বিখ্যাত চারজন ব্যক্তিত্বকে প্রেমিক হিসেবে পেলেও হে’লা কামিল এখনও বিয়ে করেননি। স্বামী-সন্তান তার কাছে অনভিপ্রেত। দীর্ঘমেয়াদি কোনো কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়াটাকে তিনি ভালো চোখে দেখেন না। ব্যালের টিকিট কাটার মতোই তার কাছে ভালোবাসার আনন্দ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী।
কায়রো শহরেই মানুষ হয়েছেন, মা স্কুলশিক্ষয়িত্রী ছিলেন, বাবা ছিলেন ছায়াছবি নির্মাতা। বাড়ি থেকে সাইকেলে আসা-যাওয়া করা যায়, এমন দূরত্বে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের স্কেচ আর খননকাজে কেটেছে তার কৈশোরের অবসর সময়। অত্যন্ত পাকা রাঁধুনি, ছবি আঁকতে পারেন, ভালো গান জানেন, আর রয়েছে মিসরীয় প্রত্নতত্ত্বেও ওপর একটা পিএইচডি। প্রথম চাকরি করেন মিসরের মিনিস্ট্রি অব কালচারে, রিসার্চার হিসেবে। পরে ডিপার্টমেন্টাল হেড হন। তারপর তথ্যমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট মুবারকের নজরে পড়লে তাকে জাতিসংঘের সাধরণ সভায় মিসরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন তিনি। পাঁচ বছর পর জাতিসংঘের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয় তাকে। এক বছর পর তদানীন্তন মহাসচিব দ্বিতীয় দফার জন্য নির্বাচিত হতে না চাওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিবের পদটার জন্য বাছাই করা হয় হে’লা কামিলকে। তাঁর সামনে লাইনে আর যারা ছিলেন তাঁরা কেউ দায়িত্ব গ্রহণে রাজি না হওয়াতেই এই সুযোগটা পেয়ে যান তিনি।
কিন্তু সব কিছু এলোমেলো করে দিতে চাইছে তার দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে তিনিই হবেন জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব, যার কোনো দেশ নেই।
একজন এইড এগিয়ে এসে তার কানে কানে কিছু বলল। মাথা ঝাঁকিয়ে সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে একটা হাত তুললেন তিনি। আমাকে বলা হলো, প্লেন টেক-অফ করার জন্য তৈরি, স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বললেন তিনি। আমি আর একজনের প্রশ্নের উত্তর দেব।
সাথে সাথে কয়েক ডজন হাত উঁচু হলো, চারদিক থেকে ছুটে এল অসংখ্য প্রশ্ন। দোরগোড়ার কাছে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের দিকে হাত তুললেন হে’লা কামিল, ভদ্রলোকের হাতে একটা টেপ রেকর্ডার রয়েছে।
লেই হান্ট, ম্যাডাম কামিল। বিবিসি থেকে। আখমত ইয়াজিদ যদি নাদাভ হাসানের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন, আপনি কি দেশে ফিরে যাবেন?
আমি একজন মিসরীয় এবং মুসলিম। আমার দেশের সরকার, তা সে যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, যদি চায় আমি দেশে ফিরি তাহলে অবশ্যই ফিরব।
এমনকি আখমত ইয়াজিদ আপনাকে পাপিষ্ঠা ও বেপর্দা মেয়েলোক বলে ঘোষণা করার পরও?
হ্যাঁ, শান্তভাবে জবাব দিলেন হে’লা কামিল।
যদি আয়াতুল্লাহ খোমেনির অর্ধেক পাগলামীও থাকে তার মধ্যে, আপনার দেশে ফেরা মানে আত্মহত্যা করা হতে পারে। কোনো মন্তব্য করবেন?
নিরুদ্বিগ্ন হাসির সাথে মাথা নাড়লেন হে’লা কামিল। এবার আমাকে যেতে হয়। ধন্যবাদ।
সিকিউরিটি গার্ডদের একটা বৃত্ত বোর্ডিং র্যাম্পের দিকে নিয়ে চলল তাকে। তার এইডরা আর ইউনেস্কোর বড়সড় প্রতিনিধিদলটা আগেই আসন গ্রহণ করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের চারজন পদস্থ কর্মকর্তা প্যান্টিতে শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে বসেছেন, নিচু স্বরে আলাপ চলছে। বাতাসে জেট ফুয়েল আর বিফ ওয়েলিংটন-এর গন্ধ ভাসছে।
জানালার ধারে একটা শসোফায় বসে সিট বেল্ট বাঁধলেন তিনি। জুতা খুললেন, হেলান দিলেন সোফায়, চোখ বুজলেন। তাকে তন্দ্রায় ঢুলতে দেখে কফি নিয়ে এসেও ফিরে গেল একজন স্টুয়ার্ডেস।
.
জাতিসংঘের চার্টার ফ্লাইট একশো ছয় রানওয়ের শেষ মাথায় চলে এল। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে টেকঅফ-এর অনুমতি পাবার পর থ্রাস্ট লিভার সামনে ঠেলে দিল পাইলট, ভেজা কংক্রিটের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল বোয়িং সেভেন-টু-জিরো/বি, হালকা কুয়াশার ভেতর উঠে পড়ল আকাশে।
সাড়ে দশ হাজার মিটার উঁচুতে উঠে এল প্লেন, অটোপাইলট এনগেজ করল ডেইল লেমকে। সিট বেল্ট খুলে সিট ছাড়ল সে। প্রকৃতির ডাক, বলে কেবিনের দরজার দিকে এগোল।
সেকেন্ড অফিসার অর্থাৎ প্রকৌশলী সোনালি চুল ভরা মাথাটা ঝাঁকাল, ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে চোখ না তুলেই হাসল একটু। নিশ্চিন্ত মনে সাড়া দিয়ে আসুন, আমি তো আছি।
পাল্টা হেসে প্যাসেঞ্জার কেবিনে বেরিয়ে এল পাইলট। একটু পরই খাবার পরিবেশন করা হবে, তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টরা। বিফ ওয়েলিংটন-এর গন্ধে জিভে জল এসে গেল লেমকের। হাত-ইশারায় রুবিনকে একপাশে ডাকল সে।
আপনাকে কিছু দেব, ক্যাপটেন?
শুধু এক কাপ কফি, বলল ডেইল লেমকে। তবে ব্যস্ত হয়ো না, আমি নিজেই নিতে পারব।
না, ঠিক আছে। প্যানট্রিতে ঢুকে কাপে কফি ঢালল।
শোনো হে।
স্যার।
কোম্পানি থেকে বলা হয়েছে, সরকার পরিচালিত একটা আবহাওয়া গবেষণায় আমাদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে। লন্ডন থেকে আমরা যখন আটাশ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকব, দশ মিনিটের জন্য পনেরো হাজার মিটারে নামিয়ে আনব প্লেনটাকে-বাতাস আর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হবে। তারপর আবার স্বাভাবিক অলটিচ্যুড-এ উঠে যাব। ঠিক আছে?
বিশ্বাস করা কঠিন যে কোম্পানি রাজি হয়েছে। বাপরে বাপ, কী পরিমাণ ফুয়েল নষ্ট হবে ভেবে দেখেছেন, স্যার?
ভেবেছ ম্যানেজমেন্টের টপ বাস্টার্ডরা ওয়াশিংটনে মোটা একটা বিল পাঠাবে না?