিবাদে, তার গায়ে কাঁটার আঁচড়টিও কেউ দিতে পারল না।

আমার মাথায় এবার একটা নতুন পরিকল্পনা খেলল। মতলবটা একেবারেই নতুন। বন্ধুদের কাছে খুব সংক্ষেপে সেটা ব্যক্ত করলাম। আমার পরিকল্পনাটা শোনামাত্র তারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেল।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে চালা ঘরটা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শত্রুপক্ষ আমাদের হঠাৎ এবং জোরদার আক্রমণের চাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। বে-কায়দা বুঝে, হঠাৎ করে কর্তব্য স্থির করতে না পেরে তারা পড়ি কি মরি করে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, সবাই গলিতে-গলিতে গিয়ে গা-ঢাকা দিল।

তারা কিন্তু হাত-পা গুটিয়েনিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইল না। দুদিকের গলিগুলো থেকেই তীর আর বর্শা নিয়ে আমাদের ওপরে আক্রমণ চালাতে লাগল। উভয়দিক থেকে ঘন ঘন বৃষ্টির মতো তীর আর বর্শা ছুটে আসতে লাগল।

তীরের ফলাগুলো কী যে মারাত্মক তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যাকে বলে যথার্থ মারণাস্ত্র। একমাত্র মালয় দেশের অস্ত্র বাঁকা কিরিচের সঙ্গেই সেগুলোর তুলনা চলতে পারে। তীরের ফলার মাথায় যে কেবলমাত্র বিষ মাখানো তা-ই নয়, সেগুলো। সর্পাকৃতি। আর লম্বাটে ও কুচকুচে কালো। সেগুলো এক নজরে দেখলেই আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যায়।

আতঙ্ক! আতঙ্কের পর আতঙ্ক। আচমকা একটা তীর ছুটে এসে সোজা আমার কপালে গেঁথে গেল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় ঝিমঝিমানি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই মাথাটা চক্কর মেরে উঠল। আমি হুমড়ি খেয়ে পথে পড়ে গেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তবু আমি হাত থেকে অস্ত্রটা ফেললাম না। দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও অনেকক্ষণ লড়ে গেলাম। এবার বিষ-জ্বালা সহ্যাতীত হয়ে পড়ল। হাঁপও ধরে গেল। আর টিকে থাকতে পারলাম না, মরে গেলাম। শেষ। আমার সব শেষ হয়ে গেল।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আমি আবার মুখ খুললাম–‘ডাক্তার টেম্পলটন, আশা করি এতকিছু শোনার পর আর আগের মতো বলবেন না যে, আপনার গোটা

অভিযানটাকে একটা স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে উৎসাহ পাচ্ছি না।’

ডাক্তার টেম্পলটন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন।

আমি এবার বললাম–‘ডাক্তার টেম্পলটন, আশা করি আপনি অবশ্যই বলতে উৎসাহি হবেন না যে, আপনি মৃত, কী বলেন?

ডাক্তার টেম্পলটন এবার নীরবে মুচকি হাসলেন।

আমি মি. বেডলোর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তাকেও নীরব দেখে আমি অবাকই হলাম। আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, তার কাছ থেকে মোক্ষম একটা মন্তব্য শুনতে পাব। কি আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ্য করলাম, ইতস্তত করছে। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, থর থরিয়ে কাঁপছে। মুখটা ফ্যাকাশে, রক্ত শূন্য। ছাইয়ের মতো বিবর্ণ সাদাটে হয়ে গেছে। তিনি নীরব, মুখে কলুপ এঁটে বসে রইলেন। টু-শব্দটিও করলেন না।

আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে আবার ডাক্তার টেম্পলটনের মুখের দিকে তাকালাম। তার অবস্থা দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার জোগাড় হলাম। দেখলাম, তিনি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কাঠের মতো সোজা ও শক্ত হয়ে চেয়ার আঁকড়ে বসে। ঘন ঘন দাঁতে দাঁত লাগার রীতিমত ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। আর চোখ দুটো ইয়া বড় বড়। নিশ্চল-নিথর। কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

পর মুহূর্তেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে, বুকে শক্তি ও সাহস সঞ্চার করে কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন–‘মি. বেডলো থামলেন কেন? বলে যান। তারপর কি হলো, বলুন?

বেডলো নিজের চেয়ারে একটু নড়েচড়ে আয়েশ করে বসলেন। তারপর আবার মুখ খুললেন ‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম–দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার একমাত্র অনুভূতি কি ছিল জানেন ডাক্তার টেম্পলটন?

ডাক্তার টেম্পলটন ভাঙা ভাঙা গলায় কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন–কী? কীসের কথা বলছেন?

‘বলতে চাইছি, অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার একমাত্র অনুভূতি ছিল, জমাটবাধা অন্ধকারের আর অস্তিত্বহীনতার।

‘অস্তিত্বহীনতার।

‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। আর সঙ্গে ছিল মৃত্যুচেতনা। আর শেষ পর্যন্ত আমার বোধ হলো অকস্মাৎ একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ যেন আমার বুকের ভেতর তোলপাড় করতে লাগল। সে যে কী অবস্থা তা বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে যে সেটা একটা অনুভূতি মাত্র, চোখে দেখা বা স্পর্শ করে উপস্থিতি অনুভব করার ব্যাপার নয়।

আমি যেন যন্ত্রচালিতের মতো মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

খুবই সত্য যে, চোখে দেখা, কানে শোনা বা শারীরিক দিক থেকে তখনকার মতো গ্রাহ্য করার মতো কোনোরকম উপস্থিতিই আমার মধ্যে ছিল না।

এক সময় জনতার উত্তেজনা থেমে গেল। এক এক করে সবাই চলে গেল। পথঘাট ধরতে গেলে জনমানবশূন্য হয়ে পড়ল। গোলমালের চিহ্নমাত্রও আর রইল না। শহরের পরিবেশ শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এলো।

আমার শবদেহটা আমারই পায়ের তলায় অবস্থান করছে। তীরটা কপালে গেঁথে রয়েছে। আর মাথাটা ফুলতে ফুলতে ইয়া বড়, খুবই বিকট আকার ধারণ করেছে। বুঝার উপায় নেই, সেটা আমার, কোনো মানুষের মাথা হতে পারে। তবে যা-কিছু বলছি সবই আমার ধারণা–অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা, কোনোটাই বাস্তব চোখের সামনে দেখা ব্যাপার অবশ্যই নয়। আবারও বলছি, কোনো ব্যাপারেই আমার আগ্রহ উৎসাহের লেশমাত্রও ছিল না। এখনও বলছি, এমনকি আমার শবদেহটার। ব্যাপারেও আমার মধ্যে কোনোরকম আগ্রহ ছিল না। বরং এ ব্যাপারে আমি একেবারেই উদাসীন, সম্পূর্ণ নিস্পৃহ।

আমার মধ্যে আগ্রহ না থাকলেও কেবলই যেন মনে হতে লাগল, কে যেন গোপন অন্তরাল থেকে আমাকে সেখান থেকে কেটে পড়ার জন্য বার বার উস্কানি দিতে লাগল।

আমি শেষপর্যন্ত সেখান থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারলাম না। তাই যে ঘুরপথে আমি শহরে ঢুকেছিলাম সে পথ অনুসরণ করে আমি ব্যস্ত-পায়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

উৰ্দ্ধশ্বাসে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেখানে হায়নাটাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেরেছিলাম ঠিক সে জাগায়টাতেই আবার এসে হাজির হলাম। সে জায়গাটাকে চিনতে পারামাত্র আমি যেন আচমকা বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে গেলাম। ভার, আগেকার সেই ইচ্ছাশক্তি আর অস্তিত্ববোধ আমার মধ্যে ফিরে আসতে লাগল।

একসময় আপন অস্তিত্ব আমার মধ্যে পুরোপুরি জেগে উঠল।

হ্যাঁ, আমি আবার আপন সত্ত্বা ফিরে পেলাম। সম্বিৎ যে আমি সম্পূর্ণরূপে ফিরে পেয়েছি তা উপলব্ধি করতে আমার দেরি হলো না।

এবার আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখন আমার একটা মাত্রই ভাবনা, কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

কিন্তু অতীতকার বাস্তবতাকে অবশ্যই বিস্মৃত হলো না। এর মধ্যে অবাস্তব ব্যাপার-স্যাপার কী-ই বা আছে তা তো আমি ভেবে উঠতে পারলাম না। সম্পূর্ণ বাস্তব যা-কিছু তাদের স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া কি করে সম্ভব, বলুন? ডাক্তার টেম্পলটন নির্দিধায় বললেন–সেটা স্বপ্ন ছিল না এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কিছুমাত্রও নেই। কিন্তু সেটাকে যে কোন নামে অভিহিত করা যায় তা-ও তো ভাববার ব্যাপারই বটে।

মি. বেডলো তাঁর দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলেন।

ডাক্তার টেম্পলটন তাঁর বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন–‘দেখুন, আমরা শুধুমাত্র এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, বর্তমান যুগের মানুষের মন, মানুষের চিন্তাধারা বিরাট একটা আবিষ্কার করতে চলেছে।

‘আবিষ্কার?

‘হ্যাঁ, আবিষ্কার। একেবারেই অভিনব এক আবিষ্কার। তবে এও সত্য যে, এ পর্যন্ত জেনেই আমাদের তুষ্ট থাকতে হবে, আত্মতৃপ্তি লাভ করতে হবে। আর বাকিটার সামান্যতম ব্যাখ্যা আমি করছি।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে ডাক্তার টেম্পলটন একটা ছবির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন–এই যে ছবিটা দেখছেন, ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। অবশ্য আমার উচিত ছিল আগেই আপনাকে এটা দেখিয়ে রাখা।

মি. বেড়লো কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আসলে ডাক্তার টেম্পলটন তাকে সে সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন–হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, ছবিটা কেন আমি আগেই দেখাইনি, ঠিক কি না? এর উত্তরে আমি বলব, বর্ণনাতীত একটা আতঙ্কের জন্যই এতদিন ছবিটা দেখানো সম্ভব হয়নি।

তাঁর অঙ্গুলি-নির্দেশিত পথে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আমরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি দীর্ঘসময় ধরে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে, ভালোভাবে লক্ষ্য করেও ছবিটার মধ্যে এমনকিছু পেলাম না যা আমার কাছে অসাধারণ বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হবে।

ছবিটার মধ্যে আমি অসাধারণ কিছু খুঁজে না পেলেও মি. বেডলোর কাছে তার বিশেষ প্রতিক্রিয়া হল।

আমি লক্ষ্য করলাম, ছবিটা দেখা মাত্র মি. বেডলোর চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন বদলে গেল। তিনি প্রায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলেন।

আসলে ছবিটা তো মি. বেডলোরই ছোট একটা প্রতিকৃতি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবে প্রতিকৃতিটা তো তাঁর নিজেরই অবয়বের এক অদ্ভুত ধরনের অবিকল প্রতিরূপ। আর যা-ই হোক না কেন, ছবিটা দেখে আমার কাছে এ ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি। তবে? তবে তার মধ্যে এরকম আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ কি? আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও ভাবনা চিন্তা দিয়ে ব্যাপারটার কিনারা করতে পারলাম না।

আমার অসহায় অবস্থাটা ডাক্তার টেম্পলটনের নজর এড়াল না। তিনি আমার বিস্ময় মাখানো মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই মুচকি হেসে বললেন–ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, দেখতে পাবেন, প্রতিকৃতিটার এক কোণে অস্পষ্ট হলেও লেখাটা বোঝা যাচ্ছে, সময়টা উল্লেখ করা হয়েছে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ।

আমি তার কথা মতো প্রতিকৃতিটার বিশেষ কোণটার ওপর চোখ বুলাতে লাগলাম।

ডাক্তার টেম্পলটন বলে চলল–‘হ্যাঁ, প্রতিকৃতিটা সে বছরই আঁকা হয়েছিল। আমার এক পরলোকগত বন্ধুর প্রতিকৃতি।

‘আপনার মৃত বন্ধুর প্রতিকৃতি?

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। মি. ওন্ডের নামে এক বন্ধু।

‘মি. ওন্ডের?’

‘হ্যাঁ। তাঁর সঙ্গে আমার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কলকাতায়। তখন ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন সেখানকার শাসক। আমি তখন যুবক। বয়স মাত্র ত্রিশ বছর।

‘সে বহুদিনের কথা ভাই।

‘সে তো নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, যে কথা বলতে চাইছি–মি. বেডলো; আপনার সঙ্গে তো আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল সারাটোগাতে, তাই না?

‘হ্যাঁ। আপনাকে প্রথমবার দেখেই প্রতিকৃতিটা আর আপনার সঙ্গে অলৌকিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই আমি আপনার ব্যাপারে উৎসাহি হয়ে পড়ি। আমিই এগিয়ে গিয়ে গায়ে পড়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করেছিলাম, মনে পড়ছে?

‘অবশ্যই। অবশ্যই।

প্রথম আলাপ পরিচয়ের মুহূর্তেই আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রস্তাব দেই।

মি. বেডলো নীরবে মুচকি হাসলেন।

ডা. টেম্পলটন বলে চললেন–‘আমি তখন এমন সব ব্যবস্থা করলাম যাতে আমি আপনার সর্বক্ষণের সঙ্গি হয়ে উঠতে পারি–অভিন্ন হৃদয় বন্ধু যাকে বলে। কিন্তু কেন আমি আপনার ব্যাপারে এতখানি উৎসাহি হয়ে পড়ি, হয়তো আপনি মনে মনে ভেবেও ছিলেন, ঠিক কি না?

মি. বেডলোর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ডাক্তার টেম্পলটনই আবার মুখ খুললেন, ব্যাপারটা আরও খোলসা করে দেবার জন্য বলতে শুরু করলেন–‘দেখুন মি. বেডলো, আমার এ কাজটার পিছনে দুটো উদ্দেশ্য, মানে কারণ ছিল–প্রথমত মৃত ব্যক্তির অনুশোচনাবিহীন স্মৃতি, আর দ্বিতীয়ত আপনার সম্পর্কে অস্বস্তিকর ও অল্প বিস্তর ভীতিপ্রদ কৌতূহলের শিকার হয়ে পড়া।

আপনি পর্বতের ভিতরে প্রবেশ করে শহরের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, যা-কিছু চাক্ষুষ করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। আপনার বর্ণনায় যে পবিত্র নদীর উল্লেখ করেছেন, তা ভারতীয় নদী গঙ্গা ছাড়া কিছুই নয়। আর নদী তীরবর্তী যে শহরের উল্লেখ করেছেন তা নদী তীরবর্তী বেনারস শহরেরই অবিকল বর্ণনা, কার্বন কপি মনে করা যেতে পারে।

আপনি যে দাঙ্গা হাঙ্গামার উল্লেখ করেছেন সেই দাঙ্গা, সেই লড়াই আর সেই হত্যালীলা সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়েছিল চৈৎসিংহের বিদ্রোহের সময়–১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। যখন ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তখনকার ঘটনা।

আপনি বর্ণনার মধ্যে পাগড়ির দড়ি বেয়ে একজনের নেমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন, ঠিক কি না? যিনি এভাবে পালিয়ে গিয়ে ছিলেন তিনি আসলে কে, বলুন তো? তিনি চৈৎসিং নিজে।

আর চালাঘরে যাদের আশ্রয় নেবার কথা বলেছিলেন, তারা আসলে হেস্টিংসের অধীনস্ত একদল সিপাহী আর এক ইংরেজ অফিসার। আমি নিজের যে দলে ছিলাম, তাদের হয়ে লড়াই করেছিলাম। আর বিষমাখা তীরটার কথা বলেছিলেন না? সে কোনো এক বাঙালি নিক্ষেপ করেছিল। তার আঘাতে সে অফিসারটি মারা গিয়েছিল তাকে ওই ভয়ঙ্কর অভিযান থেকে বিরত করার জন্য আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু ফয়দা কিছুই হলো না। সে অফিসারটি ছিলেন আর কেউ নয়, আমার এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। ওন্ডেব তার নাম।

ডাক্তার টেম্পলটন কথা বলতে বলতে একটা নোটবই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। তার কয়েকটি পৃষ্ঠা সদ্য লেখা হয়েছে বলেই মনে হল। নোটবইটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তিনি এবার বললেন–এ পাণ্ডুলিপিটা পড়ে দেখুন, তবেই বুঝতে অসুবিধা হবে না–পাহাড়ের ভেতর থেকে আপনি কল্পনার মাধ্যমে যে সময়ের এসব দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন, ঠিক সে সময়ে আমি আমার নিজের বাড়ির পড়ার ঘরে বসে সে বিবরণটা লিখতে ব্যস্ত ছিলাম। কেবল ব্যস্ত বললে ঠিক বলা হবে না, লেখার মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম।

এ আলোচনার প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে নিচে বর্ণিত বিবরণটা চালোটিসভিল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বিবরণটি হুবহু নিচে উল্লেখ করলাম।

বড়ই দুঃখের সঙ্গে আমরা মি. অগাস্টাস বেডলোর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করছি। খোলামেলা মনের মানুষটি মিষ্টি মধুর ব্যবহার এবং বহুরকম গুণের জন্য বহুদিন পর্যন্ত চার্লোটেসংভিল অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে বড়ই প্রয়োজন হিসেবে গণ্য ছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, নাগরিকদের কাছে তিনি ছিলেন চোখের মণি।

মি. বি গত বছর কয়েক ধরে স্নায়রোগে ভুগছিলেন। কষ্টও পাচ্ছিলেন খুবই। আর প্রায়ই আশঙ্কা হত সে এ রোগেই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হবে। ক্রমে এ ধারণাটা তাঁর কাছে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে পড়তে লাগল। তবে একটা তার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ হলেও প্রত্যক্ষ কারণটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

দিন কয়েক আগে। বন্ধুর পর্বতশ্রেণিতে অভিযান চালাতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সর্দি-জ্বরের কবলে পড়ে যান। পরিস্থিতি ক্রমে সঙ্গীণ হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই তার মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণে রক্ত-সঞ্চালিত হয়ে পড়ে।

তিনি ডাক্তার টেম্পলটনের শরণাপন্ন হন। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সে উপসর্গটা হ্রাস করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এ কাজে তিনি সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করলেন। তার কপালে জোঁক বসিয়ে দেওয়া হল। খুবই কম সময়ের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল, জোঁকগুলোকে যে পাত্রটার মধ্যে রাখা হয়েছিল ভুলবশত তাতে এমনকিছু সংখ্যক বিষাক্ত জলজকীট ছিল যা কাছাকাছি পুকুরগুলোতে প্রায়ই চোখে পড়ে। এ জলজ প্রাণীটা তার কপালের দক্ষিণ দিকের এক ধমণীকে কামড়ে ঝুলেছিল। বিষাক্ত কীটটি দেখতে চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত জেঁকের মতো দেখতে বলেই এরকম একটা ভুল হয়ে যায়। তারপর খুবই দেরিতে সেটা বুঝা গেল। এত বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল যে, তখন আর কিছুই করার সুযোগ ছিল না। আগে, সময়মত ব্যাপারটা ধরা পড়লে হয়তো কিছু করার সুযোগ পাওয়া যেত।

বিশেষ লক্ষ্যণীয়, চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত চার্লোটেসভিল নামক এ বিষাক্ত জলজ কীটটা যে জোঁক নয় তা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায়। একে চিনতে পারা এমনকিছু কঠিন সমস্যা নয়। এর গায়ের রং কালো। আর এটি সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলাফেরা করে। চলার কৌশল দেখে একে জেক থেকে আলাদা। করা যেতে পারে।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখলাম–একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, নিহত লোকটার নাম ‘Bedlo’ লেখার কারণটা কি, জানতে পারি কী?

সম্পাদক সাহেব আমার প্রশ্নের কি জবাব দেবেন হঠাৎ করে ভাবতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগলেন।

আমি এবার বললাম আপনারা যেমন Bedlo’ লিখেছেন, ঠিক এ পদ্ধতিতে নামের বানান লেখার বিশেষ কোনো যুক্তি, মানে যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি নিশ্চয়ই আপনারা অনুসরণ করেন, কী বলেন?

যুক্তি? যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি? আরে ভাই, এটা কোনো পদ্ধতির ব্যাপার নয়, নিছকই ছাপার ভুল। পৃথিবীর সবাইই জানে, Bedlo’ নামের বানান লেখাটার সময় শেষে একটা ‘e’ অবশ্যই বসানো চাই। এর অন্য কোনো বানান হয় বলে আমার অন্তত শোনা নেই। অবশ্য ছাপার ভুলের জন্যই এরকম প্রমাদ ঘটেছে।

সম্পাদকের দপ্তর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি আপন মনেই বলতে লাগলাম–ব্যাপারটা তাহলে আর কিছুই না হোক অন্তত একটা ব্যাপাওে প্রকৃত উপন্যাসের চেয়েও অবাক হবার মতোই বটে। কারণ Bedlo’ নামটার শেষে ‘e ব্যবহার না করে লেখার মানে দাঁড়াচ্ছে, oldeb’ নামটাকেই ছাপার সময় ভুল করে হরফগুলোকে উলটেপাল্টা সাজানো হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কিছু তো ভাবা যায় না। আর সম্পাদক সাহেবও তো বলেন ছাপার ভুলের জন্যই এ রকমটা ঘটেছে। কথাটা যুক্তিগ্রাহ্য, সন্দেহ নেই।

এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্

পাহাড়ের চূড়া। আমরা ইতিমধ্যেই পাহাড়ের চূড়ায় হাজির হয়ে গেছি।

সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে চারদিকের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলেন।

বার-কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে শেষমেশ তিনি বললেন–কিছুদিন আগে হলে পরিস্থিতি এমনটা হতো না, অবশ্যই অন্যরকম হতো।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালাম। তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–হ্যাঁ, যদি আর কিছুদিন আগে হতো তবে আমার ছোট সন্তানটা আর তোমাকে অনায়াসেই এ রাতটা দেখিয়ে নিয়ে যেতে আমার পক্ষে কোসো বাধাই থাকত না।

আমি চোখের মণি দুটোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম–হুম।

তিনি বলেই চললেন–কিস বছর তিনেক আগে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে যায় যা আগে কোনোদিন কারো জীবনে ঘটেনি। আর যদি নিতান্তই ঘটে থাকে তবে এমন কথা বলার জন্য সে আর ইহলোকে থাকেনি।

শুধু কি এ-ই, তখন পুরো ছয়টা ঘণ্টা একনাগাড়ে যে ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে আমাকে কাটাতে হয়েছিল, তাতেই আমার দেহ-মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সে পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মুহূর্তের জন্য থেমে একটু দম নিয়ে তিনি আবার মুখ খুললেন–তোমার ধারণা, আমি বুড়ো মানুষ, তাই না? আসলে কিন্তু আমি মোটেই তা নই। যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছতে পুরো একটা দিনও কিন্তু আমার লাগেনি।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো মুখ তুলে তাঁর দিকে সবিস্ময়ে তাকালাম।

আমার মুখের বিস্ময়ের ছাপটুকু তাঁর নজর এড়াল না। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তিনি এবার বললেন–হ্যাঁ ঠিকই বলছি, পুরো একটা দিনও লাগেনি। বুড়ো হতে, মানে মাথার কুচকুচোলো চুলকে সাদা করতে আমার শক্ত সাবুদ হাত-পা-কে দুর্বল করে তুলে আর স্নায়ুগুলোকে আমি অল্পসময়ে এবং অল্পায়াসেই শিথিল করে তুলতে পেরেছিলাম।

এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখের স্লান হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই তিনি এবার বললেন–কি হে, আমাকে দেখে কী একজন জবুথবু বুড়ো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না?

আমি মুহূর্তের মধ্যে তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে নীরবে মুচকি হাসলাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগলেন–বিশ্বাস কর, আজ আমি বুড়ো মানুষের মতোই সামান্য হাঁটাচলা করলে, কায়িক পরিশ্রম করলে রীতিমত হাঁপাতে থাকি, আর শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। এমনকি একটা ছায়াকে দেখলেও ভয়ে জড়সড় হয়ে যাই।

হুম! আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম।

তিনি বলেই চললেন–আরও আছে, এই যে ছোট পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছ, ওটার দিকে চোখ পড়লেই আর মাথাটা চক্কর মেরে ওঠে, জান কী?

একটু আগেই সামান্য বিশ্রামের মাধ্যমে একটু দম নিয়ে নেবার জন্য সে ছোট পাহাড়টার গায়ে এমন সাবধানতার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যে, তার শরীরের বেশির ভাগ অংশটাই পাহাড়টার একেবারে পিচ্ছিল অংশটায় এলিয়ে পড়েছিল। তিনি যে কিভাবে আচমকা নিচে পড়ে যান, কালো পাথরের সে ছোট পাহাড়টা নিচের পাহাড়গুলো থেকে একদম খাড়াভাবে প্রায় পনেরো ষোলো শো ফুট নিচে নেমে গেছে। ব্যাপারটা বাস্তবিকই অভাবনীয়।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি হলে কিন্তু ভুলেও এমন কাজ করতাম না। পৃথিবীর কোনোকিছুর লোভেই আমি পাহাড়ি প্রান্তের দুগজের মধ্যে যেতাম না। কেউ জোর করেও আমাকে নিতে পারত না। অথচ তিনি কি করে যে এমন একটা কাজ করলেন, আমি ভেবে কিছুতেই কুলকিনারা পেলাম না।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, বন্ধুবরের এমন ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মধ্যে উত্তেজনা এমন তীব্র হয়ে পড়েছিল যে, উপায়ান্তর না দেখে হঠাৎই ভূমিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে আশপাশের ঝোঁপঝাড়কে আঁকড়ে ধরেছিলাম।

সত্যি কথা বলতে কি, তখন আমি ভয়ে এমনই মুষড়ে পড়েছিলাম যে, এমনকি মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতেও ভরসা পেলাম না।

অনেকক্ষণ সেখানে দুরু দুরু বুকে শুয়ে পড়ে থাকার পর বুকে কিছুটা সাহস সঞ্চার করা সম্ভব হলো। এবার হঠাৎ করে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো আমি ধীরে ধীরে উঠে বসতে চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, অল্পায়াসেই উঠে বসতে সক্ষম হলাম। তারপর দূরবর্তী দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেও অসুবিধা হলো না।

আমার পথপ্রদর্শক এগিয়ে এলেন, আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর সহানুভূতির স্বরে বললেন–একটা কথা বলব, শুনবে কী?

কথা? কী কথা? আমি বললাম।

কথাটা হচ্ছে, এসব অসার অবাস্তব কল্পনা তেমাকে মন থেকে মুছে ফেলতে হবে, জয় করতেই হবে।

হুম।

তোমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ কী, বলতে পার?

আমি কপালের চামড়ায় ভজ এঁকে বললাম–কী? কী সে উদ্দেশ্য?

তোমাকে এখানে নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, যে ঘটনাটার কথা তোমাকে বললাম, সে জায়গটাকে যাতে তুমি চোখের সামনে, খুব ভালোভাবে দেখতে পাও, আর সে ঘটনাস্থলটাকে তোমার চোখের ঠিক সামনে রেখেই কাহিনীটা তোমাকে শোনাতে পারি, বুঝলে তো?

হুম।

এবারনিজস্ব ভাব-ভঙ্গিতে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন–এখন আমরা কোথায় আছি, বলতে পার?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গ সম্বন্ধেই বলে চললেন–আমরা এখন নরওয়ের উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করছি, অর্থাৎ ৬৮° দ্রাঘিমায়–নর্থল্যান্ড প্রদেশের অন্তর্গত ভয়ঙ্কর লকোডেল অঞ্চলে।

মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি এবার বললেন- এখন আমরা যে পাহাড়টার শীর্ষদেশে অবস্থান করছি, এর নাম হেসেগেন। মেঘে ঢাকা হেলসেগেন চূড়া বলেই সবাই একে জানে। কথা বলতে বলতে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–এবার শরীরটাকে একটু তোলার চেষ্টা করে দেখ তো, পার কি না?

আমি সামান্য নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করলে তিনি বললেন–শোন, যদি মনে কর মাথা চক্কর মারতে পারে তবে ওই লম্বা ঘাসের গোছাটাকে মুঠো করে ধরে থাক। ওই ভাবে–ওই ভাবেই, এবার নিচের দিককার বায়ুস্তর আর তীরের দূরবর্তী সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ কর।

মাথা চক্কর মারছে। সে অবস্থাতেই তার নির্দেশিত দিকে তাকালাম। সমুদ্রের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। সে-মুহূর্তেই মনের কোণে উঁকি দিল নিউবীয় ভৌগোলিকের বিবরণসমৃদ্ধ মারে টেম্রোরাম-এর কথা। এর চেয়ে বেশি তো দূরের ব্যাপার, এরকম অবর্ণনীয় শোচনীয় বিষণ্ণতায় পূর্ণ একটা দৃশ্যের কথা মানুষে ভাবতেও পারে না।

সমুদ্রের দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়, অস্বাভাবিক কালো আর সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে পড়া সারিবদ্ধ পাহাড়। সবকিছু যেন বিষণ্ণতায় ভরপুর। আর সে বিষণ্ণতাকে যেন আরও বেশি মর্মান্তিক করে তুলেছে পাহাড়ের দৈত্যাকৃতি সাদা চূড়ার ওপর ক্রোধোন্মত সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন আর্তস্বর। সে আর্তনাদ কাঁপন ধরিয়ে দিতে লাগল।

পাহাড়ের যে শিখরটার ওপর আমরা অবস্থান করছিলাম, তার ঠিক বিপরীত দিকে প্রায় পাঁচ-ছয় মাইল দূরবর্তী সমুদ্রের বুকে একটা জনমানবশূন্য দ্বীপ দেখা গেল। আরও একটা ছোট দ্বীপ দেখতে পেলাম। স্থলভূমি থেকে প্রায় দুমাইল দূরে সেটার অবস্থান। অস্বাভাবিক রকমের পর্বতময়। তা একেবারেই অনুর্বর। বহুসংখ্যক কালো পাহাড়ের শ্রেণি তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

খুব বেশি দূরবর্তী দ্বীপ আর উপকূল রেখার মধ্যবর্তী সমুদ্রের রূপ কেমন অস্বাভাবিক দেখাতে লাগল। সমুদ্রের চেহারা যে এমন হতে পারে, কল্পনাই করা যায় না।

ঠিক তখনই প্রলয়ঙ্কর ঝড় শুরু হয়ে গেল। সে কী ঝড়ের বুক-কাঁপানো গর্জন! তবে সমুদ্রে তেমন ঢেউ লক্ষিত হয়নি। আর পাহাড়গুলোর গায়ের সমুদ্রে ছাড়া অন্য কোনো স্থানে তেমন ফেনার ছড়াছড়িও দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে বলা চলে সমুদ্র ছিল মোটামুটি শান্ত-স্বাভাবিক।

আমার বুড়ো বন্ধুটি অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বলতে আরম্ভ করল–ওই যে দূরের দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, তার কী নাম, জান?

আমি বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম–না, জানি না। নরওয়ের তাকে বলে ভুরুখ।

ভুরুখ?

হ্যাঁ। আমার মাঝখানের দ্বীপটার নাম মসকো।

আর ওই মাইল খানেক উত্তরে যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, ওটার নাম?

ওটাকে বলে আমপরেন।

তারপর আরও দূরের কয়েকটা দ্বীপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে বলতে লাগলেন–ওইটার নাম ইসখেসেন, কিন্ডহেম, হট, বহম, আর ওইটার নাম সুয়ারভেন।

আমি তার একের পর এক দ্বীপের দিকে আঙুল ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে চোখের মণি দুটোকেও ঘোরাতে লাগলাম।

তিনি এবার আরও দূরবর্তী কয়েকটা দ্বীপের দিকে এক এক করে অঙ্গুলিনিদের্শ করে বলতে লাগলেন–আরও দূরে, ভুরুখ আর মসৃকো দ্বীপের মাঝখানে ওই দেখা যাচ্ছে, ওটারহম, স্যান্ডফ্লোসেন, স্টকহম আর এই যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, ওটার নাম ফ্লিমেন।

এগুলো কিন্তু দ্বীপগুলোর আসল নাম। কিন্তু এরকম নামকরণের দরকার যে কেন হয়েছিল, তা তুমি তো বলতে পারবেই না, এমনকি আমিও না।

মুহূর্তের জন্য নীরবে উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করে এক সময় ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–বন্ধু, কিছু শুনতে পাচ্ছ কী?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম–কী? কীসের কথা বলছেন?

কিছু শুনতে পাচ্ছ না?

কই, না তো।

ভালো কথা, পানির কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে কী?

আমি পানির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। নতুন কোনোকিছু নজরে পড়ল না।

বুড়ো লোকটা আমার দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে নীরবে মুচকি হাসলেন।

লফডেনের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে আমরা প্রায় দশ মিনিট আগে হেলসেগেন পর্বতের চূড়ায় উঠেছি। অতএব পাহাড়ের চূড়ায় ওঠামাত্র সমুদ্রটা অকস্মাই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠার পূর্ব মুহূর্ত অবধি আমরা একটা বারের জন্যও সমুদ্রটাকে দেখার সুযোগ পাইনি।

আমার বুড়ো বন্ধু কথা বলার সময়ই আমি একেবারেই হঠাৎ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন একটা জোড়ালো শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটা আমেরিকার বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চলে একপাল মোষ চরার মতো আর্তনাদ যেমন শোনায়, অবিকল ঠিক সে রকমই আমার কানে বাজল। ঠিক তখনই বিশেষ একটা ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। নাবিকরা যাকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী চরিত্র আখ্যা দিয়ে থাকে, সেটা যেন একেবারেই দ্রুত, বিদ্যুৎগতিতেও বলা চলে পূর্বগামী একটা স্রোতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। অত্যাশ্চর্য ঘনাটার দিকে আমি নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনেই সে স্রোতটায় অবিশ্বাস্য গতিবেগ সঞ্চারিত হলো। শুধু কি এই? গতির প্রাবল্য প্রতিটা মুহূর্তে বেড়ে যেতে লাগল। চোখের পলকে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একেবারে ভুরুখ অবধি সম্পূর্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠই যেন চাবুকের আঘাতে বাঁধনহারা ক্রোধে রীতিমত ফুঁসতে আরম্ভ করল।

তবে এও সত্য যে, এ আলোড়নটাকে উপকূল আর মসকোর মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়েই অবস্থান করতে দেখা গেল।

একটা ব্যাপার আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, অসীম জলধারা যেন ভয়ানক আলোড়নের জন্য হাজার পরস্পর বিরোধী জলধারায় বিভক্ত হয়ে হঠাৎ অভাবনীয় বিক্ষোভে সামিল হয়েছে, ফেটে পড়ছে।

একটা বা দুটো নয়, সবগুলো স্রোত ভয়ঙ্কর ফুলে ফেঁপে অবর্ণনীয় দ্রুতগতিতে পূর্বদিকে বয়ে চলেছে। জলপ্রপাতের ক্ষেত্রে জলরাশি প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ের গা-বেয়ে নিচে নেমে আসে, খুবই সত্য। ঠিক জলপ্রপাতের মতোই জলধারার দ্রুততা লক্ষিত হলো। জলপ্রপাতের স্রোতধারা ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলতে পারে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

পরিস্থিতি কিন্তু দীর্ঘসময় অপরিবর্তিত রইল না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটার পুরো পরিবর্তন ঘটে গেল। পানির উপরিতলের অশান্ত ভাবটা কিছুটা বদলে গেল। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলেও কিছুটা শান্ত তো হলই।

পানিতে ঢেউ প্রায় অদৃশ্য হয়ে এলো। ফেণাও অনেকাংশে ছড়িয়ে পড়ল। যেখানে ফেণার চিহ্নমাত্রও ছিল না সেখানে পেঁজা তুলার মতো প্রচুর পরিমাণে ফেণা জমতে আরম্ভ হলো। শেষমেশ সে ফেণাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘেঁয়ে ফেলল।

কিছুক্ষণের মধ্যে ফেণাগুলো আবার একত্রে পুঞ্জিভূত হতে হতে ঘূর্ণাবর্তের ঘূর্ণমান গতির রূপ ধারণ করল।

আমি ব্যাপারটার দিকে গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মনে হলো ঘূর্ণমান ঘূর্ণাবর্তটা যেন বৃহত্তর ঘূর্ণাবর্তের অঙ্কুর ছাড়া কিছু নয়।

অকস্মাৎ, একেবারেই অকস্মাৎ! সেটা যেন এক মাইলেরও বেশি ব্যাসার্ধযুক্ত একটা বৃত্তের আকৃতি ধারণ করল। আর ঘূর্ণাবর্তের চারদিক ঘিরে জলকণার একটা চওড়া বেষ্টণিও তৈরি হয়ে গেল।

সে ফেঁদলটার মুখের ওপর ছিটকে যাচ্ছে না।

যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, ভেতরের সে মসৃণকণা, চকচকে ঘন কালো রঙ বিশিষ্ট পানির প্রাচীরটা ৪৫° কোণে দিগন্তের দিকে সামান্য হেলে ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে চলেছে, আর বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে খুবই তীব্র একটা শব্দ। কেমন সে শব্দটা? কিছুটা আর্তনাদ আর কিছুটা গর্জন যেন তার সঙ্গে মিশে রয়েছে।

সে শব্দ, সে আর্তনাদটা এমনই ভয়ঙ্কর যে, নায়েগ্রার দুর্দান্ত বেগবতী জলপ্রপাতও কখনই এমন ভয়ঙ্কর শব্দ আর তীব্র যন্ত্রণার মাধ্যমে পরম পিতার কাছে আর্জি জানায় না। ভয়ঙ্কর সে শব্দটা কানে যেতেই আমার বুকের মধ্যে রীতিমত ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল।

পাহাড়টা থর থর করে কেঁপে উঠল। মনে হলো যেন মূল থেকে শিখর দেশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পাহাড়টাই থেকে থেকে দারুণভাবে কেঁপে উঠছে। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো তা ভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পাথরগুলো রীতিমত দুলতে শুরু করল।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমি আতঙ্কে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার স্নায়ুবিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে গেল। সে উত্তেজনাকে সামাল দিতে না পেরে আমি হাতের নাগালের মধ্যে ঝোঁপঝাড় লতাপাতা যা পেলাম তাকেই আঁকড়ে ধলাম। মনে হলো আমার সামনের দৃশ্যগুলো অনবরত ঘুরছে তো ঘুরছেই। আমার আরও মনে হলো, যে কোনো সময় পাহাড় থেকে পা-হড়কে সুগভীর খাদের মধ্যে পড়ে যাব।

আমি শেষমেশ নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই বুড়ো ভদ্রলোকটিকে বললাম দেখুন, আমি কিন্তু ঘূর্ণাবর্তটা সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিয়েছি।

বুড়ো ভদ্রলোক বলেন–কী? কী সে ধারণা, জানতে পারি কী?

আমার বিশ্বাস, এটা মালস্ট্রামের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। অনেকেই এটাকে এ নামেই সম্বোধন করে থাকে। আমরা, নরওয়ের অধিবাসীরা একে কী বলি জান?

কী? আপনারা একে কী বলেন?

আমরা একে বলি মত্সকো-স্ট্রাম।

দেখুন, এ ঘূর্ণাবর্ত সম্বন্ধে যে বিবরণ শোনা যায়, তা জানা থাকলেও এখন যা চাক্ষুষ করলাম, আমি কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য দেখার জন্য মনের দিক থেকে মোটেই তৈরি ছিলাম না।

হুম!

দেখুন, জোনাস র‍্যামাসের বিবরণ আমি পড়েছি। সে বিবরণ পাঠ করে এ ঘটনার যে মহত্ব অথবা তার আতঙ্ক বা স্তম্ভিত হবার মতো নতুনত্ব দর্শকের মনে যারপরনাই ভীত-সন্ত্রস্ত এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট করে তোলে, তার সামান্যতম ধারণাও পাওয়া যায় না।

আমার পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আসলে আমার জানাই নেই যে, লেখক কোথা থেকে এবং কিভাবে আলোচ্য ঘটনাটাকে চাক্ষুষ করেছিলেন। তবে সেটা হেলসেগেনের ওপর থেকে নয় বা প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের সময় নয়, এ বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও সে দৃশ্যটার ধরণ খুবই কমভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকলেও তার লিখিত বিবরণীর অংশবিশেষ নিচে উল্লেখ করছি

সে বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেছেন–মকো এবং লকডেনের মধ্যবর্তী স্থানের পানির গভীরতা ৩৬-৪০ ফ্যাদমের ভেতরে।

কিন্তু অন্যদিকে, ভুরুখের দিকে পানির গভীরতা খুবই কম। আর তা এতই কম যে, পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে বা ধাক্কা লেগে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে কোনো জাহাজের পক্ষেই স্বাভাবিকভাবে সেখান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কেবলমাত্র ঝড়ের সময় বা অশান্ত আবহাওয়াতেই নয়, নিতান্ত শান্ত আবহাওয়াতেও সে রকম দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে।

আর জোয়ারের সময়? তখন তো মসকো আর লকডেনের ভেতর দিয়ে এমন উত্তাল উদ্দাম গতিতে স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু হয় যে, সবচেয়ে বেশি গর্জনকারী এবং ভয়ঙ্করতম জলপ্রপাতের শব্দও তার মতো বুক কাঁপানো হতে পারে না। আর তা এত দূর থেকে শোনা যায় যে, বেশ কয়েক লীগ [এক লীগ=প্রায় তিন মাইল] দূর থেকে শোনা যায় বললেও কম করেই বলা হবে। আর তার গর্ত এতই গভীর ও আয়তনে বড়সড় যে, কোনো জাহাজ হঠাৎ করে তার চক্করের মধ্যে পড়ে গেলে যে একেবারে অতলে পৌঁছে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। আর গর্তের তলদেশে গিয়ে পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

পরে ক্রমে পানির স্রোত কমতে কমতে শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এলে সে ভাঙা টুকরোগুলো দুম্ দাম করে ছিটকে পানির ওপর পড়ে।

তবে এরকম পরিস্থিতি সর্বদা নয়, কেবলমাত্র জোয়ার-ভাটার আগে চোখে পড়ে। আবার আবহাওয়া শান্ত থাকলেও এরকম অবস্থা নজরে পড়ে। আর এ পরিস্থিতি কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মাত্র মিনিট পনেরো এ অবস্থা স্থায়ী হয়।

পানির স্রোত যখন সবচেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টি করে আর ঝড়ের জন্য তার তীব্রতা আরও অনেকাংশে বেড়ে যায় তখন তার থেকে এক নরওয়ে মাইলের মধ্যে আসা বড়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

অসাবধানতাবশত সতর্কতা অবলম্বন না করার জন্য কত ছোট-বড় নৌকা, ইয়ট আর ছোট-বড় জাহাজ যে-পানির টানে এগিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

কেবলমাত্র নৌকা বা জাহাজের কথাই বা বলি কেন? অতিকায় কোনো তিমিও যখন পথ চলতি সে ভয়ঙ্কর স্থানটার কাছাকাছি চলে আসে, ভয়ঙ্কর সে ফাঁদটায় মাথা গলিয়ে দেয়, তখন তার আত্মরক্ষার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়, নিজেকে অদৃষ্টের হাতে সঁপে দেওয়া ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তরই থাকে না। অনন্যোপায় হয়ে অদৃষ্ট বিড়ম্বিত জানোয়ারটা তখন যেভাবে ভয়ঙ্কর আর্তনাদের মাধ্যমে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে থাকে, তা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

একটা ভালুক এক সময় সাঁতরে লকডেন থেকে মসকো যাবার চেষ্টা করছিল। ভয়ঙ্কর সে স্রোতটার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে সাঁতরে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে স্রোতের টানে সে নির্দিষ্ট স্থানটায় চলে গিয়ে যেভাবে বিকট স্বরে আর্তনাদ জুড়ে দিয়েছিল, তা তীর থেকে পরিষ্কার শোনা গিয়েছিল।

আছে, আরও আছে, পাইন ও ফারগাছের অতিকায় বহুঁকাণ্ড ভয়ঙ্কর সে ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে সে গুঁড়িগুলো এক এক করে ওপরে উঠে আসে তখন পরিষ্কার মনে হয়েছিল, সেগুলোর গায়ে বুঝি ছোট ছোট লোম গজিয়েছে।

ষোল শ পঁয়তাল্লিশ খ্রিস্টাব্দের কথা।

সে-বছর সেক্সাগোসিয়া রবিবার কাকডাকা ভোরে ভয়াল এ ঘূর্ণাবর্ত এমন ভয়ঙ্কর, গগনবিদারী শব্দ এতই উত্তাল-উদ্দাম হয়ে উঠেছিল যে, উপকূলের ছোটবড় বহু বাড়ির পাথরের চাঁইগুলো পর্যন্ত তীব্র গতিতে চারদিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, তা আরও খোলসা করে বলে কারো মধ্যে করুণা সঞ্চার করা সম্ভব নয়, মোটেই নয়।

লেখক যযামাস র‍্যামাসের লেখা এ বিবরণ বিভিন্ন কারণে আমার মনোপুত হলো না। সত্যি কথা বলতে কী ভালুক আর তিমির কাহিনী দুটো তো নিতান্তই হাসির উদ্রেক করে। বলা হয়েছে, ঝড়ের কবলে পড়ে অতিকায় সব জাহাজ পাখির পালকের মতো ডুবে যায়। তাই যদি হয় তবে ভালুক আর তিমি গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করবে এটাই তো স্বাভাবিক। বরং তা যদি না করত তবেই অবাক হবার মতো ব্যাপার হতো, তাই না।

আর কালচার ও অন্যান্য সবার বিশ্বাস, মালস্ট্রামের পানির তলায় ঠিক কেন্দ্রস্থলে সুগভীর একটা গর্ত পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ দিয়ে বহুদূরবর্তী কোনো স্থান পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। তারপর সেখান থেকে গর্তের মুখটা আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আবার কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে বোথুনিয়া উপসাগরের নাম করতেও ছাড়েন নি।

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আসলে অলস কল্পনা হলেও তখন আমার মনও সে মতামতকেই সমর্থন করেছিল, অর্থাৎ আমি মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছিলাম।

কিন্তু পথপ্রদর্শককে আমার মতামত ব্যক্ত করা মাত্রই তিনি তা মুহূর্তের মধ্যেই নস্যাৎ করে দিলেন। তারপর নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন–নরওয়ের প্রায় প্রতিটা মানুষ এ-বক্তব্যকে মেনে নেয়, তবুও তিনি নিজে একমত প্রকাশ, সমর্থন নারাজ। অর্থাৎ এটা তাঁর নিজের মতো নয়।

পরমুহূর্তেই তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন–একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–বলুন, কি জানতে চাইছেন?

ঘূর্ণাবর্তটাকে তো নিজের চোখেই দেখলে, কী বল?

হ্যাঁ, তা-তো দেখলামই।

আর সেটাকে তো খুবই ভালোভাবেই দেখতে পেয়েছ, তাই না?

