নিজেদের পরিচয় দিল লিলি, প্লেনের শব্দ শোনার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব বলল। সবশেষে একটা হাত তুলে উল্টে পড়া স্লেডটা দেখল পিটকে
হেলিকপ্টারের আলোয় দুর্ঘটনার ছবিটা চট করে দেখে নিল পিট। এই প্রথম নজরে পড়ল, দশ মিটার দূরে আরেকজন পড়ে রয়েছে। প্লেনের বিচ্ছিন্ন ডানাটাও দেখতে পেল। এক মিনিট।
হেঁটে এসে ড. গ্রোনকুইস্টের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল পিট। বিশালদেহী আর্কিওলজিস্ট নিয়মিত নিঃশ্বাস ফেলছেন। ব্যস্ত হাতে তাকে পরীক্ষা করল ও। তীক্ষ্ণ চোখে ওকে লক্ষ করছে লিলি, জিজ্ঞেস করল, উনি কি মারা গেছেন?
আরে না! মাথায় চোট পেয়েছেন, তা-ও সামান্য।
উইনফিল্ডের পিছু পিছু খোঁড়াতে খোঁড়াতে এল হকিন্স, ঠিক যেন একজোড়া তুষারদানব। নিঃশ্বাস বরফ হয়ে যাওয়ায় দু’জনের ফেস মাস্কই ঝাপসা হয়ে গেছে। নিজের মাস্কটা তুলল হসকিন্স, রক্তাক্ত মুখ নিয়ে তাকাল পিটের দিকে, আড়ষ্টভঙ্গিতে হাসল সে। স্বাগতম, আগন্তুক। এক্কেবারে যথাসময়ে পৌঁছেছেন।
আপনারা…?
ওদের কথাই বলছিলাম, লিলি জানাল। আমরা একই দলে। ওরা সামনে ছিল, তাই আমরা যে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি ওরা জানে না…
তোমরাও জানো না যে আমরাও একই দুর্ভাগ্যের শিকার, হেসে উঠে বলল মাইক।
আপনারা প্লেনটা দেখেছেন? হসকিন্সকে জিজ্ঞেস করল পিট।
নামতে দেখেছি, তবে কাছে যাবার সুযোগ হয়নি। ড. গ্রোনকুইস্টের দিকে এগোল হকিন্স, তার পিছু নিল মাইক। কী রকম চোট পেয়েছেন উনি? সিরিয়াস? লিলির দিকে তাকাল সে। তুমি?
জবাব দিল পিট, এক্স-রে করার পর নিশ্চিতভাবে জানা যাবে।
ওদের সাহায্য দরকার। আশা করি…
হেলিকপ্টারে মেডিকেল দল আছে, কিন্তু…
পিটকে থামিয়ে দিয়ে প্রায় ধমকের সুরে চিৎকার করে হসকিন্স বলল, তাহলে ছাই আপনি অপেক্ষা করছেন কী মনে করে? ডাকুন ওদের! পিটকে পাশ কাটিয়ে নিজেই হেলিকপ্টারের দিকে এগোল সে, কিন্তু লোহার মতো শক্ত একটা মুঠো তার কব্জি চেপে ধরল।
আপনার বন্ধুদের অপেক্ষা করতে হবে, দৃঢ়কণ্ঠে বলল পিট। প্লেনটা খাড়িতে ডুবে গেছে বলে সন্দেহ করছি আমরা। কেউ যদি বেঁচে থাকে, সবার আগে তার চিকিৎসা দরকার। আপনাদের ক্যাম্প এখান থেকে কত দূরে?
দক্ষিণ দিকে এক কিলোমিটার, অভিযোগের সুরে জবাব দিল হকিন্স।
স্নোমোবাইল এখনও চালানো যাবে। সঙ্গীকে সাথে নিয়ে স্লেডটা উদ্ধার করুন। আহতদের নিয়ে ফিরে যান ক্যাম্পে। সাবধানে যাবেন, কারণ ওদের শরীরের ভেতর কোথাও চোট লেগে থাকতে পারে। নিশ্চয়ই রেডিও আছে?
গম্ভীর হসকিন্স মাথা ঝাঁকাল।
থারটি-টু ফ্রিকোয়েন্সিতে কান রেখে তৈরি থাকবেন, বলল পিট। প্লেনটা যদি প্যাসেঞ্জার ভরা কমার্শিয়াল জেটলাইনার হয়, নরক সাফ করার দায়িত্ব চাপবে আমাদের ঘাড়ে।
আমরা তৈরি থাকব, পিটকে আশ্বাস দিল মাইক।
হেঁটে লিলির কাছে চলে এল পিট। মেয়েটার একটা হাত ধরে মৃদু চাপ দিল ও, বলল, দেখো, ডিনারের কথা আবার ভুলে যেয়ো না! পারকা হুড মাথায় পড়ে ঝট করে ঘুরল ও, দীর্ঘ পদক্ষেপে ফিরে চলল হেলিকপ্টারের দিকে।
.
জ্ঞান ফেরার পর ভাঙা পায়ের ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠল রুবিন। শীতল বরফের প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করল সে, তাকে পেছন দিকে ঠেলছে। চোখ মেলে চারদিকে অন্ধকার দেখল সে, তবে অন্ধকারটা ধীরে ধীরে সয়ে এল। ভাঙা উইন্ডশিল্ড দিয়ে তুষার আর বরফের ধস ঢুকছে ভেতরে, ধীরে ধীরে তার নিচে চাপ পড়ে যাচ্ছে সে। একটা পা ভেঙেছে, তুষারের নিচে কিসের সাথে যেন আটকে আছে সেটা। তার মনে 1 হলো, পা-টা পানিতে ডুবে আছে। পানি নয়, ভাবল সে, তার নিজের রক্ত।
আসলে পানি। বরফের আবরণ ভেদ করে খড়ির পানিতে তিন মিটার ডুবে গেছে প্লেনটা, কেবিনের মেঝেতে থই থই করছে পানি, অনেকগুলো সিটও ডুবে গেছে।
ইয়াবারার কথা মনে পড়ল চিফ স্টুয়ার্ডের। অন্ধকারের ভেতর ডান দিকে ঘাড় ফেরাল সে। প্লেনের বো, স্টারবোর্ডা সাইডে, ভেঙেচুরে ভেতর দিকে দেবে গেছে প্রায় ইঞ্জিনিয়ারের প্যানেল পর্যন্ত। বিধ্বস্ত টেলিস্কোপ আর তুষারের ভেতর থেকে ইয়াবারার শুধু একটা মোচড়ানো হাত বেরিয়ে থাকতে দেখল সে।
অসুস্থ বোধ করায় চোখ ফিরিয়ে নিল। বিপদের সময় তার পাশে ছিল লোকটা, তার মৃত্যু বড় একটা আঘাত হয়ে বাজল বুকে। উপলব্ধি করল, কেউ যদি উদ্ধার না করে, ঠাণ্ডায় জমে সেও মারা যাবে খানিক পর।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল রুবিন।
তোবড়ানো প্লেনটার মাথার ওপর চলে এল ওদের হেলিকপ্টার। একটা ডানা নেই, অপরটা মোচড় খেয়ে ফিউজিলাজের সাথে সেঁটে আছে। লেজের দিকটাও এমনভাবে তুবড়েছে যে চেনা যায় না। অবশিষ্ট অংশটাকে দেখে মনে হলো সাদা চাদরের ওপর স্থির হয়ে আছে পেটমোটা একটা ছারপোকা। ফিউজিলাজ বরফ ভেঙে পানিতে ডুবে রয়েছে, বলল পিট। আমি বলব, এক-তৃতীয়াংশ।
আগুন ধরেনি, পিটের পাশ থেকে বলল অ্যাল জিওর্দিনো। প্লেনের ওপর পড়া, হেলিকপ্টারের উজ্জ্বল আলোর প্রতিফলনে চোখ ধাধিয়ে গেল তার। নেহাতই ভাগ্য। গা কেমন চকচক করছে দেখছ? যত্নের ছাপ। আমি বলব, ওটা একটা বোয়িং সাতশো বি। প্রাণের কোনো লক্ষণ, পিট?
দেখছি না, বলল পিট। ভালো ঠেকছে না, অ্যাল।
আইডেনটিফিকেশন মার্কিং?
খোলের গয়ে তিনটে ফিতের মতো মোটা রেখা; হালকা নীল আর নীলচে বেগুনির মাঝখানে উজ্জ্বল সোনালি।