ডাক্তার গেইল কিছু বলার আগে পানি ঠেলে এগিয়ে এল লে, সিমোন। ভয়ে আর বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার চোখ। ওহ্ গড! সিটে বসা আরোহীদের দিকে পেছন ফেরার জন্য ঘন ঘন একদিক থেকে আরেক দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। মানুষ এভাবে মারা যায়! সত্যিই কি লাশ ওগুলো, নাকি মমি?
লাশ, মৃদুকণ্ঠে বলল পিট। তবে একজন অন্তত বেঁচে আছে। হয় ককপিটে, নয়তো লুকিয়ে আছে পেছনের কোনো বাথরুমে।
তাহলে আমার চিকিৎসা দরকার তার, ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ডাক্তার গেইল।
আপনি বরং এখানেই আরোহীদের পরীক্ষা করুন, প্রস্তাব দিল পিট। দেখুন সবাই মারা গেছে কিনা। সিমোন ককপিটে চলে যান, আমি বাথরুমগুলো দেখি।
এত লাশ, বলল লে, সিমোন, কী করে সরানো হবে? কমান্ডার নাইটকে জানানো দরকার না?
যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, দৃঢ়কণ্ঠে, নির্দেশের সুরে বলল পিট।
রেডিওর ধারেকাছে যাবেন না। ক্যাপটেনকে আমার নিজেরা গিয়ে রিপোর্ট করব। আপনার লোকজনদের সবাইকে বাইরে রাখুন, কেউ যেন প্লেনের ভেতর না ঢোকে। ভালো হয় দরজাটা সিল করে দিলে। আপনার মেডিকেল দল সম্পর্কেও একই কথা, ডাক্তার গেইল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ কিছু স্পর্শও করবে না।
কিন্তু…., প্রতিবাদের সুরে শুরু করল লে. সিমোন।
আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে একটা কিছু ঘটেছে এখানে, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল পিট, দুর্ঘটনার খবর এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এয়ার ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেটর আর রিপোর্টাররা ভিড় জমাবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ না করা পর্যন্ত কেউ আমরা কারও কাছে মুখ খুলব না।
আবার কিছু বলতে গেল লে, সিমোন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। ঠিক আছে, মি. পিট।
তাহলে চলুন দেখা যাক কেউ বেঁচে আছে কি না।
বিশ সেকেন্ডের পথ বাথরুমগুলো, পানি ঠেলে পৌঁছতে দুমিনিট লাগল পিটের। এরই মধ্যে ওর পা অসাড় হয়ে গেছে। আধাঘণ্টার মধ্যে গরম করে না নিলে ওগুলো যে ফ্রস্টবাইটের শিকার হবে তা জানার জন্য ডাক্তার গেইলের উপদেশ দরকার নেই ওর।
প্লেনের ধারণক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা হলে আরও বহু লোক মারা যেত। অনেক সিট খালি থাকা সত্ত্বেও তিপ্পান্নটি লাশ গুনল পিট। পেছনের বাল্কহেড ঘেঁষে সিটে বসা একজন মহিলা ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টকে পরীক্ষা করল ও। তার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, পানিতে ঝুলে পড়েছে সোনালি চুল। পালস নেই।
একটা কম্পার্টমেন্টের ভেতর ঢুকল পিট, এটার ভেতরই বাথরুমগুলো। তিনটে দরজার মাথায় খালি চিহ্ন দেখে ভেতরে উঁকি দিল ও। কেউ নেই ভেতরে। চার নম্বরটা রয়েছে খালি নয় চিহ্ন, ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ভেতরে কেউ আছে। সজোরে কয়েকবার নক করল ও, তারপর ডাকাল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ইংরেজিতে করল প্রশ্নটা। ভাষা ঠিক আছে? আমরা আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্য এসেছি। প্লিজ, দরজা খোলার চেষ্টা করুন।
কবাটে কান ঠেকালো পিট। মনে হলো কেউ যেন ফুঁপিয়ে উঠল নিচু গলায়। তার পরই শোনা গেল ফিসফিসে আওয়াজ, যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে দু’জন মানুষ।
গলা চড়াল পিট, পিছিয়ে যান। দরজা ভাঙছি।
ভেজা পা তুলে দরজার গায়ে লাথি মারল পিট। খুব জোরে নয়, শুধু হুড়কো বা ছিটকিনি ভাঙতে চায়। কবাট ভেঙে পড়লে ভেতরে যারা আছে তারা আহত হতে পার। দ্বিতীয় লাথিতে কাজ হলো।
বাথরুমের পেছনের একটা কোণে, টয়লেট প্ল্যাটফর্মের ওপর, দু’জন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। একজন থরথর করে কাঁপছে, পরনে ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্টের ইউনিফর্ম, দ্বিতীয় ভদ্রমহিলাকে আঁকড়ে ধরে আছে সে। এক ভেঙে গেছে ইউনিফর্ম পরিহিতার, বুঝল পিট।
অপরজনের চেহারায় সন্দেহ আর কাঠিন্য ফুটে থাকতে দেখল পিট। চিনতে পারল ও, এঁকেই জানালায় দেখেছিল। তখন অবশ্য মাত্র একটা চোখ খোলা ছিল, এখন দুটোই খোলা। ঘৃণা আর সাহস নিয়ে পিটের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। মুখের একপাশ শুকনো রক্তের চাদরে ঢাকা। তার গলার সুরে মারমুখো ভাব লক্ষ করে অবাক না হয়ে পারল না ও। কে আপনি? কী চান? বিশুদ্ধ ইংরেজি, উচ্চারণ ভঙ্গি খানিকটা আঞ্চলিক।
আমার নাম ডার্ক পিট, বলল পিট, আমেরিকার জাহাজ পোলার এক্সপ্লোরার থেকে এসেছি। যা বললেন প্রমাণ করতে পারবেন?
দুঃখিত, ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ফেলে এসেছি বাড়িতে। দরজার গায়ে হেলান দিল পিট। প্লিজ, ভয় পাবেন না, সম্মানের সুরে নরম গলায় বলল আবার। আমরা সাহায্য করতে এসেছি করতে এসেছি, ক্ষতি করতে নয়।
ভদ্রমহিলার কাঁধ থেকে মাথা তুলে হিস্টিরিয়াগ্রস্থের হাসি হাসল ফ্লাইট অ্যাটেনড্যান্ট, তার পরই আবার কী মনে করে ফুঁপিয়ে উঠল।
ওরা সবাই মারা গেছে, খুন!
হ্যাঁ, জানি, শান্ত সুরে বলল পিট, একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ধরুন। আপনাদের চিকিৎসা দরকার। আমাদের সাথে ডাক্তার আছেন। এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলে….
বুঝব কীভাবে আপনি টেরোরিস্টদের একজন নন? আগের মতোই কঠিন সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রমহিলা।
শব্দখেলায় বিরক্ত হয়ে পড়েছে পিট। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক কাঁধে তুলে নিল ফ্লাইট অ্যাটেনপেন্টকে।
পেশি ঢিল দিন, মনে করুন, আপনি নায়িকা আর আমি নায়ক- উদ্ধার পেতে যাচ্ছেন এ যাত্রা। পিট বলে।
নিজেকে নায়িকা ভাবতে পারছি না, চেহারা-পোশাকের যা অবস্থা।