আজ যদি আমার পক্ষে সম্ভব হত তবে আমার জীবনের শেষ অবর্ণনীয় দুঃখ যন্ত্রণা আর অক্ষমতা-অযোগ্যতার অপরাধের কাহিনী লেখনির মাধ্যমে আজই এখানে। তুলে ধরতে উৎসাহি হতাম না।
আমার জীবনের এ পর্যায়টা শেষের দিককার বছরগুলো মতো খুব বেশি রকম চাঙা করে দিয়েছিল।
এ মুহূর্তে আমার লক্ষ্য একটাই, আমার নীতিচ্যুত হওয়ার প্রথম দিকের ঘটনাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষ সাধারণত তিলে তিলে ধাপে ধাপে নিচে নামতে আরম্ভ করে, খুবই ধীরগতিতে অবনতির পথে এগিয়ে যায়, তাই না? আমার ক্ষেত্রে কিন্তু অবনতির ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার মধ্য থেকে সৎগুণাবলী একেবারে হঠাই বিচ্যুত হয়ে যায়।
খুবই নগণ্য একটা দুষ্টুমি থেকে আমি যেন দৈত্যের মতো ইয়া লম্বা একটা লাফ দিয়ে আকাশে পৌঁছাতে পারি।
হঠাৎ একেবারে হঠাই কিভাবে একটামাত্র ঘটনার মাধ্যমে চরমতম পাপ কর্মে ব্রতী হলাম–পরিণত হয়ে গেলাম জঘন্যতম পাপীতে, তা আমার বক্তব্য থেকেই
অবগত হওয়া যাবে।
মৃত্যু! নির্মম ও নিষ্ঠুর। মৃত্যু আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের ছায়া আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। একেবারেই অন্তিম মুহূর্ত।
নিতান্তই অজানা-অচেনা এ পথে পা-বাড়াবার পূর্বে আমি স্বাভাবিকভাবেই বন্ধু বান্ধবদের সহানুভূতির প্রত্যাশী হয়ে পড়লাম। তাদের কৃপার প্রত্যাশী বলতেও আমি কিছুমাত্রও কুণ্ঠিত নই।
সে মুহূর্তে আমার একটাই ইচ্ছা, আত্মজনরা জানুক এবং বিশ্বাস করুক, মানুষের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এরকম একটা ঘটনার জালে জড়িয়ে আমি নিছকই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমার একান্ত আগ্রহ, যে কাহিনী আমি রচনা করে চলেছি সেটা পড়ে সবাই জানুক, মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করুক, মানুষ যতই বড় প্রলোভনের ফাঁদে পা দিক না কেন, ইতিপর্বে কেউই এমন অসহায়ভাবে প্রলোভনের খপ্পরে পড়েনি। জীবনে এমন অভাবনীয় পতন ঘটেনি। তাই যদি হয়, তবে এজন্যই আমার মতো আর কোনো মানুষ, কোনোদিনই আমার মতো এমন দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার হয়ে তিলে তিলে দগ্ধে মরেনি?
সত্যি কি আমি এক স্বপ্নের ঘোরে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাইনি? পার্থিব জগতের উন্মাদনা সঞ্চারকারী দৃশ্য দেখার ভয় ভীতি আর রহস্যের ফাঁদে পড়েই আমার মৃত্যু আসন্ন হয়ে ওঠেনি?