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

এবার যদি পাহাড়টাকে ডিঙিয়ে অন্যদিকে যাও তবে বুঝতে পারবে, বাতাস সেখানে সরাসরি পৌঁছায় না।

হুম।

আর পানির এ তীব্র তর্জন গর্জনকে যদি বন্ধ কর তবে তোমাকে এমন এক কাহিনী শোনাতে পারি যাতে তোমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মাবে যে, এ মসকো-স্ট্রাম সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা অবশ্যই থাকার কথা।

আমি তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে সে-মতোই কাজ করলাম।

আমার আগ্রহটুকু লক্ষ্য করে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন–

এক সময় আমাদের পরিবারের, মানে আমার আর আমার দুই ভাইয়ের মালিকানায় একটা স্কুনার টানা সত্তর মালের জাহাজ ছিল। আর সেটা ছিল এক মাস্তুল বিশিষ্ট।

সে জাহাজটা নিয়ে আমরা মাছ ধরতে যেতাম। আর মাছ ধরতে গিয়ে ক্রমে। এগোতে এগোতে প্রায়ই আমরা মত্সকো অঞ্চল অতিক্রম করে ভুরুখের কাছাকাছি বেশ কয়েকটা দ্বীপে পৌঁছে যেতাম।

এ-কথা সব মৎস্য শিকারিরই জানা আছে যে, কোনো সমুদ্রের যে কোনো ঘূর্ণিজলেই মওকা মাফিক প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। তবে একটা কথা, সে ব্যাপারে সাহস অবশ্যই থাকা দরকার। মানে ঘূর্ণিজলের বিপদ কিছু না কিছু থাকা চাইই চাই। যাক, যে কথা বলছিলাম, লকডেনের প্রতিটা নাবিকের মধ্যেই একমাত্র আমরা তিন ভাই-ই সে দ্বীপে গিয়ে মাছের কারবার চালাতাম। আর একটা কথা, সে দ্বীপাঞ্চলের পাথরের ফোকড়ে ফোকড়ে এমন বহু পছন্দ মাফিক স্থান আছে যেখানে হরেক আকৃতি ও রঙের। মাছ প্রচুর পরিমাণে মেলে।

আমরা তিন ভাই স্কুনার নিয়ে ভুরুখের কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে হানা দিতাম বলে আমরা সমুদ্রের বুক থেকে একদিনে যত মাছ তুলে আনতে পারতাম, অন্য সব মৎস্য শিকারিরা এক সপ্তাহেও সে পরিমাণ মাছ ধরতে সক্ষম হতো না। ফলে আমাদের কারবার অচিরেই ফুলে-ফেঁপে রমরমা হয়ে উঠতে লাগল।

আমরা স্কুনারটাকে নোঙর করে রাখতাম এখান থেকে পাঁচ মাইল উজানের একটা খাড়ির বুকে।

আবহাওয়া অনুকূল হলে তবেই সে পনেরো মিনিটের শান্ত সমুদ্রের সুযোগ নিয়ে মত্সকো স্ট্রামর প্রধান স্রোতে জাহাজকে ছেড়ে দিয়ে, স্রোতের টানে সেটাকে ভাসিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ওটারহম বা স্যান্ডফ্লেসেনের নিকটবর্তী কোনো এক স্থানে সুযোগ মতো নোঙর করতাম।

আমরা সেখানে থাকতাম যতক্ষণ পানি আবার শান্ত-স্বাভাবিক না হয়। এ জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার পর পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবার নোঙর তুলে বাড়ির দিকে স্কুনারের মুখ ঘোরাতাম।

এভাবে যাওয়া-আসার পথে অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যাবে সে রকম পরিস্থিতি বুঝতে পারলে তবেই কিন্তু আমরা এ অভিযানে পা-বাড়াতাম। কিন্তু একটা কথা খুবই সত্য যে, এ-কাজে আমাদের কোনোদিনই হিসাব-নিকাশে ভুলচুক হত না।

দুবছরে কেবলমাত্র দুবার বাতাস একেবারে পড়ে গিয়েছিল। ফলে তখন আমাদের স্কুনার নোঙর ফেলে কাটাতে হয়। তবে এরকম ঘটনা আকছাড় ঘটে না, খুব কমই ঘটে থাকে। আর একবার আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ছিলাম। আমরা তো সে অঞ্চলে পৌঁছলাম। ব্যস, তার কিছুক্ষণ বাদেই প্রলয়ঙ্কর ঝড় শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্র উত্তাল-উদ্দাম হয়ে উঠল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা কেবলমাত্র বলে কাউকে বুঝানো সম্ভব নয়। আর এরই ফলে আমাদের প্রায় পুরো একটা সপ্তাহ উপোষ করে কাটাতে হয় সে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ভাবলে আমাদের গায়ে জ্বর আসার উপক্রম হয়।

আমরা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরতে কতবার যে কত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। অর্থাৎ সে সব বিপদের বিশভাগের এক ভাগ সমস্যার কথাও তোমার কাছে বলা সম্ভব হবে না।

শোন, এবার যে ঘটনাটার কথা তোমার কাছে বলব, সেটা তিন বছর আগে ঘটেছিল।

১৮ খ্রিস্টাব্দের কথা।

পৃথিবীর এ অংশের মানুষ কোনোদিনই সে তারিখটার কথা শত চেষ্টা করেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।

কেন? কারণ কি? কারণ, সে বিশেষ তারিখটাতেই ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিঝড় আকাশের বুক থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল। অথচ কেবলমাত্র সারা সকালই নয়, সকাল থেকে বিকেলের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল। মাথার ওপর সূর্যদেব অত্যুজ্জ্বল রূপ নিয়ে বিরাজ করছিল। ফলে স্বাভাবিক কারণেই আমাদের মধ্যে সে প্রবীন ও অভিজ্ঞতম নাবিকটা পর্যন্ত ঘৃণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি অচিরেই কি ঘটবে। এমন অভাবনীয় পরিবেশে যে হঠাৎ মহাপ্রলয় নেমে আসবে, তা তো কারো বোঝার কথাও নয়।

আমরা তিনভাই, অর্থাৎ আমি আর দুভাই বেলা দুটোর কাছাকাছি স্কুনার নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপগুলোর নিকটবর্তী অঞ্চলে হাজির হলাম। তারপর ক্রমে এক একটা দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে জাল ফেলতে আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাছ। দিয়ে জাহাজটা বোঝাই করে ফেলতে পারলাম।

আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলাম, এত অল্প সময়ে এত মাছ আমরা এর আগে কোনোদিনই ধরতে পারিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠিক সাতটা বাজে। আমরা আনন্দে ডগমগ হয়ে নোঙর তুলে মাছ-ভর্তি জাহাজ নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। আমরা তড়িঘড়ি যাত্রা করলাম এ জন্য যে, আমরা যাতে আটটার কাছাকাছি সময়ে পানি যখন শান্ত-স্বাভাবিক থাকবে, তার মধ্যেই স্ট্রামের খারাপ অঞ্চলটা অতিক্রম করে ফেলতে পারি। আমাদের জাহাজটা উল্কার বেগে ধেয়ে চলল নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।

নতুন করে হালকা হাওয়া বইতে শুরু করলেই আমরা আবার নোঙর তুললাম।

আমাদের জাহাজটা ঢেউয়ের তালে তালে দোল খেতে খেতে ধীর-মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। বিপদের কোনোরকম আশঙ্কা আছে এমন কথা ঘুণাক্ষরেও আমার মনে আসেনি। কারণ সে-রকম কোনো সম্ভাবনা তিলমাত্রও নজরে পড়েনি।

আমরা সামান্য এগিয়ে যেতেই একেবারেই অকস্মাৎ হেলমেগনের ওপর দিয়ে একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম।

ব্যাপারটা বাস্তবিকই খুব অস্বাভাবিক তো বটেই, অভাবনীয়ও। অতীতে কোনোদিনই এমন কাণ্ড ঘটতে দেখিনি।

আমি যেন কিছু একটা নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমি প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে জাহাজটাকে বাতাসের অনুকূলে রেখে আমরা অগ্রগতি অব্যাহত রাখলাম।

না। বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কারণ, ঘূর্ণি চক্করগুলোই আমাদের অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা করতে লাগল।

অনন্যোপায় হয়ে আমি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিন্তু মুহূর্তের জন্য পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টিপাত করতেই অদ্ভুত প্রকৃতির একটা মেঘের দিকে আমার নজর গেল। তার রং তামাটে।

চোখের পলকে মেঘের টুকরোটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একেবারে দিগন্ত রেখা অবধি ঢেকে ফেলল। পরিস্থিতি যে কী ভয়ঙ্কর রূপ নিল, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে লাগল। যে বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে আমরা সামনের দিকে গতি অব্যাহত রেখেছিলাম তা একেবারে পড়ে গেল। যেটুকু আশা ছিল তাও আমাদের মন থেকে মুছে গেল।

উপায়ান্তর না দেখে আমরা জাহাজ থামিয়ে এদিক-ওদিক অনবরত চক্কর খেতে লাগলাম। এ পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে তা-ও ভেবে পেলাম না। বেশি। ভাববার অবসরই বা কোথায়।

এক মিনিট, মাত্র একটা মিনিট যেতে-না-যেতেই ঝড়টা প্রলয়ঙ্কর রূপ নিয়ে, রীতিমত ফুঁসতে ফুঁসতে আমাদের জাহাজটার ওপর আছড়ে পড়ল। আর দু মিনিটের মধ্যেই ঘন কালো যমদূতাকৃতি মেঘটা পুরো আকাশটা ছেয়ে ফেলল।

চোখের পলকে চারদিক এমন অন্ধকারে ঢেকে গেল যে, জাহাজের ভেতরে অবস্থানরত আমরা একে-অন্যকে দেখতে পাওয়া তো দূরের ব্যাপার, এমনকি নিজের হাতটাকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। কী যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম তা আর বলার নয়। এর পর পরই যে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল, তার বর্ণনা দেওয়া বাস্তবিকই সাধ্যাতীত, চেষ্টা করাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়।

আমাদের জাহাজের নরওয়ের অভিজ্ঞ ও প্রবীনতম নাবিকটার এমন প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে অভিজ্ঞতা নেই।

আকস্মিক ঝড়ের প্রথম ধাক্কাতেই মাস্তুলগুলো এমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল যে, হঠাৎ করে দেখলে যে কেউই বলবে, করাত দিয়ে যত্ন করে কেটে ফেলা হয়েছে।

তখনও বড় মাস্তুলটা অক্ষত রয়েছে। আমার ছোট ভাই সেটাকে রক্ষা করার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাকে রক্ষা করা তো দূরের ব্যাপার তাকে সঙ্গে নিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ল। ব্যস, চোখের পলক পড়তে না পড়তে মাস্তুলটার সঙ্গে সে-ও ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে তলিয়ে গেল।

আমি ছোট ভাইকে তো চোখের সামনেই হারালাম। সে নির্মমভাবে পানিতে ডুবে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেল।

আর আমার বড় ভাই, সে যে কেমন করে প্রাণে বেঁচে গেল তা বলতে পারব না। কারণ একটাই, তার মৃত্যু যে কিভাবে ঘটেছিল তা জানার কোনো উপায়ই আমার ছিল না। আর এক মুহূর্তের জন্য ফুরসৎ পাইনি যে, তার খোঁজ করব।

আর আমি, পরিস্থিতি খারাপ বুঝে ব্যস্ত হয়ে ডেকের ওপর চলে গেলাম। কোনোরকমে পালের দড়িদড়া কেটে ফেললাম। ব্যস, এবার টান টান হয়ে ডেকের ওপর শুয়ে পড়লাম। ডেকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে দিয়ে অদৃষ্ট সম্বল করে শুয়ে পড়ে থাকলাম। হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে সামনের মাস্তুলের বলয় দুটোকে বের করলাম। সে দুটোকে দুহাতে শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ডেকের ওপর পড়ে রইলাম।

কিন্তু হায়! কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও আমরা পুরোপুরি পানিতে ডুবে যাই। সে সময়টুকুতেও আমি হাত থেকে বলয় দুটোকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে দিইনি। শ্বাসরুদ্ধ করে বলয় দুটোকে ধরে রাখলাম। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণই বা থাকা সম্ভব? উপায়ান্তর না দেখে আমি কোনোরকমে ডেকের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসলাম। হাত দুটোর ওপর শরীরের ভার সঁপে দিলাম।

যাক, এভাবে কোনোরকমে মাথাটাকে তো রক্ষা করা গেল। কিছুক্ষন বাদে, একেবারে হঠাৎই আমাদের ছোট জাহাজ ভুস করে ভেসে উঠল। পানিতে-ডোবা কুকুর যেভাবে দুম করে পানি থেকে ভেসে ওঠে ছোট জাহাজটাও যেন একই রকমভাবে পানি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। সে নিশ্চিত সলিল সমাধির কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করল।

ইতিমধ্যে আমার মনে জমাটবাধা ভীতি–মনে অবর্ণনীয় ঘোরটা কেটে গেল।

এবার আমি বিষণ্ণ মনে ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবতে লাগলাম। এমন আচমকা, একেবারে হঠাৎই কে যেন আমার একটা হাত চেপে ধরল। প্রথমটায় আমি যারপরনাই ঘাবড়ে গেলাম। তারপর আতঙ্ক ও বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোমাত্র চমকে গেলাম। দেখলাম, আমার বড় ভাই আমার হাতটাকে সাড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চরম বিপদের মুহূর্তে মানুষ যা করে থাকে সে তাই করেছে। তাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরে খুশির জোয়ার বয়ে যেতে লাগল।

আমি নিঃসন্দেহ হয়ে পড়েছিলাম, আমার দাদাভাই নির্ঘাৎ পানিতে পড়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে।

কিন্তু আমার আনন্দ-উচ্ছ্বাসটুকু মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বরং মুহূর্তের মধ্যেই হতাশায় আমার বুকটা ভরে উঠল। আতঙ্কে আমি একেবারে চুপসে গেলাম। উন্মুক্ত সমুদ্রের বুকেও যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। কারণ, আমার দাদাভাই কানের কাছে মুখ এনে অনুচ্চ অথচ স্পষ্ট ও কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল–মস্‌কো স্ট্রাম; মস্‌কো স্ট্রাম! কথাটা শোনামাত্র আমি শিউরে উঠলাম। আর শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল। রক্তের গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর, আর শ্বাসক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

সত্যি কথা বলতে কি, সে মুহূর্তে আমার মানসিক পরিস্থিতি যে কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল তা কেউ, কোনোদিন জানতে পারবে না।

মুহূর্তের মধ্যেই আমার মধ্যে এক নতুনতর উপসর্গ দেখা দিল। আমার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে আরম্ভ করল। মনে হলো বুঝি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে।

মস্‌কো-স্ট্রাম শব্দটার মাধ্যমে আমার দাদাভাই কী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল তা আমি ভালোই জানতাম। আর সে আমাকে কি বোঝাতে চেষ্টা করেছিল তা-ও আমার জানা ছিল।

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, যে বাতাস আমাদের ঠেলে নিয়ে চলছে তাতে স্ট্রামের ঘূর্ণাবর্তে গিয়ে অবশ্য হুমড়ি খেয়ে পড়ব, আর সে চরম মুহূর্তের আর দেরিও বেশি নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যা আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারবে।

কিন্তু ইতিমধ্যেই ঝড়ের প্রথম তাণ্ডব অনেকাংশে কমে গেল। কেবলমাত্র যে ঝড়ের প্রকোপই কমল তাই নয়। আকাশেও দেখা দিল, অভাবনীয় পরিবর্তন। এটুকু সময়ের মধ্যে যে এত পরিবর্তন ঘটতে পারে, তা বাস্তবিকই ভাবা যায়নি।

এতক্ষণ দিগন্ত পর্যন্ত আলকাতরার মতো কালো একটা পর্দা যেন প্রকৃতিকে ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ–একেবারে হঠাৎই আমাদের মাথার ওপরে এক টুকরো প্রায় বৃত্তাকার পরিষ্কার আকাশ দেখা দিল। এক টুকরো স্বচ্ছ নীল আকাশ। স্বীকার না করে পারছি না, এত পরিষ্কার আকাশ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। উজ্জ্বল নীল আকাশের গায়ে দেখা দিল অত্যুজ্জ্বল রূপালি চাঁদ। আর তার গা থেকে ঝলমলে আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল।

কেবলমাত্র সমুদ্রের জলরাশির গায়েই নয়। চারদিকের সবকিছু যেন উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার দৌলতে ঝলমলিয়ে উঠল। কিন্তু, কিন্তু হায় আল্লাহ। সে মনোলোভা উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার কী দৃশ্যই যে শেষমেশ দেখলাম তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। আমি এবার ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখন কোলাহল এমন তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল যে, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে সাধ্যমত গলা চেঁচিয়ে কথা বলা সত্ত্বেও সে আমার একটা শব্দও শুনতে পেল না। কিছু না শুনে, কিছু না বুঝেই সে কেবলমাত্র মাথাটা নাড়ল।

আমি তার মুখের দিকে চোখ ফেরাতেই–নজরে পড়ল, তার মুখটা চকের মতো সাদা হয়ে গেছে। কীসের যেন এক আতঙ্ক তার মন জুড়ে রয়েছে।

আতঙ্কিত চোখে সে নীরব চাহনি মেলে আমার মুখের দিকে তাকাল। যেন সে কিছু একটা বলতে চাইছে। আমি শুধুমাত্র এটুকুই বুঝলাম যে, সে আমাকে বলতে চাইছে শোনো, কি বলছি। প্রথম দিকে কিছু আমার বোধগম্য হলো না। ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর একটা ভাবনা আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমি ব্যস্ত হাতে পকেট হাতড়ে ঘড়িটা বের করলাম। সেটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে দেখলাম, বন্ধ হয়ে রয়েছে।

এবার চাঁদের আলোয় নিয়ে গিয়ে ঘড়িটা ভালো করে দেখে নিঃসন্দেহ হওয়ায় সেটাকে চোখের সামনে ধরতেই আমার দুচোখের কোল ঘেঁষে পানির ধারা নেমে এলো। হঠাৎ করে কর্তব্য স্থির করে উঠতে না পেরে আমি সমুদ্রের জলে ঘড়িটাকে ছুঁড়ে দিলাম। সাতটা বেজে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্র প্রায় শান্ত, ঢেউয়ের উন্মাদনা না থাকায় সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

স্ট্রামের ঘূর্ণাবর্ত এখন চরম রূপ ধারণ করেছে। পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর।

আমরা এতক্ষণ সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় খুবই দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

সমুদ্র ক্রমেই উত্তাল-উদ্দাম রূপ ধারণ করল। সমুদ্র যেন দৈত্যের রূপ ধারণ করল। চরম উন্মত্ততা নিয়ে সমুদ্র যেন এবার আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখের পলকে আমাদের এক ধাক্কায় যেন একেবারে পর্বতের চূড়ার সমান উচ্চাতায় তুলে দিল। উঁচুতে আরও উঁচুতে উঠে আমাদের মাথা যেন একেবারে আকাশের গায়ে ঠেকে যাওয়ার জোগাড় হলো।

আমার সামান্যতমও ধারণা ছিল না যে, কোনো সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে এত ওপরে উঠে যেতে পারে। এরকম কথা কেউ বলেও আমার মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারত না। ব্যস, পরমুহূর্তেই সে ঢেউটা দুম্ করে ভেঙে গিয়ে আমাদের এক আছাড় মেরে একেবারে নিচে ফেলে দিল। আমরা পুরোপুরি ডুবে গেলাম।

আমার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। ঝিমঝিম করতে লাগল। তখন আমার মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাল যে, আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম। আর সে স্বপ্নের মধ্যেই উঁচু একটা পর্বতের চূড়া থেকে হঠাৎই পা হড়কে একেবারে নিচে পড়ে গেছি।

কিন্তু ওপরে অবস্থানকালেই একবার এক পলকে চারদিকে দৃষ্টিপাত করেছিলাম। ঠিক তখনই আমাদের যথার্থ অবস্থানটা সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারলাম। দেখলাম, মত্সকো স্ট্রাম ঘূর্ণাবর্তটা আমাদের থেকে খুব বেশি হলেও সামনে সিকি মাইলের মধ্যেই রয়েছে। সে-মুহূর্তে আকস্মিক অভাবনীয় আতঙ্কে আমার চোখ দুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর প্রচণ্ড আতঙ্কে চোখের পাতা একসঙ্গ জুড়ে গেল। আসলে চোখের সামনে ভয়ঙ্কর সে দৃশ্যটাকে বরদাস্ত করতে আমাদের চোখ দুটো অক্ষম হয়ে পড়ল।

বেশিক্ষণ নয়, মাত্র দুমিনিট, দুমিনিট পেরোতে-না-পেরোতেই হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ঢেউ থেকে নেমে গিয়ে সমুদ্র প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। আর সমুদ্রের একটা বড় ভগ্নাংশ, যতদূর চোখ যায় দেখা গেল ফেণা যেন ছেয়ে ফেলেছে।

আর আমাদের জাহাজটা বাঁ দিকে খাড়াভাবে বাঁক নিয়ে তীরগতিতে ছুটতে আরম্ভ করেছে। আর ঠিক বাতাসের কাঁধে ভর করে তখনই আচমকা সমুদ্রের তর্জন গর্জনকে ছাপিয়ে বুক-ফাটা এক আর্তস্বর এসে আমার মনে আঘাত হানল।

আমার মনে হলো হাজার কয়েক বাষ্পচারিত জাহাজ থেকে সবগুলো নল দিয়ে এক সঙ্গে তীর বেগে বাষ্প বের করে দেওয়া হয়েছে।

আমরা তখনও ঘূর্ণাবর্তের চারদিকের ফেণারাশির মধ্যেই অবস্থান করছি। আর এও মনে হলো, আর একটু পরেই তার অতল গহ্বরে আশ্রয় নেব, তলিয়ে গিয়ে চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।

না, যা আশঙ্কা করেছিলাম আসলে কিন্তু আদৌ তা হলো না। জাহাজটা ডুবল তো নাই বরং ঢেউয়ের শিখরে বুদ্বুদের মতো ভেসে চলতে লাগল।

যে শুনবে সেই আমার কথাটাকে গালগল্প বলেই উড়িয়ে দেবে, আমি ভালোই জানি। কিন্তু তা মনে হলেও যা সম্পূর্ণ সত্য, বাস্তব তাই তুলে ধরছি। আমার মধ্যে তখন একটা ভাবনারই উদয় হলো–এভাবে মৃত্যুবরণে কি মহত্বের ব্যাপার-স্যাপার কিছু আছে? আর সৃষ্টিকর্তার শক্তির এক অত্যাশ্চর্য প্রকাশের মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবন রক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের জীবনরক্ষার উপায় ভাবাটা কি নিতান্তই নগণ্য ব্যাপার?

আমার ধারণা, সে মুহূর্তে কথাটা আমার মনের কোণে উঁকি দিতেই লজ্জায় আমার চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি নিজেকে একটু সামলে-সুমলে নিলাম। প্রচণ্ড একটা কৌতূহল আমার মধ্যে ভর করল। একেবারেই অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য সে কৌতূহল। কী সে কৌতূহল? ঘূর্ণাবর্তটার গভীরতা পরিমাপ করার জন্য আমার মধ্যে ইচ্ছা জাগল। আর তা আমাকে অস্থির করে তুলল।

নিজের চোখেই তো তুমি দেখলে, ঢেউয়ের পেটটা সমুদ্রের উপরিতল থেকে বেশ কিছুটা নিচু। আর সেটা এ মুহূর্তে আমাদের থেকেও উঁচু একটা কালো পাথরের দেওয়ালের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা কথা বলছি, প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবের মুখোমুখি যদি কোনোদিন না হয়ে থাক, সে সময় সমুদ্রে অবস্থান না করে থাক, তবে প্রবল বাতাস আর জলকণার একত্রে মেশামেশি হলে মনের কোণে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায় তা তোমার পক্ষে বোঝাই সম্ভব হবে না। তোমার চোখ দুটোকে তারা ধাঁধা লাগিয়ে যাবে। তোমাকে একেবারে বধির করে ফেলবে। আর দুহাতে সজোরে কণ্ঠনালী চেপে ধরবে। কাজ আর ভাবনা চিন্তা করার মতো ক্ষমতা লোপ করে দেয়।

সত্যি কথা বলতে কি, সেই ফেণার রাজ্যে কতবার সে চক্কর মেরেছি তা। বাস্তবিকই আমার পক্ষে বলা মুশকিল।

প্রায় একটা ঘণ্টা ধরে যে আমি কতবার ঘুরেছি, ভেসে বেড়ানোর পরিবর্তে উড়ে উড়ে বেরিয়েছি আর ক্রমেই তার ভেতরের ভয়ঙ্কর দিকটায় এগিয়ে চলেছি, এগোচ্ছি তো এগোচ্ছিই।

আমি কিন্তু সর্বক্ষণই বলয়টা জোর করে আঁকড়ে ধরেই থাকলাম।

এই তো গেল আমার অবস্থা। আর আমার ভাই পিছন দিককার গলুইয়ের ওপরের খালি একটা পিপা দুহাতে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এরকম চরম মুহূর্তে তার আর করারও তো কিছুই ছিল না।

যে গহ্বরটার একেবারে কোণার দিকে সে এগোতে লাগল। সেখানে পৌঁছে। যাবার পূর্ব মুহূর্তেই সে বলয়টাকে ছেড়ে দিল। এবার সে হঠাৎই পিপেটাকে ছেড়ে দিয়ে বলয়টার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তখন তার মধ্যে আতঙ্ক এমন চরমে উঠে গেল যে, আমার হাত দুটোকে সরিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাতে লাগল যাতে বলয়টাকে আঁকড়ে ধরা যায়। কিন্তু দুজনের ধরার মতো জায়গা না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না।

আমার তো আর জানতে বা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, আমি পাগলই হয়ে গেছি। তা সত্ত্বেও তাকে এ কাজটা করার জন্য অত্র আগ্রহান্বিত দেখে আমার মনটা যে দুঃখে কী পরিমাণ বিষিয়ে উঠল, তা বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভবই নয়।

আমি বলয়টা ছেড়ে দিয়ে তাকে ধরার সুযোগ করে দিলাম। আর নিজে চলে গেলাম পিছনের গলুইটার কাছে। সেখানে গিয়ে পিপেটার কাছে গুটিসুটি মেরে বসার চেষ্টা করলাম। গোছগাছ করে কোনোরকমে বসামাত্রই জাহাজটা হঠাৎ দক্ষিণ দিকে হেলে পড়ল। ব্যস, আমরা উভয়েই গহ্বরটার ভেতরে ছিটকে পড়ে গেলাম।

মুহূর্তের মধ্যে মাত্র একবার পরমপিতাকে স্মরণ করলাম। আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, বুঝতে পারলাম। ভয়ানক দ্রুতগতিতে অবতরণ করার সময়ও আমি পিপেটাকে ছাড়লাম না, বরং অধিকতর দৃঢ়ভাবে সেটাকে আঁকড়ে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলি।

আমি চোখ দুটো বন্ধ করেই রাখলাম। কয়েক সেকেন্ড চোখ খুলে তাকানোর সাহসই হলো না। তখন তো যে কোনো মুহূর্তে পরলোকে পাড়ি জমাতে পারি এরকম আশঙ্কা বুকে স্থায়ী আসন পেতেই রয়েছে। মৃত্যুশিয়রে তবুও বুঝতে পারলাম, সমুদ্রের পানির সঙ্গে মরণ লড়াই এখনও পুরোপুরি আরম্ভই হয়নি।

একের পর এক মুহূর্ত পেরিয়ে যেতে লাগল। আমার দেহে কিন্তু তখনও প্রাণের অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে, আমি জীবিতই রয়েছি।

নিচে নামার চেতনাটা বন্ধ হয়ে গেছে।

আমাদের জাহাজটা তখনও ফেনার বৃত্তটার মধ্যেই অবস্থান করছে। আর তার গতিবেগের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রায় আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।

বুকে সাহস সঞ্চয় করলাম। সাহস করে চোখ দুটো ধীরে ধীরে মেলোম।

সে যে কী অবর্ণনীয় ভয়, জমাটবাধা আতঙ্ক আর অব্যক্ত বিস্ময়ের অনুভূতি আমার মন-প্রাণ আচ্ছন্ন করে ফেলল, তা আমি শত চেষ্টা করেও কোনোদিনই মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না।

অতিকায় পরিধি এবং অন্তহীন গভীরতা বিশিষ্ট গহ্বরটার ভেতরের দেওয়ালের ঠিক মধ্যস্থলের একটা জায়গায় জাহাজটা যেন ভোজবাজির খোলের মতো লটকে রয়েছে।

আর সে গহ্বরটার তেলতেলে গা-টাকে আবলুস কাঠ বলে ভ্রম হওয়া কিছু মাত্রও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেটাকে যেমন দ্রুতগতিতে অনবরত চক্কর খেতে দেখলাম, আর মেঘের বৃত্তাকার ফাঁক ফোকড় দিয়ে থালার মতো গোলাকার কিরণচ্ছটা যেভাবে তার ওপর পড়তে লাগল তাতে আমার ধারণা হলো গহ্বরটার মসৃণ ও কালো দেওয়ালের সঙ্গে লম্বাভাবে সোনালি রঙের জলস্রোত গহ্বরটার একেবারে অন্তিম তলদেশ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। সে যে কী স্রোত তার বিবরণ আর না-ই বা দিলাম।

আসলে আকস্মিক পরিস্থিতিটার মুখোমুখি হয়ে আমি এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, কিছুই নিবিষ্টভাবে লক্ষ করতে পারিনি। আসলে লক্ষ্য করার মতো মানসিক পরিস্থিতি আদৌ আমার ছিল না।

সাহসে ভর করে যখন চোখ দুটো খুলেছিলাম তখন কেবলমাত্র গহ্বরটার বুক কাঁপানো ভয়ঙ্কর অতিকায়ত্বটাকেই দেখেছিলাম।

বুকে সাহস সঞ্চয় করে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই নিচের দিকে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।

বৃত্তাকার গর্তটা দিয়ে গহ্বরটার ভেতরে যেটুকু অদের অত্যুজ্বল আলো ঢুকতে লাগল তাতে আমার মধ্যে এটুকু ধারণাই হলো তা বুঝি গহ্বরটার একেবারে তলদেশ পর্যন্ত গিয়ে থমকে গেছে।

কিন্তু কুয়াশা এমন জমাটবেঁধে বসেছে যার ফলে সবকিছুর ওপর যেন একটা পুরু আস্তরণ সৃষ্টি করেছে। আর এরই ফলে সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখা সম্ভব হলো না। তার সে জমাটবাধা কুয়াশার আস্তরণটার ওপর অতিকায় একটা রামধনুকে লটকে থাকতে দেখলাম। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা সরু আর প্রায় ভেঙে পড়া সেতুটাকে মহাকাল আর অনন্তকালের মধ্যে একমাত্র পথ আখ্যা দিয়ে থাকেন, এটা প্রায় সেরকমই দেখতে।

এবার সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে আরও কয়েটা কথা বলছি। সে ফেণার রাজ্য থেকে আমরা যখন প্রথম গর্তটার মধ্যে হুড়মুড় করে পড়েছিলাম তখন আকস্মিক একটা টান চাপের ফলে চো-চো করে অনেকখানি তলায় চলে গিয়েছিলাম। তার পরই গতির সে দ্রুততা আর রইল না। ফলে তখন আমাদের গতি অনেকটা মন্থর হয়ে যায়। ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকি। তবে একেবারে সরাসরি নয়, চারদিকে হরদম ঘুরতে ঘুরতে নামলাম। কখনও নামি কয়েকশো গজ, আবার গহ্বরটার পুরো একটা পাক খেয়ে নেমে চললাম।

গহ্বরটার ভেতরে তলিয়ে যেতে যেতেই লক্ষ্য করলাম, সে ঘূর্ণিপাকে কেবলমাত্র আমাদের জাহাজটাই যে আটকা পড়েছে তাই নয়। আমাদের ওপরেও নিচে-সর্বত্র জাহাজটার ছোট বড় অংশ, আসবাবপত্রের টুকরো, কিছু অতিকায় কাঠের গুঁড়ি, ছোট বড় বহু সামগ্রি, বাক্সের ভাঙা অংশ, লোহার পাত, পিপে আর চোঙের মতো কিছু বস্তু প্রভৃতি ভাসতে দেখতে পেলাম।

আমরা গহ্বরটার ভেতরে যতই নামতে লাগাম ততই ভয়ঙ্কর পরিণামের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে পেলাম। আর যতই দেখছি, কৌতূহলও যেন ততই বাড়তে লাগল।

আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আর সে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা বোঝার আগ্রহও আমাকে কম পেয়ে বসল না। আর সে অফুরন্ত আগ্রহ বুকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এগিয়ে চলা অন্য সব দ্রব্য সামগ্রির দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে ঘুরে ফিরে তাকাতে লাগলাম।

বহু দ্রব্য সামগি দেখতে দেখতে এক সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমি না নিয়ে পারলাম না।

সিদ্ধান্ত তিনটি এরকম—

প্রথমত–বস্তুটা যত ভারি হবে সেটা ততই দ্রুত গতিতে নামতে শুরু করবে। দ্বিতীয়ত-সমান বিস্তৃত দুটো স্কুপের মধ্যে একটা গোলাকার, অর্থাৎ বলের আকৃতিবিশিষ্ট হলে আর অন্যটা যে কোনো আকৃতিবিশিষ্ট হলে বলের মতো গোলাকার বস্তুটি অপেক্ষাকৃত দ্রুত নামতে থাকবে। আর তৃতীয়ত সমান আয়তনবিশিষ্ট দুটো বস্তুর মধ্যে একটা যদি সমগোলাকার হয় অন্যটা যে কোনো আকৃতিবিশিষ্ট হয় তবে সমগোলাকার বস্তুটা অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে নামতে থাকবে।

কেবলমাত্র এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথাই বা বলি কেন? আরও একটা বিস্ময়কর ঘটনাও এ সিদ্ধান্তগুলোর অনুরূপ–সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করল। ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রতিবার চক্কর খাওয়ার সময় আমাদের নজরে পড়ল অতিকায় একটা পিপে অথবা জাহাজের মাস্তুল বা তার পাইপ অথবা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গোড়ার দিকে যে সব বস্তু আমার নজরে পড়েছিল সেগুলো বর্তমানে আমাদের থেকে বহু ওপরে অবস্থান করছে। মনে হলো প্রথমবস্থায় তারা যেখানে অবস্থান করছিল সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য দূরত্বে চলে তো যায়নি বরং প্রায় একই জায়গাইে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এবার যা-কিছু কর্তব্য বলে মনে করলাম তার কিছুই করতে কিছুমাত্রও ইতস্তত করলাম না।

সবার আগে আমি মনস্থির করে ফেললাম, পানির পিপেটার সঙ্গে নিজেকে আচ্ছা করে বেঁধে ফেলব। তারপর একটু সুযোগ পেলেই সেটাসহ পানিতে লাপ দেব। আচ্ছা করে পিপেটার সঙ্গে বাঁধা-থাকার ফলে আমার পক্ষে পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকা মোটেও অসম্ভব হবে না। আমি পানিতে ভাসমান পিপেগুলোর দিকে ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চেষ্টা করলাম। আর সে সঙ্গে আমার ইচ্ছাটার কথাও তাকে বোঝাবার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম।

ভাইটি হয়তো আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারলে, বুঝেও যেন বুঝতে পারল না। এ-কথা বলার অর্থ–সে বার বার মাথা নেড়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল, সে জায়গা ছেড়ে আসতে নারাজ। হয়তো ভবিষ্যৎ অজানা বিপদাশঙ্কায় তার মন কিছুতেই আমার প্রস্তাবে রাজি নয়।

কিন্তু আমাদের উভয়ের মধ্যে তখন যা ব্যবধান তাতে করে আমার পক্ষে তার কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। কাছাকাছি যেতে পারলে হয়তো বা আমার বক্তব্য তাকে। ভালোভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতেও পারতাম।

তাই অন্য উপায় না দেখে আমি নিজেকে পিপেটার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে পিপেটাসমেত সমুদ্রে লাফিয়ে পড়লাম।

হ্যাঁ, আমি যে আশা বুকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কার্যত ঘটলও তাই। নইলে আমার পক্ষে তোমার কাছে এ কাহিনী ব্যক্ত করা কি করে সম্ভব হতো? অর্থাৎ আমি যখন তোমাকে কাহিনীটা বলার সুযোগ পেয়েছি, অতএব আশা করি তোমার বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়েই আমার পিতৃদত্ত জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল, তাই না? অতএব আমি এবার যা-কিছু বলব আশা করি অবশ্যই তা অনুমান করতে পারছ। তাই তো তাড়াতাড়ি কাহিনীটার যবনিকার দিকে। এগিয়ে যাচ্ছি। আমি জাহাজ থেকে পিপেটাসহ ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই অর্থাৎ প্রায় এক ঘণ্টা পরেই সেটা আমার অভিন্নহৃদয় ভাইকে নিয়ে উল্কার বেগে অনেকখানি নেমে গেল। আর এদিকে আমাকে নিয়ে পিপেটা আরও কিছুটা তলিয়ে যাবার পরই ঘূর্ণাবর্তের প্রকৃতিটা দ্রুত পাল্টে যেতে আরম্ভ করল।

আরও অতিকায় ও গভীর গর্তটার কালো মসৃণ খাড়া দেওয়ালটা অল্প অল্প করে কমে যেতে আরম্ভ করল। কমতে কমতে এক সময় অনেকখানিই কমে গেল।

এদিকে ঘূর্ণাবর্তের চক্কর মারা অবস্থাটা ক্রমে ধীর মন্থর হয়ে যেতে আরম্ভ করল।

আর অচিরেই ফেণারাশি আর রামধনুও বেপাত্তা হয়ে গেল। আরও অবিশ্বাস্য ব্যাপার যা আমার নজরে পড়ল তা হচ্ছে, গহ্বরটার তলদেশটা যেন ধীরে ধীরে হলেও ক্রমেই ওপরে উঠে যেতে আরম্ভ করল। বেশ কিছুটা ওপরে উঠেও এলো।

আকাশে ঘন কালো মেঘ কেটে গিয়ে আকাশটাও পরিষ্কার হতে হতে একেবারে নীল বর্ণ ধারণ করল। বাতাসের তীব্রতাও লাঘব হতে হতে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলো। পশ্চিম আকাশের গায়ে থালার মতো গোলাকার চাঁদটা অত্যুজ্জ্বল রূপ নিয়ে চোখের সামনে দেখা দিল।

অচিরেই দেখলাম, আমি পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় রয়েছি অর্থাৎ ভেসে বেড়াচ্ছি।

পরমুহূর্তেই আমার চোখের সামনে লকডেনের তীরভূমি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল। আর আমি অবস্থান করছি, মসকো-স্ট্রামের আবর্তের ওপরে।

সমুদ্র শান্ত থাকার কথা, কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের দরুণ সমুদ্র উথাল পাথাল করছে, উত্তাল-উদ্দাম তার রূপ। এক একটা ঢেউ যেন আকাশটাকে ছোঁয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়ছে।

আমি ঢেউয়ের কবলে নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ঢেউ আমাকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দিল। আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্ট্রামের খালে ঢুকে পড়তে বাধ্য হলাম। আর তারপরই হাজির হলাম, জেলেদের ডেরায়।

আমি ক্লান্ত অবসন্ন। আর টিকে থাকার মতো সামান্যতম ক্ষমতাও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ঠিক এ পরিস্থিতিতেই একটা নৌকা আমাকে তুলে নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়ে দিল। সদ্যলব্ধ স্মৃতি আর অবর্ণনীয় আতঙ্কে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম।

আমি যাদের নৌকায় আশ্রয় পেলাম, যারা আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে ছি নিয়ে নৌকায় তুলে নিল, সবাই আমার প্রাক্তন সহকর্মী। নিত্যকার কাজের সঙ্গি। তা সত্ত্বেও তারা আমাকে চিনতেই পারল না। আমার দিকে এমন ঢ্যাবা ঢ্যাবা চোখ করে তাকিয়ে রইল যেন চোখের সামনে মানুষ ভূত দেখলে যা করে থাকে। একদিন, মাত্র একটা দিন আগেও আমার যে চুলগুলো কুচকুচে কালো ছিল সেগুলো এ মুহূর্তে তুমি যেমন সাদা দেখছ, ঠিক সেরকমই দেখতে পেল। অবাক হবার মতো কথাই তো বটে। তাদের আর যা-কিছু বক্তব্য সেগুলোর মধ্যে, আমার মুখটাই পুরোপুরি বদলে গেছে।

আমি তাদের কাছে আমার কাহিনী সবিস্তারে বলেছি, তারা বিশ্বাস করেনি, করতে পারেনি।

এবার তোমার দরবারে আমার কাহিনী পেশ করলাম। আমার এ প্রত্যাশা ও বিশ্বাসটুকু আছে, সবচেয়ে ফুর্তিবাজ ছেলেরা আমার এ কাহিনীকে বেশি হৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করবে আর বিশ্বাস করবে।

ডাইরির পাতা থেকে

৬ এপ্রিল!

শনিবার!

সারা রাত ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিরলস কর্মযজ্ঞে মেতে থেকে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমি বেলুনটাকে বাতাস ভরে ফোলাবার কাজে লেগে গেলাম। কুয়াশা খুবই প্রতিবন্ধকতা করল। কুয়াশায় রেশমের কাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিল। তাই বাতাসের চাপে কাপড়ের ভাঁজগুলো খুলতে চাই ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাতাস ভরে বেলুনটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল।

কাজ পুরোপুরি মোনোর পর দিলাম বাঁধন কেটে। ব্যস, বাতাসের চাপে সেটা তর তর করে ওপরে উঠে আমাদের নিয়ে ইংলিশ চ্যানেলের দিকে এগিয়ে চলল।

বাতাসের গতি আশাতীতভাবে বেড়ে যাওয়ায় অতিকায় বেলুন আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি দ্রুত গতিতে ওপরে উঠতে আরম্ভ করল। সত্যিকথা বলতে কি, বেলুনটা আমাদের নিয়ে উল্কার বেগে ছুটে চলল।

দ্রুত গতিতে ওপরে উঠতে উঠতে আমরা পাহাড়ের মাথাগুলো ডিঙিয়ে বেশি করে রোদেও দিকে যেতে আরম্ভ করলাম। আমাদের গতিও দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল।

আমরা ব্যারোমিটারের গায়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ব্যারোমিটার যন্ত্রে পনেরো হাজার ফুট উচ্চতায় পারদ স্থির হলো।

তখন আবহাওয়া ছিল মনোরম। কুয়াশার লেশমাত্রও ছিল না। আর দিনটাও ছিল রৌদ্র কিরণোজ্জ্বল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এত ওপর থেকে হলেও পায়ের নিচের স্তর ভূ-ভাগকে মনোলোভা দেখাতে লাগল। চোখ ও মন বড়ই তৃপ্ত হলো।

আমাদের গতি অব্যাহতই রইল। আমরা দক্ষিণ অঞ্চলের পর্বতমালার দিকে উল্কার বেগে ধেয়ে চললাম। মুহূর্তের জন্যও আমাদের গতি মন্থর হয়নি। আমরা চলছি তো চলছি। তবে তখন আমরা এতই উচ্চতা বজায় রেখে চলেছি যার ফলে আমাদের সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনাও ছিল না।

ঘড়ির মিনিটের কাটাটা এগোতে এগোতে ছয়টার ঘরে পৌঁছল। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজল। ঠিক তখনই আমার অনুসন্ধিৎসু নজরে ইংলিশ চ্যানেল ধরা পড়ে গেল। আকস্মিক পুলকানন্দে মন-প্রাণ নেচে উঠল।

আমাদের গতি অব্যাহতই রইল। আরও পনের মিনিট এগিয়ে যাওয়ার পর উপকূলের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউগুলোকে আমাদের ঠিক পায়ের তলায় দেখতে পেলাম।

বুঝতে পারলাম, আমরা এবার সমুদ্রের ওপরে পৌঁছে গিয়েছি। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রকে দারুণ আক্রাশে আমাদের পায়ের তলায় অবস্থান করে অনবরত ফোঁস ফোঁস করতে দেখলাম।

এবার আমরা ভেবেচিন্তে মনস্থ করলাম, বেলুনটার গ্যাস কিছু পরিমাণে ছেড়ে দেব। এর ফলে আমাদের ধীরে ধীরে কিছুটা নিচে নামা সম্ভব হবে। কার্যত করলাম তাই। বেলুনটা থেকে কিছু পরিমাণ গ্যাস বের করে দেওয়ার ফলে আমরা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে আরম্ভ করলাম।

প্রায় বিশ মিনিট ধরে আমরা ক্রমেই নিচে নেমে যেতে লাগলাম।

মিনিট বিশের মধ্যেই আমাদের বেলুনের সঙ্গে সংযুক্ত প্রথম বয়টা সমুদ্র স্পর্শ করল। আমরা প্রায় আগের গতিতেই এগোতে লাগলাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বেলুনটার দ্বিতীয় বয়াটা সমুদ্র স্পর্শ করল। এবার বেলুনটার গতিবেগ অপেক্ষাকৃত ধীর মন্থর হয়ে এলো। আমরা সমুদ্রের ছন্দবদ্ধ ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলতে লাগলাম। এখন আমাদের গতি মোটামুটি স্থির হয়ে এলো।

এবার বেলুনটার ভ্রু এবং হালের কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিল। কারণ, যে কোনো সময় এদের ব্যবহার করতে হতে পারে। সে দুটোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য উভয়কে একই সঙ্গে সক্রিয় করে দেওয়া হলো।

এখন আমাদের সবার আগে লক্ষ্য বেলুনটাকে ঘুরিয়ে পূর্বদিকে, প্যারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সামান্য চেষ্টার মাধ্যমে আমরা বেলুনটাকে আমাদের বাঞ্ছিত দিকে ঘুরিয়ে নিতে পারলাম। কাজ হাসিল হবার পর আমাদের মধ্যে এক অনাস্বাদিত আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। অনাবিল আনন্দে আমাদের সবার মুখে হাসির ছোপ ফুটে উঠল। বাঞ্ছিত কাজে সাফল্য লাভ করামাত্র আমরা সমবেত কণ্ঠে পর-পর নয় বার জয়ধ্বনি করে উঠলাম।

এবার আমাদের আবিষ্কারের মূলনীতি একটা কাগজে বিস্তারিতভাবে লিখে ফেললাম। তারপর বিবরণ সম্বলিত কাগজটাকে একটা বোতলের মধ্যে ভরে ভালোভাবে ছিপি এঁটে দিলাম। এবার সেটাকে সফেন সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে দিলাম।

ব্যস, আনন্দ-উৎসাহ আর কতক্ষণ? বোতলটাকে সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে দিতে না দিতেই হঠাৎ এমন একটা অভূতপূর্ব, একেবারেই অভাবনীয় একটা ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হলো যাতে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আমাদের উৎসাহেও কম ভাটা পড়ল না।

বেলুনের স্পিংটাকে প্রপেলারের সঙ্গে সে ইস্পাতের দণ্ডটা যুক্ত করে রেখেছিল সেটা আচমকা খুলে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে অদ্ভুতভাবে ঝুলতে আরম্ভ করল। একেবারেই এমন একটা অভাবনীয় কাণ্ড দেখে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার যোগাড় হলো।

কিন্তু ক্রমশ চরম একটা বিপদের কপাল চাপড়ে হা পিত্যেশ করার অর্থ চূড়ান্ত সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করা, আমার ভালোই জানা আছে। অতএব মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য তৎপর হলাম। সেটাকে টানাটানি করে আবার জায়গামত বসিয়ে দেবার জন্য আমরা প্রায় সবাই মিলে জোর চেষ্টা চালাতে লাগলাম।

আমরা যখন সে লোহার দণ্ডটার সাহায্যে আবার বেলুনের স্প্রিং আর প্রপেলারের সংযোগ সাধনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম ঠিক তখনই পূর্বদিক থেকে প্রবল বেগে বাতাস ধেয়ে এলো। আর তারই প্রচণ্ড ধাক্কায় বেলুনটা উল্কার বেগে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে ছুটতে লাগল।

মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছি।

আমি সামনের উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই স্বগতোক্তি করলাম–হায় ঈশ্বর! আমরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছি।

কিন্তু যে মুহূর্তে পরিস্থিতি এমনই খারাপ যে, প্রকৃত অবস্থাটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মতো অবকাশ আমাদের নেই। কারণ তখন আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ ম্প্রিং আর প্রপেলারের মধ্যে সংযোগ সাধন করে সমূহ ধ্বংসের কবল থেকে বেলুনটাকে রক্ষা করা, আমাদের নিজেদের জীবনও বটে।

প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে শেষপর্যন্ত এক সময় অবশ্য কর্তব্যটা সম্পাদন করা সম্ভব হলো। স্প্রিং আর প্রপেলারের ব্যবস্থা করার পর আমরা এবার প্রকৃত ঘটনাটা সম্বন্ধে আলোচনা করতে বসলাম। আলোচনার ফাঁকে, ঠিক সে মুহূর্তেই মি. আইন্সওয়ার্থ আচমকা একটা অসাধারণ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। তার মুখ দিয়ে কথাটা বেরোতেই মি. হল্যান্ড তাকে সমর্থন করলেন। সমর্থনটা তিনি বেশ দৃঢ়স্বরেই করলেন।

