ওদিকে তক্তার ওপর শুয়ে দ্রুত হাত চালাচ্ছেন ভেনাটর পানিতে, মরিয়া হয়ে জাহাজটার কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করল তাকে। স্রোত আর বাতাস বাণিজ্য জাহাজটাকে আরও দূরে সরিয়ে নিল।
নাবিকদের উদ্দেশে চিৎকার করলেন ভেনাটর, একটা হাত তুলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। নাবিকদের একটা দল আর ছোট্ট একটা মেয়ে, পাশে কুকুর নিয়ে, জাহাজের পেছন দিকের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, সবাই তারা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে, জাহাজ ঘুরিয়ে তাকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই তারা করছে না। ভাটির দিকে এগিয়ে চলল জাহাজ, যেন ভেনাটরের কোনো অস্তিত্বই নেই।
ওরা তাকে ফেলে যাচ্ছে, ভেনাটর উপলব্ধি করলেন। কেউ তাকে উদ্ধার করবে না। তক্তার ওপর ঘুষি মারলেন তিনি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠলেন, স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছেন ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করেছেন। অবশেষে তিনি ঘাড় ফিরিয়ে তীরের দিকে তাকালেন।
যুদ্ধ শেষ। দুঃস্বপ্নের মতোই নেই হয়ে গেছে সব কিছু।
.
প্রথম পর্ব – নেবুলা ফ্লাইট ১০৬
১২ অক্টোবর, ১৯৯১। হিথরো এয়ারপোর্ট, লন্ডন।
০১.
ভিআইপি লাউঞ্জের ভেতর থেকে বাইরে উপচে পড়েছে ফটোগ্রাফার আর সাংবাদিকদের ভিড়টা। ভিড়ের কিনারা দিয়ে এগোলেও কেউ লক্ষ করল না পাইলটকে। চৌদ্দ নম্বর গেটের ওয়েটিং রুমে আরোহীরা অপেক্ষা করছে, তারাও কেউ খেয়াল করল না যে ব্রিফকেসের বদলে একটা ডাফল ব্যাগ রয়েছে লোকটার হাতে। মাথা সামান্য নিচু করে, চোখের দৃষ্টি নাক বরাবর সামনে, হন হন করে হেঁটে এল সে। বিশ-পঁচিশটা টিভি-ক্যামেরা সচল হয়ে রয়েছে, সতর্কতার সাথে সব কয়টাকে এড়িয়ে গেল। অবশ্য ক্যামেরাগুলোর লক্ষ্য লম্বা এক সুন্দরী। পালিশ করা চকচকে সোনার মতো রং তার গায়ের। আয়নার মতো মসৃণ। কয়লা-কালো চোখ দুটো একাধারে আদেশ ও আবেদন, দুটো ভাব প্রকাশেই সক্ষম। ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক আর সিকিউরিটি গার্ডদের ভিড়টা তাকে ঘিরেই।
ঘেরা বোর্ডি র্যাম্প বেয়ে উঠে এল পাইলট, সাদা পোশাক পরা দু’জন এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি এজেন্ট তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ছ্যাৎ করে উঠল লোকটার বুক, মাত্র কয়েক ফুট দূরে প্লেনের দরজা, কিন্তু মাঝখানে গার্ড দু’জনকে মনে হলো নিরেট পাঁচলি। সহজভঙ্গিতে একটা হাত নেড়ে কাঁধের মৃদু ধাক্কায় তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করল সে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি লেগে রয়েছে। কিন্তু কাজ হলো না, একটা হাত শক্ত করে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। এক মিনিট, ক্যাপটেন।
থামল পাইলট, মুখে হাসি আর চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল সে, যেন তাকে বিব্রত করায় কৌতুক বোধ করছে সে। তার চোখের রং জলপাই আর খয়ের মেশানো, দৃষ্টি যেন অন্তর ভেদ করে যায়। নাকটা কয়েকবারই ভেঙেছে। ডান চোয়ালে সরু একটা কাটা দাগ। ক্যাপের নিচে কাঁচাপাকা ঘোট করে ছাঁটা চুল আর মুখের ভাঁজ দেখে বোঝা যায় পঞ্চাশের ওপরই হবে বয়স। লম্বায় সে ছয় ফুট দুইঞ্চি, মোটাসোটা, তবে ভুঁড়িটা বয়সের তুলনায় এখনও ছোটই। ইউনিফর্মের ভেতর কাঠামোটা ঋজু। দেখে মনে হবে, আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার জেট চালায় এমন দশ হাজার এয়ারলাইন পাইলটদেরই একজন সে।
ব্রেস্ট পকেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে একজন এজেন্টকে দিল লোকটা। এট্রিপে বোধহয় ভিআইপি কেউ যাচ্ছেন?