আমি যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছি, অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষদের অনেকেই কল্পনার মাধ্যমে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করতে এবং উত্তেজনার শিকার হয়ে হঠাৎ-হঠাৎ কাজ করে বসতেই উৎসাহি ছিলেন। আমি কিন্তু বাল্যকালেই পূর্বসূরীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক নজির সৃষ্টি করেছি।
আমার বয়স আর গায়ে গতরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেসব প্রবণতাও উত্তরোত্তর বেড়েই গেছে। আর সে প্রবণতা বিভিন্নভাবে আমার বন্ধুবান্ধব আর সে সঙ্গে আমার নিজের অনিষ্টই ডেকে এনেছে।
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গুণাবলী আমাকে ক্রমেই খুব বেশি রকম স্বেচ্ছাচারী, পরপীড়ক আর অসংযত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলল।
আমার মতোই শারীরিক অক্ষমতা আর দুর্বল মানসিকতার জন্যই আমার বাবা-মা। চারিত্রিক বিয়গুলোকে সামলে রাখতে সক্ষম হননি। সে রকম কোনো কাজে তারা যখনই উৎসাহি হয়ে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখনই তারা নির্মমভাবে পরাজয় স্বীকার করেছেন। তবে আমি কিন্তু পরাজিত তো হইনি বরং সর্বতোভাবে জয়ী হয়েছি।
আমার পরিবারের সবার ওপর উত্তরোত্তর সাফল্য আমার কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে। আর এরই ফলে আমার প্রবর্তিত বিধানই পরিবারের কাছে আইন বলে গণ্য হয়েছে, অর্থাৎ এক বাক্যে আমার কর্তৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছে। ব্যস, আর কথা নয়, সে-বয়স থেকেই আমি হয়ে উঠলাম আমার সর্বময় কর্তা, নিজেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্তা।
এলিজাবেথের যুগের একটা পুরনো বাড়ির ছবি আমার বিদ্যালয় জীবনের প্রথম স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেটা ইংল্যান্ডের কুয়াশার চাদরে মোড়া এক গ্রাম্য পরিবেশে অবস্থিত। স্বীকার না করে পারছি না। পুরনো সে শহরটা আমার যথার্থই এক স্বপ্নরাজ্য, একটা শান্তি-সুখের আধার হিসেবে গণ্য হত।
সে বাড়িটা যে গ্রাম্য পরিবেশের নিছকই সাদামাটা একটা বাড়ি তা তো আগেই বলেছি। আরও কিছু বলতে গেলে সেটা ছিল একেবারেই অপরিকল্পিত ও রীতিমত অগোছালো। বাড়িটায় যতগুলো ঘর ছিল তার মধ্যে পড়াশুনার ঘরটাই সবচেয়ে বড় ছিল। সেটাই ছিল আমাদের পাঠশালা আর বাড়ি।
সে পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িটার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ঘরয় ছিল অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ড. ব্র্যানসবিরের থাকার ব্যবস্থা। এ ছাড়া ছাত্র জীবনের স্মৃতি আর কিই বা থাকতে পারে? সেই কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে ওঠা, চেঁচিয়ে পড়া মুখস্ত করা রাতে ঘণ্টার শব্দ হলে ঘুমিয়ে পড়া, সাময়িক অধছুটি ভোগ করা, মানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো আর খেলতে গিয়ে মাঠে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি আর পরস্পরের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, মন কষাকষি আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা–ব্যস। কিন্তু সে ঘটনার স্মৃতি করেই আমার মধ্যে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
তবুও একটা ব্যাপার আমার স্মৃতিতে আজও ছবির মতো স্পষ্ট আঁকা হয়ে রয়েছে। আমার প্রভুত্ব, আবেগ-উচ্ছ্বাস আর অত্যুৎসাহী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমি সহজেই স্কুলের বন্ধু, বিশেষ করে সহপাঠিদের নজর কেড়ে নিলাম। আর এরই জন্য অচিরেই সমবয়ী বন্ধুদের নেতা বনে গেলাম। তবে একজন বাদে। কে সে? সে ছাত্রটা আমার আত্মীয় ছিল না। অথচ তার নাম আর পদবী আর আমার নাম আর পদবী একই ছিল। তাই অন্য উপায় না থাকাতে আমি এ কাহিনীতে নিজের নাম ব্যবহার করেছি উইলিয়াম উইলসন। আর পদবীটা কল্পনা প্রসূত হলেও আমার আসল পদবীর কাছাকাছিই ছিল।