মি. আইন্সওয়ার্থের প্রস্তাবটা হচ্ছে–প্যারিসের দিকে আবার ফিরে যাবার উদ্যোগ না নিয়ে এ প্রবল বাতাসটার সুযোগ আমাদের অবশ্যই নেওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রবল বাতাসের বেগ সম্বল করে আমাদের উচিত হবে আমেরিকার উপকূলে পৌঁছে। যাবার ধান্ধা করা।

তার প্রস্তাবটা দুঃসাহসি, সন্দেহ নেই।

আমি কয়েকমুহূর্ত গুম্ হয়ে বসে তার প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা ভাবনায় লিপ্ত হলাম। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, তার মাথা দিয়ে পরিকল্পনাটা মন্দ বেরোয়নি। সাহসে ভর করে ঝুলে পড়লে পরিণতি ভালো ছাড়া মন্দ হবার তো কথা নয়। অতএব পরিকল্পনাটা দুঃসাহসি হলেও বাস্তবে পরিণত করলে আখেরে ফল ভালোই পাওয়া যাবে। শেষপর্যন্ত আমিও তার প্রস্তাবে সম্মতি না জানিয়ে পারলাম না।

কিন্তু হায়! এ কী অবাক কাণ্ড! আমরা সবাই একমত হলেও নাবিক দুজন কিন্তু মুখ ফিরিয়ে বসে থাকল। তারা কিছুতেই আমাদের আকস্মিক পরিকল্পনাটাকে মেনে নিতে রাজি হলো না।

কিন্তু নাবিক দুজন কেন যে আমাদের প্রস্তাবে কিছুতেই সময় দিল না, তার সুস্পষ্ট কারণ কিছুই বুঝতে পারলাম না, তারাও মুখ ফুটে কিছু বলল না ফলে ব্যাপারটা রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেল। আমরাও তাদের বেশি ঘাটালাম না।

যা-ই হোক আমাদের দিকে পাল্লা ভারী হওয়ায় নাবিক দুজনের আপত্তি শেষপর্যন্ত গুরুত্ব পেল না–নস্যাৎ হয়ে গেল।

এবার আমরা সোজা পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। বাতাসের বেগ প্রবল থাকায় বেলুনটা সমুদ্রের বুক চিড়ে তর তর করে এগিয়ে চলল।

একটু পরেই বাতাসের গতিবেগ প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করল। আর বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে বেলুনটাও আমাদের নিয়ে রীতিমত উল্কার বেগে সোজা পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলতে লাগল।

এবার নতুন করে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু হলো। বাতাসের সে কী বেগ! আমরা যেন বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে উড়ে চলতে লাগলাম।

আশা করি আর খোলসা করে বলার দরকার নেই। কল্পনাতীত অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের চোখের সামনে থেকে সমুদ্রতটরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন আকৃতির জাহাজকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। আরও কয়েকটার সঙ্গে জোর পাল্লা দিয়ে চলেছি। তাদের মধ্যে কয়েকটা আমাদের সঙ্গে এমন তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো মনে হলো যেন আমাদের হারিয়ে দেবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। কিন্তু একটু পরেই তাদের অধিকাংশই রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হলো।

বাজপাখির তো আমাদের উড়ে যেতে দেখে সব জাহাজের কর্মীদের মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা দেখা দিল। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে খুবই আনন্দের সঞ্চার করল।

আমাদের নাবিকরা আনন্দে এমনই মাতোয়ারা হয়ে উঠল যে, তারা ঠোঁট থেকে জেনেভার নামাতেই চায় না। আর তারা সে মুহূর্তে এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠল যেন কাণ্ডজ্ঞানই হারিয়ে বসেছে।

ব্যাপারটার শেষপর্যন্ত তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। চারদিকের জাহাজগুলো থেকে ঘন ঘন বন্দুকের গুলির আওয়াজ করে আমাদের উৎসাহ দিতে লাগল। আর চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর হৈ হুল্লুড়ের মাধ্যমে জাহাজের কর্মীরা আমাদের উৎসাহ দিতে মেতে গেল। আবার কেউ কেউ টুপি খুলে বার বার নাড়িয়ে আমাদের অভিবাদন জানাতেও বাদ দিল না। রুমালও নাড়াল কেউ কেউ।

আমাদের চিন্তা কিন্তু অন্যদিকে। আমরা ইতিমধ্যে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি তার মোটামুটি একটা হিসাব করে ফেললাম।

হিসাব নিকাশের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম আমরা পঁচিশ মাইলের কম পথ তো অবশ্যই নয়, বরং কিছু বেশি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

প্রপেলারটাকে মেরামতের পর সর্বদাই কাজে লাগানো হলো। সেটা সক্রিয় থাকার ফলে আমাদের অগ্রগতিতে ছেদ তো পড়লই না বরং তীব্র গতিতেই আমরা প্রতিনিয়ত এগিয়ে যেতে লাগলাম।

সূর্য পটে বসল। সমুদ্রের বুকে আলো-আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে ঝড়ের উন্মাদনা অনেকাংশে স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার বাড়তে বাড়তে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিল। ঝড়ের কী যে উন্মাদনা শুরু হয়ে গেল–তা আর বলার নয়। বুক শুকিয়ে ওঠার মতো প্রলয়ঙ্কর ঝড় আমাদের ওপর যেন দারুণ আক্রোশে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল।

আর সমুদ্র। রাতভর পূবের হাওয়া বয়ে চলল। সমুদ্রও কম উত্তাল উদ্দাম হয়ে উঠল না। তার ওপর ফসফরাসের দ্যুতি সমুদ্রের সর্বত্র জোনাকি পোকার মতো পর্যায়ক্রমে জ্বলতে আর নিভতে লাগল। স্পষ্টই মনে হলো লক্ষ-কোটি জোনাকি পোকা যেন সমুদ্রের বুকে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।

রাতভর পূর্বদিক থেকে বাতাস বয়ে আসায় আমাদের যাত্রার যথেষ্ট সুবিধাই করে দিল। দমকা বাতাস পেয়ে আমাদের বেলুনটার গতি অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ায় আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম।

ঠাণ্ডা কনকনে ঠাণ্ডা! ঠাণ্ডায় গায়ে রক্ত হিম হয়ে আসার উপক্রম হলো। আর বরফ-শীতল বাতাস যেন হাড়ে গিয়ে আঘাত হানতে লাগল। তার ওপর আবহাওয়া আর্দ্র থাকায় আমাদের হাল যেন বেহাল হয়ে পড়ল।

ভাগ্য ভালো যে, বেলুনের ভেতরে জায়গার অভাব নেই। ফলে আমাদের কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতে কোনো অসুবিধাই পড়তে হলো না। আমরা করলামও তাই। কম্বল আর জোব্বা জড়িয়ে পাশাপাশি গাদাগাদি হয়ে শুয়ে পড়লাম।

পুনশ্চঃ (এ প্রতিবেদনটা মি. আইন্সওয়ার্থ লিখেছেন।) আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও মনে গেঁথে রাখার মতো সময় নয়টা ঘণ্টা। অজ্ঞাত বিপদ আর রোমাঞ্চকর অভিযানের নতুনত্ব আমার চোখে এক কল্পনাতীত মহত্বরূপে দেখা দিল। সত্যি বলছি, এমন একটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার কথা মন থেকে মুছে যাবে না, কিছুতেই না।

পরম পিতার কাছে একটাই প্রার্থনা, আমাদের যাত্রা যেন শুভ হয়, সাফল্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সাফল্য প্রার্থনার পিছনে কোন অন্তনিহিত কারণ রয়েছে? আমার জীবন রক্ষার জন্যই কি পরমেশ্বরের কাছে এমন সনির্বন্ধ প্রার্থনা করছি? না, অবশ্যই না। আমার মতো অতি নগণ্য একটা জীবন রক্ষার জন্য অবশ্যই না। তবে? আমি প্রার্থনা করছি, মানুষের জ্ঞান-ভাণ্ডার যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, আর এ জয় যেন বিরাটত্ব লাভ করতে পারে।

আমি অবাক হচ্ছি, অতীতের মানুষের অনাগ্রহ আর অক্ষমতার কথা ভেবে। কই, কাজটা তো এমনকিছু কঠিন ও সমস্যা সৃষ্টিকারী তো নয়, বরং সহজসাধ্যই বটে। অথচ অকারণ ভীতির জন্যই এর প্রতি মানুষের মধ্যে অনিহা জেগেছে। এটা সত্যি আমার কাছে বিস্ময়েরই উদ্রেক করছে।

যে তুফানটা আমাদের সমুদ্রযাত্রার সহায়তা করেছে, অত্যল্প সময়ের মধ্যে আশাতীত পথ পাড়ি দেবার সুযোগ করে দিয়েছে, ঠিক সেরকমই আর একটা দমকা ঝড় উঠল। বেলুনটার গায়ে বাতাসের তীব্র চাপ লেগে ক্রমাগত চার পাঁচদিন আমাদের উল্কার বেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলুক। আর সে সময়ের মধ্যেই যাত্রীরা এক উপকূল থেকে অন্য আর এক উপকূলে অনায়াসে পৌঁছে যাক। তবে এও সত্য যে, এরকম ঝড় কেবল চার-পাঁচ দিনই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশিদিন স্থায়ীত্ব লাভ করে। এরকমই একটা ঝড়ের কল্যাণে যাত্রীরা সুবিস্তীর্ণ আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে একটামাত্র হৃদে হাজির হয়ে যায়।

সমুদ্র এখন উত্তাল উদ্দাম। আকাশ-ছোঁয়া এক-একটা ঢেউ তীব্র আক্রোশে যেন অন্যটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর সে সঙ্গে সমুদ্র জুড়ে ফেণার ছড়াছড়ি তো রয়েছেই। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার, সমুদ্র মোটামুটিনিস্তব্ধ। বুক-কাঁপানো তর্জন গর্জন এখানে অনুপস্থিত দেখে আমি একেবারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার যোগাড় হলাম। পানি থেকে কোনো শব্দ উত্থিত হয়ে আকাশের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে না। সুদীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে সমুদ্র অবস্থান করায় উত্তাল সমুদ্রের যন্ত্রণা যেন মুচড়ে মুচড়ে উঠলেও যাবতীয় যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করছে। আকাশছোঁয়া ঢেউগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন, অগণিত বিশালদেহি মূক দৈত্য বুঝি অসহ্য ও প্রতিকারহীন যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত ছটফট করছে। তীব্র আক্রোশে বার বার আছড়ে পড়ছে।

উফ্! কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা! এরকম একটা ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতা যে লাভ করেছে সে-ই সত্যিকারে বেঁচে থাকে। আর এ জীবনটা রাতটা তো একটা শতাব্দীব্যাপী জীবনের সমতুল্য।

আজকের এরকম একটা রোমাঞ্চকর রাতের বিনিময়ে অনাস্বাদিত আনন্দের বিনিময়ে আমাকে যদি একশো বছর পরমায়ু দান করতে উৎসাহি হয় তবু আমি সম্মত হব না।

এবার মি. ম্যাসনের পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। তাতে দেখা গেল, লেখা রয়েছে–রবিবার, সাতই। আজ ভোরের দিকে ঝড়ের তাণ্ডব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। একটু আগেও যে ঝড় আমাদের বেলুনটাকে উথাল-পাথাল করেছিল এমন তা-ই ক্রমে স্তিমিত হতে হতে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।

আমরা তখন ক্রামগত উত্তরদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আমরা হয়তো ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল গতিতে উত্তর দিক বরাবরই এগোচ্ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে? আমাদের গতি পশ্চিমদিকে। হানস্ আর প্রধান স্কুর দৌলতেই আমরা অনবরত পশ্চিমদিক বরাবর ছুটে চলেছি। অন্যথায় আমাদের হয়তো বা এমন উত্তর দিকেই ধেয়ে যেতে হতো। আমার বিশ্বাস, আমার দ্ধমূল ধারণা আমাদের এ অভিযান শতকরা একশো ভাগই সফল হয়েছে, আমরা যে চিন্তা করে পা বাড়িয়েছিলাম সেদিক থেকে পূর্ব সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ব্যর্থতা বা হতাশার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সাফল্য এটাই প্রমাণ করেছে যে, আকাশ-পথে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া কিছুমাত্রও সমস্যার ব্যাপার নয়।

গতকালের প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করার ছিল না,নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন দিকে বেলুনটাকে চালিত করতে পারতাম না। তবে হয়তো বা বহু

পরিশ্রম ও বুদ্ধি খরচ করে সে বাতাসের দাপটকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ একটা প্রপেলারকে ব্যবহারের মাধ্যমে মোটামুটি তেজি বাতাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছামত দিকে বেলুনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে।

আজ দুপুরে…ভার হ্রাস করে, বেলুনটার ওপন অনেকাংশে লাঘব করে আমরা তর তর করে আকাশের দিকে অনেকখানি ওপরে উঠে যেতে পেরেছিলাম। আমরা তখন ভূমি থেকে পঁচিশ হাজার ফুট ওপরে উঠে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের গতি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত।

আমি মনে মনে হিসাব করে মোটামুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছিলাম, আমার যাত্রা যদি এভাবে আরও তিন সপ্তাহও অনবরত চলে তবুও এ পুকুরের মতো ছোট্ট এ জলাশয়টাকে পাড়ি দেবার জন্য যে পরিমাণ গ্যাস আমাদের দরকার সে তুলনায় প্রচুর গ্যাসই আমাদের ট্যাঙ্কে মজুদ আছে।

এখন বুঝছি, অহেতুক ভুলগুলোকে আমরা খুব বেশি করে গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রয়োজনে নিজের ইচ্ছামত স্রোত বেছে নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারি। আর যত স্রোত আছে সবগুলোও যদি আমার বিরুদ্ধাচরণ করে তবুও আমি প্রপেলারের সাহায্যে নির্বিপরেই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারব।

না, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুরোপুরি নিরাপদেই আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম।

দিনটা তো নির্বিঘ্নেই কাটল। এখন চিন্তা হচ্ছে রাতটা নিয়ে। রাতটা যে কিভাবে কাটবে সেটাই ভাববার বিষয়। তবু আমার ধারণা, দিনের মতো রাতটাও ভালোভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

পুনশ্চঃ মি. আইন্সস্যান্ডের ডায়রির পাতায় উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই বটে। তবে একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আমি যারপরনাই স্তম্ভিত হয়েছি। ব্যাপারটা আমার কাছে অবাক হবার মতোই মনে হয়েছে। অবাক হবার মতো ব্যাপারটা ছিল, তাই না? কটোপাবিসর মতো সমান উচ্চতায় উঠে যাওয়ার পরও আমার মোটেই ঠাণ্ডা লাগেনি, কষ্ট হয়নি, মাথাও ধরেনি–মোদ্দাকথা, কোনোরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়াই আমার মধ্যে প্রকাশ পায়নি। আর কষ্টবোধও করিনি এতটুকুও।

কেবলমাত্র আমার নিজের কথাই বা বলি কেন? মি. হল্যান্ড, মি. ম্যাসন বা স্যার এভারার্ড কেউ এতটুকুও শারীরিক কষ্টবোধ করেন নি।

তবে এটা কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মি. অসবোর্ণ মাঝে মধ্যে বুকের সংকোচনের কথা বলে ছিলেন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। অচিরেই তা নিরাময় হয়ে গিয়েছিল–স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছিলেন।

আমরা দিনভর তীব্রগতিতে উড়ে চলেছি। অতএব নিঃসন্দেহ হওয়া যেতে পারে, আটলান্টিক অতিক্রম করার মোট পথের একটা বড় অংশই আমরা পিছনে ফেলে এসেছি।

আটলান্টিকের জলরাশির ওপর দিয়ে উল্কার বেগে ধেয়ে চলার সময় আমাদের বেলুনটা বিভিন্ন রকমের একটা-একটা করে বেশ কয়েকটা বিশ-ত্রিশটা জাহাজকে পিছনে ফেরে দুর্বার গতিতে অগ্রসর হয়েছে। আর আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে অন্যান্য জাহাজের কর্মীও যাত্রীরা বিস্মিত হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে।

যা-ই হোক, মোদ্দা কথা, বেলুনে চেপে মহাসাগর পাড়ি তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কথায় বলে যা-কিছু অজানা-অচেনা তাকেই আমরা অনেক বড় কিছু বলে। মনে করে থাকি।

আমরা ভূমি থেকে পঁচিশ হাজার ফুট ওপরে উঠার পর মনে হলো আকাশটা নীল নয় প্রায় কালো। সমুদ্রকে কচ্ছপের পিঠের মতো নয় সম্পূর্ণ অবতল দেখায়। আর? তারাগুলো অনেক, বেশি পরিষ্কার দেখায়। সব মিলিয়ে আমাদের এ পৃথিবীটাকে অত্যাশ্চর্য বোধ হয়।

মি. ম্যাসনের পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত বক্তব্য সোমবার সকাল হতেই প্রপেলারের দণ্ডটা বিগড়ে গেছে। ফলে কিছু সমস্যা পার হতে হলো। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই চালাবার পর হতাশ সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। ওটাকে বাতিল করে নতুন একটা দণ্ড ব্যবহার না করে উপায় নেই। আর ওটাকে একেবারে নতুন করেই গড়তে হবে।

উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দিনভর এক নাগাড়ে দমকা বাতাস বয়ে চলল। বাতাসের বেগ খুবই বেশি। ফলে বাতাস আমাদের অগ্রগতিতে যথেষ্ট সহায়তাই করতে লাগল।

ভোরের আগে, পরিবেশ পুরোপুরি পরিষ্কার হবার পূর্ব মুহূর্তে বেলুন থেকে একটা অভাবনীয় ঠুঠা আওয়াজ হতে থাকায় আমরা খুবই ঘাবড়ে গেলাম। অস্বীকার করব না, অজানা আতঙ্কে বুকের ভেতরে ঝুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।

ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করতেই অবাঞ্ছিত আওয়াজটার কারণ বের করা সম্ভব হলো। আবহাওয়ার তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গ্যাসের আয়তন বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ এমন একটা আওয়াজের সৃষ্টি হয়েছে।

অবাঞ্ছিত ও বিরক্তিকর আওয়াজটা বন্ধ করা দরকার। উপায় বের করতেও। আমাদের বেশি মাথা ঘামাতে হলো না।

কয়েকটা খালি বোতল জড়ো করে ফেললাম। এবার সেগুলোকে একটা-একটা করে নিচের একটা জাহাজে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাম। হ্যাঁ, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বটে। বোতলগুলো অক্ষত অবস্থাতেই পানিতে পড়েছে।

এবার বেলুন থেকে তলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারলাম, সেটা নিউইয়র্ক অঞ্চলের কোনো একটা জাহাজ। দেখলাম, জাহাজের নাবিকরা কায়দা কৌশল করে পানি থেকে বোতলগুলো তুলতে আরম্ভ করল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা সব কয়টা বোতল তুলে নিতে পারল।

আমি বারবার এদিক-ওদিক কাৎ হয়ে জাহাজটার নাম দেখার চেষ্টা করলাম। লেখাটা দেখতে পেলাম বটে, কিন্তু নামটা পড়া সম্ভব হলো না। কারণ, হরফগুলো এতই ছোট যে, এত উঁচু থেকে ঠিকঠাক নজরে পড়ল না–যাতে পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে। উপায়ান্তর না দেখে মি. অসবোর্ণের থলেটা হাতিয়ে দূরবীণটা বের করে চোখের সামনে ধরলাম। এবার লেখাটাকে আটলান্টা বলেই মনে হলো।

এখন রাত বারোটা। আমাদের পক্ষীরাজ বেলুনটা দুর্বার গতিতে প্রায় পশ্চিম দিকে ধেয়ে চলল। আমার চোখের মণি দুটো প্রায় অন্ধকার সমুদ্রের বুকে অনবরত চক্কর মারতে লাগল। অন্ধকার সমুদ্রের বুকে অনবরত ফসফরাসের ঝকমকি চলতে লাগল। সে যে কী মনোরম চোখে চমকলাগানো দৃশ্য তা চাক্ষুষ না করলে, কারো মুখ। থেকে শুনে বা লিখিত বিবরণীয় পড়ে সম্যক ধারণা করা সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।

পুনশ্চঃ এবার মি. আইন্সওয়ার্থের লিখিত বিবরণী উল্লেখ করছি–এখন রাত দুটো।

বেলুনের পরিস্থিতি এবং বেলুনের বাইরে অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম–চারদিক মোটামুটি শান্তই। কিন্তু এবারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমরা সম্পূর্ণ বাতাসের অনুকূলে অগ্রসর হচ্ছি।

একটা কথা খুবই সত্য যে, হুইল ডের ছাড়বার পর থেকে আমি নির্ঘুম অবস্থাতেই কাটিয়ে দিয়েছি। এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাইনি। ঘুমানো তো দূরের কথা, দুচোখের পাতা এক করাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অতন্দ্র প্রহরীর মতো চারদিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে লাগলাম।

কিন্তু আর নয়, চোখের পাতা খোলা রাখাই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘুমে চোখ বুজে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ অন্তত ঘুমিয়ে নিতে না পারলে আর চলতে পারব না।

অনুমানে বোঝালাম, আমেরিকার উপকূলে পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যেমন উল্কার বেগে ধেয়ে চলেছি তাতে এরকম ধারণাই আমার মধ্যে বদ্ধমূল হলো।

মি. আইন্সওয়ার্থের পাণ্ডুলিপির পাতা থেকে গৃহীত–মঙ্গরবার নয়, তখন রাত একটা। বেলুন থেকে দক্ষিণ আমেরিকার তটরেখা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনটা আনন্দে নেচে উঠল।

বড় একটা সমস্যা আমাদের সামনে থেকে সরে গেল।

আমি আপন মনে বলে উঠলাম–ঈশ্বরের অপার করুণা না থাকলে এমন একটা অভাবনীয় সাফল্য কিছুতেই সম্ভব নয়। আমরা আতলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। অনায়াসে আর একেবারে নির্বিবাদেই আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ঈশ্বর সহায়! ঈশ্বরের জয় হোক!এরপর কে বলতে পারবে, পৃথিবীতে কোন কাজ অসম্ভব? আমরা যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছি তা দেখে কেউ-ই এ-কথা বলতে উৎসাহি হবে না।

ডায়েরির বক্তব্য এখানেই শেষ করা হলো। তবে ডাইরির বক্তব্য ছাড়াও মি. আইন্সওয়ার্থ কিছু কথা মি. ফরসাইথকে বলে দিলেন।

বেলুনের অভিযাত্রীরা প্রথম সমুদ্রের তটরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। তখন চারদিকে মৃত্যুর–কবরখানার স্তব্ধতা বিরাজ করছিল।

অনুসন্ধিৎসু চোখে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থাকার পর দুজন নাবিক আর মি. অসওয়ার্থ প্রথম তটরেখাটা দেখতে পেয়েছিলেন।

মি. অসওয়ার্থের ফোর্থ মুলট্রিতে কিছু পরিচিত লোকজন ছিল। তাই তারা সবাই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধঅন্ত নিয়েছিলেন। সে জায়গাটার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় তারা নামার চেষ্টা করবেন।

শেষপর্যন্ত তারা করলেনও তাই। ফোর্ট মুলট্রির অদূরবর্তী এক জায়গায় বেলুনটাকে সমুদ্রের তীরের কাছাকাছি নিয়ে চলে এলেন। এতে তাদের কোনো সমস্যার মুখোমুখিও হতে হলো না। কারণ, তখন ভাটা চলছিল। আর ভাটাও শেষ হয়ে এসেছিল। ফলে বালি ছিল শক্ত আর মসৃণ। বেলুন অবতরণের পক্ষে অনুকূল ছিল সমুদ্রসৈকতটা।

বেলুনটাকে উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে সজোরে নোঙরটাকে ছুঁড়ে মারতেই সেটা উড়ে গিয়ে শক্ত বালির স্তূপে গেঁথে গেল। ব্যস, নিশ্চিন্ত।

সমুদ্র উপকূলে বেলুন অবতরণের খবরটা বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে দ্বীপের সর্বত্র একেবারে আনাচে কানাচে পর্যন্ত পৌঁছে গেল। খবরটা চাউর হতে না হতেই অসভ্য দ্বীপবাসী আর দূর্গের অবস্থানরত লোকজন ছুটাছুটি করে সমুদ্রসৈকতে ছুটে এলো। কৌতূহলবশত সবাই বেলুনটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তারা বেলুনটাকে ঘিড়ে দাঁড়িয়ে অতুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বেলুনটাকে দেখতে লাগল। তারা যত দেখছে ততই যেন বেলুনটার প্রতি কৌতূহল চড়চড় করে বেড়ে যেতে লাগল।

কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল বেলুনটার কার্যকরী ক্ষমতার কথা দ্বীপবাসীদের বোঝাতে গিয়ে। ব্যাপারটা হচ্ছে, আটলান্টিক মহাসাগরে বেলুনটায় চেপে পাড়ি দেবার মতো এত বড় অভিযানের কথা, বাস্তব অভিজ্ঞতার ব্যাপার-স্যাপার তাদের বোঝাতে গিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হলো, আর মাথার ঘাম পায়ে নামার যোগাড় হলো।

আমাদের বেলুনের নোঙরটা সমুদ্রসৈকতের শক্ত বালি স্পর্শ করেছিল ঠিক দুইটায়।

হিসাব করে দেখা গেল নোঙর তুলে বেলুনটা যাত্রা করার উপায় করে দেওয়ার পর থেকে যাত্রা শেষ করতে সময় লেগেছিল মোট পঁচাত্তর ঘণ্টা বা তার কিছু কম।

পথে খুঁটিনাটি সমস্যা কিছু দেখা দিলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দুর্ঘটনারই মুখোমুখি আমাদের হতে হয়নি। এমনকি পথ পাড়ি দেবার সময় আমাদের মনে সামান্যতম বিপদের আশঙ্কাও দেখা দেয়নি।

মোদ্দাকথা, বেলুনটা নির্বিঘ্নেই সমুদ্র সৈকতে অবতরণ করেছিল। ভাটার সময় থাকায় সৈকতভূমি এমন শক্ত ছিল, যাতে নোঙর ফেলতেও কিছুমাত্র সমস্যা হয়নি। আমাদের অভিযানের বিবরণটাকে যে পাণ্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত হয়েছে সেটাকে যখন চার্লস্টন থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দলটা তখন ফোর্ট মুলট্রিতেই অবস্থান করছিল।

ফোর্ট মুলট্রিতে অবস্থানকালে বেলুনচারীদের মনে আর কোনো বাসনা ছিল কি না, থাকলে তা যে কি কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।

তবে পাঠক-পাঠিকাদের হতাশ হবার মতো কোনো কারণই দেখছি না। একটা কথা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি যে, আগামী সোমবার বা বড়জোর তার পরের দিন আরও কিছু খবর তাদের দরবারে শে করতে পারব।

একটা কথা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, আজঅবধি যেখানে, যত অভিযান সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমান অভিযানটা যে সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে-বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশও নেই। তাই আরও কিছু বিচিত্র ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে এরকম আশঙ্কা করা নিতান্তই যুক্তিহীন। অতএব ধৈর্য ধরে ভবিষ্যতের পথ চেয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায়ই তো দেখছি না।

ডিডলিং

সেই আদিকালে অর্থাৎ সৃষ্টির গোড়াতেই দুটো ব্যাপার পণ্ডিতদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। তারা সচকিত হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে উৎসাহি হয়েছেন। উৎসাহি বলা ঠিক হবে না, বরং বা উচিত ভাবনা চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন।

কি সে বিষয় দুটো–তাই না? একটা অবৈধ সুদ আদায়, আর দ্বিতীয়টা তঞ্চকতা।

তঞ্চকতা বলতে বোঝায়, কায়দা কৌশলের মাধ্যমে লোকের সঙ্গে প্রবঞ্চণা করা বা লোক ঠকানো।

আপনারা যে, যা-ই বলুন না কেন, তঞ্চকতা যে বিজ্ঞানেরই একটা শাখা, অর্থাৎ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত আর এ-বিজ্ঞানবিদ্যা নিয়ে শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করে পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রাচ্যদেশে হয়তো বা এ-তঞ্চকতা-বিদ্যাকেই চৌষট্টি কলার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিদ্যা আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

অভিধানের পাতা ঘাটাঘাটি করলে চোখে পড়বে, তঞ্চ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রবঞ্চণা, চাতুর্য, কৌশল প্রভৃতি। আর তঞ্চক কথার অর্থ প্রবঞ্চক, ফাঁকি, ধোঁকা আর সত্যগোপন।

আবার যদি কয়েকপাতা পিছিয়ে যাওয়া যায় তবে দেখা যাবে তঞ্চন শব্দটার অর্থ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। এর অর্থ জমে যাওয়া বা জমাটবাঁধা।

এবার আপনিই বিচার করুন ধাপ্পাবাজি কতটা গাঢ় হলে, জমাট বাঁধলে একটা মানুষ প্রবঞ্চক বা তঞ্চকে পরিণত হয়ে প্রবঞ্চণার বা তঞ্চকতায় পারদর্শিতা দেখাতে পারে! অতএব এ-কথা তো বা যেতেই পারে। প্রবঞ্চণা বা তঞ্চকতায় সাধনায় সিদ্ধিলাভের মাধ্যমে প্রবঞ্চক বা তঞ্চক বৈজ্ঞানিক আখ্যা করা যে-সেকথা নয়! মোদ্দা কথা, নামকরা প্রবঞ্চক বা শ্রেষ্ঠ-প্রবঞ্চক হতে হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তবেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা সম্ভব।

কিন্তু তঞ্চকতা অর্থ সম্বন্ধে ধারণা করা গেলেও যথাযথভাবে তার সংজ্ঞা লিখতে বসলে নাস্তানাবুদ হতে হয়, বসে বসে অসহায়ভাবে মাথা চুলকানো ছাড়া উপায় থাকে না।

তবে একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, প্রবঞ্চণা বা তঞ্চতা-র সংখ্যা লেখা মহাসমস্যা হলেও তঞ্চকের সংজ্ঞা লেখা কিন্তু সহজ ব্যাপার। আমি এটাই বুঝতে চাইছি–বিজ্ঞানের বিশেষ কোনো শাখার সংজ্ঞা লেখা অনেক কষ্টসাধ্য হলেও কিছু বলে বৈজ্ঞানিকটিকে বুঝানো অনেক, অনেক সহজ ব্যাপার।

বৈজ্ঞানিক প্লেটোর কথাই ধরা যাক না কেন। তিনি যদি এ-ধারণাটাকে মাথায় আনতে পারতেন তবে দ্বি-পথ প্রাণী হিসেবে মুরগিকে কেন মানুষের পর্যায়ে ফেলা যাবে না, মানুষ গণ্য করা যাবে না, এ-কথা বলতে দুঃসাহসী হতেন না।

আমার কিন্তু এসব বিতর্কে ঝুট-ঝামেলায় আদৌ ইচ্ছা নেই। আমি কেবলমাত্র এটুকুই বলতে চাচ্ছি, একমাত্র মানুষই তঞ্চক হতে পারে, অন্য কোন জন্তু জানোয়ারের পক্ষে সম্ভব নয়।

কেবলমাত্র পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত প্রাণীরাই তঞ্চকতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছে। শেয়াল ধূর্ত–সে অন্যকে ঠকায়, কাক চুরি বিদ্যায় অভ্যস্ত, বেজি অন্যের মাথায় দিব্যি হাত বুলায় আর মানুষ করে তঞ্চকতা।

সত্যিকথা বলতে কি, তঞ্চকতাই মানুষের ভাগ্য। কবি তো বলেছেনই হা পিত্যেশ করবার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

আমি কিন্তু বলব, তঞ্চকতা করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জীবনের লক্ষ্যই তো তঞ্চকতা–জীবনে শেষ।

তাই তো কেউ তঞ্চকতা করেছে শুনলেই আমারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠি ব্যস, সব খতম হয়ে গেল! অর্থাৎ সব শেষ!

এবার বলা যেতে পারে তঞ্চকতা আসলে একটা যৌগিক পদার্থ। বহু উপাদানের সমন্বয়ে এটি গঠিত। সামান্য ব্যাপারে অসামান্যতা, স্বার্থপরতা, মৌলিকতা, ধৃষ্টতা প্রদর্শন, আঠার মতো লেগে থাকা, বেপরোয়া হওয়া, উদ্ধত প্রকৃতি হওয়া, দাঁতাল হাসি মুখে অক্ষুণ্ণ রাখা, উদ্ভাবনী শক্তি ধারণা করা প্রভৃতিই হচ্ছে তঞ্চকতার উপাদান।

এবার তঞ্চকতার উপাদানগুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যাক।

গোড়াতেই সামান্য ব্যাপারে অসামান্যতা সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক-তঞ্চক সামান্য ব্যাপার থেকে অসামান্য কিছুর সন্ধান পেতে পারে। তার চোখের দৃষ্টি খুবই তীক্ষ্ণ। সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়কেও সে দেখতে পায়, উপলব্ধি করতে সক্ষম। তার কারবার ছোটখাট ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে। সে খুচরা ব্যাপারী। নগদ অর্থ বা মূল্যবান কোনো কাগজ চোখে পড়ামাত্র তার ছোঁকছোঁকানি শুরু হয়ে যায়। যে কোনো উপায়ে সেটাকে হাফিস করে না দেওয়া অবধি সে স্বস্তি পায় না। এই একই লোক যখন কোনো আড়ম্বর ও জৌলুসপূর্ণ ব্যাপারের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন সে নিজের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, মহাজনে পরিণত হয়। এতেও কিন্তু তঞ্চকতা পুরোদস্তুর কাজ করে। আর ছোটখাটো আকারে নয় কিন্তু ব্যাপক ও বিশালরূপেই।

মহাজন আর তঞ্চকের মধ্যে পার্থক্য কিছু-না-কিছু তো আছেই। কিন্তু কতটুকু সে পার্থক্য? ম্যামথ হাতির সঙ্গে ইঁদুরের পার্থক্যের মতোই। আবার ধূমকেতুর ল্যাজের সঙ্গে শুয়োরের পার্থক্যের সমানও বলা চলতে পারে।

এবার স্বার্থতার কথা বলছি, শুনুন–তঞ্চক প্রধানত স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়। কোন ও কেমন স্বার্থ? অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে নিজের স্বার্থ। আর পকেট পূর্ণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। আর সে পকেট একান্তই নিজের। আর আপনারও বটে। প্রথম পকেটটা তার নিজের আর দ্বিতীয় পকেটটা অবশ্যই আপনার। তার সর্বদা লক্ষ্য থাকে প্রথম পকেটের দিকে।

এবার মৌলিকতার প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক-প্রত্যেক তঞ্চকই ভয়ানক রকমের মৌলিক চিন্তাধারার অধিকারী হয়। সে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জালের ফাঁদ বিছিয়ে দেয়। ষড়যন্ত্র কী বস্তু–কীভাবে চক্রান্তর জাল বুনতে হয় তা সে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি দিয়ে পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে তৈরি করে নেয়। এ-বুদ্ধির জন্য অন্যের প্রত্যাশী তাকে হতে হয় না। আর তা যদি হয় তবে তা সব কাজ ভেস্তে যাবে। সে সর্বদা নিত্য-নতুন মতলব আঁটে। প্রয়োজনে নিষ্ফল মতলব বাতিল করে দিয়ে আবার নতুন মতলব ভাজার জন্য তৎপর হয়। নতুন মতলবকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে। গ্রীক দিঘীজয়ী বীর আলেকজান্ডার হওয়ার হিম্মৎ তার যদি নাও থাকে তবে সে গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস তো হতে পারত। সে যদি তঞ্চকে পরিণত না হতো তবে ইঁদুর ধরা ফাঁদ নইলে বঁড়শি আর ছিপ হতে পারত। কিন্তু তঞ্চকতার মৌলিক চিন্তাধারা যে তার মধ্যে গিজ গিজ করছে। তঞ্চকতার প্রতি প্রবণতা তার মধ্যে জাগতে বাধ্য।

আঠার মতো লেগে থাকার ব্যাপারটা এবার বলছি শুনুন ইচ্ছাশক্তি আর আগ্রহ প্রবল না থাকলে তঞ্চকতায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। যার সঙ্গে সে তঞ্চকতা করতে আগ্রহি তার পিছনে প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্বল করে দিনের পর দিন লেগে থাকার মানসিকতা ও ধৈর্য তাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা যোগাবে। আর তারই ফলে সেনিজেকে কর্তব্য সম্পাদনে লিপ্ত রাখবে।

এবার ধৃষ্টতা প্রদর্শন সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ আভাস দিচ্ছি, শুনুন–অসীম ধৃষ্টতা ছাড়া তঞ্চকতায় পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। সে ভয়ঙ্কর রকমের দুঃসাহসী না হলে সাফল্য লাভ তো দূরের ব্যাপার তঞ্চকতা করার ব্যাপারে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। তাকে এমনই বুকের পাটা রাখতে হবে যাতে আফ্রিকার গভীর বনেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। যুদ্ধ জয়লাভ করতে হলে তাকে একটা বীজমন্ত্রই জপ করতে হবে–আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস যাতে তার মধ্যে সর্বদা বিরাজ করে।

তরবারি দেবার আঁচড় লাগার ভয়-ডরের লেশমাত্রও তার মধ্যে থাকবে না। আর তা যদি থাকে তবে গোড়াতেই তাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। আর এ-কাজে দুঃসাহসের তুলনায় বিচক্ষণতার প্রয়োজনও কম নয়। সাহস আর বিচক্ষণতাই তঞ্চককে সাফল্য দান করে গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দিতে সক্ষম।

ইংরেজ ঘোড়সওয়ার ডাকাত ডিক টারপিনের কথা আশা করি অবশ্যই জানা আছে? সে যদি আর একটু বেশিমাত্রায় বিচক্ষণ হতো তবে পয়লা নম্বরের তঞ্চক সে হতে পারত এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।

আর আইরিশ জাতীয় নেতা দা নিয়েল ওকোনেল? তোষামুদে বলে তার যথেষ্ট অখ্যাতি রয়েছে। চাটুকার-শক্তিতে তার মতো পারদর্শী সচরাচর দ্বিতীয় আর একজন চোখে পড়ে না। কিন্তু তিনি যদি তোষামোদ করার সময় জায়গামতো লাগাম টেনেনিজেকে সংযত রাখতে পারতেন, অর্থাৎ একটু কম তোষামুদে হতেন তবে তঞ্চকতায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করতে পারত।

এবার সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লসের কথা বলছি–তার মগজটায় আয়তন আর ওজন যদি আর একটু বেশি হতো তবে তঞ্চকদের তালিকার শীর্ষে নিজের নামটাকে রাখতে পারতেন। অতএব এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, পয়লা নম্বরের তঞ্চক হতে হলে তার মধ্যে ধৃষ্টতামূলক গুণ যথেষ্টই থাকা চাই।

ধৃষ্টতার মতোই তঞ্চকের আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বেপরোয়া মনোভাব। রীতিমত বেপরোয়া অর্থাৎ কাউকে তোয়াক্কা না করা কৃতী তঞ্চকের একটা বড় গুণ। সে কারো ধার ধারবে না। কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে স্নায়ুবিক বল হারালে চলবে না। তাকে মনে করতে হবে স্নায়ু নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব তার মধ্যে কোনোদিন ছিল না, আজও নেই। তঞ্চকতা করতে নেমে পিছপাও হওয়ার পাত্র সে নয়। উত্তম মধ্যম না দিয়ে তাকে ঘায়েল না করা অবধি সে তার কর্তব্যকর্ম থেকে এক তিলও সরতে নারাজ। কার্যসিদ্ধি করতে হলে তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একের পর এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। তাকে মাথা এমন ঠাণ্ডা রাখতে হবে যেন শশারও হার মেনে যায়। যত বড় সমস্যার সম্মুখীনই হতে হোক না কেন তঞ্চককে কোনোকিছু গায়ে না মেখে ঠাণ্ডা মাথায় সাফল্যের দিকে ধীর-স্থিরভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

তঞ্চকতায় সাফল্যের আর এক চাবিকাঠি হচ্ছে, তাকে উদ্ধত প্রকৃতির হতে হবে। ঔদ্ধত্য ছাড়া সে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। কথায় কথায় তাকে বুক ফুলিয়ে বড়াই করতে জানতে হবে। এতে সামান্য শৈথিল্য দেখা দিলেই তার দুর্বলতা প্রকাশ পাবে এবং সাফল্যের পরিবর্তে ব্যর্থতার গ্লানি গায়ে মেখে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো গতিই থাকবে না। হাতের পেশীর ওপরেই তাকে নির্ভর করতে হবে খুব বেশি করে। যার সঙ্গে তঞ্চকতায় প্রবৃত্ত হবে তার সামনে বার বার হাতের পেশী ফুলিয়ে তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখে মস্তানির ভাব সর্বদা প্রকট করে রাখতে হয়। সে নিজের খাদ্যবস্তু মুহূর্তের মধ্যে গোগ্রাসে গিলে ফেলবে, ঢকঢক করে মদের বোতল খালি করে দেবে, লম্বা লম্বা টানে মুহূর্তে সিগারেট খতম করে দিয়ে ঔদ্ধত্যকে প্রকট করে তুলতে তার জুড়ি নেই। এমন ভাব দেখাত তঞ্চককে ওস্তাদ হতে হবে। আর গুণের বল সম্বল করেই তঞ্চক শিরোমণি আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা টাকা ধারের নামে ছি নিয়ে নেয়। আপনার নাক-কান নির্ভয় ও নিঃসঙ্কোচে মলে দেয়। আপনার পোষা ছোট্ট কুকুরটাকে জুতোর ডগা দিয়ে টুক করে লাথি হাঁকায় আর মওকা বুঝে আপনার বউকে সবেগে চুম্বন করে সোহাগ দেখায়। উদ্ধত আচরণ ছাড়া কে কোন কালে পয়লা নম্বরের তঞ্চক হতে পেরেছে, বলতে পারেন? সবশেষে বলছি তঞ্চকতায় সাফল্য লাভ করাকে হলে মুখে সর্বদা সেঁতো হাসি বজায় রাখতে হয়। যেমন বুকে সুতীক্ষ ছুরির ফলা পুষে রাখতে হয় ঠিক তেমনি মুখে প্রতিনিয়ত সেঁতো হাসি ফুটিয়ে রেখে বাঞ্ছিত ব্যক্তির মন জয়ের চেষ্টায় লেগে থাকতে হয়। তবে হাসির প্রয়োজন কখন সবচেয়ে বেশি হয়? কাজ হাসিল করার পর। কর্ম যাতে করে দিয়ে ফিক ফিক করে সেঁতো হাসি হেসে আত্মতুষ্টি লাভ করতে হয়। তবে একটা কথা, এটা এমনই এক বিশেষ ধরনের হাসি যার বেশি ঘটে না, অন্যের চোখে ধরা পড়ে না বললেই চলে।

কাজ সাঙ্গ করে তঞ্চক পরমানন্দে নিজের আশ্রয়স্থল খোপটায় ঢুকে আপন মনে দাঁত বের করে হেসে আত্মতুষ্টি লাভ করে। কেউ দেখবে না, কেউ মানবে না, বুঝবেও না কেউ, অথচ সে নিঃশব্দে হা-হা করে হাসতে আরম্ভ করে।

আর? কাজ হাসিল করে বাড়ি ফিরে পোশাক পাল্টে সে টুক করে মোমবাতিটা জ্বেলে দেয়। বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে মাথার তলায় বালিসটাকে দিয়ে নেয়। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এবার হ্যাঁ, এবারই অঞ্চলের দেতো হাসি শুরু হয়ে যায়। সে এমন করে দাঁত বের করে হাসে না। তাকে কিছুতেই পয়লা নম্বরের তঞ্চক বলা যাবে না। নিঃশব্দে অট্টহাসিতে তাকে মাততেই হয়।

আরও আছে, তঞ্চককে পুরনো বস্তাপচা তঞ্চকতা-পদ্ধতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তার উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হতেই হয়। অন্যের কায়দা-কৌশল নকল করে কাজ করতে গেলে তার প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। সে যে পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করবে তা একেবারেই নতুন হওয়া চাই-ই চাই।

কৃতী তঞ্চকের চিন্তা-ভাবনা হয়ে পুরোপুরি নতুন, নিতান্তই নিজস্ব–কারো অনুকরণ করা অবশ্যই নয়। অনুকরণপ্রিয়তা দোষ যার মধ্যে থাকে তার পক্ষে নতুনতর কোনোকিছু করার ঝোঁক থাকতে পারে না। সেনিজেই কাজের পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়িত করবে তা তাকেই মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হয়। পয়লা নম্বরের তঞ্চক সে হবে সে তঞ্চকতার পরিকল্পনা চুরি করা, নকল করে কাজ হাসিলের চেষ্টা করাকে সে মনে-প্রাণে ঘৃণা করবে। অন্যের পদ্ধতি প্রয়োগ করে সে যদি কোনোক্রমে কারো টাকার থলি গায়েব করে ফেলে, পরমুহূর্তেই তার মাথায় যদি আসে যে, পদ্ধতিটা মৌলিক নয়, অজান্তে হলেও অন্যের মস্তিষ্ক প্রসূত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফেলেছে তবে সে তৎক্ষণাৎ টুটে গিয়ে যেন-তেন প্রকারে মালিককে চুরি-করা টাকার থলেটা ফিরিয়ে দিতে আসতেও সে কুণ্ঠিত হয় না। অতএব উদ্ভাবনীয় শক্তি প্রথম শ্রেণির তঞ্চকের একটা বড় হাতিয়ার স্বীকার না করে উপায় নেই।

তঞ্চকতা করার প্রচলন মানুষ জাতটার মধ্যে আদিম কাল থেকেই রয়েছে। তারপর থেকে একনাগাড়ে চলেই আসছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পৃথিবীর প্রথম তঞ্চক কে ছিল? এর উত্তর দিতে গিয়ে বলা যায় হয়তো বা পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম নিজেই প্রথম তঞ্চক ছিল। প্রাচীনকালে এ-বিজ্ঞানেরনিদর্শন বস্তাবস্তা পাওয়া যায়। তবে বর্তমানকালে এ বিজ্ঞানকে ঘষে মেজে রীতিমত উন্নতমানের করা হয়েছে। আদিকালের বিজ্ঞানের সঙ্গে সাম্প্রতিককালের বিজ্ঞানের যে আকাশ-পাতাল ফারাক, এ-কথা না বললেও চলে। কয়েকটা অতি সাম্প্রতিককালের উদাহরণ তুলে ধরছি–

ঠিক সে মুহূর্তেই সাধু ব্যক্তি মুশকিল আসান করে দিলেন। সমস্যার সমাধান করে দিতে গিয়ে বললেন–ধরুন, আমার কাছে পঞ্চাশ টাকার নোট আছে।

নোট বইটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে, পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিজের পকেটে চালান করতে করতে লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে যাত্রী এক লাফে মোটর বোটে উঠে গেল।

ব্যস, সে বোটে পা দেওয়া মাত্র ভটভট আওয়াজ করতে করতে জলযানটা বন্দর ছেড়ে তরতর করে এগিয়ে চলতে লাগল।

বোটটা বন্দর ছাড়তে সাধু ব্যক্তি নোটবইয়ে নোটের তোড়া দেখলেন। হ্যাঁ, সবই একশো টাকার নোট, সত্য। কিন্তু সব কটাই জাল নোট!

