তুমি একটা নেভি শিপে রয়েছে, পিট, অহেতুক কর্কশ স্বরে বললেন বায়রন নাইট। আমরা কোস্ট গার্ড নই। তুমি জানো, এখানে এই মুহূর্তে আমরা একটা দায়িত্ব পালন করছি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মৃতুকণ্ঠে, অনেকটা যেন জনান্তিকে বলল পিট, প্লেনটায় বাচ্চা আর মহিলাও থাকতে পারে।
দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা কে বলবে? এখনও প্লেনটা আকাশে রয়েছে। উদ্ধার করে বলে কোনো সাহায্যও তারা চাইছে না। তুমি তো একজন পাইলট, তুমিই বলো, বিপদেই যদি পড়ে থাকে, পোলার এক্সপ্লোরারকে ঘিরে চক্কর দেয়নি কেন ওরা?
মাফ করবেন, ক্যাপটেন, ডিউটি অফিসার বলল, বলতে ভুলে গেছি, ল্যান্ডিং ফ্ল্যাপস নামানো ছিল।
তাতেও প্রমাণ হয় না যে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, জেদের সুরে বললেন বায়রন নাইট।
রাখেন আপনার যুক্তি-তর্ক, ফুল স্টিম অ্যাহেড! ঠাণ্ডা স্বরে বলে পিট। এখন যুদ্ধ চলছে না। মানবতার খাতিরে আমরা না গিয়ে পিরবো না। সময়মত তৎপর হইনি বলে যদি একশো মানুষ মারা পড়ে, কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি। ফুয়েল খরচ যতো হয়, হোক।
খালি চার্ট রুমের দিকে ইঙ্গিত করলেন ক্যাপটেন, পিট আর জিওর্দিনো ঢোকার পর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমাদের নিজেদের একটা মিশন আছে, শান্তস্বরে নিজের মতামত জানালেন তিনি। অনুসন্ধান বন্ধ রাখা এক কথা, আর স্পট ছেড়ে চলে যাওয়া সম্পূর্ণ অন্য কথা-রাশিয়ানরা সন্দেহ করবে তাদের সাবমেরিন আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমরা চলে যাবার সাথে সাথে এলাকাটা চষে ফেলবে ওরা।
আপনার কথায় যুক্তি আছে, বলল পিট। সেক্ষেত্রে আমাদের দু’জনকে আপনি ছেড়ে দেন।
বলল, আমি শুনছি।
আফটার ডেক থেকে নুমার একটা কপ্টার নিয়ে আমি আর জিওর্দিনো রওনা হয়ে যাই, সাথে একটা মেডিকেল দল আর দু’জন ক্রু থাকুক। ঘুরে দেখে আসি প্লেনটা কোথায় পড়েছে। যদি সম্ভব হয় উদ্ধারকাজ চালানো হবে। পোলার এক্সপ্লোরার তার অনুসন্ধান চালু রাখুক।
আর রাশিয়ান সার্ভেইল্যান্স? তারা কী ভাববে?
