তারপর সংঘর্ষ ঘটল।
চোখ বুজে হাত দিয়ে নিজেদের মুখ ঢাকল ওরা। চাকা বরফ স্পর্শ করল, পিছলে গেল, গভীর জোড়া দাগ তৈরি হলো বরফের গায়ে। পোর্ট সাইডের ইনবোর্ড ইঞ্জিন দুমড়েমুচড়ে মাউন্টি থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল, ছিটকে পড়ে ডিগবাজি খেল বরফের ওপর। স্টারবোর্ডের দুটো ইঞ্জিনই গেঁথে গেল বরফের ভেতর, মোচড় খেয়ে বিচ্ছিন্ন হলো ডানাটা। পরমুহূর্তে সমস্ত পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল, নেমে এল ঘোর অন্ধকার।
বরফ ঢাকা খাড়ির ওপর দিয়ে ধূমকেতুর মতো ছুটে চলেছে প্লেনটা, পেছনে ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তপ্ত ধাতব টুকরো। প্যাক আইস পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের সময় একটা প্রেশার রিজ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিল বোয়িং। নাকের গিয়ার চ্যাপ্টা হয়ে ঢুকে গেল সামনের পেটের ভেতর, ছিঁড়ে ফেলল হেল হোল-এর আবরণ। নিচু হলো বো, বরফ খুঁড়তে খুঁড়তে এগোল, প্রতি মুহূর্তে ভেতর দিকে তুবড়ে মোটা অ্যালুমিনিয়াম শিট ককপিটে ঢুকে যাচ্ছে। অবশেষে নিজস্ব গতিবেগ হারিয়ে বিকলাঙ্গ বোয়িং স্থির হলো। বরফ ঢাকা তীর মাত্র ত্রিশ মিটার দূরে, ওখানে বড় আকারের পাথরের স্তূপ।
কয়েক মুহূর্ত মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা অটুট থাকল। তারপর বরফ ফাটার জোরাল শব্দের সাথে শোনা গেল ধাতব গোঙানি। ধীরে ধীরে বরফের আবরণ ভেঙে খড়ির পানিতে নেমে যায় বোয়িংটা।
.
০৮.
খাড়ির দিকে প্লেনটার উড়ে যাওয়ার শব্দ আর্কিওলজিস্টরাও শুনতে পেল। আশ্রয় থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে প্লেনটার ল্যান্ডিং লাইট দেখতে পেল তারা। আলোকিত কেবিনের জানালাগুলো ধরা পড়ল তাদের চোখে। তার পরই কানে এল পতনের শব্দ, সেই সাথে পায়ের তলায় অবিচ্ছিন্ন বরফের মেঝে কেঁপে উঠল। খানিক পর আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারদিকে গাঢ় হয়ে নামল অন্ধকার। বাতাসের গোঙানি ছাড়া কিছু শোনা গেল না।
গুড লর্ড! অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন, ড. গ্রোনকুইস্ট, খাড়িতে বিধ্বস্ত হয়েছে ওটা।
ভয়াবহ! লিলির গলায় অবিশ্বাস আর বিস্ময়। একজনও বাঁচবে না!
বোধহয় পানিতে ডুবে গেছে, সেজন্যই কোনো আগুন দেখা গেল না, মন্তব্য করল গ্রাহাম।
হকিন্স জিজ্ঞেস করল, কী ধরনের প্লেন, কেউ দেখেছ?