দুঃসাহসের তঞ্চতা নমুনা তো এরকমই হয়ে থাকে–এমন এক স্থানে জাতীয় সমাবেশ বা সভা হতে চলেছে যেখানে যেতে গেলে একটা সাঁকো না পেরিয়ে উপায় নেই। ফলে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা দলে দলে কাতারে কাতারে সাঁকোটার ওপর দিয়ে সভাস্থলে যেতে লাগলাম।

এক তঞ্চক সমাবেশের খবর পেয়েই আগেভাগে সাঁকোটার গায়ে আস্তানা গড়ল না। এমন একটা মওকা তো আর হাতছাড়া করা যায় না।

তঞ্চক পরিকল্পনামাফিক প্রত্যেকের কাছ থেকে সাঁকো ভাড়া বাবদ একটা করে টাকা আদায় করতে লাগল। মানুষই হোক আর গরু-ছাগল-ঘোড়া গাধাই হোক সঁকো পেরোতে গেলেই একটা করে টাকা দক্ষিণা দিলে তবেই ওপারে যেতে পারবে।

অনেকে ব্যাপারটা নিয়ে একটু-আধটু ওজর আপত্তি যে করেনি তা নয়। কিন্তু একে ভিড় ঠেলে যাওয়া, তার ওপর সমাবেশে যোগদানে বিলম্ব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পকেট থেকে একটা করে টাকা বের করে তঞ্চকের হাতে গুঁজে দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে সাঁকোটা পেরিয়ে যেতে লাগল।

ব্যাপারটা মিটে গেলে তঞ্চক পকেট ঝেড়ে ঝুড়ে হিসেব করে দেখল, অল্পক্ষণের মধ্যেই সে পঞ্চাশ-ষাট টাকা কমিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ ধনী বনে যাওয়া তঞ্চক বাবাজী সেঁতো হাসি হেসে আত্মতৃপ্তি লাভ করার জন্য বাড়ির পথ ধরল। দুঃসাহস না থাকলে এত অল্পসময়ে ও অল্পায়াসে এতগুলো টাকা কামানো কি তার সম্ভব হত?

এবার শুনুন একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক তঞ্চকতার কথা–এক তঞ্চক ছাপা হুণ্ডির কাগজে স্বাক্ষর করে তার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করল। সেহেতু হুণ্ডির কাগজটায় সরকারি ছাপ রয়েছে অতএব টাকা ধার দিতে দ্বিধা থাকার কথাও নয়।

তঞ্চক মহাপ্রভু একই ছাপা হুণ্ডির কাগজ কয়েকটা খরিদ করে বাড়ি ফিরে এলো। প্রতিদিন একটা করে কাগজে মাংসের ঝোল মেখে নেয়। তার পর সেটাকে নিজেরই পোষা কুকুরের দিকে বাড়িয়ে ধরে। মাংসের গন্ধ পেয়ে কুকুরটা অত্যুৎসাহী হয়ে সেটর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে পরম তৃপ্তিতে মাংসের ঝোলটুকুর সদগতি করে। তারপর মনিব তাকে ভেজা কাগজটা উপহার দিয়ে দেয়। সেটাকে নিয়ে দৌড়ে দূরে চলে যায়। তারপর সেটাকে নিয়ে খেলায় মেতে যায়।

রোজই কুকুরটা একটা করে কাগজের গা থেকে মাংসের ঝোল জিভ দিয়ে চেটে পুটে খেয়ে তৃপ্তি লাভ করে এবং শেষে পুরো কাগজটাই উপহার পায়। এমন ব্যবস্থা চচা রোজই চলতে লাগল।

কিছুদিন এভাবে চলার পর একদিন তঞ্চক মহাপ্রভু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরটাকে সঙ্গে করে সে বন্ধুর বাড়িতে টাকা শোধ করার জন্য উপস্থিত হলো।

শেঁকল-খোলা পোষা কুকুরটাকে পাশে বসিয়ে তঞ্চক বন্ধুকে বলল তোমার প্রাপ্য। মিটিয়ে দিতে এসেছি। সই-করা হুণ্ডিটা নিয়ে এসো।

তার বন্ধু ঘরে গিয়ে হুণ্ডির কাগজটা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলো।

হুণ্ডির কাগজটা তঞ্চক-বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া মাত্র কুকুরটা সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যস, তার হাত থেকে সেটাকে ছোঁ মেরে নিয়েই দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করল। চোখের পলকে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কোন হদিসই পাওয়া গেল না।

বিষণ্ণ মুখে কুকুরটার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে প্রাপক বন্ধু বলল–আমার টাকাগুলো দাও।

টাকা? টাকা অবশ্যই দেব। কিন্তু আমার স্বাক্ষর করা হুণ্ডিটা ফেরৎ দিলেই তোমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেব।

হুম! প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করে প্রাপক বন্ধু চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তঞ্চক বলল–আমার স্বাক্ষর করা হুণ্ডিটা ফিরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেব।

আশা করি আর না বললেও চলবে–বেচারার অসহায়ভাবে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। হুণ্ডিটাও ফিরে এলো না, বন্ধুকে তার পাওনাগণ্ডা মেটাতেও হলো না।

এবার মাজা-ঘষা এক তঞ্চকতার উদাহরণ তুলে ধরছি–একবার প্রকাশ্য দিবালোকে ভরা-রাস্তায় তঞ্চকেরই এক অংশীদার এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাকে অপমান করে বসল। যা মুখে এলো তা-ই বলে গালমন্দ করল। তারপর মন থেকে ভয় দূর করার জন্য সে মহিলাটিকে সঙ্গে করে তার বাড়ি পৌঁছে দিতে গেল।

তাকে সদর দরজায় পৌঁছে দিয়ে সে বিদায় নিতে গেল।

মহিলাটি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন–আপনি যে কষ্ট করে আমাকে পৌঁছে দেবার জন্য এতটা পথ এলেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

তঞ্চক লোকটা ফিরে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই মহিলাটি বি বিনয়ে বললেন–ভাই, আপনি যখন কষ্ট করে আমার জন্য এতই করলেন, দয়া করে ভেতরে আসুন।

তঞ্চক দরজায় দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগল।

মহিলাটি আগের মতোই কাকতি-মিনতি জানাতে গিয়ে বললেন–দয়া করে একবারটি ভেতরে আসুন। বাড়িতে আমার বাবা আর ভাইরা রয়েছেন, আলাপ করে যাবেন না?

তঞ্চক এবার কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–কিন্তু মহাশয়া, আমার পক্ষে যে দেরি করা সম্ভব নয়–দুঃখিত।

মহিলাটি অধিকতর মোলায়েম স্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন–কিন্তু–কিন্তু আপনি এতটা করলেন

দেখুন, আপনি যদি আমার কাছে সত্যি কৃতজ্ঞ–

এ কী বলছেন ভাই! কৃতজ্ঞতার কথা মুখে না বললেও–

ভালো কথা, তঞ্চকতার নিদর্শনস্বরূপ আপনি আমার একটা উপকার করতে পারেন।

উপকার?

হ্যা! দশটা টাকা ধারস্বরূপ দিতে পারেন?

এ তো সামান্য ব্যাপার মশায়! দশটা তো মাত্র টাকা; এর জন্য এমন অনুনয় বিনয়–কথা বলতে বলতে মহিলাটি তার বান্ডিলটা খুলে একটা নোট বের করে তার হাতে গুঁজে দিলেন।

তঞ্চক হাত বাড়িয়ে প্রায় ছোঁ মেরে নোটটা নিয়ে নিল। এ-তঞ্চতার ক্ষেত্রে একটা মাত্র ফাঁক থেকে গেছে, খুঁতও বলা চলে। নোটটার অর্ধেক, অর্থাৎ পাঁচ টাকা বিনা প্রতিবাদে তার অংশীদারের হাতে তুলে দিতে হয়। অংশীদার বলতে যে লোকটাকে মুখ বুজে বেধড়ক পিটুনি খেতে হয়েছে।

এবার খুবই ছোট্ট হলেও অভাবনীয় বৈজ্ঞানিক তঞ্চকতার একটা নমুনা পেশ করছি–দশাসই চেহারাধারী এক ব্যক্তি এক রেস্তোরাঁয় হাজির হলেন পানাহার করতে। গায়ে বহুমূল্য জমাকালো পোশাক।

টেবিলে বসেই ভদ্রলোক দামি চুরুট অর্ডার দিলেন। এক পরিবেশক সঙ্গে সঙ্গে তার বাঞ্ছিত চুরুট টেবিলে পৌঁছে দিল। ভদ্রলোক চুরুটটাকে হাতে তুলে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ এঁকে সেটাকে পরিবেশককে ফেরৎ দিলেন।

পরিবেশক পরবর্তী অর্ডারের জন্য টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

খদ্দের ভদ্রলোক এবার বললেন–ঠাণ্ডা পানি আর ব্র্যান্ডি নিয়ে এসো।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশক তাঁর বাঞ্ছিত বস্তু দুটো নিয়ে আবার টেবিলে ফিরে এলো। খদ্দের ভদ্রলোক পরম তৃপ্তিতে বস্তু দুটোই নিঃশেষে উদরস্থ করলেন।

হাত থেকে ব্র্যান্ডির খালি গ্লাসটা নামিয়ে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

চেয়ারটাকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালে পরিবেশক বলল–স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ। আর মিছে এখানে বসে সময় নষ্ট করতে যাব কেন?

ঠাণ্ডা পানি আর ব্যান্ডির দামটা মেটাতে হয়তো আপনি ভুলে গেছেন।

ভ্রু কুঁচকে খদ্দের ভদ্রলোক বলে উঠলেন–ভুলে গেছি? ভুলে গেছি মানে?

আমতা আমতা করে পরিবেশক এবার বলল–স্যার, ওই যে ঠাণ্ডা পানি আর ব্রান্ডি পান করলেন।

ব্যস, আর যাবে কোথায়! খদ্দের ভদ্রলোক বাজখাই গলায় বলে উঠলেন–সে কী হে! ঠাণ্ডা পানি আর ব্রান্ডির দাম-স্বরূপ তোমাকে তো আগেই চুরুট দিয়ে রেখেছি–দিইনি বলতে চাও?

পরিশেক তো একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। সে এর কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে অথর্বের মতো নীরবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

খদ্দের ভদ্রলোক ধরতে গেলে তার ওপর মারমুখি হয়ে আগের মতো তড়পাতে লাগল–চালাকি করার জায়গা পাওনি! টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চুরুটটার দিকে আঙুলনির্দেশ করে তিনি এবার বললেন–তোমার সামনেই তো চুরুটটা পড়ে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না?

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু চুরুটের দাম তো আপনি শোধ করেননি।

যা আমি মুখেও তুলিনি তার জন্য দাম দিতে যাব? এমন আহাম্মক আমাকে পেয়েছ! বাজে ধান্ধা ছাড়, আমাকে যেতে দাও।

কিন্তু, কিন্তু–

এর মধ্যে কোনো কিন্তু টিন্তু নেই।

খদ্দের ভদ্রলোক রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দেবার পূর্ব মুহূর্তে উপস্থিত অন্যসব খদ্দেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন–শোন হে, মদের নেশা ধরিয়ে দিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে ঠকবাজি করার ধান্দা ছাড় বাছাধন! কথাটা বলেই সে লম্বা-লম্বা পায়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে পথে নেমে গেল। আর এদিকে পরিবেশক বেচারা নিতান্ত অপরাধীর মতো তাঁর ফেলে যাওয়া পথের দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

খুবই সাধারণ প্রকৃতির তঞ্চকতার একটা উদাহরণ এবার বলছি শুনুন–এক ভদ্রলোকের টাকার ব্যাগ খোয়া গেছে। খোয়া গেছে ঠিক বলা যাচ্ছে না, হারিয়ে ফেলতেও পারেন।

তিনি টাকার ব্যাগটা ফিরে পাবার আশায় খবরের কাগজে জিজ্ঞাপন দিলেন যে টাকার ব্যাগটা ফিরিয়ে দেবেন তাকে নগদ এত হাজার টাকা পুরস্কারস্বরূপ দেওয়া হবে।

খবরের কাগজের পাতার বিজ্ঞাপনটা এক তঞ্চকের চোখে পড়ল। তৎক্ষণাৎ সেটাকে নিজের পকেট বইয়ে টুকে নিল।

আসল বিজ্ঞাপনে কথার ফুলঝুরি ছিল, কিন্তু নকল কপিতে তা টোকা হলো না, বাদ দিয়ে জরুরি কথাগুলোই সে কেবলমাত্র টুকে নিল। এমনকি ঠিকানাটাও একটু আধটু রদবদল হয়ে গেল। প্রকৃত মালিকের পল্লিরই প্রতিবেশী অমুকের ঠিকানায় হারানো টাকার থলেটা ফেরৎ দিলেই প্রাপ্য পুরস্কার মিলে যাবে।

বড় বড় শহরে সারাদিনে বহুবার খবরের কাগজ বের হয়, অর্থাৎ ঘণ্টাখানেক পরপর। তঞ্চক মহাপ্রভু তার নকল বিজ্ঞাপনটা বের করেছিল আসল বিজ্ঞাপনটা সে খবরের কাগজে, যে সময়ে বেরিয়েছে তার কিছু সময় পর যে খবরের কাগজে বেরোবে তার পাতায়।

যথাসময়ে নকল বিজ্ঞাপনটা বুকে নিয়ে নির্দিষ্ট খবরের কাগজটা বেরল। এদিকে তঞ্চক বাবাজী নকল ঠিকানার সদর দরজার কাছাকাছি একটা গোপন জায়গায় শিকারি বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল, শিকার ধরার প্রত্যাশা নিয়ে।

একটু পরেই একজনকে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে নির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই তঞ্চক ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল।

প্রাপকের হাত থেকে টাকার ব্যাগটা নিয়ে তঞ্চক প্রথম বিজ্ঞাপনে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মিলিয়ে নিল। সে সন্তুষ্ট হয়ে টাকার ব্যাগটা নিয়ে তার হাতে পুরস্কার গুঁজে দিল।

ব্যস, টাকার ব্যাগটা পাওয়ামাত্র তঞ্চক আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে চোখের পলকে সেখান থেকে চম্পট দিল।

এদিকে বহু বিজ্ঞাপন যখন একই দিনে বহু কাগজে ছাপা হয়ে বের হয়, তখন প্রাপক বড় বিজ্ঞাপনের কথার ফুলঝুরি কথা ভুলে যায়। ঘুলিয়ে ফেলে। ছোট বিজ্ঞাপনের ঠিকানা অনুযায়ী চলে যায় বলেই তঞ্চককের ভাগ্য খুলে যায়। ফলে সহজেই তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

ঠিক একই রকম আর একটা তঞ্চকতার নমুনা তুলে ধরছি–এক ভদ্রমহিলা বহুমুল্য হীরার আংটি হারিয়েছেন। আংটিটা যেমন দেখতে চমৎকার দামও তেমনি আকাশ ছোঁয়া।

বহু খোঁজাখুঁজি করে হতাশ হয়ে ভদ্রমহিলা শেষপর্যন্ত খবরের কাগজের শরণাপন্ন হলেন। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনে আংটিটার যথাযথ বিবরণ দেওয়া হলো।

যথাসময়ে আংটিটার বিবরণ এবং পুরস্কারের কথাসহ খবরের কাগজ বেরল। ভদ্রমহিলা বিজ্ঞাপনে এও উল্লেখ করলেন, হিরার আংটির প্রাপককে কোনোরকম জেরা না করেই পুরস্কারস্বরূপ মোটা টাকা দেওয়া হবে। আর সে সঙ্গে আংটির মালিক ভদ্রমহিলার পুরো ঠিকানা তো দিলেনই।

বিজ্ঞাপনটা প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরে বিজ্ঞাপনের বর্ণনা অনুযায়ী ভদ্রমহিলার বাড়িতে একজন হাজির হলো। লোকটা এমনই সময়ে আংটিটা নিয়ে এলো যখন আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়িতে নেই। জরুরি দরকারে কোথায় যেন গেছেন। বাড়ির পরিচারক দরজা খুলে আগন্তুকের প্রয়োজনের কথা জানতে চাইল।

আগন্তুক খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কথা পাড়ল। পরািরক আংটিটা দেখতে চাইল।

আগন্তুক কোটের পকেট থেকে আংটিটা বের করে পরিচারকের সামনে ধরল।

সেটাকে দেখামাত্রই পরিচারক চিনতে বলল। খবরটা প্রকাশ হতেই ভদ্রমহিলার ভাই এবং অন্য কয়েকজন ছুটে এলেন। সবাই আংটিটা চিনতে পেরে একবাক্যে বলল–হ্যাঁ, এটাই হারিয়ে যাওয়া আংটি।

কিন্তু আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়িতে নেই শুনেই আগন্তুকের মুখ শুকিয়ে গেল। মনে মনে বিরক্তও হলো খুবই। পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করে এতটা পথ আসার পর বাঞ্ছিত ব্যক্তি বাড়ি নেই শুনলে যে কোনো লোকই বিরক্ত হবার কথা। সে বিষণ্ণ মনে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিল।

এমন সময় বাড়ির সবাই তাকে অনুরোধ করে বসতে বলল। তারপর পুরস্কারের টাকা মিটিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে আংটিটা নিল।

প্রাপ্য পুরস্কার বুঝে পেয়ে আগন্তুক খুশি মনে সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। একটু পরেই আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়ি ফিরলেন।

ব্যস, আর যাবে কোথায়, আংটিটা দেখেই ভদ্রমহিলার তো মাথায় রক্ত ওঠার যোগাড়। কেবল তারই নয় বাড়িসুদ্ধ লোকের বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। আরে ব্যস, এ যে রীতিমত দিনে ডাকাতি! লোকটা এতগুলো লোককে মুহূর্তের মধ্যে ঘোল খাইয়ে দিয়ে চলে গেল!

অনুশোচনা হবার মতো কথাই তো বটে। কারণ, আংটিটা যে নকল। একটা নকল আংটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে লোকটা এতগুলো টাকা নিয়ে চলে গেল। এ কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার।

এবার খবরের কাগজটা এনে বিজ্ঞাপনটা বের করা হলো। হ্যাঁ, আংটিটা অবিকল বিজ্ঞাপনের বিবরণ অনুযায়ী তৈরি বটে। কোথাও এতটুকু অমিল নেই। অতএব খুঁত ধরার সাধ্য কার? একমাত্র মালিক, যার হাতে সর্বক্ষণ সেটা থাকে, চোখে দেখে সে ছাড়া কারো পক্ষে তফাতটুকু ধরতে পারা তো সম্ভবও নয়। তাই তো তক্কে তক্কে থেকে, মালিকের অনুপস্থিতিতেই তঞ্চক মহাপ্রভু বাড়িতে হাজির হয়েছিল।

তঞ্চকতার শেষ? না, শেষ নেই। তঞ্চকতার কথা বলতে বসলেও শেষ করা যাবে না। একের পর এক ঘটনা স্মৃতির পটে ভেসে উঠবে। পাতার পর পাতা ভরবে। রাত কেটে যাবে, তবুও মনে হবে কাহিনী কতই না বাকি রয়ে গেছে। রাত ভর বললেও বুঝি তঞ্চকতার অর্ধেকও বলা হয়ে ওঠেনি।

যাক গে, শেষ যখন করাই যাবে না তবে এ-মুহূর্তে একটা পথই বেছে নেওয়া যেতে পারে সভ্যতার মোড়কে মোড়া একটা খুবই সুসভ্য সুপরিকল্পিত তঞ্চতার কাহিনী দিয়ে এ-নিবন্ধের যবনিকাপাত টানছি।

আর কেবলমাত্র সম্প্রতিকালেই না। এর পরবর্তীকালেও একের পর এক তঞ্চতার ঘটনা পৃথিবীর বুকে, পৃথিবীর প্রতিটা আনাচে কানাচে প্রতিদিন ঘটে চলেছে। আর পৃথিবীর বড় বড় শহরের বুকে তো তঞ্চকদের কারবার খুবই রমরমা। তবু আজ অবধি আমরা কেউ এ-ব্যাপারটা নিয়ে তেমন করে মাথা ঘামাইনি।

এবার আমেরিকার এক বড় শহরের ছোট্ট একটা তঞ্চকতার কাহিনী পাঠক পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরছি।

একবার সে শহরে এলেন এক ভদ্রলোক। মানে সবাই তাকে বিশিষ্ট ভদ্রলোক বলেই জানে। তার চেহারা ছবি যেমন দেখাক, আবার পোশাক আশাকও খুবই রুচিসম্মত ব্যবহার করেন। যাকে বলে সর্বদা একজন ভদ্ৰশিষ্ট ব্যক্তির মতো সেজেগুজে থাকেন। কথাবার্তাও রীতিমত রুচিশীল ব্যক্তির মতো। আচার আচরণ আর কথা বলার ধরন-ধারণ মহাশয় ব্যক্তির মতোই লক্ষণীয়। এক কথায় এমন মার্জিত স্বভাবের মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। প্রথম আলাপের মুহূর্তেই তিনি সবার মন ও নজর কেড়ে নেবার ক্ষমতা রাখেন।

ভদ্রলোক শহরে এসেই সোজা সম্ভ্রান্ত পল্লিতে চলে গেলেন। সেখানে খুঁজেপেতে সুদৃশ্য একটা বাড়ি ভাড়া করে ফেললেন।

আগন্তুক ভদ্রলোক বাড়িউলির সঙ্গে কথা বলে ভাড়া ঠিক করে ফেললেন। আর তাকে এ কথাও পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, প্রতি মাসের প্রথম দিনই সকাল দশটার মধ্যেই যেন এসে ভাড়া বুঝে নিয়ে রসিদ দিয়ে যায়। এমন একজন উদারচেতা নিষ্ঠাবান ভাড়াটে পেলে এমন কোন বাড়িউলি আছে যে খুশিতে ডগমগ হবে না?

ব্যস, আর কোনো সমস্যাই রইল না। বাড়িউলি এক মাসের অগ্রিম ভাড়া বুঝে পেয়ে, ভাড়াটের হাতে খুশিমনে বাড়ির চাবি তুলে দিলেন।

বাড়িউলি প্রথম মাস শেষ হতেই ভাড়াটে ভদ্রলোকের কথার দাম যে যথেষ্টই আছে তার প্রমাণ পেয়ে গেলেন। কারণ মাসের পয়লা তারিখে বেলা দশটার মধ্যেই ভাড়ার টাকা হাতে পেয়ে গেল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভাড়াটের প্রতি তার আস্থা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল।

এবার ভদ্রলোক শহরের এক নামি খবরের কাগজে অগ্রিম টাকা মিটিয়ে দিয়ে জবরদস্ত একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনটার মূল বক্তব্য এরকম–তিন-চারজন কেরানি নিয়োগ করা হবে। কর্মপ্রার্থীদের অবশ্যই শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভুত এবং মার্জিত স্বভাবের হতে হবে। কারণ অগাধ অর্থ তাদের জিম্মায় থাকবে, হাতাতে হবে। তাই চাকরিতে নিযুক্ত হবার আগে নির্বাচিত প্রার্থীদের কেরাণিদের মাত্র দেড় হাজার টাকা জমা রাখতে হবে।

সব শেষে কোম্পানির নাম ছাপা হয়েছে–বগ, হগস, লগস্, ফ্রগ অ্যান্ড কোম্পানি। ১১০, ডগ স্ট্রিট।

বিজ্ঞপনের পাতায় প্রতিষ্ঠানটার এমন একটা বাহারি নাম দেখে সবাই তো রীতিমত ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হলো। কারো মনে এতটুকু সন্দেহ জাগল না জাগার কথাও নয়। খালি পাত্রের আওয়াজ বেশি এ-কথা কারো অজানা না থাকলেও কেউ তিলমাত্র বিপরীত ধারণাও করতে পারল না।

এক মাসের মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশজন কর্মপ্রার্থী ভদ্রলোকের বাড়ির দরজায় এসে হাজির হলো। প্রত্যেকেই চাকরিটা পাওয়ার জন্য তার কাছে বহুভাবে কাকুতি মিনতি জানাতে লাগল।

ভদ্রলোক কিন্তু প্রথম দিন কাউকেই চাকরিতে বহাল করার আগ্রহ দেখালেন না।

পরবর্তীকালে অর্থাৎ মাসের শেষ দিন বারে বারে পঞ্চাশ জনকেই চাকরিতে বহাল করলেন। আর প্রত্যেকের কাছ থেকে দেড় হাজার করে নগদ টাকা বুঝে নিয়ে রসিদও দিয়ে দিলেন প্রত্যেককে।

মাসের এক তারিখ সকাল দশটায় এক এক করে পঞ্চাশজনই কোম্পানির দরজায় হাজির হলো চাকরিতে যোগদান করার বাসনা নিয়ে। কিন্তু হায়! কোথায় অফিস! কোথায়ই বা কোম্পানি মালিকই বা কোথায় গেলেন? পাখি খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে।

এদিকে বাড়িউলি সকাল দশটায় রসিদ নিয়ে হাজির হতে পারল না। ফলে তার পক্ষে ভাড়া বুঝে পেয়ে রসিদটা তার হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হলো না। কিন্তু যদি এক মিনিট আগে, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটায় রসিদ নিয়ে হাজির হতো তবে কি সত্যনিষ্ঠ মার্জিত স্বভাবের নৈপুণ্যের সঙ্গে কোম্পানি পরিচালনাক্ষম ভদ্ৰবেশি তঞ্চকের দেখা পেত, নাকি ভাড়ার টাকা হাতে পেত?

থ্রী সানডেস ইন এ উইক

তোমার মনটা পাথরের মতো কঠিন।

তোমার মাথায় ঘিলু বলতে রতিও নেই। তুমি একটানিরেট বোকা, হদ্দ বোকা। তুমি একটা গোয়াড়গোবিন্দ, বদমেজাজি, বস্তাপচা তোমার বুদ্ধি বিবেচনা আর সেকেলে একটা বুড়ো হাবড়া! আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্তর সামনে ঘুষি বাগিয়ে কল্পনার মাধ্যমে আমি এ-কথাগুলো উচ্চারণ করলাম।

হ্যাঁ, কল্পনা। কল্পনার মাধ্যমেই আমি কথাগুলো বললাম।

আসল ব্যাপারটা হল, আমি যা-কিছু করতাম আর যা-কিছু করতে ইচ্ছা হত উভয়ের মধ্যে সামান্য হেরফের তো থাকতই থাকত।

আমি বৈঠকখানার দরজা খুলেই দেখতে পেলাম, চুল্লির তাকটার ওপরে পা দুটো তুলে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বুড়ো হাবড়াটা বসে রয়েছে। আর তার হাতে মদ-ভর্তি একটা বোতল।

আমি দরজাটা খুলে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। আস্তে আস্তে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম-পূজনীয় কাকা, তুমি এত বেশি মাত্রায় হৃদয়বান, দয়ার অবতার, সুবিচেক।

তিনি প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন–‘হ্যাঁ, বুঝলাম বাছা, তোমার যা বক্তব্য আছে বল।’

আমি আবার মুখ খুললাম–‘কাকা, আমি নিঃসন্দেহ যে, আমার পূজনীয় কাকা, কেটের সঙ্গে আমার মিলনের ব্যাপারে বাধা দেবার মতো কোনোরকম ইচ্ছা তোমার নেই। তুমি যা-কিছু বলছ তা নিছকই একটা রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। আম নিশ্চিত। আমি জানি, আমি এটা খুব ভালোই জানি। সত্যি বলছি, মাঝে মধ্যে তুমি কী সুন্দর মানুষই না হয়ে ওঠ।

ফিক করে হেসে তিনি ছোট্ট করে বললেন–উচ্ছন্নে যাও তুমি।’ তারপর অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন–‘অবশ্যই! অবশ্যই। ঠিকই বলেছ বাছা।

আর আমি এ ব্যাপারেও নিঃসন্দেহ যে, আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছিলেন। শুনুন কাকা, সম্প্রতি কেট আর আমার একমাত্র ইচ্ছা–আপনার সুচিন্তিত সারগর্ভ পরামর্শ দান করে আমাদের ধন্য করুন। পরামর্শ বলতে আমি সময়টার কথা বলতে চাইছি। কাকা, আপনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি বলতে চাইছি, সংক্ষেপে ব্যাপারটা হল, আমাদের বিয়েটা কবে, কখন সম্পন্ন হলে আপনার পক্ষে সুবিধা হয়, বুঝতেই তো পারছেন, এ-কথাটা জানার জন্যই আমি এমন ধানাই-পানাই করছি।

‘ওরে হতচ্ছাড়া কোথাকার। তুই কি বলতে চাইছিস, আমার মাথায় আসছে না? তার চেয়ে বরং বল কখন সম্পন্ন হয়ে গেল? বল তো?

‘হ্যাঁ! হা! হো! হো! আ! কী ভালল! কী চমৎকার কথা! কী ভালো কাকাটি আমার! কী বুদ্ধিমানের ঢেকি! কী আমার পরম পূজনীয় কাকা, এখন আমার যা-কিছু জানতে ইচ্ছে করছে, মানে জানতে চাইছি।’

‘কি জানতে চাইছিস, খোলাসা করে বল তো?’ মানে কোন্ সময়ে

‘আমার একটা কথাই জানা দরকার, সঠিক সময়টা মানে কোন্ সময়ে আমাকে বলে দাও।

‘উফ! সঠিক সময়? সঠিক সময়টা জানার জন্য খুবই উতলা হয়ে পড়েছিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ, কাকা, সঠিক সময়টা–তবে আপনার যদি এ-ব্যাপারে কোনো ওজর আপত্তি না থাকে।

মুহূর্তের জন্য কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এঁকে বুড়োভামটা বললেন– একটা কথা–’

তাঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম-এর মধ্যে একটা কথার কি থাকতে পারে।

‘আরে পারে, থাকতে পারে বলেই তো–’

‘ঠিক আছে তোমার সে-একটা কথা বলতে কি বলতে চাইছ, খোলসা করেই বল?

‘কথাটা হচ্ছে, আমি যদি এ ব্যাপারটাকে অনেক দূর টেনে নিয়ে যাই, মানে অনেকটা পিছিয়ে দেই, তবে?

‘আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, অনেক পিছিয়ে দিতে চাইছেন?

‘হ্যাঁ। অনেকটা মানে–মনে কর এক বছর-দুবছর বা ওরকম কোনো একটা সময়ের কথা বলছি।

আমি চোখ দুটো কপালে তুলে সবিস্ময়ে বললাম–এক বছর-দু বছর বা তার চেয়েও বেশি?

‘হ্যাঁ! তবে কি কাজটা সঠিক হবে, বল তো?

‘ইয়ে মানে আপনি যদি তা-ই সঠিক জ্ঞান করেন।

‘ভালো কথা। ঠিক আছে ববি, সোনামণি আমার, বাছা আমার, কী ভালো ছেলেই তুমি! সচরাচর এমন ভালো ছেলে চোখেই পড়ে না। ঠিক বলিনি?’

‘কাকা–‘

আমাকে কথাটা বলতে না দিয়ে আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ কাকাই আবার বলতে লাগলেন–শোন বাছাধন আমার, সঠিক সময়টাই যখন আমার কাছে জানতে চাইছ। তখন আমি মাত্র এই একটাবারের জন্য তোমাকে ধন্য করব, বুঝলে কিছু?

‘আদরের কাকা আমার। লক্ষ্মী কাকা আমার।

আমার কণ্ঠস্বরটাকে চাপা দিয়ে, গলা ছেড়ে বুড়োভাম আমার পূজ্যাস্পদ কাকা এবার বলে উঠলেন–‘চুপ কর বাপধন! চুপ কর! আমি এই একবার মাত্র এই একবার তোমাকে ধন্য করব।’

‘আমার লক্ষ্মী কাকা! সোনামণি কাকা আমার!

‘যা বলছি, মন দিয়ে শোন, তোমাকে আমি সম্মতি দেব। আমার ভোজটা–জেনে রাখ, ভোজের কথাটা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখছি, কি করা যায়।

‘উফ! আবারও ভাববেন!

‘হ্যাঁ, ভাবতে তো হবেই বাছাধন। ব্যাপারটা তো কম জটিল নয়। ভাবনাচিন্তা তো অবশ্যই করা দরকার। আমি কণ্ঠস্বরে কিছুটা উন্মা প্রকাশ করে বললাম–‘বেশ আপনি ভাবুন, সারাটা জীবন ধরে আপনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন।

‘তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন বাপধন।

‘এটা উত্তেজিত হবার মতো কথা নয়, আপনি বলতে চাইছেন?

‘যাক গে, মাথা ঠাণ্ডা করে শোন, আমি কি বলতে চাইছি। যাক এবার বল তো বিয়েটা কবে হতে পারে?

‘আমিই যদি তা ঠিক করব তবে আর আপনাকে মিছে বিরক্ত করতে যাব কেন, বলতে পার? আজ তো রবিবার ঠিক কি না?

‘হ্যাঁ, আজ রবিবারই বটে।

‘তবে কবে তোর বিয়েটা সেরে দেওয়া যেতে পারে–ঠিক কবে সারা যেতে পারে! বাপধন, আমার কথাগুলো তোর কানে ঢুকছে তো? আমার দিকেনিস্তেজ চোখের মণি দুটো মেলে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে নিয়ে তিনিই আবার বলতে আরম্ভ করলেন– কি হে, অমন বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছিস যে বড়! আমি বলছি–কথা দিচ্ছি, কেটকে তুই নিজের করে পাবি।

‘পাব? আপনি বলছেন, কেটকে আমি পাব।’

‘পাবি। অবশ্যই পাবি বাপধন। শুধু পাবিই না, সে সঙ্গে পেটপুরে ভোজও খাবি।

‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা কবে?

‘কবে? যখন একই সপ্তাহে তিনটি রবিবার পড়বে।

‘একই সপ্তাহে তিন-তিনটি রবিবার!

‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। তার আগে অবশ্যই নয়। হতচ্ছাড়া নচ্ছাড় পাজি কোথাকার–তার আগে অবশ্যই নয়, জেনে রাখ । মাথা খুটে মরলেও তার আগে হবার নয়। হতচ্ছাড়া চরিত্রহীন–জেনে রাখ, তার আগে কিছুতেই নয়।

‘হুম! ‘বাপধন, তুই তো আমাকে ভালোই জানিস–এক কথার মানুষ আমি।’

‘হুম!

‘আমার কথা তো সাফ সাফই তোকে বললাম। এবার আমার সামনে থেকে কেটে পড়।

কথাটা বলেই বুড়ো হাবড়াটা হাতের বোতলের ছিপিটা খুলে ঢক ঢক্‌ করে মদ গিলতে লাগলেন।

আমি রাগে গ গস্ করতে করতে হতাশায় জর্জরিত মন নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। আর আমার পরম পুজ্যাস্পদ কাকা মদের বোতলটা নিয়েই মেতে রইলেন।

আমার কাকা ক্যাবলাকান্ত একজন সভ্য-ভব্য রুচিবান বৃদ্ধ ইংরেজ। আর যথার্থই একজন ভদ্রলোক বলে তার খ্যাতি রয়েছে। তবে এ নামের গানের লোকটার সঙ্গে তার বৈসাদৃশ কিছু না কিছু অবশ্যই রয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, তার কয়েকটা দুর্বল দিক অবশ্যই রয়েছে। সে হচ্ছে, একজন বেঁটেখাটো, ইয়া বড় টাকওয়ালা, রসিক আর প্রেমের পূজারি আর দেহটা প্রায় অর্ধগোলাকৃতি । তিনি এমন একজন পুরুষ যার নাকটা টকটকে লাল, লম্বা একটা টাকার থলে সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে আর নিজের মান সম্মান সম্বন্ধে যারপর নাই সচেতন। কোনো পরিস্থিতিতেই মর্যাদা নষ্ট করতে সে রাজি নয়।

একমাত্র তাঁর এরকম অদ্ভুত চরিত্র, আর এরকম অভাবনীয় চারিত্রিক বৈচিত্র্যের জন্যই বাইরের লোকজন, পরিচিত মহলে সবাই তাকে একজন হাড়কিপ্টে বলেই জানে।

আরও আছে, সমাজের বহু ভালো মানুষের মতোই তিনি আরও একটা বিশেষ গুণের অধিকারী। সেটা হচ্ছে, মানুষকে আশা ভরসা দিয়ে হঠাৎ করে নিরাশ করার গুণের কথা বলতে চাইছি। সত্যি তাঁর এ মনোভাবটা বড়ই অদ্ভুত।

যে কোনো লোক, যে কোনো প্রশ্নই করুক না কেন, তিনি সরাসরি জবাব দিয়ে থাকেন–‘না’।

তবে এও সত্য যে, দু-একবার সামান্য অনুরোধ করলেই নিজের মতো পরিবর্তন করে ফেলেন। আর টাকার থলেটার দিকে কেউ লালসা-মাখানো দৃষ্টিতে তাকায়, হাত বাড়ায় তবে কঠোরভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তবে এও সত্য যে, যদি গো ধরে বসে থাকলে টাকার অঙ্কটা মোটাই হয়ে যেত।

আর দান ধ্যানের বেলায়ও দেখা যায়, তাঁর মতো উদার হৃদয় ব্যক্তি সচরাচর হয় না। তবে এও খুবই সত্য যে, তবে তাকে অকৃপণভাবে কাউকে কিছু দান করতে দেখা যায়নি।

এ বুড়ো লোকটার সঙ্গে কাছাকাছি, পাশাপাশি আমি সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছি। আমার বাবা-মা দুনিয়া ছেড়ে যাবার সময় এক বহুমূল্য উত্তরাধিকাররূপে আমাকে তাঁর জিম্মায় সঁপে দিয়ে গেছেন।

আর যা-ই হোক না কেন, আমি কিন্তু মনে প্রাণে বিশ্বাস করি নচ্ছাড় এ বুড়ো হাবড়াটা আমাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশিই ভালোবাসেন। তবে এও সত্য যে, তিনি আমাকে খুব ভালোবাসলেও কেটকে যতটা ভালোবাসেন ততটা অবশ্যই নয়। আর ভালোবাসলেও তার কবলে পড়ে আমি তো একটা পোষা কুকুরের মতোই জীবন ধারণ করছি।

সত্যি বলছি, প্রথম থেকে পঞ্চাশ বছর অবধি পাঁচ-পাঁচটা বছর তিনি প্রতিদিন আমাকে নিয়মিত বেতের আঘাতের শাসনে ধন্য করেছেন।

পাঁচ থেকে পনের বছর অবধি দীর্ঘ দশ-দশটা বছর তিনি প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় আমাকে শোধনাগারের ভয় দেখিয়ে জড়সড় করে রাখতেন।

তারপর পনেরো থেকে বিশ বছর পর্যন্ত পাঁচটা বছরের মধ্যে এমন একটা দিন যায়নি যেদিন আমাকে মাত্র পাঁচটা শিলিং হাতে গুঁজে দিয়ে তিনি বিদায় করে দেবার ভয় দেখাননি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি রীতিমত একটা দুঃখি কুকুর। কিন্তু সেটাই তো আমার জীবনের একটা অংশে পরিণত হয়ে উঠেছিল। আমার বিশ্বাসের একটা অংশ ছিল।

অবশ্য কেট ছিল আমার বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য আর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। এ ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগই বিশ্বাসী ছিলাম।

সত্যি বলছি, মেয়ে হিসেবে কেট বড়ই ভালো। তার ভেতর বাহির সবটাই ভালো। সে আমাকে ভালোবাসে। আর সে ভালোবাসানিখাদ। সে আমাকে কথা দিয়েছে পাকা কথা–ভাঁওতা দিয়ে আমার ক্যাবলাকান্ত কাকাটির মন জয় করতে পারলে, তাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারলেই সে আমাকে বিয়ে করবে।

কেট! বেচারি কেট! আমার মন ময়ুরী–আমার প্রিয়তমা কেট। তার বয়স পনেরো বছর। সামান্য অর্থকড়ি যা আছে তা দিয়ে কোনোরকমে দিন গুজরান হয়ে যায়।

আমার মতে পনেরো বছর বয়সে যা-কিছু আছে, একুশ বছরেও তার খুব একটা হেরফের হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।

কিন্তু হায়! এ কী ঝকমারিতেই না পড়া গেল রে বাবা! হাড়গিলে বুড়োটার কাছে গিয়ে বহু বহু তোয়াজ, হা-পিত্যেশ কান্নাকাটি করেছি। কি কাকস্য পরিবেদন। ফলাফল লবডঙ্কা। বার বার হতাশ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে।

কী পাষণ্ড বুড়োট! তার বুকটা সত্যি পাথর দিয়ে তৈরি। দয়া-মায়ার লেশটুকুও নেই। নচ্ছাড়টা আমাদের মতো দুটো ইঁদুরছানাকে নিয়ে এমন নির্মম খেলায় মেতেছে যা দেখে কেবল রক্ত মাংসের মানুষই নয়, স্বয়ং জোভ-এরও ক্রোধে ফেঠে পড়ার কথা। শত তোয়াজ করেও হাড়গিলে বুড়োটার মন জয় করা যাচ্ছে না। এঁটুলির মতো। সর্বদা তার গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছি তবুও তার পাথর মন এতটুকুও নরম হচ্ছে না।

নচ্ছাড় বুড়োটা মনে-প্রাণে আমাদের বাসনা পূর্ণ করার মতো একটা অজুহাত দাঁড় করাতে পারলেই দুম্ করে দশ হাজার পাউন্ড খসাতে রাজি আছে।

কিন্তু হায়! আমরা এমনই আহাম্মক যে, বিয়ের ব্যাপারটা নিজেরাই ঠিক কেবল নয়, পাকা করে ফেলেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমরা এতটা এগিয়ে যাওয়ায় বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, অর্থাৎ বিয়েটা তিনি কিছুতেই ঠেকাতে পারবেন না।

আমি তো তাঁর কিছু কিছু দুর্বলতার কথা আগেই বলে রেখেছি। সবকিছু খোলসা করে বললেও তাঁর একগুঁয়েমির কথা তেমন কিছু বলা হয়নি, মানে বলিনি।

আমি তার দুর্বলতার কথা বলেছি সত্য। দুর্বলতা বলতে আমি সে-কথাই বোঝাতে চেয়েছি যে, তিনি একরকম মেয়েলি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আর সে কুসংস্কারগুলো তিনি মনে প্রাণে মেনে চলেন।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাতর কুসংস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্ন আর অমঙ্গল প্রভৃতির ব্যাপারে তার বিশেষ বিশ্বাস।

কুসংস্কার ছাড়া আর যা-কিছু তিনি মেনে চলেন তাদের মধ্যে আর যেগুলোকে তিনি বেশি করে মেনে চলেন তা হচ্ছে, কথা রাখারাখির ব্যাপার আর ঠুনকো মান। সম্মানবোধ। পুরো ব্যাপারটাই তবে খোলসা করেই বলা যাক। ব্যাপারটা কি হল– অদৃষ্টকেই সবকিছুর জন্য দায়ী না করে পারা যাচ্ছে না।

আমার বাগদত্তা কেটের পরিচিত নৌ-বিভাগের দুটো লোক আছে। তারা এক বছর বিদেশে কাটিয়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হয়।

১০ অক্টোবরের কথা। সেদিনটা ছিল রবিবার। পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী সেদিন বিকেলে সেই দুজন লোককে সঙ্গে করে আমি আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্তর সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে হাজির হলাম। আমাদের আশা আকাঙ্খ তছনছ হয়ে যাবে মনে গেঁথে রাখার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক তিন সপ্তাহ পরে সে ঘটনাটা ঘটে।

আমরা তাঁর বাড়ি পা দেবার পর প্রথম আধঘণ্টা মামুলি কথাবার্তার মধ্য দিয়েই কেটে যায়। তারপর খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমরা আলোচনাটাকে মোড় ঘুরিয়ে এভাবে নিয়ে গেলাম–

ক্যাপ্টেন প্যান্ট বললেন–আপনি তো জানেনই যে, তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুড়ো খুল্লতাত বলে উঠলেন–‘কথা? কি কথা, নির্দিধায় বলে ফেলুন মি. প্র্যান্ট।

‘কথাটা হচ্ছে, আমি এক বছর এখানে ছিলাম না তা-তো আপনি ভালোই জানেন, কী বলেন?’

‘হ্যাঁ, তা জানি বটে।’

‘আজ ঠিক এক বছর পূর্ণ হলে আমি আবার এ দেশের মাটিতে পা দিয়েছি।’

‘হ্যাঁ, তা-তো দেখতেই পাচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, আজ তো দশই অক্টোবর–আজই এক বছর পূর্ণ হল। আশা করি আপনার অবশ্যই মনে আছে মি. ক্যাবলাকান্ত, গত বছর ঠিক এ তারিখটাতেই আপনার বাড়ি এসেছিলাম, বিদায় নেবার জন্য।

‘হ্যাঁ, মনে আছে–অবশ্যই মনে আছে।

‘ভালো কথা, ব্যাপারটা কিন্তু আকস্মিক যোগাযোগই সন্দেহ নেই–আমাদের এ বন্ধু ক্যাপ্টেন স্মিদার্টনও ঠিক এক বছর এখানে ছিলেন না। তিনিও আজই এখানে পৌঁছেছেন।

এবার ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বললেন–‘হ্যাঁ, এক বছরই বটে। ঠিক এক বছরেরই ব্যাপার। ঠিক এক বছর বিদেশে কাটিয়ে আজই এখানে পৌঁছেছি।’

‘হ্যাঁ–হ্যাঁ, তা বটে। আমার হাড়গিলে খুল্লতাত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন।

‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আশা করি আপনার স্মরণ আছে, গত বছর ঠিক যে দিনে, অর্থাৎ দশ অক্টোবর ক্যাপ্টেন এ্যান্টের সঙ্গে আপনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার জন্য আমিও এ-বাড়িতে এসেছিলাম।’

‘আছে, অবশ্যই মনে আছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে মনে তো আছেই। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুতই বটে মি. স্মিদার্টন, তাই না?

‘কেন? অদ্ভুত কেন?’

‘অদ্ভুত নয় বলছেন? আপনারা দুজনই ঠিক এক বছর আগে গিয়েছিলেন।

আবার আজ, আবার একই দিনে দেশের মাটিতে ফিরে এসেছেন। অদ্ভুত তো বটেই।

‘এদিক থেকে তো অদ্ভুতই বটে।

‘খুবই আশ্চর্য যোগাযোগ। ডক্টর ডাবু এলো. ডী, যাকে ঘটনার এক অদ্ভুত যোগাযোগ আখ্যা দিয়েছেন। ডক্টর ডাক্ বলেন–‘

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কেট আগ বাড়িয়ে বলে উঠল–‘ব্যাপারটা যে অদ্ভুত এ-কথা তো স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বাবা, ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আর ক্যাপ্টেন প্যান্ট তো ঠিক একই দিকে, মানে একই পথে যাননি। আর আশা করি অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না, সেটাই উভয়ের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য, ঠিক বলিনি?

আমার পূজ্যাস্পদ কাকা বললেন–‘বাছা, আমি অন্য কোনো কথা বুঝি না। কি করেই বা বুঝব, বল? আমার কিন্তু ধারণা, ব্যাপারটা এরই ফলে আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডক্টর ডাবল’।

তাঁকে নামিয়ে দিয়ে কেট আবার সরব হল–না, তা কেন হবে? ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন উত্তমাশা অন্তরীপে গিয়েছিলেন, আর হর্ণ অন্তরীপ ঘুরে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট।

‘ঠিক! একদম ঠিক কথা বলেছ। একজন গিয়েছিলেন পশ্চিম দিকে, আর দ্বিতীয়জন গিয়েছিলেন পূর্বদিকে, ঠিক কি না?

কেট বলল–‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

‘ভালো কথা, ডক্টর ডাব–‘

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম–‘ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আর ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট, আপনাদের কাছে আমার একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ আছে।

‘অনুরোধ? কি বলছেন, খোলাখুলি বলেই ফেলুন?’ ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন ও ক্যাপ্টেন প্যান্ট সমস্বরেই বলে উঠলেন।

‘আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ আগামীকাল সন্ধ্যায় আপনাদের একবারটি আমার বাড়ি আসতে হবে।

উভয়ে মুচকি হেসে প্রায় সমস্বরেই বলে উঠলেন–সে-না-হয় এলাম, কিন্তু কেন দয়া করে বলবেন কী?

‘আরে ব্যাপার তেমন কিছুই নয়, কিছুক্ষণ একসঙ্গে বসে গল্পসল্প আর পানাহার করে কাটাতে চাচ্ছি, এই আর কি।

উভয়ে হাসতে হাসতে এবার বললেন–‘ব্যাপারটা অবশ্যই খুবই আনন্দের আপত্তির কোনো কারণই থাকতে পারে না।’

‘তবে কথা এই, ক্যাপ্টেন স্মাির্টন আর আপনি ক্যাপ্টেন প্যান্ট–আপনারা আপনাদের সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা গল্পাকারে শোনাবেন, সবাই মিলে আনন্দ করে হুইস্ট খেলব আর গলা অবধি মদ–‘।

ক্যাপ্টেন প্যান্ট তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–‘গলা অবধি যে মদ গিলতে চাচ্ছেন–কিন্তু আগামীকাল যে রবিবার সেটা কি খেয়াল আছে? অবশ্য আমারও এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, স্বীকার করে নিচ্ছি।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্ত সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বললেন ‘আরে আপনাদের উভয়কে কাছে পেয়ে আমি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে এতই অভিভূত হয়ে পড়েছি যে, আগামীকাল কি বার তা-ও আমার হুঁশ নেই!

