নিষ্ফল রাগে হাত দুটো শক্ত মুঠো করে দাঁড়িয়ে থাকলেন ভেনাটর। সহস্র বছরের জ্ঞান আর শিল্পকর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে যাচ্ছে বলে তাঁর সেই আগের দৃঢ় বিশ্বাস কর্পূরের মতো উবে গেছে মন থেকে।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ফেরালেন ভেনাটরন, দেখলেন তাঁর দিকে ফিরে সকৌতুকে হাসছে সেভেরাস।
চিরকালের আশা ছিল মারা যাব, বলল সেঞ্চুরিয়ান, কোলের ওপর সুন্দরী মেয়ে আর হাতে মদের পাত্র নিয়ে।
কে কীভাবে মরবে তা শুধু ঈশ্বরই বলতে পারেন, অস্পষ্টস্বরে বললেন ভেনাটর।
আমি বরং বলব ভাগ্যের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
এত পরিশ্রম, এত সময় ব্যয়, সব বৃথা গেল!
অন্তত আপনার জিনিসগুলো নিরাপদে লুকানো থাকল, বলল সেভেরাস। কেউই পালাতে পারেনি তা তো নয়। নাবিকরা সাম্রাজ্যের সেরা পণ্ডিতদের জানিয়ে দেবে এখানে কী করেছি আমরা।
না, বললেন ভেনাটর। কেউ তাদের রূপকথা বিশ্বাস করবে না। ঘাড় ফিরিয়ে পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালেন তিনি, ওগুলো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।
আপনি সাঁতার জানেন?
সেভেরাসের ফিরে এল ভেনাটরের দৃষ্টি। সাঁতার?
আমার সেরা পাঁচজন লোককে আপনার সাথে দিচ্ছি। অসভ্যদের মাঝখানে দিয়ে পথ করে দেবে ওরা। সাঁতার জানলে জাহাজটায় আপনি পৌঁছবার চেষ্টা করতে পারেন।
আমি…আমি ঠিক জানি না।…পানির দিকে তাকালেন ভেনাটর, নদীর কিনারা আর জাহাজের মাঝখানে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।
পোড়া একটা কাঠ ভেলা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, ঝঝের সাথে বলল সেভেরাস। যা করার তাড়াতাড়ি করুন। সবাই আমরা আমাদের ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাব আর কিছুক্ষণের মধ্যে।
তোমাদের কী হবে?
লড়ার বা দাঁড়বার জন্য ঢালের এই মাথাটা কী?
সেনটিউরিয়ানকে আলিঙ্গন করলেন ভেনাটর। ঈশ্বর তোমার সঙ্গে থাকুন।
তারচেয়ে বরং আপনার সাথে হাঁটুন তিনি। ঝট করে সৈনিকদের দিকে ঘুরল সেভেরাস, প্রায় অক্ষত পাঁচজন শক্তিশালী লোককে বাছাই করল, নির্দেশ দিয়ে বলল, নদীর কিনারা পর্যন্ত ভেনাটরের পথ নির্বিঘ্ন করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে হবে তাদেরকে প্রয়োজনে প্রাণ দিতে হবে। তারপর বাকি সৈনিকদের নিয়ে নতুন করে ছোট্ট একটা ঝাক তৈরি করল। অসম যুদ্ধের শেষাংশে অভিনয় করার জন্য।
পাঁচজন সৈনিক ভেনাটরকে মাঝখানে নিয়ে ছোট্ট একটা বৃত্ত তৈরি করল। সময় নষ্ট না করে নদীর কিনারা লক্ষ্য করে ছুটল তারা। রণহুঙ্কার ছাড়ল, হতচকিত অসভ্যদের মধ্যে সামনে যাকে পেল তাকেই ঘায়েল করল তলোয়ালের আঘাতে। খেপে ওঠা ষাঁড়ের মতো তীরবেগে ছুটল তারা।
এতই ক্লান্ত যে সব রকম অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছেন ভেনাটর, তবে তাঁর হাতে তলোয়ারটা মুহূর্তের জন্যও স্থির হলো না বা একবারও হোঁচট খেলেন না তিনি। একজন পণ্ডিত, রূপান্তরিত হয়েছেন যোদ্ধায়। তার ভেতর শুধু আশ্চর্য একটা জেদ কাজ করছে, মৃত্যুভয় ভুলে গেছেন।
অস্থির অগ্নিশিখার ভেতর দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোল তারা। মাংস পোড়ার গন্ধে বমি পেল ভেনাটরের। জামাটা আরেকবার ছিঁড়ে নাকে কাপড় চেপে ধরলেন তিনি। ধোঁয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, ঝর ঝর করে পানি ঝরছে চোখ থেকে।
এক এক করে ধরাশায়ী হলো সৈনিকরা, কিন্তু যতক্ষণ নিঃশ্বাস থাকল ততক্ষণ তারা রক্ষা করল ভেনাটরকে। হঠাৎ করে পায়ে ছোঁয়া পেলেন ভেনাটর। চোখে কিছুই দেখছেন না, লাফ দিলেন সামনে। ঝপাৎ করে পানিতে পড়লেন তিনি, সাথে সাথে সাঁতার কেটে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করলেন। কাঠের একটা তক্তার স্পর্শ পাওয়া মাত্র আঁকড়ে ধরলেন সেটাকে। ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন খোলা নদীতে। তক্তার ওপর উঠলেন তিনি, পেছনে তাকাবার সাহস হলো না।
ঢালের মাথায় দাঁড়িয়ে সৈনিকরা এখনও পাথর বর্শা ঠেকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। চারবার একত্রিত হয়ে রোমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল অসভ্যরা, প্রতিবার সৈনিকদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। নিজেদের অবস্থানে অটল থাকলেও, রোমানদের সংখ্যা কমছে। চৌকা আকৃতিটা ভেঙে পড়ল, অসহায় কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ঢালের খোলা মাথায়, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে যুঝছে। তাদের চারপাশে আহতরা কাতরাচ্ছে, এখানে সেখানে স্তূপ হয়ে আছে লাশ। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে রক্তের স্রোত। তবু লড়ে চলেছে রোমানরা।
এরপর আরও দুঘণ্টা ধরে চলল যুদ্ধ। এখন আগের মতোই শক্তি নিয়ে হামলা করছে অসভ্যরা। বিজয়ের গন্ধ পেয়েছে, শেষ একটা হামলা চালাবার জন্য আবার তারা জড় হলো।
মাংস থেকে ফলাটা বের করতে না পেরে তীরের বেরিয়ে থাকা অংশটা ভেঙে ফেলল সেভেরাস, অক্লান্তভাবে লড়ে যাচ্ছে সে। পাশে মাত্র অল্প কজন সৈনিক। তারারও এবার একে একে পড়ে যাচ্ছে। পাথর, বর্শা, বল্লম ঢেকে ফেলছে তাদেরকে।
সবার শেষে পতন হলো সেভেরাসের। শরীরের নিচে ভাঁজ হয়ে গেল পা দুটো, তলোয়ার ধরা হাতটা নড়াতে পারল না। মাটিতে গেড়ে রয়েছে সে, কাত হয়ে যাচ্ছে। শরীর, তার পরও দাঁড়াবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। মুখ তুলল আকাশে, বিড়বিড় করে বলল, মা, বাবা, তোমাদের হাতে তুলে নাও আমাকে।
যেন তার আবেদনে সাড়া দিয়েই, ছুটে এসে তার সারা শরীর বর্শা গাঁথল অসভ্যরা। সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে গেল সেভেরাস।