হিটারের হোস নিয়ে ডানায় উঠল লোকগুলো, চোখে-মুখে গরম বাতাস পেল পিট।
আমাদের মনে হয় দরজা কেটে ঢুকতে হবে, বলল ও। ওকে একপাশে সরে দাঁড়াতে বলে কোটের পকেট থেকে ব্যাটারিচালিত একটা যন্ত্র বের করল কর্ক সিমোন। সুইচ অন করতেই শেষ প্রান্তে একটা চাকা ঘুরতে শুরু করল। আমেরিকান নেভির সৌজন্য। অ্যালুমিনিয়াম আর প্লেক্সিগ্নাস মাখনের মতো কাটতে পারে। শুধু কথায় নয়, আড়াই মিনিটের মধ্যে কাজটা করেও দেখল সে।
কোমর বাঁকা করে ঝুঁকল পিট, সদ্য ভাঙা জানালার ভেতর হাত গলিয়ে দিয়ে টর্চ জ্বালল। প্লেনের ভেতর ভদ্রমহিলার ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও। খড়ির ঠাণ্ডা পানিতে টর্চের আলো চকচক করছে। ছোট ছোট লাফ দিয়ে কাছাকাছি খালি সীটগুলোয় ওঠার চেষ্টা করছে মন্থরগতি ঢেউ। পিটের আর সিমোন দু’জন মিলে জানালা দিয়ে হোসটা ঢোকাল, তারপর ছুটল প্লেনের সামনের দিকে। ইতোমধ্যে নেভির লোকজন পানির নিচে হাত ডুবিয়ে মেইন একজিট ভোর ভোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। যা ভয় করা হয়েছিল তাই, আটকে গেছে ওটা। ব্যস্ততার সথে দরজার গায়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো তৈরি করা হলো, ফুটোয় ঢোকানো হলো স্টেনলেস স্টিলের হুক, প্রতিটি হুক সোমোবাইলের সাথে কেবল দিয়ে যুক্ত। স্নোমোবাইল চালু করে খোলা হলো দরজাটা।
প্লেনের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। কেমন যেন একটা অশুভ পরিবেশ। চেহারায় ইতস্ত ত ভাব নিয়ে পেছন দিকে তাকাল পিট। ডাক্তার গেইল তার দলবল নিয়ে ওর ঠিক পেছনেই রয়েছেন। লে, সিমোন্সের লোজন পাওয়ার ইউনিটের কেবল খুলছে প্লেনের ভেতর আলোর ব্যবস্থা করার জন্য। চলুন, ঢোকা যাক, বলল ও।
খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল পিট। পানিতে পড়ল, ডুবে গেল হাঁটু পর্যন্ত। অনুভব করল যেন এক হাজার সুই হঠাৎ করে বিধে গেছে পায়ে। বাল্কহেড ঘুরে মাঝখানের আল ধরে এগোল ও, আলের দুপাশে প্যাসেঞ্জার কেবিনের সারি সারি সিট। ভৌতিক নিস্তব্ধতা ওর হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিল। ঠিক ধরতে পারছে না, কিন্তু অনুভব করছে, ভয়ংকর কী যেন একটা ঘটে গেছে এখানে। পানি ঠেলে এগোচ্ছে, শুধু তারই শব্দ পাচ্ছে, আর কোনো আওয়াজ নেই।
তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পিট, সবচেয়ে বীভৎস ভয়টা বিষাক্ত ফুলের পাপড়ির মতো উন্মুক্ত হতে শুরু করল।
পিটের দুপাশে ওগুলো যেন সব ভূতের মুখ, ফ্যাকাসে আর সাদা। কেউ নড়ছে না, কারও চোখে পলক নেই, কেউ কথা বলছে না। যার যার সিটে স্ট্র্যাপ দিয়ে নিজেকে আটকে রেখেছে, পিটের দিকে তাকিয়ে আছে সারি সারি লাশ।
১০. হিমেল বাতাস
১০.