ক্যাপ্টেন প্যান্ট, মুখের হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই এবার বললেন–‘আপনার নিমন্ত্রণ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি। তবে আগামীকালের পরিবর্তে বরং অন্য কোনো দিন

কেট এতক্ষণ নীরবে সবকিছু শুনছিল। সে এবার মুখ না খুলে পারল না– আরে ধৎ! আপনারা কী সব যা-তা বকছেন, বুঝছি না তো!

ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট নিতান্ত অপরাধীর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল–কেন? আবার কী হল?

‘আসলে আবেগের বশে আপনারা সবাই সবকিছু গোলমাল করে ফেলছেন দেখছি। আমি ভালোই জানি, রবার্ট এত ভুললামন নন। তবু তিনিও যেন সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন।’

‘সবই মেনে নিচ্ছি, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী?

‘যে রবিবার নিয়ে আপনারা এত কচলাকচলি করছেন, তা কিন্তু অবশ্যই আগামীকাল নয়–আজই তো রবিবার।

আমার পরম পূজ্যাস্পদ খুল্লতাত ক্যাবলাকান্ত মুহূর্তে মিইয়ে গিয়ে জিভ কেটে বললেন–দেখ দেখি কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার, কী লজ্জার ব্যাপার দেখুন তো! সত্যি আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! ঠিক, ঠিক তো! আজই তো রবিবার!

ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট তাদের কথার মধ্যে নাক গলালেন–‘দেখুন, আমি আগেই আপনাদের উভয়ের কাছেই মার্জনা ভিক্ষা করে নিচ্ছি। আমি কিন্তু এখনও দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছি, আমার এত ভুল হয়ই না। তাই আমি এখনও বলছি আজ না, আগামীকালই রবিবার।

কেট কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে বললেন–‘কি বললেন? আগামীকাল রবিবার?

‘অবশ্যই! কারণ–

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–

‘আপনারা যে কি বলছেন আমার মাথায় যাচ্ছে না। আমি বলতে চাইছি, গতকাল কী রবিবার ছিল না।’

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন ছাড়া অন্য সবাই সমস্বরেই বলে উঠলেন–‘গতকাল গতকালই বটে। আপনি হেরে গেছেন।

আমার খুল্লতাত বললেন–‘আজ রবিবার, হ্যাঁ, আজই রবিবার। আমি কি এটা জানি না?’ ক্যাপ্টেন প্যান্ট বলে উঠলেন–‘না, আজ কিছুতেই নয়, আগামীকালই রবিবার।

স্মিদার্টন আবার মুখ খুললেন–‘আপনাদের সবারই মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। আপনারা সবাই পাগল হয়ে গেছেন দেখছি। এই যে আমি এখানে, এই চেয়ারে বসে রয়েছি এটা যেমন সত্য আর আগামীকাল যে রবিবার ঠিক তেমনই সত্য।

কেট উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে রীতিমত ফুঁসতে লাগল–‘আমি সবই বুঝতে পেরেছি। কাকা এটা কি আপনার বিচার সভা বসেছে নাকি? এখানে কি তোমার জ্ঞান বৃদ্ধির বিচার হচ্ছে?

‘হুম! আমার খুল্লতাত প্রায় অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন।

কেট আগের মতোই ফুঁসতে ফুঁসতে এবার বলল–‘কাকা তর্কাতর্কি বাদ দিয়ে ব্যাপারটার নিষ্পত্তির দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দিন। দেখবেন, এক মিনিটের মধ্যেই কেমন অনায়াসেই ফয়সালা করে দিচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা কিন্তু পানির মতোই পরিষ্কার।

‘খুবই সহজ সরল।’

‘অবশ্যই। নিতান্তই সহজ সরল একটা ব্যাপার নিয়ে তোমরা এতগুলো লোক নিজেদের মধ্যে কথা-কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়েছ। এখন আমি কি বলছি সবাই ধৈর্য ধরে শোন–ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বলছেন গতকাল ছিল রবিবার, ছিলও ঠিক তাই। অর্থাৎ তিনি ঠিকই বলেছেন–ববি, কাকা আর আমার বক্তব্য হচ্ছে, আজই রবিবার তিনিও ঠিক, আবার আমরাও ঠিকই বলছি। আবার ক্যাপ্টেন প্যান্ট এ দুটোর কোনো মতকেই সমর্থন করছেন না। তিনি বলছেন, আগামীকাল রবিবার। তাই হবে, মেনে নিচ্ছি। তিনিও ঠিকই বলেছেন। তবে কার্যত কি দেখা যাচ্ছে, বলুন তো?

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই কেট এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

সবার মুখের ওপর মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে কেট আবার সরব হল– ‘এখন দেখা যাচ্ছে, আসলে আমাদের সবার কথাই ঠিক, অর্থাৎ একটা সপ্তাহে তিনটি রবিবার হয়ে গেছে। আমাদের কারো কথা মিথ্যা নয়, কেউই কারো কাছে হেরে যাইনি, আপনারা কী বলেন?

কেটের কথা শেষ হলে সবাই একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগল।

মুহূর্তের জন্য থেমে স্মিদার্টন এবার মুখ খুললেন–‘ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট, এটা কেমন কথা হল। কেট বাজিমাৎ করে দেবে? আমাদের ওপর দিয়ে টেক্কা মেরে এভাবে নাস্তানাবুদ করবে?

‘হ্যাঁ, কার্যত তা-ই তো দেখছি। বিমর্ষমুখে ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট জবাব দিলেন।

স্মিদার্টন বলে চললেন–‘আমরা কী আহাম্মক! মি. ক্যাবলাকান্ত, এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা এরকম আমরা, সবাই জানি, পৃথিবীর পরিধি চব্বিশ হাজার মাইল তাই না?

‘হ্যাঁ, তা তো আমরা অবশ্যই জানি।

‘এখন কথা হচ্ছে, পৃথিবীটা নিজের অক্ষের ওপরে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অনবরত চক্কর খেয়ে বেড়ায়। মানে পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে চব্বিশ হাজার মাইল একবার পরিক্রমা করে। এবার আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাতর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বললেন–‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আশা করি ব্যাপারটা এবার আপনার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে, কি বলেন?

আমার খুল্লতাতটি ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে ঘাড় কাৎ করে তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললেন–‘অবশ্যই অবশ্যই, ডক্টর ডাব–‘

তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন বললেন–ক্যাপ্টেন প্যান্ট, তবে। ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে, এটা ঘণ্টায় এক হাজার মাইল গতিতে চলছে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, হিসেবে তো এরকমই দাঁড়াচ্ছে।

‘এবার মনে করুন, আমি এখান থেকে জাহাজে চেপে এক হাজার মাইল পূর্বদিকে গেলাম। তবে আমি অবশ্যই লন্ডনে এখানে লন্ডনে সূর্যোদয় আশা করব এক ঘণ্টায়। অতএব ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে আপনার এক ঘণ্টা আগে আমি সূর্যের মুখ দেখছি, ঠিক কি না?’

‘যা নির্ভেজাল বাস্তব তাকে তো অস্বীকার না করে উপায় নেই।

‘এবার যদি একই দিকে, অর্থাৎ পূর্ব-দিকেই আর এক হাজার মাইল গেলে, দুঘণ্টা আমি সূর্যোদয় আশা করব। তারপর একই দিকে, একই গতিতে ক্রমাগত চলতে থাকলে আমি সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকে চক্কর মেরে আবার একই জায়গায় ফিরে আসব। তখন এক হাজার মাইল পূর্বদিকে অগ্রসর হবার ফলে আমি চব্বিশ ঘণ্টা আগে লন্ডনে সূর্যোদয় দেখতে পাব–এরকম প্রত্যাশা তো করা যাবে না। এবার আশা করি বুঝতে পারছেন, আপনার চেয়ে আমি এক ঘণ্টা এগিয়ে রয়েছি। ক্যাপ্টেন প্যান্ট, আমি কি মনে করতে পারি, ব্যাপারটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি?

ক্যাপ্টেন প্যান্ট নীরবে মুচকি হাসলেন। তিনি মুখ খোলার আগেই আমার খুল্লতাত বলে উঠলেন–সবই তো হল, কিন্তু ডাব এলো ডী’

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন এবার অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে বললেন–এবার ক্যাপ্টেন প্যান্টের কথাটা বিবেচনা করা যাক। কি বলেন?

ক্যাপ্টেন প্যান্ট ঘাড় তুলে তার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকালেন।

তিনি মুখ খোলার আগেই ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আবার বলতে আরম্ভ করলেন–‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, অন্য দিকে ক্যাপ্টেন প্র্যান্ট যখন এখান থেকে আমার বিপরীত দিকে, অর্থাৎ ক্রমাগত পশ্চিমদিকে জাহাজ চালিয়ে, এক হাজার মাইল পাড়ি দিলেন তখন হলো এক ঘণ্টা–এভাবে ক্রমাগত জাহাজ চালাতে চালাতে যখন চব্বিশ ঘণ্টা জাহাজ চালানো হবে তখন দেখা যাবে তিনি চব্বিশ হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন। অতএব দেখা যাবে লন্ডনের সময় থেকে তিনি পুরো একটা দিন পিছিয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা এবার খোলসা হলো তো?’

আমার বুড়ো হাড় গিলে কাকাটি নিতান্ত বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–‘এবার বুঝলেন তো, এভাবেই আমার কাছে গতকাল রবিবার ছিল। আর ক্যাপ্টেন এ্যান্টের কাছে হিসাব মতো আগামীকাল হবে রবিবার।

আমরা সবাই তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখে সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বলে চললেন–‘মি. ক্যাবলাকান্ত, আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কথা কি জানেন?

আমার পরম পুজ্যাস্পদ খুল্লতাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। ক্যাপ্টেন স্মিদার্টন আগের মতোই বলে চললেন–‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের বক্তব্যই ঠিক। আর আমাদের একজনের ধারণা অন্যের ধারণার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করার পিছনে কোনো দার্শনিক কারণ অবশ্যই থাকা সম্ভব নয়।

আমার হাড়গিলে বুড়ো খুল্লতাত উল্লসিত হয়ে বললেন–‘আরে বাবা! একী অদ্ভুত কথা শুনলাম! সত্যি আজ আমার চোখ খুলে গেছে! আরে কেট আর ববি, দেখ তো কী অদ্ভুত কাণ্ড! এখন বুঝছি, তোমরা ঠিকই বলেছ।’

কেট আর আমি সচকিত হয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–‘সত্যি, তোমাদের কথাই ঠিক, স্বীকার না করে উপায় নেই। ওই যে, তোমরা একটু আগে বলেছিল, আমার বিচার হচ্ছে, এটাই সত্যি। তবে মনে রেখো, আমি এক কথার মানুষ। আমার কথার নড়চড় হয় না। তোমার যেদিন, যখন খুশি কেটকে গ্রহণ করতে পার। জোভের নামে দিব্যি কেটে বলছি, সবই মিটে গেল। তিনটি রবিবার পর পর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে।

আমি কি করব, কী-ই বলব ভেবে না পেয়ে নীরবে তার পরবর্তী মন্তব্য শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন–‘আমি এবার যাচ্ছি; এ ব্যাপারে ডাবল এলো. ডী কোন্ মত দেন, আমার জানা দরকার। আমি চললাম। কথা বলতে বলতে তিনি থপ থপ আওয়াজ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

দ্য অ্যাঞ্জেল অব দ্য অড

নভেম্বরের এক বিকেল।

নভেম্বরের শীতের এক বিকেল।

এইমাত্র আহার সেরে উঠেছি। খাদ্যবস্তুর মধ্যে প্রধানতম ছিল ক্ৰফে নামক ছত্রাকের একটা তরকারি। পেটের রোগীদের উপযুক্ত খাদ্য।

আহার সেরে আমি একাই খাবার ঘরের চুল্লির ঢাকনার ওপর পা দুটো রেখে আয়েশ করে সময় কাটাতে লাগলাম। হাতের নাগালের মধ্যেই ছোট টেবিলটার ওপর হরেক রকম মদের বোতল সাজানো রয়েছে।

সকাল থেকে একে একে টাকারম্যান লিখিত সিসিল, গ্রিসওল্ড লিখিত পুরাকীর্তিকথা, গ্লোভার লিখিত লিওনিডাম আর উইল্কির, এপিগোনিয়াড প্রভৃতি বই পড়ে কাটিয়েছি। তাই নির্দিধায় মেনে নিচ্ছি নিজেকে এখন যেন কেমন বোকা হাদা মনে হচ্চে। একটু পওে পরে লাফিও দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়েছি, মনে-প্রাণ সতেজও করে নিয়েছি বটে।

না, লাফিও থেকে কোনো ফল পেলাম না। তাই হতাশ হয়ে হাত বাড়িয়ে একটা সংবাদপত্র টেনে নিলাম।

একের পর এক পাতা উলটে কুকুর বেপাত্তা, বাড়ি ভাড়া, শিক্ষানবীশ ও পত্নীদের বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ প্রভৃতি ব্যাপার-স্যাপারে চোখ বুলিয়ে সম্পাদকীয় পাতাটা খুললাম। আগোগোড়া পড়ার পর একটা বর্ণও বুঝতে না পেরে ভাবলাম, চীনা ভাষা। আবার গোড়া থেকে শেষ অবধি পড়েও তেমন ফল হলো না।

শেষপর্যন্ত আমার মধ্যে বিরক্তি জাগল। বিরক্তিবশত হাতের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। আসলে নিচের লেখাটুকুর দিকে চোখ পড়তেই সেটাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হলো না।

মৃত্যুর উপায় অদ্ভুত এবং অগণিত। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটা খবরের কাগজে একটা বিচিত্র মৃত্যুর কথা ছাপা হয়েছে। লোকটা ফু-র সাহায্যে তীর ছোঁড়ার খেলায় মেতেছিল। খেলার পদ্ধতিটা হচ্ছে বেশ লম্বা একটা সুঁচের ছিদ্রে পশমের সূতো পরিয়ে সজোরে ফুঁ দিয়ে টিনের একটা নলের ভেতর দিয়ে বের করে লক্ষ্যভেদ করতে হবে।

খেলাটা বাস্তবিকই অত্যক্তৃত, তাই না? যা-ই হোক, খেলা শুরু হল, লোকটা ভুল করে বিপরীত দিকে সঁচটাকে রাখল। এবার সঁচটার গতি যাতে তীক্ষ্ণতর হয় সে জন্য ফুসফুস ভরে শ্বাস নিতে গিয়েই প্রমাদটা ঘটল। সূঁচ দ্রুত তার গলার ভেতরে ঢুকে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সেটা গলার ভেতর দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে হাজির হয়। ব্যস, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে দুনিয়ার খেলা শেষ করে পরলোকে চলে যেতে হয়।

লেখাটা পড়া শেষ করেই আমি বিষণ্ণমুখে খবরের কাগজটাকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেললাম। আসলে কাহিনীটা পড়ার পরই আমি রাগে ভেতরে ভেতরে দারুণ ফুঁসতে লাগলাম।

কেন যে আমার মধ্যে এমন আকস্মিক ক্রোধের সঞ্চার ঘটল তা আমারই জানা নেই, অন্য কাউকে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

আমি হাতের কাগজটাকে সজোরে টেবিলে ছুঁড়ে মেরেই গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম–মিথ্যা কথা! নির্ভেজাল মিথ্যো কথা! লোককে বোকা হদা বানাবার ফন্দি ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য যে নিরেট বোকা পাঠকদের মনে চমক লাগিয়ে দিতে পারলেও আমার মতো বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ পাঠককে এমন একটা মনগড়া অদ্ভুত কাহিনী দাঁড় করিয়ে ধাপ্পা দেওয়া এত সহজ নয়।

মনে পুঞ্জিভূত ক্রোধটুকু অব্যাহত রেখে আমি আবার ক্রোধে স্বগতোক্তি করতে লাগলাম। এবার থেকে বিচিত্র বা অদ্ভুত শিরোনাম দেওয়া কোনো কাহিনীর দিকে আমি কোনোদিন ভুলেও ফিরে তাকাব না। কোনো সাংবাদিক এমন কোনো কাহিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বললেও বিশ্বাস করব না, কোনোদিনই না।

হায় ঈশ্বর। হায় পোড়া কপাল, তুমি তবে কী বোকার মতো কথাটাই না বলে ফেললে।–কথা গোপন অন্তরাল থেকে এমন মিষ্টি মধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো যা এর আগে কোনোদিনই শুনিনি। কথাটা শোনামাত্র আমার মনে কেমন খটকা লাগল, গোড়ার দিকে আমার মনে হল, আমার শোনারই ভুল, নুতবা কানে কোনো ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে বলেই এমনটা বোধ হচ্ছে।

পরক্ষণেই নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে বোঝাপড়া করার পর আবার ভাবলাম, তা-ই যদি হয় তবে এমন অর্থপূর্ণ কথাই বা কি করে সম্ভব। তাই ঘরে কে ঢুকেছে তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার ঘরটার চারদিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে নিলাম। ঘরে কেউ ঢুকেছে কি না তার আড়চোখে দেখে নেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। না, কারও নজরে পড়ল না। নিঃসন্দেহ হলাম, কেউ নেই, আমার কাজের সাক্ষী কেউ নেই।

উফ! একটু আগে শোনা সে কণ্ঠস্বর।

সেই অবিশ্বাস, একেবারেই বিচিত্র যে কণ্ঠস্বরেই কে যেন এবার চঞ্চল–তুমি দেখছি মদের নেশায় শুয়োরের মতো একেবারে কুঁদ হয়ে রয়েছে হে! আমি তোমার পাশে, ধরতে গেলে প্রায় গা-ঘেঁষেই বসে তবু আমার অস্তিত্বই অনুভব করতে পারছ না? এ কী অবাক কাণ্ড হে?

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই আমি চোখ তুলে সরাসরি তার মুখের দিকে তাকালাম। সম্পূর্ণ সত্য যে, আমার মুখোমুখি লোকটা অবস্থান করছে সেও দেখতে অদ্ভুত, বাউণ্ডুলে প্রকৃতির হলেও কিম্ভুতকিমাকার, ভাষায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব নয়।

তার শরীরটার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা যেতে পারে যে একটা মদের গ্লাস, একটা মদের নল, নইলে ওরকমই কিছু একটা, আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে লোকটার চেহারার তুলনা একমাত্র ফলস্টাফের সঙ্গেই চলতে পারে। নিচের দিকে দুটো খিল… লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে পায়ের অভাব পূরণ করা যেতে পারে।

আর হাত? শরীরের কাঠামোর ওপর থেকে দুটো লম্বা, বোতল দুপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তার মাথা? দেহখাঁচার ওপরে একটা মদের পেয়ালার ওপর পুরু করে বস্তা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নস্যির বড় কৌটোর মতো দুটো ছিদ্র মুখের দুপাশে করে দেওয়া আছে। আর সে ছিদ্র দুটো আমার দিকেই অবস্থান করছে। যা কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়ে আমার শ্রুতিগোচর হচ্ছে সবই কিন্তু ওই ছিদ্র দুটো দিয়েই বেরিয়ে আসছে। আর সে শব্দ দুটো দিয়ে যেসব কথা বেরিয়ে আসে সবই সহজবোধ্য বলেই তার বিশ্বাস।

অবিশ্বাস্য বিচিত্র মূর্তিটা একই দুর্বোধ্য, অবোধ্যও বলা চলে। এবার বলল আমি তো তোমার ব্যাপার স্যাপার দেখে বড়ই অবাক হচ্ছি হে!

আমি মুখ তুলে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

সে আগের মতো চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ একে বলতে লাগল–ধ্যুৎ! তুমি দেখছি, হাঁসের মতোই বোকা হাঁদা হে!

আমি তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।

সে আগের কথার জের টেনে বলল–শোন, তুমি যদি নিছকই একটা বোকা না হতে তবে কী খবরের কাগজের পাতায় যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তাতে অবিশ্বাস করতে। আমার কথা শোন, ওসব সত্যি, সবই শতকরা একশো ভাগই সত্যি।

তার কথায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য এনেই বললাম–তুমি কে হে? কি তোমার পরিচয়?

সে কিছু বলল না। আসলে আমি তাকে কিছু বলার জন্য উপযুক্ত সময় না দিয়ে আমিই আবার বলতে লাগলাম আর তুমি এখানে ঢুকলেই বা কি করে তা-ও তো আমার মাথায় আসছে না। আর তুমি কি যে বলতে চাচ্ছ মথামু কিছু বুঝছি না। তুমি এখানে ঢুকলে কি করে এ মুহূর্তে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমার কথা শেষ হতেই মূর্তিটা আগের মতোই দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে কি যেন বরে আমার কথার উত্তর দিল–শোন হে, আমি এখানে কিভাবে ঢুকেছি তা নিয়ে। তো হেতামার মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। আর এটাও শুনে রাখ, আমি কি বলব আর বলবনা তা-ও তোমার ব্যাপার নয়। পুরোপুরি আমার, নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আমি তার চাছালোলা কথাগুলো শুনে সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম।

সে আমাকে একই রকম অবাক করল–আমার সাফ কথা তুমি শুনে রাখ, আমার মন যা চায় তা-ই আমি বলতে পারি। আর বলবও ঠিক তা-ই। আর আমার পরিচয়, মানে আমি কে, তাই তো তুমি জানতে চাইছ, ঠিক কি না?

আমি নীরবে মাথা ঝাঁকালাম।

সে বলেই চলল–আমার পরিচয় মুখ ফুটে নাই বললাম। একটু পরেই আমার পরিচয় তুমি স্বচক্ষেই চাক্ষুষ করতে পারবে। আর সে জন্যই আমি এখানে হাজির হয়েছি, বুঝলে?

আমি নির্দিধায় বললাম–তুমি একটা আস্ত মাতাল। একজন পয়লা নম্বরের ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে। আমি এখনই ঘণ্টা বাজিয়ে আমার পরিচারককে ডাকব। তাকে বলব, যেন লাথি মেরে তোমাকে সদর দরজার বাইরে, একেবারে রাস্তায় পৌঁছে দিয়ে আসে।

হতচ্ছাড়া আগন্তুকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল–আমি ভালোই জানি এ তোমার কর্ম নয়। তুমি পারবে না, কিছুতেই না।

আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম–কী বললে, পারব না!

অবশ্যই না। বললামই তো তুমি ও কাজ কিছুতেই করতে পারবে না।

কী পারব না? আমি কি করতে পারব না? তুমি কী বলতে চাইছ? সাক্ষাৎ শয়তানের মতো ফিকফিক করে হেসে সে এবার বলল–ওই কাজ, মানে ঘণ্টাটা বাজাতে পারবে না?

তার কথাটা শুনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম।

কিন্তু হতচ্ছাড়াটা আমাকে কিছুতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দিল না। আমি চেয়ারের আশ্রয় ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করা মাত্র সে তার শক্ত বোতলের হাত দিয়ে আমার কপালে আচমকা এমন সজোরে একটা আঘাত হানলো যার ফলে আমি আবার ধপাস করে চেয়ারটার ওপর বসে পড়লাম।

তার কাণ্ড দেখে আমি কপালের ব্যথা-বেদনার কথা ভাবার অবকাশই পেলাম না। এতই অবাক হলাম যে, হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পালাম না এ মুহূর্তে আমার কর্তব্য কি?

আমি মুখ খোলার আগেই লোকটা বিশি স্বরে হেসে বলল কি হে, ব্যাপারটা তো নিজের চোখেই দেখলে। এখন যা বলছি, লক্ষ্মী ছেলের মতো শোন, এখানে চুপটি করে বসে থাক। এবারই জানতে পারবে, আমি কে–কি আমার পরিচয় কী?

আমি তার দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকিয়ে রইলাম। সে বলেই চলল–আমার পরিচয় জানতে চাইছ, তাই না? ভালো কথা, আমার দিকে তাকাও। হ্যাঁ, তাকাও দেখ! আমিই কদাকার অদ্ভুত দেবদূত।

আমি বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠলাম–হ্যাঁ, রীতিমত বটে! তুমি নিজেকে দেবদূত বলে পরিচয় দিচ্ছ? দেবদূতের একজোড়া পাখা থাকে বলেই তো আমি জানতাম।

পাখা! ডানা! রেগে একেবারে আগুন হয়ে গিয়ে সে এবার খেঁকিয়ে উঠল– আমার ডানার কি দরকার হে! হায় ঈশ্বর! হায় আমার কপাল! তুমি কী ভেবেছ, আমি একটা মুরগির ছানা? আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা কী খোলসা করে বলতো?

আমি ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে আমতা আমতা করতে লাগলাম–আরে না, না, তুমি অবশ্যই মুরগির ছানা নও। তোমার সম্বন্ধে আমি ভুল ধারণা করেছি।

বহুৎ আচ্ছ। তাই যদি হয় তবে চেয়ারটায় চুপটি করে বসে থাক। আর কথা বলার সময় আগপাছ চিন্তা করে তবেই কথা বলবে, বুঝলে বাছাধন। আর যদি হম্বিতম্বি করার চেষ্টা কর তবে আবার এমন এক ঘা বসিয়ে দেব যে, একেবারে দফা রফা হয়ে যাবে।

আর কিছু বলার মতো সাহস আমার হলো না। বাধ্য হয়েই মুখে কুলুপ এঁটেই বসে রইলাম।

সে আগের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল–শোন আহাম্মক, পেঁচার ডানা লাগে, মুরগির ডানা লাগে আর ডানা দরকার হয় ক্ষুদে শয়তানের, ঠিক কিনা? দেবদূতের ডানা অবশ্যই থাকে না, আর আমি যে কিম্ভুতকিমাকার দেবদূত হে।

আমি ভয়ে ভয়ে হাত কচলে বললাম। বেশ তো, কিন্তু তুমি এখানে, আমার এখানে হানা দিয়েছ কেন? কোন দরকারে।

আমার মুখের কথা কেড়েনিয়ৈ আগন্তুক বলল–দরকার, কি কাজ? কি দরকারে? তুমি যে কী নিচ কূলের লোক তা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি যে, একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোককে অর্থাৎ এক দেবদূতকে জিজ্ঞেস করছ, এখানে কোন্ কাজে এসেছে। তুমি কেমন নিচ বংশোদ্ভুত এবং এক আহম্মক হে!

সত্যি বলছি, আগন্তুক দেবদূত হলেও তার কথাগুলোকে আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলাম না, বরং আসহ্যই মনে হলো। ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে হাতের কাছে লবনের পাত্রটা পেয়ে সেটাকে যন্ত্রচালিতের মতো তুলে নিয়ে তার কপাল বরাবর ছুঁড়ে মারলাম। এমনও হতে পারে, আমার লক্ষ্য ঠিক ছিল না, নতুবা সে তড়াক করে একদিকে সরে গিয়েছিল। তাই লবনের পাত্রটা ছুটে গিয়ে দুম করে ম্যান্টেল পিসের ওপর রাখা ঘড়িটার গায়ে আঘাত হানলো যার ফলে মুহূর্তে তার ডায়ালটা ভেঙে গেল।

আগন্তুক দেবদূতের বদলা নিতে ছাড়ল না। সে আমার কপালে বোতল হাত দিয়ে দমাদম কয়েক ঘা হেঁকে দিল।

আঘাতের চোটে আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলাম। বরং বাধ্য হলাম বলাই উচিত। স্বীকার করতে লজ্জায় মরে যাচ্ছি, বিরক্তিবশতই হোক, আর যন্ত্রণাতেই হোক, আমার চোখে দুটোর কোণে পানি ভিড় করল, কয়েক ফোঁটা পানি গলা দুটো বেয়ে মাটিতেও পড়ল।

আমার বেহাল পরিস্থিতি দেখে কদাকার দেবদূত সহানুভূতির স্বরে অনুচ্চকণ্ঠে বলল–হায় ঈশ্বর! লোকটা হয় অনেক দুঃখ-যন্ত্রণায় ভূগেছে, নতুবা গলা অবধি মদ গিলে একেবারে বে-হেড হয়ে গেছে।

মুহূর্তের জন্য থেমে আমাকে লক্ষ্য করে সহানুভূতির স্বরে এবার বলল শোন হে, এত কড়া মদ কেন যে গিলতে যাও, ভেবে পাই না। একটু পানি ঢেলে হালকা করে নিলেই তো পার। এই নাও, ভালো ছেলের মতো এটা খেয়ে ফেল। কান্না থামাও। এটা খেয়ে নাও।

কথা বলতে বলতে কদাকার অদ্ভুতদর্শন দেবদূত তার বোতল-হাত থেকে কিছুটা বর্ণহীন তরল পদার্থ আমার মদের গ্লাসে ঢেলে দিল।

সে বোতলটা সামান্য কাৎ করতেই তার গায়ে সাটা একটা লেবেল আমার নজর এড়াল না। তাতে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে–কার্যওয়াসার কথাটা।

আগন্তুক বিচিত্র দেবদূতের মমত্ববোধ আমাকে মুগ্ধ করল। ফলে আমার ক্রোধ অনেকাংশে লাঘব হয়ে গেল। আর আমার মদের গ্লাসে একাধিকবার পানি মিশিয়ে দিয়েও সে মন জয় করে নিল। ফলে আমার মন মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে এলো। এবার সে যে অসাধারণ একটা ভাষণ দিল তা-ও আমি মন দিয়ে শুনলাম। সে যে কি বলল, তা পুরোপুরি বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম তা হচ্ছে, সে হচ্ছে একজন অশুভ শক্তির সাক্ষাৎ-নিয়ন্তা। আর সে এসব বিচিত্র দুর্ঘটনায় লিপ্ত থাকে যা নাস্তিকদের মনে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে, অস্থির করে ফেলে।

আমি তার কথা অবিশ্বাস করায়, তার কাজে বাধা সৃষ্টি করায় সে চটে এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করল যাতে শেষপর্যন্ত আমি ঘাবড়ে গিয়ে সামলেসুমলে নিতে বাধ্য হলাম। আর সে-ও মওকা পেয়ে এক নাগাড়ের বকবকানি শুরু করে দিল। রীতিমত কথার ফুলঝুরি।

তার ভাষণ চলতেই লাগল। আমি কোনোরকম বাধা না দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পরমানন্দে এলাচি চিবুতে ব্যস্ত রইলাম।

কিন্তু আমার এ আচরণটা দেবদূতের পছন্দ হলো না। সে হঠাত্র রেগে একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। রাগ সামলাতে না পেরে সে দুহাতে নিজের চোখ দুটো ঢেকে মোক্ষম একটা অভিশাপ আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। আর রাগে কাঁপতে কাঁপতে এমন ভাষায় আমাকে শাসাল, ভয় দেখাল যে তার অর্থ একটা বর্ণও আমি বুঝতে পারলাম না।

শেষপর্যন্ত অদ্ভুতদর্শন দেবদূত নতজানু হয়ে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে আর্চবীশপ জিল-ব্লাসের ভাষায় আমার মঙ্গল কামনা করল। আমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে পথে নামল।

আমি কিন্তু এতে তেমন খুশি হতে পারলাম না। বরং সে চলে যাওয়ায় আমি কেমন একটা অবর্ণনীয় অস্বস্তিই বোধ করতে লাগলাম।

পর পর কয়েক গ্লাস মদ উদরস্থ করায় শরীরে ঝিমুনি অনুভব করলাম। ঘুমে চোখের পাতা দুটো জড়িয়ে আসতে লাগল। ফলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মিনিট পনের-বিশ ঘুমিয়ে নিলাম।

ছয়টায় এক জায়গায় আমার যাবার কথা। খুবই জরুরি দরকার। যত অসুবিধাই থাক না কেন যেতে আমাকে হবেই। আমার বসতবাড়ির বীমার পলিসির মেয়াদ গতকাল শেষ হয়ে গেছে। এ নিয়ে কিছু গোলযোগের সূত্রপাত হয়েছে। তাই কথা বলে স্থির করেছি ঠিক ছয়টায় কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সঙ্গে দেখা করে আমি বীমার পলিসি নবীকরণ করিয়ে নেব।

ঘাড় ঘুরিয়ে ম্যান্টেলপিসের ওপরে রক্ষিত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলাম, এখনও পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে।

এখন পাঁচটা ত্রিশ মিনিট। হেঁটে মাত্র পাঁচ মিনিটে বীমা কোম্পানির দপ্তরে পৌঁছে যেতে পারব। আর আমার দিবান্দ্রিা কোনোদিনই পঁচিশ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। তাই খুবই নিশ্চিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ঘুম থেকে উঠেই বীমা কোম্পানির দপ্তরের উদ্দেশ্যে হাঁটা জুড়ব।

হঠাৎ আমার ঘুম চটে গেল। হুড়মুড় করে উঠে বিছানায় উঠে পড়লাম। ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম মাত্র তিন মিনিট আমি ঘুমিয়েছি। কারণ আমার হাতে এখনও সাতাশ মিনিট সময় রয়ে গেছে। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে, মনে হলো বেশ কিছু সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মাত্র তিন মিনিট আমি ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। অচিরেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।

দ্বিতীয় বার যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির দিকে চোখ ফিরিয়েই সচকিত হয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসে পড়লাম। দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে।

ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই স্বগতোক্তি করলাম–সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এখন না গিয়ে কাল সকালে বীমা কোম্পানির দপ্তরে গিয়ে বিলম্বের জন্য

মার্জনা ভিক্ষা করেনিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন হলো। ঘড়িটা কোনো-না-কোনোভাবে বিকল হয়ে যায়নি তো? খাট থেকে নেমে ম্যান্টেলপিসের ওপর থেকে ঘড়িটাকে নামিয়ে আনলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে সহজেই নজরে পড়ল, মেওয়া খাওয়ার সময় তার খোসাগুলো ঘরের মেঝেতে ফেলেছিলাম। তাদেরই একটা কণা বাতাসে উড়ে গিয়ে কাঁচের ফাঁক দিয়ে ডায়ালে ঢুকে গিয়ে মিনিটের কাঁটাটার গতি রোধ করে দিয়েছে। ফলে সেটা সে মুহূর্ত থেকেই একই জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আপন মনেই বলে উঠলাম–ধ্যুৎ! এ ব্যাপার। একে নিছকই একটা অঘটন বলা যায়। এরকম ব্যাপার তো যে কোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে।

ঘড়ির ব্যাপারটাকে সামান্যতম আমল না দিয়ে আমি আবার বিছনায় কাৎ হয়ে পড়লাম।

হাত বাড়িয়ে শিয়য়ের কাছে ছোট পড়ার টেবিলটায় একটা মোমবাতি জ্বালালাম। এবার ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান বইটা টেনে নিলাম। বইটাকে খুলে চোখের সামনে ধরলাম। কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর-হওয়া সম্ভব হলো না। আমি বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। মোমবাতিটা জ্বলেই চলল।

কখন যে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম বলতে পারব না। তবে এটুকু অন্তত বলতে পারি, ঘুমিয়ে পড়ার অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই যে বিচিত্র দেবদূত বার বার আমার সামনে হাজির হতে লাগল।

সত্যি বলছি, আমার যেন পরিষ্কার মনে হলো সে যেন কোচের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হাত-বাড়িয়ে আমার মশারিটা সামান্য ফাঁক করল। মদের বোতল খালি আর আমি যে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে চোখ-মুখ বিকৃত করে বিরক্তিকর শব্দ করেছিলাম, সে এখন তারই বদলানিচ্ছে।

আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে না বুঝতেই সে ঝট করে আমার মাথার ছড়ানো টুপিটাকে খুলে ফেলে দিল। আমি তো ব্যাপার দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হলাম।

আমি আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম, আমার গলার ভেতর দিয়ে একটা নল গলিয়ে দিয়ে তার বগলের নিচে ঝুলিয়ে রাখা বোতল থেকে কার্থওয়াসার বের করে আমার পাকস্থলিটাকে কানায় কানায় ভরে দিল। আমি সে বিশেষ পানীয়টার স্রোতে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলাম।

আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। আমার যন্ত্রণা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, তখন আচমকা আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমিনিদারুণ

অস্থিরতার শিকার হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত বিছানার ওপর বসে পড়লাম।

জ্বলন্ত মোমবাতিটার দিকে চোখ পড়তেই আমি যারপরনাই অবাক হয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা ইঁদুর জ্বলন্ত মোমবাতিটাকে দাঁত কামড়ে ধরে পালাতে গিয়ে অঘটনটা ঘটিয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যেই দম বন্ধকরা একটা উৎকট গন্ধ আমার নাকের ভেতর দিয়ে সোজা ফুসফুসে ঢুকে গেল। খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম।

অস্থিরভাবে খাট থেমে নেমে খোলা জানালা দিয়ে বার কয়েক এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতেই বুঝতে পারলাম, বাড়িতে আগুন লেগে গেছে। মিনিট কয়েকের মধ্যে বাড়ির সর্বত্র দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল। সম্পূর্ণ বাড়িটাই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।

আমি উন্মাদের মতো চারদিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে আঁচ করে নিতে গিয়ে নিঃসন্দেহ হলাম, জানালা ছাড়া অন্য কোনো পথেই আমার পক্ষে ঘরটা থেকে বেরনো সম্ভব নয়।

তবে পরমুহূর্তেই দেখতে পেলাম, পল্লীবাসীরা লম্বা একটা মই জোগাড় করে এনে আমার জানলায় রাখল।

মইটা জানালায় লাগতে না লাগতেই আমি উম্রান্তের মতো মইটার দিকে ছুটে গেলাম। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সেটা বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে যেতে লাগলাম।

মইটা বেয়ে আমি কিছুটা নেমে যেতেই হঠাৎ একটা নাদুসনুদুস শুয়োরকে দেখে থমকে গেলাম। তার ইয়া মোটা পেট আর দৈহিক গঠন দেখেই প্রথমেই যার কথা আমার মনে পড়ল–সে আর কেউ না ওই অদ্ভুত দেখতে দেবদূত।

বিশালদেহী শুয়োরটা পানি-কাদার মধ্য থেকে উঠে ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে এসে আমার মইটার গায়ে পরম আনন্দে গা ঘষতে আরম্ভ করল। ব্যাপার দেখেই তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে পড়ার জোগাড় হলো। মিনিট খানেকের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল, আমার ভীতিটা অমূলক নয়। বরং যা আশঙ্কা করেছিলাম, কার্যত ঘটলও ঠিক তাই। মইটার সঙ্গে আমিও হুড়মুড় করে পথে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। ব্যস, যা ঘটার ঘটে গেল। আমার একটা হাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

এবার আমি বাস্তবিকই মহাফাপড়ে পড়ে গেলাম। বীমার জন্য ক্ষতি, মাথার সব চুল পুড়ে ছাই হয়ে যাবার জন্য ক্ষতি–বাস্তবিকই দুর্ঘটনাটা আমাকে দুর্ভাবনার সাগরে ছুঁড়ে দিল। আর আমি বে-সামাল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে রীতিমত খাবি খেতে লাগলাম।

কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে হাপিত্যেশ করতে করতে আমি মনস্থির করে ফেললাম, এবার একটা সহধর্মিনী গ্রহণ না করলে আর চলছে না।

আমার পরিচিত গণ্ডির মধ্যেই এক বিধবা অপরূপ সুন্দরি–অকালে স্বামী রত্নটাকে খুইয়ে বড়ই মর্মপীড়ার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এক নজর তাকে দেখলেই শরীর ও মন রোমাঞ্চে ভরে ওঠে।

আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যাকে প্রতিজ্ঞাও বলা চলে–সে রূপসি যুবতি বিধবাটার ক্ষতস্থানে যেন শান্তির প্রলেপ দিয়ে দিল।

আমি সদ্য স্বামীহারা সে বিধবা যুবতির কাছে আমার অভিলাষের কথা ব্যক্ত করতেই সে বার কয়েক আমতা আমতা করে হলেও শেষমেশ আমার টোপটা গিলল। আমার প্রস্তাবে পুরোপুরি মতো দিয়ে দিল।

আমার আকাঙ্ক্ষিতার সম্মতি পাওয়ায় আমি যেন আকাশের চাঁদকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেলাম। মহাবিস্ময় ও পুলকানন্দে স্তবস্তুতি করতে করতে আমি সটান তার পায়ের কাছে পড়ে গেলাম।

আমার অবস্থা দেখে তিনি লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে নিজের কালো চুলের গোছাটা দিয়ে আমার মাথার ধার করা পরচুলোকে ঢেকে দিল।

ব্যাপারটা যে কিভাবে ঘটেছিল তা আমার পক্ষে বলা বাস্তবিকই কঠিন। আমি যখন উঠে সোজাভাবে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম অত্যাশ্চর্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড! আমার মাথার পরচুলা যেন ভোজবাজির মতো কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর সে জায়গায় রয়েছে কুচকুচে কালো চুল।

আর সে বিধবা যুবতি? তিনি মাথার অর্ধেকটা অন্যের চুলে ঢাকা রয়েছে। আর তা দেখেই তিনি সক্রোধে রীতিমত হম্বিতম্বি শুরু করে দিলেন। রাগে, ঘৃণায় আর অপমানে তার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপছে।

ব্যস, বিধবা যুবতিটাকে সহধর্মিনী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্খটা এভাবেই এমন একটা অঘটনের মাধ্যমে চিরদিনের মতো নিঃশেষ হয়ে গেল। যাকে একেবারেই অভাবনীয় ছাড়া কিছুই ভাবা সম্ভব নয়।

তবে এও সত্য যে, স্বাভাবিক কার্য-কারণের ব্যাপারটা ঘটেছিল।

আমি কিন্তু এতেই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম না, বরং তার চেয়ে কম নির্মম, নিষ্ঠুর কোনো এক নারীকে পটিয়ে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে গেলাম।

এবারও গোড়ার দিকে আমার ভাগ্য খুলে গেল বলেই মনে হলো। ধরেই নিলাম এবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেই হবে। কিন্তু অচিরেই খুবই সাধারণ একটা ঘটনা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল।

আমার বাঞ্ছিতা, আমার বাগদত্তাকে শহরের গণ্যমান্য লোকের মেলায় হঠাৎ দেখতে পেয়েই আমি তাকে অভিবাদন জানাবার জন্য ব্যস্তপায়ে ছুটে গেলাম। উভ্রান্তের মতো একে ঠেলে, ওকে ধাক্কা মেরে তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র আচমকা কি যেন একটা বস্তু, উড়ে এসে আমার চোখে পড়ল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলাম।

আমি অস্থিরভাবে চোখ ডলাডলি করে দৃষ্টিশিক্ত ফিরে পাওয়ার অনেক আগেই আমার মনের মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

আমার আকস্মিক ও ক্ষণিকের দৃষ্টিহীনতাকে পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত জ্ঞান করে আমি বড়ই মর্মাহত, ক্ষুব্ধও কম হইনি।

আমি আকস্মিক অভাবনীয় ব্যাপারটায় এমনই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম যে, আমার জ্ঞানবুদ্ধি যেন নিঃশেষে আমার মধ্য থেকে উবে গেছে।

আমার অন্ধত্ব কিন্তু তখনও নিমূর্ল হয়নি, কিছুই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। ঠিক তখনই সে অদ্ভুতদর্শন দেবদূত যেন আমার চোখের সামনে এসে হাজির হলো।

আমি তখনও চোখের সমস্যা নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি। কিন্তু সে দেবদূত আমার সামনে উপস্থিত হয়েও এমন বিনয়ের সঙ্গে আমাকে সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করল, যা আমার কাছে নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিল।

সে এগিয়ে এসে আমার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ সেরে ফেলল। এবার খুবই সতর্কতার সঙ্গে তার কাছে থেকে কী যেন একটা বস্তু বের করে আনল। তার সহানুভূতি আমাকে বাস্তবিকই অবর্ণনীয় স্বস্তি দান করল।

না, খুব হয়েছে ভাবলাম, ভাগ্য যখন এতই মন্দ তখন আর ধরে প্রাণটাকে মিছে জিইয়ে রেখে ফায়দাই বা কি? এর চেয়ে বরং মরে যাওয়াই অনেক, অনেক ভালো।

আমি আত্মহত্যাকেই একমাত্র শান্তির পথ হিসেবে বেছে নিলাম। কিন্তু সেটা কিভাবে? নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘ বোঝাপড়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, নদীর

জলে প্রাণ বিসর্জন দেওয়াই সহজতম উপায়। শেষপর্যন্ত নদীর পানিকেই শান্তির পথ। হিসেবে চূড়ান্তভাবে বেছে নিলাম।

এবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি গুটিগুটি অদূরবর্তী নদীটার দিকে হাঁটতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। স্থানটা বড়ই নির্জন নিরালা। ধারে-কাছে তো নয়ই, এমনকি দূরেও কোনো মানুষজনের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। ব্যস, মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করেই আমি ব্যস্ত-হাতে পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে নদীর পাড়ে রেখে দিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় আচমকা নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আগেই বলেছি, মানুষ জনের নামগন্ধও ধারে কাছে ছিল না। তাই গাছের ডালে বসে থাকা একটা কাক আমার এ-কাজের একমাত্র প্রাণবন্ত সাক্ষী রইল। হতচ্ছাড়াটা মদে ভেজানো শাকে উদর পূর্তি করে নেশার ঘোরে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড রে বাবা? আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ামাত্রই হতচ্ছাড়া পাখিটা আমার পোশাক-পরিচ্ছদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশটা ঠোঁটে কামড়ে ধরে উড়ে গেল। কেন যে সেটা এমন একটা কাজে উৎসাহি হয়ে পড়ল, তা আমি কিছুই বলতে পারব না।

তাই নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আমাকে আত্মহত্যার ইচ্ছাটাকে তখনকার মতো শিকেয় তুলে রাখতে হলো। ব্যস্ত হয়ে পানি থেকে উঠে এসে শরীরেরনিম্নাংশকে কোটের মধ্যে ঢুকিয়ে কোনোরকমে লজ্জানিবারণ করে নচ্ছার শয়তান পাখিটার খোঁজে ছুটতে আরম্ভ করলাম।

কিন্তু অদৃষ্টের বিড়ম্বনাও আমাকে অনুসরণ করে চলল। আমি কাকটাকে আকাশের দিকে নিবদ্ধ রেখে উদ্ধশ্বাসে পোশাক-চোর ওই শয়তান পাখিটার পিছন পিছন ধেয়ে চললাম। এক সময় হঠাৎ আমার খেয়াল হলো মাটির সঙ্গে আমার পা দুটোর কোনো সম্পর্কই নেই, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, উদ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে আমি কখন যে পাহাড়ের ওপরে উঠে গিয়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি। এর অনেক আগেই আমি আছড়ে পড়ে থেঁতলে যেতাম। অবশ্য ভাগ্যগুণে বাতাসের কাঁধে ভর করে ভাসমান একটা বেলুনের গা থেকে ঝুলন্ত দড়ি ধরে যদি ঝুলে পড়তে না পারতাম তবে আমার অবস্থা যে কি হতো তা ভাবলেই আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসতে লাগল।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমি গলা ছেড়ে চিৎকার করে মাথার ওপরের বেলুনটার চালককে লক্ষ্য করে আমার চরমতম দুর্গতির কথা জানোনোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালাতে লাগলাম। দীর্ঘসময় ধরে আমি বুককাঁপা চিৎকার করলাম। কিন্তু কোনো ফলই হলো না। এর দুটো কারণ হতে পারে। বোকাহাদাটা হয়তো আমার চিল্লাচিল্লি শুনতেই পায়নি। আবার এমনও হতে পারে, শয়তানটা সবকিছু শুনে বুঝেও আমার দিকে নজর দিতে উৎসাহি হলো না।

ইতিমধ্যে দৈত্যাকৃতি যন্ত্রটা খুবই তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যেতে লাগল। আর আমার শক্তি-সামর্থ্যও সে অনুপাতে কমে যেতে আরম্ভ করল। আমি উঠছি তো উঠছিই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি হয়তো অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে সমুদ্রের বুকে আছাড় খেয়ে পড়ে নিঃশব্দে ডুবেই যেতাম। ঠিক সে মুহূর্তে অকস্মাৎ আমার মাথার ওপর থেকে এর গম্ভীর ফাঁকা এক আওয়াজ বাতাসে ভেসে কানে এলো। আওয়াজটা কানে আসার পরই আমার মনোবল যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। আচমকা ওপরের দিকে চোখ ফেরাতেই বিচিত্র সেই দেবদূত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

দেখলাম, সে সুবিশাল আকাশযানটার ওপর থেকে ঝুঁকে, অদ্ভুতভাবে হাত দুটো ভাঁজ করে বসে রয়েছে। তার দুটো ঠোঁটের ফাঁকে একটা পাইপ আটকে রয়েছে। আর সেটা থেকে থেকে ধোয়া ছাড়ছে। মৌজ করে তামাকের সদ্ব্যবহার করে চলে।

তার ভাবগতিক দেখে মনে হল, এ পৃথিবীতে সে পরমানন্দেই দিন গুজরান। করছে।

আমি তখন কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে বসেছিলাম। তাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই চোখে-মুখে মিনতির সুস্পষ্ট ছাপ এঁকে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে মুহূর্তে তার করুণাই আমার একমাত্র ভরসা।

সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল–তোমার কি নাম হে? আর তুমি কোন সাহসে এভাবে চলাফেরা করছ? কেনই বা তুমি এ অবস্থায় এখানে এসেছ, বলবে কী?

