মি. বেডলো কথা বলার সময় থেকে থেকে অভাবনীয়ভাবে হেসে উঠতেন। এ হাসিটুকু তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনে করা যেতে পারে। তার সে হাসিটুকু বৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও কিন্তু মোটেই আমার বিরক্তির সঞ্চার করত না। আর তার সে হাসিতে কেমন যেন এক অবর্ণনীয় বিষণ্ণতার প্রলেপ মাখানো থাকত। গভীর বিষণ্ণতা। তাঁর চোখ দুটো ছিল বিড়ালের চোখের মতো গোলাকার আর বড়ও ছিল অস্বাভাবিক। কেবলমাত্র আকৃতির দিক থেকেই নয়, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও বিড়ালের চোখের সঙ্গে তার চোখ দুটোর সাদৃশ্য খুব বেশি করে লক্ষিত হত তা হচ্ছে–বিড়াল ও বিড়ালের মতো অন্যান্য প্রাণীর মতো আলো কমা-বাড়ার সঙ্গে চোখ দুটো ছোট-বড় হয়ে যেত। আর যদি তার মধ্যে উত্তেজনা ভর করত তবে মুহূর্তের মধ্যেই চোখের মণি দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠত। রীতিমত জ্বল জ্বল করত আর সে দুটো থেকে যে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত তা অবশ্য প্রতিফলিত আলো নয়। তবে? সূর্যরশ্মি বা মোমবাতির আলোর মতো মৌলিক আলো। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ পরিস্থিতিতে তার চোখের উভয় গোলকই একেবারেই নিষ্প্রভ-নিস্তেজ, ঝাপসা আর অস্পষ্ট। সে দুটোর দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘদিন ধরে কবরস্থ থাকা মৃত ব্যক্তির চোখের কথা মনের কোণে উঁকি মেরে উঠত। সত্যি তার চোখ দুটোর দিকে তাকালেই সর্বাঙ্গে যেন কেমন একটা অব্যক্ত কম্পন অনুভব করতাম। আর আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে যেত।
আমার সঙ্গে দেখা হলে ভদ্রলোক কথা প্রসঙ্গে বহুবারই নিজের চেহারার এসব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করে আফশোস করেছেন। ক্ষোভপ্রকাশও কম করেননি। তারপর দীর্ঘসময় ধরে ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছেন। আমি তার কথা কতখানি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি আর কতখানিই বা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি যাচাই করে উঠতে পারিনি, তার ধারণা নিতেও চেষ্টার ত্রুটি করতেন না।
সে ভদ্রলোকের সব কথা ধৈর্য্যের সঙ্গে শুনে ও বিচার বিশ্লেষণ করে আমি এ সিদ্ধান্তইনিতাম যে, তিনি দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে আমার মধ্যে যে ধারণা সঞ্চার করতে চাইতেন তা সংক্ষেপে অর্থাৎ সারমর্ম বললে এরকম দাঁড়ায়–আজ আমি তার চেহারা যেমন দেখছি, তিনি কিন্তু চিরদিন হুবহু এমনটা ছিলেন না। তার আগেকার চেহারা ছবির সঙ্গে আজকের চেহারার সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি। আর কারণস্বরূপ তিনি যা আমার কাছে ব্যক্ত করেছেন তা হচ্ছে–একের পর এক বহু স্নায়ুবিক রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে আজ তার এ হাল হয়েছে। তবে এও সত্য যে, তিনি কিন্তু রোগব্যাধি সম্বন্ধে কোনোদিনই উদাসীন ছিলেন না। তিনি অতীতের দীর্ঘদিন টেম্পলটন নামক কোনো এক চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক নাগাড়ে দীর্ঘদিন ধরে হরেকরকম রোগের চিকিৎসা তিনি করেছেন।
ডা. টেম্পলটনের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয় সবরাটোগেতে। তার বয়স তখন সত্তর বছর। প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই তিনি ডাক্তারের কাছে নিজের দৈহিক সমস্যার কথা খোলাখুলি বলতে অনুরোধ করেন, তিনি সুচিন্তিত চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর রোগমুক্তি ঘটলে যারপরনাই বাধিত হবেন। তাঁর অমায়িক সহজ সরল ব্যবহার ও মধুর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে ডা. টেম্পলটন তার চিকিৎসা করতে সম্মত হন।
ডা. টেম্পলটন এবার প্রভূত বিত্ত সম্পদের অধিকারী বেডলোর চিকিৎসায় হাত দিলেন। দিন কয়েক চিকিৎসা করার ফলে তিনি আশাতীত ফল পান।
এবার ডা. টেম্পলটন টাকার কুমির বেডলোর সঙ্গে একটা পাকাপাকি চুক্তি করার প্রয়োজন বোধ করলেন। সে চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল, কি পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি তার চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তারা স্থির সদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেন। চুক্তির শর্ত হল–বার্ষিক মোটা অর্থের বিনিময়ে তিনি একমাত্র এ পঙ্গু লোকটার চিকিৎসায় নিজেকে লিপ্ত রাখবেন। নিঃস্বার্থভাবে বা অর্থের বনিময়ে কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি অন্য কারো চিকিৎসাই করতে পারবেন না।
ডা. টেম্পলটন যৌবনে একজন পর্যটক ছিলেন। দেশভ্রমণ করা নেশা ছিল তার, রক্ত মাংস মজ্জার সঙ্গে মিশেছিল। আর এক সময় তিনি যখন প্যারিসে বাস করতেন তখন মেসমারের দলের সঙ্গে মিশে যান। তাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান।
বর্তমানে ডা. টেম্পলটন তীব্র ব্যথা বেদনার উপশম ঘটানোর জন্য চুম্বকঘটিত ওষুধই ব্যবহার করেন।
ধনকুবের বেড়লো ডা. টেম্পলটনকে দিয়ে চিকিৎসা করানো সুবাদে কথা প্রসঙ্গে তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতির গুপ্তকথা জানতে পারলেন। আর মৈসুরিক গবেষণা, ভাবনা চিন্তা থেকে ওষুধগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর প্রতি তাঁর আস্থা অনেকাংশে বেড়ে গেল। তবে এও সত্য যে, তিনি তার নতুন ছাত্রটার মধ্যে নিজের ভাবনা চিন্তা সঞ্চারিত করতে, পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে দিনের পর দিন প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। তারপর শেষপর্যন্ত দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে সম্মত করতে পারলেন। বেডলো এবার ডা. টেম্পলটনের ওপর পুরোপুরি আস্থাবান হয়ে উঠলেন।
তারপর থেকে রোগ নিরাময়ের বিভিন্ন কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে ডা. টেম্পলটন এবং বেডলোর মধ্যে একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যায়। আর এভাবেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। আমি কিন্তু এমন কথাও বলছি না যে, উভয়ের বোঝাপড়া সহজ-সরল ঘুম-পাড়ানি ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও বিস্তার, লাভ করেছিল। তবে এও খুবই সত্য যে, সে-শক্তিটাই খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।