ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে স্যালুট করল নোরিকাস, ক্যাম্পের কেন্দ্র লক্ষ্য করে ছুটল।
ষাটজন সৈনিক দ্রুত ফাঁপা একটা চৌকো আকৃতি নিল। সিরিয়ান তীরন্দাজরা থাকল আকৃতিটার দুপাশে, সশস্ত্র ক্রীতদাসদের মাঝখানে, বাইরের দিকে মুখ করে। রোমান সৈনিকরা থাকল আকৃতির সামনের আর পেছনে। সৈনিকদের তৈরি পাঁচিলের আড়ালে, চতুর্ভুজের ভেতর, মিসরীয় আর গ্রিক সহকারী ও মেডিকেল দলসহ থাকলেন ভেনাটর। পদাতিকদের জন্য প্রধান অস্ত্র হলো গ্লাডিয়াস-দুমুখো তীক্ষ্ণ ডগা তলোয়ার, বিরাশি সেন্টিমিটার লম্বা। আর আছে ছুঁড়ে মারার জন্য দুমিটার লম্বা বল্লম। শারীরিক নিরাপত্তার জন্য সৈনিকরা লোহার হেলমেট পরেছে, হেলমেটের কিনারা গালের দুপাশে ঝুলে আছে, দুটো প্রান্তকে বাঁধা হয়েছে চিবুকের কাছে। খাঁচা আকৃতির লোহার বেড় দিয়ে বুক, কাধ আর পিঠেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা হাড়টাকে রক্ষার জন্য লোহার গার্ড। তাদের ডালগুলো কাঠের তৈরি।
পাহাড় থেকে হুড়মুড় করে নেমে না এসে আস্তে ধীরে কলামটাকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলল অসভ্যরা। হামলা করার সময়ও তারা ব্যস্ত হলো না। প্রথমে তারা অল্প কজন লোক পাঠিয়ে নিবিড় ঝাঁকটা ভাঙার জন্য একটা খোঁচা দিল। অনেকটা কাছাকাছি এসে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচামেচি করল তারা, অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে হুমকি দিল। কিন্তু সংখ্যায় নগণ্য হলেও শত্রুপক্ষ ভয় পেল না বা ছুটে পালাল না।
অভিজ্ঞতা মানুষকে নির্ভয় করে, আর সেঞ্চুরিয়ান সেভেরাসের অভিজ্ঞতার কোনো অভাব নেই। লাইন থেকে কয়েক পা এগিয়ে অসভ্য যোদ্ধায় গিজগিজ করা সামনের প্রান্তরটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। উপহাসের ভঙ্গিতে শত্রুদের উদ্দেশে হাত নাড়ল একবার। অসম যুদ্ধে আগেও বহুবার তাকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। মাত্র ষোলো বছর বয়েসে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় সে। সাধারণ সৈনিক থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে, দানিয়ুবের তীরে গথদের সাথে আর রাইনের তীরে ফ্রাঙ্কদের সাথে যুদ্ধ করে বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পদক পেয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর ভাড়াটে সৈনিক হয়েছে সে, যে বেশি টাকা দেবে তার পক্ষ নিয়ে লড়াই করতে আপত্তি নেই।
নিজের সৈনিকদের প্রতি অটল বিশ্বাস রয়েছে সেভেরাসের। তাদের খাপমুক্ত তলোয়ার আর হেলমেট রোদ লেগে ঝলমল করছে। সবাই তারা শক্তিশালী যোদ্ধা, যুদ্ধ করে অভিজ্ঞ হয়েছে, পরাজয় কাকে বলে জানে না।
বেশির ভাগ গৃহপালিত পশু, তার ঘোড়াটাসহ ঈজিপ্ট থেকে সমুদ্র অভিযানে বেরোনোর পরপরই মারা গেছে। কাজেই চৌকো আকৃতির ঝাঁকের সামনে থাকল সে-হাঁটছে, কয়েক পা এগিয়ে একবার করে ঘুরছে, যাতে চারদিকে দাঁড়ানো শত্রুপক্ষের ওপর নজর রাখা যায়।