লোকটার নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ আর বাহানার জবাবে আমার মাথায় একটা মাত্রই কথা বেরিয়ে এলো রক্ষা কর, বাঁচাও আমাকে।

আমার কথাটা শেষ হওয়ামাত্র সে যন্ত্রটার ভেতর থেকে কার্থওয়াসর-এর বড়সড়ও ভারি একটা বোতল ছুঁড়ে দিল। সেটা এসে দুম করে আমার মাথায় পড়ল। উফ! কী নিষ্ঠুর লোকটা। আর একটু হলেই আমার মাথাটাই ফেটে যেত। তার আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমি ধরে-থাকা দড়িটাই ছেড়ে দিতে চাইলাম।

আমার মনোভাব বুঝতে পেরে কে যেন চেঁচিয়ে বলল–আরে, করছ কী! করছ। কী! ভুলেও এমন কাজ করো না! দড়িটা শক্ত করে ধরে থাক, মাথা গরম করে এরকম চরম ভুল করতে যেয়ো না।

আমি তার কথার কি জবাব দেব ভেবে না পেয়ে কপালের চামড়ায় পর পর কয়েকটা ভাজ এঁকে নীরবে তাকিয়ে রইলাম।

সে বলে চলল–শোন, তোমার যদি আরও কাথওয়াসর-এর বোতল দরকার হয়ে থাকে বল, দিচ্ছি। কিন্তু দড়িটা যেন ভুলেও ছেড়ে দিও না। নাকি, একটাতেই তোমার কাজ মিটে গেছে? বিবেক বিচার-বিবেচনা বোধ ফিরে পেয়েছ? নাকি–

আমি মুখে কিছু না বলে ব্যস্তভাবে দুবার মাথা নাড়লাম। প্রথমবার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম, এ মুহূর্তেরই আমার আর বোতল দরকার নেই। আর দ্বিতীয় বার হ্যাঁ সূচক, অর্থাৎ আমি বিবেক-চৈতনা ফিরে পেয়েছি। এবার দেবদূতের রাগ অনেককাংশে কমে গেছে বলেই মনে হলো।

দেবদূত আবার মুখ খুলল। সে এবার বেশ নরম গলায় আরও বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল–তবে তুমি শেষপর্যন্ত মেনে নিচ্ছ যে, অদ্ভুত কাণ্ডও দুনিয়ায় ঘটে থাকে, কী বল?

আমি আবার মাথা নেড়ে তার কথার সম্মতি জানালাম। এবারও মুখে টু-শব্দটিও করলাম না।

এবার সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–তুমি তবে আমাকে না, মানে বিচিত্র দেবদূতকে বিশ্বাস করছ, তাই না?

আমি এবারও মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে তার কথার জবাব দিলাম।

সে এবার বলল–তুমি যে আমাকে বিশ্বাস করছ, সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করছ, তার প্রমাণ কী? আমি উপযুক্ত প্রমাণ চাই। আমার কাছে আত্মসমর্পণের প্রমাণস্বরূপ তোমার ডান হাতটাকে বাঁদিকের জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণের প্রমাণ দাও।

না, তার নির্দেশ পালন করা স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। কারন, আমি তো অনে আগেই মই থেকে পড়ে গিয়ে ডান হাতটাকে খুইয়েছি। আর অন্য হাতটা যদি ছেড়ে দেই তবে তো আমি সঙ্গে সঙ্গেই অক্কা পাব। আর জ্যাকেট? হায় আমার কপাল! সেই সদাশয় কাকটার দেখা না পেলে আমি জ্যাকেট পাবই বা কোথায় যে পকেটে হাত ঢোকাব? তাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমি এমন ভাবে মাথা নাড়লাম যাতে সে বোঝে তার নির্দেশ পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কিন্তু আমি এ-কাজটা করে কী ভুল, বোকামিই যে করেছিলাম, তা আর শোধরাবার নয়।

আমি মাথা নাড়ানো থামাতে-না-থামাতেই বিচিত্র দেবদূত রেগে গর্জে উঠল– ঠিক আছে, তুমি তবে জাহান্নামেই যাও।

কথাটা বলতে বলতেই যে একটা চকচকে ঝকঝকে ছুরি দিয়ে ব্যস্ত-হাতে আমার ধরে-থাকা দড়িটাকে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিল।

ভাগ্য ভালো যে আমি তখন আমার নিজের বাড়িতে পৌঁছে গেছি। আর আমার অবর্তমানে মিস্ত্রিরা ঝটপট বাড়িটাকে মেরামত করে প্রায় নতুনের মতো করে ফেলেছে। তাই দড়িটা কাটার ফলে আমি ছাদের চিমনিটার মধ্যে ঢুকে গেলাম। তারপর সেটা দিয়ে গলে একেবারে ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়লাম।

মেঝেতে পড়ার ফলে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষণ যে আমি অচৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়েছিলাম, তা বলতে পারব না।

সংজ্ঞা ফিরে পাবার পর বুঝতে পারলাম, ভোর হতে চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, চারটা বাজে।

দড়িটা কেটে দেওয়ার ফলে আমি ঘরের মেঝের যেখানে পড়েছিলাম, সেখানেই অলসভাবেই পড়ে রইলাম। মাথায় হাত দিয়ে দেখি, নিভে থাকা চিমনির ছাই কালি মাখামাখি হয়ে রয়েছে। আর উলটে থাকা ভাঙা টেবিলটার ওপর আমার পা দুটো উঠে রয়েছে।

ঘরের বাকি অংশের অবস্থাও একই রকম। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গ্লাস আর বোতলের ছোট-বড় টুকরো, খাবারদাবারের টুকরো, একটা ছেঁড়া-ফাটা খবরের কাগজ, সিডাম কৰ্থওয়াস-এর একটা অলি পাত্র এবং আরও কত কি সে চোখে পড়ল সব বলা সম্ভব নয়।

বিচিত্র দেবদূত আমার কাজের মাধ্যমে ক্ষুব্ধ হয়ে এভাবেই বদলা নিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

 দ্য অ্যাসাইনমেন্ট

রহস্যময় এক মানব!

রহস্যময় এক অদৃষ্ট-বিড়ম্বিত মানব।

সে হতভাগা নিজের কল্পনার উজ্জ্বল আভায় নিজেই পথ হারিয়ে ফেলেছে। পতঙ্গের মতো উদ্ভ্রান্ত হয়ে নিজের যৌবনের আগুনে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাস্তবে নয়, কল্পনার মাধ্যমে তোমাকে আবার দেখছি, দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি,

মূর্তি ধারণ করে তুমি আর একবার উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছ।

না না, তুমি তো ছায়াবৃত শীতল উপত্যকার আজকের তুমি নও। ঠিক যেমন তোমার হওয়া দরকার তেমন তো নও। সে তুমি তোমার মাতৃভূমি, তোমার নিজের দেশ ভেনিসের এক গাম্ভীর্যপূর্ণ মহৎ জীবনকে অবহেলা-অবজ্ঞায় অপচয়ের মাধ্যমে শেষ করে দিয়েছিলে, সে তুমি তো বর্তমানের তুমি নও।

সত্যি, আমি আবারও বলছি, তোমার যেমন হওয়া উচিত সে তুমি তো নও।

এ লোকটা ছাড়া আর লোকের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। মানুষের ভাবনা চিন্তা ছাড়া অন্য চিন্তা-ভাবনাও আছে; কূটনীতিবিদদের মতবাদ ছাড়া অন্য মতবাদের অস্তিত্ব আছে। অতএব তোমার চরিত্র সম্বন্ধে কে প্রশ্নের অবতারণা করবে? তোমার স্বপ্ন-দেখা দিনগুলো সম্বন্ধে তোমার ওপর কেই বা শেষ চাপিয়ে দেবে? আর তোমার যেসব কাম-কাজ শাশ্বত শক্তির ধারামাত্র তাকে কে জীবনের অবক্ষয় বলবে, কুৎসা গাইবে?

ভেনিসের মানুষ যে পথকে পন্ডে দ্য সমৃপিরি বলে সম্বোধন করে, (মাথার ওপরে ছাউনি দেওয়া বিশেষ ধরনের পথের কথা বলছি) –তারই তলায় যে লোকটার সঙ্গে আমার তৃতীয় অথবা চতুর্থবার দেখা হয়েছিল তার কথাই আমি বলতে চাইছি।

আর সেখানকার যে পরিবেশে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটেছিল সে কথাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে ঘেঁটে এখন আমি ব্যক্ত করছি। তবুও আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে, উফ! সে-কথা কি আমি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারি, নাকি ভুলে যাওয়া সম্ভব? সেই মাঝরাত, সেই ব্রীজ অব সাইজ। সে অতুলনীয় নারী আর সে রোমান্স–খালের এপাড় থেকে ওপাড়ে প্রতিভা যে ঘুরে ঘুরে বেড়াত।

রাত! মাঝরাত! ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। চকের ইয়া পেল্লাই ঘড়িটায় ইতালীয় সন্ধ্যার পঞ্চম ঘণ্টা গম্ভীর আওয়াজ তুলে বেজে গেছে।

ক্যাম্পানাইল স্কোয়ারটা জনমানবশূন্য। অবর্ণনীয় নিস্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে।

প্রাচীন ডিউক প্রাসাদের অত্যুজ্জ্বল বাতিগুলো এক এক করে নিভতে শুরু করেছে। একটু একটু করে অন্ধকার নামতে নামতে এক সময় অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল অতিকায় প্রাসাদটা।

আমি ছোট চক থেকে বড় খালের গা-বেয়ে ভিঙি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম।

কিন্তু খাল বরাবর আমার ডিঙিটা সান সার্কো খালের মোহনার বিপরীতে পৌঁছতে-না পৌঁছতেই রাতের অন্ধকার ভেদ করে বাতাস বাহিত নারীকন্ঠের তীব্র ও দীর্ঘ আর্তনাদ আমার কানে এলো।

আকস্মিক আর্তস্বরটা শোনামাত্র আমি সচকিত হয়ে এক লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার আকস্মিক লাফে ভিঙিটা একদিকে কাত হয়ে ডুবতে ডুবতে কোনোরকমে বেঁচে গেছে।

আর ডিঙি চালকের হাত থেকে একমাত্র বৈঠাটা হঠাৎ ঝপাৎ করে হাত ফসকে পানিতে পড়ে গেল। ব্যস, একে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার তার ওপর স্রোতের টানে বৈঠাটা যে ভেসে কোথায় চলে গেল হদিসই পেলাম না।

বৈঠাটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় স্রোতের টানের ওপরই আমাদের ভিঙিটার গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হলো। তাই অন্যন্যোপায় হয়ে আমরা স্রোতের টানে এগিয়ে চললাম।

আমরা তখন যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখানকার সব স্রোতই বড় খাল থেকে ছোট খালের দিকে প্রবাহিত হয়।

আর আমরা এর ফলে অতিকায় শুকনের মতো ব্রীজ অব সাইজ-এর দিকে আমাদের ভিঙিটা মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল।

ভিঙিটা আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ঠিক তখনই ডিউকের সুবিশাল প্রাসাদটার প্রতিটা জানালা আর সিঁড়ির ধাপগুলোতে হাজার হাজার জ্বলন্ত মশালের আলো ঠিকড়ে চোখের পলকে সে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত যেন দিনের মতো ঝলমলিয়ে উঠল। সীসা-রঙের অস্বাভাবিক দিনের আলোয় সবকিছু উদ্ভাসিত হয়ে পড়ল।

একটু পরেই সুবিশাল ও সুউচ্চ প্রাসাদটার ওপর তলাকার একটা জানালা দিয়ে মায়ের কোল থেকে হঠাৎ ফসকে একটা শিশু নিচের গভীর অন্ধকার খালের পানি পড়ে গেল।

খালের শান্ত পানি পড়ায় হতভাগ্য শিশুটা সহজেই তলিয়ে গেল। সে মুহূর্তে তার কাছাকাছি আমার ভিঙিটাই ছিল। তা সত্ত্বেও বহু দক্ষ সাঁতারুই ইতিমধ্যে ঝাঁপিয়ে তার খোঁজে বৃথাই পানি তোলপাড় করতে লাগল।

হায়! যে হারানিধির খোঁজে তারা অনবরত পানি তোলপাড় করে চলেছে সে যে এতক্ষণে কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়ে থিতু হয়ে গেছে।

তখন পানি থেকে মাত্র সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ ওপরে, প্রাসাদের সদরদরজার গায়ে কালো পাথরে বাঁধাই চওড়া পাথরটার ওপরে দাঁড়িয়ে-থাকা মূর্তিটাকে তখন যারা দেখতে পেয়েছিল তারা কেউ কোনোদিনই তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।

কে সে? সেটা কার অতিকায় মূর্তি? তার নাম মারচেসা এফেফাদিতে। সারা ভেনিসের মানুষের চোখের মণি, বড়ই আদরের মানুষ, সদাহাস্যময় নারী, সুন্দরীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী, সুন্দরী শ্ৰেষ্ঠা-বুড়ো অস্থিরমতি প্রেমিকা তরুণী স্ত্রী, প্রথম এবং একমাত্র সন্তান এ রূপবান শিশুটার মা এখন যে খালের শীতল পানির তলায় শায়িত।

নারী একা, একদম একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার রূপার মতো সুদৃশ্য খোলা পা দুটো নিচের আয়নার মতো মসৃণ কালো পাথরের ওপর ঝলমল করছে।

রূপসি নারীর বল-নাচের কায়দায় বাঁধা চুলের গোছাটা আধখোলা অবস্থায় পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে। তার গায়ে হীরার একটা মালা জড়িয়ে দেওয়ায় তার সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে।

বরফের মতো ধবধবে সাদা সুতোয় বোনা একটা মাত্র বস্ত্রখণ্ড দিয়ে তার রূপ লাবণ্যকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো আবরণের চিহ্নমাত্রও নেই।

তা সত্ত্বেও সারা রাতের উষ্ণ বিষণ্ণতায় ভরপুর আর অচঞ্চল বাতাসেও সে মিহি বস্ত্রখণ্ডের আবরণটার একটা ভাজও উড়ছে না, নড়ছেও না এতটুকুও।

তবুও কী অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! তার একমাত্র প্রদীপের সলতে, একমাত্র আশার। আলো খালের পানির অতল গহ্বরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, সেদিকে কিন্তু তার উজ্জ্বল চোখের মণি দুটো নিবদ্ধ নেই।

তবে? সে রূপসি নিস্পলক চোখে, স্থির দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। এমন অসম্ভব কোনো ব্যাপারের কথা ভাবা যায় না, কি ভাবতে উৎসাহ পাওয়া যায়। তবুও যা বাস্তব তাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না।

আমার বিশ্বাস, পুরনো প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের কারাগারটাই ভেনিস নগরের উচ্চতম বাড়ি। কিন্তু এ নারী কিভাবে সে বাড়িটার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়তে হয়। আর তা কখন, কোন্ মুহূর্তে? যখন তারই একমাত্র সন্তান নিচেই শীতল সলীল সমাধিতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।

আর দূরবর্তী ওই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, বিষাদময় কুলুঙ্গীটাও তারই জানালার বিপরীত দিকে যেন বিরাট গ্রীবা বিস্তার করে অবস্থান করছে।

তবে সে সুবিশাল বাড়িটার ছায়ায়, তার স্থাপত্য ও ভাস্কর্যগতিতে, তার আইভিলতা ঝুলে থাকা গম্ভীর কার্নিসটায়, এমনকি আকর্ষণীয় থাকতে পারে যা মারচেসা দ্য মেননী ইতিপূর্বে অন্তত হাজারবার চাক্ষুষ করেছে।

বাজে কথা! কী সব বাজে কথা! কার না জানা আছে যে, এরকম মানুষের চোখ দুটো ভাঙা-আয়নার একটা বিষণ্ণতাকে, একটা দুঃখ-যন্ত্রণাকে বহুগুণ প্রতিবিম্বিত হতে দুঃখ-যন্ত্রণাকে হাতের নাগালের মধ্যে দেখে অগণিত দ্রব্য সামগ্রির মধ্যে প্রতিফলিত হতে? জানে, সবাই-ই তা জানে।

মেনতনি! মারচেসার থেকে বেশ কিছু সংখ্যক সিঁড়ি ওপরে, পানি দরজার খিলানের তলায় পরিপূর্ণ হয়ে মেনতনি স্বয়ং যক্ষের মতো অবস্থান করছে।

কেন মেনতনি দাঁড়িয়ে, কেন? কি করছে সেখানে দাঁড়িয়ে? পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে একটু পর-পর সে হাতের গিটারের তারে টোকা মারছে। আর? আর কিছুক্ষণ বাদে-পরেই সন্তানকে খোঁজ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। গিটারের তারে টোকা মারছে। আর সন্তানের খোঁজ করতে বলছে। ব্যস, এটুকুই।

এমন একটা ব্যাপার চোখের সামনে দেখে আমিও যেন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। সে মুহূর্তে হঠাৎ করে কর্তব্য নির্ধারণ করাই আমার পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আর্তস্বরটা প্রথম শুনেই আমি যে ভিঙিটার ওপর যন্ত্রচালিতের মতো লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, সে মুহূর্ত থেকেই আমি যেন চলার মতো শক্তি সামর্থ্যটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম।

কার্যত যা দেখা গেল তা হচ্ছে, উত্তেজিত জনগণের দৃষ্টিতে আমি যেন একটা অলৌকিক অশুভ উপস্থিতিতে পরিণত হয়ে যাই। ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখ আর নিশ্চল নিথর হাত-পাসহ সে ভিঙিটায় চেপে আমিও তাদের মিছিলে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। তাদের দলের ভিড়ে আমি চলছি তো চলছিই। না, সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো।

এতগুলো লোক একজোট হয়ে দীর্ঘসময় ধরে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পানি তোলপাড় করল। কিন্তু ফায়দা কিছুই হলো না। অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘ নিরলস কঠোর পরিশ্রম করেও ব্যর্থ হয়ে, হতাশায় জর্জরিত মনে অনিবার্য দুঃখকে স্বীকার করে নিয়ে বিশ্রাম নিতে লাগল।

না, জলমগ্ন শিশুটাকে উদ্ধারের আশা আর কারোই রইল না, তার মায়েরও না। সবার মুখেই হতাশার কালো ছায়া।

ঠিক তখনই কারাগারের যে কুলুঙ্গিটার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারই জমাটবাঁধা অন্ধকার কোণ থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এলো একটা আবছা মূর্তি। আপাদমস্তক আলখাল্লায় মোড়া একটা মূর্তি।

অন্ধকারের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা খাড়া পাহাড়টার চূড়ার ওপর উঠে মূর্তিটা মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পর মুহূর্তেই আচমকা লাফিয়ে পড়ল খালের ঠাণ্ডা পানিতে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মূর্তিটা শিশুটাকে জীবিত শিশুটাকে বুকে জাপ্টে ধরে পানির ওপরে ভেসে উঠল।

তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জীবিত শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই সে কালো পাথরটার ওপর এসে মারচেসারের পাশে দাঁড়াল। পানিতে ভিজে জবজবে ও ভারী হয়ে যাওয়ায় মূর্তিটার গায়ের আলখাল্লাটা মহিলার পায়ের কাছে খুলে পড়ে গেল।

দর্শকরা বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দীর্ঘদেহী ও সুঠাম যুবকটার মূর্তির দিকে। তাকিয়ে রইল ইউরোপের প্রায় সর্বত্র প্রতিটা আনাচে কানাচেও যার নাম লোকের মুখে মুখে উচ্চারিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সত্যি যুবকটা এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। উদ্ধারকারী যুবক একটা কথাও উচ্চারণ করল না। সে গম্ভীর মুখে জীবিত শিশুটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু মারচেসা? মারচেসা তো তার সন্তানকে ফিরে পাবে, জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। আদরে-সোহাগে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে।

হায়! এ কী অবিশ্বাস্য কাণ্ড! মুহূর্তের মধ্যে আর এক জোড়া হাত এগিয়ে এসে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে শিশুটাকে নবাগত যুবকটার হাত থেকে তুলে নিল। বহু বহুদূরে নিয়ে চলে গেল। তাকে নিয়ে গেল সবার চোখের আড়ালে, প্রাসাদের ভেতরে হাজির হলো।

কিন্তু মারচেসা! মারচেসা-র ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। একে স্থাস ফুলের পাপড়ির মতো নরম আর প্রায় তরল চোখ–চোখের মণিদুটো যেন পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সত্যি! চোখ দুটো কাণায় কানায় পানিতে ভরে উঠেছে। দেখুন ওই দেখুন, কেমন পানি থৈ থৈ করছে।

আর মরচেসার দেহ আর মন বার বার কেমন শিহরিত হয়ে উঠছে। একটু আগেও যা নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তি ছিল। এখন তার মধ্যে যেন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে; পাথরের মূর্তি যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তার মুখের পাথরের মতো পাগ্রতা, পাথরের বুক ওঠা-নামা আর পাথরের পা দুটো বরফের মতো ধবধবে সাদা রঙ–হঠাৎই কিছুর ওপর যেন রক্তিম স্রোত বয়ে চলল।

নেপোলির মৃদুমন্দ বাতাস যেমন ঘাসের রূপালি ফুলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তিরতির করে কাঁপতে থাকে, ঠিক তেমনই মৃদু একটা কম্পন শিহরণ তার দেহ পল্লবের ভেতরে বইতে লাগল।

এ কী অভাবনীয়, অদ্ভুত ব্যাপার! মারচেসা অকস্মাৎ কেন এমন রক্তিম হয়ে উঠল? কেন তার মধ্যে এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের জোয়ার বইতে শুরু করেছে?

না, এ প্রশ্নের কোনো জবার দেওয়া সম্ভব নয়, আসলে কোনো জবাবই যে নেই। কেবলমাত্র এটুকুই বলা যেতে পারে, মায়ের ভীত সন্ত্রস্ত মন, নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কের জন্য লম্বা লম্বা পায়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় চটি পরা সম্ভব হয়নি। আসলে চটি পরার মতো মানসিকতাই তার ছিল না। তার ওপর খোলা কাঁধের ওপর প্রয়োজনীয় আবরণ চাপানোও হয়নি। এ যদি না-ই হয় তবে তার দেহল্লব অকস্মাৎ এমন লক্ষিত বা হবে কেন?

আর চারদিকের বহু অনুসন্ধিৎসু চোখের চাহনি কি? –কাঁপা কাঁপা বুকের বার বার অস্বাভাবিক ওঠা নামা কি?

কি? কি? কি? নবাগত যুবক মেনতানি প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাবার পর আকস্মিকভাবে তার একটা হাত কি রূপসি মারচেসার কাঁধ ছুঁয়ে গিয়েছিল–তাই কি? সে জন্যই কি তার মধ্যে এমন আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে! সে যুবকটার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সে এতই গলা নামিয়ে, অস্বাভাবিক গলা নামিয়ে অথবা খুবই দ্রুততার সঙ্গে সে অর্থহীন কথাগুলো উচ্চারণ করেছিল কেন?

কি বলেছিল, কি বলেছিল সে? সে কি বলেছিল পানির কুলকুল রবকে আমি ভুল শুনেছিলাম, তুমিই বিজয়ীর সম্মানলাভে ধন্য হয়েছ। সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পরে, আমরা মিলিত হব–কথা থাকল। এমন অর্থহীন কথা কেন সে উচ্চারণ করেছিল?

সমবেত জনতা ক্রমে নীরব হতে লাগল। এক সময় হৈ হট্টগোল, চিৎকার চ্যাঁচামেচি, গণ্ডগোল সবই থেমে গেল–পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো।

এক এক করে প্রাসাদটাগুলো ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে আত্মগোপন করে রইল। আর সে আগন্তুক যুবক? হ্যাঁ, আমি এখন তাকে সনাক্ত করতে পেরেছি। মসৃণ কালো পাথরটার ওপর সে একা, একেবারেই একা দাঁড়িয়ে থাকল।

আগন্তুক যুবকটা এখন কল্পনাতীত উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে। আর অনুসন্ধিৎসু নজরে একটা ডিঙি নৌকার খোঁজে বার বার এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। তার অবস্থা দেখে আমি তাকে আমার ডিঙিটায় উঠতে না বলে পারলাম না। আর সেও নিজের সমস্যা দূর করতে গিয়ে আমার ভদ্রতাটুকুর সুযোগ নিল।

আমরা উভয়ে খোঁজাখুঁজি করে দরজাটার কাছ থেকে একটা বৈঠা জোগাড় করে ফেললাম। এবার বৈঠার টানে ভিঙিটা আমার নিয়ে তরতর করে আগন্তুক যুবকটার। মাথা গোঁজার স্থানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম।

ভিঙিতে উঠে আগন্তুক যুবকটা আমার মুখোমুখি বসল। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সে নিজেকে সামলে সুমলে নিল। তারপর আমাদের সামান্য পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে সে রীতিমত বিনয়ের সঙ্গে এবং যথেষ্ট ভদ্রতা বজায় রেখে আমার সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করল।

আমার নিজের কথায় আবার ফিরে যাই। সত্যি বলতে কি, এমনকিছু কিছু ব্যাপার আছে যার খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে, চিন্তাভাবনা করতে আমার খুব ভালো লাগে।

আগন্তুক যুবকটা জগতের কাছে এখনও আগন্তুক বলেই পরিচিত। তার অন্য কোনো পরিচয় তো কারোই জানা নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমিও তাকে আগন্তুক বলেই সম্বোধন করব। এ ছাড়া উপায়ও তো কিছু নেই। এ ছাড়া তার চেহারা ছবিটাও তো সে রকমই একটা ব্যাপার।

তার উচ্চতা সঠিক জানা নেই, আর তা না জানলেও তার দৈহিক বিবরণ দেওয়ার তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এতএব এভাবেই ব্যাপারটা ব্যক্ত করছি– মাঝারি উচ্চাতার চেয়ে একটু কমই তার দৈহিক উচ্চতা। তবে এত সত্য যে, প্রচণ্ড কোনো আবেগ-উচ্ছ্বাসের মুহূর্তে তার দৈহিক উচ্চতা সামান্য বেড়ে যায়।

আর তার গড়ন একহারা। এ চেহারায় ব্রীজ অব সাইজ-এ কাজের তৎপরতার যতটা পরিচয় পাওয়া যায়, বিপদের মুহূর্তে কিন্তু ঠিক অতটা মেলে না। অর্থাৎ হারকিউলিসের মতো তার যে শক্তির খ্যাতি রয়েছে, তা কিন্তু বিপদের মুহূর্তে ছাড়া অন্য কোনো সময় লক্ষিত হয় না।

এবার তার মুখায়বের দিকে নজর দেওয়া যাক। সত্যি করে বলতে গেলে তার মুখ আর থুতনিতে দেবতাসুলভ আদল বর্তমান। টানাটানা চোখ দুটো অসংযত। আর সে দুটো বাদামি থেকে কালো পর্যন্ত রং পরিবর্তিত হয়।

আর মাথাভর্তি একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল। চুলের গোছার ফাঁক দিয়ে তার উন্নত ও প্রয়াত কপালটা থেকে থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ফলে মনে হয়, আলো আর হাতির দাঁতের শুভ্রতায় ঝলমল করতে থাকে।

সবকিছু মিলিয়ে এমন একটা দর্শনীয় দেহসৌষ্ঠব চোখের সামনে ধরা দেয় যার তুলনা চলতে পারে একমাত্র সম্রাট কমোভাস-এর শ্বেতপাথরের মূর্তির সঙ্গেই। সত্যি কথা বলতে কি, সম্রাট কমোভাস-এর মূর্তি ছাড়া তার মতো দেহসৌষ্ঠব অন্য কোথাও, অন্য কারো মধ্যেই আমি অন্তত দেখিনি।

আর স্পষ্ট করে বললে আগন্তুক যুবকের মুখে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়, এমন কোনো স্থায়ী প্রকাশভঙ্গিও নেই যা স্মৃতির পাতায় আঁকা হয়ে যেতে পারে, দীর্ঘসময় মনে থাকে। অর্থাৎ তার মুখটা এমনই একটা মুখ যা দেখার পর মুহূর্তেই মন থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আরও আছে, তার মুখটা মন থেকে মুছে ফেললেও আবারও অন্তরের অন্তরতম কোণে টেনে আবার চাপা ও অফুরন্ত আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই থেকে যায়। তবে এও খুবই সত্য যে, প্রত্যেকটা দ্রুতগতিসম্পন্ন আবেগই যে তার মুখের আয়নায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় না তা নয়। তবে যে কোনো আয়নার মতোই আবেগটা যখন ফুরিয়ে যায় তখন মুখের আয়নায় তার কিছুমাত্র নজিরই রেখে যায় না। অর্থাৎ সবটুকু চিহ্নিই নিঃশেষ হয়ে যায়।

সে-রাতে আগন্তুক যুবকটার সঙ্গে যখন আমার ছাড়াছাড়ি হলো, অর্থাৎ যখন বিদায় নিয়ে আমার কাছ থেকে চলে গেল, তখন সে আচমকা আমার হাত দুটো চেপে ধরল। আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলল–বন্ধু, তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।

বল, কি বলতে চাইছ, নির্দিধায় বল?

কথা দাও, আমার অনুরোধ তুমি রাখবে?

আমি ম্লান হেসে বললাম–কি তোমার অনুরোধ তাই তো জানা হলো না, কথা দেব কি করে?

আমার হাত দুটো ধরে রেখেই সে বলল–আগামীকাল খুব ভোরে তোমাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। কথা দাও, তুমি যাবে।

আমরা বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটা খুব জরুরি। তাই মুখের হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই আমি ঘাড় কাৎ করে তার কথার জবাব দিলাম–কথা দিচ্ছি, কাল ভোরে তোমার ওখানে যাব।

আমি কথা রক্ষা করলাম। পরদিন কাকডাকা সকালে তার পাল্লাজোতে উপস্থিত হলাম। সুবিশাল এক প্রাসাদ। কেবলমাত্র সুবিশাল বলাটা হয়তো ঠিক হবে না। জাকজমকপূর্ণ, অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত একটা প্রাসাদ। বড় খালটার গায়ে, রিয়ালোটর অদূরে সেটা অবস্থিত। তবে এও সত্য যে, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় পরিবেশ–বিশেষ করে বাড়িটা যেন রীতিমত বিষণ্ণতায় ভরপুর।

আমি সদর-দরজায় পা দিতেই এক প্রবীন ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।

আমি তার পিছন পিছন মোজাইক-করা একটা চওড়া ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম।

লোকটা আমাকে নিয়ে এমন একটা ঘরে গেল যার ভেতরে ঢোকার আগেই, দরজার সামনে দাঁড়াতেই ঘরের ভেতরের বহু মূল্য বস্তু সামগ্রির অতুলনীয় উজ্জ্বলতা খোলা-দরজা দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে আসায় চোখ দুটোকে এমন ধাধিয়ে দিল যে, আমি যেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে গেলাম।

আমার পূর্ব পরিচিত ব্যক্তি যে বিত্তশালী–অগাধ ধন সম্পদের মালিক, তা আমার জানা ছিল বটে। তবে সে একজন রীতিমত টাকার কুমির এ বিষয়ে আমার তিলমাত্র সন্দেহও নেই। তবে এও স্বীকার করছি, তার ধন-দৌলতের বর্ণনা আমি যেরকম ভাষায় শুনেছি তাকে আমি নিজেই অতিরঞ্জিত ও হাসির ব্যাপার আখ্যা না দিয়ে পারিনি; ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমার কাছে পরিবেশন করা হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহই হয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু চারদিকে কৌতূহল মিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে দৃষ্টিপাত করে করে যা-কিছু আমার সামনে ধরা দিল, তাতে আমি বিশ্বাস করতেই উৎসাহ পাচ্ছিলাম না যে, এমন রাজৈশ্বর্য ইউরোপের কোনো মানুষের বাড়িতে থাকা সম্ভব। কেবলমাত্র আমার কথাই বা বলি কেন? নিতান্ত হলফ করে বললেও কেউই এমন ধন-ঐশ্বর্যের অস্তিত্বের কথা বিশ্বাস করবে না–বিশ্বাস করার মতো ব্যাপারও নয়।

আমি আগেই বলেছি ভোরের আলো ফুটে গেছে। এখন পূব-আকাশে সূর্যদেব উঁকি দিতে শুরু করেছেন। ক্রমে সূর্যের রক্তিম আভায় প্রকৃতি উদ্ভাসিত হয়ে গেল।

এত বেলা হয়ে গেছে তবু ঘরের মধ্যে এখনও অনেক, অনেক উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। ঘরের অবস্থা, জ্বলন্ত বাতি, সবকিছু দেখে এবং আমার বন্ধুর চোখ-মুখের ক্লান্তির ছাপটুকু চাক্ষুষ করে আমি ধরেই নিলাম গত রাতে সে বিছানায়ই আশ্রয় নেয়নি। সে সম্পূর্ণ বিদ্রি অবস্থাতেই সারাটা রাত কাটিয়েছে।

ঘরটার ভেতরের স্থাপত্য, বিশেষ করে ভাস্কর্য শিল্পরীতি এবং আসবাবপত্র ও সাজসজ্জা দেখলেই অনুমান করা যায় যে, মানুষের চোখ দুটোকে ঝলসে দিতে আর চমক সৃষ্টি করতে এ সবের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপরোক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে গিয়ে শালীনতাবোধ অথবা জাতীয়তাবোধের দিকে সামান্যতম নজরও দেওয়া হয়নি।

আমার চোখের মণি দুটো একটা বস্তুর ওপর থেকে অন্য একটা বস্তু, তার পর সেটা থেকে অন্য আর একটা বস্তুর ওপর অনবরত চক্কর খেতে লাগল। কোনো বস্তুর ওপরই বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না বা স্থির হয়ে বসল না।

আমার দৃষ্টি ইতালীয় শিল্পীদের সবচেয়ে ভালো ভাস্কর্যশিল্পের ওপর স্থির থাকল না। এমনকি গ্রীক চিত্রশিল্পীদের অত্যদ্ভুত মূর্তির ওপরও নয় আবার মিশরের অতিকায় খোদাই-শিল্পসামগ্রির ওপরও নয়। এমনকি ঘরের দরজা-জানালার পর্দাগুলোতেও বৈচিত্রের ছোঁয়া আছে। ধরের বহুমূল্য পর্দাগুলোনিচু পর্দার বিষণ্ণ সুরের তালে তারে আলতোভাবে দোল খাচ্ছে। কিন্তু সে সুরের উৎস যে কোথায় তা আমার কাছে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।

অদ্ভুত কারুকার্যমণ্ডিত ধুনচি থেকে বাতাসবাহিত পরস্পর বিরোধী ধূপের গন্ধ নির্গত হয়ে নাকে এসে পৌঁছাচ্ছে। হরেক রঙের অগণিত আলোকরশ্মির দশ ইন্দ্রিয়কে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।

ঘরের বিভিন্ন আকৃতি ও রঙ বিশিষ্ট দ্রব্য সামগ্রির ওপর ভোরের রক্তিম ও তাজা আলোকচ্ছটা পতিত হচ্ছে। আর সে আলোকচ্ছটা গলিত চিলি সোনার বহু মূল্য কার্পেটের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেন হাজারো শিখায় ঝিল্লা দিচ্ছে। আর সে আলোকচ্ছটায় ঘরের সবকিছু যেন উদ্ভাসিত হয়ে পড়ছে। সে যে কী অপরূপ শোভা তা ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে সম্যক ধারণা দান করা সম্ভব নয়।

আমি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই ভেতরের সবকিছুর ওপর কৌতূহলী চোখের মণি দুটো বুলাতে লাগলাম। অন্য কোনো দিকে আমার খেয়ালমাত্রও নেই। এমন সময় গৃহকর্তা আচমকা যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার জোগাড় হলো। হাসতে হাসতে তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।

পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে, হাসি থামিয়ে গৃহকর্তা অঙ্গুলি-নির্দেশ করে একটা চেয়ারে আমাকে বসতে অনুরোধ করলেন। তারপরই একটা অটোম্যানের ওপর। টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল।

আমার ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া ভাবটা দেখে সে বলল–আমার ঘরটা যে তোমার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করেছে তা আমার বুঝতে বাকি নেই, বন্ধু। কথা বলতে বলতে সামনের মূর্তিগুলোর দিকে অঙ্গুরিনিদের্শ করে বলল–এই যে পাথরের মূর্তিগুলো দেখছ–ঔসব ছবি, আর ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শন এবং পর্দাগুলোর ব্যাপারে আমার নিজস্ব রুচি এবং ধ্যান-ধারণা তোমার মধ্যে বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। আমার প্রাসাদ ও অন্যান্য জাকজমক তোমার মনপ্রাণকে একেবারে কাণায় কাণায় ভরিয়ে দিয়েছে, তাই না? কিন্তু সুপ্রিয় আমাকে কিন্তু মার্জনা করতে হবে।

আমি আচম্বিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম, ক্ষমা? কেন ক্ষমা? ক্ষমার প্রশ্ন উঠছে কেন?

আমাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে গৃহকর্তাই আমার মুশকিল আসান করতে গিয়ে বলল–কী ভাবছ বন্ধু? কেন ক্ষমা, তাই ভাবছ তো? আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে বলল–আমার উদাত্ত হাসির কথা বলতে চাইছি। আমার উদাত্ত হাসিকে মার্জনা করতেই হবে।

আমার চোখ-মুখের বিস্ময়ের ছাপটুকু গৃহকর্তার নজর এড়াল না। আমার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে এবার বলল–কী ব্যাপার, বল তো বন্ধু, তোমার মুখের বিস্ময়ের ছাপটুকু যে কিছুতেই মিলছে না। তোমার অবস্থা যে একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছে দেখছি!

আমি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তার দিকে নীরব চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম। সে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখল–হ্যাঁ যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এমনকিছু কিছু জিনিসের অস্তিত্ব লক্ষিত হয় যা পুরোদস্তুর হাস্যকর। আর তাতে মানুষের হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যাবার জোগাড় হবে, নয়ত মরেই যাবে।

মরে যাবে! হাসতে হাসতে মরে যাবে!

হা বন্ধু, হ্যাঁ। হাসতে হাসতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, এর চেয়ে গৌরবের কিছু আছে, নাকি থাকতে পারে, তুমিই বল? স্যার টমাস মোরের নাম নিশ্চয়ই তোমার শোনা আছে, কী বল?

আমি মুখ তুলে তাকালাম।

কিন্তু আমাকে হ্যাঁ বা না উত্তর দেবার আগেই গৃহকর্তাই আবার বলতে শুরু করল–স্যার টমাস মোর, বড় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। স্যার টমাস মোর হাসতে হাসতেই পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আহা! বড় ভালো লোক ছিলেন!

মুহূর্তের জন্য থেমে গৃহকর্তা আবার মুখ খুলল–ভালো কথা, তুমি কি জান বন্ধু, স্পার্টাতে এক সময় হাজার দেব-দেবীর মন্দির আর পবিত্র বেদী ছিল।

আমি ঘাড় কাৎ করে নীরবে তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সে পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চলল হাজারো দেবদেবীর মন্দির! কিন্তু কী অত্যাশ্চর্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কি জানি?

আমি কি জবার দেব ভেবে না পেয়ে তার মুখের দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

সে বলে চলল–অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটা হচ্ছে। স্পার্টার অন্য সব দেব-দেবীর মন্দির ধ্বংস মানে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলেও হাসির দেবতার মন্দিরটা কিন্তু শেষপর্যন্ত অক্ষত রয়ে গেল। আজও সেটা বহাল তবিয়তে সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এবার চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গৃহকর্তা বললেন–কিন্তু হায়! বন্ধু, তুমি আমার বাড়িতেনিমন্ত্রিত অতিথি, সম্মানীয় ব্যক্তি। যাকগে, সে সব পুরনো কাসুন্দি আর না-ই বা ঘাঁটলাম। যে কথা বলতে চাইছি, তোমাকে নিয়ে যে একটু-আধটু আমোদ ফুর্তি করব তারও উপায় নেই। উপায় নেই বলতে, আসার অধিকারই নেই। অতএব তোমার অবাক হবার ব্যাপারটা তো আর অমূলক নয়। তবে একটা কথা, রাজার ঘরের মতো সাজানো আমার ঐ ঘরটার মতো আর একটা ঘর তৈরি করা ও সুসজ্জিত করে তোলা ইউরোপের কারো সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোবে না। তবে এও সত্য যে, আমার প্রাসাদের অন্য ঘরগুলো কিন্তু ঠিক এর সমান মানের নয়, উকট ফ্যাশান যাকে বলে। ফ্যাশানের চেয়ে সেটাই তো ভালো, তোমার কী মতো বন্ধু? কিন্তু এটাই আজ সবার উম্মার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যা-ই হোক, এ ব্যাপারে আমি একটু বেশি রকমের কঠোরতা পালন করি। যে কেউ হুটহাট করে আমার প্রাসাদে প্রবেশাধিকার পায় না। আমি মাত্র দুজনকে এখানে প্রবেশ করতে দিয়েছি–একজন আমার খানসামা আর দ্বিতীয়জন হচ্ছ, বন্ধু তুমি।

আমি কিছু সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আসলে কী ভাবে যে তার বক্তব্যের স্বীকৃতি দেব, হঠাৎ করে ভেবে পেলাম না। পর মুহূর্তেই তার বক্তব্যের স্বীকৃতিস্বরূপ মাথাটা সামান্য নত করলাম।

বুঝতে পারলাম শয্যা ছেড়ে নামার চেষ্টা করছে। আমি ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে তার খাটের গা-ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আমার কাঁধে ভর দিয়ে সে খাট থেকে নেমে এলো।

তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে ঘরে পায়চারি করতে লাগল।

ঘরে ঘুরতে ঘুরতে সে আমাকে লক্ষ্য করে কয়েকটা ছবির দিকে পর পর অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল–বন্ধু, এই যে ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছ, সবই গ্রীক আমল থেকে শুরু করে সিমাবু কাল পর্যন্ত, আর সিমাবু আমল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পর পর টাঙানো হয়েছে।

তাই বুঝি?

অবশ্যই। আর একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে ভাসুই মতবাদের পরোয়া না করে এগুলোর মধ্যে বহু ছবিকেই বাছা হয়েছে।

হুম্।

আর একটা কথা, সব ছবিই কিন্তু এ ঘরের পক্ষে খুবই মানানসই নির্বাচন। বুঝেছ বন্ধু? এ ছবিগুলো কার বা কার আঁকা, তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে-ই আবার বলতে আরম্ভ করল–অজ্ঞাতনামা কৃতীশিল্পীদের মহৎ চিত্রশিল্প বলে অবশ্যই মনে করা যেতে পারে।

এবার দেওয়ালের এক পাশে টাঙানো কয়েকটা ছবির দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে সে বলল–এই যে অসমাপ্ত শিল্পকর্মগুলো দেখছ, এদের চিত্রশিল্পীরা তাদের আমলে খুবই খ্যাতিমান হলেও আজকের দিনের শিল্পবোদ্ধারা তাদের নীরবতার ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, আর আমার কাছে।

কথা বলতে বলতে সে অকাস্মাৎ তমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল–একটা কথা, জিজ্ঞেস করতে পারি কী বন্ধু?

কী? কী কথা? তুমি নির্দিধায়–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে বলল–কথাটা হচ্ছে, ম্যাডোনা দেলা পিয়েতা সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা, বল তো?

আমি অপরূপ রূপসমৃদ্ধ ছবিটার দিকেই সৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলাম। তার কথায় যেন হঠাৎই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে উঠলাম–এটা যে গিদোর নিজেরই মূর্তি। আমি সোৎসাহে কথাটা ছুঁড়ে দিলাম।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

কিন্তু এটা তুমি, কোত্থেকে, কীভাবে সংগ্রহ করেছ?

গৃহকর্তা নীরবে ম্লান হাসল। আমি বলে চললাম–ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে ভেনাসের যে স্থান মর্যাদা, চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে সে-ও সে স্থানলাভের যোগ্য বলেই স্বীকৃত।

সে কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ ফুটিয়ে তুলে বলল–হ্যা! ভেনাস, রূপসি ভেনাস? মেদিসির ভেনাস? ছোট মাথা আর মাথাভর্তি সোনালি চুল?

তাঁর আবেগ-উচ্ছ্বাসটুকু আমার নজর এড়াল না।

সে আগের মতো আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল–তার বাঁ হাতের অংশবিশেষ। আর ডান হাতের পুরোটাই পুনঃস্থাপন। এবার গলা নামিয়ে অধিকতর গলা নামিয়ে বলল–বন্ধু, আমার কিন্তু মনে হয়, সে ডান হাতের ভঙ্গটুকুতেই স্নেহধারা বর্ষিত হচ্ছে। এই এপোলোর ছবিটা যে কপি-করা এতে কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আর আমি নিজে? আমি এমনই বোকা অন্ধ যে এপোলোর স্পর্ধিত প্রেরণাটাও বুঝে উঠতে পারিনি। তুমি আমার প্রতি করুণা প্রদর্শন করতে পার সত্য, কিন্তু আন্তিনুসকে বেছে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তরও তো কিছু নেই। সক্রেটিস কী বলেছিলেন, জানো?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে আমার জিজ্ঞাসা নিরসন করতে গিয়ে বলল–ভাস্কর্যশিল্পী একখণ্ড শ্বেত পাথরের মধ্যেই তার মূর্তিটাকে পেয়েছিলেন, সক্রেটিসই তো এ-কথা বলেছিলেন, তাই না?

সে যা-ই হোক, গৃহকর্তা এরকম সব ছোটখাট ব্যাপার প্রসঙ্গে যেভাবে আবেগ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল, তার ভেতর দিয়েই ত্রাসের আভাস আমার চোখে ধরা পড়েছে, আর কথা এবং কাজের মধ্যে কিছুটা স্নাছুবিক দাওয়াইয়ের প্রলেপ–এমন একটা উত্তেজনার প্রকাশ, যা সর্বদাই আমার মন-প্রাণকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। আবার অনর্গল কথা বলতে বলতে মাঝে-মধ্যে বক্তব্যের গোড়ার দিকটা ভুলে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেছে। তারপর গভীর মনোযোগের সঙ্গে উৎকর্ণ হয়ে থাকে কেন? এমনও হতে পারে কোনো অতিথির আগমনের প্রতীক্ষায়, নতুবা কোনো কাল্পনিক শব্দ শোনার প্রত্যাশায়ই তার এমন থমকে যাওয়ার কারণ।

কিছুক্ষণের জন্য বিরতির ফাঁকে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ। হলো অটোমানের ওপর রক্ষিত একটা বইয়ের ওপর। বইটা পণ্ডিত-কবি পলিটিয়ানের লেখা অতি সুন্দর ট্রাজেডি দ্য আরফিও।

বইটা হতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শেষের দিকে পেন্সিলে দাগ দেওয়া একটা অংশের দিকে আমার নজর পড়ল। তৃতীয় অঙ্কের শেষের দিকের একটা অংশ–মর্মভেদী উত্তেজনাপূর্ণ অংশ। এমন একটা অংশ যা পড়লেই যে কোনো পুরুষের মধ্যেই আবেগ-উচ্ছ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আর নারীরা? যে কোনো নারীর বুক নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে, সন্দেহ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, পুরো পাতাটাই চোখের জলে ভিজানো।

তার সে পাতাটারই বিপরীত দিকের পাতায় আমি কি দেখতে পেলাম? সে পাতার নিচের ইংরেজি পংক্তিগুলো এমন এক হাতের লেখায় লিখিত, যার সঙ্গে আমার সদ্য পরিচিত এ বন্ধুটার হাতের লেখার কোনো সাদৃশ্যই খুঁজে পেলাম না।

দীর্ঘসময় ধরে গবেষণা চালাবার পর সেটা যে এ বন্ধুরই হাতের লেখা, বহু কষ্টে তা বুঝতে পারলাম।

সে পাতায় যা লেখা ছিল তা মোটামুটি এরকম–

ওগো আমার প্রেম-ভালোবাসা, তুমিই আমার সর্বস্ব ছিলে। আমার মন সর্বদাই তোমার জন্য কেঁদে আকুল হতো।

সাগরের মাঝে সবুজ একটা দ্বীপ। প্রেম-ভালোবাসা একটা ঝর্ণাধারা, পূজোর একটা বেদী পরীদের দেশের ফুলে-ফুলে সজ্জিত–সে সব ফুল-ফল আমারই জন্য। ওগো আমার প্রেম-ভালোবাসা সব, সবকিছুই তোমার আমার জন্য।

কিন্তু হায়! সে শান্তি-মুখের স্বপ্ন যে বড়ই ক্ষণস্থায়ী। হায়রে আমার নক্ষত্রোজ্জ্বল আশা-আকাঙ্ক্ষা, তোমার উদয় কেন হলো? মেঘের আড়ালে আত্মগোপন করার জন্যই যে তোমার প্রকাশ হলো! তুমি বড়ই ক্ষণস্থায়ী; এই আছ, এই নেই! হায়!

কার তীব্র কণ্ঠস্বর যেন ভবিষ্যতের ওপাড় থেকে বাতাসবাহিত হয়ে কাছে এসে বাজছে। কে যেন গলাছেড়ে বলছে–অগ্রসর হও, এগিয়ে যাও।

কিন্তু আমার অন্তরাত্মা যে হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে মরে অতীতের বুকে, ব্যবধান বড়ই অস্পষ্ট; নির্বাক, নিশ্চল আর অভিভূত! কারণ, হায়! হায়! আমার কাছে, আমার সামনের পৃথিবীর আলো যে নিপ্রভ–না, নিষ্প্রভ নয়, এ একেবাওে নিভেই গেছে।

সৈকত ভূমির বালির রাশিতে যে বাণী গভীর সমুদ্রকে বাধা দেয়, আটকে রাখে, তা হচ্ছে–আর নয়! আর নয়। কিছুতেই আর নয়।

হায়! বজ্রপাতে পুড়ে-যাওয়া গাছের শাখায় শাখায় আর কোনোদিন কুঁড়ি দেখা দেবে না, ফুল ফুটবে না এবং আহত ঈগলও আর কোনোদিন আকাশে ডানা মেলবে না। সময় আজ আমার কাছে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, আমার রাতের যত স্বপ্ন সবকিছু কাকে কেন্দ্র করে? সবই তো ওই কালো, মায়া-কাজল পরানো চোখ দুটোকে কেন্দ্র করে।

আর যেখানে তোমার পদচারণে ধ্বনি উত্থিত হয়, মনোলোভা শব্দ উত্থিত হয় সেখানেই অপার্থিব নাচ শুরু হয়ে যায়। হায়! এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! আর সে অদ্ভুত অপার্থিব নাচ ইতালির নদীর তীরে তীরে শুরু হয়ে যায়। হায়! এ কী কাণ্ড!

ঘায়! অভিশপ্ত মুহূর্তে তারা তোমাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় ধাক্কায় একটা অপবিত্র উপাধানে প্রেম-ভালোবাসা থেকে তোমাকে বয়ে নিয়ে চলে গেল।

তারা তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার কুয়াশাচ্ছন্ন রাজ্য থেকে, আমার বুক থেকে। কোথায়? কোথায় নিয়ে গেল? উলুখাগড়ার রূপালি বন যেখানে প্রতিনিয়ত কেঁদে মরে!

উপরোক্ত পংক্তিগুলো যেহেতু ইংরেজি ভাষায় লিখিত ছিল তাই আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম না যে, তাদের লেখকের ওই বিশেষ ভাষাটা রপ্ত ছিল। আমি কিন্তু তাতে তিলমাত্রও অবাক হইনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তো ভালোই জানা ছিল যে, অনেক কিছুই তার জানা আছে, অনেক কিছুই রপ্ত আছে। আর তার জানা বিষয়গুলোকে দশজনের কাছে গোপন রাখতেও সে খুব মজা পেত, খুবই সত্য কথা।

তবে লেখাটার উল্লিখিত তারিখ আর সে সঙ্গে জায়গার নামটা পড়ার পর আমার মধ্যে অন্তহীন বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটল।

লেখাটার সবার ওপরে লন্ডন কথাটা লেখা হয়েছিল। তারপর সেটাকে কেটে দেওয়া হয়েছে। আর এমনভাবে কাটা হয়েছে যাতে অনুসন্ধানি নজরে দেখলে কথাটা বোঝা যায়।

এই মাত্রই তো বললাম জায়গাটার নামটা পড়ার পর আমার মধ্যে অন্তহীন বিস্ময়ের উদ্রেক করল। আমার খুব ভালোই স্মরণ আছে যে, এর কারণ সম্বন্ধে আগের কোনো এক কথা প্রসঙ্গে আমি নতুন এ-বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তবে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অতীতে কোনো সময়ে লন্ডন শহরের বাসিন্দা মার্চে ডি মেনতানির সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছিল? কারণ বিয়ের আগে সে মহিলাটি বেশ কয়েক বছর সে শহরে কাটিয়েছিল।

আমার প্রশ্নের উত্তরে সে যা বলেছিল, তা যদি আমি নিতান্ত ভুল বুঝে না থাকি তবে–সে আমাকে বলেছিল, সে কোনোদিনই গ্রেট ব্রিটেনের সে রাজধানী শহরটায় পা দেয়নি।

প্রসঙ্গ ক্রমে সে আমাকে এও অবশ্যই বলা দরকার, আমি একবার নয়, বহুবারই শুনেছি যে, আমার এ নতুন বন্ধুবর কেবলমাত্র যে জন্মসূত্রে তা-ই নয়, শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেও একজন নির্ভেজাল ইংরেজ।

আমার হাতে যে কবি পলিটিয়ানের ট্র্যাজিডি দ্য অরফিও-টা রয়েছে সেটার দিকে নজর না দিয়েই আমার বন্ধুবর বলল–আরও একটা ছবি আছে যেটা তোমাকে দেখানো হয়নি।

আমি মুচকি হেসে বললাম–না দেখালে আমি কী করে দেখব? আমার কথা শেষ হতে না হতেই সে হাত বাড়িয়ে একটা পর্দা সরিয়ে দিল।

আমার চোখের সামনে থেকে পর্দাটা সরে যেতেই একটা ছবির দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো।

সে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বলল–এটা মার্চেসা এফ্লোদিত-এর প্রতিকৃতি।

আমি অপলক চোখে, মার্চেসা এফ্লোদিত-এর পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছবিটার যে বিশেষত্বটুকু আমার চোখে ধরা পড়ল, তাতেই আমার পক্ষে ছবিটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া দায় হয়ে পড়েছে।

বাস্তবিকই ছবিটা প্রতিকৃতির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার মতোই বটে। আর এও স্বীকার করতেই হবে, কোনো মানুষের শিল্প-দক্ষতা সে নারীর অতিমানবিক সৌন্দর্যকে এর চেয়ে নিখুঁত করে আঁকতে পারত না, অবশ্যই না।

ডিউকের প্রাসাদের দরজায় গত রাতে সে অপার্থিব মূর্তিটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, আর একবার সে-ই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার মুখে হাসির ঝিলিক বিরাজ করলেও তারই মধ্যে আত্মগোপন করে রয়েছে রীতিমত দুর্বোধ্য অসঙ্গতি, সে বিষণ্ণতার অস্পষ্ট ছাপটা যা চিরদিনই পূর্ণ সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কযুক্ত।

তার হাত দুটোর পরিস্থিতি? ডান হাতটা ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখা আছে। আর অদ্ভুত আকৃতিবিশিষ্ট পাত্রের দিকে ডান হাতটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আর পরীর মতো ছোট্ট যে পা-টাকে দেখা যাচ্ছে, সেটাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে কোনোরকমে মাটি স্পর্শ করেছে। আর তার ডানা দুটো? ঝলমলে আলোয় আলোকিত পশ্চাৎপটে দেখা যায় কি যায় না, এমন ভঙ্গিমায় তার সুদৃশ্য ডানা দুটো আলতোভাবে উড়ছে। বাঃ! কী মনোরম দৃশ্য!

আমার দৃষ্টি এবার প্রতিকৃতিটার ওপর থেকে সরে এসে পাশে অবস্থানরত নতুন বন্ধুর ওপর গিয়ে পড়ল।

সে কিছু বলার আগেই, নিজে থেকেই আমার ঠোঁট দুটো বার বার নড়ে উঠল, উচ্চারিত হলো চাপম্যান-এর লেখা বুসিডি এর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা–

ওই–ওই তো সে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে রোমক মূর্তির মতো খাড়াভাবে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু যতদিন তাকে শ্বেতপাথরে পরিণত না করে দেয়, ততদিন সে দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়েই থাকবে।

আমার কথা শেষ হলে বন্ধুবর গুটিগুটি এগিয়ে গেল রূপার কাজ করা একটা টেবিলের দিকে। সেটা ঘরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে না হলেও ভজন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে? আমি কিন্তু বলব, স্থান এবং কালে ভয়ই তাকে এমনটা করতে বাধ্য করে। আমি নিজেরই অতীতে একসময় বড়ই শিল্পপ্রীতি ছিলাম। তবে এও সত্য যে, সেটা আমার পক্ষে চরম বোকামি ছিল। আর তা-ই আমার মন-প্রাণকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এও স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বর্তমানে এসবই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে।

আজ আমার আত্মা এসব আরবীয় ধূপধানের মতোই অগ্নিজ্বালায় দাউ দাউ করে জ্বলছে তো জ্বলছেই। আর সে দৃশ্যের যথার্থ স্বপ্নের মুল্লুকের চিত্র দর্শনের উপযোগি করে তৈরি করে তুলেছে, বর্তমানে আমি যার দিকে দ্রুত ধেয়ে চলেছি।

কথা বলতে বলতে আমার বন্ধুবর অকস্মাৎ থমকে গেল। কথা বলা বন্ধ করে মুখে একেবারে কলুপ এঁটে দিল। তার মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে অচিরেই একেবারে বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

আমি তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। উৎকণ্ঠার সঙ্গে তার প্রতিটা মুহূর্তের দিকে নজর রেখে চললাম।

আমার মনে হল, আমার নতুন এ বন্ধুবরের কানে এমন একটা শব্দ আছে, সে দিকে তার শ্রুতি আকৃষ্ট হচ্ছে তা আমি শুনতে পাচ্ছি না।

শেষমেশ সে ঝট্‌ করে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যস্তভাবে ওপরের দিকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর ছিলচেস্টারের বিশপের লেখা কবিতার দুটো পংক্তি আবৃত্তি করল

ওখানেই, আমার অপেক্ষায় ওখানেই থাক। ওই উন্মুক্ত প্রান্তরেই আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হবই হব।

না, আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি সামর্থ্য তার রইল না। মদের মাদকতা শিক্ত তার কায়িক শক্তিকে গ্লাস করে ফেলল। হলো সে অটোমানের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। পর মুহূর্তেই সিঁড়ি থেকে দ্রুত পায়ে চলার শব্দ ভেসে এলো। বার বার দরজায় গায়ে আঘাত পড়তে লাগল।

আমি উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনলাম। তারপরই আমার মনে দ্বিতীয় গোলযোগের আকাঙ্খ উঁকি দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই মেনতানির বাড়ির পরিচারকটা উৰ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। তার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছে। সে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে কেটে কেটে কোনোরকমে কয়েকটা টুকরো টুকরো অসংলগ্ন কথা উচ্চারণ করল–আমার মনিবাণি! আমার মনিবাণি! বিষ! বিষ! হায়! হায় রূপসি এফ্রোদিতে! রূপসি এফ্রোদিতে!

আমি বুকভরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ছুটতে ছুটতে অটোমানটার কাছে হাজির হলাম। ঘুমন্ত বন্ধুবরকে অত্যাশ্চর্য, রীতিমত অবিশ্বাস্য খবরটা শোনাবার জন্য জাগাতে চেষ্টা করলাম।

আমি যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। যারপরনাই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। তার হাত-পা কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটোর রক্ত কেন্দ্রস্থলে প্রায় কাছাকাছি রক্ষিত ছিল।

টেবিলের ওপর কয়েকটা সুন্দর, মনোলোভা কারুকার্যমণ্ডিত পানপাত্র রক্ষিত ছিল। আর পানপাত্র দুটোর কাছাকাছি বড় বড় দুটো ইউট্রাস্কন পাত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। একটা ব্যাপার আমার নজর এড়ালো না, প্রতিকৃতিটার সামনের দিককার মতোই টেবিলটাকে অনন্য কারুকার্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে থাকার পর আমার মনে হলো, তাতে মোহানিস বার্জারই ভরে রাখা ছিল।

আমি যখন শিল্পকর্ম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি তখন সে হঠাৎই বলে উঠল–বন্ধু, অনেকক্ষণ ধরে আমরা শুধু কথাই বলে চলেছি, তাই না?

তাতে কি আছে, ভালোই তো লাগছে।

না, এখন আর কোনো আলোচনা নয়। চল, আগে একটু পান করে চাঙ্গা হয়ে নেবে। এখন সকাল, একেবারেই সকাল, তবু চল দু-এক পেয়ালা পান করা যাক। দেখবে, তাতে শরীর ও মন চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

সূর্যোদয়ের প্রথম ঘণ্টাটা দেবদূতের হাতুড়ির আঘাতে প্রথম ঘণ্টাটা মনোলোভা ও শ্রুতিমধুর সুরে বেজে উঠল। সে ঘণ্টাধ্বনি ঘরময় বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

ঘণ্টাধ্বনিটা যেন বলতে লাগল–সত্যি এখন খুবই সকাল। তা হোক গে। এসো। আমরা গানে গানে মন-প্রাণ ভরিয়ে তুলি। আমরা পান করি, আকণ্ঠ পান করে শরীর ও মনকে চাঙ্গা করে তুলি।

বাতি আর ধূপদানিগুলো দূরের ওই অতি উজ্জ্বল অতিকায় সূর্যটাকে পরাজিত করার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এসো তার সম্মান রক্ষার্থে আমরা পানীয় দিয়ে পানপাত্র দুটোকে ভরে নিই।

আমার হাতের পাত্রটাতে পানীয় ঢেলে কানায় কানায় ভরে দিয়ে সে নিজে ব্যস্তভরে একের পর এক পাত্র পানীয় গলায় ঢালতে লাগল।

পর মুহূর্তেই একটা ধূপদানের অত্যুজ্জ্বল আলোর দিকে সে নিজের হাতের পানীয় ভর্তি পেয়েলাটাকে তুলে ধরল। তারপর সে আপন মনে বলতে লাগল–আমার জীবনের কাজই তো হচ্ছে স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকা। তাই তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ, আর তাই আমি নিজের জন্য স্বপ্ন কুঞ্জকে গড়ে তুলেছি।

আর একটা কথা আমার পক্ষে কি ভেশিমের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু গড়ে তোলা সম্ভব হতো? বল, এর চেয়ে বেশি কিছু কি আমি গড়ে তুলতে পারতাম?

তবে এ-কথা তো খুবই সত্য যে, তোমার চারদিকে যে স্থাপত্যনিদর্শন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, এসব কী তুমি দেখতে পাচ্ছ?

আমি কিন্তু বলব, এই যে চারদিকে এত অসঙ্গতি, তা কেবলমাত্র কাপুরুষদের চোখেই ধরা পড়ে। আর কয়েক মুহূর্ত আগেও যে চোখ দুটো অত্যুজ্জ্বল ছিল, এখন সে দুটো মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

আমার সর্বাঙ্গ টলতে আরম্ভ করল। নিজেকে সামলে রাখাই আমার পক্ষে দায় হয়ে পড়ল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে টলতে টলতে টেবিলটার কাছে এগিয়ে গেলাম। সেটার একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

ভাঙা-কালো একটা পানপাত্রের ওপর আমার হাত পড়ল। সচকিত হয়ে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর একেবারেই হঠাৎ সে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্যের একটা সামগ্রিক ব্যাপারের চেতনা, একটা বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো আমার মন-প্রাণকে উদ্ভাসিত করে দিল। আর সে আলোর বন্যায় আমি ভেসে গেলাম।

দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স ফাল

রটারডাম থেকে সব শেষে যে খবর পাওয়া গেছে তা হচ্ছে ওই নগরটা বর্তমানে দার্শনিক উত্তেজনায় তোলপাড় হচ্ছে। উত্তেজনা রীতিমত তুঙ্গে উঠে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আসলে রটারডাম শহরে সম্প্রতি এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে যা একেবারেই অভাবনীয়, আর নতুনও বটে। ঘটনাগুলোকে ভালোভাবে বিচার করলে বলতেই হয় সেগুলো প্রচলিত চিন্তাধারা ও মতামতের পুরোপুরি বিরোধী। এমন কোনো ব্যাপার স্যাপার সেখানকার মানুষ অন্তর থেকে সমর্থন করা তো দূরের ব্যাপার ভাবতেই উৎসাহ পাচ্ছে না।

আর আমার মতামত যদি জানতে চাওয়া হয় তবে আমি নির্দিধায় বলব, এর আগেই ব্যাপারটা নিয়ে ইউরোপের সর্বত্র তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। সবাই উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তাণ্ডবে মেতে উঠেছে। সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তাধারা নিয়ে প্রচলিত মতামতের বিরোধী বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করার মতো মানসিকতা এ পরিস্থিতিতে কারোরই নেই।

আর জ্যোতির্বিদ্যা, সুস্থ চিন্তাধারা, পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর জ্যোতির্বিদ্যার বক্তব্যও মতামতের সাধ্যমত খোঁজ খবর নিয়ে যা শোনা গেছে তা হচ্ছে মাসের…তারিখে (সঠিক মাস ও তারিখ আমার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না) অগণিত জনসমাগম, উদ্দেশ্যটা কি তা জানা নেই (স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি) শান্ত ও সুশৃঙ্খল রটারডাম নগরের এক্সচেঞ্জ এলাকাটিতে ঘটেছিল।

সেদিন খুবই গরম পড়েছিল। এ-ঋতু হিসেবে গরমটাকে অভাবনীয়ই বলতে হয়। কেবলমাত্র অস্বাভাবিক গরমই নয়, বাতাসের লেশমাত্রও ছিল না। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। তবে আকাশের গায়ে মেঘ গাঢ় থেকে গঢ়তর হচ্ছে। মনে হলো কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামলে নামতেও পারে।

হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম, কার্যত হলও তা-ই। জমাট-বাঁধা মেঘ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো ছিটেফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল ভ্যাপসা গরম থেকেনিস্কৃতি দেবার জন্য প্রকৃতিদেবী এমন তৎপর হয়েছে।

তা সত্ত্বেও দুপুরের দিকে সেই সমবেত জনতার মধ্যে একটু আধটু অস্থিরতা ও উত্তেজনা দেখা দিল। হাজার দশেক মানুষের কণ্ঠস্বর আকাশ বাতাস মথিত করতে লাগল। তারপরই দশ হাজার মানুষ আকাশের দিকে মুখ তুলল। পরমুহূর্তেই দশ হাজার বাঁশি যেন একই সঙ্গে বেজে উঠল।

এতগুলো মানুষের সমবেত কণ্ঠস্বর যে ধ্বনি তুলল, তার সঙ্গে একমাত্র নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবর্ণনীয় গর্জনেরই তুলনা চলতে পারে। গগনভেদি চিৎকার চাচামেচি যেন পুরো শহরটাকে তোলপাড় করতে লাগল। সে যে কী হৈ হট্টগোল, তা ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণার সঞ্চার করা সম্ভব নয়। আর সে চিৎকার চাচামেচি রটারডাম নগরের চারদিকের বাড়িগুলোতে বাধা পেয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে রীতিমত এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটল। সব মিলে পরিবেশটা যেন সম্পূর্ণরূপে অভাবনীয় হয়ে উঠল।

এমন হৈ-হট্টগোলের উৎস কোথায়–কোত্থেকে আসছে তা অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যপারটা সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ব্যাপারটা কারো কাছেই অজানা রইল না। যে জমাটবাঁধা মেঘের কথা একটু আগেই উল্লেখ করলাম তারই একটা টুকরোর পিছনেনিরেট একটা পদার্থ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম। সত্যিকারেরই অদ্ভুত সে পদার্থ।

আমি বিস্ময়-মাখানো দৃষ্টিতে বিচিত্র ধরনের যে নিরেট পদার্থটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পলক ফেলতেও ভরসা পাচ্ছি না, যদি মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।

আপাতদৃষ্টিতে দেখা অদ্ভুত সেনিরেট পদার্থটা অচিরেই অধিকতর স্বচ্ছ হয়ে উঠল। সত্যি কথা বলতে কি, এমন কোনো পদার্থকে এর আগে কেউ-ই আকাশে বিচরণ করতে দেখেনি।

ব্যাপারটা ক্রমেই সবার মধ্যে যার পরনাই রহস্যের সঞ্চার করল। আর হবে নাই বা কেন? আর এর গঠন প্রকৃতি এমন অবিশ্বাস রকম বিচিত্র যে অগণিত নারী-পুরুষ তার দিকেনিষ্পলক চোখে হাঁ করে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থেকেও ব্যাপারটা সম্বন্ধে সামান্যতম আঁচও করতে পারছে না। আর যদি ব্যাপারটা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই করতে না পাওে, তবে তার স্তব স্তুতিই বা কি করে করবে। ফলে কপরেল চামড়ায় বিস্ময়ের ভাজ এঁকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কারও তো কিছু নেই।

আসলে ওটা কী? এমন কোন বস্তু যা আকাশের গায়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কিভাবেই বা এমন অসম্ভব একটা কাণ্ড সম্ভব হচ্ছে?

খামখেয়ালিভাবে একত্রে জমা-হওয়া রটারডামের মানুষগুলো যত ভূতের নাম তাদের জানা আছে তাদের নাম করে করে তারা জানতে চাইছে, ওটা কীসের ইঙ্গিতবাহী। কেউ কিছু জানে না, বুঝতে পারছে না, এমনকি সামান্যতম অনুমানও করতে পারছে না।

না কেউ-ই না, অন্য কেউ তো সামান্য ব্যাপার এমনকি নগরের কর্তাব্যক্তি মিনহীর সুপারবাস ভন অ্যান্ডারডুক অকস্মাৎ উদ্ভুত এ-রহস্যটা উদ্ঘাটনের সামান্যতম সূত্রও খুঁজে পাচ্ছে না।

পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকুল বলে কারো পক্ষে কিছু করাও সম্ভব হচ্ছে না। কোনো যুক্তিগ্রাহ্য মন্তব্যও করতে পারছে না। সবাই অসহায় ও অস্থির দৃষ্টি মেলেনিশ্চেষ্টভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কিছুই করার নেই বুঝেও পথে জড়ো-হওয়া প্রতিটা মানুষ নিজনিজ বাঁশিটাকে আবার মুখে তুলে নিল। দু-ঠোঁটের ফাঁকে রেখে শক্ত করে চেপে ধরল। কিন্তু হঠাৎ যেন তারা কেমন থমকে গেল।

সবার মুখেই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। কয়েক পা হাঁটল। আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আসলে এমন একটা অভাবনীয়, একেবারেই উদ্ভট পরিস্থিতিতে কি যে করণীয়, তা-ই ভেবে উঠতে পারছে না। শেষপর্যন্ত করার মতো কিছু না পেরে সবাই আবার নিজনিজ বাঁশিতে ফুঁ দিল। এতগুলো বাঁশির সমবেত ধ্বনি রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল।

এরই মধ্যে আকামেমর বিচরণকারী সেই কৌতূহল-উদ্দীপক নিরেট পদার্থটা নগরের মাথার উপরে আরও অনেক, অনেক নিচে নেমে এসেছে। কখন আর কিভাবে সে ওটা গুটিগুটি এতটা নিচে নেমে এসেছে, কেউ টেরও পায়নি। ধোয়া উদগীরক পদার্থটা সমবেত জনতার মনে আরও অনেক বেশি কৌতূহল সঞ্চার করল।

সবাই তো ঘাড় ঘুরিয়ে চলমান সে বস্তুটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। তাদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই অদ্ভুত যে বস্তুটা ক্রমে নিচে নামতে নামতে একেবারেই কাছাকাছি চলে এলো।

এবার ব্যাপারটা নিয়ে এতগুলো মানুষের ধন্ধ প্রায় ঘুচে গেল। হ্যাঁ, এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল, নির্ঘাৎ ওটা বেলুন বা বেলুন জাতীয় কোনো একটা বস্তু।

হ্যাঁ, সেটা বেলুন জাতীয় পদার্থ ঠিকই। কিন্তু সবার মনেই একই প্রশ্ন কই, এরকম কোনো বেলুন তো এর আগে কেউ কোনোদিন রটারডামের আকাশে দেখেনি! ব্যাপারটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করার মতো অবকাশ কারো নেই। একে, অন্যের চোখের দিকে কেবল নীরব চাহনি মেলে তাকাতে লাগল আর সবিস্ময়ে আপন মনে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে চলল।

ওটা বেলুন বা বেলুন জাতীয় পদার্থ বটে। কিন্তু আসলে বস্তুটা কি? আমার মনেও একই প্রশ্ন বার বার জাগতে লাগল। নোংরা খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি এমন একটা বিচিত্র বেলুনের কথা কে, কবে আর কোথায়ই বা শুনেছে? অন্য কোনো দেশের মানুষ শুনে থাকলেও হল্যান্ডের মানুষ যে শোনেনি, এ-বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহও নেই।

ইতিপূর্বে কেউ কোনোদিন এমন অদ্ভুত বেলুনের কথা না শুনলেও আজ, এ মুহূর্তে তাদের নাকের ডগায় না হলেও নাক থেকে কিছুটা ওপরে এরকম বিচিত্র একটা বেলুন যে অবস্থান করছে, তা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে এও সত্য যে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে আমি জানতে পেরেছি, এমন কোনো মশলা ব্যবহার করে ওটাকে তৈরি করা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে কোনোদিনই এ ধরনের কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়নি।

আর এ-কথাটা বলতে বাধা নেই, রটারডামের অধিবাসীদের শুভবুদ্ধির প্রতি এ একটি মারাত্মক অসম্মানজনক ব্যাপার। আর শূন্যে ভাসমান বস্তুটার যে গঠনপ্রকৃতি, তা তো আরও অনেক বেশি অপবাদের ব্যাপার। কেন? কীসের নিন্দা? আসলে বস্তুটার গঠন প্রকৃতি এমন বিচিত্র ধরনের যে, সেটা দেখতে উলটে দেওয়া একটা গাধার টুপির চেয়ে ভালো কিছু নয়। গাধার টুপির চেয়ে খারাপ দেখতে কিছু থাকলে তা-ও ভাবা যেতে পারে।

আর ইয়া বড় একটা লোমশ টুপিকে বিচিত্র যন্ত্রটার শেষপ্রান্তে নীল রঙের ফিতে দিয়ে অনেকটা মোটর গাড়ির মতো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বেশি বিচিত্র, যা ব্যাপার তা হচ্ছে, ওই লোমশ টুপিটার মাথায় অর্ধগোলাকার একটা টুপিকে কালো রঙের ফিতে আর রূপার বকলেস দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এমন বিচিত্র আকৃতির কোনো বস্তুর কথা ভাবতেও উৎসাহ পাওয়া যায় না।

তবে এ-কথা স্বীকার না করে পারা যাবে না যে, রটারডাম নগরের অধিবাসীরা শপথ করে বলতে পারে যে, তারা এমন দৃশ্য তো ইতিপূর্বে বহুবারই চাক্ষুষ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এখন ব্যাপারটাকে উপস্থিত সবাই অভ্যস্ত দৃষ্টিতেই।

তবে এও সত্য যে ভ্রাট গ্রেটেল কাল শূন্যে ভাসমান বেলুনের মতো বস্তুটাকে। দেখামাত্রই বিস্ময় বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে আনন্দের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল। তার অন্তরঙ্গ জনটির ঠিক ওরকমই একটা টুপি ছিল। আর এও বলে রাখা দরকার যে, প্রায় বছর পাঁচেক আগে ভ্রাউ গ্রেটেলও তার সঙ্গিসহ রীতিমত আকস্মিকভাবে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। আর নিতান্তই বিনা কারণে ঘটেছিল।

আর এ বিবরণীর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের খবরাখবর নেবার যাবতীয় প্রয়াসই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। বহু চেষ্টা চরিত্র করেও তাদের সম্বন্ধে কোনো কথাই জানা সম্ভব হয়নি।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, বর্তমানে এ নগরের পূর্বদিকে নির্জন-নিরালা এক পরিবেশে অদ্ভুত ধরনের সব জঞ্জালের স্তূপের মধ্যে এমনকিছু হাড়গোড় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোকে মানুষের কঙ্কাল বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাপারটা বাতাসের। কাঁধে ভর করে সে মানুষের কানে পৌঁছে গেছে।

হাড়গোড় আবিষ্কারের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু লোক নানারকম আলোচনা সমালোচনায় মেতে গেল। শেষপর্যন্ত কিছু লোকের ধারণা হলো ওখানে একটা ভয়ঙ্কর রকমের খুন হয়ে গেছে। তারা এ-বিষয়েও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে, ভ্রাউ গ্রেটেল তার শিকার হয়েছে। অতএব ওসব হাড়গোড় তারই।

যাক, প্রসঙ্গটাকে অন্য দিকে আর টেনে না নিয়ে গিয়ে আসল ব্যাপারটায় ফিরে যাওয়া যাক।

ওই সেই বিচিত্র বেলুনটা মাটি থেকে একশো ফুটের মধ্যে নেমে এলো। এবার সেটাকে সবাই খুব ভালোভাবেই দেখতে পেল। ভিড় করে অপেক্ষমান মানুষগুলো এবার কেবলমাত্র বেলুনটাকেই নয়, বেলুনের আরোহীকেও দেখতে পেল। কেবল দেখতে পেল বললে ঠিক বলা হবে না, বরং স্পষ্টভাবেই দেখতে পেল।

সত্যি লোকটা বড়ই অদ্ভুত। আর দেখে তাদের এও মনে হলো তার দৈহিক উচ্চতা খুব বেশি হলেও দুই ফুট। কিন্তু সামান্য উচ্চতায়ই লোকটা হয়তো বা দৈহিক ভারসাম্য হারিয়ে তার ছোট্ট আকাশযানটা থেকে গড়িয়ে পড়ে যেত। তবে তার পড়ে na যাওয়ার কারণ হচ্ছে, বৃত্তাকার একটা বেষ্টনির মধ্যে সে আবদ্ধ থাকার জন্যই দৈহিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে আর সেটা বুক সমান উঁচু এবং দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধা। তাই দুর্ঘটনা ঘটতে পারেনি।

ছোটখাট মানুষটা উচ্চতার তুলনায় তার দেহটা বেশি রকম স্থূল হওয়ায় ধরতে গেলে একটা বলের মতো আকৃতি হয়ে গেছে। তবে তার পা দুটো দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু হাত দুটো একেবারেই বিশ্রি এবং অস্বাভাবিক লম্বা। মাথার চুলগুলো সনপাটের মতো ধবধবে সাদা। আর সেগুলো একটা সরু ফিতে দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা। আর নাকটা টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো অস্বাভাবিক লম্বা ও সামান্য বাঁকানো। এক পলক দেখলেই মনে হয় সেটা উত্তেজকও অত্যুজ্জ্বল এবং তীক্ষ্ণ। আর একটা ব্যাপার আমাকে বড় কম অবাক করেনি। তার মাথায় কান বলে কিছু নেই। কানের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে দুটো একদম মসৃণ। কোনোদিন কানের অস্তিত্ব ছিল বলেও মনে হলো না। বয়সের ভারে তার চিবুক আর গাল দুটো কুঁচকে গেছে। তবে ফোলাফোলা ভাব অবশ্যই আছে আর ভাঁজ পড়াও বটে।

আর তার পোশাক পরিচ্ছদ? গায়ে আকাশ-নীল রঙের সার্টিনের তৈরি ঢিলেঢালা একটা ফ্রক-কোট। আর তার সঙ্গে রং মিলিয়ে একটা ব্রীচেস পরা। রূপার একটা বকলেস দিয়ে হাঁটুর সঙ্গে বেঁধে দেওয়া। আর মাথায় পড়েছে হলুদ রঙের একটা টুপি। একদিকে কাৎ করে মাথায় বসানো। লাল ও লম্বাটে একটা রেশমি রুমাল অদ্ভুতভাবে একটা বো-নেট বেঁধে চমৎকারভাবে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মা নিয়েছেও চমৎকার।

সমতল থেকে শখানেক ফুট নেমে আসার পর বেঁটেখাট বুড়ো লোকটা যেন হঠাৎ ভয়ে মুষড়ে পড়ল। তার হাবভাব দেখে মনে হলো খুবই ভয় পেয়ে গেছে। আর এও মনে হল, মাটির আর কাছাকাছি আসতে মোটেই আগ্রহী নয়। কেন সে মানুষের তার এমন অনীহা তা-ও বুঝা গেল না।

ভূমির কাছাকাছি আসতে চান না বলেই হয়তো বহু কষ্টে একটা ক্যানভাসের ঝোলা হাতে তুলেনিল। কি সব দিয়ে যেন সেটা ভর্তি। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল, ঝোলাটার ভেতরে হাতটা চালান করে দিয়ে ভেতর থেকে মুঠো ভর্তি করে বালি তুলে নিয়ে নিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগল। ব্যস, তারপরই সে একেবারে স্থির হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ নিশ্চল-নিথরভাবে বসে থাকার পর এক সময় সে ঝটপট হাতটাকে ফ্রক কোটের পকেটে চালান করে দিল। সেখান থেকে মরক্কো চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটা নোটবই বের করে আনল।

এবার সে নোট বইটাকে হাতের ওপর নিয়ে হাতটাকে বার কয়েক ওপরনিচ করে তার ওজন সম্বন্ধে ধারণা করে নিয়ে সবিস্ময়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। বইটার ওজনই তার এরকম বিস্ময়ের কারণ।

কয়েক মুহূর্ত বইটার দিকেনিষ্পলক চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা লম্বা কাগজ বের করে আনল। কাগজ বলতে আসলে সেটা একটা চিঠি।

হাতের চিঠিটা বার দুতিন উলটে পাল্টে দেখে নিয়ে সে সেটাকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নগর প্রধান সুপারবাসের দিকে ছুঁড়ে দিল।

চিঠিটা ভাসতে ভাসতে এসে নগর প্রধানের পায়ের কাছে পড়ল।

নগর প্রধান মুহূর্তের জন্য চিঠিটার দিকে তাকিয়ে সেটাকে মাটি থেকে তুলে নেবার জন্য নিচের দিকে ঝুঁকলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কৌতূহলী নগরবাসীরা নীরবে ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে লাগল। তারা মুখে কিছু না বললেও তাদের মধ্যে কৌতূহল ও চাঞ্চল্যের অভাব নেই।

বিমানচারীর রটারডাম নগরের কাজ মিটে গেছে। এখানে তার আর কোনো দরকার নেই। কেবলমাত্র চিঠিটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে সে আবার ওপরে ওঠার জন্য তৎপর হল।

বিমানটাকে ওপরে তুলতে হলে তাকে সেটা থেকে আরও কয়েকটা বালির থলেকে নিচে ফেলে দিতে হবে। এভাবে বিমানটাকে হালকা করতে পারলে তবেই তো সেটা ধীরে ধীরে উর্ধগামী হবে।

বিমানচারী শেষপর্যন্ত করলেও তা-ই। সে একের পর এক বালির থলে বিমান থেকে ঝটপট নিচে ফেলে দিতে লাগল।

বালির থলেগুলো যে কোথায় কার ঘাড়ের ওপর পড়ছে, সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলো একের পর এক সরাসরি নগর প্রধানের পিঠের ওপর দমাদম পড়তে লাগল। আর এরই ফলে তিনি এতগুলো মানুষের চোখের সামনে একবার বা দুবার নয়, পর পর ছয়বার ডিগবাজী খাওয়ার ভঙ্গিতে উলটে গেলেন। যাকে বলে কেবলমাত্র বেইজ্জতের ব্যাপারই নয়, এতে তিনি রীতিমত নাস্তানাবুদ হতে লাগলেন।

তবে এও সত্য যে, কেউ যদি মনে করেন নগর-প্রধান অ্যান্ডারডু বিমানচারীর এরকম একটা বিচ্ছিরি কাণ্ডকে নীরবে বরদাস্ত করেছেন, মুখ বুজে হজম করেছেন তবে কিন্তু ভুলই করা হবে।

বরং উপস্থিত নগরবাসীদের বক্তব্য, তিনি আধা ডজনবার ডিগবাজী খাওয়ার সময় প্রত্যেক বারই পাইপ থেকে খুব জোরে বাঁশি বাজাতে লাগলেন। সাধ্যমত জোরেই বাঁশি বাজালেন। তাতে তার প্রচণ্ড ক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে। আর সবাই এও মনে করল, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বুঝি এভাবে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই থাকবেন।

বালির থলে গুলো ফেলে দেওয়ার ফলে আকাশ যানটা অনেকাংশে হালকা হয়ে যাওয়ায় ক্রমে ওপরে উঠতে উঠতে ইতিমধ্যে বেশ ওপরে উঠে গেছে। তারপর সেটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে একসময় রটারডাম নগরের অনেক উঁচু দিয়ে এক সময় দ্রুত মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দিল। ঠিক সেভাবে সেটা মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল ঠিক সে-রকমভাবেই ক্রমে মেঘের ভেতরে ঢুকে সম্পূর্ণরূপে মেঘের মধ্যে আত্মগোপন করল। সেটা রটারডামের ভালো মানুষদের বিস্ময় মাখানো নজরের বাইরে চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

বিমানটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর এবার পথচারী জনতার নজর পড়ল বিমান থেকে উড়ে-আসা চিঠিটার ওপর। সত্যি বলতে কি, বিমানটার অবতরণ এবং চিঠিটানিক্ষেপের ফলে মহামান্য নগরপালক ভন অ্যান্ডারভুকের দেহ-মন আর মর্যাদাকে রীতিমত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

বালির বস্তার আঘাতে পদস্থ ব্যক্তিটি যত ডিগবাজী খান আর পথে গড়াগড়ি খান না কেন চিঠিটাকে কিন্তু নজরে নজরে রেখেছেন, কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেননি।

পথচারীরা অনুসন্ধিৎসু নজরে চিঠিটার দিকে লক্ষ্য রেখে নিঃসন্দেহ হলো যে, চিঠিটা জায়গা মতোই পড়েছে। অর্থাৎ তিনি নিজেই হাত বাড়িয়ে পথের ওপর থেকে চিঠিটা হাতে তুলে নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চিঠিটা লেখা হয়েছে ‘রটারডাম কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমি’র সভাপতি এবং সহ-সভাপতি অর্থাৎ ভন অ্যান্ডারডুক এবং তাঁর সহকারী অধ্যাপক রুবাদুরের নামে। সভাপতি ভন অ্যান্ডারডুক চিঠিটা হাতে নিয়ে তাঁর সহকারী অধ্যাপক রুবাদুরের সামনে; পথের মাঝে দাঁড়িয়েই চিঠিটা খুললেন।

খামটার মুখ খুলে ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করে আনলেন। দেখলেন তাতে স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে–

‘মহামান্য সভাপতি ভন অ্যান্ডারডুক ও সহ-সভাপতি রুবাদুব, রটারডাম কলেজ অব অ্যাস্ট্রনমি’ মহাশয়দ্বয়–

আপনাদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে যে, গত পাঁচ বছর আগে হান্স ফাল নামক কোনো এক ব্যক্তি তিনজন সহকারীকে নিয়ে রটারডাম নগর থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। হান্স ফালের সম্পূর্ণ নাম ছিল–ভ্রাট গ্রেটেল হান্স ফাল। আর সে ছিল পেশায় কর্মকার। লোহা পড়িয়ে, পিটিয়ে পাটিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করাই ছিল তার জীবিকার একমাত্র উপায়। আর তার তিন সঙ্গিও একই পেশায় নিযুক্ত ছিল।

কিন্তু কেন যে হান্স ফাল কাউকে কিছু না জা নিয়ে, না বলে চুপিসারে বাড়ি থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল তা কেউই জানে না। মহাশয়দ্বয়, আশা করি আপনারা জেনে অবশ্যই খুশি হবেন যে, আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া হান্স ফাল।

আমার সহ-অধিবাসী ও পরিচিতজনরা জানেন যে, ঘেউয়ের ক্রাউট নামক গলির মুখে মুখে অবহিত ছোট্ট ইটের বাড়িটায় গত চল্লিশ বছর যাবৎ আমি বসবাস করছি।

আমি যখন নিখোঁজ হই, তখনও সে বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম, অর্থাৎ সে বাড়িটা থেকেই বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম।

কেবলমাত্র আমার কথাই বা বলি কেন? আমার পূর্ব পুরুষরাই বংশ পরম্পরায় সে বাড়িটাতেই বাস করে গেছেন।

আমার পূর্বসূরীরা আর আমি একই কর্মকার বৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করি। আমাদের পেশার মুখ্য কাজ ছিল হাপর মেরামত করা। এ সম্মানজনক আর লাভজনক। কাজেই আমরা স্মরণাতীতকালে নিজেদের লিপ্ত রেখেছি। আমাদের বংশের কেউ ভুলেও বংশগত পেশা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়নি।

সম্প্রতি মানুষ রাজনৈতিক কার্যকলাপে যেভাবে মেতে উঠেছে, রাজনীতিকে জীবনের সবচেয়ে অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়ে তাতেই সম্পূর্ণরূপে আত্ম নিয়োগ করেছেন তাতে আমার মতো রটারডম নগরের একজন সৎ মানুষের কাছে আমার এ বংশগত পেশাকে আঁকড়ে থাক ছাড়া অন্য কোনো পেশার প্রতি আগ্রহান্বিত হওয়া উচিত নয়। উপযোগিও অবশ্যই নয়।

আরও খোলসা করে বলছি–আমার পেশায় জমার পরিমাণ ভালো; আর কোনোদিনই কাজের অভাব হয় না। কাজ করতে পারলে, শরীর বরদাস্ত করলে কাজ যতই চাওয়া যাবে অভাব হবে না, অতীতেও কোনো দিন হয়নি।

কিন্তু যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কথায় কথায় সে প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, আমরা ক্রমেই স্বাধীনতা, দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনা ও ভাষণ, সংস্কারবাদ আর অনুরূপ সবকিছু ফলাফলগুলো সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে শিখে ফেললাম।

অতীতে এক সময় যারা পৃথিবীর সবগুলো দেশের শীর্ষে, অর্থাৎ সবচেয়ে সেরা খদ্দের এমন আমাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে ভাববার এতটুকু অবকাশ তাদের নেই, ইচ্ছারও পুরোপুরি ভাটা পড়ে গেছে।

সত্যি কথা বলতে কি, সরকারের ক্ষমতা যত হ্রাস পেতে লাগল, যতই শক্তির ঘাটতি হতে লাগল, লোহা আর চামড়ার স্থায়িত্ব ততই বেড়ে যেতে লাগল। সে এক কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হল।

শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে, অল্পদিনের মধ্যেই রটারডাম নগরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এক জোড়া হাপর জোগাড় করা সম্ভব হলো না। কী সমস্যায়ই না পরা গেল। এত বড় একটা নগরে একটা হাপরও মিলল না। এমনকি এমন এক জোড়া হাপরের হদিস পাওয়া গেল না, যার কোনোরকম হাতুড়ি ঘা দেওয়া বা সেলাই করার দরকার হতে পারে।

এমন একটা সমস্যা-সঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্যে কি করে টিকে থাকা সম্ভব বা বেশি দিন বরদাস্ত করা যেতে পারে সেটাই চিন্তার বিষয়।

পরিস্থিতির শিকার হয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি ইঁদুরের মতো নিঃস্ব, একেবারে গরিব হয়ে গেলাম। যাকে বলে একেবারেই কপর্দকশূন্য হয়ে গেলাম।

পরিস্থিতি আবার আমাকে এমন রক্তচক্ষু দেখাতে লাগল যে, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণের ব্যাপারটাও আমার কাছে রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠলাম। আমার ভালো লাগত না। অন্তহীন হাহাকার আর হতাশা আমাকে পেয়ে বসল।

অসহ্য! সে মুহূর্তে জীবনটা আমার কাছে একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠল। তখন আমার প্রধানতম ও একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়াল কিভাবে জীবনটাকে শেষ করে দিয়ে দুর্বিসহ অশান্তির হাত থেকে চিরদিনের মতো নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। আর একমাত্র চিন্তা আমার মাথায় ভর করল, জীবনটাকে শেষ করে দেবার সুবিধাজনক উপায় কী? একই উপায় উদ্ভাবন করতে গিয়ে তন্ময় হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে লাগলাম।

কিন্তু আপন চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকার মতো সুযোগই বা কোথায়? পাওনাদাররা আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। তারা সময় অসময়ে বাড়ি বয়ে এসে জোর তাগাদা দিতে লাগল। তাদের ঘন ঘন তাগাদায় দুদণ্ড স্থির হয়ে বসে যে জীবনটাকে খতম করে দেওয়ার কথা ভাবব, তার সুযোগ তারা দিচ্ছে কই।

পরিস্থিতি ক্রমেই আবারও দুর্বিষহ হয়ে পড়তে লাগল। পাওনাদাররা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমার বাড়িটার চারদিকে পাহারা দিতে থাকে। বাড়ির সীমানার বাইরে বেরোলেই আমাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরবে, এটাই তাদের লক্ষ্য।

পরিস্থিতি আরও একধাপ খারাপের দিকে গেল। পাওনাদাররা এগিয়ে এসে পালা করে আমার বাড়ির দরজায় বসে থেকে কড়া পাহারা দিতে লাগল। শুধু কি এ-ই? কড়া সুরে আমাকে আইনের হুমকি দিতেও ছাড়ল না। তিনটি লোক এভাবে আমাকে ভোগান্তির চরম সীমায় ঠেলে দিল। তারাই আমাকে সবচেয়ে বেশি করে উত্যক্ত করতে লাগল।

আমি যারপরনাই মনমরা হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে তাদের ওপর প্রতিশোধাত্মক জেদও আমার মধ্যে চলতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি কোনোদিন মওকা মেলে, এ তিনজনকে যদি হাতের মুঠোয় পাই, তবে এভাবে নিরবচ্ছিন্ন উৎপীড়ন এবং অপমানের প্রতিশোধ নেবই নেব। উপযুক্ত বদলা নানিতে পারলে আমার আমার দেহ-মনের জ্বালা কমবে না। সেই শুভ মুহূর্তের আশায়, পথ চেয়ে তখনকার মতো আত্মহত্যার পরিকল্পনাটাকে বাতিল করে দিলাম। ভাবলাম, দেখাই যাক না, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় কি না, আমার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির চাকা ঘোরে কিনা।