হিমেল বাতাসের চেয়ে ঠাণ্ডা একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো পিটের ঘাড়ের পেছনে। বাইরের আলো জানলো দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে, দেয়ালগুলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়া নড়াচড়া করছে। এক এক করে সিটগুলো দিকে তাকাল ও, যেন আশা করছে চোখচোখি হলে হঠাৎ কেউ হাত বাড়াবে বা কথা বলে উঠবে। কিন্তু না, পাতাল সমাধিতে রাখা মমির চুপচাপ বসে থাকল সবাই।
আরোহীদের একজনের ওপর ঝুঁকে পড়ল পিট। তার লালচে সোনালি চুল মাথায় ঠিক মাঝখানে দুভাগ করা। আলোর কিনারায় একটা সিটে বসে আছে সে। তার চেহারায় ব্যথা, ভয় বা বিস্ময়ের কোনো চিহ্ন নেই। চোখ দুটো আধখোলা, যেন ধুমে ঢলে পড়ার আগের মুহূর্তে রয়েছে। ঠোঁট জোড়া স্বাভাবিকভাবে জোড়া লাগানো। চেয়াল সামান্য একটু ঝুলে পড়া।
তার অসাড় একটা হাত ধরল পিট। পালস্ পেল না। হার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বুঝছ? জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার গেইল, পিটকে পাশ কাটিয়ে আরেক আরোহীকে পরীক্ষা করছের তিনি।
মারা গেছেন ভদ্রলোক, জবাব দিল পিট।
ইনিও।
মৃত্যুর কারণ?
এক্ষুনি বলতে পারছি না। আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখছি না। মারা গেছে খুব বেশিক্ষণ হয়নি। প্রচণ্ড ব্যথা বা হাত-পা ছোঁড়ার কোনো লক্ষণ নেই। চামড়ার রং দেখে রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে মারা গেছেন বলেও তো মনে হচ্ছে না।
সেটারই সম্ভাবনা বেশি, বলল পিট। অক্সিজেন মাস্কগুলো এখনও ওভারহেড প্যানেলে রয়েছে।
একের পর এক আরোহীদের পরীক্ষা করে চলেছেন ডাক্তার গেইল। আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে বলতে পারব।
দোরগোড়ার মাথায় একটা আলো জ্বালার ব্যবস্থা সেরে ফেলল লে, সিমোন। বাইরের দিকে ফিরিয়ে একটা হাত আঁকাল সে। প্লেনের ভেতরটা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল।
কেবিনের চারদিকে তাকাল পিট। চোখে পড়ার মতো ক্ষতি শুধু সিলিংয়ের হয়েছে, কয়েক জায়গায় তুবড়ে গেছে সেটা। প্রতিটি সিট খাড়া অবস্থা রয়েছে, প্রত্যেক আরোহীর সিট বেল্ট বাঁধা। বরফজলে অর্ধেক ডুবে বসে ছিল, নড়াচড়া না করে হাইপোথারমিয়ায় মারা গেছে, এ অবিশ্বাস্য। এক স্বর্ণকেশী বৃদ্ধাকে তার খোলা হাতের তালুতে লাল একটা গোলাপ।
বোঝাই যাচ্ছে প্লেন বরফ স্পর্শ করার আগেই মারা গেছে সবাই, বললেন ডাক্তার গেইল।
সার সার সিটের ওপর আবার চোখ বুলালো পিট। কিন্তু কেন?
বিষাক্ত গ্যাস মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?
না।
আমিও না।
আর কী হতে পারে?
খাদ্যে বিষ?
ঝাড়া তিন সেকেন্ড পিটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ডাক্তার গেইল। নিঃশ্বাস ফেলছে এমন কাউকে দেখতে পেয়েছ তুমি? কোথায়?
দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার আগে, বলল পিট, জানালা দিয়ে এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়েছিয়েন। কোনো সন্দেহ নেই তাকে আমি জীবিত দেখছি। কিন্তু এখন কেন যে দেখছি না…।