দুটো বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে নিপুণ ভঙ্গিতে তলোয়ার চালালো সেঞ্চুরিয়ান, চারজন অসভ্য তার পায়ের সামনে ধরাশায়ী হলো। তরোয়ালের চওড়া দিকটার আঘাতে আরেকজন আছড়ে পড়ল, এক কোপে তার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করল সে। মাত্র অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হলো অসভ্যরা, কয়েকশো নিহত সঙ্গীকে ফেলে নাগালের বাইরে চলে গেল আবার।
দম ফেলার ফুরসত পেয়ে হিসাবে মন দিল সেভেরাস। ষাটজন সৈনিকের মধ্যে বারোজন হয় মারা গেছে, নয়তে যেতে বসেছে। আরও চৌদ্দজন বিভিন্ন ধরনের আঘাত পেয়ে অচল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্রীতদাসরা। অর্ধেকের বেশি হয় মারা গেছে নয়তো নিখোঁজ।
দ্রুত পায়ে ভেনাটরের দিকে এগোল সে। জামা ছিঁড়ে বাহুর একটা ক্ষত বাধার চেষ্টা করছেন তিনি। কোমরে জড়ানো কাপড়ের ভাঁজে এখনও সাহিত্য ও শিল্পকর্মের তালিকাটা বহন করছেন গ্রিক পণ্ডিত। এখনও আমাদের সাথে আছেন তাহলে, গুরুদেব!
মুখ তুলে তাকালেন ভেনাটর, তার দুচোখে উপচে পড়ছে দৃঢ় প্রত্যয়। আমার চোখের সামনে মারা যাবে তুমি, সেভেরাস।
হুমকি, ঈর্ষা, নাকি দিব্যজ্ঞান?
কিছু আসে যায়? দেশে ফিরে যাওয়া আমাদের কারও পক্ষেই আর সম্ভব হবে না।
জবাব দিল না সেভেরাস। হঠাৎ করে আবার শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ, সবাই মিলে অসভ্যরা এত বেশি পাথর আর বর্শা ছুড়ছে যে গোটা আকাশ কালো হয়ে গেল, ঢাল তুলে ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৈনিকরা। এক ছুটে চৌকো ঝাকের সামনে পৌঁছে গেল সে।
রোমানরা সাহসের সাথে যুদ্ধ করল, কিন্তু সংখ্যায় তারা কমে গেল। প্রায় সব কজন সিরিয়ান ধরাশায়ী হয়েছে। বিরতিহীন পাথর আর বর্ষা-বৃষ্টি আকৃতিটাকে ছোট করে তুলল। যারা যুদ্ধ করছে তারা সবাই আহত ও ক্লান্ত, রোদ আর পিপাসায় কাতর। তলোয়ার ধরা হাতগুলো ঝুলে পড়তে লাগল, হাতবদল করল বারবার।
ক্লান্ত অসভ্যরাও, তারাও বিপুলহারে ক্ষগ্রিস্ত, তবু তারা নদীর পথে ঢাল ছেড়ে এক ইঞ্চিও নড়ল না। রোমান সৈনিকরা একজন যদি নিহত হয়, অসভ্যরা নিহত হয়েছে বারোজন। ভাড়াটে সৈনিকদের প্রতিটি লাশ পিনকুশনের মতো হয়েছে দেখতে, তীর বিদ্ধ।
দৈত্যাকার ওভারশিয়ার মাসার হাঁটু আর উরুতে দুটো তীর খেয়েছে। এখনও পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও, আঁকের সাথে এগোতে পারছে না সে। পিছিয়ে পড়ল, আর দেখতে না দেখতে বিশজনের একটা অসভ্য বাহিনী ঘিরে ধরল তাকে। ঘুরল সে, অলসভঙ্গিতে, তুলোয়ার চালিয়ে নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত করল তিনজনকে। তার শক্তি দেখে পিছিয়ে গেল বাকি সবাই, নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল। চিৎকার করে তাদেরকে সামনে এসে পড়ার আহ্বান জানাল মাসার।