পাহাড় প্রাচীর সমুদ্র আছড়ে পড়ার মতো বিকট গর্জন তুলে ধেয়ে এল অসভ্যরা, ঝাঁপিয়ে পড়ল রোমানদের ওপর। জনসমুদ্রের প্রথম ঢেউটাকে লম্বা বর্শা আর তীরের বাধা পেরিয়ে আছাড় খেল ঝাকের গায়ে। কাস্তে দিয়ে গম কাটার মতো সাফ করা হলো তাদের। অসভ্যদের লাল রক্তে তলোয়ালের চকচকে গেল লাটিনিয়াস মাসার ক্রীতদাসরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে এক চুল নড়ল তো নাই-ই, শত্রু নিধনেও তারা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিল।
চারদিক থেকে বৃত্তটা ছোটো করে আনল অসভ্যরা। লোক তারা যা হারিয়েছে, তার দশগুণ নেমে এল পাহাড় থেকে। বাঁধ ভাঙা পানির মতো আসছে তো আসছেই, বিরতিহীন। রোমানদের ঝকটা মন্থরগতিতে সামনে এগোল। অসভ্যদের তৃতীয় আক্রমণ শুরু হলো। সবুজ ঘাসমোড়া ঢালে আবার রক্তস্রোত বইল। অসভ্যদের একটা দল পেছন থেকে হামলা চালালো। সদ্য নিহত বা আহত সহযোদ্ধাদের গায়ে আছাড় খেল তারা, পড়ে থাকা অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে খালি পা, নিজেদের কীভাবে রক্ষা করতে হয় জানে না। ঝাক থেকে বেরিয়ে এসে অপ্রস্তুত অসভ্যদের কচুকাটা করল রোমানরা, কাজ সেরে আবার তারা ফিরে গিয়ে চৌকো আকৃতি নিল।
এবার অন্যদিকে মোড় নিল যুদ্ধ। বিদেশিদের বল্লম, বর্শা আর তীরের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবে না বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেল অসভ্যরা, জড় হলো নতুন করে। এরপর তারা ঝাঁক ঝাঁক ভোঁতা তীর আর বর্শা ছুঁড়তে শুরু করল, মেয়েরা ছুড়ল পাথর।
ঢাল তুলে মাথা বাঁচাল রোমানরা, মন্থর কিন্তু অবিচল ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল নদী আর নিরাপদ আশ্রয় জাহাজের দিকে। অসভ্যরা দূরে সরে যাওয়ায় তাদের ক্ষতি যা করার তা শুধু সিরিয়ান তীরন্দাজরাই করতে পারছে। ক্রীতদাসদের জন্য ঢালের সংখ্যা যথেষ্ট নয়, অরক্ষিত অবস্থায় বর্শা আর তীরের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছে বেচারিরা, তার ওপর গুহার ভেতর পাথর খোঁড়ার কাজ করতে হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পড়ে যাবার পর আর উঠতে পারল না। ঝাক থেকে বেরিয়ে এসে সাহায্য করতে রোমানরা কেউ রাজি নয়। একটু পরই অসভ্যদের হাতে আহত ধরাশীয়দের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
যুদ্ধ পরিস্থিতি ও শত্রুপক্ষের ভাবসাব লক্ষ করে নতুন একটা নির্দেশ দিল সেভেরাস। স্থির হয়ে গেল সৈনিকের ঝাঁক, সবাই তারা যে যার অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিল। অসভ্যরা ধরে নিল, রোমানরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। বিকট রণহুঙ্কার ছেড়ে তীরবেগে ছুটে এল তারা। একেবারে যখন কাছে চলে এসেছে অসভ্যদের বিশাল বাহিনী, শেষ মুহূর্তে আরেকটা নির্দেশ দিল সেভেরাস-হ্যাঁচকা টানে সৈনিকরা খাপমুক্ত করল তলোয়ার, পাল্টা হামলা শুরু করল।