মাথা নাড়ল গ্রাহাম। চোখের পলকে বেরিয়ে গেল। তবে বেশ বড়সড়। সম্ভবত একাধিক ইঞ্জিন। বরফ জরিপের জন্য এসে থাকতে পারে।
দূরত্ব আন্দাজ করে দেখি, আহ্বান জানালেন ড. গ্রোনকুইস্ট।
স্নান চেহারা নিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লিলি। কথা বলে সময় নষ্ট করছি। আমরা। ওদের সাহায্যে দরকার।
ঠিক, সায় দিলেন ড. গ্রোনকুইস্ট। এসো, আগে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচি।
আশ্রয়ে ফিরে এসে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল ওরা, সেই সাথে প্ল্যানটাও তৈরি করল। লিলি বলল, কম্বল লাগবে, অতিরিক্ত সবগুলো গরম কাপড় সাথে নাও। আমি মেডিকেল সাপ্লাই নিচ্ছি।
মাইক গ্রাহাম, ড. গ্রোনকুইস্ট নির্দেশ দিলেন, রেডিওতে ডেনবর্গ স্টেশনকে জানাও। থিউল-এর এয়ারফোর্স রেসকিউ ইউনিটকে খবর পাঠাবে ওরা।
বরফ খুঁড়ে আরোহীদের বের করতে হতে পারে, সাথে কিছু টুলস থাকা দরকার, প্রস্তাব দিল হকিন্স।
নিজের পারকা আর গ্লাভস চেক করে নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন ড. গ্রোনকুইস্ট। আর কি দরকার হতে পারে ভেবে দেখো। একাটা সোমোবাইলের সাথে স্লেড বেঁধে নিচ্ছি আমি।
ঘুম ভাঙার পর পাঁচ মিনিটও পেরোয়নি, বিবেকের আহ্বান সাড়া দিয়ে গভীর অন্ধকার রাতে হিম বরফের রাজ্যে বেরিয়ে পড়ল দলটা। একটা শেডের ভেতর রয়েছে স্নোমোবাইলগুলো, শেডের ভেতর তাপমাত্রা বাইরের চেয়ে বিশ ডিগ্রি বেশি রাখা হয়েছে হিটার জ্বেলে, তার পরও প্রথম স্নোমোবাইলটা পাঁচবারের চেষ্টায় স্টার্ট নিল, দ্বিতীয়টা নিল বত্রিশ বারের মাথায়। ইতোমধ্যে জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্যান্যরা। ড. গ্রোনকুইস ছাড়া সবার পরনে পা পর্যন্ত লম্বা জাম্পস্যুট। সবাইকে একটা করে হেভি-ডিউটি ফ্ল্যাশ লাইট দিলেন তিনি। রওনা হয়ে গেল দলটা। লিলির কোমর ধরে স্নোমোবাইলে তুলে নিলেন ভদ্রলোক। দ্বিতীয়টায় উঠল মাইক গ্রাহাম আর জোসেফ হসকিন্স।
খাড়ির ওপর বরফের আবরণ এবড়োখেবড়ো, ঝাঁকি খেতে খেতে এগোল স্নোমোবাইল, প্রতি মুহূর্তে বিপদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকল আরোহীরা। বরফের পাতলা আবরণ ভেঙে যেতে পারে। প্রেশার রিজগুলো আগে থেকে চেনা কঠিন, ঢাল বেয়ে ওঠার পর টের পাওয়া যায়। ড. গ্রোনকুইস্টের বিশালবপু এক হাতে বেড় দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে লিলি শার্প, চোখ বন্ধ, মুখ গুঁজে দিয়েছে দলনেতার কাঁধে। মাঝেমধ্যে মুখ তুলে গতি কমাবার জন্য চিৎকার করছে সে, কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে ফুলম্পিডে স্লোমোবাইল চালাচ্ছেন ড. গ্রোনকুইস্ট। ঘাড় ফিরিয়ে একবার পেছন দিকে তাকাল লিলি। পিছু পিছু আসছে ওরা।
দ্বিতীয় স্নোমোবাইল স্লেড টানছে না, কাজেই প্রথমটাকে পাশ কাটিয়ে গেল অনায়াসে, দেখতে দেখতে বরফের রাজ্যে হারিয়ে গেল মাইক আর হসকিন্স।
বেশ খানিক পর স্নোমোবাইলের আলোর শেষ প্রান্তে বড়সড় একটা ধাতব আকৃতি মাথাচাড়া দিচ্ছে দেখে পেশিতে টান পড়ল ড. গ্রোনকুইস্টের। হঠাৎ করে হ্যান্ডগ্রিপটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে আটকে দিলেন তিনি। সামনের স্কি-গুলোর কিনারা বরফের ভেতর গেঁথে গেল, প্লেনের একটা বিচ্ছিন্ন ডানা এক মিটার দূরে থাকতে আরেক দিকে ঘুরে গেল স্নোমোবাইল। বাহনটাকে সিধে করার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু একবার কাত হতে শুরু করায় স্লেডটাকে আর সিধে করা গেল না, জিনিসপত্র নিয়ে উল্টে পড়ল সেটা, হ্যাঁচকা টান খেয়ে আরও কাত হয়ে গেল স্লেমোবাইলেও। তারপর কী ঘটল দু’জনের কেউই বলতে পারবে না। কামানের গোলার মতো ছিটকে পড়লেন ড. গ্রোনকুইস্ট, তার আর্তনাদ শুনতে পেল লিলি। অন্ধকার শূন্যে সেও ছিটকে পড়েছে, কিন্তু কোথায় কোনো ধারণা নেই। স্লেডটা ধেয়ে এল তার দিকে, কয়েক ইঞ্চির জন্য ধাক্কা দিল না। কয়েক মিটার দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল সেটা। স্নোমোবাইল ওল্টাতে গিয়েও ওল্টায়নি, ছুটে এসে লিলির পাশে থামল সেটা, এখনও কাত হয়ে রয়েছে। তারপর সেটা পড়ল। সরাসরি লিলির একটা পায়ের ওপর। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে।