আমার কাছে তো ভালোই লাগছে, সহাস্যে পিট বলে। চলুন না হয়, ডিনারে যাই একদিন?
আমার স্বামী আসতে পারবে তো?
যদি উনি বিল দেন, তবে।
আমি হাঁটতে পারব বলে মনে হয় না, বলে পিটের ঘাড় জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। হাসি গোপন করে তাকে দুহাতের ওপর তুলে নিল উদ্ধার কর্তা। ঘাড় ফিরিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাল ও। দয়া করে ভুলেও পানিতে নামতে যাবেন না। এক্ষুনি আপনার জন্য ফিরে আসছি আমি।
এই প্রথম হে’লা কামিল উপলব্ধি করলেন, তিনি নিরাপদ। ভয়ংকর সময়টাতে স্থির থাকলেও এখন, এই মুহূর্তে কান্না পেল তার।
.
রুবিন জানে, সে মারা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা বা ব্যথা, কিছুই অনুভব করছে না। অচেনা কণ্ঠস্বর, আকস্মিক আলো, এসবের কোনো অর্থ খুঁজে পেল না সে। নিজেকে তার বিচ্ছিন্ন, বিচ্যুত বলে মনে হলো। অলস মস্তিষ্কে চিন্তাশক্তি লোপ পেতে যাচ্ছে। যা কিছু ঘটছে সব যেন অতীত থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট স্মৃতি, কবে যেন ঘটেছিল।
বিধ্বস্ত ককপিট হঠাৎ সাদা উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। কোনো কোনো মানুষ দাবি করে মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আবার ফিরে এসেছে তারা, তাহলে সেও কি তাই আসছে? শরীরবিহীন একটা কণ্ঠস্বর কাছ থেকে কথা বলে উঠল, শক্ত হোন, সাহস করুন, সাহায্য এসে গেছে।
চোখ মেলে অস্পষ্ট মূর্তিটাকে চেনার চেষ্টা করল।
আপনি কি ঈশ্বর?
মুহূর্তের জন্য ভাবলেশহীন হয়ে গেল লে, সিমোন্সের চেহারা। তারপর সকেতুকে হাসল সে। না। স্রেফ মরণশীল একজন মানুষ, ঘটনাচক্রে আপনাদের প্রতিবেশী।
আমি মারা যাইনি?
দুঃখিত, বয়স আন্দাজ করতে যদি ভুল না করে থাকি, আপনাকে আরও পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আমি নড়তে পারছি না। পা দুটো যেন পেরেকের সাথে আটকে আছে। বোধ হয় ভেঙে গেছে…প্লিজ, বের করুন আমাকে।
ধৈর্য ধরুন, আপনাকে উদ্ধার করতেই এসেছি আমি, চামড়ার দস্তানা পরা হাত দিয়ে ব্যস্ততার সাথে প্রায় এক ফুট তুষার আর বরফ সরিয়ে ফেলল লে, সিমোন, রুবিনেরর বুক আর পেট মুক্ত হলো, ছাড়া পেল হাত দুটো। এবার আপনি নাক চুলকাতে পারবেন। শাবল আর যন্ত্রপাতি নিয়ে এক্ষুনি ফিরব আমি।
মেইন কেবিনে ফিরে এসে সিমোন দেখল, ফ্লাই অ্যাটেনড্যান্টকে বুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকছে পিটও। গেইলের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিল ও।
ডাক্তার গেইল, বলল সিমোন। ককপিটে একজন বেঁচে আছে।
এই এলাম বলে।
পিটের দিকে তাকাল সিমোন, আপনার সাহায্য পেলে ভালো হয়…
মাথা ঝাঁকাল পিট। দুমিনিট সময় দিন। বাথরুম থেকে আরো একজন কে নিয়ে আসে আগে।
.
হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হলেন হে’লা কামিল, ঝুঁকে আয়নার দিকে তাকালেন। নিজের প্রতিবিম্ব দেখার জন্য আলোর আভা যথেষ্টই রয়েছে বাথরুমে। যে মুখটা তার দিকে পাল্টা দৃষ্টি ফেলল, হঠাৎ দেখে তিনি চিনতে পারলেন না শুকনো, নির্লিপ্ত চেহারা, চোখে কোনো ভাষা নেই। ভাগ্যহত রাস্তার মেয়েদের একজন বলে মনে হলো, পুরুষের হাতে বেদম মারধর খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে।
র্যাক থেকে টেনে কয়েকটা পেপার টাওয়েল নামালেন তিনি, ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে মুখ থেকে রক্ত আর লিপস্টিক মুছলেন। মাসকারা আর আইশ্যাডো ও চোখের চারপাশে লেপে মুছে একাকার হয়ে গেছে, তাও পরিষ্কার করলেন। চুল মোটামুটি ঠিকঠাকই আছে, শুধু আলগা প্রান্তগুলো হাত দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় সরিয়ে দিলেন।
আয়নায় চোখ রেখে ভাবলেন, এখনও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে চেহারা। পিটকে ফিরে আসতে দেখে জোর করে একটু হাসলেন তিনি, আশা করলেন নিজেকে অন্তত পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন।
দীর্ঘ এক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকল পিট, তারপর কৌতুক করার লোভ সামলাতে না পেরে সবিনয় কোমল সুরে জিজ্ঞেস করল, মাফ করবেন, গর্জিয়াস ইয়াং লেডি, এদিকে কোনো বুড়ি ডাইনিকে দেখেছেন নাকি?
চোখে পানি বেরিয়ে এলেও হে’লা কামিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসলেন। আপনি চমৎকার মানুষ, মি. পিট। থ্যাঙ্ক ইউ।
আই ট্রাই, গড নোজ, আই ট্রাই।
কয়েকটা কম্বল এনেছে পিট, সেগুলো মহাসচিবের গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর একটা হাত রাখল তার হাঁটুর নিচে, আরেকটা তার কোমরের চারদিকে, অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে নিল শরীরটা বাথরুম প্ল্যাটফর্ম থেকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আইল ধরে এগোল ও, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে।
পিট একবার হোঁচট খেতেই হে’লা কামিল উদ্বেগের সাথে জানতে চাইলেন, আপনি ঠিক আছেন?
শুধু জ্যাক ডেনিয়েলসের গরম হুইস্কি পেটে পড়লে সব ঠিক, সহাস্যে জানাল পিট।
পুরো এক বাক্স উপহার দেব, প্রতিশ্রুতি দিলেন হে’লা কামিল।
বাড়ি কোথায়?
আপাতত নিউ ইয়র্কে।
পরের বার আমি যখন নিউ ইয়র্কে যাব, আপনি আমার সাথে ডিনার খাবেন?
দুর্লভ একটা সম্মান বলে মনে করব, মি. পিট।
উল্টোটাও সত্যি, মিস কামিল।
ভ্রু জোড়া একটু ওপরে তুললেন মহাসচিব। এই বিধ্বস্ত চেহারায় আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
মানে, একটু যখন পরিবেশনের যোগ্য করেছেন চেহারাটা, তখন আর কি চিনতে পেরেছি।
আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত। আপনার পা নিশ্চয়ই অবশ হয়ে গেছ?
লোককে বলতে পারব ইউ,এন, সেক্রেটারি জেনারেলকে দুহাতে বয়ে এনেছি, তার তুলনায় কষ্টটুকু কিছুই নয়।
অদ্ভুত, সত্যি অদ্ভুত, ভাবল পিট। আজ কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল ওর? এমন সাফল্য রোজ জোটে না ভাগ্যে। একই দিনে তিন তিনটে সুন্দরী মেয়েকে ডিনার খাবার প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ কয়জন পায়। কোনো সন্দেহ নেই, এটা একটা রেকর্ড। সভ্যতা থেকে দুহাজার মাইল দূরে, জনমানবহীন বরফের রাজ্যে, মাত্র ত্রিশ মিনিট সময়সীমার ভেতর এই সাফল্য-ভাবা যায় না। রাশিয়ান সাবমেরিন খুঁজে পাবার চেয়ে ঢের বড়ো সাফল্য এটা।