শক্ত প্যাকেট করা মোটাসোটা একটা জিনিসের গায়ে খোঁচা মারল দ্বিতীয় এজেন্ট। আরে, এখানে এটা আমরা কী দেখছি? মুখ তুলল সে, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। এয়ারলাইন পাইলটরা কবে থেকে প্যারাসুট নিয়ে প্লেনে উঠছে?
হাসল ডেইল লেমকে। স্কাইডাইভিং আমার হবি। ছুটি পেলেই জাম্প করার জন্য বন্ধুদের সাথে ক্রয়ডনে চলে যাই।
আপনি নিশ্চয়ই একটা জেটলাইনার থেকে লাফ দেয়ার কথা ভাবেন না?
পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উড়ছে, নিচে আটলান্টিক, গতিবেগ পাঁচশো নট-না! আতকে ওঠার ভান করল পাইলট।
সন্তুষ্ট হয়ে পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল এজেন্টরা। ডাফল ব্যাগ বন্ধ করা হলো, ফিরিয়ে দেয়া হলো আইডিকার্ড। আপনাকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য দুঃখিত, ক্যাপটেন লেমকে।
আলাপটা আমি উপভোগ করেছি।
হ্যাভ আ গুড ফ্লাইট টু নিউ ইয়র্ক।
থ্যাঙ্ক ইউ।
প্লেনে চড়ল ডেইল লেমকে সরাসরি ককপিটে চলে এল। দরজা বন্ধ করে কেবিনের আলো নিভিয়ে দিল সে, এয়ারপোর্ট ভবনের জানালা থেকে কেউ যাতে তাকে দেখতে না পায়। ভালো করে রিহার্সেল দেয়া আছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া জড়তাহীন। সিটগুলোর পেছনে হাঁটুগেড়ে বসল সে, পকেট থেকে ছোট একটা টর্চ বের করে খুলে ফেলল ট্র্যাপ-ডোরের ঢাকনি। ককপিটের নিচে ইলেকট্রনিকস বেতে পৌঁছানোর পথ এটা, কবে কে জানে কোনো এক ভঁড় ওটার নাম দিয়েছে হেল হোল। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর মইটা নামিয়ে দিল সে। এই সময় ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টদের চাপা গুঞ্জন ভেসে এল, তার সাথে লাগেজ টানা-হাচড়ার শব্দ। মেইন কেবিনটাকে আরোহীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। ট্র্যাপ-ডোর দিয়ে খানিকটা নিচে নামল সে, ডাফল ব্যাগটা টেনে নিল। নিচে নেমে এসে পেনলাইটটা জ্বালল সে। হাতঘড়ি দেখে বুঝলো, ফ্লাইট ক্রুদের পৌঁছানোর আগে তার হাতে সময় আছে পাঁচ মিনিট। প্রায় পঞ্চাশবার অনুশীলন করেছে, প্রতিটি কাজ দ্রুত নিখুঁতভাবে সারতে অসুবিধা হলো না। ফ্লাইট ক্যাপের ভেতর শুকিয়ে নিয়ে আসা মিনিয়েচার টাইমিং ডিভাইসটার সাথে অ্যাকটিউয়েটরটা সংযুক্ত করল। জোড়া লাগানো ইউনিটটা ছোট একটা দরজার কজায় আটকে দিল। এই দরজা শুধু মেকানিকরা ব্যবহার করে। এরপর প্যাকেট থেকে প্যারাসুটটা বের করল সে।
ফাস্ট ও সেকেন্ড অফিসার এসে দেখল, তাদের ক্যাপটেন ডেইল লেমকে পাইলফের সিটে বসে আছে, মুখটা এয়ারপোর্ট ইনফরমেশন ম্যানুয়্যাল-এর আড়ালে। স্বাভাবিক কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই তারা রুটিন চেকে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কো পাইলট বা প্রকৌশলী, দু’জনের কেইউ খেয়াল করল না যে অন্যান্যবারের চেয়ে তাদের ক্যাপটেন আজ বেশ চুপচাপ ও নির্লিপ্ত। তারা যদি জানত এটাই তাদের জীবনের শেষ ফ্লাইট, তাহলে কি হতো বলা যায় না। অন্তত তাদের দৃষ্টি আর অনুভূতিগুলো যে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভিআইপি লাউঞ্জে চোখ-ধাঁধানো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর ঝক ঝাক মাইক্রোফোনের দিকে মুখ করে রয়েছেন হে’লা কামিল। মনের অবস্থা যাই হোক, দৃঢ় ও ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, ধৈর্যের প্রতিমূৰ্তি, অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গোটা ইউরোপজুড়ে ঝটিকা সফর শেষে নিউ ইয়র্কে ফিরছেন হে’লা কামিল, সরকারপ্রধানদের সাথে বিরতিহীন কথা বলেছেন, কিন্তু সে ব্যাপারে খুব কম প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হলো তাকে। মৌলবাদী ধর্মীয় নেতারা তাঁর দেশের সরকারকে উৎখাত করার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছে সে সম্পর্কে তার মতামত জানতে চায় সবাই।
মিসরে এই মুহূর্তে ঠিক কী ঘটছে ভালো ধারণা নেই হেলা কামিলের। মৌলবাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আখমত ইয়াজিদ, ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও আইন সম্পর্কে সে একজন পণ্ডিত। গোটা মিসরে ভয়াবহ ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে লোকটা। অধিকারবঞ্চিত লাখ লাখ গ্রামবাসী, যারা নীল নদের তীরে বসবাস করে, আর কায়রো শহরের বস্তিবাসী, যারা মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের মনে কুসংস্কার আর হিংসার আগুন ভালোভাবেই জ্বলতে পেরেছে সে। আর্মি আর এয়ারফোর্সের বড় বড় অফিসাররা কোনো রকম রাখঢাক না করে মৌলবাদীদের সাথে সলাপরামর্শ করছে। কীভাবে সদ্য নির্বাচিত নতুন সরকারপ্রধান নাদাভ হাসানকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তের বিবরণ হে’লা কামিল পাচ্ছেন না। কাজেই স্পষ্ট করে কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
দাঁড়ানোর বা কথা বলার ভঙ্গিতে যতই দৃঢ়তা থাকুক, মনে মনে ভীষণ অসহায় ও নিঃসঙ্গ বোধ করছেন তিনি।
এতই সুন্দরী তিনি, যেন রানী নেফারতিতির পুনর্জন্ম হয়েছে। বার্লিন মিউজিয়ামে রানীর যে পোর্টেটি আছে, একই ভঙ্গিতে পোজ দিলে হে’লা কামিল নিঃসন্দেহে উতরে যাবেন। দু’জনেরই মরালগ্রীবা, সরু নাক-আয়ত চোখ, তীক্ষ্ণ মুখাবয়ব-একবার দেখলে ভোলা যায় না। বয়স বিয়াল্লিশ বলা হলেও তাঁকে দেখে তা মনে হয় না। একহারা গড়ন। কালো চোখ। রেশমের মতো কালো চুল কোমর ছাড়িয়েছে। নারীজাতির সমস্ত সৌন্দর্য যেন তার ওপর ঢেলে দেয়া হয়েছে। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা তিনি। এই মুহূর্তে ভাজবহুল স্কার্ট আর কোট পরে আছেন, কোটটার ডিজাইন শুধু তাঁর জন্য করা হয়েছে প্যারিসের বিখ্যাত একটা ডিজাইন সেন্টারে।