- বইয়ের নামঃ ছায়াশ্বাপদ
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
ছায়াশ্বাপদ
০১.
শেষ ডিসেম্বরের এক হিমেল সন্ধ্যা। প্যাসিও প্লেসে। এসে ঢুকেছে তিন গোয়েন্দা। হেঁটে যাচ্ছে একটা পার্কের পাশ দিয়ে। এই শীতেও মৌসুমের শেষ কয়েকটা গোলাপ ফুটে আছে। পার্কের পাশে একটা আস্তরবিহীন লাল ইটের বাড়ি, সেইন্ট জুডস রেকটরি-গির্জার যাজকদের বাসভবন। রেকটরির ওপাশে ছোট্ট গির্জা, ঘষা-কাঁচের ভেতর দিয়ে আলো আসছে। ভেতরে বাজছে অর্গান, কখনও উঁচু পর্দায়। কখনও একেবারে খাদে নেমে যাচ্ছে সুর। অর্গানের শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে বাচ্চা। ছেলেমেয়েদের গলা, তালে তালে সুর করে পবিত্র শ্লোক আওড়াচ্ছে কবিতার মত।
রেকটরি আর গির্জার পাশ দিয়ে হেঁটে এসে ছিমছাম নীরব একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা, একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। বাড়িটার একপাশে রাস্তার সমতলে কয়েকটা গ্যারেজ। দ্বিতল বাড়ি, প্রতিটি জানালায় পর্দা, বদ্ধ কাঁচের শার্সি। বাইরের জগৎ থেকে নিজেদেরকে একেবারে আলাদা করে রেখেছে যেন। ভাড়াটেরা।
এটাই, বলল কিশোর পাশা, তিনশো তেরো নাম্বার, প্যাসিও প্লেস। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে হাজির হয়েছি।
গ্যারেজগুলোর ডানে পাথরের চওড়া সিঁড়ি, গেটের কাছে উঠে শেষ হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল খাকি রঙের জ্যাকেট পরা একটা লোক। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালও না, পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল।
সিঁড়িতে পা রাখল কিশোর। উঠতে শুরু করল। ঠিক পেছনেই রয়েছে মুসা আর রবিন।
হঠাৎ অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠল মুসা। লাফিয়ে সরে গেল একপাশে।
থেমে গেল কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, প্রায় উড়ে নিচে নেমে যাচ্ছে একটা কালো কিছু।
বেড়াল, সহজ গলায় বলল রবিন।
প্রায় মাড়িয়ে দিয়েছিলাম! কেঁপে উঠল মুসা। দুপাশ থেকে স্কি-জ্যাকেটের দুই প্রান্ত টেনে এনে চেন তুলে দিল। কালো বেড়াল!
হেসে ফেলল রবিন। তাতে কি? কুলক্ষণ ভাবছ নাকি?…এস।
গেটের খিলের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। ওপাশে পাথরের বিরাট চত্বর। মাঝখানে বড় একটা সুইমিং পুল, ওটা ঘিরে লোহার চেয়ার-টেবিল সাজানো। চত্বরের চারপাশে লতাগুল্মের ঝাড়।
গেট খুলল কিশোর। এই সময় জ্বলে উঠল ফ্লাডলাইট, সুইমিং পুলের ভেতরে, লতাগুল্মের ফাঁকে ফাঁকে।
এখানে কি চাই! কিশোরের প্রায় কানের কাছে কথা বলে উঠল খসখসে নাকী একটা গলা।
গেটের পাশেই বাড়ির একটা দরজা খুলে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে এক মোটাসোটা মহিলা। লাল চুল। রিমলেস চশমার ভেতর দিয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দার দিকে।
ম্যাগাজিন বিক্রি করতে এসেছ? আবার বলল মহিলা, চকলেট? নাকি সাহায্য চাইতে এসেছ ক্যানারি পাখির এতিম বাচ্চার জন্যে? তা যে-জন্যেই এসে থাক, বিদেয় হও। আমার ভাড়াটেদের বিরক্ত করা চলবে না।
মিসেস ডেনভার!
ডাক শুনে ফিরে তাকাল মহিলা। চত্বরের দিকে মুখ-করা একটা ব্যালকনি থেকে নেমে এসেছে সিঁড়ি। সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন এক বৃদ্ধ। মনে হয়, ওরাই আমার লোক।
আমি কিশোর পাশা, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। বয়েসের তুলনায় ভারিক্কি গলা, ভাবভঙ্গি। অপরিচিত কারও সঙ্গে এভাবেই কথা বলে সে। সমান্য পাশে সরে দুই সহকারীকে দেখিয়ে বলল, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড। আপনিই মিস্টার ফ্র্যাঙ্ক অলিভার?
হ্যাঁ, বললেন বৃদ্ধ। দরজায় দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকালেন। আপনাকে দরকার নেই, মিসেস ডেনভার।
বেশ! রাগ প্রকাশ পেল মহিলার গলায়। গটমট করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা।
নাকা বুড়ি, বিড়বিড় করলেন ফ্র্যাঙ্ক অলিভার। ওর ব্যবহারে কিছু মনে। কোরো না। ভেবে বোসো না, এ-বাড়ির সবাই এমনি। তা নয়। আর সবাই খুব ভাল। এস।
বৃদ্ধকে অনুসরণ করে ব্যালকনিতে উঠে এল তিন গোয়েন্দা। কয়েক ফুট দূরে দরজা। তালা খুললেন মিস্টার অলিভার। ছেলেদেরকে নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। ছাতের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে পুরানো আমলের বড় দামি ঝাড়বাতি। টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা কৃত্রিম ক্রিসমাস গাছ, চমৎকার করে সাজানো।
বস, কয়েকটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন মিস্টার অলিভার। দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেন।
ঠিক সময়ে এসেছ, বললেন বৃদ্ধ, ভাল। আর কোন কাজ নেই তো। তোমাদের? মানে, ক্রিসমাস সপ্তাটা কাটানর জন্যে অন্য কোন প্ল্যান নেই তো?
কাজ আছে, তবে সময় বের করে নিতে পারব আমরা, ভারিক্কি ভাবটা বজায় রাখল কিশোর। স্কুল খুলবে আগামী হপ্তায়। তার আগেই বেশ কিছু কাজ সেরে নিতে হবে। আপনাকে সময় দিতে পারব।
কষ্ট করে হাসি চাপল মুসা। কি কাজ, খুব ভালই জানা আছে তার। কয়েকদিন ধরেই মেরিচাচী খুব খাঁটিয়ে মারছেন তিনজনকে, লোভনীয় পারিশ্রমিক দিচ্ছেন। অবশ্যই। কিন্তু ওই একঘেয়ে কাজ আর ভাল লাগছে না তিন গোয়েন্দার। অথচ এমনভাবে বলছে কিশোর, যেন কি সাংঘাতিক জরুরি কাজ পড়ে আছে! নিজেদের দাম বাড়াচ্ছে আসলে।
তো, আবার বলল কিশোর, কি জন্যে ডেকেছেন? শুনি আগে সব, তারপর বলতে পারব, আমাদের দিয়ে সাহায্য হবে কি না।