প্রথমে ওরা মনে করবে কোনো কোইনসিডেন্স। ইতিমধ্যে নির্ঘাত ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে ওরাও। কিন্তু ঈশ্বর না করুন, ওটা যদি সত্যি বাণিজ্যিক এয়ারলাইনার হয়, সেক্ষেত্রে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে যেতে হবে আপনাকে। উদ্ধার শেষে আবার নিজের কাজে ফিরে যাবে পোলার এক্সপ্লোরার।
তোমাদের হেলিকপ্টারের গতিপথ ওরা পর্যবেক্ষণ করবে, জানো তো।
আমি আর অ্যাল খোলা চ্যানেলে আমাদের কথাবার্তা চালাব, এতে করে ওরা বুঝবে আমরা আসলেই উদ্ধারকাজে চলেছি।
এক মুহূর্ত শূন্য চোখে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করলেন বায়রন নাইট। এরপর মুখ খুললেন, তাহলে দেরি করছো কেন? ভ্রু কুঁচকালেন কমান্ডার। জলদি কপ্টারে গিয়ে ওঠো তোমরা, বাকি সবাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
পোলার এক্সপ্লোরারকে ঘিরে চক্কর না দেওয়ার পেছনে রুবিনের বেশ কয়টি কারণ আছে। প্রথমত, দ্রুত উচ্চতা হারাচ্ছিল বিমান, আর দ্বিতীয়ত, তার নিজের পাইলট জ্ঞান অত্যন্ত স্বল্প। নিমিষে বরফের রাজ্যে প্লেন ক্রাশ করে সব শেষ করে দেওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার।
জাহাজের আলো যেন আশার আলো জ্বাললো মনে। এখন অন্তত একটা উদ্ধারকারী দল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
অকস্মাৎ দেখা গেল কালো সাগর নয়, ওদের নিচে জমাট বাঁধা নিরেট বরফ। তারার আলোয় কাছ থেকে নীলচে চকচকে দেখল আদিগন্ত বরফের রাজ্য। সংঘর্ষ, স্পর্শ বা পতন, যাই বলা হোক, আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। এই সময় হঠাৎ রুবিনের মনে পড়ল ইয়াবারাকে ল্যান্ডিং আলো জ্বালার কথা বলা দরকার।
আলো জ্বলে ওঠার সাথে সাথে হতচকিত একটা মেরু ভালুককে দেখতে পেল ওরা। এক পলকে প্লেনের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। যিশুর মায়ের দিব্যি, বিড়বিড় করে উঠল ইয়াবারা, ডান দিকে পাহাড় দেখতে পাচ্ছি আমি। সাগর পেরিয়ে জমির ওপর চলে এসেছি আমরা।
অবশেষে ভাগ্যের দাঁড়িপাল্লা রুবিন আর আরোহীদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পাহাড় একটা নয়, এক সারিতে পাশাপাশি অনেকগুলো, গ্রিনল্যান্ডের উপকূল বরাবর দুদিকে একশো মাইল পর্যন্ত ওগুলোর বিস্তৃতি। তবে সেদিকে প্লেনের নাক ঘোরাতে ব্যর্থ হলো রুবিন, নিজের অজান্তে আরডেনক্যাপল ফিরড-এর মাঝখানে নামিয়ে আনছে নিজেদের। লোয়ার দ্য ল্যান্ডিং গিয়ার! নির্দেশ দিল সে।
নিঃশব্দে নির্দেশ পালন করল ইয়াবারা। সাধারণ ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের সময় এই পদ্ধতি সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে, তবে অজ্ঞতাবশত হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে রুবিন। বরফে ল্যান্ড করার সময় দক্ষ একজন পাইলটও এই সিদ্ধান্ত নিত। ল্যান্ডিং গিয়ার নামানোর ফলে দ্রুত নিচে নামছে প্লেন। রুবিন বা ইয়াবারা, কারও কিছু করার নেই আর। দু’জনের কেউই জানে না যে নিচের বরফ মাত্র এক মিটার পুরু, একটা বোয়িং সাতশো বি-র ভার সহ্য করার জন্য যথেষ্ট নয়।
ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেলের প্রায় সব আলো লাল সঙ্কেত দিচ্ছে। ওদের মনে হলো কালো একটা পর্দা ছিঁড়ে সাদা পাতালে প্রবেশ করল প্লেন। কন্ট্রোল কলাম ধরে টানল। বোয়িংয়ের গতি কমে গেল, সেই সাথে শেষবারের মতো উঁচু হলো নাকটা-আবার আকাশের উঠতে চাওয়ার দুর্বল প্রচেষ্টা।
আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে ইয়াবারা। তার মাথা ঠিকমত কাজ করছে না। থ্রটল টেনে কাছে আনার কথা মনে থাকল না, মনে থাকল না ফুয়েল সাপ্লাই বন্ধ করা দরকার, অফ করা দরকার ইলেকট্রিক সুইচগুলো।