পেছনের দুর্ঘটনা সম্পর্কে সাথে সাথে কিছু টের পায়নি মাইক আর হসকিন্স। পেছনে ওদেরকে কতদূর ফেলে এসেছে জানার কৌতূহল নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাল মাইক। বহু পেছনে ওদের আলো নিচের দিকে মুখ করে স্থির হয়ে রয়েছে দেখে তাজ্জব বনে গেল সে। হসকিন্সের কাঁধে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল ওরা বোধহয় বিপদে পড়েছে!
প্ল্যানটা ছিল, প্লেনের চাকার দাগ ধরে অকুস্থলে পৌঁছবে ওরা। সেই দাগ খোঁজার কাজে ব্যস্ত ছিল হসকিন্স। তাই নাকি! বলেই বিরাট একটা বৃত্ত রচনা করে স্লোমোবাইল ঘোরাতে শুরু করল সে। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার ফলে চোখ ব্যথা করছে, তার, ফলে ভালো করে দেখতে পায়নি সামনেটা। প্লেনের চাকার রেখে যাওয়া গভীর গর্তটা যখন দেখতে পেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুমিটার ফাঁকাটার কিনারা থেকে শূন্যে উঠে গেল ওদের বাহন। দু’জন আরোহীর ভার থাকায় বাহনের নাকটা নুয়ে পড়ল নিচের দিকে, সংঘর্ষ ঘটল গর্তের অপর প্রান্তের দেয়ালের সাথে, শব্দ শুনে মনে হলো পিস্তলের গুলি ছোঁড়া হয়েছে। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, গর্তের কিনারা টপকে বরফের ওপর আছাড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল দু’জনেই, যেন অযত্নে ফেলে রাখা কাপড়ের তৈরি একজোড়া পুতুল।
ত্রিশ সেকেন্ড পর অশীতিপর বৃদ্ধের মতো নড়ে উঠল হকিন্স। হাঁটু আর কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো সে। তারপর বসল, কিন্তু আচ্ছন্ন ভাবটা কাটল না। এখনও বুঝতে পারছে না এখানে কীভাবে এল সে। হিস হিস শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাল।
পিঠ বাঁকা করে বসে রয়েছে মাইক, দুহাতে পেট চেপে ধরে গোঙাচ্ছে।
প্রথম দস্তানাটা খুলে নাকে আঙুল বুলালো হসকিন্স। না, ভাঙেনি। তবে ফুটো দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, ফলে মুখ দিয়ে বাতাস টানতে হচ্ছে ওকে। অন্য কোনো হাড়ও ভাঙেনি, কারণ মোটা গরম কাপড়ে মোড়া ছিল শরীরটা। হামাগুড়ি দিয়ে উইনফিল্ডের কাছে চলে এল সে। কী ঘটেছে? প্রশ্ন করেই বুঝল বোকামি হয়ে গেল।
প্লেনের চাকা বরফের গায়ে একটা গর্ত রেখে গেছে…
লিলি আর ড. গ্লোনকুইস্ট…?
দুশো মিটার পেছনে রয়েছে ওরা, বলল মাইক। গর্তটাকে ঘুরে যেতে হবে আমাদের, ওদের বোধহয় সাহায্য দরকার।
ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে কোনোরকমে দাঁড়াল হসকিন্স। এক পা এক পা করে গর্তের কিনারায় এসে থামল সে। অদ্ভুত কাণ্ড, সোমোবাইলের হেডল্যাম্প এখনও জ্বলছে। ল্যাম্পের ম্লান আলোয় গর্তের ভেতর তলাটা দেখতে পাওয়া গেল। খাঁড়ির পানিতে অসংখ্য বুদ্বুদ, লাফ দিয়ে উঠে আসছে বরফের মেঝে ছাড়িয়ে ছফুট ওপরে। তার পাশে এসে দাঁড়াল মাইক। একযোগে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।
মানবতার সেবক! ঝঝের সাথে বলল হসকিন্স। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ব্যাকুল। যার যা কাজ তাই তার করা উচিত, বুঝলে! আমরা আর্কিওলজি বুঝি, তাই নিয়ে থাকা উচিত ছিল!
চুপ! হঠাৎ তাগাদা দিল মাইক। শুনতে পাচ্ছ? একটা হেলিকপ্টার! ফিয়র্ডের দিক থেকে এদিকেই আসছে।
একটা ঘোর আর বাস্তবতার মাঝখানে ভাসছে লিলি।
সে বুঝতে পারছে না, সহজ-সরলভাবে চিন্তা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে কেন। মাথা তুলে ড. গ্রোনকুইস্টের খোঁজ করল সে। কয়েক মিটার দূরে অনড় পড়ে রয়েছেন তিনি। চিৎকার করে ডাকল লিলি, কিন্তু তিনি নড়লেন না, যেন মারা গেছেন। হাল ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে, একটা পা সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলার সাথে সাথে তার ইচ্ছে হলো ঘুমিয়ে পড়ে।
লিলি জানে, মাইক আর হসকিন্স যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসবে। কিন্তু সময় ধীরগতিতে বয়ে চলল। কারও দেখা নেই। ঠাণ্ডায় কাঁপছে সে। ভীষণ ভয় লাগছে। তারপর তন্দ্রা মতে এল। এই সময় শব্দটা শুনতে পেল সে। হঠাৎ করে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল কালো আকাশ। ঝুরঝুরে তুষার উড়ল তার চারপাশে। যান্ত্রিক শব্দটা থেমে গেল একসময়। আলো ঘেরা অস্পষ্ট একটা মূর্তি এগিয়ে এল তার দিকে।
মূর্তিটা ধীরে ধীরে ভারী পারকায় মোড়া একটা মানুষের আকৃতি নিল। মানুষটা প্রথমে তাকে ঘিরে ঘুরল একবার, যেন পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করল। তারপর একটানে তার পায়ের ওপর থেকে তুলে ফেলল স্নোমোবাইলটা। আবার তার চারদিকে ঘুরল মানুষটা, এবার তার মুখে আলো পড়ায় চেহারাটা পরিষ্কার দেখতে পেল লিলি। এই বিপদেও বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠল তার, এমন ঝকঝকে সবুজ চোখ জীবনে দেখেনি সে। কাঠিন্য, কোমলতা, আন্তরিক উদ্বেগ সব যেন খোলা বইয়ের মতো পড়া গেল মুখটায়। সে একটা মেয়ে দেখে আগন্তুকের চোখ একটু সরু হলো। লিলি ভাবল, এই লোক এল কোত্থেকে?
কী বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল সে, তোমাকে দেখে কী যে খুশি লাগছে আমার!
আমার নাম ডার্ক পিট, হাসিখুশি কষ্ঠ থেকে জবাব এল। খুব যদি ব্যস্ততা না থাকে, কাল রাতে আমার সাথে ডিনার খেতে আপত্তি আছে?
.
০৯.
পিটের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল লিলি, সন্দেহ হলো শুনতে ভুল করেছে। কোথাও যাবার অবস্থা আমার বোধ হয় নেই।
পারকার হুড মাথার পেছনে সরিয়ে দিয়ে লিলির পাশে হাঁটু গেড়ে বসল পিট, তার গোড়ালিতে হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখল। হাড় ভাঙেনি, কোথাও ফুলেও নেই, সহাস্যে বলল ও। ব্যথা?
ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গেছি, ব্যথা লাগলেও টের পাব না।
স্লেড থেকে ছিটকে পড়া একটা কম্বল তুলে নিয়ে লিলিকে ঢাকল পিট। তুমি প্লেনের প্যাসেঞ্জার নও। এখানে এলে কীভাবে?