ঠেকে শিখেছে অসভ্যরা, এখন আর তারা হাতের নাগালে আসছে না। দূর থেকে মাসারকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুড়ল তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাসারের শরীরের পাঁচ জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল। বর্শাগুলো ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেলল মাসার। সে যখন এই কাজে ব্যস্ত, একজন অসভ্য ছুটে কাছে চলে এল, তারপর ছুঁড়ে দিল হাতে বর্শা। সরাসরি মাসারের গলায় বিধল সেটা। ধীরে ধীরে ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়ল সে। অসভ্য নারী-বাহিনী উন্মাদিনীর মতো ছুটে এল, পাথর ছুঁড়ে ছাতু বানিয়ে দিল তাকে।
নদীর কিনারায় পৌঁছানোর পথে রোমানদের সামনে একমাত্র বাধা বেলে পাথরের একটা ঢাল। আরও সামনে, হঠাৎ করে দেখা গেল নীল আকাশ রং বদলে কমলা হয়ে গেছে। তারপর ধোয়ার একটা বিশাল স্তম্ভ মোচড় খেতে খেতে মাথাচাড়া দিল, কালো আর ভারী বাতাস বয়ে নিয়ে এল কাঠের পোড়া গন্ধ।
বিস্ময়ের ধাক্কা খেলেন ভেনাটর, তারপর হতাশায় মুষড়ে পড়লেন। জাহাজ! আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। জাহাজে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে?
রক্তাক্ত সৈনিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, উন্মাদের মতো ছুটল নদীর দিকে। দুদিক থেকে হামলা চালালো এবার অসভ্যরা। বেশ কজন ক্রীতদাস অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল, সাথে সাথে তাদেরকে মেরে ফেলা হলো। বাকিরা একটা গাছের আড়াল থেকে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করল, কিন্তু পিছু ধাওয়ারত অসভ্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর, আপাতত প্রাণে বাঁচতে পারল মাত্র একজন।
সেভেরাস আর তার আহত সৈনিকরা যুদ্ধ করতে করতে ঢলের মাথায় পৌঁছল, তারপরই হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে পড়ল, খেয়াল নেই চারদিকে রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। ঢাল থেকে নিচে, নদীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল তারা।
আগুনের স্তম্ভগুলো পাক খেতে খেতে উঠে গিয়ে মিশছে কালো ধোয়ার সাথে। জাহাজের বহর, তাদের পালানোর একমাত্র বাহন, নদীর কিনারা ধরে সার সার পুড়ছে। মিসর থেকে নিয়ে আসা বিশাল আকৃতির জাহাজগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।
সৈনিকদের ঠেলে সামনে চলে এলেন ভেনাটর, দাঁড়ালেন সেভেরাসের পাশে। চুপ হয়ে গেছে সেঞ্চুরিয়ান, তার জামা আর লোহার বর্ম রক্ত ও ঘামে পিচ্ছিল। সর্বনাশা আগুনের আভায় জ্বল জ্বল করছে তার চোখ দুটো।
নদীর তীরে নোঙর ফেলা জাহাজগুলো অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। অসভ্যদের বিশাল এক বাহিনী নাবিকদের এক জায়গায় জড় করে পায়ের তলায় পিষে মেরেছে, তারপর আগুন দিয়েছে জাহাজে। তাদের হামলা থেকে বেঁচে গেছে একটা মাত্র ছোট্ট বাণিজ্য জাহাজ। নাবিকরা যেভাবেই হোক অসভ্যদের আক্রমণ এড়িয়ে গেছে। চারজন নাবিক পাল তোলার কাজে ব্যস্ত, বাকি কয়জন দ্রুত বৈঠা চালিয়ে গভীর পানিতে সরে যাবার চেষ্টা করছে।