কড়া ভাঁজের স্যুট পরা ব্রিটিশ গার্ড মাথা ঝাঁকাল। জাতিসংঘের একটা দল নিউ ইয়র্কে ফিরে যাচ্ছে। ওদের সাথে নতুন সেক্রেটারি জেনারেলও আছে।
হে’লা কামিল?
হ্যাঁ।
এ কি কোনো মেয়েলোকের কাজ!
মার্গারেট থ্যাচার বেলায় সেক্স কোনো বাধা হয়ে দেখা দেয়নি।
তা অবশ্য। কথাটায় যুক্তি আছে।
হে’লা কামিলের মতো বিচক্ষণ, এমন পুরুষই বা আপনি কজন পাবেন? দেখবেন, চমৎকার চালিয়ে নেবেন উনি।
মৃদু শব্দে হাসল পাইলট। তবে কথা কী জানেন, তার নিজের দেশের মুসলিম ধর্মান্ধরা তাকে বাঁচতে দিয়ে হয়। কথার সুরেই বোঝা গেল, পাইলট আমেরিকান।
আইডি কার্ডের ফটো থেকে চোখ তুলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ব্রিটিশ সিকিউরিটি এজেন্ট, তবে কোনো মন্তব্য করল না। ফটোর দিকে আবার চোখ রেখে নামটা শব্দ করে পড়ল, ডেইল লেমকে।
কোন সমস্যা?
না, যাতে না হয় সে চেষ্টা করছি, ভারী গলায় বলল গার্ড।
হাত দুটো শরীর থেকে দূরে সরালো ডেইল লেমকে। আমাকে কি সার্চও করা হবে?
দরকার নেই। একজন পাইলট কেন তার নিজের প্লেন হাইজ্যাক করতে যাবে? তবে আপনার কাগজপত্র চেক না করে উপায় নেই, আপনি সত্যি ক্রুদের একজন কি না জানতে হবে।
ইউনিফর্মটা আমি ফ্যাশন শোতে দেখাব বলে পরিনি।
আমরা আপনার ব্যাগটা দেখতে পারি?
কেন নয়, বলে ব্যাগটা মেঝেতে রেখে খুলল পাইলট।
ফ্লাইট অপারেশনস ম্যানুয়ালগুলো তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল দ্বিতীয় এজেন্ট তারপর একটা মেকানিকাল ডিভাইস বের করে নেড়েচেড়ে দেখল, সাথে ছোট আকৃতির হাইড্রলিক সিলিন্ডার রয়েছে। কিছু যদি মনে করেন, এটা কী বলবেন?
অয়েল-কুলিং ভোর-এর জন্য ওটা একটা অ্যাকটিউয়েটর আর্ম। খোলা অবস্থায় আটকে গেছে। কেনেড়িতে আমাদের মেইন্টেন্যান্সের লোকেরা অনুরোধ করেছে আমি যেন হাতে করে নিয়ে যাই, কেন নষ্ট হলো ভালো করে বুঝে দেখা দরকার।