তারপর এক পা দুপা করে এগোতে এগোতে ঘরটার কেন্দ্রস্থলে হাজির হলে দেখা যাবে একটু আগে যাদের বিচিত্র জন্তু-জানোয়ার মনে হয়েছে সেগুলোই ক্রমে হরেক রকম ভৌতিক মূর্তি হয়ে আপনাকে আক্রমণ করার জন্য চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে।
ভৌতিক পরিবেশটাকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তোলা হয়েছে, ঘরের ভেতরে কৃত্রিম উপায়ে একটা তুফানের মতো তীব্র বাতাস সৃষ্টির মাধ্যমে। সে বাতাসটা পর্দাগুলোকে পিছন দিক থেকে অদ্ভুতভাবে হরদম নাচায়। আর এরই ফলে পর্দার গায়ে আঁকা ছবিগুলো যেন ভয়ঙ্কর জীবন্ত রূপ ধারণ করে অন্তরে রীতিমত ত্রাসের সঞ্চার করে। সব মিলিয়ে ঘরটার পরিবেশ এমন ভয়ঙ্কর ও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে যে ভাষার মাধ্যমে তার যথাযথ বিবরণ দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়।
এরকম পরিবেশ সম্বলিত একটা ঘরে, বাসর ঘরে, সো-র লেডিকে নিয়ে আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটা কাটল। কেবলমাত্র প্রথম রাতের কথাই বা বলি কেন? বিবাহিত জীবনের প্রথম মাসের ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহগুলো কিছুটা অস্বস্তির মধ্যেই কাটল।
দিন যতই যেতে লাগল একটা ব্যাপার আমার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল, আমার সহধর্মিনী আমার কথাবার্তা আর আচরণের হিংস্রতাকে রীতিমত ভয় করে, আমার সংস্রব থেকে দূরে দূরে থাকতেই আগ্রহী, আমার প্রতি তিলমাত্র ভালোবাসাও তার মনে নেই।
আমি কিন্তু তার রকম সকম বুঝে মর্মাহত না হয়ে বরং খুশিই হলাম? তার ওপর বিতৃষ্ণায় আমার মন ভরে উঠল। আর তা মানবসূলভ নয়, বরং নিশ্চিত করে বলা যায় দানবসূলভ।
এরকম নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল জ্বলজ্বলে লিজিয়ার স্মৃতি। উফ! কী তীব্র সে অনুতাপ জ্বালা। সেই লিজিয়া যে আমার অন্তরতমা, সবচেয়ে বেশি সোহাগিনী, রূপের আকরতন্বী তরুণি, আজ সে করবে চিরনিদ্রায় সমাহিত।
আমার প্রেয়সী, আমার দেবী লিজিয়ার পবিত্রতা, তার অতুলনীয় বিদ্যাবুদ্ধি-জ্ঞান, তার স্বর্গীয় আচরণ আর গভীর প্রেম–সবকিছু এক এক করে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে জেগে উঠে আমাকে নতুনতর এক উম্মাদনার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে চলল দূরে বহুদূরে এক মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকে।
আমি যে আফিমের নেশার কবলে পড়েছি, আত্মসমর্পণ করেছি সে আফিমের ঘোরে আমি স্বপ্নে মশগুল হয়ে পড়ি। গলা ছেড়ে আবেগ মধুর স্বরে তার নাম ধরে ডাকি। আমার আকুল স্বরে, ডাকাডাকিতে রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, আবার কখনও বা দিনের ফুটফুটে আলোয় উপত্যকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে পরিবেশটাকে রীতিমত সরগম করে তুলতাম।
আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, পরলোকগত প্রেয়সীর প্রতি আমার মনের তীব্র আকর্ষণ, একাগ্র ও ঐকান্তিক বাসনার জোরেই তাকে আবার ইহলোকে, আমার বুকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব। হায় ঈশ্বর! তাও কি কখনও সম্ভব, কোনোদিন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ হতে পারে! কি করে বা তা ঘটবে? সে যে চিরদিনের মতো ইহলোক ত্যাগ করে গেছে।
যাক, ত্রাঁসা-র লেডি রোয়েনাকে নিয়ে আমি বিবাহিত জীবন যাপন করতে লাগলাম।
বিয়ের পর প্রথম মাস পেরিয়ে আমরা দ্বিতীয় মাসে পা দিলাম। দ্বিতীয় মাসের গোড়ার দিকেই আমার সহধর্মিনী লেডি রোয়েনা ব্যানোর কবলে পড়ে বিছানানিল। অস্বাভাবিক জ্বর। জ্বরের প্রকোপে রাতগুলো ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে পড়তে লাগল। ঘুম… না, ঘুম নয়, চোখ বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে মুখ দিয়ে বার বার এমন সব আওয়াজ করে বলতে লাগল, বহু মানুষের যাতায়াতের কথা যাদের অস্তিত্ব কেবলমাত্র তার কল্পনার রাজ্যে আর ঘরটার ভৌতিক পরিবেশ ছাড়া ইহলোকের কোথাও থাকা সম্ভব নয়।
আমার সহধর্মিনী সো-র লেডি রোয়েনা-র ব্যামো ক্রমে সারতে লাগল, ভালো হয়ে উঠতে লাগল। শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সেরে উঠল।
কিন্তু সে কতদিনই বা সুস্থ থাকল। দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই সে দ্বিতীয়বার কঠিন ব্যাধিতে পড়ল। আপাদমস্তক তীব্র যন্ত্রণা বোধ করতে লাগল। ক্রমে তা যন্ত্রণার তীব্রতা বাড়তে বাড়তে তাকে অস্থির করে তুলল। এবার পাকাপাকিভাবে বিছানায় আশ্রয়নিল।
রোয়েনার শরীর তো প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল। এবার ব্যাধির আক্রমণে সে পাকাপাকিভাবে বিছানায় নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হল।
চিকিৎসক এসে রোয়েনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আঁতকে উঠলেন। দীর্ঘ পরীক্ষার মাধ্যমেও তার রোগনির্ণয় এবং নিরাময়ের উপায় হয়ে উঠল হতাশার ছাপ।
রোগের প্রকোপ ক্রমেই বাড়তে লাগল। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্নায়ুবিক বিকার বেড়ে গিয়ে মেজাজ মর্জি তিড়িক্কি হয়ে পড়ল।
এক সময় রোগীর পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে, সামান্যতম কোনো ভয়ের কারণ ঘটামাত্র সে যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে আর নানাভাবে ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে। এবার সে মাঝে মধ্যেই দারুণ চমকে উঠে বলতে লাগল, সে নাকি চাপা একটা শব্দ শুনতে পায়। ফিসফিস করে কে বা কারা প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কি যেন বলে। আর এও বলল, পর্দার আড়াল থেকে মানুষের হাঁটাচলার শব্দ শুনতে পায়। হায় ঈশ্বর! এ কী ভয়ঙ্কর কথা।
সেপ্টেম্বর মাস শেষ হতে চলল। তখন এক রাতে সে বেশ তেড়েমেরেই তার ভয়ানক অস্বস্তিকর অবস্থার কথা আমার কাছে বলল।
ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক তন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে সবেমাত্র সে জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর ভয়ে ভয়ে আমি শীর্ণ আর চকের মতো ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকালাম।