মিসর ছেড়েছি আজ এগারো মাস। আনন্দ-ফুর্তির জন্য আরেকটা দিন দেরি করলে কোনো ক্ষতি নেই।
আমরা লুটপাট করতে আসিনি। অসভ্যরা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। আমরা মাত্র কজন, তারা অনেক।
আমাদের বিরুদ্ধে যত অসভ্যই পাঠানো হোক, আমার সৈনিকরা তাদের সামলাতে পারব।
তোমার লোকজন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রণকৌশল তারা ভুলে যায়নি, আত্মবিশ্বাসের হাসি নিয়ে বলল সেভেরাস।
কিন্তু তারা কি রোমের মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করবে?
কোন দুঃখে, কেন? সাম্রাজ্যের সুদিন এসে আবার চলে গেছে। আমাদের এককালের তিলোত্তমা টাইবার আজ নোংরা বস্তিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের শিরায় যদি রোমান রক্ত থেকেও থাকে, তা খুবই কম। আমার বেশির ভাগ লোকজন প্রদেশগুলোর আদি বাসিন্দা। আমি একজন স্প্যানিয়ার্ড আর আপনি একজন গ্রিক, জুনিয়াস ভেনাটর। আজকের এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে এমন একজন সম্রাটের প্রতি আধপোয়া বিশ্বস্ততাও থাকবে কেন, যে সম্রাট বহুদূর পুবের একটা শহর থেকে শাসন করেন? এমনকি শহরটাকে আমরা কেউ দেখিনি পর্যন্ত। না, জুনিয়াস ভেনাটর, না আমার সৈনিকরা যুদ্ধ করবে, কারণ তারা পেশাদার যোদ্ধা, কারণ তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য ভাড়া করা হয়েছে।
কিংবা অসভ্যরা তাদেরকে বাধ্য করবে।
যখনকার সমস্যা তখন। সত্যি যদি অসভ্যদের দুর্মতি হয়…
সংঘর্ষ এড়ানো গেলে সব দিক থেকে ভালো। আমি সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই রওনা হতে চাই…
বিকট শব্দে বাধা পেলেন ভেনাটর, পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠল মাটি। এক ছুটে তাবু থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে তাকালেন তিনি। মাচার নিচ থেকে অবলম্বনগুলো সরিয়ে নিয়েছে ক্রীতদাসরা, বিশাল আকারে কয়েকশো টন পাথরসহ মাটি আর বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখ। ধুলোর প্রকাণ্ড মেঘ ক্ষীণস্রোত নালার ওপর ছড়িয়ে পড়ল। পতনের প্রতিধ্বনি এখনও শোনা যাচ্ছে, শব্দটাকে ছাপিয়ে উঠল সৈনিক আর ক্রীতদাসদের উল্লাসধ্বনি।
যিশুর কৃপায় কাজটা শেষ হলো, আপন মনে বিড়বিড় করলেন ভেনাটর, তাঁর প্রসন্ন চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কী এক পবিত্র আলোয়। বহু শতকের জ্ঞান রক্ষা পেল।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল সেভেরাস। দুঃখের বিষয়, কথাটা আমাদের সম্পর্কে খাটে না।
ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর। নিরাপদে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যদি ঘরে ফিরতে পারি, তারপর আর ভয় কিসের?
শারীরিক নির্যাতন আর মৃত্যু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, চাঁছাছোলা ভাষায় বলল সেভেরাস। আমরা সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেছি। সহজে ক্ষমা করার পাত্র থিয়োডোসিয়াস নন! সাম্রাজ্যের কোথাও আমাদের লুকোবার জায়গা থাকবে না। উচিত কাজ হবে বিদেশে কোথাও আশ্রয় খুঁজে নেয়া।
আমার স্ত্রী আর মেয়ে…এনটিওচ-এর ভিলায় তাদের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা…
ধরে নিন ইতিমধ্যে তাদেরকে সম্রাটের লোকজন বেধে নিয়ে গেছে। হয় মারা গেছে, নয়তো ক্রীতদাস হিসেবে বেঁচে দেয়া হয়েছে।
অসম্ভব! সবেগে মাথা নাড়লেন ভেনাটর, দুচোখে অবিশ্বাস। উঁচু মহলে বন্ধু বান্ধব আছে আমার, আমি না ফেরা পর্যন্ত ওদেরকে তারা রক্ষা করবে।
এমনকি উঁচুমহলের বন্ধুদেরকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করা যায়। ঘুষ দিয়ে দুর্বল করাও সম্ভব।
অকস্মাৎ কঠোর হয়ে উঠল ভেনাটরের চেহারা। আমরা যা অর্জন করেছি তার তুলনায় কোনো ত্যাগই বড় নয়। এখন শুধু দেখতে হবে আমরা যাতে অভিযানের রেকর্ড আর চার্ট নিয়ে ফিরতে পারি, তা না হলে সবই নিষ্ফল হয়ে যাবে।
জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল সেভেরাস, কিন্তু সে তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে ছুটে আসতে দেখে চুপ করে থাকল। ঢাল বেয়ে তীরবেগে ছুটে আসছে যুবক নোরিকাস, দুপুরের রোদে চকচক করছে তার ঘামে ভেজা মুখ, হাপরের মতো, হাপাচ্ছে সে, বার বার দূরবর্তী নিচু পাহাড়গুলোর দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাবার চেষ্টা করছে।
কপালে হাত তুলে রোদ ঠেকালেন ভেনাটর, পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালেন। শক্ত কিছু নতুন রেখা ফুটল তাঁর মুখে।
অসভ্যরা, সেভেরাস! বদলা নেয়ার জন্য ছুটে আসছে তারা!
পাহাড়গুলো যেন পিঁপড়েতে ঢাকা পড়ে গেছে। কয়েক হাজার অসভ্য পুরুষ ও নারী ওপরে দাঁড়িয়ে তাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী নিষ্ঠুর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তারা তীর-ধনুক সজ্জিত, হাতে চামড়ার ঢাল আর বর্শা-বর্শাগুলোর ডগা তীক্ষ্ণ করা হয়েছে কালো কাঁচের মতো আগ্নেয় শিলার টুকরো দিয়ে। কারও কারও হাতে কাঠের হাতলসহ পাথরের কুঠার। পুরুষদের পরনে শুধু কৌপীন। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সবাই, যেন কার ইঙ্গিতের অপেক্ষায়, ভাবলেশহীন, ঝড়ের পূর্ব মুহূর্তের মতো, ভীতিকর, থমথমে।
আরেক দল অসভ্য জড় হয়েছে জাহাজ আর আমাদের মাঝখানে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নোরিকাস।
ঘাড় ফেরালেন ভেনাটর, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তোমার বোকামির এই হলো ফল, সেভেরাস। রাগে কেঁপে গেল তার গলা। তুমি আমাদের সবাইকে খুন করলে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা শুরু করলেন তিনি।
আপনার ঈশ্বরভক্তি অসভ্যদের ঘুম পাড়াতে পারবে না, শুরুদেব, ব্যঙ্গের সুরে বলল সেভেরাস। খেলা দেখাবে শুধুমাত্র তলোয়ার। নোরিকাসের দিকে ফিরে তার একটা বাহু আঁকড়ে ধরল সে, দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিল, বাদককে বলল বাজনা বাজিয়ে সৈনিকদের জড় করুক। ক্রীতদাসদের হাতে অস্ত্র তুলে দিক লাটিনিয়াস মাসার। শক্ত চৌকো আকৃতি নেয়ার হুকুম দাও সৈনিকদের। নদীর দিকে আমরা ঝাক বেঁধে এগোব।