ওই তিন হতচ্ছাড়া পালা করে রোজই আমার দরজা আগলে বসে থাকতে লাগল। কিন্তু দিন কয়েক এভাবে চালাতে চালাতে তাদের উৎসাহে একটু ভাটা পড়ল। লক্ষ্য। করলাম, পাহারা দিতে দিতে তাদের একজন মাঝে মধ্যেই কোথায় চলে যায়। আমি মনে মনে ভাবলাম, এ-ই মওকা। ব্যস, আর দেরি নয়। একদিন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। তাদের চোখে ধূলো দিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মনে আমার অন্তহীন হতাশা আর হাহাকার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হতাশ মনে বিনা উদ্দেশ্যে ছোট-বড় রাস্তা আর গলি দিয়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, কেনই বা হেঁটে চলেছি কিছুই আমার জানা নেই।

বিনা উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে শেষপর্যন্ত এক সময় একটা গলির মোড়ে পৌঁছলাম। সামনের একটা বইয়ের দোকানের কাছে গিয়ে আচমকা গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

দোকানটার সামনে কয়েকটা চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হলো, খদ্দেরদের বসার জন্যই এ-আয়োজন। সে যা-ই হোক, চেয়ার যখন খালি পাওয়া গেছে তখন বসতে আপত্তি কোথায়। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে আমি তাদের একটা টেনে বসে পড়লাম। আর কেন যে হাতের কাছে যে বইটা পেলাম সেটাকে তাকের ওপর থেকে টেনে হাতে নিয়ে নিলাম বলতে পারব না।

জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ওপর লেখা একটা বই। বইটা হাতে নিয়ে একের পর এক পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দু-চারটা পাতা উলটেই বুঝতে পারলাম, বইটা ভালোই। তবে সেটা বেশি মোটা নয়, চটি।

বইটার লেখকের নাম ছাপা আছে–এনামের। তিনি বার্লিনের অধ্যাপক হতে পারেন। আর তা যদি না হন তবে এনামের কোনো ফরাসি পণ্ডিত।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এরকম ব্যাপার স্যাপার সম্বন্ধে আমার একটু-আধটু কৌতূহল দীর্ঘদিনের। আর এ-বিষয়ে অল্পবিস্তর খোঁজখবরও আমি রাখি।

কয়েকটা পাতা উলটে, অল্প সময়ের মধ্যে বইটার প্রতি আমার আগ্রহ যারপরনাই বেড়ে গেল। চোখের সামনে থেকে সরাতে তো পারলামই না, বরং বইটার মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিলাম।

দুনিয়ার অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে বইটার শেষ পাতা পর্যন্ত একবারে পড়ে শেষ করে ফেললাম। আগেই বলেছি, বইটা বেশি মোটা নয়, চটি। একবার পড়ার পর মন তৃপ্ত হলো না। আরও একবার পড়ে ফেললাম।

বইটা পড়া শেষ করে যখন হুঁস ফিরে পেলাম তখন দেখলাম শহরের বুকে চারদিকে রাতের অন্ধকার নেমে আসতে চলেছে।

বইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে আত্মস্থ হবার পর ভাবলাম, রাত হয়ে গেছে। আর এখানে বসে থাকা সমিচিন হবে না, এবার বাড়ি ফেরা দরকার। চেয়ারটার আশ্রয় ছেড়ে উঠে পড়লাম। সোজা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

আমি বাড়ির দিকে হেঁটে চলেছি বটে, কিন্তু মন আমার পড়ে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ওই চটি বইটার পাতাগুলোর মধ্যে। আর তার বক্তব্য মাথার মধ্যে অনবরত চক্কর খেয়ে চলল।

বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছলাম তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। চিন্তাক্লিষ্ট মন নিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

আলোনিভিয়ে শুয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু কিছুতেই আমার ঘুম এলো না। ঘুম তো আর আমার আজ্ঞাবাহী নয় যে, বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখ জুড়ে আসবে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ব। ঘুম তো আসার কথাও নয়, আমার মাথায় যে ভিড় করে রয়েছে গুচ্ছেরখানেক এলোমেলো আজগুবি চিন্তা। চিন্তার সে জট ছাড়াতে ছাড়াতেই রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠল।

না, ভোর হবার পর আর বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকার সম্ভব হলো না। এক লাফে অস্থির চঞ্চল মন নিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলাম।

বিছানা ছাড়ার পর আমার মানসিক অস্থিরতা চড়চড় করে বেড়ে চলল। নিজেকে সামলে-সুমলে রাখতে না পেরে খুব সকালেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সাধ্যমত লম্বা লম্বা পা ফেলে যে বইয়ের দোকানটায় হাজির হলাম। পকেট হাতড়ে পয়সা-কড়ি যা পেলাম তা দিয়ে একটা ব্যবহারিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং একটা যন্ত্র-বিজ্ঞান প্রসঙ্গে লেখা বই খরিদ করে নিলাম।

দোকানির প্রাপ্য দাম মিটিয়ে দিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে, বই দুটো বগলে নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

বাড়ি ফেরবার পর আমাকে যেন অদ্ভুত একটা নেশায় পেয়ে বসল। একটু ফুরসৎ পেলেই বই দুটোর যে কোনো একটা নিয়ে বসে পড়ি। আর তার একের পর এক পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে লাগলাম। সে যে কী নেশা তা ভুক্তভোগি ছাড়া কাউকে বুঝিয়ে বলা বা যথাযথ ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়।

দিনের পর দিন বই দুটোর পাতার মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে আমার মধ্যে অত্যাশ্চর্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য একটা ভাবান্তর ঘটতে লাগল। বুঝলাম, বই দুটোর পাতায় বহুবার চোখ বুলানোর ফলেই এ-রকমটা ঘটছে।

সত্যি বলছি, বই দুটো পর পর বেশ কয়েকবার পড়ার ফলেই একটা অদ্ভুত পরিকল্পনা আমার মাথায় খেলতে লাগল। এর পিছনে কোন শক্তির প্রভাব বেশি আমার অতিরিক্ত প্রতিভা, নাকি শয়তানের? এদের কোনটা যে আমাকে বেশি রকম প্রভাবিত করেছে তা নিশ্চিত করে আমি বলতে পারব না।

আরও একটা একেবারেই নতুনতর মতলব আমার মাথায় খেলে গেল। আমার পাওনাদারদের মধ্যে যে তিনজন এঁটুলির মতো আমার পিছনে লেগে রয়েছে, আমার। দরজায় বসে আমার ওপর কড়া নজর রেখে চলেছে তাদের আমার দলে ভেড়াবার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। ভাবলাম, তাদের আমার দলে ভেড়াব বললেই তো আর তারা সুড়সুড় করে আমার খাতায় নাম লেখাবে না। আমার প্রতি তাদের খোয়া-যাওয়া আস্থাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে তাদের সার্বিক সহানুভূতি লাভ করার চেষ্টা নিছকই পাগলের চিন্তা তাদের প্রাপ্য অর্থের কিছু-না-কিছু, অন্তত অর্ধেক হলেও ফিরিয়ে দিতে হবে।

আমি উক্ত পাওনাদার তিনজনের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার শুভবাসনা নিয়ে নিজের বসতবাটীটা বিক্রি করে দিলাম। তা দিয়ে তাদের প্রাপ্য মোট অর্থের অর্ধেক মিটিয়ে দিলাম। আর তাদের প্রতিশ্রুতি দিলাম, আমার পরিকল্পনাটা সার্থক, বাস্তবায়িত করতে পারলে অবশিষ্ট প্রাপ্য অবশ্যই মিটিয়ে দেব।

পাওনাদার তিনজন আমার কথায় আশ্বস্ত হল। আমি এবার মওকা বুঝে আমার পরিকল্পনাটাকে সফল করার কাজে তাদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা প্রার্থনা করলাম।

শিক্ষার আলোক থেকে তারা বঞ্চিত। বুদ্ধিও স্বাভাবিকভাবেই কম। তাই আমার কায়দা কৌশলে পেশ করা বক্তব্যে তারা সহজেই ঘায়েল হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, তারা রীতিমত উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে আমার প্রস্তাবটাকে স্বাগত জানাল। আর আমার মধ্যে খেলে গেল অভাবনীয় এক খুশির জোয়ার।

বহু বুদ্ধি খরচ করে এবং দীর্ঘ চেষ্টা চরিত্রের মাধ্যমে এ-দিককার একটা হিল্লে করে ফেলতে পারলাম।

এবার আমার স্ত্রীর সাহায্য-সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ল। কারণ, আমার অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি করা দরকার। সে আমাকে সার্বিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল আর তা রক্ষাও করল। তারই সহযোগিতায় আমি অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে আমার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে পারলাম।

হ্যাঁ, সে আমার কথা রেখেছে। এসব ব্যাপার স্যাপার ঘুণাক্ষরেও কারো কাছেই এতটুকু ফাঁস করেনি।

আরও টাকাকড়ি চাই। আরও কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে আমার পরিকল্পনা বাস্তবরূপ দেওয়া যে কিছুতেই সম্ভব নয়, এ-ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ। যে করেই হোক প্রয়োজনীয় অর্থ আমাকে সংগ্রহ করতেই হবে। কিন্তু উপায়? উপায় যা হোক কিছু একটা তো করতেই হবে। এতখানি এগিয়ে শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েনিশ্চেষ্ট হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এমন সুন্দর একটা পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেলে আফসোসের আর সীমা পরিসীমা থাকবে না।

আমি আবার মতলব ভাঁজতে লাগলাম, কিভাবে আরও কিছু পয়সা কড়ি জোগাড় করা যায়। এবার বিভিন্নরকম অজুহাত দেখিয়ে শীঘ্রই পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু পরিচিতজনের কাছ থেকে টাকাকড়ি হাতিয়ে জড়ো করতে লাগলাম।

এত টাকা কিভাবে, কবে শোধ করতে পারব এসব চিন্তা ভাবনা না করেই আমি সমানে ধার করে মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় করে ফেললাম।

এবার একটা-দুটো করে প্রতিটা বারো গজ মাপের মসলিনের টুকরো কিনে জড়ো করতে লাগলাম। সেগুলো ক্যাম্বিক মসলিনের টুকরো। আর বেশ কিছু পরিমাণ ভালোভাবে পাক দেওয়া দড়ি, ইয়া পেল্লাই একটা বেতের মজবুত ঝুড়ি, প্রচুর পরিমাণ রবারের বার্ণিশ, আর এমন সব জিনিসপত্র এক-এক করে জোগাড় করতে মেতে গেলাম, ইয়া পেল্লাই একটা বেলুন তৈরি করতে যা-কিছু দরকার হতে পারে।

সব জিনিসপত্র এক জায়গায় জড়ো করলাম। এবার হাত চালিয়ে জিনিসগুলো গোছগাছ করে নেওয়া দরকার। আমার স্ত্রীর ওপর এ গুরুদায়িত্বটা অর্পণ করলাম। তার ওপর আমার আস্থা পুরো দস্তুর। তবে, গোছগাছের কাজকর্ম কিভাবে সারতে হবে তা তাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম।

স্ত্রীর সাহায্যে সবকিছু গোছগাছ করার পর আমি এবার সেগুলোকে রাতের অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে, খুবই সতর্কতার সঙ্গে রটারডাম নগরের পূর্বদিকের এক নির্জন নিরালা স্থানে নিয়ে জমা করলাম।

এবার আমি পরিকল্পনামাফিক খুবই গোপনে একটা বিশেষ প্রকৃতির গ্যাস তৈরির কাজে লেগে গেলাম। সেটা এমনই এক বিশেষ প্রকৃতির গ্যাস, যা আমি ছাড়া আর কেউ-ই আজ পর্যন্ত তৈরি করেনি, করতে পারেনি। আর কিছু না হোক অন্তত এরকম কোনো কাজে অবশ্যই ব্যবহার করেনি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার সে গ্যাস তৈরির গোপন রহস্যটা আমি অনায়াসেই খোলসা করতে পারতাম। কিন্তু সে যে ন্যায়ত ধৰ্মত উচিত হবে না। কারণ সত্যি কথা বলতে কি, সে গোপন তথ্যটার মালিক আমি নিজে নই, ফরাসি দেশের এক নাগরিক। সে দেশেরনিজ শহরের অধিবাসী। আর তিনি শর্ত আরোপ করেই তথ্যগুলো আমাকে বলেছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, আমি কোন কাজে সে গ্যাস ব্যবহার করব তা না জেনেই তিনি। আমার কাছে গোপন তথ্যটা প্রকাশ করেছেন। আর তিনি আমাকে এও বলেছেন, কোনো একটা বিশেষ জানোয়ারের ঝিল্লি ব্যবহার করেও এরকম একটা বেলুন অনায়াসেই তৈরি করে নেওয়া সম্ভব।

হ্যাঁ, খুবই সত্য বটে, বিশেষ এ-জানোয়ারের ঝিল্লি থেকে তৈরি বেলুন থেকে গ্যাস কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না।

তবে ওই পদ্ধতিতে বেলুন তৈরি করতে অবশ্যই বহু অর্থ ব্যয় হয়, তা ছাড়া কাম্বিক মসলিনের ওপর রবারের আস্তরণ ব্যবহার করলেও সেটা বেলুন তৈরির কাজে একই রকম উপযোগি হবে কিনা এ ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম না।

উক্ত ঘটনাটা এখানে উল্লেখ করার কারণও আছে যথেষ্টই। কারণটা হচ্ছে, আমার বিশ্বাস যে, এমনও হতে পারে সে ভদ্রলোক ভবিষ্যতে এরকম গ্যাস ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে বেলুন তৈরি করে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করতে পারেন। আশা করি, আর খোলসা করে বলার দরকার নেই। তবুও বলছি, ভবিষ্যতে যদি এ-গ্যাস ব্যবহার করে তিনি আকাশে উড়তে আগ্রহী হন তবে আমি অবশ্যই তাকে এ-বিশেষ আবিষ্কারের খ্যাতি থেকে বঞ্চিত করতে আগ্রহী নই, করবও না।

যা-ই হোক, আমি বেলুন তৈরির কাজে মেতে গেলাম। কঠোর পরিশ্রম, নিরবছিন্ন অধ্যবসয়ায় এবংনিষ্ঠার সঙ্গে আমি কর্তব্য কর্ম সম্পাদনে লেগে রইলাম। অল্প কয়দিনের মধ্যেই আমি বাঞ্ছিত বেলুন তৈরির কাজটা সেরে ফেললাম।

বহু আকাঙ্ক্ষিত বেলুন তৈরির কাজটা সারার পর আমি যাত্রার উদ্যোগ আয়োজন করতে লাগলাম।

আমি বেলুন তৈরির ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে আরও একবার কিছু অত্যাবশ্যক কথাবার্তা সেরে নেওয়া দরকার মনে করলাম। তাকে পাশে বসিয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিলাম, যে, প্রথম দিন বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়ে হারা উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই বইয়ের দোকানে যাওয়া, বই দুটো খরিদ করা থেকে শুরু করে বেলুনটা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে যা-কিছু করেছি, সে সব কথা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখবে, কোনো অবস্থাতে সামান্যতম তথ্যও সে কারো কাছে ফাস করবে না। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, কথা দিল। কিন্তু আমাকে তার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে হল, যত শীঘ্র সম্ভব আমি তার কাছে ফিরে আসব।

আমি এবার খরচপাতি করার পর হাতে অবশিষ্ট সামান্য যা-কিছু টাকাকড়ি, স্ত্রীর হাতে দিলাম তার সংসার খরচ হিসেবে। আমার অনুপস্থিতিতে তার খাওয়া-পড়া আর তার অন্যান্য টুকিটাকি তো তাকে কিনতে হবে। আমার ঘরণীটি সত্যি খুবই কর্মঠ মহিলা। সে পারে না এমন কাজ খুব কমই আছে। আমার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই সে যাবতীয় কাজকর্ম সেরে নিতে পারে।

যাক, সংসার খরচের মতো সামান্য কিছু অর্থ হাতে তুলে দিয়ে, যত শীঘ্র সম্ভব বাড়ি ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

আমার স্ত্রী সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বিষণ্ণ মনে, কৃত্রিম হাসির রেখা মুখে ফুটিয়ে তুলে আমাকে বিদায় জানাল।

আমি পথে নামলাম।

একটা কথা স্বীকার না করে পারছি না, আমি নিজের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আমার স্ত্রী সব সময়ই আমাকে একজন সত্যিকারের কুঁড়ের বাদশা বলেই মনে করত। যদিও সে মুখ ফুটে বল না, তবু আমার বিশ্বাস, তার বদ্ধমূল ধারণা, আমার মতো গেঁতো লোক দ্বিতীয়টি নেই। আমি তার কাছে নিতান্তই একটা আপদ না হলেও বোঝাস্বরূপ তো বটেই, এক ধরনের মানুষ আছে যারা কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, মুখেন। মারিতং জগৎ–আমিও তাদেরই একজন। বসে বসে অলীক কল্পনা করা ছাড়া আমি নাকি আর কোনো কাজেরই নই।

জানি না, আমার ধারণাটা কতখানি সত্য–আমার বিশ্বাস, আমার বিদায় মুহূর্তে আমার স্ত্রীর মুখে বিষণ্ণতার কালো ছায়া নেমে এলেও মনে মনে একটু আধটু হলেও সে খুশিই হয়েছে। কারণ, এরকম একটা নিষ্কর্মার চেঁকির হাত থেকে দিন কয়েকের জন্য হলেও নিষ্কৃতি পাওয়া গেল।

স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন রাস্তায় নামলাম, তখন শহরের বুকে রাত। অন্ধকার বিরাজ করছে।

দেখলাম, আমার পাওনাদার তিনজন, এতদিন যারা আমার চক্ষুশূল ছিল, নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাকে এতদিন জ্বালিয়ে মেরেছে, তারা আমার জন্য সদর দরজায় অপেক্ষা করছে।

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাওনাদার তিনজনের সঙ্গে মিলিত হলাম। হাসিমুখে সবার সঙ্গে করমর্দন সারলাম। সহকারী হিসেবে তাদের সঙ্গে নিলাম। আসলে এখন যা-কিছু করার বাকি, যা-কিছু করতে হবে তা একার দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়। দু তিনজন সহকারী চাই-ই চাই। তাদের সঙ্গে আগেই এরকম কথাবার্তা সেরে রেখেছিলাম। তাই মূর্তিমান তিনজন সন্ধ্যা থেকেই সদর দরজায় মোতায়েন রয়েছে।

পাওনাদার তিনজনকে সহকারী হিসেবে নিয়ে মালপত্রের কাছে গেলাম। আমি আর সহকারী তিনজন, মোট চারজনে মোটর, অতিকায় বেলুন আর অন্যান্য অত্যাবশ্যক সামগ্রি নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। বড় রাস্তা না ধরে অলিগলি দিয়েই আমরা হাঁটতে লাগলাম। ঘুরপথে, একটু বেশি রাস্তা অতিক্রম করতে হলেও এটাই নিরাপদ মনে করলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের বাঞ্ছিত স্থানে পৌঁছে গেলাম। আমাদের কাজের উপযোগি সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় কাজ শুরু করতে কোনোরকম বেগ পেতে হলো না। আমরা জোরকদমে কাজে মেতে গেলাম। হাত চালিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আমরা যত শীঘ্র সম্ভব কাজটা সেরে ফেলার জন্য তৎপর হলাম।

বাতাস প্রয়োগ করে বেলুনটাকে ফোলাবার সময় ছোট ছোট পিপেগুলো যেখানে রাখব মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, সেখানে সবার নজরের আড়ালে আমি আগেভাগেই গোপনীয়তা বজায় রেখে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিলাম। এরকম সব গর্তকে পঁচিশ ফুট বৃত্তাকার ব্যাসে সাজালাম। আর পিপেটাকে বৃত্তটার ঠিক কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করার কথা। পিপেটাকে যেখানে বসানো হবে ঠিক সেখানে আর একটা অধিকতর গভীর ও ব্যাসযুক্ত একটা গর্ত খুঁড়ে ফেললাম। এবার পাঁচটা খালি পিপের মধ্যে বারুদ বোঝাই করলাম। এগুলোকে এবার গর্তগুলোর পাঁচটার মধ্যে প্রতিটাতে একটা করে ঢুকিয়ে দিলাম। এখানে বলে রাখা দরকার, প্রত্যেকটা পিপেতে পঞ্চাশ পাউন্ড করে বারুদ ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে দিলাম। ছোট ছোট পিপে ও বড়সড় পিপেগুলোকে যথাপদ্ধতিতে আচ্ছাদিত বারুদ দিয়ে যুক্ত করে দিলাম। এভাবে কাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ করার পর গর্তটাকে মাটি দিয়ে বোঝাই করে বড় পিপেটাকে তার ওপর স্থাপন করলাম। আর একটা দেশলাইয়ের কাঠির বারুদের বিপরীত মাত্র ইঞ্চিখানেক মাটির ওপর জেগে থাকে আর সেটা যেন কারো চোখে না পড়ে।

ব্যস, কিছুটা অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এবার আমি অবশিষ্ট গর্তগুলোকে ঝটপট মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে পিপেগুলোকে জায়গামতো বসিয়ে দিলাম। যাক। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হল।

সেদিনটা ছিল ১ এপ্রিল।

আগেই কথা প্রসঙ্গে বলেছি, সেটা ছিল এক ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। তার ওপর আকাশে জমাটবাধা কালো মেঘের একাধিপত্য। ফলে তারা দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই পড়ে না। আর মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, যাকে বলে ইলশেগুড়ি। এমন প্রতিকুল প্রাকৃতিক পরিস্থিতির জন্য আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারাই মহাসমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটা পদক্ষেপেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম, অভাবনীয় অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন ধৈৰ্য্য সম্বল করে আমাকে কাজটার প্রতিটা ধাপ সম্পূর্ণ করতে হচ্ছিল।

আমি কায়দা করে সহকর্মী তিনজনকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমের কাজে লাগিয়ে দিলাম। তারাও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আমার নির্দেশিত কাজে মেতে গেল। তবে তাদের কৌতূহলমিশ্রিত প্রশ্নবাণ আমাকে যারপরনাই উত্যক্ত করতে লাগল।

কাজের ফাঁকে আমার সহকর্মী তিনজনের মধ্যে থেকে একজন তো কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে আমাকে সরাসরি প্রশ্নই করে বসল–এমন হরেক আকৃতি ও প্রকৃতির যন্ত্রপাতি কোন কাজে লাগবে, দয়া করে বলবেন কি? বৃষ্টিতে এভাবে ঘণ্টর পর ঘণ্টা ভিজে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এসব কাজ করে শেষপর্যন্ত ফয়দাই বা কি হবে? এমন আরও কতসব তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নবাণে আমাকে সজাগ করে দেওয়ার জোগাড় করল।

আমার সহকর্মীদের বিরক্তি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে লক্ষ্য করে আমি ভেতরে ভেতরে খুশিই হলাম। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় তাদের বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে উঠে গেলে, তারা হয়তো আমাকে ছেড়ে যেতেই বাধ্য হবে। তাদের ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। তারা চলে গেলে আমি কম-বেশি সমস্যায়ই পড়ব।

আমি কিন্তু ভেবেই রেখেছি, আমার এ-পরিকল্পনাটাকে কোনোরকমে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারলে, উৎরে গেলে তাদের যা-কিছু প্রাপ্য প্রতিটা কানাকড়ি পর্যন্ত শোধ করে দেব। আমার আন্তরিক ইচ্ছাটার কথা তাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। তারা আমার কথায় তখনকার মতো আশ্বস্ত হল।

আমার কথার ওপর ভরসা করে নতুন উদ্যমে আমার কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে কাজে মেতে গেল। আমি এবার পুরোদ েকাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম। সে যে কী তৎপরতা তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

আমি তিন সহযোগিকে নিয়ে বেলুনটাকে ফোলানোর চেষ্টা চালাতে লাগলাম। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে সেটাকে প্রয়োজন-অনুযায়ী ফোলানো সম্ভব হল।

এবার ফোলানো বেলুনটার সঙ্গে দড়িটাকে শক্ত করে বেঁধে দিলাম, তারপর এক এক করে আমার যাবতীয় যন্ত্রপাতি–ব্যারোমিটার, দূরবীক্ষণ যন্ত্র, চৌম্বক শলাকা, কম্পাস, ইলেকট্রোমিটার, বাঁশি, পকেট-ঘড়ি, ঘণ্টা, প্রভৃতি তার মধ্যে রেখে দিলাম। কেবলমাত্র যন্ত্রপাতির কথাই বা বলি কেন? প্রচুর খাদ্যবস্তু আর পানীয় জলও গাড়িটাতে রাখলাম। খুঁটিনাটি অত্যাবশ্যক জিনিসপত্র যা-কিছু গাড়িতে নেওয়া দরকার সবকিছু গাড়িতে তোলার পর একটা মোটাসোটা বিড়াল আর একজোড়া পায়রাও গাড়িতে তুলে নিলাম।

প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়িটাকে তৈরি করতে রাত শেষ হয়ে গেল। এক সময় পূর্ব আকাশে ভোরের আলো দেখা দিল। শহরের বুকে ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে এলো।

ভাবলাম, আর দেরি নয় এবার যাত্রা শুরু করা দরকার। হাতের জ্বলন্ত চুরুটটা যেন হঠাৎ আঙুলের ফাঁক থেকে খসে পড়েছে এমন ভাব দেখিয়ে সেটাকে হাত থেকে ফেলে দিলাম।

পরমুহূর্তেই পথ থেকে চুরুটটা আমার হাতে তুলে নেবার জন্য উপুড় হবার সুযোগ পেলাম। আর এরকম চিন্তা করেই যে সেটাকে হাত থেকে ফেলে দিয়েছি তা। তো আর আর স্বীকার করার অপেক্ষা রাখে না। যাক, যে কথা বলছিলাম, চুরুটটাকে তুলে নেবার অছিলায় ছোট্ট একটা পিপের তলা থেকে সামান্য পরিমাণ বের করে রাখা। দেশলাইয়ের কাঠিটাতে আগুন জ্বেলে দিলাম।

এমনই সন্তর্পণে এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজটা সেরে ফেললাম যে, আমার তিন সহযোগি ব্যাপারটার কিছুমাত্রও টেরই পেল না। দেশলাইয়ের কাঠিটায় আগুন ধরিয়ে দেওয়ামাত্র আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত গতিতে গাড়িটায় চেপে বসলাম। গাড়িতে চেপেই ব্যস্ত হাতে গাড়ির সঙ্গে বাঁধা একমাত্র দড়িটাকে সুতীক্ষ একটা অস্ত্র দিয়ে ঘ্যাচ করে কেটে দিলাম।

ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। সে যে কী নিঃসীম আনন্দ, কী মজা, তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।

একলক্ষ পঁচাত্তর পাউন্ড বালি বোঝাই কতগুলো থলে নিয়ে অভাবনীয় দ্রুতগতিতে গাড়িটা তরতর করে ওপরে উঠে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই আমি ওপরে, একেবারে মেঘের রাজ্যে পৌঁছে গেলাম। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো আরও সমপরিমাণ বোঝা গাড়িতে চাপিয়েও অনায়েসেই ওপরে ওঠা সম্ভব হত।

ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় দেখলাম, ব্যারোমিটারে পারদ ত্রিশ ইঞ্চিতে অবস্থান করছে, আর উনিশ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেন্টিগ্রেড থার্মোমিটারের পারদ।

ওপরে ওঠার সময় একটা ব্যাপার আমাকে খুবই বিস্মিত করেছিল, গজ পঞ্চাশেক ওপরে উঠতেই একেবারেই অভাবনীয় একটা কাণ্ড ঘটে গেল। আর সেটা ঘটল মুহূর্তের মধ্যেই। অস্বাভাবিক বেগে বিশ্রি একটা কড়কড় আওয়াজ করতে করতে আমার পিছন দিক থেকে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আগুন, জ্বলন্ত কাঠকয়লা, আগুনের মতো গরম টুকরো টুকরো পাথর আর যন্ত্রটার ভাঙাচোরা টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মিলে এমন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল যে, ব্যাপার দেখে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে পড়ার জোগাড় হল। আর মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার বুকের ভেতরে ফুসফুস বুঝি কুঁকড়ে মুচড়ে গেছে। অচিরেই বুঝি তার কাজ বন্ধ হয়েনিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

আমার পক্ষে বেশিক্ষণ স্থির থাকা সম্ভব হলো না। হাঁটু দুটো তিরতির করে কাঁপতে লাগল। তারপর সর্বাঙ্গে কম্পন অনুভব করলাম পর মুহূর্তেই দুম্ করে আছাড় খেয়ে গাড়িটার তলায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, খেল খতম।

গাড়িটার তলায় পড়ে মুমূর্ষ-প্রায় অবস্থায় আমি ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটাকে নিয়ে আমি মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি করে ফেলেছি। আর তারই ফলে আমার বরাতে আরও অনেক, অনেক দুর্ভোগই রয়েছে। সেকেন্ডের মধ্যেই আমি পৌনে মরা হয়ে গেলাম। শরীরের সবটুকু রক্ত বুঝি নিঃশেষে মাথায় উঠে গেছে।

আমি হুমড়ি খেয়ে গাড়িটার তলায় পড়ে যাবার পর মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর একটা সংঘর্ষ আচমকা রাতের জমাটবাধা অন্ধকারকে খান খান করে আকাশটাকে টুকরো টুকরো করে দিল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতেই আকস্মিক বিস্ফোরণের কারণটা আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, এর জন্য আমি একমাত্র আমি, নিজেই দায়ী। আমার কাজের সামান্য হেরফেরের জন্যই এরকম অত্যাশ্চর্য, একেবারে অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটে গেল। আর এরই জন্য আমি নিজে এখন ওটার ওপর অবস্থান করছি, আর ওর হাতের মুঠোর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি।

সেখানে, গাড়িটার তলায় অসহায়ভাবে পড়ে থাকার সময় আমার মধ্যে একটামাত্র চিন্তাই ভর করল–কি করে আমি জীবনটাকে রক্ষা করতে পারব।

প্রথমে বেলুনটা ভেঙে-ছিড়ে, টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার পরমুহূর্তে শত-সহস্র টুকরোয় বিভক্ত হয়ে তীব্র বেগে চারদিকে ছড়িয়ে দিল। তারপর লাটুর চেয়েও তীব্র গতিতে চক্কর খেতে লাগল। মাতালের মতো টালমাটাল হতে হতে আমাকে আচমকা দুম্ করে ছুঁড়ে দিল। আমি বেতের ঝুড়িটায় আটকা পড়ে অভাবনীয়ভাবে শূন্যে দোল খেতে লাগলাম। আমার মুখ ঝুড়িটার বাইরে আর মাথা নিচের দিকে রেখে আমি আকাশের কাছাকাছি উঁচুতে ঝুলতে লাগলাম। কোনোক্রমে ঝুড়িটার সঙ্গে আমার যে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে, তা ছিন্ন হয়ে গেল পরিস্থিতি যে কী মর্মান্তিক হবে–উফ্! না, আর ভাবতে পারছি না। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে।

সে মুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আমি ভাগ্য গুণে কিভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম তা ভাবলে আজও আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসার জোগাড় হয়। স্নায়ু শিথিল হয়ে পড়তে শুরু করে। ব্যাপারটা হচ্ছে, অভাবনীয় উপায়ে একটা দড়ির টুকরো বেতের ঝুড়িটার গা থেকে ঝুলছিল। ফুট তিনেক লম্বা ছিল সেটা। ঠিক পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে, ঈশ্বরের অপার কৃপার জন্যই হয়তো বা সে দড়িটার সঙ্গে আমার বা পায়ের গোড়ালির কাছাকাছি একেবারেই অত্যাশ্চর্যভাবে আটকে যায়। আমি সেটার সঙ্গে লটকে গেলাম। আমার তখনকার শোচনীয় পরিস্থিতির কথা কারো কাছে ব্যক্ত করা তো দূরের কথা আমি নিজেই ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।

বাতাস। একটু বাতাস যে মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বোধ হতে লাগল। একটু বাতাসের অভাবে আমি মরিয়া হয়ে হাঁপাতে লাগলাম। মাথাটা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঝিমঝিম করতে লাগল, শরীরের সবকটা স্নায়ু, সব কটা মাংসপেশী তীব্র যন্ত্রণায় টনটন করতে লাগল। সে যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা, কী মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্যে আমি প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম তা পরমপিতা ছাড়া কারোরই জানার কথা নয়। আর ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণার সঞ্চার করা তো নিতান্তই পাগলের প্রলাপ মাত্র।

অসহ্য যন্ত্রণায় আমি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় অসহায়ভাবে কাত্রাতে লাগলাম। আমার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগল। অসহ্য! কী যে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় আমি অসহায়ভাবে ধুঁকতে লাগলাম তা আর বলার নয়।

আমার স্নায়ুগুলো ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। কেমন যেন একটা বমি বমি ভাব আমাকে পেয়ে বসল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে পড়তে লাগল। ব্যস, সংজ্ঞা হারিয়ে আমি এলিয়ে পড়লাম। আমি সংজ্ঞাহীনতার অন্ধকারের অতল গহ্বরে সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে গেলাম। অন্ধকার! নিঃসীম অন্ধকার।

দড়ির টুকরোটার সঙ্গে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কতক্ষণ যে ঝুলে ছিলাম তা বলতে পারব না। তবে অনেকক্ষণ যে ছিলাম তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এরকমটা বলার এবার বেল্প এক দুটো হাত ফিরিয়েই আশিরাগুলো ফুলে করে নখগুলো কারণ এই যে, আমি যখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম তখন পূর্ব আকাশে ভোরের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে। আর ভাঙাচোরা বেলুনটা ধীর-মন্থর গতিতে অন্তহীন সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। কাছাকাছি তো নয়ই, এমনকি যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও ডাঙার লেশমাত্রও চোখে পড়ল না।

আমি যে ভাসতে ভাসতে কোন দিকে এবং কোথায় চলেছি তার কিছুই আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতেই হয়, আমার সে অসহনীয় যন্ত্রণা, স্নায়ুবিক শৈথিল্য এবং মানসিক অস্বস্তির তীব্রতা আগের চেয়ে অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে গেছে।

এবার বেশ ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে বিচার বিবেচনা করতে লাগলাম।

একের পর এক দুটো হাতকেই ধীরে ধীরে চোখের সামনে নিয়ে এলাম। যে দুটোর দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি ফিরিয়েই আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম, দৃষ্টি থমকে গেল। দেখলাম, আমার হাতের শিরা-উপশিরাগুলো ফুলে একেবারে মোটা মোটা দড়ির মতো হয়ে উঠেছে, আর আঙুলের ডগাগুলো, বিশেষ করে নখগুলো আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে, কালসিটে পড়লে ঠিক যেমনটি হয়। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় গেল না।

মাথাটা সাধ্যমত এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালোভাবে হাত দুটোকে দেখলাম, কিন্তু তেমন ফোলেনি তো। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে।

ব্যাপারটাকে তখনকার মতো সামাল দেবার জন্য জ্যাকেটের পকেটে একটা হাত চালান করে দিলাম। হাতড়ে হাতড়ে কতগুলো ট্যাবলেট আর দাঁত-খড়কের মোড়কটাকে খুঁজলাম। না পেলাম না। মনটা হঠাৎ আরও বিষিয়ে উঠল। সত্যি ব্যাপার অবাক হবার মতোই বটে। সেটা কোথায় যে বেপাত্তা হয়ে গেল ভেবে কুল কিনারা পেলাম না।

এবার উপলব্ধি করতে পারলাম, বাপায়ের গোড়ালিতে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে।নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আর সে সঙ্গে আমার বর্তমান পরিস্থিতির একটা ধোয়াটে, ঝাপসা চেতনা অন্তরের অন্তঃস্থলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করল। আমি কিন্তু তাতে অবাক হলাম না, এমনকি ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া তো দূরের কথাসামান্যতম ভীতিও আমার মধ্যে সঞ্চারিত হলো না।

মিনিট কয়েকের মধ্যে গভীর চিন্তা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। আমি চিন্তার জগতের অতলে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম। আমি যেন এ জগতের কেউ নই, অন্য কোনো লোকে বাস করছি।

দীর্ঘ চেষ্টার পর পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করে নিতে পারলাম। তারপরই হাত দুটোকে ঘুরিয়ে পিছন দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে পাজামার ফিতের সঙ্গে আটকানো লোহার বকলেসটাকে ধীরে ধীরে খুলে ফেললাম। আমার এবারের কাজ হলো গলাবন্ধটাকে খোলার চেষ্টা চরিত্র করে সেটাকেও কোনোরকমে খুলে ফেললাম। এবার বকলেসের সঙ্গে সেটাকে আটকে দিয়ে কোমরে আচ্ছা করে জড়িয়ে দিলাম।

এবার মাংসপেশীর ওপর চাপ প্রয়োগ করে শরীরটাকে উপরের দিকে সামান্য তুলে বকলেসটাকে গাড়িটার ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। এবার সেটাকে বেতের ঝুড়ির সঙ্গে আচ্ছা করে বেঁধে দিলাম। বেতের ঝুড়িটার আর বিচ্ছিন্ন হবার কোনো সম্ভাবনা রইল না।

সে মুহূর্তে আমার শরীরটা গাড়ির সঙ্গে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে লটকে রইল।

আমি নিজেকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেবার জন্য প্রয়াস না চালিয়ে প্রায় পনের মিনিট সেভাবেই গাড়িটার সঙ্গে লটকে রইলাম। ভাবলাম, আমি তো দিব্যিই আছি, তোফা ব্যবস্থা। কিন্তু ব্যাপারটা যে বোকামি ছাড়া কিছু নয় তা অচিরেই বুঝতে পারলাম। এবার আতঙ্ক, ভয়-ভীতি হতাশা আর নিরবচ্ছিন্ন বিষণ্ণতা আমাকে পেয়ে বসল। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তখন কী যে এক অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে ফেলল, তা কাউকে বুঝিয়ে বলা তো সম্ভবই ছিল না, আসলে আমি নিজেই তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। আর এরই ফলে মানসিক স্থিরতা ও মনোবল আমার মধ্য থেকে উবে গেল। সে জায়গা দখল করল জমাট বাঁধা ভীতি আর আতঙ্ক।

ভাগ্য ভালো যে, আমার সে অভাবনীয় ভীতি আর মানসিক দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মনকে অচিরেই শক্ত করে বেঁধে ফেলা সম্ভব হল। আর এও বলে রাখা দরকার হঠাৎ জেগে ওঠা তীব্র একটা হতাশাই যেন আমাকে সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে সে বারের মতো রক্ষা করেছিল।

এবার আমি উন্মাদের মতো গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে সমস্ত শরীরটাকে অল্প অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে একটু একটু করে ওপরের দিকে তুলতে লাগলাম। এভাবে নিজেকে তুলতে তুলতে অচিরেই ঝুড়ির মুখটাকে আঁকড়ে ধরে ফেললাম। এবার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ওপরে তুলতে তুলতে এক সময় আমার প্রয়াস ফলপ্রসু করা সম্ভব হল। আর গাড়িটায় চেপেই দুম্ করে আছড়ে পড়লাম। সর্বাঙ্গ অনবরত থরথর করে কাঁপতে লাগল। মানুষের শরীর যে এভাবে কাঁপতে পারে আমার অন্তত জানা ছিল না।

গাড়িটার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আমি অনবরত কাঁপতেই লাগলাম। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো এ-কাঁপুনি বুঝি আর কোনোদিনই থামবে না। দীর্ঘ সময় কাঁপুনি অনেকটা কমে যাওয়ায় কিছুটা সুস্থবোধ করলাম।

আমি যেন এবার সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে বেলুনটাকে দেখতে লাগলাম। সেটার অবস্থা নিরীক্ষণ করে স্বস্তি পেলাম। বুঝলাম, আমার ওপর দিয়ে তুমুল ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেলেও বেলুনটার তেমন ক্ষতি হয়নি। ওটার সঙ্গে যেসব যন্ত্রপাতি আটকানো ছিল সেগুলো অক্ষতই রয়েছে। আর পাথরের কুঁচি আর বালির থলেগুলো আর খাবার দাবারও খোয়া যায়নি। মজুদই আছে।

আমি এবার পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটাকে আবার যথাস্থানে খুঁজে দিলাম। দেখলাম, দুটা বাজে।

আমার আকাশযান বেলুনটা নিয়ে তখনও দ্রুত ওপরে উঠেই চলেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যারোমিটারের দিকে তাকালাম। বুঝলাম, আমরা এখন সমতল ভূমি থেকে পৌনে চারমাইল ওপরে অবস্থান করছি।

এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, আমার পায়ের তলায় অন্তহীন উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্র অবস্থান করছে। আর তার ওপর ভাসছে। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো কালো কালো অসংখ্য বস্তু।

হাত বাড়িয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা নিয়ে চোখের সামনে ধরলাম। এবার চোখের সামনে বিশালায়তন একটা কামানবাহী বৃটিশ যুদ্ধজাহাজ ভাসছে। সেটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান করছে আর অনবরত অস্বাভাবিক দোল খাচ্ছে। হঠাৎ করে দেখে মনে হলো জাহাজটা বুঝি ঢেউয়ের তালে তালে দোল খাচ্ছে।

পায়ের তলায় সমুদ্র, মাথার ওপরে সুবিশাল নীল আকাশ আর অত্যুজ্জ্বল সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই আমার দুরবীক্ষণ যন্ত্রটার গণ্ডির মধ্যে ধরা পড়ল না।

আমি একটু স্বস্তিবোধ করায় দ্ৰ মহাজনদের আমার পরিকল্পনাটা সম্বন্ধে দু-চার কথার মাধ্যমে নতুন করে কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।

আশা করি আপনাদের মনে আছে, রটারডাম নগরে বসবাসকালে আমি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে হয়ে মরিয়া হয়ে আত্মহত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হয়েছিলাম। আর জেদটা এমনভাবে আমার মধ্যে চেপে বসে যা থেকে কোনো শক্তিই আমাকে। বিরত করতে পারবে না।

তবে প্রসঙ্গক্রমে এ-কথাও বলে রাখছি যে, দারিদ্র্যজনিত। নিরবচ্ছিন্ন হতাশা হাহাকার কিন্তু আমার মধ্যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগাতে পারেনি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি পড়লাম, উভয় সঙ্কটে। পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার সুতীব্র বাসনা, আর অন্যদিকে দুঃসহ যন্ত্রণায় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। আর এও স্বীকার না করে উপায় নেই ওই পুস্তক বিক্রেতার কাছ থেকে খরিদ করা বিশেষ বই দুটোই আমাকে পরিকল্পনাটা গ্রহণ করতে, জীবনের গতিকে অন্য পথে চালিত করতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

যাক গে, ধানাইপানাই ছেড়ে খোলসা করে বলি–বলাতে যা ঘটে ঘটুক আমার সামর্থ্য যদি শেষপর্যন্ত অব্যাহত থাকে তবে, যদি হিম্মৎ থাকে তবে আমি সুদূরবর্তী চাদে পাড়ি জমাব। চাঁদের বুকে আমি পদচিহ্ন এঁকে দেব।

আমার অকৃত্রিম বাসনার কথা তো আপনাদের কাছে খোলাখুলিই ব্যক্ত করলাম। এবার এক এক করে তুলে ধরছি আপাত দৃষ্টিতে আমার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা–অভিযানটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমি বলব, মানুষের ইতিহাসে এক তুলনাহীন চন্দ্র-অভিযানের কাহিনী। আর সে সঙ্গে আমার কাজের একের পর এক ধাপের অগ্রগতি ও ফলাফলের কাহিনী।

সমতলভূমি থেকে পৌনে চারমাইল উচ্চতার কথা তো আগেই বলে রেখেছি, ঠিক কিনা? সে পরিমাণ উচ্চতায় ওঠার পর আমার, অর্থাৎ আকাশযানটার গতি উর্ধমুখি কিনা তা বোঝার জন্য একটা পালক ছেড়ে দিলাম।

পালকটা গতি দেখে নিঃসন্দেহ হলাম, তখনও আমার আকাশযান দ্রুত উপরের দিকে ধেয়ে চলেছে।

আমার আকাশযানটা যখন দ্রুতগতিতে ওপরের দিকে ছুটেই চলেছে তখন আর মিছে বালির থলেগুলোকে ফেলে দেওয়ার দরকার নেই। বাধ্য হয়েই আমি ওকাজ থেকে বিরত হলাম।

তখন পর্যন্ত শ্বাসক্রিয়া ভালোভাবেই চালাতে পারছিলাম। কোনোরকম কষ্ট, কোনোই অস্বস্তিবোধ করছিলাম না। এমনকি মাথায়ও যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম না।

এবার ঘাড় ঘুরাতেই বিড়ালটার দিকে চোখ পড়ল। সে পা চারটি ছড়িয়ে আয়েশ করে শুয়ে। আমার খুলে রাখা কোটটার ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তবে লোলুপ দৃষ্টিতে পায়ে দড়িবাধা পায়রাগুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখায় তারা উড়ে যেতে পারছে না। গাড়ির এক সমতল জায়গায় কিছু শস্যদানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত।

পরমুহূর্তেই আবার ঝুলন্ত ব্যারোমিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। দেখলাম, ওটার পারদস্তম্ভ ইতিমধ্যেই গুটিগুটি অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। হিসাব করে বুঝতে পারলাম, আমি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ মাইল ওপরে অবস্থান করছি। আরও কত উপরের উঠতে হবে ঈশ্বরই জানেন।

পকেট-ঘড়িটায় সাতটা বাজতে বিশ মিনিট বাকী। বেলুনটা দ্রুত একের পর এক মেঘ ডিঙিয়ে অনেকগুলো মেঘের ওপরে উঠে গেল।

মেঘের রাজ্যে হানা দেওয়াই কেবল নয়, একেবারে মেঘের রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়ার ফলে আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আর অন্য কয়েকটা বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হল। কিছু যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত–একের পর এক বিকল হয়ে গেল। আর মেঘের আপ্যায়নের ফলে আমাকে পুরোপুরি কাকভেজা ভিজে যেতে হল। বাস্তবিকই এ যেন এক বিচিত্র সহাবস্থান।

সত্যি বলছি, আমার তিলমাত্র ধারণাও ছিল না যে, এত বেশি উঁচুতে মেঘের এমন অস্বাভাবিক দাপট থাকতে পারে।

পাঁচ পাউন্ড ওজনের দুটো বালির তলে পাকা ফলের মতো বেলুনটা থেকে নিচে ফেলে দিলাম। হিসাব করে দেখলাম, থলে দুটো ফেলে দেওয়ার পরও মোট একশ পঁয়ষট্টি পাউন্ড ওজনের থলে বেলুনটায় রয়ে গেছে। আর তারই জন্য ভেসে এদিক-ওদিক না গিয়ে মেঘের দাপটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেলুনটা সোজা আরও ওপরে উঠে গেল।

আচমকা একট অদ্ভুত কাণ্ডের সম্মুখীন হয়ে আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। অতর্কিত উজ্জ্বল বিদ্যুতের ঝলক অভাবনীয় দ্রুততার ঘরে আকাশের এ-প্রাপ্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আগুন জ্বেলে দিল। আলোকরশ্মি যে এত উজ্জ্বল হতে পারে এ ধারণা আদৌ আমার ছিল না। ভুলে যাবেন না, অত্যাশ্চর্য, নিতান্ত অবিশ্বাস্য এ ঘটনাটা কিন্তু রাতের অন্ধকারে ঘটেনি, দিনের বেলাতেই ঘটেছিল। আর যদি রাতের জমাট বাঁধা অন্ধকারে ঘটত তবে যে কী মনোলোভা দৃশ্যের সৃষ্টি করত তার বর্ণনা কেবল লেখনিই নয় শিল্পীর তুলিও যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারত না। সংক্ষেপে তার বর্ণনা দিলে বলতেই হয় পুরোদস্তুর অভাবনীয় দৃশ্য চাক্ষুষ করে চোখও মনকে তৃপ্ত করা যেত, সন্দেহ নেই। আবার এমনও হতে পারত, সেটা হয়তো নরকেরই কার্বনকপি।

কি হতে পারত সে কথা ছিঁড়ে দিয়ে যেটুকু চাক্ষুষ করলাম তাতেই আমার নাড়ির গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হল, শুরু হলো বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন ধুকপুকানি আর মাথার সবগুলো